পরদিন শামীম আলেক্সকে একটা ই-মেইল পাঠালো :
প্রিয় আলেক্স:
আমি জানি তুমি বিশ্বাস করবে না, তারপরও আমি তোমাকে লিখছি। বিশ্বাস কর সাথে যে ছবিটা পাঠাচ্ছি সেটা সত্যি। আমার বাজায় বড় একটা একুয়ারিয়ামে ছোট একটি মেয়ে, বয়স সম্ভবত আটচল্লিশ ঘণ্টায় বেশি নয়। সে পানির নিচে শান্ত হয় ঘুমাচ্ছে, সে ফুসফুস দিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে না, নিশ্বাস নিচ্ছে তার তুক দিয়ে। তার শরীরে একটা রূপালী আভা লক্ষ্য করেছ? এটা এসেছে ত্বকের ওপরে খুব সূক্ষ্ম একটা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের আস্তরণ থেকে, নিশ্বাসের সাথে যেটা বের হয়ে আসছে। এই মুহূর্তে আমি কোনো ঝুঁকি নিচ্ছি না, একটা পাম্প দিয়ে পানিতে অক্সিজেন মিশিয়ে যাচ্ছি।
মেয়েটির খুব খারাপ ধরনের নিমোনিয়া হয়েছিল, এইটুকুন শরীরে অনেক এন্টিবায়োটিক গিয়েছে। কাল থেকে আজকে সে অনেক খানি ভালো!
তোমার কী মনে হয়? জীব বিজ্ঞান বই কী নূতন করে লিখতে হবে?
শামীম।
পুনঃ ছবিটি, তোমার জন্যে-সাংবাদিকেরা হাতে পেলে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।
দুই মিনিটের ভেতর শামীম আলেক্সের কাছ থেকে একটা উত্তর পেলো:
প্রিয় শামীম,
আমি আসছি।
আলেক্স
পুনঃ আমার জন্যে বেশি করে ঝাল দিয়ে ভারতীয় কায়দায় মুরগির মাংস রান্না করে রেখো।
পুনঃ পুনঃ মৎস্যকন্যার জন্যে সম্ভাব্য কিছু ওষুধ, এন্টিবায়োটিক হরমোন, স্টেরয়েড, নিউট্রিয়েন্ট আনছি। কাস্টমস আটকালে উদ্ধার করার ব্যবস্থা রেখো।
০৩. তেরো বছর পর
তেরো বছর পর
পুকুরের বাঁধানো ঘাটে শুয়ে শামীম আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। গভীর নীল আকাশ। সেই আকশে এক চিলতে মেঘ। সেই মেঘের কাছাকাছি একটা চিল উড়ছে। সত্যিই কী উড়ছে, নাকী ভেসে আছে? দুটি পাখা মেলে ধরে আকাশে কী সহজে একটা চিল ভেসে থাকে। কেমন করে ভেসে থাকে?
শামীম উঠে বসে পুকুরের দিকে তাকাল, পুকুরের স্থির পানিতে একটু ঢেউ নেই, একটু আলোড়ন নেই, মনে হয় পুকুরের পানি নয়, সময় বুঝি স্থির হয়ে আছে। পুকুরের কাচের মতো স্থির পানিতে বড় বড় গাছের ছায়া পড়েছে, সেই ছায়াগুলোও স্থির। শামীম নিজের ভেতরে এক ধরনের বিষণ্ণতা অনুভব করে, কেন তার ভেতরে এই অকারণ বিষণ্ণতা সে জানে না। শামীম একবার আকাশের চিলটিকে দেখে আবার পুকুরের স্থির পানির দিকে তাকাল, এই মুহূর্তে সেরিনা পানির নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কতোক্ষণ থেকে সে পানির নিচে আছে কে জানে! পয়তাল্লিশ মিনিট? এক ঘন্টা? নাকী আরো বেশি?
তেরো বছর আগে অজানা অচেনা একটা গ্রামের ডোবায় সেরিনাকে কোচ দিয়ে একজন প্রায় গেঁথে ফেলছিল, শামীম শেষ মুহূর্তে তাকে বাঁচিয়েছিল। টাওয়েলে পেঁচিয়ে নিয়ে এসে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। গরিলার মতো একজন ডাক্তার ঠিক করে সেরিনার চিকিৎসা করতে রাজী হয় নি বলে শামীম সেরিনাকে তার বাসায় নিয়ে এসেছিল। তাকে বাসায় নিয়ে এসেছিল বলে সে বুঝতে পেরেছিল সেরিনা অন্য সবার থেকে ভিন্ন। সালামান্ডারের মতো কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মার্ক্সপিয়াল জুলিয়া ক্রিক ডুনার্টের মতো সেরিনা ত্বক দিয়ে নিশ্বাস নিতে পারে। শামীমের মনে হয়, মাত্র সেদিনের ঘটনা যখন সেরিনার কথা শুনে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে পরের দিন আলেক্স এই দেশে চলে এসেছিল। পুরো এক মাস আলেক্স সেরিনার পাশে পাশে ছিল। এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা নিয়ে যেন সুস্থ মানুষের মতো বেঁচে থাকতে পারে সে জন্যে আলেক্স একটু একটু করে সেরিনাকে প্রস্তুত করেছে। সেরিনার রক্তটাকে পরিশুদ্ধ করেছে, ত্বকটাকে কোমল করেছে, লোমকূপকে বিস্তৃত করেছে, রক্তনালীকে স্পষ্ট করেছে। ফুসফুঁসে নিমোনিয়াকে দূর করেছে। সেরিনা নামটিও আলেক্সের দেওয়া, গ্রীক উপাখ্যানে মৎস্যকন্যার নাম ছিল সাইরেন-সাইরেন থেকে সেরিনা।
এক মাস পর আলেক্স ওয়াশিংটন ডিসি ফিরে গিয়েছিল। সেরিনার পরিচয় গোপন রেখে আলেক্সের নেচারে একটা প্রবন্ধ লেখার কথা ছিল। সেই প্রবন্ধ আর লেখা হয় নি। আলেক্স ছুটি কাটাতে মাউন্ট রেইনিয়ারের চূড়ায় উঠতে গিয়ে বরফ ধ্বসে হারিয়ে গেল। শামীমের কী অবাক লাগে, একজন মানুষ কী সহজে হারিয়ে যায়।
শামীম কখনো ভাবে নি অজানা অচেনা একটা গ্রামের ডোবায় পরিত্যক্ত একটি নবজাতককে নিয়ে সে আবার নিজের জীবন শুরু করবে। শাহানা আর রিতু মারা যাবার পর তার জীবনটা ছিল খাপছাড়া, সে ঠিক করে নিয়েছিল বাকী জীবনটা এভাবেই কাটিয়ে দেবে। কিন্তু সেরিনার কারণে আবার তার সব হিসেব ওলট পালট হয়ে গেল। এই মেয়েটি যেন সুন্দর সুস্থ একটা জীবন পেতে পারে শামীম তার সব ব্যবস্থা করতে শুরু করেছিল, তখন একদিন রাতে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবার জন্য কোলে নিয়েছে তখন হঠাৎ করে অবোধ শিশুটি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিল। এক মাসের শিশু সত্যি সত্যি কারো চোখের দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ ভাবে হাসতে পারে কী না সেটা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে কিন্তু শামীম কোনো আলোচনার মাঝে গেল না। সেই অর্থহীন হাসিটি তার বুকের ভিতর সবকিছু ওলট পালট করে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে শামীম ঠিক করল সেরিনাকে সে নিজের সন্তান হিসেবে বড় করবে। তার খাপছাড়া অগোছালো জীবনটাকে আবার নূতন করে সাজাতে হল। মফস্বলের একটা শহরে সে এসে স্থায়ী হল। শহরতলীতে বড় জায়গা নিয়ে তার বাসা। বাসার পাশে বড় পুকুর। সেই পুকুরের ঘাটে সে এখন বসে আছে, গভীর পুকুরের কালো পানির নিচে সেরিনা সাঁতার কাটছে।