.
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক থেকে শুরু করে পরবর্তী দশটি বছরের উর্দু কবিতার ইতিহাস চুঘতাই আর লুধিয়ানির দ্বন্দ্বযুদ্ধের ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁদের কলম ও ঠোঁটের মধ্য দিয়ে উর্দু কবিতার দুটি শক্তিশালী স্রোতোধারা প্রবহমান হয়েছে। এই দুই সমবয়সী কবি কী করে ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে ঘোরতর শত্রু হয়ে উঠলেন, সেই গল্প লাহোরের সাহিত্য আড্ডার মুখরোচক কিংবদন্তি। তাতে সত্যের পাশাপাশি অনেক মিথ্যার খাদও মিশে আছে। যেমন কেউ কেউ বলেন, দেশভাগের পর লুধিয়ানা থেকে লাহোরে আসা মোহাজির, কপর্দকহীন কিশোর লুধিয়ানি বেশ কিছুদিন চুঘতাই পরিবারে আশ্রিত ছিলেন। সে বয়সে দুজনই ওই পরিবারের এক বয়োজ্যেষ্ঠ নারীর প্রেমে পড়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত সেখান থেকে।
কিংবদন্তি যা-ই চালু থাক, লাহোরের উত্তর অংশের বনেদি এলাকায় বেড়ে ওঠা চুঘতাই আর দক্ষিণ অংশের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মহল্লায় বসবাসকারী লুধিয়ানির কবিতার জগৎ যে ভিন্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। তরুণ বয়সে লুধিয়ানি হকিকত পসন্দ বা বাস্তববাদ নামক একটি নতুন কাব্য-আন্দোলনের জন্ম দেন। এটির দুর্বিনীত অনুসারীরা উর্দু কবিতায় চল্লিশের দশক থেকে চালু রুহানী বা মরমি ধারার কবিদের নির্দয় সমালোচনা করতেন। বলতে কি, চুঘতাই ছিলেন এই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। তিক্ত বিদিষ্ট চুঘতাই একপর্যায়ে ফরাসি প্রতীকবাদী কবিদের প্রভাববলয়ে আসেন, তাতে ষাটের দশকের মাঝামাঝি তাঁর কবিতা নতুন দিকে বাঁক নেয়। উর্দু কবিতায় প্রতীকবাদী ধারা যে দ্রুত বিকাশ লাভ করতে শুরু করে, সেটার একক কৃতিত্ব চুঘতাইকেই দিতে হবে। পরবর্তীকালে পরাবাস্তববাদী উপকরণও মিশে যেতে থাকে তাঁর কবিতায়। এ সময় চুঘতাইয়ের জনপ্রিয়তা এত বেড়ে যায় যে তিনি একপ্রকার গার্হস্থ্য নামে পরিণত হন। তাঁর কবিতার বই নেই, পুরো পশ্চিম পাকিস্তানে এমন মধ্যবিত্তের বাড়ি খুঁজে পাওয়া যেত না।
চুঘতাইয়ের জনপ্রিয়তার চাপে লুধিয়ানির বাস্তববাদী ধারাটি শুকিয়ে যেতে শুরু করে। একটা পর্যায়ে লুধিয়ানির কলম থেমে যায়। বেশ কিছুদিন তিনি নিরুদ্দেশ থাকেন। এ সময় তাঁকে ঘিরে নানা রকম গুজব ডালপালা ছড়াতে শুরু করে। বছর দুয়েক পর তিনি ফিরে আসেন এবং গুলো কি মহেক নামে তাঁর একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। সমালোচকেরা সবাই স্বীকার করেন, এই বইয়ের কবিতাগুলো লুধিয়ানির এত দিনকার প্রবণতা ও ভঙ্গিমার অনেকটাই বিপরীত। তিনি এক নতুন পথে হাঁটতে শুরু করেছেন।
কিন্তু বইটি প্রকাশের পরপরই হইচই শুরু করে দেন চুঘতাই। লাহোর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে তিনি যে অভিযোগ করেন, তা উর্দু সাহিত্যের ইতিহাসের সবচেয়ে কেলেঙ্কারিময় ইলজাম। লুধিয়ানির বিরুদ্ধে তিনি কুম্ভিলকবৃত্তির অভিযোগ আনেন। প্রমাণ হিসেবে নিজের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি হাজির করেন। ওই দিনের পর থেকে অনেককেই বলতে শোনা গেছে, ঈর্ষাকাতর চুঘতাই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছেন।
পরবর্তী দুই বছরে লুধিয়ানির আরও দুটি কবিতার বই বের হয় এবং দুবারই একইভাবে পাণ্ডুলিপি চুরির অভিযোগ আনেন চুঘতাই। দুবারই তিনি হাস্যরসের জন্ম দেন। এর পরপরই আদালতে মামলা।
.
‘লোকটা জোচ্চোর, উকিল সাহেব। এ নিয়ে মনে কোনো সন্দেহ রাখবেন না’, বললেন চুঘতাই।
আমি তার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘কিন্তু প্রমাণ তো লাগবে।’
‘ওর কবিতাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। ও লিখেছে, ‘লৌট আও বো চমনমে/ যাহা গুলাবোঁ কি পারি নিশাবাজ হো কে/শোয়ে হ্যায় ঘাস কি গালিচে পে৷’ (ফিরে এসো সেই বাগানে/যেখানে গোলাপের পাপড়ি শুকিয়ে/লুটিয়ে আছে ঘাসের গালিচায়)। এই চিত্রকল্প তৈরি করা ওর বাবার পক্ষেও সম্ভব নয়। এই ভাষা ওর নয়। আরও প্রমাণ দেব? গত দেড় বছরে আমি একটাও নতুন কবিতা লিখিনি। এই দেড় বছরে ওর নতুন বই বের হওয়াও বন্ধ। বলে কিনা রাইটার্স ব্লক।’
আমি বললাম, ‘আপনার পাণ্ডুলিপির কবিতাগুলো লেখার পর নিচে তারিখ দেওয়া থাকে না?’
প্রশ্ন শুনে চুঘতাই বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর যা বললেন, সে রকম অদ্ভুত কথা আমি জীবনে শুনিনি। তিনি বললেন, ‘ওর কবিতার বই বের হচ্ছে আমার কবিতাগুলো লেখারও আগে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ও আমার কবিতাই চুরি করছে।’
স্তম্ভিত হয়ে চুঘতাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি।
চুঘতাই বলেন, ‘আপনি বিশ্বাস করছেন না আমার কথা, তা-ই না?’
‘আপনি ব্যাখ্যা করে বলুন।’
‘আমার পাণ্ডুলিপি লেখার অন্তত ছয় মাস থেকে দেড় বছর আগে বের হচ্ছে ওর কবিতার বই। তবু বলব, ও আমার পাণ্ডুলিপিই চুরি করছে।’
‘যে পাণ্ডুলিপি লেখাই হয়নি, সেই পাণ্ডুলিপি চুরি হয় কী করে?’
চুঘতাইয়ের চোখে অসহায় চাহনি। তাঁকে নিয়ে আমার মনের মধ্যে কী চিন্তা দানা বাঁধছে, তিনি বোধ হয় টের পেতে শুরু করেছেন।
.
চুঘতাইদের বাগানবাড়ির দোতলার বারান্দায় সারা রাত বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবলাম আমি। ভোরের দিকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।
নাশতার টেবিলে চুঘতাইয়ের মুখোমুখি বসে বললাম, ‘উপমা-উৎপ্রেক্ষা, কবিতার শব্দচয়ন প্রবণতা, চিত্রকল্প তৈরির কৌশল–যা-ই বলুন, এগুলো কিছুই এজলাসে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে কাজে লাগবে না।’