‘কাগজের পৃষ্ঠায় উইকিপিডিয়া প্রিন্ট দিয়ে রাখার প্রকল্প বাতিল হয়ে গেছে। আর এইখানেই মূল বিপদটা লুকানো। সংরক্ষণের বিপদ। উদ্যোক্তারা টের পেতে শুরু করলেন, উইকিপিডিয়া ক্রমশ বাড়তে থাকা এমন এক জ্ঞানভান্ডার, যেটা ডিজিটাল ফরম্যাটে ছাড়া অন্য কোনো ফরম্যাটে সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। তার মানে এই ফরম্যাটের স্থায়িত্বের ওপর নির্ভর করছে পুরো উইকিপিডিয়ার অস্তিত্ব।
‘ডিজিটাল জগতে তথ্য কীভাবে সংরক্ষিত হয়? তা কতটা সুরক্ষিত? আপনি বিশাল বিশাল সব সার্ভারে উইকিপিডিয়া কপি করে রাখছেন। কিন্তু সেই সার্ভারগুলো রাখছেন কোথায়? ধরা যাক, এক বিশাল ভূমিকম্পে একসঙ্গে সব সার্ভার ধ্বংস হয়ে গেল? পরদিন আপনি যে পৃথিবীতে জেগে উঠবেন, সেখানে কোনো উইকিপিডিয়া থাকবে না। শুধু উইকিপিডিয়া কেন, কোনো এনসাইক্লোপিডিয়াই থাকবে না। কারণ উইকিপিডিয়া অন্য সব ফিজিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়াকে আগেই বিদায় করে দিয়েছে।
‘উইকিপিডিয়া কর্তপক্ষ কিছুদিন ধরেই ভাবছে, কিছ সার্ভার তারা চাঁদের পিঠে নিয়ে গিয়ে সেখানে মাটির তলায় পুঁতে রাখবে। পৃথিবী যত বড় দুর্যোগেই পড়ুক, চাদে লুকানো স্টোরেজ থেকে ডাউনলোড করে নিলেই চলবে।
‘ও রকম কোনো একটা মহাদুর্যোগের কথা যদি বাদও দেন, আরেকটা বিপদ কিন্তু গোকুলে বাড়িছে। ডিজিটাল জগতের নিজস্ব চরিত্রের ভেতরেই সেটার জন্ম। ব্যাপারটা পদ্ধতিগত। লক্ষ করবেন, ডিজিটাল জগতে কোনো ফরম্যাটই চিরস্থায়ী নয়। ডেটা স্টোরেজ ব্যবস্থার কথাই ধরুন। ফ্লপি ডিস্কের জগৎ কীভাবে চোখের পলকে মিলিয়ে গেল! সিডি ডিস্ক আজ কোথায়! আপনি নিশ্চিন্তে ডেটা স্টোর করে রাখছেন। কিন্তু যে ফরম্যাটে সেটা রাখছেন, সেই ফরম্যাট রিড করার যন্ত্রই ধরুন আর থাকল না। তখন ভূমিকম্প হওয়া না-হওয়া একই কথা।
‘কোনো ডিজিটাল স্টোরেজ সিস্টেমই খুব দীর্ঘস্থায়ী নয়। কিছুদিন ফেলে রাখলে ওটা মৃত্যুঘুমে তলিয়ে যায়। আর জাগতে চায় না।
‘আমি উইকিপিডিয়ার প্রসঙ্গটা তুলেছি একটা উদাহরণ হিসেবে, আমাদের কালে জ্ঞান ও তথ্য উৎপাদন এবং সংরক্ষণের বৃহত্তর ছবিটা বুঝতে যাতে সুবিধা হয়। তথ্য বা জ্ঞান এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে নেওয়ার এই সংকট মানবসভ্যতাকে চিরকালই ভুগিয়েছে। সম্রাট অশোকের মতো পাথরের গায়ে খোদাই করে আপনি অনুশাসন লিখে রাখতে পারেন বটে, কিন্তু জগতের সব পাহাড়ের গা সয়লাব করে ফেললেও আপনি এক টেরাবাইট তথ্যও উল্কীর্ণ করতে পারবেন না। সমকালীন জ্ঞান সমকালেই হারিয়ে যায়। গ্রিক পণ্ডিতদের কথা চিন্তা করুন। অজস্র পণ্ডিত গিজগিজ করত। তাদের কার লেখা আজ আর টিকে আছে? আমরা শুধু অন্যের অনুবাদ ও রেফারেন্স থেকে তাদের কথা জানি। মধ্যযুগের মুসলিম পণ্ডিতেরা আরবি ভাষায় অনুবাদ করে না দিলে আজ অ্যারিস্টটল কোথায় থাকতেন? লাতিন সাহিত্যের কথাই ধরুন। বিপুলসংখ্যক নারী সাহিত্যিক ছিলেন রোমান যুগে। একজনের লেখাও আজ টিকে নেই। মধ্যযুগের সাহিত্যের শুধু সেগুলোই টিকেছে, যেগুলো কেউ হাতে লিখে কপি করেছে। আমরা জানি কেন এবং কারা পিরামিড বানিয়েছিল। কিন্তু আমরা কি জানি, প্রাচীন মিসরীরা কীভাবে দুপুরের খাবার রান্না করত? কতটা লবণ দিত ডালে? মিসরীয় বাদ্যযন্ত্রের চেহারা আমরা দেখেছি। কিন্তু ওইসব যন্ত্রে বাজানো সুরের নোটেশন কি টিকে থেকেছে? থাকেনি। হারিয়ে গেছে।
‘মানুষের সভ্যতা আসলে তার লব্ধ জ্ঞানের যোগফল ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ সমস্যা হলো, মানুষের স্মৃতিকোষ ডেটা স্টোরেজের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম নয়। মানুষ চিরকালই তার সামগ্রিক স্মৃতি ও জ্ঞানরাশিকে জমিয়ে রেখেছে তার মগজের বাইরে, কোনো ভৌত কাঠামোর মধ্যে। রাক্ষস যেভাবে তার প্রাণ লুকিয়ে রাখে ভোমরার মধ্যে। জগতের সব লাইব্রেরির সব বই আজ পুড়িয়ে ফেলুন, আগামীকাল সূর্যোদয়ের আগেই মানবসভ্যতা অন্ধকার যুগে ফিরে যাবে।
‘ডিজিটাল যুগে জ্ঞানভান্ডার আপনি কাগজের বইয়ের মধ্যে সীমিত রাখতে পারেননি। রাখা সম্ভব নয়। কারণ এই জ্ঞানভান্ডারের আকার প্রায় অসীমের কাছাকাছি। সেখানেই বিপদ অসীম আর শূন্যের মধ্যে ভেদরেখা অতি সামান্য। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ডিজিটাল প্রযুক্তির জোরে আপনি প্রায় অতিমানব। হয়ে উঠেছেন ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে গুহামানব হয়ে পড়ার ঝুঁকিও ডেকে এনেছেন।
‘রোমানরা ভাবত, তাদের সভ্যতা অক্ষয়। রোমান সম্রাটরা ভাবতেন, তারা এমন এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন, যা চিরকাল টিকে থাকবে। আমরাও একই রকম আত্মপ্রসাদে ভুগছি।
‘প্রশ্নটা এক বা দুই দশক বা শতাব্দীর নয়। প্রশ্নটা হলো, বর্তমান ডিজিটাল জ্ঞানভান্ডারকে কী করে পরবর্তী দশ বা বিশ হাজার বছর পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা যাবে। এমন নির্ভরযোগ্য ডেটা স্টোরেজ পদ্ধতি কোথায় মিলবে। এই প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে আমার এই বাগানের যোগ আছে। কিংবা বলতে পারেন, এই বাগানই মানুষের সেই প্রশ্নের জবাব।
‘আমরা একদল লোক বলতে চাইলাম, মানুষকে এই প্রশ্নের জবাব বাইরের দিকে না খুঁজে, খুঁজতে হবে ভেতরের দিকে। মধ্যযুগের সুফি-সাধকেরা যেভাবে মানুষের ভেতরেই অনন্ত জগৎ খুজতেন, আমরাও প্রায় সেভাবেই বললাম, প্রতিটি মানুষ নিজে সহস্র কোটি তথ্যের এক বিশাল ভান্ডার বয়ে নিয়ে চলেছে নিজের ভেতরে। বিবর্তনের পথে এই তথ্য লুকানো আছে তার জিনের মধ্যে, ডিএনএ বিন্যাস-কাঠামোয়। প্রকৃতির রাজ্যে ছয়টি বর্ণে লেখা হচ্ছে অনন্ত এক গ্রন্থ। অক্ষয় সেই কিতাব। আজও যদি আপনি বরফের নিচে চাপা পড়া প্রাচীন কোনো ম্যামথের মৃতদেহ খুঁজে পান, বা পেয়ে যান গাছের আঠার মধ্যে আটকে পড়া কোনো প্রাগৈতিহাসিক মশা, তাহলে সেটার পাকস্থলীর মধ্যে পাওয়া ডিএনএ থেকে আপনি ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনতে পারবেন। কোটি কোটি বছরেও নষ্ট হয় না ডিএনএর কাঠামোর মধ্যে থাকা তথ্য-উপাত্ত।