শোনা যায়, র্যাট স্মেলার তাঁর দেড় কক্ষের ক্ষুদ্র অ্যাপার্টমেন্টে পাঁচ হাজার শব্দের একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়েছিলেন। বেশ কিছু দলিলপত্রও জোগাড় করে ফেলেছিলেন তিনি। প্রতিবেদনের প্রস্তাবিত শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন বানিয়ালুলু একটি দেশের নাম। আটলান্টিকের অপর পারে একটি ইংরেজি ট্যাবলয়েডের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছিল বলেও জানা যায়, তবে কেউ নিশ্চিত নন, নির্মীয়মাণ প্রতিবেদনের কোনো অসম্পূর্ণ খসড়া তিনি সেই পত্রিকার অফিসে পাঠিয়েছিলেন কি না। তত দিনে তার প্রতিবেদনের। বিষয়বস্তু নানাভাবে প্রচার পেতে শুরু করেছে এবং তিনি কোন বিষয়ে অনুসন্ধান করছেন, একটা পর্যায় পর্যন্ত সেটা জানাজানি হয়ে গেছে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে র্যাট স্মেলার নিখোঁজ হন। অনেকে বলেন, তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে এই অন্তর্ধানের যোগ আছে। থাকাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
র্যাট স্মেলার একটি বিস্ফোরক তথ্য প্রচারে নেমেছিলেন। তার দাবি, ট্রাম্পের প্রথম ঘোষণায় কোনো দাপ্তরিক প্রমাদ ছিল না। বানিয়ালুলু নামে একটি দেশের অস্তিত্ব সত্যি আছে। বেলজিয়াম বা দক্ষিণ আফ্রিকা বা প্যারাগুয়ে নামক দেশগুলো যেভাবে অস্তিত্বশীল, বানিয়ালুলুর অস্তিত্ব তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তফাতের মধ্যে জাতিসংঘের সদস্য দেশের তালিকায় এটির নাম নেই, পৃথিবীর কোনো মানচিত্রে এটির উল্লেখ পাওয়া যায় না এবং কোনো ভূগোলের বইতেও এর সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টের গোপন কুঠুরি থেকে র্যাট স্মেলার যেসব দালিলিক তথ্য-উপাত্ত হাত করেছেন, সেগুলোর ভিত্তিতে বানিয়ালুলুর কিছু বিবরণ দাঁড় করানো সম্ভব। তবে স্বীকার না করে উপায় নেই, সেই বিবরণ বড়ই ছেঁড়াছেঁড়া, অসম্পূর্ণ এবং জোড়াতালিময়। এগুলো দেশটি সম্পর্কে কোনো অখণ্ড, সঙ্গতিপূর্ণ ছবি হাজির করে না। যেমন ধরা যাক, আমরা বানিয়ালুলুর রাজধানী শহরের নাম পাই না, অথচ রাজধানীর পূর্ব প্রান্তে ইমাহাতি নামে যে একটি মহল্লা আছে এবং সেই মহল্লার ৩৩৬ ও ৩৩৭ নম্বর বৈদ্যুতিক খুঁটির মধ্যবর্তী দূরত্ব যে ১৬ গজ–এই অপ্রয়োজনীয় তথ্য আমরা জানতে পারি। দেশটির দাপ্তরিক ভাষা লুলুর নিজস্ব লিপি নেই, এই তথ্য একাধিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু আমরা জানতে পারি না, কোন ধার করা লিপিতে তা লেখা হচ্ছে। এক স্থানে খুবই পরোক্ষ একটি উল্লেখে বলা হয়েছে, নেপোলিয়নের অস্টারলিৎসের যুদ্ধ জয়ের সময়কাল থেকে লুলু ভাষা মান্দারিন লিপিতে লেখা হয়ে আসছে। কিন্তু এ থেকে অনুমান করার কোনো কারণ নেই যে দেশটির সঙ্গে চীনা ভাষাভাষি অঞ্চলের কোনো ভৌগোলিক যোগ আছে।
বানিয়ালুলু সম্পর্কে কিছু বিবরণে শুধু যে সঙ্গতির অভাব প্রকট–তা-ই নয়, কিছু বিবরণ পরস্পরবিরোধীও বটে। যেমন ধরা যাক, কয়েকটি উল্লেখ থেকে মনে হতে পারে, দেশটি সিরিয়া এবং আজারবাইজানের মাঝামাঝি কোনো মালভূমি অঞ্চলে অবস্থিত। আবার অপর একটি উল্লেখে মনে হবে, দেশটি বাল্টিক সাগর তীরবর্তী। অথচ নামের ধ্বনিবিন্যাসের কারণে অনেকের অনুমান, বানিয়ালুলুর অবস্থান আফ্রিকা মহাদেশের কোথাও অনেকে লাতিন আমেরিকাকেও সন্দেহে রাখতে পারেন। তবে অবস্থান নিয়ে যত ধোঁয়াশাই থাক না কেন, দুটি বিষয় সন্দেহের উর্ধ্বে। প্রথমত, বানিয়ালুলু কোনো দ্বীপ দেশ নয়। এটির অবস্থান। পৃথিবীর বৃহৎ মহাদেশীয় ভূখণ্ডগুলোর কোনো একটিতে। দ্বিতীয়ত, দেশটি বিষুবীয় অঞ্চলের দেশ নয়।
র্যাট স্মেলার বানিয়ালুলুর ভূ-প্রকৃতি, কৃষি, জলবায়ু এবং মানুষের জীবনযাত্রা-সংক্রান্ত যেসব দলিল জোগাড় করেছেন, আমি বলব, সেগুলো বরং অনেক বেশি সুসঙ্গত এবং বিশদ। কিছু বিবরণ রেমব্রান্টের ছবির মতো জীবন্ত। একটি বিবরণে আদ্দিশ নামে একটি পাহাড়ের পাদদেশে সাত সদস্যের একটি পরিবারের। এক দিনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা আছে। পরিবারের একটি মেয়ে পাতকুয়া থেকে বালতি দিয়ে পানি তুলছে। এমনকি সেই বালতির প্রতিটি রিভেটের গায়ে হলদেটে মরচের বিবরণও আমরা পাই। পরিবারটির বসতভিটা থেকে সামান্য দূরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে একটি নদী, যার নাম যদিও উল্লেখ করা নেই, তবে সেই নদীর স্বচ্ছ জলের তলদেশে খেলা করা প্রতিটি মাছের নামধামসহ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া আছে। সেই বিবরণ এত নিখুঁত যে মাছের প্রতিটি আঁশ থেকে ছুটে আসা রোদের ঝিলিক চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
র্যাট স্মেলার বানিয়ালুলুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত দ্বিতীয় বর্ষের বোটানি বইয়ের (রুশ ভাষায় ভাষান্তরিত) পঞ্চম অধ্যায়ের পুরোটাই হাতে পেয়েছেন। সেখানে বানিয়ালুলুর ছয় ধরনের বায়ুপরাগী ফুলের প্রস্থচ্ছেদের ছবি দেওয়া আছে। পাঁচটি ফুল অতি পরিচিত। ষষ্ঠ ফুলটি আমাদের জবা ফুলের মতো দেখতে হলেও একটু ভালো করে তাকালে পাপড়ির বিন্যাসের অমিলগুলো চোখে পড়বে।
ষাটের দশকে দেশটিতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল বলে একটি দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোথাও বলা হয়নি, বানিয়ালুলুর প্রধান ফসল কী। ভুট্টাজাতীয় একটি ফসলের উল্লেখ এক স্থানে পাওয়া যায় বটে, কিন্তু তা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে যেতে চাইলে তা হবে অতি সাধারণীকরণ।