কিন্তু শিগগিরই বোঝা গেল, এই নাভিরজ্জুর ভেতর দিয়ে অতি সীমিত কিছু নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কোনো কিছুরই বিনিময় সম্ভব নয়। আর সেটাই সম্ভবত সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পরিস্থিতি। দুটি জগৎ যখন আপাদমস্তক ভিন্ন কাঠামোয় গড়া হয়, দুটি জগতের অভিজ্ঞতার যখন কোনো অভিন্ন রেফারেন্স বিন্দু থাকে না, তখন দুই জগতের মধ্যে নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার বিনিময় ছাড়া আর কীই-বা ঘটা সম্ভব?
আগেই বলেছি, আমার উন্মার্গগামী বন্ধু এই অভিজ্ঞতার গাণিতিক কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টায় নিমগ্ন হলো। সে চাইছিল, এর ভেতর দিয়ে অপর মহাবিশ্ব সম্পর্কে যতটা পারা যায়, তথ্য সংগ্রহ করা। কিন্তু আমাদের কাঁচামাল বড়ই সীমিত। আর এগুলো থেকে আমরা শেষ পর্যন্ত কোনো বোধগম্য বিবরণে পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। অজন্তার মন্দিরগুহায় জ্যাকসন পোলকের চিত্র এঁকে রাখলে একজন পূজারি যেমন শূন্য চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকবে, আমাদের অন্তঃসারশূন্য গাণিতিক বিবরণগুলোর দিকেও আমরা তাকিয়ে ছিলাম সেভাবে।
আমি অনুমান করলাম, সমস্যাটা কিছু পরিমাণে ভাষাতাত্ত্বিক হতে পারে, যদিও ভাষাতত্ত্বের মৌলিক স্বীকার্যগুলো সম্পর্কে আমার খুব বেশি ধারণা ছিল না। আমার অজ্ঞতাই এ ক্ষেত্রে বরং আমাকে সৃজনশীল করে তুলছিল। আমি বললাম, আমাদের পার্থিব ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের নন্দনতাত্ত্বিক নির্মাণের যে সম্পর্ক, সেটার কোনো গাণিতিক কাঠামো যখন দাঁড় করানো যাবে, তখন যেকোনো নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতাই গাণিতিক কাঠামোয় রূপান্তরযোগ্য হবে। ভেঙে সহজ করে বললে, ক্যানভাসে ভেসে ওঠা ছবির সঙ্গে তুলি নামক বস্তু আর রঙের পিগমেন্টের নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্ককে গাণিতিক কাঠামোয় রূপ দিতে হবে। ছবি একটা চিন্তামাত্র, এটা এক পরিবর্তনশীল অস্থির প্রবাহ, যার ভেতরে অনবরত চিহ্ন আর অর্থের জটিল মিথস্ক্রিয়া চলছে। ছবি নামক এই চিন্তাপ্রবাহের সঙ্গে রঙের পিগমেন্ট, তার্পিন তেল আর ক্যানভাসের সুতার বুননের কোনো না কোনো যোগসূত্র। অবশ্যই আছে, তা যত পরোক্ষই মনে হোক না কেন। সেটাকে গাণিতিক কাঠামোয় রূপান্তর করতে পারলে আমরা সেখান থেকে উল্টো পথে ভিন্ন আরেক ধরনের রঙের পিগমেন্ট, ভিন্ন আরেকটা তুলি আর সেই সঙ্গে সেই তুলি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভিন্ন আরেক শিল্পীকে পুনর্নির্মাণ করতে পারব। আর সেখান থেকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা সম্ভব হবে পুরো একটা মহাবিশ্ব, এমন একটা জগৎ–যেটা আমাদের মতো নয়।
ক্যানভাসে তুলি চাপানোর সাড়ে চার মাস পর একদিন টের পেলাম, আমাদের ছবিটি আঁকা হয়ে গেছে। একজন শিল্পী কখন ঠিক করেন, তাঁর শিল্পকর্মটি পরিপূর্ণ হয়েছে, সেটা এক জটিল রহস্য বটে। কিন্তু এই ছবির ক্ষেত্রে আমি এবং আমরা দুজনেই সম্ভবত একই সময়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই।
ছবিটা শেষ করে আমি ইজেল থেকে বেশ কিছুটা সরে এসে তাকাই ক্যানভাসের দিকে। আমি নিশ্চিত অপর প্রান্তে, স্থানের জটিল, অপার নদীর ভিন্ন পাড়ে অবস্থানকারী সেই শিল্পীও একইভাবে তাকিয়ে আছে এই ক্যানভাসের দিকে। আমরা কি একই ছবি দেখছি? একই অবয়ব? তারও পাশে কি তাঁর কোনো গণিতবিদ বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে? শিল্প-অভিজ্ঞতার ভিন্ন এক গাণিতিক কাঠামো দাঁড় করানোর প্রাণান্ত চেষ্টা কি চালিয়ে যাচ্ছে সেই গণিতবিদও? আমরা সফল হইনি, কিন্তু যদি সেই গণিতবিদ সফল হয়ে থাকেন? আমরা কি কোনো দিনও জানতে পারব তাঁর সাফল্যের বার্তা? আমি আমার বসন্তকালীন প্রদর্শনীতে টাঙালাম এই ক্যানভাস। গ্যালারিতে আর দশটা ক্যানভাসের পাশে সাদামাটাভাবেই রাখা হলো এটা। দর্শকেরা যখন এটার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, আমি সাবধানে তাকাচ্ছি তাদের চোখের দিকে, বিস্ময়ের কোনো অচেনা অনুভূতির চিহ্ন খুঁজছি আমি সেখানে। আর তখন নিজের অজান্তে কল্পনা করছি ভিন্ন একটা গ্যালারির কথা, ভিন্ন একসারি দর্শক আর তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা কৌতূহলী অন্য এক শিল্পীর চেহারা।
০৪. ভেতরে আসতে পারি?
আমি এসেছি কমিশন থেকে।
কমিশন মানে?
কমিশন ফর এলিমিনেশন অব জুয়েলটি টুওয়ার্ডস রোবটস। অনেক বড় নাম। সংক্ষেপে কমিশন বললেই সবাই বুঝে যায়। আপনার সময় হবে?
আমি ভালো করে তাকালাম লোকটার দিকে। একটা সানগ্লাস পরে আছে। গায়ে একরঙা টি-শার্ট। বয়স চল্লিশের কোঠায়। কেমন। চালাক চালাক একটা ভাব। দেখে সরকারি লোক মনে হয় না।
বললাম, আমার একটু তাড়া আছে। বের হব।
সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা সময় নেব।
আসুন।
লোকটা ঘরে ঢুকে সোফায় বসল। লক্ষ করলাম, তার হাতে একটা ছোট্ট বাহারি নোটবুক, স্কেচ খাতার মতো দেখতে। সেটা খুলে লোকটা কলম হাতে নিয়ে বসল।
বলুন, কী করতে পারি?
আমি কমিশনের ফিল্ড ইন্সপেকটর। আমাদের কমিশন সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে আপনার?
সামান্য।
রোবটদের ওপর কোনো নিষ্ঠুরতা, তাদের প্রতি রূঢ় আচরণের কোনো অভিযোগ পেলে আমরা সেটা ফার্স্ট হ্যান্ড ইন্সপেক্ট করি। কিছু ফর্ম পূরণ। আমাদের জোনাল অফিস একটা রিপোর্ট জেনারেট করে। সেটা কয়েকটা ডিপার্টমেন্টে যায়। এইটাই রুটিন।
কোনো অভিযোগ গেছে?
যায়নি।
তাহলে?
সেটাই খতিয়ে দেখতে এসেছি। কেন যায়নি।