‘আপনি কি ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন?’
‘না। একটু আগে টেলিগ্রাম করে এলাম, ফিরতে আরও এক মাস দেরি হবে।’
‘কী করবেন আপনি?’
‘চোরকে হাতেনাতে ধরব।’
‘কীভাবে?’
‘ফাঁদ পেতে। ঢাকায় আমার এক কবিবন্ধু আছে। আরিফ হাসান। ব্যর্থ কবি। বছর পাঁচেক আগে তাঁর একটি কবিতার বই বেরিয়েছে। এখানে আপনার এই বাগানবাড়িতে বসে বসে আমি ওই বাংলা কবিতার বইটি এখন উর্দুতে অনুবাদ করব। গোপনে। আপনি সেগুলো আবার কপি করবেন। হুবহু। তারপর আপনার নামে ওই কবিতার পাণ্ডুলিপি ছাপতে জমা দেবেন প্রকাশকের কাছে। ছাপবেন না। ছাপতে দেবেন শুধু।’
চুঘতাই তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। তার চোখ চকচক করছে।
.
১৯৬৮ সালের ৭ নভেম্বর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হয়ে গেল। বাংলা কবিতার বইয়ের নাম ছিল সময়চক্র। উর্দুতে সেটা দাঁড়াল ওঅক্ত কা সিলসিলা। প্রকাশককে দেওয়া হলো ৯ নভেম্বর। আর তখনই খবর পেলাম, ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ কবি তালাল লুধিয়ানির নতুন বই বেরিয়ে গেছে, নাম ওঅক্ত কা সিলসিলা। সেই বইয়ের জন্য তিনি অল পাকিস্তান উর্দু একাডেমির পুরস্কারও পেয়ে গেছেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমার লাহোরে পা রাখারও দেড় বছর আগে এসব ঘটে গেছে।
আমি আশ্চর্য হলাম না। আমার কাছে সবই পরিষ্কার হয়ে গেছে। লুধিয়ানি চুরি করছেন পৃথিবীর তাজ্জবতম উপায়ে। এই চুরি ঠেকানোর কোনো পথ নেই।
কিন্তু আমার পাতা ফাঁদে তাকে পড়তেই হলো।
ঢাকার কবির বাংলা কবিতা মেরে দেওয়ার অভিযোগে মামলা হলো লুধিয়ানির বিরুদ্ধে। তার চেয়েও বড় অভিযোগ, উর্দু একাডেমির সঙ্গে প্রতারণা করে পুরস্কার বাগানো। দ্বিতীয় অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো।
লুধিয়ানিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পারার কথা নয়। সময়ের জটিল গলিপথে লুকিয়ে পড়ার কৌশল তিনি জেনে গেছেন। তার লেখার কক্ষের দরজা ভেঙে পুলিশ ঢুকে দেখে, ঘর খালি। লুধিয়ানির স্ত্রীর দাবি, পুলিশ দরজা ভাঙার সময়ও ভেতরে স্বামীর গলার আওয়াজ তিনি শুনেছেন।
ওই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অন্য কোনো পথ নেই।
০৬. দ্বিখণ্ডিত
আমি পরপর কয়েকটি ঘটনা বলব। একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কহীন মনে হতে পারে। তবু একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন, প্লিজ। শুনলে এগুলোর মধ্যে একটা যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারেন। পাবেনই। আর শেষে আমি আপনাকে বলব, কেন এখানে এসেছি।
হিলারি স্টেপস কী জিনিস জানেন? জানার কথা নয়। এভারেস্ট শৃঙ্গের ঠিক আগে আগে একটা বিরাট পাথরের চাঙড়। ১২ মিটার উঁচু খাড়া একটা দেয়ালের মতো। ধরুন জেলখানার দেয়াল কত উঁচু হয়? চৌদ্দ-পনেরো ফুট হবে। সেটাই কী দুর্লঙ্ঘ্য লাগে! আর এ তো পাক্কা ১২ মিটার! যারা এভারেস্টে চড়েন, পর্বতারোহীরা, তাঁদের চোখে এটা হলো সর্বশেষ বড় চ্যালেঞ্জ। সাড়ে আট হাজার মিটারের ওপরে, অত উঁচুতে, একটা দৈব নিষেধ যেন দাঁড়িয়ে আছে–বলছে, এসো না, উঠো না। কাব্য করছি না। বইপত্রে পড়ুন, এটার কথা বলা আছে, হিলারি স্টেপসের কথা। ওইটা পার হতে বিরাট কসরত। অনেকে ওখান থেকে ফিরে আসে। কী আফসোেস দেখুন! এভারেস্টের মাত্র ৫৮ মিটার নিচ থেকে ফিরে আসা। স্বর্গের দরজায় কড়া নেড়ে ফিরে আসা আরকি।
গত সপ্তাহে পত্রিকায় একটা খবর এসেছে, আপনার চোখে পড়ার কথা। টিম মোসেডেল নামে এক ব্রিটিশ পর্বতারোহী এভারেস্ট থেকে নেমে এসে প্রেস কনফারেন্স করে বললেন, হিলারি স্টেপস আর নেই। নেই মানে, যাওয়া-আসার পথে তিনি পাথরটা দেখতে পাননি। কোথায় গেল? সম্ভবত ধসে পড়েছে। দু বছর আগে নেপালে একটা ভয়ানক ভূমিকম্প হয়েছিল, আপনার মনে থাকার কথা। মোসেডেলের অনুমান, সেটার ঝাঁকিতে পড়ে গিয়ে থাকবে পাথরটা। হতেই পারে। এ রকম ভূকম্পনের আঁকাআঁকিতে কত কিছুই তো অদলবদল ঘটে। স্বয়ং হিমালয় পর্বতখানাই তো উঠে এসেছে এমন এক তুলাধোনা ঝাঁকুনিতে।
তো, হিলারি স্টেপস নেই, ভালো কথা। না থাকলে সমস্যা তো নেই। যারা এভারেস্টে চড়বেন, তাঁদের জন্য সুসংবাদ। কিন্তু গোল বাধল এর দুদিন পরে। অং শেরিং নামে এক শেরপা কাঠমান্ডুতে পাল্টা প্রেস কনফারেন্স করে বললেন, হিলারি স্টেপস ওখানেই আছে। বহাল তবিয়তে। অং শেরিং নিজে সেটা দেখেছেন। শুধু শেরিং নন, আরও অনেক শেরপাই দেখেছেন। মোসেডেলের আগে-পরে যারা এভারেস্টে উঠেছেন, তাঁরা সবাই সেটা দেখেছেন। এখনো দেখছেন।
তাহলে ঝামেলাটা কোথায়? অং শেরিং বললেন, মোসেডেলের দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে। অতিরিক্ত তুষারে পাথরটা হয়তো এমনভাবে ঢাকা পড়ে গেছে, চোখে দেখা যায় না। কিন্তু দেখা যাক না-যাক, পাথরটা আছে। তার জায়গাতেই আছে। সরে তো যায়ইনি, একটু টালও খায়নি। যারা এভারেস্টে চড়ছেন, তাদের আগের মতোই কষ্ট করে পাথরটা ডিঙাতে হচ্ছে।
ব্যাপারটা এখানেই মিটে যাওয়ার কথা। শেরপারা যুগ যুগ ধরে এই পথ বেয়ে উঠছেন, নামছেন। জায়গাটা তাদের হাতের তালুর মতো চেনাজানা। তারা যেটা বলবেন, সেটাই ধ্রুব সত্য। কিন্তু সমস্যা হয়েছে কী, মোসেডেলও ফেলনা কেউ নন। এ নিয়ে ষষ্ঠবার এভারেস্টে চড়েছেন তিনি। এই পথ তারও কম চেনা নয়। হিলারি স্টেপসের মতো অত বড় একটা পাথরখণ্ড থাকার পরও সেটাকে নেই ভাবার মতো আনাড়ি তিনি নন। আর তা ছাড়া মোসেডেল খাঁটি ব্রিটিশ চিজ। তিনি জায়গাটার একটা ছবিও তুলে এনেছেন। তাতে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, পাথরটা নেই। চার বছর আগে পঞ্চমবার যখন এভারেস্টে চড়েছিলেন, তখনকার ছবিও দেখালেন মোসেডেল। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে একই অ্যাঙ্গেলে ভোলা ছবি। তাতে দেখা যাচ্ছে পাথরটা আছে। তার মানে মধ্যবর্তী কোনো এক সময় তা নেই হয়ে গেছে। সেটা ২০১৫ সালের ভূমিকম্পের সময় ঘটেছে বলে অনুমান করলে খুব বেশি কষ্টকল্পনা মনে হয় কি?