ওরা কিছুই খুঁজে পাবে না। কেননা আমি এমন এক অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করে লিখছি, যা ওদের পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব নয়। সবার চোখের সামনে আমি প্রতিদিন একটু একটু করে লিখে রাখছি আমার প্রতিবেদন। ওরা দেখছে, কিন্তু টের পাচ্ছে না। এই নিচ্ছিদ্র নজরদারির মধ্যেও কীভাবে বোকা বনছে ওরা, ভেবে আনন্দ পাচ্ছি। নিজেদের যত চালাক ভাবুক, ওরা তো বোকাই। নাহলে আমার ডাইনিং টেবিলে লবণ আর মরিচদানিগুলোর দিকে কেন ওরা একবারও সন্দেহের চোখে তাকাবে না? কেন বুঝতে পারবে না, প্রতিদিন ওগুলোর সজ্জা বদলের মধ্যে প্যাটার্ন লুকিয়ে আছে? টরে টক্কা, টরে টক্কা, টক্কা টরে টরে। মোর্স কোড! গর্দভেরা, এ অতি মামুলি মোর্স কোড। আদি অকৃত্রিম মোর্স কোড।
লবণদানি-মরিচদানি; লবণদানি-লবণদানি, মরিচদানি লবণদানি, মরিচদানি-মরিচদানি।
হা-হা-হা-হা।
আমার ক্যামেরায় প্রতিদিন একবার করে তুলে রাখছি আমার ডিনার করার ছবি। বিশেষ কায়দা করে সেলফি তুলছি, যাতে লবণদানি-মরিচদানিগুলো দেখা যায়, আবার সেগুলো ছবিতে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ফুটে না ওঠে। ছবিগুলো প্রিন্ট দিয়ে তারিখ লিখে সাজিয়ে রাখছি আমার ব্যক্তিগত অ্যালবামে।
ওরা সেই অ্যালবামের পাতায় চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকছে, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ছবির সামনে-পেছনে যাচাই করে দেখছে, কোনো জলছাপ আছে কি না। তারপর হতাশ হয়ে রেখে দিচ্ছে।
আমি জানি, আমাকে বেশি দিন সময় দেওয়া হবে না। খুব শিগগিরই সেই বিশেষ দিনটি আসবে, যেদিন বিকেলে আমি আমার কুকুরটাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোলে একটা সাদা মাইক্রোবাস আমাকে অনুসরণ করবে। রাস্তার নির্জন অংশে দুটি ল্যাম্পপোস্টের মাঝখানে ওরা মাইক্রোবাস থামাবে। তারপর দরজা খুলে দুজন লোক এসে আমাকে দুদিক থেকে ধরে ঝট করে টেনে তুলবে মাইক্রোবাসে। আমার কুকুরটা ভীষণ ঘেউঘেউ করতে থাকবে। কিছুক্ষণ ছুটবে সেটা মাইক্রোবাসটার পেছন পেছন। তারপর একসময় দাঁড়িয়ে পড়বে বড় রাস্তার মোড়ে। তাকিয়ে থাকবে অপসৃয়মাণ সাদা মাইক্রোবাসটার দিকে।
সেই বিকেলবেলা আসার আগেই আমি পুরোটা লিখে ফেলতে পারব আশা করছি। আমি জানি, আমি নিশ্চিতভাবে জানি, আমার অন্তর্ধানের খবর জানাজানি হওয়ার পর যে লোকগুলো এই বাসায় পা রাখবেন, তাঁদের মধ্যে ইস্যুরেন্স ক্লেইমের সেই তরুণ পরিদর্শকও থাকবেন, যার অনুসন্ধানী দৃষ্টির ওপর ভরসা করে আমি এত কিছু সাজিয়েছি। আমি জানি, ওই তরুণ পেশাদার পরিদর্শক আমার ব্যক্তিগত ছবির অ্যালবামটি হাতে তুলে নেবেন এবং সেটার পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে তাঁর ভ্রু কুঁচকে যাবে। একই লোকের প্রতিদিনের নৈশাহারের ছবি যত্নে সাজিয়ে রাখার মধ্যে তিনি মানসিক অসুস্থতার বাইরে আরও কিছুর গন্ধ খুঁজে পাবেন এবং এই অ্যালবামটি তিনি তাঁর কাছে রেখে দেওয়ার অনুমতি জোগাড় করে ফেলবেন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে। নিজ বাসায় পড়ার টেবিলে রাতের পর রাত তিনি আমার অ্যালবামের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকবেন–এটা আমি একপ্রকার নিশ্চিত। তারপর কোনো এক ভোররাতের দিকে যখন আমার পোষা কুকুরের ডাকাডাকির শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে যাবে, আর তিনি উঠে পড়ার টেবিলে বসে টেবিলবাতি জ্বালিয়ে আরেকবার অ্যালবামটায় চোখ বোলাতে শুরু করবেন, সেই মুহূর্তে ছবির ডাইনিং টেবিলের লবণদানি আর মরিচদানিগুলোর দিকে তাঁর চোখ আটকে যাবে।
এই সামান্য কয়েকটা দৈব ঘটনার শিকল আশা করা কি এতই বাতুলতা?
.
বাইরে কুকুরটা একটানা ডাকাডাকি করছে। আমি জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলাম। লাইটপোস্টের আলোয় দেখি একটা কুকুর। আমারই জানালার দিকে তাকিয়ে ডাক ছাড়ছে।
অস্বাভাবিক আচরণ। কুকুরেরা সাধারণত এ রকম করে না। এই কুকুরটাকে চেনা চেনা লাগল। কয়েক দিন ধরে এ রকম ডেজা-ভ্য হচ্ছে। রাস্তাঘাটে এমন কিছু লোক দেখছি, যাদের আগেও দেখেছি বলে আবছা মনে পড়ছে। কিছু লোক যেন ঘুরে ঘুরে আসছে আমার চলার পথে।
আমাকে কি অনুসরণ করা হচ্ছে?
আমার যা পেশা, তাতে এ ধরনের অভিজ্ঞতা নতুন কিছু নয়। বহু লোকের বড় বড় অঙ্কের টাকাপয়সার ভাগ্য ঝুলে থাকে আমার সিদ্ধান্তের ওপর। পেশাটা ঝুঁকিপূর্ণ, এমন বলব না, তবে দুয়েকবার টেলিফোনে হুমকি যে পাইনি, তা তো নয়। কিন্তু এবার পুরো ব্যাপারটায় কী যেন একটা ঝামেলা আছে। চরাচরজুড়ে যেন একটা বিরাট ফিসফাস। কেউ যেন কিছু একটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুই স্পষ্ট নয়। সবই ধোঁয়াশা।
এখন আর ঘুম আসবে না। টেবিলে এসে বসলাম। বাতি জ্বালোম। টেবিলে সেই ক্রোনোবায়োলজিস্টের অ্যালবামটা পড়ে আছে। এটা নিয়ে কয়েক দিন ধরে দারুণ কসরত করছি।
ভদ্রলোক হঠাৎ করে হারিয়ে গেছেন। এ রকম অন্তর্ধান নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে এই সময়। তবে প্রৌঢ় বয়স পেরিয়ে যাওয়া একটা নির্ঝঞ্ঝাট লোকের এই পরিণতি বরণ করার কথা নয়। শুরু থেকে কোথাও একটা ঘাপলার গন্ধ পাচ্ছি। অ্যালবামটা তো আরও সন্দেহজনক। একই টেবিলের একই অ্যাঙ্গেলের ছবি প্রতিদিন তুলেছেন ভদ্রলোক। এমনকি প্লেটের খাবারটা পর্যন্ত হুবহু এক। পেছনে দেয়ালঘড়িতেও একই সময় দেখা যাচ্ছে। রাত সাড়ে নয়টা। একটা লোক প্রতিদিন রাত সাড়ে নয়টায় হুবহু একই দৃশ্যের ছবি কেন….এক মিনিট! হুবহু একই দৃশ্য তো নয়। সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন আছে।