এদিকে শেরপা অং শেরিংই বা ছাড়বেন কেন। ছবি তিনিও বের করলেন। একই জায়গার ছবি। একই অ্যাঙ্গেলে। সেখানে পাথরটা আছে।
ব্যাপার তো খুবই জটিল হয়ে গেল। একটা পাথর আছে, আবার নেই। কিংবা একজনের জন্য তাঁছে, আরেকজনের জন্য নেই। এই প্যাঁচ খুলবে কে?
আপনি শুনছেন তো? বিরক্ত লাগছে না তো? এবার তাহলে আরেকটা ঘটনা বলি। একটু অতীতের।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। ঘটনা বলা ঠিক হচ্ছে। আসলে একটা ছবি। ছবিটাই ঘটনা। একটা আলোকচিত্র। ছবিটা আমি পকেটে করে এনেছি। একটা পেপার কাটিং। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে কাটিং করেছি। ঢাকায় আনন্দবাজার একটা জায়গাতেই পাওয়া যায়। ধানমন্ডি দুইয়ে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে। সেখানে রিডিং টেবিলে বসে কাঁচি দিয়ে কেটে পকেটে ভরেছি। কেউ দেখেনি।
এই যে ছবিটা আপনার টেবিলে বিছিয়ে দিলাম। একটু দেখুন। কী দেখছেন? একটা লোক বসে আছে। তার চারপাশে বইপত্রের স্থপ। লোকটার নাম কেশবন। বি এস কেশবন। দক্ষিণ ভারতের লোক। বোঝাই যাচ্ছে জায়গাটা একটা লাইব্রেরি। গ্রন্থাগার। আর কেশবন এটার লাইব্রেরিয়ান। কেশবন ভারতের প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগারিক। ছবিতে তাঁকে গালে একটা হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। একটু যেন বিমর্ষ। চারপাশের স্তূপ করে রাখা বইগুলো তিনি দুই ভাগে ভাগ করছেন। কেন ভাগ করছেন? কারণ দেশ ভাগ হচ্ছে। তারিখটা লক্ষ করুন। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাস। এক মাস পরেই ইংরেজরা চলে যাবে। সবকিছু পাকাপাকি হয়ে গেছে। ভারত উপনিবেশ ভাগের প্রস্তুতি চলছে। যেখানে যা কিছু আছে, দুই ভাগ। হিসাব-কিতাব চলছে। কেশবন তার লাইব্রেরির বইপত্রও দুই ভাগ করছেন। ছবিতে দেখুন, এক পাশের বইয়ের ওপর প্ল্যাকার্ডে রোমান হরফে লেখা। ‘পাকিস্তান’। আরেক ভাগে ইন্ডিয়া।
ছবিটা তুলেছেন ডেভিড ডগলাস ডানকান নামে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক। ১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট আমেরিকার লাইফ ম্যাগাজিনে প্রথম ছাপা হয় এটা। পঞ্চাশ বছর পর ১৯৯৭ সালের আগস্টে টাইম ম্যাগাজিনে আবার ছাপা হয় এই ছবি। একেবারে প্রচ্ছদে। ভারত ভাগের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তারা প্রচ্ছদ কাহিনি করেছিল। আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ছবিটা ছাপা হয়েছে।
দেশভাগের গ্রাউন্ড রিয়েলিটি ফুটে উঠেছে সামান্য একটা ছবিতে। বিখ্যাত ছবি। আইকনিক ছবি। কিন্তু ছবিটা খুবই কনফিউজিং। রহস্য দেখা দিয়েছে ছবিটার লোকেশন নিয়ে। কেশবন লাইব্রেরির বই ভাগ করছেন। কিন্তু কোন লাইব্রেরির বই?
লাইফ ম্যাগাজিনসহ প্রথম দিককার পত্রপত্রিকায় লেখা হলো, জায়গাটা দিল্লির ইমপেরিয়াল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি। কেশবন সেটারই লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন বাদে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে কলকাতার ম্যাগাজিনগুলো দাবি করতে শুরু করল, জায়গাটা আসলে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি। কেশবন ওই সময় নাকি ছিলেন ওই লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান। নানান তথ্য-প্রমাণ দিয়ে এই দাবি তোলা হলো। সেসব তথ্যপ্রমাণ এত অকাট্য, অস্বীকার করার জো নেই। এই যে আমি আনন্দবাজার থেকে কেটে এনেছি যে ছবিটা, সেটার ক্যাপশনেও দেখুন একই কথা দাবি করা হয়েছে।
তাহলে একটা ছবি। একটা ঘটনা। কিন্তু সেটার লোকেশন দুটা। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব। অথচ একটা দৃশ্যের তো একটাই লোকেশন হবে, তা-ই না? দুটো লোকেশন তো হতে পারে না।
এই ছবির রহস্য ভেদ করতে নেমেছিলেন আনহাদ হুনদাল নামে এক ভারতীয় সাংবাদিক। ছবিটা নিয়ে নানান জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে শুরু করেন তিনি। এঁকে দেখান, তাঁকে দেখান। কেউ কিছু জানেন কিনা, জিজ্ঞেস করেন। এভাবে একদিন তিনি গেলেন অন্বেষা সেনগুপ্ত নামে এক মহিলার কাছে। অন্বেষা দেশভাগ-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। ছবি দেখে অন্বেষা বললেন, দেশভাগের সময় নানান কিছুই ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়েছিল বটে। কোনো সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ভাগ হয়নি। প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু কোনো পক্ষই সম্মত হয়নি। ফুলে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরিই হোক, আর যোক দিল্লির ইমপেরিয়াল সেক্রেটারিয়েট লাইব্রেরি, কোনোটাতেই এই দৃশ্যের অবতারণা হয়নি।
তাহলে বই ভাগাভাগির ছবিটা এল কোথা থেকে? এর জবাব দিতে পারবেন দুজন। এক, যিনি ছবিটা তুলেছেন, মানে ডেভিড ডগলাস ডানকান। দুই, যিনি ছবির বিষয়বস্তু, মানে কেশবন। ডগলাস কবে মরে ভূত হয়ে গেছেন! কেশবন এখনো বেঁচে আছেন বটে, কিন্তু স্মৃতি এমন ক্ষয়ে গেছে, ভরসা করা কঠিন। তবু নয়াদিল্লির এক শহরতলিতে তাঁর নিরিবিলি বাগানবাড়িতে গিয়ে অশীতিপর লাইব্রেরিয়ানের চোখের সামনে মেলে ধরা হলো ছবিটা। বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে কেশবন ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘লোকটা আমিই বটে। কিন্তু ঘটনাটা কখনো ঘটেনি।’
কোন ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করছেন কেশবন? লাইব্রেরি ভাগ হওয়াটা? না, মোটেও তা নয়। কেশবনের ছেলে মুকুল কেশবন বললেন, ‘বাবা বোঝাতে চাচ্ছেন, দেশভাগের ঘটনাটাই আসলে ঘটেনি।
মানে? মানে হলো, ভারত ভাগ হয়েছে–এটাই কেশবন। বিশ্বাস করেন না। আজীবন করেননি। তিনি বরাবর মনে করে এসেছেন, একটা অখণ্ড ভারতে তিনি বসবাস করছেন। ইংরেজরা চলে গেছে বটে, তবে র্যাডক্লিফের মানচিত্রটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে। ওটার আর দরকার হয়নি। শেষ মুহূর্তে মুসলিম লীগ আর কংগ্রেস লিডারদের মধ্যে একটা রফা হয়েছিল। জিন্নাহকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল। তাতে কলকাতার দাঙ্গাও আর হয়নি। লাহোরেও কাউকে কচুকাটা করা হয়নি।