মানে?
আপনি একটা রোবট কমিশন করেছিলেন। মেট্রোনোম হাইপার-অ্যান্ড্রয়েড বি-টু-সিক্স সিরিজের।
সে তো সতেরো বছর আগের কথা। সেটা এখন আর আমার সঙ্গে নেই।
কিন্তু আপনি সেটা ডিকমিশন করেননি।
করিনি। ভুলে গেছি। তাতে হয়েছেটা কী?
এগুলোকে এখন আর মামুলি গাফিলতি হিসেবে দেখা হয় না। নতুন কিছু আইন-কানুন হয়েছে। রোবটদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের ব্যাপারে এখন অনেক কড়াকড়ি। আমাদের কমিশন এখন আর ছোট প্রান্তিক দপ্তর নেই। একটা পূর্ণাঙ্গ সরকারি ডিপার্টমেন্টের অধীনে চলে গেছে।
হুম। শুনেছি সিনেটে নাকি কোটা চাওয়া হচ্ছে। অ্যান্ড্রয়েড কোটা। রোবটরা বসবে সিনেটে! হাস্যরসের একটা সীমা থাকা উচিত।
সিনেটে বসতে দেওয়ার দাবি মানা হয়নি বটে। তবে তাদের জোর আন্দোলন একেবারে বিফলে গেছে, বলা যাবে কি? বিশেষ করে টানা সতেরো দিনের ধর্মঘটের পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত সিনেটের একটা বিশেষ ককাস তো গঠন করতেই হলো। চাকা কিছুটা তো ঘুরেছে। সেটাই বা কম কী! এই ককাস এখন রোবটদের দিকটা দেখাশোনা করে। আমাদের কমিশন তাদের কাছেই জবাবদিহি করে। রিপোর্টের একটা কপি সেখানে যায়।
মানে আপনি এখানে সিনেট কমিটির প্রতিনিধিত্ব করছেন, বলতে চান নাকি?
ঘুরপথে তো তা-ই বটে।
কী সাংঘাতিক। আসল কথায় আসুন।
আপনি একটা মেট্রোনোম হাইপার-অ্যান্ড্রয়েড কিনেছিলেন।
একবার বলেছেন কথাটা। কিন্তু আপনি সেটা ডিকমিশন করেননি। মানে ফেরত দেননি। অথচ সেটা এখন আর আপনার সঙ্গে নেই।
নেই, হারিয়ে গেছে। কিংবা স্ক্র্যাপ করেছি। কবেকার কথা।
আমাদের মনে হয়েছে, এ ক্ষেত্রে আপনার বিরুদ্ধে আর্টিকেল টোয়েন্টি এইট ট্রিগার করার অবকাশ আছে।
হোয়াট! সেটা আবার কী?
বুঝিয়ে বলছি। টোয়েন্টি এইট আওয়ার ল-এর কথা শুনেছেন? অনেক পুরোনো একটা আইন।
শুনিনি।
১৮৭১ সালে আমেরিকায় রেলওয়ে কোম্পানির জন্যে শুরুতে এই আইনটা তৈরি করা হয়েছিল। রেলের ওয়াগনে পশু পরিবহনের ক্ষেত্রে কতগুলো মান্য নিয়মকানুন। রেলযাত্রা যদি একটানা ২৮ ঘণ্টার বেশি লম্বা হয়, সে ক্ষেত্রে ওয়াগনে পরিবহন করা পশুর কতগুলো বিশেষ যত্ন নিশ্চিত করতে হয়। যেমন ধরা যাক, নির্দিষ্ট একটা সময় পরপর দানাপানি দেওয়া এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর ট্রেন থামিয়ে জানালাগুলো খুলে দেওয়া, যাতে আলো-বাতাস প্রবেশ করে।
রেল কোম্পানির একটা প্রাচীন আইন এখানে কীভাবে প্রাসঙ্গিক?
ওই যে জানালা খুলে দেওয়া, আলো-বাতাস চলাচলের কথা বলা হচ্ছে, ওইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার।
বুঝিনি।
বলছি। অ্যান্ড্রয়েড বা রোবটদের অধিকার নিয়ে যখন আইন কানুন তৈরি করা শুরু হলো, তখন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটা ব্যাপার ঘটল। বেশির ভাগ বিধিবিধান ধার করা শুরু হলো উনবিংশ শতাব্দীর পশু অধিকার-সংক্রান্ত আইন-কানুন থেকে। শিল্প বিপ্লবের কারণে উনবিংশ শতকে পশুপাখি আর মানুষের মধ্যেকার দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছিল। ফলে মানবেতর পশুদের অধিকারের দাবি উঠতে শুরু করে। এবার ফিফথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোলিউশনের যুগে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এবার পশুদের জায়গায় রোবট বা অ্যান্ড্রয়েড। রোবট অধিকার সংরক্ষণে এযাবকালের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ আর্টিকেল টোয়েন্টি এইট এসেছে রেল ওয়াগনের ওই আইন থেকে।
আমার একটু তাড়া আছে। একটা শোক অনুষ্ঠানে যেতে হবে। লোকজন অপেক্ষা করছে। আইনের ইতিহাসবিষয়ক ক্লাস লেকচার শোনার মুডে আমি এখন নেই।
জানি। আপনার স্ত্রীর শোক অনুষ্ঠান। অতি সম্প্রতি আপনার যে একটা পারিবারিক ট্রাজেডি ঘটে গেছে, সেটা শুনেছি। আমি সমব্যথী। যে কথা বলছিলাম, আপনি যে বি-টু-সিক্স সিরিজের মেট্রোনোম হাইপার-অ্যান্ড্রয়েড কমিশন করেছিলেন, সেই সিরিজটার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলোর বাইরের অবয়ব সেকেলে ধাঁচের, একেবারে প্রথম যুগের রোবটদের মতো, যখন রোবটেরা দেখতে রোবটের মতো ছিল। নস্টালজিক লোকেরা এভাবেই চায়। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, সিরিজটা নিঃসঙ্গ বুড়োবুড়িদের জন্য কাস্টমাইজ করা। ফলে এগুলোর মধ্যে বিশেষ কিছু অ্যালগরিদম প্রোগ্রামড় করে দেওয়া হয়েছে। যেমন ধরুন, এরা নিঃসঙ্গতা একেবারেই সহ্য করতে পারে না। নির্জনতা এদের মধ্যে তীব্র সাফোকেশনের অনুভূতি তৈরি করে। আতঙ্কে এরা পাগলের মতো হয়ে যায়। এক ধরনের অ্যাকিউট সাইকোলজিক্যাল ট্রমার ইলেকট্রনিক প্রতিরূপ আরকি। এই বিশেষ সিরিজের আরেকটা চরিত্র-বৈশিষ্ট্য হলো অ্যাকলুফোবিয়া।
সেটা কী জিনিস?
অন্ধকারভীতি। অন্ধকারে এদের দশা যে কী করুণ হয়, চিন্তা করা যায় না! অবর্ণনীয়! বীভৎস!
তো, সমস্যা কী?
সমস্যা হলো, এই চরিত্র-বৈশিষ্ট্যগুলো আপনি জানতেন। ভালো করে জানতেন। কেনার সময় ম্যানুয়েল দেওয়া হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী এক দিনের একটা সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণও আপনাকে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের কাছে তথ্য আছে, আপনি আপনার ওই হাইপার-অ্যান্ড্রয়েডটাকে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা অন্ধকার ঘরে আটকে রাখতেন।
বাজে কথা।
এবং আপনি সেটাকে একা বাড়িতে তালাবদ্ধ করে রেখে মাঝে মাঝে প্রমোদভ্রমণে বের হতেন। কয়েক দিনের জন্যে। পুরো বাড়িতে একটা মেট্রোনোম হাইপার-অ্যান্ড্রয়েড একা। এর চেয়ে নিষ্ঠুর আচরণ আমরা চিন্তা করতে পারি না।