একটা লোকের পক্ষে সারা জীবন এ রকম বিরাট এক বিভ্রান্তির মধ্যে বসবাস করা কী করে সম্ভব, আমার মাথায় ঢোকে না। এটা স্রেফ পাগলামি। কিন্তু কেশবনের এই ছবিটার ব্যাখা কে দেবে? ছবিটা একটা বিরাট খটকাই থেকে গেল।
ভাবছেন এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা কেন বলছি আপনাকে? আপনার সঙ্গে এগুলোর কী যোগ? আরেকটু ধৈর্য ধরুন। কিংবা এক কাপ চা খাওয়াতে পারেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার ওই পারে একটা হোটেল আছে। মালাই দেওয়া চা বানায়। ফ্লাস্ক হাতে কাউকে যদি পাঠিয়ে দিতেন। এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না।
এবার বর্তমান সময়ে আসি। তিন বছর আগের কথা। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দুটি দৈনিক পত্রিকায় দুটি খবর ছাপা হলো। খুব মামুলি খবর। এক মন্ত্রীর খবর। আমি তার নাম বলছি না। একটি খবরে বলা হলো, মন্ত্রী নেত্রকোনায় একটা সেতু উদ্বোধন করেছেন। আরেকটি খবরে বলা হলো, মন্ত্রী খুলনায় পার্টির একটি সভায় যোগ দিয়েছেন। দিতেই পারেন। মন্ত্রীরা এসব কাজই তো করবেন। সমস্যা হলো, পত্রিকা দুটি একই দিনে ছাপা হওয়া। এবং দুটি পত্রিকাই দাবি করছে, ছাপা হওয়ার আগের দিন মন্ত্রী এ কাজটি করেছেন। মানে একই দিনে। শুধু যে একই দিনে, তা-ই নয়, একই সময়ে বিকেলবেলা।
দুটি জায়গা লক্ষ করুন, একটা নেত্রকোনা, আরেকটা খুলনা। কীভাবে এটা সম্ভব হলো? হয় পত্রিকা দুটির কোনো একটি তারিখে ভুল করেছে। অথবা মন্ত্রী এক জায়গায় কাজ সেরে আসলেই আরেক জায়গায় গিয়েছেন। সমস্যা হলো, বাংলাদেশে নেত্রকোনায় বিকেলবেলা একটি সেতু উদ্বোধন করে বিকেলবেলাতেই খুলনায় গিয়ে পার্টির সভা করা সম্ভব নয়। বিমানে বা হেলিকপ্টারে করে গেলেও না। তার মানে পত্রিকা দুটির কোনো একটা ভুল নিউজ করেছে। না, পত্রিকা দুটির কোনোটিই ভুল নিউজ করেনি। আমি দুটি পত্রিকা অফিসে গিয়েছি। শুধু পত্রিকা অফিস নয়, নেত্রকোনা এবং খুলনাতেও গিয়েছি। মন্ত্রী আসলেই পত্রিকায় উল্লিখিত দিনে ওখানে গিয়েছিলেন। ওই সব কর্মসূচিতে তিনি অংশ নিয়েছেন।
মন্ত্রী আমাদের এলাকার লোক। একে-ওকে ধরে আমি একদিন তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। তার সঙ্গে দেখা করলাম। পত্রিকার কাটিং তুলে দিলাম তাঁর হাতে। তিনি দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছু বললেন না।
চা-টা এরা ভালোই বানিয়েছে। আপনাকে আর বিরক্ত করব না। বৃষ্টি কমে এসেছে। আমিও উঠব। আরেকটা ঘটনা বলেই আমি শেষ করব। তারপর আসল কথায় আসব।
এবার যেটা বলব, সেটার সঙ্গে আমি নিজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আমি একটা সরকারি দপ্তরে ছোটখাটো পদে চাকরি করি। দপ্তরটা তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তো ফিল্ম সেন্সর বোর্ডেও কিছুদিন কাজ করতে হয়েছে আমাকে। সেন্সর বোর্ড কী করে, জানেন তো? যারা ছবি বানায়, চলচ্চিত্র, তারা একটা করে কপি জমা দেয়। সেন্সর বোর্ড সেটা স্ক্রিনিং করে। সবাই মিলে একসঙ্গে বসে ছবি দেখে। তারপর আলাদাভাবে রিপোর্ট করে। কোথাও কোনো আপত্তি আছে কি না, সরকারি গাইডলাইন ঠিকমতো মানা হয়েছে কি না–এসব বিষয়ে রিপোর্ট। আমার কাজ ছিল এসব রিপোর্ট কম্পাইল করা, সুপারিশগুলোর একটা তালিকা করে সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেওয়া। নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের খুব দুর্দিন যাচ্ছিল, মনে আছে? অশ্লীলতাবিরোধী আন্দোলনের কারণে খুব মন্দা। বছরে দশ বারোটি ছবিও বানানো হয় কি হয় না। সেন্সর বোর্ডে কাজ নেই। বোর্ড মেম্বাররা কালেভদ্রে একত্রে বসে ছবি দেখার সুযোগ পান। এ রকম সময়ে একদিন তরুণ এক চলচ্চিত্র নির্মাতার একটা ছবি জমা পড়ল। লোকটা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গাঁটের পয়সা খরচ করে ছবিটা তৈরি করেছেন।
সেন্সর বোর্ডে একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেল। কাজ পাওয়া গেছে। একদিন সন্ধ্যার পরপর ইস্কাটন গার্ডেন রোডে সেন্সর বোর্ডের অফিসে ফিল্ম স্ক্রিনিংয়ের বন্দোবস্ত হলো। আমিও তাতে উপস্থিত ছিলাম। সদস্য না হয়েও। ছবির কাহিনি বেশ জটিল। আর্ট ফিল্ম বলতে পারেন। বিষয়বস্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন। বিশ্বজুড়ে বামধারার রাজনীতির বিদায়ঘণ্টা বাজছে। নানান অস্তিত্ববাদী ক্রাইসিস। এ নিয়ে জটিল কাসুন্দি। ছবির প্রায় কিছুই বুঝলাম না। সমাপ্তিটা তো মাথার ওপর দিয়ে গেল।
এ রকম সিনেমা ঢাকার হলগুলোয় চলবে না। এগুলো ফেস্টিভ্যালে দেওয়ার জন্য। পুরস্কার-টুরস্কার পাবে। পত্রপত্রিকায় উচ্ছ্বসিত রিভিউ হবে।
ছবি শেষে বোর্ড মেম্বাররা গম্ভীর মুখে চলে গেলেন। তিন দিনের মধ্যে সবাই নিজ নিজ রিপোর্ট জমা দিলেন। সেগুলো সবই আমার টেবিলে এল। দাপ্তরিক দায়িত্ব হিসেবে আমাকে সেগুলো পড়তে হলো। পড়তে পড়তে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। রিপোর্টগুলো পড়ে বোঝার উপায় নেই, দশ বোর্ড মেম্বার আসলে একটি অভিন্ন ছবি দেখেছেন। দেখলাম, তারা আসলে দশটি আলাদা আলাদা ছবির কথা বলছেন। একেক জনের ছবি শেষ হয়েছে একেকভাবে। যেমন একজন বললেন, তাঁর আপত্তি ছবিটির অহেতুক বিয়োগান্তক সমাপ্তি নিয়ে। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রধান চরিত্রের মৃত্যু অপ্রাসঙ্গিক। এটা দর্শকদের মধ্যে ভুল মেসেজ দেবে। কিন্তু আমি অবাক হলাম এটা ভেবে যে, ছবিতে তো প্রধান চরিত্রের মৃত্যুই হয়নি। ছুরিকাঘাতে মৃত্যুর কোনো দৃশ্যই কোথাও নেই। এভাবে একেকটা রিভিউ রিপোর্ট পড়ছি, আর আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।