গল্পের একপর্যায়ে শামস মেহেদির ওয়াকিটকিতে ভিটিএমআইএস রুমের মহসীন মোস্তফার কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে। মহসীন বন্দরের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সতর্কবার্তা দিচ্ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়সংক্রান্ত সতর্কবার্তা! বন্দরের জন্য অ্যালার্ট নম্বর ৪। বন্দরের বিপদসংকেতের মাপকাঠি আলাদা। এখানে চার নম্বর অ্যালার্ট মানেই মহাবিপদ সংকেত। এর চেয়ে খারাপ কিছু ঘটতে পারে না। ঘোষণা শুনে আমাদের ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল। আমি আর শামস মেহেদি অবাক হয়ে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
এ রকম আঁতকা আকাশ থেকে ঘূর্ণিঝড় পড়ে নাকি? দুপুরের দিকে আবহাওয়া দপ্তর থেকে একটা ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্কসংকেত ঝুলিয়ে রাখা ছিল বটে, বন্দরের জন্য কোনো আলাদা সতর্কতাই ছিল না। কারণ সেপ্টেম্বরে সমুদ্রে এ রকম লঘুচাপ সপ্তাহে দু-তিনটা থাকেই। সেগুলো বিশেষ ধর্তব্যের নয়।
বলা নেই কওয়া নেই, এক লাফে অ্যালার্ট ফোর? মহসীনের কি মাথাটাথা খারাপ হলো নাকি!
ভাষ্য ২
মহসীন মোস্তফা, রেডিও কন্ট্রোল অপারেটর
চট্টগ্রাম বন্দর
২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আমার ডিউটি তখন শেষের দিকে। উঠব উঠব করছি। লুবনা ম্যাডামের গাড়িতে আজ লিফট পাওয়া যাবে। কিন্তু শর্ত, সময়মতো বের হতে হবে। আমি টিফিন ক্যারিয়ার গোছাচ্ছি, এমন সময় আবহাওয়া অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিস থেকে কামরুল মোল্লা ল্যান্ডফোনে আমাকে ফোন করেন। আমার হাত থেকে টিফিন ক্যারিয়ার পড়ে যাওয়ার অবস্থা। ঠিক শুনছি তো? কামরুল আমাকে বলছেন, ৬ নম্বর বিপদসংকেত নদীবন্দরে। এখন, নদীবন্দর আর মাছ ধরার জাহাজের জন্য যেটা ৬ নম্বর বিপদ সংকেত, সমুদ্র বন্দরের জন্য সেটা অ্যালার্ট ৩। এর ওপর এক ধাপ উঠলেই অ্যালার্ট ৪।
আমি আমাদের ফ্লোর ইনচার্জ হার্বার মাস্টার আমিনুল ইসলামের টেবিলে ছুটে যাই। আমিনুল ইসলাম আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ঢাকায় আবহাওয়া দপ্তরের কয়েকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। ক্রস চেক। তারপর আমাকে বললেন, মহসীন, ঘোষণা দাও। অ্যালার্ট ৩।
লুবনা ম্যাডামের গাড়ির ড্রাইভার আমার মোবাইলে বারবার ফোন দিচ্ছিল। তাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার টেবিলে মাইক্রোফোনের বাটন অন করি। ঘোষণা দিতে যাব, এই সময় আমার টেবিলের ল্যান্ডফোন বেজে ওঠে। আবহাওয়া অফিসের কামরুল আবার ফোন দিয়েছে। বলল, মহসীন ভাই, স্টপ। ভুল হইছে। ৬ নম্বর নয়, ৭ নম্বর মহাবিপদসংকেত।
তার মানে বন্দরের জন্য অ্যালার্ট ৪ ঘোষণা করা ছাড়া আর উপায় নেই।
আমি ইংরেজিতে বললাম, হোলি শিট!
ঘোষণা দেওয়ার সময় বুঝতে পারছিলাম, আমার গলা কাঁপছে।
ভাষ্য ৩
মনজুর আকন্দ, থার্ড অফিসার, গ্লাডিয়েটর
সাগরে ২৩ দিনের মাছ ধরার সর্টি শেষে আমরা বন্দরে ফিরছি। আমাদের গ্লাডিয়েটর একটা মিড ওয়াটার ফিশিং ট্রলার। এবার ২৩ দিন অনেক রিবন ফিশ আর পমফ্রেট ধরা পড়েছে। প্রচুর দাতিনা মাছও পেয়েছি। অল্প কিছু লবস্টার। ফ্রিজিং করে সেগুলো খোলে ভরে রাখা হয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বহির্নোঙরের আলফা অ্যাংকরেজ এলাকা পেরিয়ে আমরা কর্ণফুলীর এসচয়ারিতে ঢুকছি। আমাদের ডানে ‘সেইন্ট ভ্যালিয়েন্ট’ নামে সিঙ্গাপুরের একটি মাদার ভেসেল। যাওয়ার সময় এটাকে দেখে গিয়েছিলাম। ২৩ দিন ধরে পণ্য নিয়ে এটা এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। বন্দরের কাজের গতির নমুনা।
ব্রিজ রুমে রেডিও বার্তা আসছে। অপারেটরের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। অ্যালার্ট ফোর। রেডিওর শর্ট ওয়েভ স্টেশন থেকে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে সাড়ে চার শ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, যেটার পরিধির বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটারের বেশি। একটা বিশাল চাকা যেন বন বন করে ঘুরছে। আমি ব্রিজরুমে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সাগরের পানি পুকুরের মতো শান্ত। ঝড়ের কোনো চিহ্ন কোথাও নেই। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে গেছে। পুরো সাগর লাল হয়ে আছে।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, সমুদ্র আজ একটু যেন বেশিই লাল। এত লাল আগে দেখিনি।
ভাষ্য ৪
নাথানেল সেভেন্তো, ক্যাপ্টেন, এল এসপেকতাদোর
ব্রাজিল থেকে তিন হাজার টন গম নিয়ে এসেছিল আমাদের জাহাজ এল এসপেকতাদোর। ১৫ দিন আউটার অ্যাংকরেজ চার্লিতে অপেক্ষা করার পর আমরা বন্দরে প্রবেশ করার অনুমতি পাই। আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করেছিলাম। কেননা চট্টগ্রাম বন্দরের কাজের গতি আমাদের অজানা নয়। নতুন জেটিতে আমাদের পণ্য খালাস শুরু হয়েছিল সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখ মধ্যরাতে। কিন্তু ২৯ তারিখ সন্ধ্যার আগে আগে ৩০ শতাংশ পণ্য খালাস বাকি থাকতেই আমাদের দ্রুত বন্দর ত্যাগ করতে বলা হয়। আমরা অবাক হইনি। কেননা ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ম্যাটেরিওলজি ডিপার্টমেন্ট থেকেও আমাদের ঝড়ের সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছিল। বে অব বেঙ্গলের সমুদ্র কতটা আনপ্রেডিকটেবল, আমাদের ধারণা আছে। কিন্তু এ রকম আকস্মিক ঝড়ের কথা আমি কোনো দিন শুনিনি। আমাদের ক্রুদের অনেকেই চট্টগ্রাম শহরে গিয়েছিল বাজারসদাই করতে। তাদের জরুরি তলব করে দ্রুত নোঙর তুলে আমরা আউটার অ্যাংকরেজ চার্লিতে ফিরে আসি। ভোলা সাগরের বুকে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করতে থাকি ঝড়ের। এইটাই নিয়ম। ঝড়ের সময় জাহাজ বন্দরে রাখা হয় না। গভীর সমুদ্রে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, যাতে বন্দরের জেটির সঙ্গে ধাক্কা না লাগে।