মৃদু ঢেউয়ে জাহাজটা ধীর গতিতে দুলছে। আর অদ্ভুত একটা কটকট আওয়াজ উঠছে, গা ছমছম করা।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, জাহাজের ডেকে উঠতে হবে। কিন্তু ডেক এত উঁচুতে, ওঠা সম্ভব হচ্ছিল না।
অনেক কষ্টে পেছনে দড়ির মই ছুঁড়ে অবশেষে দুপুরের দিকে ডেকে উঠতে পারলাম আমরা দুজন। আমি আর রশীদুদ্দীন পাটোয়ারি।
পুরো জাহাজে একটা লোকও নেই। পরিত্যক্ত।
ভাষ্য ৭
রশীদুদ্দীন পাটোয়ারি, সিনিয়র নেভাল ইন্সপেক্টর
চট্টগ্রাম বন্দর
আমরা যেন বর্তমান ছেড়ে পুরোনো একটা যুগে প্রবেশ করেছি। চার মাস্তুলবিশিষ্ট বিশাল এক গ্যালিয়ন। এখন পাল গুটিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা গোটানো পাল আর দড়িদড়ার ওপর দিয়ে হাঁটলাম। ডেক, কোয়ার্টার ডেক, ব্রিজ ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে আমাদের মনে হচ্ছিল, জাহাজটাকে কিছুতেই পরিত্যক্ত বলার জো নেই। একটু আগেও যেন এখানে লোকজন ছিল। পুরো জাহাজ ক্রু আর খালাসিতে গিজগিজ করেছে। তাদের সবার কর্মব্যস্ততার ছাপ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। কাপ্তানের কক্ষে কাঠের টেবিলে পুরোনো মানচিত্র আর কম্পাস এমনভাবে ছড়িয়ে রাখা, যেন একটু আগেও কাপ্তান এখানে কাজ করছিলেন। খালাসিদের বিছানাগুলো এখনো উষ্ণ। যেন এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে গেছে। এমনকি কিচেনে ঢুকে দেখি, তরকারি আর মাংস কুটে রাখা হয়েছে। সেলারে ওয়াইনের পিপায় ওয়াইন ভরা। কোনো এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে সবাই যেন তড়িঘড়ি জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। অথবা আমাদের ডেকে উঠতে দেখে অদৃশ্য হয়ে গেছে সবাই। লুকিয়ে আছে জাহাজেরই কোথাও। পুরো ব্যাপারটা এমন বেখাপ্পা, আমরা মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিলাম না। যেন বহুকাল আগে সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যাওয়া এক জাহাজ ঝড়ের ঘুর্ণিতে পড়ে এত বছর পর উঠে এসেছে। কিন্তু সবকিছু এত পরিপাটি আর উষ্ণ থাকে কী করে?
জাহাজের খোলে কাঠের ওপর খোদাই করা নাম অনেক কষ্টে উদ্ধার করতে পারলাম ‘সান্তা কাতারিনা দো মন্তে সিনাই’।
বড় অদ্ভুত নাম। কাপ্তানের কক্ষেও কাগজপত্রে এই নাম পেয়েছি। পরে খোঁজখবর করে জেনেছি, পর্তুগিজ আর্মাদাদের বহরে এ রকম নামধাম একসময় দেখা যেত। বিশেষ করে মসলা আর মসলিনের বাণিজ্যের জন্য এ অঞ্চলে যেসব সওদাগরি জাহাজ আসত, সেগুলোর কোনো কোনোটায় এই তরিকার নামের দেখা মিলত। আমাকে এইসব পরে জানিয়েছেন শৈলেনদা, মানে শৈলেন ব্যানার্জি, আমাদের নেভাল একাডেমির সাবেক অধ্যাপক।
আবহাওয়াবিদ শাকিল আব্বাসের সাক্ষাৎকার
প্রশ্ন আমরা শুধু দুটি প্রশ্ন করব আপনাকে। আপনি ঠিক ঠিক জবাব দেবেন।
আবহাওয়াবিদ করুন।
প্রশ্ন কোনো লঘুচাপ সৃষ্টি না হয়ে, কোনো রকম মধ্যবর্তী দশা না পেরিয়ে শূন্য থেকে সমুদ্রে একটা পূর্ণাঙ্গ ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে?
আবহাওয়াবিদ পারে।
প্রশ্ন : কীভাবে?
আবহাওয়াবিদ: পৃথিবীর মাথা খারাপ হয়ে গেলে।
প্রশ্ন: এই ঘূর্ণিঝড়ের একটা অস্বাভাবিক দিক নিয়ে আপনি এর আগে পত্রপত্রিকায় একটি মন্তব্য করেছেন, আমাদের কানে এসেছে।
আবহাওয়াবিদ: কী সেটা?
প্রশ্ন : আপনি বলেছেন, এই ঘূর্ণিঝড়টির বাতাস উল্টো দিকে ঘুরছিল।
আবহাওয়াবিদ : বলেছি।
প্রশ্ন : আপনি কি একটু বুঝিয়ে বলবেন?
আবহাওয়াবিদ : পৃথিবীর আবর্তনের কারণে উত্তর গোলার্ধে যত সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়, সেগুলোর বাতাস ঘোরে ক্লকওয়াইজ, মানে ঘড়ির কাটার দিকে। আর দক্ষিণ গোলার্ধের ঘূর্ণিঝড়গুলো ঘোরে অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ, মানে ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে। কিন্তু উত্তর গোলার্ধে হওয়া সত্ত্বেও এই ঝড়টির। বাতাস ঘুরছিল অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ।
প্রশ্ন : এটা কি সম্ভব?
আবহাওয়াবিদ : সম্ভব।
প্রশ্ন: কীভাবে?
আবহাওয়াবিদ: পৃথিবীর মাথা খারাপ হয়ে গেলে।
০৯. সার্কাডিয়ান ছন্দ
আজও লোকটাকে দেখলাম। রাস্তার উল্টো দিকে অচেনা ঝাঁকড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকল লোকটা। একটানা। পায়ের ভর একবারও বদল করল না। এ থেকে বোঝা যায়, এ লোক কেমন প্রশিক্ষিত। C
লোকটার মধ্যে একটা অলস অন্যমনস্ক ভাব। একবারও আমার দোতলার জানালার দিকে তাকাল না। উল্টো দিকে খেলার মাঠে ছেলের দল ক্রিকেট খেলছে। সেদিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকল, যেন খেলা দেখছে।
চার ঘণ্টা পর লোকটা চলে গেল।
জানালার পর্দা সামান্য ফাঁক করে দেখি, তার জায়গায় আরেকটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে। একই রকম উদাস ভঙ্গি। বুঝলাম, ডিউটি বদল। এরা এখন চব্বিশ ঘণ্টাই নজর রাখছে আমার ওপর। এরা টের পেয়ে গেছে, আমি মরিয়া হয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। কীভাবে টের পেয়েছে, আমি জানি না।
বাইরে বাইরে আমি তো একই রকম নিরীহ ভাব বজায় রাখছি। প্রতিদিনের মতো মোড়ের দোকানটায় পাউরুটি আর মাখন কিনতে যাচ্ছি। পোষা কুকুরটাকে হটিয়ে আনছি। বিকেলবেলা। আর পেনশনের টাকা তুলতে মাসে একবার করে যাচ্ছি সদর রাস্তার ব্যাংকটাতে। আর তো কোথাও যাচ্ছি না। কারও সঙ্গে দেখা করছি না। আমার কাছেও কেউ আসছে না। কাউকে টেলিফোন করছি না। করতে চাইলেও লাভ নেই। ফোন তুললেই যেভাবে একটা খট করে আওয়াজ হয়, বুঝতে পারি, আড়ি পাতা হয়েছে।
ওরা অবশ্য আঁচ করতে পারছে, আমি সবকিছু লিখে রাখতে শুরু করেছি। কিন্তু কোথায় লিখে রাখছি, কীভাবে লিখছি, কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আমি বাইরে বেরোলে ওরা সারা ঘর আঁতিপাঁতি করে তল্লাশি চালায়, আমার লেখার টেবিল, দেরাজ তছনছ করে, বিছানার তোশক, বালিশের তুলা বের করে ফেলে, কিন্তু কোথাও কিছু খুঁজে পায় না।