আমি রাজি হয়েছি, রাজি না হয়ে উপায় ছিল না বলে নয়। রাজি হয়েছি, কেননা আমার নিজের স্বার্থ আছে। আমার নিজের হাইপোথিসিসের সত্যাসত্য অনুসন্ধানে এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কী হতে পারে? এই হাইপোথিসিসকে পাগলামি মনে করা হয়েছে, ঠাট্টা করা হয়েছে, এর জন্যে আমাকে একাডেমিক নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।
আমি ড্রিম রুমে ঢুকছি। সকলের চোখে একটা বস্তুগত জগৎ থেকে আমি ঢুকছি বস্তুহীন, অস্থির, কাঁপাকাপা এক চৈতন্যলোকে। কিন্তু আমার হাইপোথিসিস, যার আনুষ্ঠানিক নাম বুলগাশেম প্যারাডক্স, তাতে পুরো ব্যাপারটা উল্টানো।
সেকেন্ড কমিউনিটি বলে আসলে কিছু নেই।
আমি কোনো স্বপ্নের ভেতরে ঢুকছি না।
আমি আসলে সাড়ে ১২ শ কোটি বছরের এক অতিকায় মহাজাগতিক স্বপ্নের ভেতর থেকে বেরোচ্ছি।
.
আমি ড্রিম রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। পেছন ফিরে দেখলাম, একটু দূরে রাঘবন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।
আমি তার দিকে এমনভাবে হাত নাড়লাম, যেন বিদায় নিচ্ছি, যেন একটা বোর্ডিং ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
আমার আচরণে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন রাঘবন।
১১. মইদুল ইসলামের শেষ তিন উপন্যাস
ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র নান্দনিক-এর বর্ষা সংখ্যায় শুয়োপোকার খোলসত্যাগ’ শিরোনামে সমালোচক সালাউদ্দীন তাবরেজির একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। দীর্ঘ, তথ্যবহুল এ নিবন্ধে সমালোচক আমাদের সময়কার রহস্যময় লেখক মইদুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন। সালাউদ্দীন তাবরেজির পাণ্ডিত্য প্রশ্নাতীত। তাঁর গদ্য সুখপাঠ্য, যুক্তি ধারালো এবং অন্তর্দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তার পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত না হওয়ার অবকাশ কম। তবে নিবন্ধের শেষ দিককার কয়েকটি সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাকে দ্বিমত পোষণ করতে হচ্ছে। আমি সেই জায়গাগুলো তুলে ধরে আমার অবস্থান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
মইদুল ইসলামের সাহিত্যকীর্তিকে তিনটি ধাপে ভাগ করেছেন। সমালোচক–প্রারম্ভিক পর্ব, মধ্য পর্ব (যেটিকে অনেকে তার নিরীক্ষাকাল হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন) এবং চূড়ান্ত পর্ব। মইদুল ইসলামের শেষ তিনটি উপন্যাসকে চূড়ান্ত পর্বের অন্তর্ভুক্ত করেছেন সমালোচক এবং এগুলোকে তার সামগ্রিক লেখক জীবনের কালমিনেশন বা চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
এটা অস্বীকার করার জো নেই যে এক দশক ধরে এ রকম বিশ্লেষণ একপ্রকার সাহিত্যিক রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। যেকোনো মনোযোগী পাঠক এটা লক্ষ না করে পারবেন না। এসব সমালোচনা আসলে একই বক্তব্যের চর্বিত চর্বন। একটি লেখা থেকে আরেকটি লেখা আলাদা করা যায় না এবং এগুলো লেখক মইদুল ইসলাম বা তার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আমাদের নতুন কোনো তথ্য দেয় না।
শেষ তিনটি উপন্যাস সম্পর্কে আমি কেবল যে সমালোচক সালাউদ্দীন তাবরেজি এবং সেই সূত্রে অপরাপর সমালোচক ও বোদ্ধা পাঠকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি, তা-ই নয়, আমি খুব দৃঢ়ভাবে মনে করি, তারা বিভ্রান্ত। আর এই বিভ্রান্তির উৎস লেখক মইদুল ইসলামের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা। এটা অবশ্য পুরোদস্তুর সমালোচকদের দোষ নয়। কেননা জীবদ্দশায় লেখক মইদুল ইসলাম একপ্রকার নির্জন, নিভৃতচারী এবং সর্বোপরি তথ্যপ্রতিবন্ধক জীবন যাপন করে গেছেন। নিভৃতচারী বললে অবশ্য সত্যের অপলাপ হবে। তিনি অসামাজিক ছিলেন, এ কথা বলার অবকাশ নেই। তিনি আসলে শুধু সাহিত্যিক-সুধীজন পরিমণ্ডল সযত্নে পরিহার করে চলতেন। সমসাময়িক লেখক কবিদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ছিল। তিনি কোনো সাহিত্যবোদ্ধা বা কননাইসারদের আড্ডায় যোগ দিতেন না। বাংলা উপন্যাসে ফার্সি শব্দের প্রয়োগ নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে একদা মৃদু বচসা এবং পত্রিকার পাতায় কয়েকটি চিঠি চালাচালি ছাড়’ আমরা সাময়িকপত্রে তার আর কোনো উপস্থিতি দেখতে পাই না তাঁর বাসাতেও কাউকে তিনি নিমন্ত্রণ জানাতেন না। মইদুল ইসলামের সংসারজীবন সম্পর্কে আমরা অল্পবিস্তর যা জানি, তা তার স্কুলের সহপাঠী এবং মায়ের দিককার আত্মীয় (সম্ভবত মায়ের ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে) মির্জা একরামুল বাশারের দিনশেষের রাঙা মুকুল নামে ৬৪ পৃষ্ঠার এক অপরিসর গ্রন্থের কল্যাণে। বৈঠকি ঢঙে লেখা এই ক্ষুদ্রায়তন পুস্তিকাটিকে কোনোভাবেই মইদুল ইসলামের অফিশিয়াল বায়োগ্রাফি বলার অবকাশ নেই, তবে এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না, অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে লেখা, দুর্বলভাবে সম্পাদিত, মুদ্রণপ্রমাদে ঠাসা, ‘পুষ্টিহীন’ (যেমনটা হুমায়ুন আজাদ এক ঘরোয়া আড্ডায় বলেছিলেন বলে শুনেছি) এই গ্রন্থটি প্রকাশের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, মইদুল ইসলামের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কৌতূহলী পাঠকের ক্ষুন্নিবৃত্তি। আর এটি মইদুল ইসলামের ব্যক্তিজীবনের অনেক অপ্রয়োজনীয় ডিটেইলের ওপর আলোকপাত করে বটে, তবে তার সৃজনকৌশল, পাঠরুচি, লেখার অভ্যাস বা তার অন্তর্জগৎ সম্পর্কে আমাদের প্রায় কিছুই জানায় না। অনুমান করতে দ্বিধা করছি না, লেখকের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে সমালোচক তাবরেজি মহাশয়ের জ্ঞানের দৌড় মির্জা একরামুল বাশারের চটি গ্রন্থটির বাইরে বিস্তৃত হওয়ার অবকাশ পায়নি।
লেখক মইদুল ইসলামের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে ডিটেইল তথ্য অবগত হওয়ার বিষয়টিতে আমি অশেষ গুরুত্ব দিতে চাই। তার কারণ এই নয় যে, নিও রিয়ালিস্টদের মতো আমিও বিশ্বাস করি, লেখকের সাহিত্যকর্ম তাঁর ব্যক্তিজীবনেরই একটি এক্সটেনশন। সে রকম নয়। আমার বিশ্বাস বরং এর বিপরীত কিছুই হবে। আমি যেটা জোর দিয়ে বলতে চাই, সেটা হলো, কেবল লেখক মইদুল ইসলামের ক্ষেত্রে তাঁর শেষ দিককার সাহিত্যকর্মগুলোর যথাযথ মূল্য বিচার করতে হলে তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই কিছু তথ্য জানা থাকতে হবে। আমার সৌভাগ্য যে সেই তথ্যগুলো জানার সুযোগ আমার হয়েছে। কীভাবে হয়েছে, সেটা আমি যথাস্থানে বলব। এক্ষনে শুধু এটা বলে রাখি যে, এসব ব্যক্তিগত তথ্যই মইদুল ইসলামের শেষ তিনটি উপন্যাস প্রশ্নে সমালোচক সালাউদ্দীন তাবরেজির মতামতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণে আমাকে বাধ্য করছে।