র্যাট স্মেলার দেশটির গ্রামাঞ্চলে একটি বিয়ের বনের দীর্ঘ ক্লান্তিকর বিবরণ দিয়েছেন। তা থেকে সেখানকার লোকাঁচার, পোশাক এবং খাদ্যাভাস সম্পর্কে অনেক ধারণা পাওয়া যায়। এমনকি যে চারটি বিয়ের গীতের লিরিক তুলে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে প্রচলিত লোকবিশ্বাস এবং অধিবাসীদের যৌথ মনোজগৎ সম্পর্কে বেশ কিছু বিষয় অনুমান করা যায়। শেয়াল আর কাকের চালাকি নিয়ে কয়েকটি উপদেশমূলক গল্পের একটি সিরিজ এ ক্ষেত্রে সোনার খনি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এগুলো থেকে সহজে অনুমেয়, সেখানকার কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলোয় এখনো কৌম সমাজকাঠামোর প্রভাব প্রবল এবং শহরাঞ্চলে অর্থবিত্তের চেয়ে দৈহিক শক্তি এবং বংশপরিচয়কে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়।
র্যাট স্মেলার দেশটির মুদ্রা এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত সামান্য কিছু বিবরণ হাজির করতে পেরেছেন। এ ছাড়া দেশটির শিল্প অঞ্চলে অবস্থিত একটি কারাগারের পঞ্চাশজন কয়েদির অপরাধের বিবরণ থেকে সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা এবং এমনকি আর্থসামাজিক কাঠামো সম্পর্কে কিছু কিছু ধারণা পাওয়া যায়।
মোটকথা র্যাট স্মেলার যেসব বিচ্ছিন্ন দলিল ও বিবরণ উদ্ধার করেছেন, সেগুলো জোড়া লাগিয়ে বানিয়ালুলুর একটি ছবি দাঁড় করানো যায় বটে, তবে সেই ছবি একটা পুরোনো বিবর্ণ পারিবারিক অ্যালবামের ফাংগাস আক্রান্ত গ্রুপ ছবির মতোই ধোঁয়াশাময়। তাতে প্রকাশিত অংশের চেয়ে অপ্রকাশিত অংশই বেশি।
র্যাট স্মেলারের প্রতিবেদনের সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো, সমগ্র বিশ্বের কাছে বানিয়ালুলুর অস্তিত্ব কী করে এত দিন গোপন রাখা সম্ভব হলো আর এ নিয়ে এত ঢাকঢাক-গুড়গুড়ের কারণ কী এগুলোর কোনো ব্যাখা এতে নেই। এ নিয়ে কোনো ইঙ্গিত বা অনুমানের সূক্ষ্ম সূত্রও হাজির করতে পারেননি তিনি। আমার মনে হয়েছে, গোপনীয়তার এই রহস্য ভেদের চেয়ে দেশটির বিবরণ দেওয়ার দিকেই তার ঝোঁক ছিল।
এই সব বিবরণ থেকে কতগুলো সাধারণ জিনিস যৌক্তিকভাবে প্রতিপন্ন হয়। প্রথমত, বানিয়ালুলু কোনো বিচ্ছিন্ন দেশ নয়। মান্দারিন লিপি গ্রহণ, রুশ ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত বইপত্রের উপস্থিতি এবং সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় (ভুলবশত) উল্লেখ প্রমাণ করছে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে এটির যোগাযোগ আর দশটা দেশের মতোই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঘটছে। র্যাট স্মেলার এমনকি তুরস্কের একটি বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের বানিয়ালুলু সফর এবং দেশটি থেকে গ্রানাইট পাথর আমদানিসংক্রান্ত একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের কথা উল্লেখ করেছেন।
এরপরও বানিয়ালুলুর অদৃশ্য থেকে যাওয়ার বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে দুৰ্জেয় রহস্যগুলোর একটি। অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে এই বিষয়টিতেই র্যাট স্মেলারের বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল।
আমি নিজে এ বিষয়ে বিস্তর অনুসন্ধান করে অবশেষে বুঝতে পেরেছি, এ ক্ষেত্রে খুব বেশি অগ্রগতির সুযোগ নেই। বানিয়ালুলুর অনস্তিত্ব কোনো অভিপ্রায়হীন নিরীহ ঘটনা নয়। এর পেছনে চরাচরব্যাপী ষড়যন্ত্রের সুদীর্ঘ জাল বিছানো। সেই জাল ভেদ করা শুধু যে অসম্ভব, তা-ই নয়, তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণও। আমরা বড়জোর ষড়যন্ত্রটির প্রকৃতি এবং উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু আঁচ অনুমান করতে পারি।
বানিয়ালুলুর অনস্তিত্বের দুটি লক্ষণীয় দিক আছে। প্রথম কথা হলো, এটির উপস্থিতি বিশ্বের যৌথ মানব অনুধাবন থেকে এমন বিশেষ কায়দায় মুছে ফেলা হয়েছে, যেন ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই এটির অস্তিত্ব ছিল না। অর্থাৎ অবলোপন প্রক্রিয়াটির একটি রেট্রোস্পেকটিভ এফেক্ট বিদ্যমান। এটা অর্জন প্রায় অসম্ভব একটি বিষয়। দ্বিতীয়ত, বানিয়ালুলুর অস্তিত্ব অবলোপনের সঙ্গে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের যোগ আছে। এই অবলোপন প্রক্রিয়াটির সাফল্যের সঙ্গে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি অংশজুড়ে বিস্তৃত একটি সুবিশাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার টিকে থাকা না-থাকার প্রশ্ন জড়িত।
অবলোপন প্রক্রিয়াটি কীভাবে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে, এ বিষয়ে আমার একটি অনুমান বা হাইপোথিসিস আছে। অনুমানটি আমার মধ্যে বিদ্যুভূলকের মতো উঁকি দিয়েছে, যখন আমি দক্ষিণ আমেরিকায় হিস্পানি উপনিবেশ বিস্তার প্রক্রিয়া নিয়ে পোস্ট-কলোনিয়ান ইতিহাসবিদ টমাস মানরোর একটি বই পড়ছিলাম। মানরো দেখিয়েছেন, কী করে হিস্পানি কনকিস্তাদোররা একটি বিশাল অ্যাজটেক মন্দির ফিজিকালি ধ্বংস না করে সেটার অস্তিত্ব মুছে দিতে পেরেছিল। পিরামিড আকৃতির এই মন্দিরটির দেড় হাজার সিঁড়ির ধাপের একটি পাথরও না সরিয়ে, একটি মূর্তিও অপসারণ না করে মন্দিরটি এমনভাবে গায়েব করা হয়েছে, কোথাও কোনোভাবে এটি আর দেখতে পাওয়া যায় না, দেখতে পাওয়া যাবে না। যে অভিনব কায়দায় এ কাজটি করা হয়েছে, টমাস মানরো সেটার নাম দিয়েছেন ‘কালচারাল ডিজইন্টিগ্রেশন’। মন্দিরসংক্রান্ত সমস্ত তথ্য, সমস্ত উপাত্ত টুকরো টুকরো করে এমন বিশেষ কায়দায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অন্য তথ্যের সঙ্গে তা মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এগুলো সমন্বিত করে মন্দিরসংক্রান্ত কোনো অভিন্ন অনুধাবন কারও পক্ষে গড়ে তোলা আর সম্ভব নয়। ফলে কারও অনুধাবনে মন্দিরটি একটি প্রাচীন বৃক্ষ, কারও অনুধাবনে এটি একটি প্রাথমিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিকক্ষের ব্ল্যাকবোর্ড, আবার অনেকের অনুধাবনে এটি একটি লন্ড্রির দোকান হিসেবে প্রতিভাত হয়।