একটা অস্বস্তি ভর করল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিলাম।
চৌকাঠে দাঁড়িয়ে উর্দি পরা এক সেনা কর্মকর্তা।
ড. বুলগাশেম?
বলছি।
আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
এক্ষুনি?
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে জিপটা যেদিকে ছুটল, সেটা সেনানিবাস এলাকার উল্টো দিক। আমি চিন্তিত বোধ করলাম। জিপের সহযাত্রীদের কাছ থেকে কিছু জানার উপায় নেই। শহর পেরিয়ে পার্বত্য এলাকার পথ ধরলাম আমরা।
গাড়ি ছেড়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা নির্জন পাহাড়ে উঠছি। গাছপালা একটু কমে এলে আকাশে ভেসে উঠল মানমন্দিরের চূড়া।
তখন মনে পড়ল, প্রায় পরিত্যক্ত এই মানমন্দিরে সামরিক লোকজনের আনাগোনার খবর দেখেছি পেপারে। কী ঘটছে, কৌতূহল অনেকের।
মানমন্দিরের পোর্টিকোয় পাহারা দেখে বুঝলাম, ভবনটা আসলে এরই মধ্যে সামরিক স্থাপনায় পরিণত হয়েছে।
অবজারভেশন কক্ষে যে লোকটা আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন, তিনি মানমন্দিরের বেসামরিক কিউরেটর পি রাঘবন। পরিচয় না থাকলেও একাধিক একাডেমিক সেমিনারে আমি তাকে দেখেছি।
রাঘবন ও আমার মধ্যে যে কথোপকথন হলো, তার নিরস প্রাতিষ্ঠানিক টোন আমার দৃষ্টি এড়াল না। রাঘবন গবেষক থেকে প্রশাসক হয়ে উঠছেন।
আপনি অবাক হচ্ছেন ড, বুলগাশেম, সন্দেহ নেই।
অবশ্যই। প্রথমত অবাক হচ্ছি, একটা জ্যোতির্বিদ্যার মানমন্দিরে সামরিক উর্দির লোকজন দেখে।
ভুলে যাচ্ছেন কেন, মহাকাশ সংস্থা আসলে প্রতিরক্ষা দপ্তরের অংশ। মহাকাশ গবেষণা তো দিনশেষে সামরিক গবেষণাই।
কিন্তু এভাবে টেকওভারের মানে কী?
আমরা একটা নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে আছি।
কত বড়?
অনেক। আপনি যতটা কল্পনা করতে পারেন, তার চেয়েও বড়।
হুমকির ধরন?
এখনো আমরা পুরোপুরি ঠাহর করতে পারিনি।
উৎস?
সবটা বলা যাবে না। শুধু বলব, হুমকিটা আসছে বাইরের দিক থেকে।
বাইরের দিক মানে?
বাইরের দিক মানে বাইরের দিক।
রাঘবনের কথার মধ্যে এমন একটা ইশারা ছিল, আমরা দুজনেই মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালাম। দুপুর হয় হয়। কুয়াশা কেটে ঝকঝকে রোদে চোখ ঝলসে যাচ্ছে।
আমি অবিশ্বাস ভরা চোখে রাঘবনের দিকে তাকালাম। প্রতিবাদ করে উঠলাম, দয়া করে এ কথা বলবেন না যে আমরা সংকেত পাচ্ছি।
বলব।
মানে?
মানে আমরা সংকেত পাচ্ছি। অবশেষে। দু শ বছরের টানা চেষ্টার পর।
মানে কেউ সংকেত দিচ্ছে?
দিচ্ছে।
মানে বাইরে সত্যি কেউ আছে!
আছে। এখন আমরা মোটামুটি নিশ্চিত।
তাহলে ঘোষণা করছেন না কেন? এত বড় বৈপ্লবিক, বিস্ফোরক তথ্য কেন চেপে রাখছেন?
কারণ আমরা কনফিউজড।
এই না বললেন, আপনারা নিশ্চিত?
নিশ্চিত, আবার কনফিউজড।
মানে?
আমরা আমাদের রিসেপ্টরে যেসব ডেটা পাচ্ছি, সেগুলো যে সজ্জাতেই সাজানো যাক না কেন, কতগুলো মৌলিক অসঙ্গতি থেকে যাচ্ছে, সেগুলো এত মৌলিক যে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। নানা রকম গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে সেগুলো ফিল্টার করার চেষ্টা করা হয়েছে। কাজ হয়নি। এগুলোর ব্যাখ্যার পঞ্চাশ রকম হাইপোথিসিস দাঁড়িয়ে গেছে। সেগুলো ঝাড়াই-বাছাই করে শেষ পর্যন্ত যেটা টিকেছে, যেটা জিগস-পাজলের টুকরোগুলোকে খাপে খাপে বসিয়ে দিতে পেরেছে, সেই হাইপোথিসিস মেনে নেওয়ার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত নই।
কী সেটা? আমরা এর নাম দিয়েছি হিট্টি প্রোপোজিশন। গণিতবিদ প্রফেসর হিট্টির নাম শুনেছেন তো?
আমি গণিতের লোক নই।
আমি খুব সরল করে শুধু সিদ্ধান্তটা বলি। প্রফেসর হিট্টি বলছেন, আমরা যেসব ডেটা পাচ্ছি, সেগুলো কোনো করপোরাল উৎস থেকে আসছে না।
মানে?
এগুলোর কোনো জাগতিক প্রতিরূপ নেই। মানে এর কোনো বস্তুগত উৎস সরাসরি মিলবে না।
আধ্যাত্মিক ব্যাপার নাকি? সুফিবাদ?
না। সুফিবাদ নয়। প্রফেসর হিট্টি বলছেন, আমরা যেসব ডেটা পাচ্ছি, সেগুলো আসলে স্বপ্নের উপকরণ মাত্র।
স্বপ্ন মানে?
স্বপ্ন মানে স্বপ্ন, আমাদের ঘুমের মধ্যে যেগুলো মস্তিষ্কের মধ্যে তৈরি হয়, বিজ্ঞানের এই তুরীয় অগ্রগতির কালেও যেগুলোর কারণ বা প্রকৃতি আমরা খুব একটা উদ্ঘাটন করতে পারিনি।
আমি থ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। দেখি, কথাটা বলে রাঘবন অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন। বিব্রত ভাব লুকানোর চেষ্টা।
আমরা বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থাকলাম। শেষে আমি বললাম, এটা কোনো প্র্যাকটিকাল জোক নয় তো?
জোক নয়। আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প হাইপোথিসিস নেই। আমরা একপ্রকার নিরুপায়।
তাহলে একটা দুশ বছরের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের এই পরিণতি? মহাবিশ্বে আমরা আমাদের দোসর পেলাম বটে, কিন্তু পুরোটা পেলাম না, পেলাম শুধু তাদের স্বপ্ন?
এক দিক থেকে দেখলে তা-ই। হুম, খুব ক্রুড অর্থে তা-ই বটে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ওদের স্বপ্নগুলো ট্রান্সমিটেড হচ্ছে। আর সেটা ট্রান্সমিটেড হচ্ছে একটা রেগুলার লুপবিশিষ্ট রেডিও-থারমাল তরঙ্গের আকারে, আমাদের রিসেপ্টরগুলো যেটা ডিকোড করতে সক্ষম।
আমি একটু অধৈর্য হয়ে পড়লাম। বললাম, তা এখানে আমার ভূমিকাটা কী? আমাকে তলব কেন?
আপনি কিছু অনুমান করতে পারছেন না?
না। পারছি না।
দেখুন, নিউরোলজিস্ট প্রফেসর সাইলো দোলুশ আপনার নাম প্রস্তাব করেছেন। আমরাও আপনার রেকর্ডস ঘেঁটেছি। অবসরে যাওয়ার আগে আপনি কমপ্যারেটিভ ফিলোলজি পড়াতেন। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটা ডিপার্টমেন্ট খোলার চেষ্টা করেন আপনি, যার বিষয়বস্তু বিভিন্ন পুরোনো বিলুপ্ত বিদ্যা।