‘ডিজিটাল ডেটা সংরক্ষণের এই যে অভিনব প্রযুক্তি আমরা উদ্ভাবন করলাম, সেটার নাম দেওয়া হলো ডিএনএ স্টোরেজ। কৌশলটা খুব সহজ। ডিএনএর যে ছয়টা বেজ সিকোয়েন্স আছে, সেগুলো ব্যবহার করে কোড় করা হয় তথ্য। তারপর এই ডিএনএ কাঠামোটিকে রেখে দিতে হয় একটা শীতল কোনো জায়গায়। পরে যখন খুশি চাইলেই এই ডিএনএর তথ্য রিট্রিভ করা যাবে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং মেশিনের সাহায্যে।
‘এই পদ্ধতির সুবিধা হলো, বিপুলসংখ্যক তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করে রাখা যায় খুব অল্প জায়গার মধ্যে। ধরা যাক, এই মুহূর্তে বিশ্বের সব পারসোনাল কম্পিউটারে এবং সব সার্ভারে যা কিছু তথ্য আছে ডিজিটাল ফরম্যাটে, তা সবই যদি ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করা যায়, তাহলে তা একটা ছোট্ট কাভার্ড ভ্যানের মধ্যে এঁটে যাবে।
‘বছর বিশেক আগে আমরা দুনিয়ার সব তথ্য ডিএনএ স্টোরেজ করার প্রক্রিয়া শুরু করি–সব তথ্য–এফবিআইয়ের গোপন নথিপত্র থেকে শুরু করে মুদির দোকানের ফর্দ পর্যন্ত, সবকিছু। আর তা করতে করতে দ্বিতীয় একটা চিন্তা আমাদের মাথায় আসে। আমি বলব, চিন্তাটা আমারই মাথায় আসে প্রথম। আর আমার নেতৃত্বে শুরু হয় গোপন আরেকটা প্রকল্পের কাজ। আমাদের কথা হলো, একটা নির্জীব ফ্রিজারের মধ্যে এসব ডিএনএ সিকোয়েন্স সংরক্ষণ করে রাখার দরকার কী? তার চেয়ে প্রকৃতির নিজস্ব সংরক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে কী সমস্যা? ভেবে দেখুন, প্রকৃতি কীভাবে তার নিজস্ব ডিএনএ বা জিন সিকোয়েন্স সংরক্ষণ করে? প্রকৃতি সেটা করে জীবদেহে। একটা জীবদেহ বা প্রাণিদেহ তো আসলে জিনের একটা বাহক বা ক্যারিয়ারমাত্র। আমি বলব, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ক্যারিয়ার। ফলে আমাদের যেটা করতে হবে, তা হলো ডিজিটাল কোডবাহী ডিএনএ বা জিনগুলোকে কোনো জীবদেহের জিনতন্ত্রের মধ্যে স্থাপিত করতে হবে। আমরা সেটা শুরু করি উদ্ভিদের মধ্যে। বিভিন্ন উদ্ভিদের জিনতন্ত্রের মধ্যে আমরা আমাদের কোডেড ডিএনএগুলো ইমপ্ল্যান্ট করতে শুরু করি। ওই উদ্ভিদ প্রজাতি যত দিন টিকে থাকবে, তত দিন টিকে থাকবে এসব কোডেড তথ্য। এইভাবে আমাদের তথ্যভান্ডার ফুলে-ফলে প্রকাশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এই বাগানে। মানুষের জ্ঞান লালন পালনের ভার প্রকৃতির হাতে তুলে দেওয়া হলো।
‘কিন্তু এখানে একটা সমস্যা দেখা দিল। প্রকৃতি জিনের মধ্য দিয়ে তথ্য বহন করে বটে। কিন্তু প্রকৃতি সেই তথ্য অবিকৃত রাখে না। জিনের মিউটেশন হয়ে ক্রমাগত নতুন নতুন সিকোয়েন্স তৈরি হয়। ফলে এখানে এই বাগানে নতুন নতুন প্রজাতি তৈরি হতে শুরু করে। আমরা এটাকে বাধা দিইনি। চলুক না। তথ্যের সঙ্গে তথ্য মিশে, তথ্যের কী কী নতুন মিউটেশন দাঁড়ায়, সেটাও তো এক নতুন পরীক্ষা।
‘বলতে পারেন, এই পদ্ধতিতে আমরা আমাদের মানব সভ্যতার পাশাপাশি প্যারালাল কী কী সভ্যতা হতে পারত, বা হতে পারে, সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি।
‘ফলে এ মুহূর্তে যে আপেলগাছের নিচে আপনি বসে আছেন, বলেছি যে সেটা আসলে শেক্সপিয়ারের সব সনেট, কিন্তু আদতে এত দিনে সেটা আর শেকৃপিয়ারের সনেট নেই। বলা যেতে পারে, শেকসপিয়ার যেসব সনেট লিখতে পারতেন, কিন্তু লেখেননি, এগুলো সেই সব সনেটে পরিণত হয়েছে।’
.
ড. মারদ্রুস উঠে চলে যাওয়ার পরও আমি অনেকক্ষণ আপেলগাছের নিচে বেঞ্চে বসে থাকলাম।
গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল যে লোকটা, তাকে আবার দেখতে পাচ্ছি। লোকটা একটা নষ্ট লন মোয়ার যন্ত্র সারাই করার চেষ্টা করছে। আমি তাকে ভালো করে লক্ষ করার চেষ্টা করলাম। কেননা ড. মারদ্রুসের শেষ কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজছে।
‘আপনাকে একটা কথা না জানিয়ে পারছি না। জগতের জ্ঞানভান্ডার উদ্ভিদের জিনতন্ত্রে ইমপ্ল্যান্টের মধ্যে আমরা এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। চারপাশটা ভালো করে খেয়াল করে। দেখবেন। মোজার্টের গানের স্বরলিপি থেকে শুরু করে ওয়ালমার্টের শপিং লিস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য আপনার চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে।’
০৮. বহুযুগের ওপার হতে
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দস্তগীর কমিটির প্রথম প্রতিবেদন কোনো দিন আলোর মুখ দেখবে না। শোনা যায়, ৭০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি এত অসংলগ্ন ছিল, বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ঘরভর্তি লোকজনের সামনে সেটি টেবিল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। নতুন করে প্রস্তুত করা দ্বিতীয় প্রতিবেদন ১৩ দিন পর ঢাকায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেই প্রতিবেদন। ৩৬ পৃষ্ঠায় নামিয়ে আনা হয়েছিল। তাতে তদন্ত কমিটির নেওয়া কয়েকটি সাক্ষাৎকার ও বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ও ভাষ্য হেঁটে ফেলে দেওয়া হয়। প্রথম প্রতিবেদনে ছিল, অথচ দ্বিতীয় প্রতিবেদনে স্থান পায়নি, এমন কয়েকজনের ভাষ্যের কিছু অংশ ও দুটি সাক্ষাৎকার এখানে তুলে ধরা হলো।
ভাষ্য ১
ফজলে ইকরাম চৌধুরী, সভাপতি
বাংলাদেশ মাস্টার স্টিভিভোরস অ্যাসোসিয়েশন
২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আমি বন্দরের ৩ নম্বর কন্টেইনার জেটিতে গ্যান্ট্রি ক্রেন অপারেটর শামস মেহেদির সঙ্গে অলস গল্প করছিলাম। শামস মেহেদি আমাদের সাতক্ষীরা এলাকার ছেলে। আমার দেশি ভাই। বিএল কলেজের ছাত্র ছিল। আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যাপারে আমি ঘটকালি করছিলাম। শামস মেহেদি ক্রেনের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। এ সময় মাঝেমধ্যে তার পকেটে রাখা ওয়াকিটকি বেজে উঠছিল। তাতে আমাদের গল্পে বিঘ্ন ঘটছিল না। কেননা কেউ আমরা সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছিলাম না।