এই গবেষণা চলার সময় আমাদের ক্রোনোবায়োলজিস্ট গোপনে আরেক ধরনের পরীক্ষা চালালেন। তিনি দেখলেন, এই বিশেষ যাত্রাপথ অনুসরণ করার কারণে শুধু যে মানুষের সার্কাডিয়ান রিদমের তাল-লয় কেটে যাচ্ছে, তা নয়, একই প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে মানুষের অন্ত্রে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী কৃমিকুলে। এমনকি অন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসগুলোরও ছন্দে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এভাবে এগোতে গিয়ে ক্রোনোবায়োলজিস্টের মাথায় একটা বিশেষ চিন্তা উঁকি দিতে শুরু করে, সার্কাডিয়ান রিদম তাহলে অমোঘ নয়। এটা ভেঙে ফেলা সম্ভব।
শুরু হয় সার্কাডিয়ান রিদম নিয়ে আরেক ধরনের গবেষণা। আর সেটা গোপনে। আমাদের ক্রোনোবায়োলজিস্ট এই নতুন। গবেষণা চালাতে শুরু করেন পুরোনো গবেষণার সমান্তরালে। সার্কাডিয়ান রিদম মুছে ফেলার বিকল্প পদ্ধতি খুঁজতে থাকেন তিনি। বিমানযাত্রার মতো অত জটিল পথ অনুসরণ নয়। আরও সরল কোনো উপায়। সেটা তিনি পেয়েও যান একসময়। তারপর মানুষ থেকে শুরু করে নানা পশুপাখির সার্কাডিয়ান রিদম মুছে দিতে থাকেন তিনি। আর সেটা করতে গিয়ে নতুন আরেকটা ব্যাপার তার চোখে পড়ে। তিনি লক্ষ করেন, সার্কাডিয়ান ছন্দ মুছে ফেলা মানেই এক ছন্দহীন বিশৃঙ্খলা নয়। বরং প্রাণিদেহে তখন ধীরে ধীরে আরেক ধরনের ছন্দ উঁকি দেয়। সেটা আরেকটু বৃহৎ পরিসরের সার্কাডিয়ান ছন্দ। কিন্তু সেটার চলন-বলন ভিন্ন। আর সেটার ফ্রিকোয়েন্সি বা ছন্দের বিস্তারকাল ২৭ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। সবার ক্ষেত্রে। এ যেন সব জীবের মধ্যে লুকিয়ে রাখা আদি ছন্দ। কেন? ঠিক ২৭ ঘণ্টা ৩৬ মিনিটই কেন? এর চেয়ে বেশি বা কম কেন নয়?
ক্রোনোবায়োলজিস্টের মনে হলো, তিনি যেন রক অ্যান্ড রোলের আড়ালে লুকানো কোনো জ্যাজসংগীত খুঁজে পেয়েছেন।
এই নতুন সার্কাডিয়ান ছন্দের উৎস নিয়ে গবেষণায় আমাদের ক্রোনোবায়োলজিস্ট এতই নিবিষ্ট ছিলেন যে তাঁর চারপাশে অপরিচিত কিছু লোকের আনাগোনা তিনি লক্ষই করলেন না। নিজের গবেষণা নিয়ে তিনি যদি অত বেশি মত্ত না থাকতেন, তাহলে অবশ্যই তার চোখে পড়ত, মধ্যরাতে গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে হেঁটে মেট্রো স্টেশনে যাওয়ার পথে কয়েকজন লোক নিয়মিত তার পিছু নিচ্ছে। এমনকি মেট্রোর কামরা ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও তারা ঠিক তার চারপাশ ঘেঁষে বসছে।
নতুন গবেষণা শুরুর দ্বিতীয় সপ্তাহে ক্রোনোবায়োলজিস্টের চাকরি চলে গেল। গবেষণাগারের পরিচালক তাঁর হাতে সাদা খাম ধরিয়ে দিলেন। তার অপরাধ কী, সেটার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হলো না। চিঠি হাতে তিনি বেশ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে পঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে শহরের কেন্দ্রীয় পার্কে একটা চেরিগাছের নিচে বেঞ্চে বসে থাকলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত। স্ট্রিটলাইটগুলো জ্বলে উঠলে তিনি হেঁটে বাসায় ফিরলেন। সদর দরজায় চাবি ঘোরানোর সময় প্রথমবারের মতো তার খটকা লাগল। তিনি ফিরে তাকালেন এবং রাস্তার উল্টো দিকে ফুটপাতে একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। পরের কয়েকটা দিন আরও কিছু খোঁজখবরের পর তিনি নিশ্চিত হলেন, তাঁর জীবনের এই আকস্মিক ট্র্যাজেডির পেছনে সার্কাডিয়ান
রিদমসংক্রান্ত গবেষণার যোগ আছে। এই গবেষণা বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই যে তার চাকরি খেয়ে ফেলা হয়েছে, এটা বুঝে যাওয়ার পর তিনি আঁচ করতে শুরু করলেন, তার চারপাশে কোথাও গভীর একটা ষড়যন্ত্র পাক খেয়ে উঠছে।
কেন? কেন? কেন?
একই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকল তার মাথায়।
প্রাণিদেহে ২৪ ঘণ্টার সার্কাডিয়ান ছন্দের তলায় ২৭ ঘণ্টা ৩৬ মিনিটের আরেকটি ছন্দ লুকানো আছে, এই নিরীহ সত্য ধামাচাপা দেওয়ার পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? কেন এই তথ্য বিপজ্জনক?
চাকরি যাওয়ার ১৭ বছর পর একদিন দুপুরবেলা ক্রোনোবায়োলজিস্ট তাঁর ইউরেকা মুহূর্তটি পেয়ে গেলেন। তিনি তখন পোষা কুকুরকে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করিয়ে রোদে বসিয়ে রেখে পাশে মোড়ায় বসে তার কাছে আসা বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিনগুলোর পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছিলেন। একটি ম্যাগাজিনের ৪৮ নম্বর পৃষ্ঠায় একটা ছোট্ট আবিষ্কারের খবরের ওপর তার চোখ আটকে গেল। আমাদের গ্যালাক্সির উল্টো প্রান্তে প্রায় সাত হাজার আলোকবর্ষ দূরে এমন একটি গ্রহ পাওয়া গেছে, যে গ্রহের আহ্নিক গতি ২৭ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট। মানে গ্রহটা ঠিক ২৭ ঘণ্টা ৩৬ মিনিটে নিজের চারপাশে একবার পাক খায়।
এ দিয়ে হয়তো বিশেষ কিছুই বোঝায় না। একটা বিদঘুঁটে অনুমান আর সামান্য কিছ দৈব মিলের ওপর ভর করে কিছই দাঁড় করানো সম্ভব নয়। কিন্তু পত্রিকার পাতায় শিল্পীর তুলিতে আঁকা ওই গ্রহটির কাল্পনিক ল্যান্ডস্কেপের দিকে মায়াময় চোখে তাকিয়ে থাকলেন আমাদের ক্রোনোবায়োলজিস্ট।
জীবনসায়াহ্নে নিজেদের ফেলে আসা ভূমির ছবির দিকে এভাবেই তাকিয়ে থাকেন শরণার্থীরা।
১০. বুলগাশেম প্যারাডক্স
একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, কেউ একজন আমার দিকে একটা পিস্তল তাক করে আছে। লোকটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তবে বোঝা যায়, সে আততায়ী নয়। এক ধরনের অথোরিটি আছে তার মধ্যে। মানে ব্যাপারটা খুন নয়। এক্সিকিউশন।
বিছানা ছেড়ে দেখি ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে। কফি বানিয়ে জানালার ধারে বসলাম। বাইরে ঘন কুয়াশায় বেশি দূর দেখা যায় না। একটা গাড়ির হেডলাইট কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে আসছে। আমারটা এ রাস্তার একমাত্র বাড়ি। তার মানে গাড়িটা আমার কাছেই আসছে। আরেকটু কাছে এলে দেখি সেনাবাহিনীর জিপ।