ভোর চারটার দিকে ঝড় আঘাত হানে বন্দরে। ২২ বছরের নাবিক জীবনে আমি সমুদ্রে বহু ঝড় দেখেছি। কিন্তু এবার যা দেখলাম, আমার পক্ষে বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়।
আমাদের জাহাজের ক্যাডেট ইঞ্জিনিয়ার এডওয়ার্ড গ্রিনভিল শিক্ষানবিশ। ল্যাঙ্কাশায়ারে বাড়ি। ব্রিস্টলে কোনো একটা নৌবিদ্যার কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডব দেখে কেবিনে বসে ছেলেটা সারা রাত ধরে কান্নাকাটি করল। যিশুর নাম ধরে ডাকাডাকি।
হার্বার মাস্টার আমিনুল ইসলামের সাক্ষাৎকার
প্রশ্ন: ঝড় কখন আঘাত হেনেছিল?
আমিনুল: ভোর চারটার পর। আজানের আগে আগে।
প্রশ্ন: আপনারা পোর্ট পুরোপুরি ক্লিয়ার করেছিলেন?
আমিনুল: মোটামুটি। সাতটা কনটেইনার জাহাজ ছিল। তাদের সবাইকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে বন্দর ছেড়ে যেতে বলি আমরা। যেসব জাহাজের ড্রাফট বা তলার গভীরতা সাড়ে ৯ মিটারের বেশি, সেগুলো বন্দরে এমনিতেই ঢুকতে পারে না। কার্গো ভেসেলগুলো এর কম ড্রাফটের হয়। বাল্ক কার্গোগুলো বেশি ড্রাফটের। সেগুলো আউটার অ্যাংকরেজে থাকে। মানে। বন্দরের নিকটবর্তী খোলা সমুদ্রে। ঝড়ের সময় সবাইকে খোলা সমুদ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন : এটুকু আমরা জানি।
আমিনুল : বলে রাখছি, যাতে আমাদের ভুল না বোঝেন।
প্রশ্ন : এই ঝড়ের ব্যাপারে অস্বাভাবিক কিছু কি আপনাদের চোখে পড়েছে?
আমিনুল : না তো।
প্রশ্ন: আপনারা অ্যালার্ট ওয়ানে না গিয়ে সন্ধ্যায় কেন সরাসরি অ্যালার্ট ফোরে চলে গেলেন?
আমিনুল : কারণ ঝড়টা খুব কাছে চলে এসেছিল।
প্রশ্ন : হঠাৎ?
আমিনুল : হঠাৎ।
প্রশ্ন : কোথায় শুরু হয়েছিল ঝড়টা?
আমিনুল : সেটা আবহাওয়া দপ্তর বলতে পারবে। আমরা কী করে বলব?
প্রশ্ন : ঝড়ের পর কী হয়েছিল?
আমিনুল: ঝড়ের পর সব শান্ত। কোনো ডিসট্রেস কল আসেনি। কোনো এসওএস বার্তা নেই। ভোরবেলা বন্দরের একটা টহল দল টাগ বোট নিয়ে আউটার অ্যাংকরেজগুলো ইন্সপেকশন করে এসেছে।
প্রশ্ন : সেখানে তারা অস্বাভাবিক কিছু পায়নি?
আমিনুল : সব জাহাজ অক্ষত ছিল। কোনো জাহাজ বিপাকে পড়েনি।
প্রশ্ন : আমরা আবার প্রশ্ন করছি। টহল দল কি অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেয়েছে?
আমিনুল : পেয়েছে।
প্রশ্ন : কী সেটা?
আমিনুল: তারা ওয়াকিটকিতে যা জানাচ্ছিল, আমরা সেটার কোনো মানে বুঝতে পারছিলাম না।
প্রশ্ন: কোথায়?
আমিনুল: ব্রাভো আর চার্লির মাঝামাঝি আউটার। অ্যাংকরেজে উন্মুক্ত সমুদ্রের একটা অঞ্চলকে আমরা বলি আলফা, একটাকে বলি ব্রাভো। আরেকটাকে বলা হয় চার্লি।
প্রশ্ন: জানি। সেখানে কী দেখতে পেয়েছে তারা?
আমিনুল: আপনারা তো সেটা জানেন। আমাকে প্রশ্ন করছেন। কেন?
প্রশ্ন : বটে, বটে। তা, শুনে আপনারা কী করলেন?
আমিনুল: আমরা তাদের ফিরে আসতে বলি। দ্বিতীয় আরেকটা দল পাঠাই আমরা সকাল ১০টার দিকে। এটায় ইন্সপেকশন বিভাগের প্রধান রশীদুদ্দীন পাটোয়ারি ছিলেন।
প্রশ্ন: তিনি কী দেখলেন?
আমিনুল: তিনিও একই জিনিস দেখেছেন।
প্রশ্ন: ওটা তখনো ওখানেই ছিল?
আমিনুল: ছিল। একই জায়গায়। একইভাবে।
প্রশ্ন: এবার শুধু রেকর্ড রাখার খাতিরে আপনি কিছু জিনিস বলুন। আমরা জানি কি জানি না, সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমরা প্রশ্ন করব, আপনি সরাসরি জবাব দেবেন।
আমিনুল: ঠিক আছে।
প্রশ্ন : রশীদুদ্দীন পাটোয়ারি কী দেখতে পেয়েছিলেন?
আমিনুল : তিনি সমুদ্রের পানিতে একটা বিশাল জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। বিশাল। আর অচেনা।
ভাষ্য ৫
রশীদুদ্দীন পাটোয়ারি, সিনিয়র নেভাল ইন্সপেক্টর
চট্টগ্রাম বন্দর
প্রথম অবস্থায় বুঝতে পারছিলাম না, জিনিসটা কী।
ঝড়ের পর সমুদ্র ঝকঝকে পরিষ্কার আর অস্বাভাবিক শান্ত। কিন্তু আলফা আর চার্লির মাঝখানে এই জায়গাটা কেমন ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়া। অস্বাভাবিক সেই কুয়াশার ভেতরে আমাদের ছোট্ট টাগ বোটটা যখন ঢুকল, মনে হলো একটা প্রাচীন গুহায় ঢুকছি। হুট করে বাতাসটা ঠান্ডা হয়ে গেল। তাপমাত্রা যেন ধপ করে নেমে গেল কয়েক ডিগ্রি।
আমরা সামনে তাকিয়ে আছি। খুব বেশি দূর দৃষ্টি চলে। এ কারণে বুঝতেই পারিনি একটা জাহাজের খোলের কয়েক হাতের মধ্যে চলে গিয়েছি। আরেকটু হলে আমাদের টাগ বোট ধাক্কা খেত খোলের গায়ে। জাহাজটা এতো বড়, হঠাৎ মনে হলো, কুয়াশার মধ্যে একটা কালো ছায়া যেন আমাদের গ্রাস করতে আসছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাডার সেকশনের মঈনুদ্দীন মাহমুদ। তিনি আমার জামার আস্তিন খামচে ধরলেন। আর তখন সব কুয়াশা কেটে গিয়ে সামনে ভেসে উঠল পুরো জাহাজটা।
এ রকম জাহাজ আমি জীবনে কখনো দেখিনি। না, ঠিক বলছি না। দেখেছি। বইপত্রে, সিনেমায়। কাঠের একটা সুবিশাল গ্যালিয়ন বা পাল তোলা জাহাজ। চার কি পাঁচ শ বছর আগে এ রকম জাহাজে চেপে বণিক আর অভিযাত্রীরা বেরিয়ে পড়তেন। নতুন মহাদেশ আর সমুদ্রপথ আবিষ্কারে।
এ জাহাজ কবে জাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে। এটা এখানে এল কী করে?
ভাষ্য ৬
মঈনুদ্দীন মাহমুদ, অপারেটর, রাডার সেকশন
জাহাজটাকে ঘিরে বেশ কয়েকবার চক্কর দিল আমাদের টাগ। বোট। আমরা বেশ কিছুক্ষণ উচ্চস্বরে ডাকাডাকি করলাম : ‘কেউ কি আছেন? সাড়া দিন।
জাহাজের গায়ে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনি উঠতে লাগল। কোনো সাড়াশব্দ নেই।