টেবিলের লবণদানিগুলো প্রতিটি ছবিতে আলাদাভাবে সাজানো। কেন? তা ছাড়া একটা ডাইনিং টেবিলে এত লবণদানি আর মরিচদানি থাকে নাকি? ব্যাপারটা কী?
.
চার দিনের চেষ্টায় পুরো সংকেতটা পাঠোদ্ধার করা গেল। সেটার জন্য অবশ্য ধন্যবাদ দিতে হবে আমার হ্যাম রেডিও স্টেশনের বন্ধুকে।
হ্যাম রেডিও হচ্ছে একধরনের শৌখিন রেডিও স্টেশন। এগুলো যারা চালায়, মোর্স কোডের ওপর তাদের একটা দখল থাকে। বাতিল হয়ে যাওয়া একটা সংকেতলিপি যে আজও এভাবে টিকে আছে, সেটা জানা ছিল না।
ক্রোনোবায়োলজিস্টের বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় না। ভদ্রলোক বার্তা পাঠাতে যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, সেটা বড়জোর ঠান্ডাযুদ্ধের যুগের গুপ্তচরদের মাথায় আসতে পারে, কোনো বিজ্ঞানীর মাথায় নয়। এত ঢাক-ঢাক গুড়-গুড়ের কারণ এখন অনুমান করা যাচ্ছে। তার অন্তর্ধান আর আমার চারপাশে রাস্তাঘাটে কয়েকটা আধচেনা লোকের বারবার ফিরে আসা থেকে সেটা পরিষ্কার।
গুপ্তসংকেত ভেঙে যে বার্তা পাওয়া গেল, তা পড়ে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়লাম। কী জানতে পেরেছি, সেটাই এবার লিখে রাখছি। এটাও মোর্স কোডে। তবে একই পদ্ধতি নয়। আমাকে আরেকটা অভিনব পদ্ধতি বের করে নিতে হয়েছে। লাইব্রেরির সব বই আমি বাঁধাই করে নিয়েছি সাদা আর কালো মলাট দিয়ে। তারপর শেলফে বইগুলো সাজিয়ে রাখছি মোর্স কোড মেনে। আমার এই বার্তা ভবিষ্যতের অজানা কোনো বুদ্ধিমান পাঠকের উদ্দেশে।
.
ক্রোনোবায়োলজিস্টের বক্তব্যের কেন্দ্রে আছে সার্কাডিয়ান রিদম। এই জিনিসটা কী, শুরুতেই তা তিনি সরল ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
সার্কাডিয়ান রিদম হলো এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর, প্রতিটি জীবের দেহে ক্রিয়াশীল এক অদৃশ্য ছন্দ। একটা জীবদৈহিক ঘড়ি যেন সবার মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘড়ির বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ২৪ ঘণ্টার একটা অমোঘ পেন্ডুলাম দুলছে সবার ভেতরে। শুধু মানুষ আর স্তন্যপায়ী প্রাণী নয়, একই ছন্দে দুলছে গাছপালা, সমুদ্রের মাছ, এমনকি ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া পর্যন্ত।
এই ছন্দ যে শুধু ঘুম আর জাগরণের চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে, তা-ই নয়, এই ছন্দ মেনে বৃক্ষ ডালপালা মেলছে, বহুঁকোষী জটিল প্রাণীর দেহে হরমোনের সংকেত ছুটছে কোষ থেকে কোষে।
কিন্তু ছন্দটা ঠিক ২৪ ঘণ্টার ঘড়িতেই বাধা কেন? কারণ, পৃথিবী নিজের চারপাশে একবার পাক খেতে ২৪ ঘন্টা সময় নেয়। দিন-রাতের পালাবদলের এই ছন্দই বহু কোটি বছর ধরে একটু একটু করে জীবদেহে ঢুকে পড়েছে।
বিজ্ঞানীরা প্রথম প্রথম ভাবতেন, এই ছন্দের পেছনে বোধ হয় দিনের আলো আর রাতের অন্ধকারের কোনো যোগ আছে। কিন্তু নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, ব্যাপারটার সঙ্গে আলোর ওঠানামার সরাসরি যোগ নেই। কিছু প্রাণীকে মাটির কয়েক শ ফুট গভীরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিনের পর দিন রেখে দেওয়া হয়েছে, যেখানে আলোর সামান্য রেশও প্রবেশ করতে পারে না। তবু তাদের মধ্যে সেই একই সার্কাডিয়ান রিদম সচল পাওয়া গেছে। যাবতীয় কায়দা-কানুন করেও এই ঘড়ি বন্ধ করা যায়নি। এই ছন্দ মুছে ফেলার কোনো উপায় নেই। তার মানে ঘড়িটা জীবনের আরও গভীরে কোথাও প্রোথিত। হয়তো জীবদেহের ডিএনএ কাঠামোর মধ্যে সেটা গেঁথে দেওয়া আছে।
সার্কাডিয়ান রিদমের এই জ্ঞান সবার আগে লুফে নিয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। কেননা মানবদেহে ওষুধ সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করে, যদি সার্কাডিয়ান রিদমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওষুধ প্রয়োগ করা যায়। এ কারণে সার্কাডিয়ান রিদম নিয়ে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর গবেষণাগারে।
আমাদের এই ক্রোনোবায়োলজিস্টও সে রকমই এক গবেষণাগারে কাজ করতেন। তবে সেটা ছিল সরকারি ওষুধ কোম্পানির গবেষণাগার। আর তিনি যুক্ত ছিলেন এক বিশেষ ধরনের গবেষণায়। তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল সার্কাডিয়ান স্লিপ ডিজর্ডার।
সেটা আবার কী?
কারও কারও দেহে সার্কাডিয়ান রিদমের এই ছন্দ কিছুটা গড়বড় হয়ে যায়। আর সেটা সবার আগে প্রকাশ পায় তাদের ঘুমের চক্রে। এই চক্র এলোমেলো হয়ে যায়। সার্কাডিয়ান স্লিপ ডিজর্ডারের রোগী অসময়ে ঘুমান, আর অসময়ে জেগে থাকেন। ক্রোনোবায়োলজিস্টরা লক্ষ করলেন, যাদের ক্ষেত্রে এ রকম স্লিপ ডিজর্ডার হয়, তাদের জীবনযাত্রার ধরনে কিছু মিল আছে। এদের বেশির ভাগই বিজনেস এক্সিকিউটিভ। এবং প্রায় সবাই ঘন ঘন বিমানযাত্রায় অভ্যস্ত। গবেষণার একপর্যায়ে আমাদের ক্রোনোবায়োলজিস্ট একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলেন। তিনি দেখলেন, শুধু ঘন ঘন বিমানযাত্রা করলেই হবে না, বিমানযাত্রার একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুসরণ করলেই কেবল এই ডিজর্ডার দেখা দেবে। সব রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ক্রোনোবায়োলজিস্ট নিশ্চিত হলেন, বিমানযাত্রার এ রকম কেবল একটিই প্যাটার্ন সম্ভব। সেই অশুভ প্যাটার্ন বা পথটি অত্যন্ত জটিল আর শর্তযুক্ত। যেমন ২৩ ডিগ্রি অক্ষাংশ ও ১৭০ ডিগ্রি দ্রাঘিমা থেকে প্রথমে বিমানে চেপে পশ্চিমে ৭৮ ডিগ্রি অক্ষাংশে যেতে হবে। এই যাত্রায় মাত্র ২ ডিগ্রি দ্রাঘিমা বিচ্যুতি থাকা যাবে। তারপর সেখানে দুই দিন অবস্থানের পর (অবস্থানের দৈর্ঘ্য বেশি বা কম হলে চলবে না) বিমানে চেপে পুব দিকে সরে যেতে হবে ৪৪ ডিগ্রি অক্ষাংশ ও ৭৮ ডিগ্রি দ্রাঘিমায়। এভাবে অন্তত ৩৫টি সুনির্দিষ্ট যাত্রাপথ ও গন্তব্য পেরোলে ৭৭ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে সার্কাডিয়ান স্লিপ ডিজর্ডার দেখা দেওয়ার। মানচিত্রে আঁকলে এই যাত্রাপথটি এমন জটিল হিজিবিজি দেখায়, কোনো মাথামুণ্ডু পাওয়া যায় না।