একর দেড়েক জমিতে বিশাল এক উদ্যান। সবুজ ঘাসের গালিচায় পাথর ফেলে পায়ে চলা পথ বানানো হয়েছে। দুপাশে আধচেনা গাছের ফাঁকে কিছু গুল্মও আছে। বাগানের মাঝামাঝি একটা অর্কিডের শেড। এখানে-সেখানে মর্মর পাথরের ফোয়ারা, কাঠের বেঞ্চ। প্রাচীন কোনো প্রাসাদ-উদ্যান বলে ভুল হয়। এক কোনায় একটা গ্রিনহাউসের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, গাছের ডালপালায় ভালো করে চোখ পড়ে না।
তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি, কেন এই বাগান একটা নিষিদ্ধ। জগৎ, কেন বাইরের বিশ্বের কাছ থেকে এটি লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
‘কারণ এই বাগানের টিকে থাকা না-থাকার ওপর নির্ভর করছে গোটা মানবজাতির অস্তিত্ব। এটাই আমাদের সভ্যতার প্রাণভোমরা,’ ড. মারদ্রুস বললেন। তিনি কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি।
আমি চমকে ফিরে তাকাই। আমার চিন্তা হয়তো চেহারায় অনেকটাই ফুটে উঠেছে।
‘কীভাবে? একটা সামান্য বাগান কী করে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে?’
‘এটা কোনো সামান্য বাগান নয়। আসুন ঘুরে দেখাই, তাহলে বুঝতে পারবেন।’
.
একটা আপেলগাছের নিচে বেঞ্চে আমরা দুজন বসেছি। আমি আর ড. মারদ্রুস।
আপেলগাছ বললাম বটে, তবে বলা উচিত, আপেলগাছের মতো দেখতে একটা গাছ। খুব বড় গাছ নয়। ডালগুলো নুয়ে পড়া। তাতে যেসব ফল ধরে আছে, দেখতে আপেলের মতোই।
‘কী গাছ এটা, বলতে পারেন?’
‘আপেল।’
‘কোন জাতের আপেল? গ্যালা, ফুজি নাকি গ্র্যানি স্মিথ?’
‘আমি আপেলের জাত চিনি না।’
ড. মারদ্রুস বেঞ্চ ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান। হাত বাড়িয়ে একটা আপেল ছিঁড়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেন। একটা লাল গোলাকার পুরুষ্টু আপেল।
‘নিন। খেয়ে দেখুন। এটা আসলে রেড ডেলিশাস। খেয়ে স্বাদটা কেমন বলবেন।’
ড. মারদ্রুসের বাড়িয়ে ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে এক মুহূর্ত স্নোহোয়াইটের সেই বিখ্যাত দৃশ্যটার কথা মনে পড়ল।
‘নিন। চেখে দেখুন। ভয়ের কিছু নেই। এতে বিষ মেশানো নেই।’
আমি আপেলটা হাতে নিয়ে বসে থাকলাম। কামড় বসালাম না। ড. মারদ্রুস আমার কাণ্ড দেখে একটু হাসলেন। বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে।
‘এক হিসেবে আপনার এই অস্বস্তি খুব অমূলক নয়। যে জিনিসটা আপনি হাতে ধরে আছেন, সেটা বাইরে থেকে দেখতে আপেলের মতো বটে। কিন্তু এটা আপেল নয়। বলতে কি, এটা আসলে কোনো ফলই নয়।
‘তাহলে এটা কী?’
‘বললে বিশ্বাস করবেন? এটা শেক্সপিয়ারের একটা সনেট।’
‘মানে?’
‘হ্যাঁ, শেক্সপিয়ারের সনেট। একটা নয়, শেক্সপিয়ারের সবগুলো সনেট। শুধু সনেট না, এটা শেক্সপিয়ারের সব ট্র্যাজেডি ও কমেডি এবং এলিজাবেথান পিরিয়ডে লেখা সব নাটক, ওই সময়ের সব চিঠি এবং এমনকি জমি-জায়গা কেনাবেচা-সংক্রান্ত সব দলিল-দস্তাবেজ।’
আমি অবাক হয়ে মারড্রসের দিকে তাকালাম।
‘আর ওই যে ওখানে নিমগাছটা দেখছেন, ওটা সংস্কৃত কবি কালিদাসের লেখা সবগুলো কাব্য নাটক– কুমারসম্ভব, শকুন্তলা, মেঘদূতম। বাতাসে নিমের পাতাগুলো কীভাবে কাঁপছে দেখুন। মন্দাক্রান্তা ছন্দে কাঁপছে বলে মনে হচ্ছে না?’
লোকটা পাগল নাকি?
আমার মুখের ভঙ্গি দেখে হো হো করে হেসে উঠলেন মারদ্রুস।
‘বুঝিয়ে বলব। আপনি এই বাগানের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। একদিক থেকে দেখলে আপনি হবেন এটার মালি। প্রতিদিন গাছগুলোর যত্ন নেবেন আপনি, পানি দেবেন, সার দেবেন, আগাছা ঘেঁটে দেবেন, কলম করবেন, বীজ সংগ্রহ করবেন। ফলে আপনাকে বুঝিয়েই তো বলতে হবে।’
‘যতই বুঝিয়ে বলুন, একটা আপেলের শেক্সপিয়ারের সনেট হয়ে ওঠার গল্প কোনো দিনই আমার কাছে বোধগম্য হবে না।’
‘আপেল তো শেকসপিয়ারের সনেট হয়নি। বরং শেকসপিয়ারের সনেটই আপেল হয়ে উঠেছে। ব্যাপারটা খুব সরল। আপনি একজন বোটানিস্ট। জেনেটিক্স পড়া আছে আপনার। ফলে আপনি আরও সহজে বুঝতে পারবেন।’
ড. মারদ্রুস একটা দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। ঘণ্টা তিনেকের একটা ক্লাস লেকচার বলা যায়। তাঁর বক্তৃতা শুনতে শুনতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। কেউ একজন একে একে বাগানের গ্যাসবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। আমি অনড় হয়ে বসে থাকলাম আপেলরূপী সনেটগাছের তলায়। যা শুনলাম, তা এখনো ঠিকমতো হজম হচ্ছে না। তবু ওই বক্তৃতার একটা সারসংক্ষেপ এখানে তুলে ধরছি।
.
‘উইকিপিডিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে আপনার? সারা বিশ্বের শতসহস্র ভলান্টিয়ার মিলে একটু একটু করে গড়ে তুলছে বিশাল এক অনলাইন জ্ঞানভান্ডার। উন্মুক্ত। অসীম। যে কেউ চাইলেই এটায় নতুন ভুক্তি যোগ করতে পারে, পুরোনো ভুক্তি সম্পাদনা করতে পারে। ক্ল্যাসিক্যাল যুগের এনসাইক্লোপিডিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতে হবে, এটা অসীমসংখ্যক ভলিউমের, অসীমসংখ্যক পৃষ্ঠার এক মহাগ্রন্থ। সমস্যা হলো, অসীম হলেও এটা অনন্তকালের নয়। উইকিপিডিয়া স্বল্পায়ু নিয়ে জন্মেছে।
‘উইকিপিডিয়া কাগজে প্রিন্ট দিয়ে বই আকারে বের করার একটা প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল কিছুদিন আগে। যারা নিয়েছিলেন, তাঁরা শিগগিরই টের পেলেন, এটা অসম্ভব একটা কাজ। পুরো প্রকল্প দেউলিয়া হয়ে যাবে, তবু প্রিন্ট দেওয়া শেষ হবে না। এ মুহূর্তের কথাই ধরুন। উইকিপিডিয়ায় এখন ৪ কোটি আর্টিকেল আছে, ২২৯টি ভাষায়। আর প্রতি মুহূর্তে সেটা হু হু করে বাড়ছে। গত বছর ফরাসি ভলান্টিয়াররা তর্ক তুলেছেন, রেসিপি বা রন্ধনশৈলী কেন উইকিপিডিয়ার আর্টিকেলভুক্ত হবে না। মানে ব্যাপার হলো, দুনিয়ার যেকোনো কিছু উইকিপিডিয়ার বিষয় হতে পারে।