কিন্তু আমি এই সব কেন করব?
করবেন এক ধরনের জুস্যাডিজম থেকে। পশুদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে মর্ষকামী লোক যে কারণে মজা পায়। আপনি এক ধরনের জুস্যাডিস্ট।
ধরুন আমি জুস্যাডিস্ট। কিংবা ব্যাকরণ মেনে যদি বলি, ধরুন আমি রোবো-স্যাডিস্ট। তাতে?
এটা প্রমাণিত হলে আপনার সাজা হবে। নতুন আইন বড় কড়া।
কী সাজা?
আর্টিকেল টোয়েন্টি এইটের সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী, আপনার নামের পাশে লাল কালিতে দাগ পড়ে যাবে। শুধু মেট্রোনোম সিরিজের নয়, ভবিষ্যতে কোনো বর্গের, কোনো সিরিজের, কোনো হাইপার-অ্যান্ড্রয়েডই আপনি আর কমিশন করতে পারবেন না। মোটা অঙ্কের জরিমানাও গুনতে হতে। পারে।
আমার আর্থিক সামর্থ্য সম্পর্কে আপনার ভালো ধারণা নেই। আমি এখন উঠব।
আমি কি আপনার সঙ্গে যেতে পারি?
কোথায়?
শোক অনুষ্ঠানে?
না। পারেন না। আপনার সঙ্গ আমার অসহ্য লাগছে।
আমার আরও কিছু বলার আছে। সেটা যেতে যেতে বলি?
.
গাড়ি ছুটে চলেছে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে।
আমি পাশে বসা লোকটার কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করছি। লোকটা আবার সেই খাতা খুলে কলম হাতে বসেছে। কিছুই লিখছে না। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এ তো খুবই ভোগাবে দেখছি।
লোকটা বলল, আপনার স্ত্রীর দুর্ঘটনা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক।
আমি চুপ করে থাকি।
গাড়িটা কি আপনিই চালাচ্ছিলেন?
হ্যাঁ।
শুনছি এটা নিয়ে এক ধরনের কানাঘুষা শুরু হয়েছে।
কী রকম?
মানে নিন্দুকেরা যা করে আরকি। আপনার তো শত্রুর অভাব নেই। তারাই হয়ত ছড়াচ্ছে।
কী বলে তারা?
বাদ দিন। আমরা ওই রোবটটার প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
মেট্রোনোম হাইপার-অ্যান্ড্রয়েড সিরিজের?
লোকটা আমার দিকে তাকায়। আমার কণ্ঠস্বরের ঠেসটা ধরতে পেরেছে মনে হলো।
হ্যাঁ। বি-টু-সিক্স সিরিজের। ওটার প্রতি যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হতো, তার প্রমাণ আমরা কীভাবে পেলাম, অনুমান করতে পারেন?
পারি। আমার স্ত্রীর ডায়েরি থেকে। ও নিয়মিত ডায়েরি লিখত, আমি জানি।
আপনি বুদ্ধিমান।
একটা মুচকি হাসি ঝুলিয়ে রেখে লোকটা আবার চুপ করে বসে থাকে। নীরবতা ভাঙতে আমি নিজে বাধ্য হয়ে কথা বলি।
একটা ব্যাপার আমাকে বুঝিয়ে দিন তো, আমার বাসায় একটা অত্যন্ত সেকেলে হাউসহোল্ড রোবটের প্রতি নির্দয় আচরণ করা হতো, তা-ও বছর সতের আগে, এটা প্রমাণ করা আপনার জন্যে এত জরুরি কেন?
আইন-কানুন বদলেছে। অনেক কিছুতে এখন কড়াকড়ি।
বাজে কথা রাখুন। আমি অত গর্দভ না যে কিছুই আঁচ করতে পারব না। আপনি এসেছেন আমার স্ত্রীর মৃত্যুরহস্য তদন্ত করতে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আসল কথায় না গিয়ে আপনি গৃহকাজে নিযুক্ত একটা নগণরোবটের কথা বার বার আনছেন কেন।
কারণ আমি যদি প্রমাণ করতে পারি, আপনি রোবটটার প্রতি নির্দয় আচরণ করতেন, জেনেশুনে করতেন, কোনো কারণ ছাড়া শুধু এক ধরনের বিকৃত আনন্দ পাওয়ার জন্য করতেন, তাহলে প্রমাণ হয়ে যাবে, আপনার স্ত্রীর ওই দুর্ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা ছিল না। যেটা কানাঘুষা চলছে, সেটাই আসলে ঠিক–আপনি তাকে হত্যা করেছেন।
আমি তাকিয়ে থাকি লোকটার দিকে। নিরীহ লোকটার সাহসের তারিফ করতে হয়।
লোকটা বলল, যোগসূত্রটা ধরতে পারছেন না? আচ্ছা, বঝিয়ে দিচ্ছি। সুয়েতোনিয়াস নামে এক রোমান ইতিহাসবিদ ছিলেন, নাম শুনেছেন?
আবার বক্তৃতা!
উনি ১২ জন রোমান সম্রাটের ওপর একটা বই লিখেছিলেন, নাম দ্য টুয়েলভ সিজারস। সেখানে দোমিন নামে এক সম্রাটের কথা বলা আছে। দোমিতানের একটা খুব বিদঘুঁটে স্বভাব ছিল। তিনি নানা রকম পোকামাকড় ধরতেন। তারপর সুচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেগুলো হত্যা করতেন। দিনের বড় একটা সময় তিনি ব্যয় করতেন এ কাজে।
তো?
গুজব চালু আছে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন।
অর্থহীন কথাবার্তা।
এবার আসি আসল কথায়। নতুন ধারার অপরাধবিজ্ঞানের একটা বড় মাথাব্যথা হলো, খুনি ব্যক্তির আচরণের কিছু সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন বের করা, যাতে আগাম ইন্টারভেন করা যায়। এ ক্ষেত্রে হোমিসাইডাল ট্রায়াড় নামে একটা ধারণা অপরাধবিজ্ঞানে প্রায় ধ্রুব সত্যের মর্যাদা পেয়ে গেছে। এটার আদি নাম ছিল ম্যাকডোনাল্ড ট্রায়াড়। গবেষণা করে দেখা গেছে, বিশেষ তিনটা চরিত্র-বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ যদি কারও মধ্যে দেখা যায়, তাহলে একশ ভাগ সম্ভাবনা, লোকটা খুনি হবে। তবে এর জন্যে তিনটা বৈশিষ্ট্যই থাকতে হবে। একটা বা দুটা থাকলে হবে না।
তো, কী সেই তিন বৈশিষ্ট্য?
প্রথমটা হলো, লোকটার তোতলানোর স্বভাব থাকবে। ছোট বেলায় তো বটেই, বড় হয়েও। দ্বিতীয়ত, আগ্নেয়াস্ত্রের প্রতি লোকটার থাকবে অন্ধ আকর্ষণ। ছোটবেলায় খেলনা অস্ত্রের প্রতি। বড় হয়ে সত্যিকার আগ্নেয়াস্ত্র। আপনার মধ্যে দুটি লক্ষণই পূর্ণমাত্রায় দেখা গেছে। ম্যাকডোনাল্ড ট্রায়াডের তৃতীয় লক্ষণটি হলো রোবটদের প্রতি নিষ্ঠুরতা। এবং এটা আপনার স্বভাবে আছে বলে আমি আদালতে প্রমাণ করতে পারব।
প্রমাণ হলে?
আদালত আর বাড়তি কোনো প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করবে না। এটা অনেকটা গণিতের মতো। আপনার ফাঁসি হয়ে যাবে। নতুন সাক্ষ্য আইনে এখন ম্যাকডোনাল্ড ট্রায়াডকে বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। এটা অনেকটা মেন্টাল ফিঙ্গারপ্রিন্টের মর্যাদা পায়। বলতে পারেন, এটাই সিনেটের অ্যান্ড্রয়েড ককাসের এযাবকালের সবচেয়ে বড় সাফল্য। আমি এখন নামব। সামনের ওই মোড়টায় আমাকে নামিয়ে দিলেই চলবে।