তাই বলে ভাববেন না, আমার জীবনে এই ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। বলতে কি, অনেক ছোটবেলা থেকে আমি এ রকম অসংগতি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমি লক্ষ করেছি, জগতে এ রকম অসংগতির ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটে। একটা ঘটনা দু-টুকরো হয়ে দুটি ঘটনায় পরিণত হয়। একটা লোক একই সময়ে দুই জায়গায় অবস্থান করে। খুব অল্প সময়ের জন্য করে। অধিকাংশ লোকেরই এগুলো নজর এড়িয়ে যায়। তবে কারও কারও চোখে পড়ে। তারা এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। চেপে যায়।
আমি চেপে গেলাম না। এ রকম ঘটনা আমি অনুসন্ধান শুরু করলাম। কড়া নজর রাখা। দেখলাম, যতটা বিরল ভেবেছিলাম, ততটা বিরল নয় এসব ঘটনা। সতর্ক থাকলে চোখে পড়ে। মাঝে মাঝেই পড়ে।
ব্যাখ্যা? না কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র নই। তবে এটুকু বুঝি, আমরা যতটা সরল মনে করি, জগৎটা তত সরল নয়। যেটাকে আমরা বাস্তবতা বলি, সেটা একটা বিছিয়ে রাখা চাদরের মতো। যুক্তির চাদর। কিন্তু সমস্যা কী জানেন, চাদরটার এখানে-সেখানে ছেঁড়াফাটা, কোথাও কোথাও সেলাই খুলে যাওয়া, কোথাও তাপ্পি মারা। ওই ছেঁড়া ফুটোগুলো দিয়ে আরেকটা জগৎ উঁকি দেয়। সূক্ষ্ম একটা আভাস পাওয়া যায়, বাস্তবতার এই চাদরের নিচে আরেকটা বৃহত্তর জমিন আছে। সেখানে দুইয়ে দুইয়ে সব সময় চার হয় না। সেখানে লজিক চলে তার নিজের নিয়মে।
সবচেয়ে অদ্ভুত কথা কী জানেন, এই বিশেষ ধরনের ঘটনা, এইসব অসংগতি খুঁজতে খুঁজতে আমি এগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম একটা প্যাটার্ন আবিষ্কার করতে শুরু করলাম। ব্যাখ্যা করতে পারব না, কিন্তু এটা ঠিক যে আমি আগাম আভাস পাই। আমি প্রেডিক্ট করতে পারি। টের পাই, কখন এ রকম ঘটনা আবার ঘটতে যাচ্ছে। এটা আমার একটা বাড়তি ক্ষমতাই বলতে পারেন। আমি আগাম বুঝতে পারি, চাদরটার কোথায় কোথায় ছেঁড়া।
আপনি যে বিরক্ত হচ্ছেন সেটা স্পষ্ট। হবেনই-বা না কেন! এতক্ষণ ধরে বকবক করছি। এভারেস্টের চূড়ার একটা পাথরখণ্ড, দেশভাগের সময়কার একটা লাইব্রেরি ভাগের ছবি, সেন্সর বোর্ডের সিনেমা নিয়ে গ্যাঞ্জাম–এসব হাবিজাবি কথা এ রকম বৃষ্টির দুপুরে মোহাম্মদপুর থানার ওসিকে বলার কী মানে? আপনি যে এতক্ষণ ধৈর্য ধরে শুনেছেন, এটাই অবাক বিষয়। আপনার ঘড়িতে এখন কটা বাজে? দুপুর দুটা সাঁইত্রিশ মিনিট, তাই তো? বেশ। এবার তাহলে কাজের কথায় আসি। আমি এসেছি একটা জিডি করতে। আপনি আমার নামে একটা জিডি রেকর্ড করবেন। হ্যাঁ, এখন। কী লিখবেন? লিখুন, একটা লোক আমাকে হুমকি দিচ্ছে। লোকটাকে আমি চিনি না। নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। টেলিফোনে দিচ্ছে, রাস্তায় দেখা করে দিচ্ছে। বলছে, আমাকে মেরে ফেলবে। লিখছেন? জিডি করার সময়টা ভালো করে লিখুন। দুইটা সাঁইত্রিশ মিনিট। পারলে সেকেন্ডটাও লিখুন। এবার কি সই দিতে হবে আমাকে? দিচ্ছি। এবার তাহলে উঠি। জানতে চান এসবের মানে কী? কেন এত বকবক করলাম? আরে, আমি তো ভেবেছিলাম আপনার কৌতূহল বলে কিছুই নেই। এতক্ষণ যেভাবে মুখ গোমড়া করে ফোনে গেম খেলছিলেন, ভেবেছি আপনি কিছুই শোনেননি। শুনুন, আপনাকে খোলাসা করেই বলি। আপনাকে বলাই যায়। ইনফ্যাক্ট আপনাকে বলাই ভালো। জিডির অভিযোগের তদন্ত করাটা আমার জন্য খুব দরকারি না। দরকারি হলো জিডি করাটা। এটাই আমার অ্যালিবাই। আমার দরকার এটা প্রমাণ করা যে এই দুপুর দুইটা সঁইত্রিশ মিনিটে আমি মোহাম্মদপুর থানায় বসে ছিলাম একেবারে ওসি সাহেবের সামনে। একবারও নড়িনি। কোথাও যাইনি। কারণ কী? কারণ, ঠিক এই মুহূর্তে এই দুটা সাঁইত্রিশ মিনিটে বনানী এগারো নম্বর রোডে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে ডাকাতি হচ্ছে। ছয়জন ডাকাত ভয়ানক অস্ত্র তাক করে সবাইকে জিম্মি করে ভল্টের টাকাপয়সা সব নিয়ে যাচ্ছে। আজই সন্ধ্যাবেলা এটা নিয়ে থানায় মামলা হবে। আজ রাত থেকেই তদন্ত শুরু হবে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ছয় ডাকাতের দুজনকে চেনা যাবে। তাদের একজন আমি। হ্যাঁ, আমি। কোনো ভুল নেই। এই আমিই–তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক ক্লার্ক। কীভাবে সেটা সম্ভব, এতক্ষণ ধরে সেটাই তো বোঝানোর চেষ্টা করলাম আপনাকে।
আমার এখন একটাই ভরসা। আপনি। আপনার সাক্ষ্য। আর এই জিডি।