- বইয়ের নামঃ সুহানের স্বপ্ন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. দ্রুমান ইঞ্জিন
রিশি মনিটরে একটা গ্রহকে স্পষ্ট করতে করতে বলল, আমি আমার জীবনে যতগুলো গ্রহ দেখেছি তার মাঝে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে এই গ্রহটা।
টিরিনা তার অবাধ্য চুলগুলোকে পিছনে সরিয়ে বলল, কেন? তুমি হঠাৎ এই গ্রহটার বিপক্ষে প্রচার শুরু করছ কেন? একটা গ্রহ হচ্ছে গ্রহ-তার মাঝে আবার ভালো খারাপ আছে নাকি?
থাকবে না কেন? একশবার থাকবে।
টিরিনা মুখ টিপে হেসে বলল, কী রকম?
মনে কর যে গ্রহে খোলা আকাশ, নিশ্বাস নেবার মতো বাতাস আর পানিতে ঢাকা বিশাল বিশাল সাগর বা হ্রদ আছে সেটা হচ্ছে ভালো গ্রহ। যে গ্রহে সেগুলো নেই সেটা হচ্ছে খারাপ গ্রহ।
টিরিনা খিলখিল করে হেসে বলল, তার মানে তুমি আসলে পৃথিবীকে ধরে নিয়েছ আদর্শ গ্রহ—যে গ্রহ যত বেশি পৃথিবীর কাছাকাছি সেই গ্রহ তোমার কাছে তত ভালো।
রিশিকে এক মুহূর্তের জন্য একটু বিভ্রান্ত দেখায়, সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, সেটা কি খুব অযৌক্তিক ব্যাপার হল? এখন না হয় আমরা সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছি—কিন্তু একসময় তো আমরা সবাই পৃথিবীতেই থাকতাম। আমাদের শরীরের বিবর্তন হয়েছে পৃথিবীর পরিবেশের উপযোগী হয়ে কাজেই পৃথিবীর মতো গ্রহকে ভালো বললে তোমার এত আপত্তি কেন?
টিরিনা হাসল। বলল, মোটেও আপত্তি নেই। আমি শুধু বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছি।
রিশি টিরিনার মুখে সূক্ষ্ম হাসি আবিষ্কার করে মুখটা অকারণে কঠোর করে বলল, উহুঁ, তুমি বোঝার চেষ্টা করছ না।
তা হলে আমি কী করছি?
তুমি আমার সাথে কৌতুক করার চেষ্টা করছ।
টিরিনা আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল, ঠিক আছে সেটাই না হয় হল—এটাও কি খুব বড় অপরাধ? আমরা দুইজন একটা মহাকাশযানে করে প্রায় আস্ত একটা গ্যালাক্সি পার হয়ে যাচ্ছি। বেশিরভাগ সময় কাটে আমাদের হিমঘরে। লিকুইড হিলিয়াম তাপমাত্রায় জমে পাথর হয়ে থাকি। দশ-বারো বছরে এক-আধবার আমাদের জাগিয়ে তোলা হয়। কিছুদিন আমরা জেগে থাকি তখন তোমার সাথে আমি কৌতুকও করতে পার না?
রিশি বলল, না সেটা আমি বলি নি। কৌতুক করতে পারবে না কেন, অবশ্যই পারবে। মানুষের যদি কৌতুকবোধ না থাকত তা হলে তারা মনে হয় এখনো বিবর্তনের উল্টো রাস্তায় গিয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত।
টিরিনা চোখ বড় বড় করে রিশির দিকে তাকিয়ে বলল, তা হলে তোমার ধারণা বিবর্তনে আমরা ঠিক দিকেই এগুচ্ছি?
রিশি বলল, কেন? তোমার কি সন্দেহ আছে নাকি?
কী জানি? টিরিনা কাধ কঁকিয়ে বলল, এই আমাদের ছোটাছুটি দেখে মনে হয় বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালেই বুঝি ভালো ছিল। তুমি দেখেছ আমরা এখন এক মুহূর্ত বিশ্রাম নিই না। দিশ-বারো বছরে একবার আমাদের হিমঘর থেকে বের করে, আমরা তখন ছোটাছুটি করতে থাকি। ইঞ্জিন পরীক্ষা করি, জ্বালানি পরীক্ষা করি, ট্রাজেক্টরি পরীক্ষা করি, মনিটরের আসনে বসে থাকি—তোমার কি ধারণা এটা খুব চমৎকার একটা জীবন?
রিশি একটু অবাক হয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে টিরিনা? আমি ভেবেছিলাম তুমি খুব আগ্রহ নিয়ে এই স্পেসশিপে এসেছিলে! হঠাৎ করে খেপে গেলে কেন?
টিরিনা হাসল। বলল, না খেপি নি। এগুলোও বিবর্তনের ফল, মেয়েদের শরীরে অন্যরকম হরমোন থাকে—তোমরা ছেলেরা সেটা বুঝবে না। ছেলেরা এসব বিষয়ে একটু ভোতা হয়
এবারে রিশি হা হা করে হেসে উঠল, বলল, তোমার কপাল ভালো মহাকাশযানে শুধু আমি আর তুমি! অন্য কেউ হলে পুরুষ জাতির বিরুদ্ধে অশোভন উক্তি করার জন্য তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করে দিত, পঞ্চম মাত্রার অপরাধ হিসেবে তোমার এতক্ষণে বিচার হয়ে যেত।
ভারি তোমার বিচার—তোমার এই বিচারকে আমি ভয় পাই নাকি? বড়জোর এক বেলা কফি খেতে দেবে না।
শাস্তি হচ্ছে শাস্তি। কী পরিমাণ শাস্তি পেয়েছ সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। শাস্তি পেয়েছ কি না সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
মহাকাশযানের এই লম্বা যাত্রাগুলোতে যারা কোনো শাস্তি পায় না, উল্টো তাঁদেরই শাস্তি হওয়া দরকার বুঝতে হবে তাদের ভেতরে কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই। আনন্দ স্ফূর্তি নেই।
ভালোই বলেছ। বলে হাসতে হাসতে রিশি আবার মনিটরের দিকে তাকাল এবং তার মুখের হাসি মিলিয়ে সেখানে এবারে একটা বিতৃষ্ণার ভাব ফুটে ওঠে। সে মাথা নেড়ে বলল, ছি! এটা একটা গ্রহ হল নাকি?
টিরিনা একটু এগিয়ে যায় গ্রহটা দেখার জন্য, মনিটরে কদাকার গ্রহটিকে একনজর দেখে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, এটা ভালো গ্রহ না। বিচ্ছিরি একটা গ্রহ।
এর মাঝে বাতাস আছে কিন্তু সেই বাতাস হালকাভাবে বিষাক্ত। এই গ্রহ শীতল নয় কিন্তু তাপমাত্রা এমন যে তুমি কখনোই অভ্যস্ত হবে না। আলো আছে কিন্তু ঠিক ভুল তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের, সবকিছুকে দেখাবে লালচে পচা ঘায়ের মতো।
টিরিনা গ্রহটাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে দেখতে বলল, গ্রহটার কোনো নাম আছে নাকি?
না। এই পচা গ্রহকে কেউ নাম দিয়ে সময় নষ্ট করবে ভেবেছ? এর কোনো নাম নেই—এটার কপালে জুটেছে শুধু একটা সংখ্যা, সাত সাত তিন দুই নয়।
টিরিনা তথ্যকেন্দ্রের মডিউলটি টেনে নামাতে নামাতে বলল, দেখি আমাদের তথ্যকেন্দ্রে এর সম্পর্কে কোনো তথ্য আছে নাকি।
মডিউলের সাথে যোগাযোগ করার এক মুহূর্ত পরেই টিরিনা চিৎকার করে বলল, কী আশ্চর্য!