আমি খুব সংক্ষেপে কিন্তু স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব তাবরেজির সঙ্গে কেন আমি দ্বিমত পোষণ করি এবং আমার বক্তব্যের ভিত্তি কী।
সালাউদ্দীন তাবরেজি তার ১৫ পৃষ্ঠার নিবন্ধে এটা দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে মইদুল ইসলামের পূর্বেকার সকল সাহিত্যকর্মের পাশে তাঁর শেষ তিনটি উপন্যাসকে (গিরগিটি, বেহুলার বাসর এবং তারাশঙ্করের ডায়েরি) যতই সাজুয্যহীন বা বিসদৃশ দেখাক না কেন, বা তাঁর কট্টর ভক্তদের মধ্যে এগুলো যত হতাশা আর নেতিবাচক আলোড়নই তুলুকু না কেন, এ তিন উপন্যাস তার সাহিত্যিক বাঁক পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করছে। এবং এই বাঁক পরিবর্তনের ধারা আসলে আরও আগে থেকে শুরু হয়েছিল, বিশেষ করে তার অষ্টম উপন্যাস লুকের ছায়া থেকে আমরা এর ইঙ্গিত পেতে শুরু করি। আর এই ‘সিন্দাবাদীয় অভিযান’ পরিণতি পেয়েছে শেষ তিন উপন্যাসে এসে।
আমি বলব, এটি তাবরেজি মহাশয়ের কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। সাহিত্য আলোচনার একটি সুবিধাজনক দিক হলো, যেকোনো পূর্বানুমানের পক্ষে ভূরি ভূরি তথ্যপ্রমাণ সর্বদা হাতের কাছে হাজির পাওয়া যায়।
এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মইদুল ইসলামের শেষ তিনটি উপন্যাস নিয়ে এত আলোচনার অবকাশ তৈরি হয়েছে মূলত দুটি কারণে; প্রথমত, ওই তিন উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কট্টর (আমি বলব ‘জেহাদি) ভক্তরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, একটি অংশ খুব আহত বোধ করেছে এবং তারা এটিকে তাদের প্রিয় লেখকের এত দিনকার র্যাডিক্যাল অবস্থানের প্রস্থানবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করেছে, দ্বিতীয় শ্রেণির ভক্তরা তাঁর লেখার এ আকস্মিক ও প্রবল বাঁক পরিবর্তনকে গ্রহণ করেছে হেনরি জেমস কথিত ‘লিটারারি ইনএভিটাবিলিটি হিসেবে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, ওই তিন উপন্যাস বিপুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে, যা মইদুল ইসলামের মতো একজন কাল্ট লেখকের ক্ষেত্রে কেবল বিম্ময়করই নয়, অস্বাভাবিকও বটে। আমি শুনেছি, তার গিরগিটি উপন্যাসটি প্রথম বছরেই সাতটি এডিশন প্রকাশিত হয়েছিল।
মইদুল ইসলামের লেখনশৈলীর এই ‘জন আপডাইকিয়ান। উল্লম্ফন এবং তাঁর পাঠকপ্রিয়তা অর্জনের ঘটনাটি একই সঙ্গে ঘটেছিল। কাজেই এটা সহজে অনুমেয় যে লেখার ভঙ্গিমা বদলানোর কারণেই তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এটাই অনিবার্য সিদ্ধান্ত। কিন্তু এটাও ভুললে চলবে না যে এই জনপ্রিয়তা অর্জনের বিষয়টি তার পুরোনো কট্টর ভক্তদের কারও কারও অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং তারা তখন থেকেই ঘটনাটির নানা রকম ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর প্রয়াস চালিয়ে আসছেন। বলা বাহুল্য নয়, সালাউদ্দীন তাবরেজির সমালোচনা সেই প্রয়াসের একটি দৃষ্টান্তমাত্র। মইদুল ইসলামের জীবনের শেষ তিনটি উপন্যাসকে “হংস মাঝে বক” হিসেবে না দেখে লেখকের সুচিন্তিত এবং দীর্ঘমেয়াদী খোলস পরিবর্তন হিসেবে দেখা (যে কারণে নিবন্ধের শিরোনাম ‘শুয়োপোকার খোলসত্যাগ) এবং এই তিন উপন্যাসকে তার সাহিত্যিক পথপরিক্রমণের চূড়ান্ত পরিণতি প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বস্তিলাভ ঘটে।
আমি এই অবস্থান মেনে নিতে রাজি নই। ওই তিন উপন্যাস যত অস্বস্তিই তৈরি করুক না কেন, আমাদের এটা মানতে প্রস্তুত থাকতে হবে যে, মইদুল ইসলামের তাবৎ সাহিত্যকীর্তির সঙ্গে এগুলো সাযুজ্যহীন। এগুলো গ্রহণ করার জন্য তিনি তাঁর পাঠককুলকে মোটেও প্রস্তুত করেননি, তাঁর লেখনী এগুলোর কোনো পূর্বাভাস বহন করে না। এর কেবল একটিই ব্যাখ্যা হতে পারে, এবং যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ছলচাতুরির আড়াল সরিয়ে। আমি সেটা অকপটে জোর গলায় বলতে চাই : ওই তিন উপন্যাস মইদুল ইসলামের লেখা নয়!!!!
আমি জানি, আমার বক্তব্য অত্যন্ত কর্কশ শোনাবে, অনেকের কাছে এটা খুবই রুচিহীন মনে হবে, তবে এ কথা বলার মধ্য দিয়ে আমি বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উদ্ভাবন করার চেষ্টা করছি না। কোনো সাহিত্যিক কেলেঙ্কারির অনুপ্রবেশ ঘটানো আমার অভিপ্রায় নয়। আমি কেবল সেই কথাটিই স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করছি, যেটি গত এক দশক ধরে তার সীমিত অথচ নিষ্ঠ ভক্তদের মনে অবিরত গুঞ্জরিত হচ্ছে।
আমার বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে আমি মইদুল ইসলামের সাহিত্যকর্মকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে তুলনা টানব না। আমার স্বৰ্গত বন্ধু আবুল খায়ের সে কাজটি সুচারুভাবে করে গেছেন। আমি বরং মইদুল ইসলামের ব্যক্তিজীবনের কয়েকটি তথ্যের দিকে সবাইকে দৃষ্টি দিতে বলব। এই সব তথ্যের উৎস পরোক্ষ হলেও এগুলোর অথেনটিসিটির ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।
পশ্চিমের কাল্ট মুভির ধারণা ধার করে মইদুল ইসলামকে কাল্ট লেখক হিসেবে অভিহিত করেছেন মরমি কবি সুকুমার রায় (ছড়াকার সুকুমার রায় নন, ইনি বিক্রমপুর সরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক)। আমার ধারণা, তার এ অভিধা সীমিত আকারে হলেও গ্রহণ করা যায়। এটা ঠিক যে, মইদুল ইসলামের লেখার ভক্ত পাঠককুল সংখ্যায় খুব সীমিত ছিল, তবে এরা তাঁর প্রতি ছিল মোহমুগ্ধ, রিলিজিয়াস কাল্টের মতো তাঁর ভক্ত পাঠকেরা নিজেদের মধ্যে একপ্রকার যোগাযোগ রক্ষা করত, একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্ব বোধ করত এবং তার লেখা নিয়ে তারা নিয়মিত আনুষ্ঠানিক আড্ডার আসর বসাত। এ রকম দুয়েকটি আসরে যোগদানের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল এবং সেগুলোর একটিতে আমি তাঁকে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমের অবতার হিসেবে। অভিহিত হতে দেখেছি। পাঠককুলের কাছ থেকে এ রকম একনিষ্ঠ ভক্তিভজনা উপভোগের ক্ষেত্রে মইদুল ইসলামকে অনায়াসে কমলকুমার মজুমদারের সঙ্গে তুলনা করা চলে। তবে কমলকুমারের মতো তাঁর গদ্য দুর্বোধ্য, দুর্গম ছিল না। তিনি বরং কিছুটা লিরিক্যাল গদ্য লিখতেন। অপরাপর কাল্ট লেখকের মতো তিনি বিরলপ্রজও ছিলেন না। মইদুল ইসলাম নিয়মিত লিখতেন এবং দু কি তিনটি নির্দিষ্ট প্রকাশনা সংস্থা থেকে তাঁর বই একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হতো। লেখার রহস্যময়তার কারণে অনেকে তাকে কাফকার সঙ্গে তুলনা করতেন, তবে আমার মনে হয় লেখনভঙ্গি আর বিষয়বস্তুর দিক থেকে মার্কিন লেখক ডোনাল্ড বার্থলমের সঙ্গেই তার বেশি মিল পাওয়া যাবে। একাধিক সূত্রে আমি শুনেছি, আমেরিকান লেখকদের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল। তার লেখার টেবিলের একপাশের দেয়ালে ফিলিপ রথের একটি ছবি অ্যাডহেসিভ টেপ দিয়ে ঝোলানো পাওয়া গেছে বলে মির্জা একরামুল বাশারের বইয়ে উল্লেখ দেখেছি।