- বইয়ের নামঃ কিছুক্ষণ
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ আফসার বাদ্রার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে
ভূমিকা
ট্রেন দেখলেই আমার ট্রেনে চড়তে ইচ্ছা করে। ঢাকা শহরে অনেকগুলি রেল ক্রসিং। গাড়ি নিয়ে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। চোখের সামনে দিয়ে ট্রেন যায় আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবি ট্রেনের যাত্রীরা কি সুখেই না আছে।
আমার এই উপন্যাসটা ট্রেনের কামরায় শুরু, সেখানেই শেষ। কাহিনী শেষ হয়ে গেছে-ট্রেন চলছেই। মনে হচ্ছে এই ট্রেনের শেষ গন্তব্য অপূর্ব লীলাময় অলৌকিক কোনো ভুবন। উপন্যাসের নাম কিছুক্ষণ ধার করা নাম। ধার করেছি আমার প্রিয় একজন লেখক বনফুলের (বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়) কাছ থেকে।
হুমায়ূন আহমেদ
———
০১.
ট্রেন কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে। চিত্রাকে সিদ্ধান্ত যা নেবার এখনই নিতে হবে। সে ট্রেনে থাকবে, না-কি স্যুটকেস নিয়ে নেমে যাবে? বিশাল এই স্যুটকেস হাতে নিয়ে নামা তার পক্ষে সম্ভব না। নেমে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে তাকে কুলি ডাকতে হবে। দেরি করা যাবে না। এক্ষুণি ডাকতে হবে। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। ছটায় ছাড়ার কথা। এখন বাজছে পাঁচটা পঞ্চাশ। দুঃখে চিত্রার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
চিত্রার হাতে প্রথম শ্রেণীর স্লিপিং বার্থের টিকেট। হাত পা ছড়িয়ে যাবে। ট্রেনে তার একফোঁটা ঘুম হয় না। তাতে অসুবিধা নেই গল্পের বই পড়তে পড়তে যাবে। হাত ব্যাগে দুটো গল্পের বই আছে। দুটাই ভূতের গল্প। স্টিফেন কিং। চলন্ত ট্রেনে ভূতের গল্প পড়তে ভাল লাগে। স্টেশনের বুক স্টল থেকে এক কপি রিডার্স ডাইজেস্ট কিনেছে। ট্রেনে বাসে ডাইজেস্ট জাতীয় পত্রিকা পড়তে আরাম। মন দিয়ে পড়তে হয় না। চোখ বুলালেই চলে।
ট্রেন এখনো দাঁড়িয়ে। আজ কি ট্রেন লেট হবে? চিত্রা জানালা দিয়ে মুখ বের করল। একজন কুলিকে জানালার পাশেই দেখা যাচ্ছে। সে কি ডাকবে তাকে? বলবে স্যুটকেস নামিয়ে দিতে?
সে ঠিক করল নেমেই যাবে আর তখনই বিশাল বড় বড় দুটা কালো ট্রাঙ্ক দরজায় নামল। ট্রাঙ্কের সঙ্গে বেডিং, বেতের ঝুড়ি। এইসবের মালিক এক মাওলানা। সুফি সুফি চেহারা যার গা থেকে আতরের গন্ধ আসছে। মাওলানার স্ত্রী গর্ভবতী। বোরকায় তাঁর অস্বাভাবিক বিশাল পেট ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। ভদ্রমহিলা দৌড়ে ট্রেনে উঠার পরিশ্রমে ক্লান্ত। তিনি ট্রাঙ্কের উপর বসে পড়েছেন। বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। বিশাল এই ঝামেলা ডিঙিয়ে চিত্রার পক্ষে নামা অসম্ভব। বোরকাপরা মহিলা স্বামীকে বললেন, পানি খাব। পানি। আর ঠিক তখনই ট্রেন দুলে উঠল।
চিত্রার প্রধান সমস্যা দুজনের যে কামরায় তার সিট সেখানে বুড়ো এক ভদ্রলোক আধশোয়া হয়ে আছেন। ভদ্রলোকের মাথা অস্বাভাবিক ছোট। তিনি তাঁর ছোটমাথা হলুদ রঙের মাফলার দিয়ে পেঁচিয়ে বলের মতো বানিয়েছেন। গায়ে প্রায় মেরুন রঙের কোট। কোন রুচিবান মানুষ এই রঙের কোট পরে বলে চিত্রার জানা নেই। তাঁর হাতে সিগারেট। সিগারেটে একেকটা টান দিচ্ছেন আর বিকট শব্দে কাশছেন। ঘর ভর্তি সিগারেটের ধূয়া। ভদ্রলোকের পরণে লুঙ্গি। এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা ট্রেনে বা লঞ্চে উঠেই কাপড় বদলে লুঙ্গি পরে ফেলে। উনি মনে হয় সেই জাতের। প্লেনে উঠেও কি এরা এই কাণ্ড করে? হয়ত করে। লাঞ্চ টাইমে গামছা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায় গোসলের জন্যে। বিমানবালার কাছে গায়ে মাখার জন্যে তেল চায়। অসহ্য!
ভদ্রলোকের লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত উঠে এসেছে। কাঠির মতো দুটো পা বের হয়ে আছে। পা ভর্তি পাকা লোম। ভদ্রলোক আবার কিছুক্ষণ পর পর এক পা দিয়ে আরেক পা ঘসছেন। পায়ের বেহালা বাজাচ্ছেন। কি কুৎসিত! কি কুৎসিত।
এমন একজন মানুষের সঙ্গে দিনাজপুর পর্যন্ত যেতে হবে? চিত্রা করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। কামরায় ঢুকছে না। রেলের একজন এটেনডেন্টকে পাওয়া গেলে জিজ্ঞেস করত খালি কোনো কামরা আছে কি-না। এত বড় স্লিপিং বগি। একটাও খালি সিট থাকবে না? শাদা পোশাকের কোনো এটেনডেন্টকে দেখা যাচ্ছে না। প্রয়োজনের সময় এদের কাউকেই পাওয়া যায় না।
চিত্রাকে এই বিপদে ফেলেছে তার রুমমেট লিলি। ট্রেনের টিকিট লিলি তার মামাকে দিয়ে কাটিয়েছে। সেই মামা না-কি রেলের বিরাট অফিসার। লিলি তার মামাকে বলেছে টু সিটার স্লিপারের একটা টিকিট দিতে। সেখানে যেন অন্য কেউ না যায়। একটা সিট অবশ্যই খালি যাবে। লিলির মামার কাছে এই ব্যবস্থা করা না-কি কোনো বিষয়ই না।
এখন দেখা যাচ্ছে বিষয়। লিলির ক্ষমতাবান রেল মামা কিছু করতে পারেন নি। চিত্রাকে যেতে হবে পা ভর্তি সাদা লোমের বুড়োটার সাথে। যে বুড়ো দুই পা ঘসে ঘসে পা বেহালা বাজাবে। মহান পা-সঙ্গীত! ইচ্ছা করলে চিত্রা এখনই লিলির সঙ্গে কথা বলতে পারে। মোবাইল ফোন সঙ্গে আছে। কিন্তু লাভ কি। লিলি নিশ্চয়ই বুড়োকে সরাতে পারবে না।
ম্যাডাম, কোনো সমস্যা?
চিত্রা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রেলের একজন এটেনডেন্ট। হাতে চাবির গোছা। সরল ধরনের চেহারা। গোল মুখ, বড় বড় কান। চিত্রা শরীর বিদ্যা নামের একটা বই-এ পড়েছে যাদের মুখ গোলাকার, কান বড় বড় তারা সরল প্রকৃতির হয় এবং অন্যকে বিপদে সাহায্য করার মানসিকতা এদের আছে। এরা পরোপকারী।
চিত্রা বলল, স্লিপিং বার্থে খালি কোনো সিট কি আছে? আমি এই বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে যেতে চাচ্ছিনা। উনি ক্রমাগত সিগারেট খাচ্ছেন। একটু আগে একটা শেষ করেছেন এখন আরেকটা ধরিয়েছেন।
এটেনডেন্ট বলল, কামরার ভেতরে সিগারেট খাওয়া যাবে না, আমি উনাকে নিষেধ করে দিচ্ছি।
আর কোনো সিট কি আছে?
বাথরুমের কাছের ফোর সিটারে একটা খালি আছে কিন্তু সেখানে আপনি যেতে পারবেন না।
যেতে পারব না কেন?
ম্যাডাম, সামান্য অসুবিধা আছে। তারপরেও খোঁজ নিয়ে দেখি। আপাতত নিজের কামরায় বসুন।
এটেনডেন্ট স্যুটকেস ঢুকিয়ে দিল। চিত্রাকে তার পেছনে পেছনে যেতে হল। চিত্রাকে ঢুকতে দেখে বুড়ো পা গুটিয়ে নিল। পিট পিট করে তাকাল। বুড়োর নাকের নিচে বিশাল গোঁফ। উপরের ঠোঁটটা গোঁফের কারণে ঢাকা পড়ায় তাকে কার্টুন ফিগারের মত লাগছে।
চিত্রা বলল, দয়া করে সিগারেট খাবেন না। আমি সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারি না।
বুড়ো বলল, তুমি কি আমার সঙ্গে যাচ্ছ? আমার রুম মেট?
জি।
ভালো সমস্যা হল। আমি সিগারেটে টান না দিয়ে থাকতে পারি না।
করিডোরে গিয়ে খাবেন।
বুড়ো বলল, আমার শরীর ভালো না। আর্থরাইটিসের ব্যথা। হাঁটাহাঁটি করতে পারি না। প্রতিবার সিগারেটের জন্যে করিডোরে যাওয়া আমার জন্যে সমস্যা। যাই হোক তোমার নাম কি?
চিত্রা।
চিত্রা নামের অর্থ কি?
জানি না। (চিত্রা তার নামের অর্থ জানে। বুড়োটাকে অর্থ বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। চিত্রা একটা নক্ষত্রের নাম।)
হত। বাবা আবার কি মনে করে নামের আগে আব্দুর বসিয়েছেন। তুমি কি পড়াশোনা করছ? ছাত্রী?
জি।
কি পড়ছ?
ফিজিক্স।
কোন ইয়ার?
থার্ড ইয়ার। এবার অনার্স দেব।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি?
জি।
ইউনিভার্সিটি খোলা না?
খোলা।
ইউনিভার্সিটি খোলা, তাহলে যাচ্ছ কোথায়? ক্লাস মিস করে ঘোরাঘুরি করার মানে কি?
জবাব না দিয়ে চিত্রা বের হয়ে গেল। ক্লাস মিস দিয়ে ঘোরাঘুরি করলে বুড়োর কি? বুড়োর সঙ্গে অকারণ কথা বলার চেয়ে করিডোরে হাঁটাহাঁটি করা ভালো। ট্রেনে বুফে কার নিশ্চয়ই আছে। বুফে কারে জানালার পাশে বসে চা খেতে খেতে দূরের দৃশ্য দেখা যেতে পারে। সন্ধ্যা এখনো মিলায়নি। শেষ বিকেলের আলোয় দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত দেখতে ভালো লাগার কথা। রিডার্স ডাইজেস্ট খুলে jokes পড়া যেতে পারে। যদিও সে এখনো রিডার্স ডাইজেস্টের কোন জোক পড়ে হাসেনি। ভাগ্য ভাল থাকলে এবার হয়ত হাসবে।
তিন কামরা পরেই বুফে কার। সেখানে চা নেই আছে কফি। চা বিক্রিতে লাভ নেই। কফিতে লাভ বলেই কফি। কফির কড়া গন্ধ চিত্রার ভালো লাগে না তারপরেও সে কফি নিয়ে জানালার পাশে বসল। ব্যাগের ভেতর মোবাইল ফোনের রিং বাজছে। মনে হচ্ছে হাত ব্যাগের ভেতর ছোট্ট কোনো শিশু হাতপা ছুঁড়ে কাঁদছে। এক্ষুনি তাকে কোলে নিতে হবে।
টেলিফোন করেছে লিলি। ধরবে না ধরবে না করেও চিত্রা টেলিফোন ধরল। লিলি অকারণে কথা বলবে। বিরক্ত অবস্থায় কারোর অকারণ কথা শুনতে ভাল লাগে না।
হ্যালো চিত্রা, ট্রেন ছেড়েছে?
হুঁ।
টঙ্গী পার হয়ে গেছে?
হুঁ।
হুঁ হুঁ করছিস কেন। কথা বল। নিজের মতো করে টু সিটের স্লিপার পেয়েছিস?
হুঁ।
বললাম না মামাকে বললেই মামা ব্যবস্থা করে দেবে। এখন দরজা বন্ধ করে হাফ নেংটা হয়ে শুয়ে পড়। তুইতো আবার ট্রেনে ঘুমাতে পারিস না। গল্পের বই নিয়ে বসে যা। গান শোনার যন্ত্রপাতি নিয়েছিস? এম পি থ্রীটা আছে না?
না।
সেকি? আমার ওয়াকম্যানটা তোকে নিয়ে যেতে বললাম না? বের করে তোর টেবিলে রেখেছিলাম।
ওয়াকম্যানে গান শুনতে আমার ভালো লাগে না। মনে হয় কানের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে কেউ গান করছে।
লিলি আনন্দিত গলায় বলল, এটাইতো ভালো। শুধু পুরুষ গায়কদের গান শুনবি। মনে হবে কোনো পুরুষ তোর কানে চুমু খাচ্ছে।
চিত্রার বিরক্তি লাগছে। লিলির মুখ আলগা। অশালীন কথাবার্তা সে অবলীলায় বলে। চিত্রা বলল, লিলি একটা কথা—তোর মামা কিন্তু আমাকে একা সিট দেননি। আমার সঙ্গে এক বুড়ো আছে।
বলিস কি? আমি এক্ষুনি মামাকে টেলিফোন করছি।
এখন টেলিফোন করে লাভ কি?
অবশ্যই লাভ আছে। প্রয়োজনে ট্রেন ব্যাক করে ঢাকা যাবে। নতুন বগি লাগানো হবে। নো হাংকি পাংকি।
কেন অর্থহীন কথা বলছিস?
লিলি বলল, আমি মোটেই অর্থহীন কথা বলছি না। আমি অর্থহীন কথা বলার মেয়ে না। এক্ষুনি টেলিফোন করে আমি মামার বারটা বাজিয়ে দিচ্ছি। আর শোন, বুড়ো যেহেতু আছে—খবরদার ঘুমাবি না। বুড়োগুলো হয় sex starved। শুধু ছোঁক ছোঁক করে। রাতে ঘুমিয়ে পড়বি হঠাৎ জেগে উঠে দেখবি বুড়ো তোর বিশেষ কোনো জায়গায় হাত রেখে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
Please stop it.
এরচে ভয়ংকর কিছুও ঘটতে পারে। যেমন ধর…
চিত্রা টেলিফোনের লাইন অফ করে দিল। লিলি থামবে না— নোংরা কথা বলতেই থাকবে। লিলি পরীর মতো একটা মেয়ে। মায়া মায়া চোখ। পবিত্র চেহারা অথচ কি সব নোংরা ধরনের কথা।
চিত্রা কফিতে চুমুক দিল। যা ভেবেছিল তাই অতিরিক্ত চিনি এবং কুসুম গরমও না। কফি থেকে হরলিক্সের গন্ধও আসছে। এর মানে কি? বয়কে ডেকে একটা ধমককি দেয়া যায় না? অবশ্যই দেয়া যায়। তবে এই মুহূর্তে ধমক দেয়া যাবে না। অন্য একজন ধমকা ধমকি করছেন। তিনি গর্ভবতী বোরকাওয়ালীর স্বামী–মাওলানা। তিনি পানি কিনতে এসেছেন। ছোট এক বোতল পানি তের টাকা চাচ্ছে। অথচ বাইরে বার টাকা। বয় নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, বাইরে থেকে পানি কিনেন। খামাখা প্যাচাল পারেন কেন?
মাওলানা এখনো তার স্ত্রীকে পানি খাওয়াননি ভেবে চিত্রার খারাপ লাগছে। তার স্বামীও কি এরকম ইনসেনসেটিভ হবে?
চিত্রা যাচ্ছে বিয়ে করতে। যদিও তার বড় মামা খোলাসা করে কিছু বলছেন না। তিনি খোলাসা করে কিছু বলার মানুষও না। তিনি জানিয়েছেন-আমার শরীর খুব খারাপ, স্ট্রোক হয়েছে। একটা পা অবস। আমি তোকে প্রতিষ্ঠিত দেখে মৃত্যুর জন্যে তৈরি হতে চাই। চিত্রাকে প্রতিষ্ঠিত দেখার মানে নিশ্চয়ই তাকে বিবাহিতা দেখা। পুরুষদের কাছে মেয়েদের প্রতিষ্ঠার একটাই অর্থ বিবাহ।
চিত্রা কফির কাপ সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। সে এটেনডেন্টকে খুঁজে বের করবে। সে কোনো ব্যবস্থা করেছে কি-না দেখব।
বুড়ো সিগারেট হাতে করিডোরে দাঁড়ানো। চিত্রাকে দেখে বলল, কোথায় গিয়েছিলে?
অভিভাকের মতো গলা, যেন কৈফিয়ত তলব করছে। চিত্রার যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবে। বুড়োর কৈফিয়ত তলবের কিছু নেই।
চিত্রা, তুমি উপরের সিটে থাকবে। আমার পক্ষে উপরে উঠা সম্ভব না। তাছাড়া আমাকে ঘন ঘন সিগারেট খেতে হবে।
চিত্রা জবাব দিল না। জবাব দেবার কিছু নেই। বুড়োর সঙ্গে খেজুরে আলাপেরও কিছু নেই।
বুড়ো সিগারেটে লম্বাটান দিয়ে বলল, এই স্লিপিং কারে একটা ডেডবডি যাচ্ছে এটা কি জান? বাথরুমের লাগোয়া যে কামরা সেখানে।
চিত্রা বলল, তাই না-কি?
ইয়াং ছেলের ডেডবডি। সঙ্গে মা আছে, ভাই আছে। স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার হল এরা কেউ কাঁদছে না। মনে হয় অধিক শোকে পাথর।
চিত্রা জানালার দিকে এগিয়ে গেল। বুড়োর সঙ্গে বক বক করার কোনো ইচ্ছা নেই। ট্রেনে একটা ডেড বডি যাচ্ছে এই বিষয়টাও ভালো লাগছে না। এক সময় ডেডবডি থেকে গন্ধ ছড়াতে থাকবে। স্লিপিং বার্থের এসি কামরা। জানালা খোলার উপায় নেই। ডেডবডির গন্ধ বের হবে না। কামরার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকবে।
দরজার পাশে দাঁড়ানো গেল না। মধ্যবয়স্ক এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতেও সিগারেট। আজকের ট্রেনের সব যাত্রীই কি স্মোকার? চিত্রা আবার বুফে কারের দিকে রওনা হল। এক কাপ কফি কিনে জানালার পাশে বসে থাকবে। কফিতে চুমুক দেবে না। চিত্রা মোটামুটি নিশ্চিত আজ সারা রাত সে তাঁতের মাকুর মত একবার যাবে নিজের কামরায় একবার যাবে বুফে কারে। কফি কিনবে এবং জানালা দিয়ে ফেলে দেবে।
চিত্রা আগে যেখানে বসেছিল সেখানে চাদর গায়ে এক লোক বসে আছে। চিত্রার সামান্য মন খারাপ হল। বুফে কার পুরোটাই খালি। তাকে যে ঠিক আগের জায়গাতেই বসতে হবে তা-না। অথচ আগের জায়গাতেই বসতে ইচ্ছা করছে।
ম্যাডাম, আপনার নাম কি চিতা?
চিত্রার পেছনে স্লিপিং কারের এটেনডেন্ট দাঁড়িয়ে আছে। চিত্রা বিস্মিত হয়ে বলল, আমার নাম চিতা না। ফোঁটাওয়ালা বাঘের নাম চিতা। আমার নাম চিত্রা।
আপনার মোবাইল সেট টা কি বন্ধ?
হ্যাঁ।
আপনাকে মোবাইল সেট অন করতে বলেছে।
কে বলেছে?
ম্যাডাম, সেটাতো বলতে পারব না। ট্রেনের গার্ড সাহেব খবর দিয়েছেন। ম্যাডাম, আপনার কিছু লাগলে আমাকে বলবেন। আমি ব্যবস্থা করব।
গরম এক কাপ চা খাওয়াতে পারবেন? এরা বলছে চা নেই, শুধু কফি।
চায়ের ব্যবস্থা এক্ষুনি করব।
চা-টা যেন গরম হয় আর ঘন হয়। আমি পাতলা চা খেতে পারি না।
নাশতা কিছু দিতে বলব? এদের চিকেন কাটলেট খারাপ না।
নাশতা খাব না। থ্যাংক য়্যু।
চিত্রা তার মোবাইল টেলিফোন অন করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিলির টেলিফোন।
হ্যালো চিত্রা। তুই কি ভেবেছিস মোবাইল অফ করে আমার কাছ থেকে পার পেয়ে যাবি? দেখলি ক্ষমতার নমুনা? মামার মাধ্যমে ট্রেনের গার্ডকে ধরে তোর কাছে পৌঁছে গেলাম।
তাই তো দেখছি।
মামাকে তোর ব্যাপারটা বলেছি। উনি খুবই রাগ করেছেন। তোর টিকিটটা যাকে হ্যান্ডেল করতে বলেছেন তার চাকরি যায় যায় অবস্থা। কে জানে হয়তো এর মধ্যে চাকরি চলে গেছে। দেশের বেকার আরো একজন বেড়েছে।
ও আচ্ছা।
তুই যে ভাবে ও আচ্ছা বললি তাতে মনে হচ্ছে তুই আমার কথা বিশ্বাস করছিস না। মামা রেলওয়ে বোর্ডের মেম্বার। এই বৎসরই চেয়ারম্যান হয়ে যাবেন। চিত্রা নিশ্চিত থাক, একটা ব্যবস্থা হবে। প্রয়োজনে বুড়োকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হবে। ভালো কথা, বুড়ো কি ইতিমধ্যে তোর গায়ে হাত দিয়েছে?
লিলি! এই জাতীয় কথা আমার শুনতে ভালো লাগে না।
এটা হল বাস্তবতা। রিয়েলিটি। এইসব ঘটনাই সব জায়গায় ঘটছে। কয়েকদিন আগে মগবাজার রেলক্রসিঙের কাছে কি হয়েছে শোন। গার্মেন্টসের একটা মেয়ে ষোল সতেরো বয়স। কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ দুই বদ এসে টান দিয়ে মেয়েটার শাড়ি পেটিকোট সব খুলে ফেলল। মেয়ে আচমকা নেংটু হয়ে এমন হতভম্ব যে…
লিলি! আমি শুনতে চাচ্ছি না।
তুই মুখে বলছিস শুনতে চাচ্ছিস না। আসলে ঠিকই শুনতে চাচ্ছিস। নোংরা কথা শুনতে নিষিদ্ধ আনন্দ আছে। কথা যত নোংরা তত মজা।
প্লিজ! প্লিজ লিলি। প্লিজ।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমি টেলিফোন রাখছি। মামার সঙ্গে যোগাযোগ হলেই তোকে জানাব। বন ভয়াজ।
চিত্রার চা এসেছে। পট ভর্তি চা, দুধ, চিনি। একটা এক্সট্রা টি ব্যাগ। পট থেকে চায়ের গন্ধ আসছে। আজকালকার চা থেকে গন্ধ আসে না। অনেকদিন পর গন্ধ পাওয়া গেল। চিত্রার প্রায়ই মনে হয় চায়ের গন্ধে এক ধরনের মন খারাপ ভাব থাকে। কেন এ রকম মনে হয় কে জানে। চিত্রা রিডার্স ডাইজেস্ট খুলল। Laughter the best medicine এর পাতা বের করল। মন ভাল করার কোনো medicine পাওয়া যায় কি-না দেখা যাক।
From Websters Dictionary Windown 95 n.32 bit extensions and a graphical shell for a 16 bit patch to an 8 bit operating system originally coded for a 4 bit microprocessor written by a 2 bit company that cant stand 1 bit of competition.
এর মানে কি? এটা পড়ে কেউ হাসবে কেন?
আমি কি আপনার সামনের চেয়ারটায় বসতে পারি?
চিত্রা সামান্য হকচকিয়ে গেল। অচেনা পুরুষদের সঙ্গে হড়বড় করে কথা লিলি বলতে পারে। সে পারে না। সে খানিকটা আড়ষ্ট বোধ করে। তার জায়গায় লিলি থাকলে বলতো—অবশ্যই বসতে পারেন। হঠাৎ আমার সামনে বসতে চাচ্ছেন কেন? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কারণটা ব্যাখ্যা করুন। প্রথমবারেই সুন্দর করে ব্যাখ্যা করবেন যাতে আমাকে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার কোনো প্রশ্ন না করতে হয়, সহজ বাংলায় ঝেড়ে কাশুন।
ভদ্রলোক তার সামনে বসেছেন। বয়স ২৫ থেকে ত্রিশ। চারকোনা মুখ। চোখে গোলাকার মেটাল ফ্রেমের চশমা। চারকোনা মুখের সঙ্গে গোল চশমা মানাচ্ছে না। তাকে বোকা বোকা দেখাচ্ছে। গায়ে ব্লেজার। কফি কালারের ব্লেজার। ভদ্রলোকের মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল। কোকড়ানো চুলের জন্যে চেহারায় নিগ্রো নিগ্রো ভাব চলে এসেছে। তবে গায়ের রঙ গৌর। ইনি কি একজন তরুণীকে একা বসে থাকতে দেখে ভাব জমাতে এসেছেন? কিছু পুরুষ থাকে যাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা।
আমার নাম আশহাব। আশহাব অর্থ বীর। তবে আমি বীর না। ভীতু প্রকৃতির মানুষ। আমি একজন ডাক্তার। মাকে নিয়ে দেশের বাড়িতে যাচ্ছি।
চিত্রা বলল, ও। তার আড়ষ্ট ভাব কমল না বরং সামান্য বাড়ল। সামনে বসা ভদ্রলোক সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অচেনা এক তরুণীর সঙ্গে কথা বলছেন যেন তিনি পূর্ব পরিচিত। ঘটনা সে রকম না। চিত্রা এই প্রথম ভদ্রলোককে দেখছে।
ভদ্রলোক খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, আমি শুনেছি আপনি সামান্য বিপদে পড়েছেন। একটা কাজ করতে পারেন। আমার মার সঙ্গে এক কামরায় থাকতে পারেন। আমি চলে যাব আপনার সিটে।
চিত্রা বলল, থ্যাংক য়্যু।
চিত্রার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। ট্রেন জার্নি এখন তার অনেক ভালো লাগছে। সামনে বসা যুবককে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে জানালা দিয়ে দূরের দিগন্ত দেখতে পারলে ভালো হত। দিগন্ত ঘন কুয়াশায় ঢাকা। সেই কুয়াশা এগিয়ে আসছে। ট্রেন এমনভাবে ছুটছে যে মনে হচ্ছে কুয়াশা যেন তাকে ধরতে না পারে এটাই ট্রেনটির একমাত্র বাসনা।
আশহাব বলল, সহযাত্রী হিসেবে আমার মা কেমন সেটা জেনে তারপর ডিসিসান নেবেন। পরে দেখা গেল ফ্রম ফ্রাইং পেন টু ফায়ার। কড়াইয়ে ভাল ছিলেন ঝাপ দিয়ে পড়লেন আগুনে। আমার মা বেশির ভাগ সময়ই বিরক্তি
চিত্রা তাকিয়ে আছে। অপরিচিত একজন তরুণীর সঙ্গে কোনো ছেলে এই ভাবে কথা কি বলে?
আপনি মার সঙ্গে থাকলে সবচে বড় উপকার হবে আমার। মার চিৎকার হৈ চৈ শুনতে হবে না। মা নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে চিৎকার করবেন না।
চিত্রা বলল, চা খাবেন? আমার ফ্লাস্ক ভর্তি চা।
আশহাব বলল, আমি চা খাইনা, তবে এখন খাব। আমার মা ট্রেনে উঠার পর থেকে কি নিয়ে হৈ চৈ করছে শুনলে আপনি অবাক হবেন। আপনার শোনাও দরকার। হৈ চৈ আপনার সঙ্গেও করবেন। বলব?
চিত্রা বলল, বলুন।
স্লিপিং কারে একটা ডেডবডি কেন যাচ্ছে এই হচ্ছে মায়ের সমস্যা। ট্রেনে কি যাচ্ছে না যাচ্ছে সেটা আমার ব্যাপার না। ডেডবডি আমি তুলিনি। মা সামনের স্টেশনে নেমে যেতে চাচ্ছেন। অর্থহীন কথা না?
আশহাব উঠে গিয়ে কাউন্টার থেকে কাপ নিয়ে চা ঢালছে। তাকে খুবই বিরক্ত দেখাচ্ছে। তার সামনেই অতি রূপবতী একটা মেয়ে বসে আছে এই ব্যাপারটাই এখন তার মাথায় নেই।
চিত্রার ইচ্ছা করছে রিডার্স ডাইজেস্টের খোলাপাতাটি ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে—এই জোকটা পড়ে আমাকে বলবেন কোন জায়গাটা হাসির। সম্ভব না। এতটা ঘনিষ্ঠতা এই যুবকের সঙ্গে তার হয় নি। হবার সম্ভাবনাও নেই।
তিন নম্বর বগিতে আশহাবের মা
তিন নম্বর বগিতে আশহাবের মা সাজেদা বেগম বসে আছেন। তাঁর সামনে পানের বাটা খোলা। পান, সুপারি, চুন, খয়ের সবই আছে। আসল বস্তু নেই। জর্দা নেই। জর্দা ছাড়া পান কেউ খায়? তাঁর পরিষ্কার মনে আছে পানের বাটায় জর্দা তিনি নিজের হাতে নিয়েছেন। সেই জর্দা গেল কোথায়? অবশ্যই আশহাব সরিয়েছে। জর্দা খেলে এই হয় সেই হয়। বেশি ডাক্তারি শিখে গেছে। এদেরকে সকাল বিকাল দুইবেলা থাপড়াতে হয়।
দরজায় টুক টুক শব্দ উঠছে। সাজেদা বললেন, কে?
দরজা সামান্য ফাঁক হল। চিত্রা মুখ বের করে বলল, আসব?
সাজেদা বললেন, এসো। তোমার নাম চিত্রা? আশহাব বলেছে তুমি আমার সঙ্গে রাতে থাকবে। বোসো। আমার অসুবিধা নাই।
চিত্রা বসল। সাজেদা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছেন। এত সুন্দর সুন্দর মেয়ে যেখানে সেখানে দেখা যায়, শুধু তিনি তার ছেলের জন্যে মেয়ে খুঁজে পান না। সুন্দরী মেয়ে হঠাৎ পেয়ে গেলে জানা যায় মেয়ের প্রেম আছে। আজকালকার মেয়ে প্রেম ছাড়া থাকতেই পারে না। তাঁর পাশে বসা মেয়েটাকে পছন্দ হচ্ছে। দেখা যাবে এই মেয়ে হয় বিবাহিতা কিংবা প্রেমকুমারী। এক সঙ্গে দু-তিনটা প্রেম করে যাচ্ছে। সাজেদা ভাইবা সেসানের জন্যে তৈরি হলেন। রূপবতী কোনো তরুণী দেখলেই তিনি ভাইবা নেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি জর্দা ছাড়া পান মুখে দিয়েছেন। মুখ মিষ্টি হয়ে আছে। মিষ্টি মুখে কথা বলতেই ইচ্ছা করে না।
তোমার কি বিয়ে হয়েছে?
জি না।
বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে?
না।
যাচ্ছ কোথায়?
দিনাজপুরে আমার বড় মামার কাছে।
হঠাৎ বড় মামার কাছে যাচ্ছ কেন?
উনি অসুস্থ। উনাকে দেখতে যাচ্ছি।
উনার কি অসুখ?
হার্টের অসুখ।
হার্টের অসুখ, দিনাজপুরে বসে আছেন কেন?
আমি উনাকে ঢাকায় আনার জন্যে যাচ্ছি।
বাবা কি করেন?
বাবা বেঁচে নেই।
যখন বেঁচে ছিলেন তখন কি করতেন?
ব্যাংকে চাকরি করতেন।
মা বেঁচে আছেন?
জি না।
সাজেদা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়েটার এখনো বিয়ে হয়নি কেন তা পরিস্কার হয়েছে। এই মেয়ে কঠিন এতিম। বাবা মা দুজনই নেই। কার দায় পড়েছে এতিম মেয়ে ঘরে ঢুকানোর? শ্বশুর শাশুড়ির আদর ছাড়া বিয়ে কি? স্ত্রীর ভালোবাসা হিসাবের মধ্যে আসে না। শ্বশুর শাশুড়ির ভালোবাসা আসে। আশহাবের সঙ্গে এই মেয়ের বিয়ের কিছুমাত্র সম্ভাবনা নেই জেনে সাজেদার ভালো লাগছে। মেয়েটার সঙ্গে এখন নিশ্চিন্ত মনে কথা বলা যাবে। যদি জানা যায় এই মেয়ে এক সঙ্গে তিনটা প্রেম করে বেড়াচ্ছে তাহলেও কিছু যায় আসে না। প্রেম করে বেড়ালে বরং ভাল।
সাজেদা বললেন, ঘুমের সময় তোমার কি নাক ডাকে?
চিত্রা থতমত খেয়ে বলল, না।
সাজেদা বললেন, আমার ডাকে। আমার ঘরে ঘুমাবে ভালো কথা। এটা মাথার মধ্যে রাখবে। মাঝ রাতে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলবে না, আমি এই কামরায় ঘুমাব না। একবার ঘুম ভেঙে গেলে আমার আর ঘুম আসে না।
জি আচ্ছা।
বাথরুমের পাশের কামরায় একটা ডেড বডি যাচ্ছে শুনেছ?
জি শুনেছি।
গন্ধ পাচ্ছ না? মরা মানুষের গন্ধ?
পাচ্ছি না।
তোমার কি নাক বন্ধ? লাশের গন্ধে আমার শরীর উল্টে আসছে। রেল কোম্পানির কারবারটা দেখ ডেড বডি নিয়ে রওনা হয়েছে। আর আত্মীয় স্বজনের আক্কেল দেখ। তোরা নিজেরা নিজেরা যা। একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে চলে যা—-মাইক্রোবাসে একটা লাল ফ্ল্যাগ ঝুলিয়ে দিবি সবাই সাইড দিবে। হোস করে চলে যাবি। ট্রেনের অতগুলি যাত্রীকে বিপদে ফেললি কি মনে করে?
চিত্রা চুপ করে রইল।
ভদ্রমহিলা বিরক্ত গলায় বললেন, এখন একটা কাজ কর। আমার ছেলেকে খুঁজে বের কর। তাকে বল জর্দার ব্যবস্থা করতে। কোত্থেকে ব্যবস্থা করবে সে জানে।
চিত্র উঠে দাঁড়াল। সাজেদা মনে মনে আফসোসের নিঃশ্বাস ফেললেন কি সুন্দর লম্বা একটা মেয়ে। শুধু যদি এতিম না হত। শাড়িটাও পরেছে সুন্দর করে। শাড়ির উপর চাদরের কাজটাও ভালো। তবে হাতি ঘোড়ার ছবি আঁকা। এমন চাদর গায়ে দিয়ে নামাজ হবে না। প্রশ্ন করলে দেখা যাবে মেয়ে নামাজই পড়ে না। তার পরেও জানা থাকা ভালো। সাজেদা বললেন, তুমি নামাজ পড়?
মাঝে মধ্যে পড়ি!
এটা কেমন কথা। মাঝে মধ্যে পড়ি মানে কি? তুমি কি মাঝে মধ্যে ভাত খাও? ভাততো তিনবেলাই খাও। দোয়া মাছুরাটা কি বল দেখি।
চিত্রা বলল, আমি জর্দার ব্যবস্থা করে তারপর বলি?
চিত্রার মোবাইল বাজছে। লিলির টেলিফোন। লিলি আজ ঘুমাবে না। সারারাত জেগে থাকবে। কিছুক্ষণ পর পর টেলিফোন করে বিরক্ত করবে। চিত্রা মোবাইল হাতে কামরা থেকে বের হয়ে এল। চিত্রা হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে লিলি বলল, ছয়বার রিং হবার পর ধরলি। ব্যাপার কি? শোন তোর জন্যে ভালো খবর আছে।
কি খবর?
মামা জানিয়েছেন সেলুন কারে একজন মন্ত্রী যাচ্ছেন ময়মনসিংহ পর্যন্ত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। উনি নেমে গেলেই তুই সেলুন কারে দাখিল হয়ে যাবি। কোনো সমস্যা নেই। রাজার হালে যাবি। থুক্কু রাণীর হালে যাবি। কুইন অব দিনাজপুর।
হুঁ।
হুঁ হুঁ করছিস কেন? এ রকম একটা নিউজ দিলাম, তুই লাফিয়ে উঠবি তা না শুকনা। আর শোন তোর কামরায় যে বুড়ো উঠেছে উনার খোঁজ পাওয়া গেছে। উনিতো খুবই নামকরা মানুষ। প্রফেসর রশীদ। আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটির ম্যাথমেটিক্সের ফুল প্রফেসর। ম্যাথমেটিক্সে নোবেল প্রাইজের ব্যবস্থা থাকলে উনি অবশ্যই নোবেল পুরস্কার পেতেন।
তাঁর সম্পর্কে খবর কোথায় পেয়েছিস?
মামা জানিয়েছেন। তোর কামরাটা খালিই ছিল। উনি যখন টিকেট চাইলেন তখন উনাকে দিতেই হয়েছে। এখন বুঝেছিস।
হুঁ।
চিত্রা তুই বরং ঐ বুড়োর সঙ্গেই থাক। বুড়ো তোর গায়ে হাত রাখলে ভাল। সবাইকে বলতে পারবি বিখ্যাত একজন মানুষ আমাকে হাতা-পিতা করেছেন।
চুপ কর।
ফান করলে তুই রেগে যাস কেন?
তোর ফান আমার ভাল লাগে না।
চিত্রা শোন সেলুন কারে দাখেল হবার পর সেখানকার সুবিধা-অসুবিধা আমাকে টেলিফোন করে জানাবি। আমি নিজে সেলুন কার দেখিনি। তোর কাছে যদি শুনি জোশ তাহলে প্রগ্রাম করে তোকে নিয়ে একবার সেলুন কারে ঘুরব।
আচ্ছা।
সারারাত আমার মোবাইল খোলা থাকবে। সমস্যা মনে করলেই আমাকে জানাবি। তোর জন্যে আরেকটা সারপ্রাইজ আছে।
আবার কি সারপ্রাইজ?
এখন বললে তো আর সারপ্রাইজ থাকবে না। যখন ঘটবে তখন জানবি। ইন্টারেস্টিং সারপ্রাইজ। খোদা হাফেজ।
গুড নাইট, স্লিপ টাইট।
রশীদ সাহেব সিগারেট খেতে বের হয়েছেন তবে এবার করিডোরে না। দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দরজার একটা জানালা সামান্য খোলা। খোলা জানালায় শীতের বাতাস ঢুকছে। প্রবল হাওয়ায় সিগারেট টানা মুশকিল, তবে তার তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। রেলের এটেনডেন্ট জানালার পাশে বসার জন্যে সবুজ রঙের একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এনে দিয়েছে। তিনি এটেনডেন্টের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর ইচ্ছা করছে এখনি তাকে কিছু বখশিস দেন। পাঁচশ টাকা দিয়ে দিলে কেমন হয়? পাঁচশ টাকা এমন কিছু টাকা না। সাত ডলারেরও কম। বিশ ডলার বখশিস তাঁকে প্রায়ই দিতে হয়। টাকাটা এখনি দিয়ে দেয়া দরকার। নামার সময় তড়িঘড়ি করে নামবেন। বখশিস দিতে ভুলে যাবেন।
চেয়ারে বসতে বসতে রশীদ সাহেব বললেন, বাবা, তোমার নাম কি?
এটেনডেন্ট বলল, স্যার, আমার নাম বসির।
তোমার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তোমার জন্যে পাঁচশ টাকা বখশিস স্যাংসান করেছি। আমার মনে না থাকলেও তুমি চেয়ে নেবে। এতে দোষের কিছু নাই। এই ট্রেনে যাত্রী সর্বমোট কত জন আছে বলতে পারবে? আন্দাজ করে বললেও হবে।
বসির বলল, আন্দাজ করা লাগবে না। সঠিক সংখ্যা বলতে পারব স্যার। সবতো টিকেটের যাত্রী। টিকেটের হিসাব গার্ড সাহেবের কাছে আছে।
সঠিক সংখ্যাটা বল।
একটু সময় লাগবে। ধরেন এক ঘণ্টা।
এক ঘণ্টা সময় তোমাকে দিলাম।
স্যার, আপনার কিছু কি লাগবে? চা বা কফি।
চা-কফি কিছু লাগবে না। আমি রাত নটার সময় দুই থেকে তিন পেগ হুইস্কি খাব। হুইস্কি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। তুমি একটা গ্লাস দেবে। বরফ কি দিতে পারবে?
পারব স্যার। বুফে কারে ফ্রিজ আছে।
ভেরি গুড।
স্যার, আপনার সিগারেট কি লাগবে? আপনার হাতের প্যাকেটটা তো মনে হয় শেষের দিকে।
সিগারেট লাগবে না। সঙ্গে অনেক আছে। আমি রোস্টেড সিগারেটে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। আমেরিকার বাইরে যখন যাই স্যুটকেস ভর্তি সিগারেট নিয়ে যাই। বসির, আমার রুমমেট মেয়েটি কোথায় জান?
বুফে কারে দেখেছিলাম। তাকে কিছু বলব?
কিছু বলতে হবে না। বেচারী মনে হয় এক কামরায় আমার সঙ্গে যেতে সংকোচ বোধ করছে। এই কারণেই বাইরে বাইরে ঘুরছে।
উনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে স্যার। তিন নম্বর কামরায়। আপনার সঙ্গে একজন ডাক্তার থাকবেন।
ভেরি গুড। বৃদ্ধ বয়সে হাতের কাছে ডাক্তার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
রশীদ সাহেব হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটা ধরালেন। বসির এখনো কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সে এই মুহূর্তে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুড়ো মানুষটার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা সে নেবে না। কিছুতেই না। এমন একটা সিদ্ধান্ত সে কেন নিয়েছে নিজেই বুঝতে পারছে না। কোনো কারণ ছাড়াই বুড়ো মানুষটাকে তার ভাল লাগছে।
বসির।
জি স্যার।
আমি একুশ বছর পর দেশে এসেছি।
ভালো করেছেন।
মোটেই ভালো করিনি—আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি অচেনা এক দেশে ঘুরছি। এরকম কেন মনে হচ্ছে তাও বুঝছি না।
একা এসেছেন স্যার? ম্যাডামকে নিয়ে আসেন নাই?
বিয়ে করি নি। ম্যাডাম পাব কোথায়? পোস্ট ডক করার সময় স্পেনের এক মেয়ের সঙ্গে মোটামুটি পরিচয় হয়েছিল। মেয়েটিকে প্রপোজ করেছিলাম। সে রাজিও হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়নি। মেয়ের নাম ইয়েনডা। সে স্ট্যাটিসটিকসের ছাত্রী ছিল।
বসির বলল, বরফের ব্যবস্থা কি স্যার এখন করব?
রশীদ সাহেব বললেন, এখন না। রাত ঠিক নটায়। সময়ের ব্যাপারে আমি খুব পার্টিকুলার। যদিও জানি সময় বলে কিছু নেই। সময় আমাদের কাছে একটা ধারণা মাত্র। তার বেশি কিছু না। পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার বলে কিছু নেই।
বসির বলল, স্যার, আমি খোঁজ নিয়ে আসি ট্রেনে মোট যাত্রী কতজন।
যাও।
জানালাটা বন্ধ করে দিন স্যার। ঠাণ্ডা লাগবে।
ঠাণ্ডা লাগবে না। আমি ঠাণ্ডার দেশের মানুষ।
ইয়েনডার কথা মনে পড়ায় রশীদ উদ্দিন হঠাৎ সামান্য বিষণ্ণ বোধ করছেন। ইয়েনডার সঙ্গে দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তার আছে। এমট্রেকের অবজারভেশন ডেকে মুখোমুখি বসে দুজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন। পাশ দিয়ে চলে গেছে Rocky mountain. একটা বিখ্যাত গান আছে না রকি মাউন্টেইন নিয়ে–Rocky mountain high. কে গেয়েছে গান টা?
চিত্রা বুফে কারে ডাক্তার আশহাবের মুখখামুখি বসে আছে। সহজ ভাবেই গল্প করে যাচ্ছে। অপরিচিত জনের সঙ্গে কথা বলার অস্বস্থি কাজ করছে না। তাদের টেবিল থেকে একটু দূরে কয়েকজন যুবক প্রাণখুলে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন মনে হয় ওস্তাদ গল্পকার। কিছুক্ষণ পর পর সে একটা গল্প করছে। আশপাশের সব বন্ধুরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গল্পকার ছেলেটির গায়ে নীল রঙের স্যুয়েটার। টকটকে লাল রঙের একটা মাফলারে সে কান ঢেকেছে। তাকে দেখে থ্রি ডাইমেনশনাল বাংলাদেশের পতাকার মতো লাগছে। চিত্রার ইচ্ছা করছে বাংলাদেশী ঐ পতাকার কাছে গিয়ে বলে——আপনাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ বসতে পারি? গল্প শুনব। অনেকদিন আমি হাসি না। আপনার গল্প শুনে হাসব।
ইচ্ছা করলেও কাজটা তার পক্ষে সম্ভব না। লিলি থাকলে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঐ টেবিলে চলে যেত। গম্ভীর ভঙ্গিতে বলত—আমাকে জায়গা দিন তো। জোকস শুনব। আমি নিজেও শুনাব।
আশহাব বলল, আপনার কি মনে হচ্ছে আমার মাকে রুমমেট হিসেবে নিতে পারবেন?
চিত্রা বলল, কেন পারব না?
মা কিন্তু অনেক বিরক্ত করবে। রাতে ঘুমুতে দেবে না। উদ্ভট সব ভূতের গল্প শুরু করবেন। সব ভূত উনি নিজেই দেখেছেন।
চিত্রা বলল, মায়ের উপর আপনার কি কোনো রাগ আছে?
আশহাব বলল, আছে। মা হচ্ছে এমন একজন মানুষ যার কাছে অন্যের মতামতের কোনো মূল্য নেই। আমার ডাক্তার হবার কোনো ইচ্ছা ছিল না। অন্যের রোগের উপর আমি বেঁচে থাকব ভাবতেই খারাপ লাগে। মার জন্যে আমাকে ডাক্তারি পড়তে হয়েছে। আমার বাবার একটা গল্প শুনলেই বুঝবেন মা কেমন মহিলা। গল্পটা বলব? আপনার শোনার ধৈর্য আছে?
আছে। আপনি গল্প ভালো বলেন।
আশহাব বলল, আমার বাবা ছিলেন খুবই নির্বিরোধী মানুষ। কারো কোনো ঝামেলায় নেই। অফিসে যাবেন, অফিস থেকে বাসায় ফিরে চুপচাপ বসে থাকবেন। তিনি একবার ঠিক করলেন সবাইকে নিয়ে কক্সবাজার যাবেন সমুদ্র দেখবেন। তিনি ট্রেনের টিকিট কাটলেন। কক্সবাজারে হোটেল বুকিং দিলেন। তাঁর উৎসাহের সীমা নেই। যেদিন যাব তার আগের দিন মা।
মা বললেন, কক্সবাজার সি বিচে চোরাবালি আছে। অনেকে চোরাবালিতে ড়ুবে মারা গেছে।
বাবা বললেন, সমুদ্রে নামব না।
মা বললেন, বাদ। বাদ। সমুদ্র বাদ। চল সিলেটে যাই। জাফলং সুন্দর জায়গা। সিমিরা জাফলং গিয়েছিল। ছবি তুলে এনেছে। দেখার মতো জায়গা। সেখান থেকে ইন্ডিয়া দেখা যায়।
বাবা বললেন, ইন্ডিয়া দেখার দরকার কি?
মা বললেন, সমুদ্র দেখারইবা দরকার কি? চোখ বন্ধ করে ঘরে বসে থাক।
আমাদের সমুদ্র দেখার পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেল। বাবা মারা গেলেন সেই বছরই। চিত্রা, আমি যদি একটা সিগারেট ধরাই আপনি কিছু মনে করবেন?
আমি কিছু মনে করব না।
আশহাব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, মা দুই টিফিন কেরিয়ার ভর্তি খাবার নিয়ে এসেছেন। খাবারের প্রতিটি আইটেম আমাকে খেতে হবে। ভালো লাগুক বা না লাগুক, খেতে হবে। খাওয়া নিয়ে আরো ব্যাপার আছে।
আর কি ব্যাপার?
খাবারের প্রথম নলাটা মা আমার মুখে তুলে দেবেন। এতে নাকি ছেলেমেয়ের হায়াত বাড়ে। দৃশ্যটা চিন্তা করে দেখুন—আমি চোখ বন্ধ করে হা করে আছি মা মুখে ভাতের প্রথম নলা তুলে দিচ্ছেন।
চিত্রার হাসি আসছে সে হাসি চাপতে চাপতে বলল, চোখ বন্ধ করে হা করে থাকবেন কেন? চোখ ভোলা রাখবেন।
চোখ খোলা রেখে সেই সময় মায়ের মুখ দেখব? নো।
আশহাব সিগারেটে লম্বা টান দিল। ঠিক তখন এটেনডেন্ট বসির বলল, স্যার, আপনাকে আপনার মা ডাকেন। আশহাব চমকে উঠে সিগারেট জানালা দিয়ে ফেলে দিল। সে উঠে দাঁড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। বসিরের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি মাকে বলুন আমি এখন আসতে পারব না। একটু দেরি হবে।
বসির চলে যেতেই আশহাব বিব্রত গলায় বলল, মাকে কেমন ভয় পাই দেখেছেন? মার কথা শুনেই লাফ দিয়ে উঠেছি।
চিত্রা বলল, দেখলাম।
খুবই খারাপ লাগছে।
মাকে ভয় পাওয়ার মধ্যে খারাপ লাগার কিছু নেই। আপনি যান তার সঙ্গে দেখা করে আসুন।
আশহাব উঠে দাঁড়াল। সে দ্রুত যাচ্ছে। চিত্রার মনে হল—এই মানুষটার বর্তমান চেষ্টা এটেনডেন্ট মার কাছে পৌঁছানোর আগেই পৌঁছানো। যেন
মহিলাকে শুনতে না হয়, আমি এখন আসতে পারব না।
সাজেদা বেগম ছেলেকে দেখেই বললেন, আমাকে একা ফেলে রেখে কোথায় ঘুরঘুর করছিস?
আশহাব জবাব দিল না।
সাজেদা বললেন, ঐ মেয়েটা কোথায়?
কোন মেয়েটা?
রাতে আমার সঙ্গে থাকবে যে মেয়েটা। চিত্রা নাম।
আশহাব বলল, জানি না কোথায়।
সাজেদা অবাক হয়ে বললেন, মিথ্যা কথা বলছিস কেন? এটেনডেন্ট আমাকে বলল, তুই মেয়েটার সঙ্গে গল্প করছিলি। তুই বলে পাঠিয়েছিস আসতে পারবি না। ঘটনা কি? ঐ মেয়ের সঙ্গে তোর কি? তুই কি ঐ মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছিস?
দশ মিনিট কথা বললে প্রেমে পড়ে যায়?
তাহলে মিথ্যা কথা বললি কেন? কেন বললি, মেয়ে কোথায় তুই জানিস না। মুখ ভোতা করে থাকবি না। বল ঐ মেয়ের সঙ্গে তোর কি? তোর গা থেকে ভুরভুর করে সিগারেটের গন্ধ আসছে। তুই কি সিগারেট খেয়েছিস? কাছে আয়, মুখ শুকে দেখি।
আশহাব বলল, মুখ শুকতে হবে না মা। আমি সিগারেট খেয়েছি। আজই যে প্রথম খাচ্ছি তা-না, প্রায়ই খাই।
কি বললি, প্রায়ই খাস?
হ্যাঁ খাই।
সাজেদা বললেন, তোর ভাব-ভঙ্গি তো মোটেই ভালো মনে হচ্ছে না। এখন তো আমার মনে হচ্ছে তুই সুযোগ পেলে মদও খাস। আমার গা ছুঁয়ে বল তুই মদ খাস কি খাস না।
মা, আমি কয়েকবার খেয়েছি।
হতভম্ব সাজেদা নিজেকে সামলে নিয়ে চাপা গলায় বললেন, তোর বাবা একবার বন্ধুর বাসা থেকে মদ খেয়ে এসেছিল। তাঁকে কি করেছিলাম মনে আছে?
আশহাব বলল, মনে আছে। আমি যতদিন বাঁচব ততদিন মনে থাকবে। যে অন্যায় সে রাতে তুমি করেছ তার কোনো তুলনা নেই।
সাজেদা হতভম্ব গলায় বললেন, তুই আমার অন্যায়টা শুধু দেখলি। তোর বাপের অন্যায়টা দেখলি না? বন্ধুর বাসা থেকে মদ খেয়ে এসে আমাকে বলেছে জিরা-পানি খেয়েছে। তার মুখে না-কি জিরার গন্ধ। আমাকে জিরা চেনায়। আমি জিরার গন্ধ চিনি না? আমি মশলা ছাড়া রাধি?
আশহাব কামরা থেকে বের হল। মার একটানা কথা শুনতে অসহ্য লাগছে। মা কথা বলতেই থাকবেন, বলতেই থাকবেন। এক সময় কাঁদতে শুরু করবেন। আশহাব করিডোরে এসেই সিগারেট ধরাল। সিগারেটে টান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল মার সঙ্গে এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও চলত। সমস্যার সমাধান অবশ্যি দ্রুত করা যাবে। মার সামনে বসে বললেই হবে, মা! মুখে ভাত তুলে দাও। এই কাজটা সে কি এক্ষুনি করবে? না-কি কিছু সময় নেবে? খুক খুক কাশির শব্দে আশহাব তাকালো।
বুড়ো ভদ্রলোক কাশছেন।
দরজার পাশে প্লাস্টিকের চেয়ারে রশীদ সাহেব বসে আছেন। হাতে কাগজ কলম। হিসাব নিকাশ হচ্ছে। এই বুড়োর সঙ্গে রাত কাটাতে হবে। আগেই পরিচয় করে নেয়া ভালো হবে। যদি তেমন অসহনীয় হয় তাহলে বুফে কারে বসে থাকাটাও খারাপ না। আশহাব এগিয়ে গেল। বুড়োর সঙ্গে রাত কাটাবার একটা সুবিধা আছে। বুড়ো সিগারেট খায়। এত দূর থেকেও তার গা থেকে নিকোটিনের কড়া গন্ধ আসছে।
রশীদ সাহেব খাতায় কিছু হিসাব নিকাশ করছেন। এই মুহূর্তে তার হাতে সিগারেটের বদলে কলম। সিগারেট বিপদজনকভাবে ঠোঁটে ঝুলে আছে। যে কোনো মুহূর্তে ঠোঁট থেকে খসে পড়তে পারে। বৃদ্ধের নজর হাতের কাগজে। বসির নামের এটেনডেন্ট তাঁকে ট্রেনযাত্রীর পুরো সংখ্যা দিয়েছে।
ফুল টিকেট যাত্রী ৬২২ জন।
হাফ টিকেট যাত্রী ১৮ জন।
ইনজিনের সঙ্গে ড্রাইভারসহ ৪ জন।
গার্ডরুমে ২ জন।
জেনারেটর রুমে ৩ জন।
রশীদ সাহেব গভীর মনযোগে তাকিয়ে আছেন। যাত্রী সংখ্যার গুণ ভাগ চলছে। আশহাব এসে দাঁড়ানো মাত্র রশীদ সাহেব বললেন, আপনিই তো ডাক্তার! আমার সঙ্গে যার থাকার কথা?
আশহাব বলল, জি।
কটা বাজে দেখুন তো।
নয়টা দশ।
সর্বনাশ। নেশার সময় হয়ে গেছে। আসুনতো কামরায় যাই। আপনার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হোক। ঐ মেয়েটাকেও দরকার। আমার ঘর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। ঐ মেয়ে তো থাকবে আপনার মায়ের সঙ্গে?
জি।
তাহলে এক কাজ করুন আপনিই তার স্যুটকেস আপনার মার ঘরে রেখে আসুন। আমি চাই না মেয়েটা আমার কামরায় আবার আসুক। আমি মদ্যপান করব এই দৃশ্য দেখে মেয়েটার ভালো নাও লাগতে পারে।
আপনি মদ্যপান করবেন?
হ্যাঁ। আপনার কি কোনো অসুবিধা আছে?
আশহাব কি বলবে ভেবে পেল না। মদ্যপান অনেকেই করে তবে সরাসরি ঘঘাষণা দিয়ে কেউ কি করে? এই বুড়ো এমনভাবে বলছে যেন বিষয়টা মাইকে সবাইকে জানানো খুবই জরুরী। হ্যালো ট্রেনযাত্রী! মাইক্রোফোন টেস্টিং। ওয়ান টু থ্রি। আমি এখন মদ্যপান করব।
আশহাব বুড়োর পাশে বসেছে। টু সিটার বগিতে মুখোমুখি বসার সুবিধা নেই। দুটো সিটের একটা উপরে, একটা নিচে। আশহাবের মনে হল মুখখামুখি বসতে পারলে ভালো হত। বুড়োর কাণ্ডকারখানা ভালোমতো দেখা যেতো। বুড়ো মদ খাওয়ার বিষয়টা যথেষ্ট আয়োজন করে শুরু করেছে। ঝকঝকে গ্লাস। গ্লাসে পেঁচানো ন্যাপকিন, বরফের বাক্স, বরফ তোলার চামচ। এর মধ্যে বসির বরফ দিয়ে গেছে। বুড়ো গ্লাস হাতে নিয়ে আশহাবের দিকে তাকিয়ে বলল, চিয়ার্স।
আশহাব যন্ত্রের মতো বলল, চিয়ার্স।
বুড়ো বলল, মদ্যপানের সময় শরীরের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে চারটি ইন্দ্রিয় অংশ গ্রহণ করে। চোখ দেখে, জিহ্বা স্বাদ নেয় এবং স্পর্শ নেয়, নাক ঘ্রাণ নেয় শুধু একটা ইন্দ্রিয় অংশ নিতে পারে না। সেই ইন্দ্রিয়ের নাম কান, সাধু বাংলায় কর্ণ। কান যেন অংশ নিতে পারে শুধুমাত্র এই জন্যে অর্থাৎ কানকে শুনাবার জন্যে আমরা বলি Chears.
ও আচ্ছা।
বুড়ো বলল, মদ্যপানের সময় আমি প্রচুর কথা বলি। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে খানিকটা জড়তা আসে। মোটর একসানের উপর কন্ট্রোল কমে যায় বলেই—ক্রমাগত কথা বলা। আপনার পরিচয় আমি পেয়েছি, ইয়াং ডক্টর। আমার পরিচয় দেয়া হয়নি—আমি একজন দৈত্য! নাইস টু মিট ইউ।
বুড়ো হাত বাড়িয়েছে। আশহাবকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করতে হল। সে খানিকটা শংকিত বোধ করছে। বুড়ো দুটো চুমুক দিয়েই নিজেকে দৈত্য বলছে। গ্লাস শেষ করার পর কি বলবে কে জানে।
আশহাব বলল, আপনি দৈত্য?
বুড়ো বলল, হ্যাঁ দৈত্য। A giant. হা হা হা। Old giant. বৃদ্ধ দৈত্য!
আশহাব চুপ করে আছে। যে নিজেকে দৈত্য পরিচয় দিচ্ছে তার সঙ্গে আলাপ আলোচনা অর্থহীন।
আমি হচ্ছি ৮ নম্বর দৈত্য। Giant number eight. আমার কথা শুনে চমকাচ্ছ, না? এখন থেকে তুমি করে কথা শুরু করলাম। পেটে সামান্য পড়লেই নিজেকে অতি বৃদ্ধ একজন বলে মনে হয়। সবাইকে মনে হয় হাঁটুর বয়েসী, তোমাকে তুমি করে বলায় আহত বোধ করছ না তো?
আশহাব জবাব দিল না। সে আহত বোধ করলেও বৃদ্ধের কিছু যাবে আসবে বলে মনে হয় না। বৃদ্ধ হাতের গ্লাস খুব সাবধানে সিটের পাশের টেবিলে রেখে তার চামড়ার হ্যান্ড ব্যাগ খুলে একটা কমলা রঙের মোটা হার্ড কভার বই বের করে আশহাবের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল বইটার পাতা উল্টালেই বুঝবে কেন নিজেকে দৈত্য বলছি।
বইটার প্রথম পৃষ্ঠা দেখেই আশহাব চমকে উঠল। আমেরিকার ম্যাকমিলন কোম্পানির প্রকাশিত বই। নাম—Ten Giant of Math World, দশ জন Giant-এর ছবিও প্রথম পাতায় দেয়া। দশজনের একজন এই বুড়ো। আশহাব চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। বুড়ো বলল, এখন আমার বিষয়ে তোমার Perspective বদলে গেছে, না? আমাকে নিশ্চয়ই অন্যরকম ভাবে দেখছ?
জি।
মনে হচ্ছে না এই জ্ঞানী বুড়ো পাবলিক প্লেসে মদ্যপান করলেও করতে পারে। এইটুকু ছাড় বুড়োটাকে দেয়া যেতে পারে।
জি, মনে হচ্ছে।
এই বুড়োর প্রতি কিছুক্ষণ আগেও বাজে ধারণা পোষণ করছিলে এই ভেবে খারাপ লাগছে না?
লাগছে।
তুমি কি আমার সঙ্গে জয়েন করবে? ট্রেনের ঝাঁকুনির সঙ্গে প্রথম শ্রেণীর ব্লান্ডেড হুইস্কি ভালো লাগার কথা। তোমাদের ওমর খৈয়ম কি বলেছেন–
এই খানে এই তরুর তলে
তোমায় আমায় কৌতূহলে
যে কটিদিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে,
সঙ্গে রবে সূরার পাত্র
অল্প কিছু আহার মাত্র
আরেক খানি ছন্দ মধুর
কাব্য হাতে নিয়ে।
আশহাব বলল, তোমাদের ওমর খৈয়ম বলছেন কেন? ওমর খৈয়মতো আপনারও।
বৃদ্ধ বললেন, আমার না। আমি অংকের মানুষ। কবিতার সঙ্গে অংকের বিরোধ আছে। বৃদ্ধ আরেকটা গ্লাস বের করলেন। গ্লাসে হুইস্কি ঢাললেন, বরফ দিলেন। বুঝা যাচ্ছে ব্যবস্থাটা আশহাবের জন্যে। আশহাবের বলতে ইচ্ছা করছে—স্যার, আমি খাব না। আমার সঙ্গে আমার মা আছেন। মুখ থেকে গন্ধ পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আশহাব বলতে পারল না। তার মধ্যে প্রবল ঘোর তৈরি হয়েছে পৃথিবীর দশজন সেরা অংকবিদের একজন তার সামনে বসা, কি আশ্চর্য। সব বিদেশি নামের ভিড়ে দুটো দেশি নাম রামানুজন, রশীদ। বাংলাদেশের অনেকেই রামানুজনের নাম জানে রশীদ উদ্দিনের নাম কেউ কি জানে?
বৃদ্ধ গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, চিয়ার্স।
আশহাব গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, চিয়ার্স। সে ঠিক করেছে গ্লাসে চুমুক দেবে না। দ্রতা রক্ষার জন্যে গ্লাস হাতে নিয়ে বসে থাকবে। মাঝে মাঝে গ্লাসে ঠোঁট লাগাবে। চুমুক দেয়ার ভান করবে।
সাজেদার বগীর দরজা সামান্য খোলা
সাজেদার বগীর দরজা সামান্য খোলা। করিডোর থেকে দেখা যাচ্ছে তিনি হেলান দিয়ে আছেন। তাঁর চোখ ভেজা। মাঝে মাঝে তিনি গায়ের পাতলা চাদর দিয়ে চোখ মুছছেন। চোখ মুছার কারণে ঠোঁটের পানের রসও মুখের নানান জায়গায় লাগছে। তাঁকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
চিত্রা করিডোর থেকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তার হাতে ছোট্ট ঠোঙায় জর্দা। ট্রেন কিছুক্ষণের জন্যে কি একটা স্টেশনে থেমেছিল। পান-সিগারেট ওয়ালার কাছ থেকে সে পাঁচ টাকার জর্দা কিনেছে। চিত্রা বগীতে ঢুকবে কি টুকবে না বুঝতে পারছিল না। মোটামুটি অপরিচিতা এক মহিলা চোখ ভাসিয়ে কাঁদছেন। এই সময় কি তাঁকে বিরক্ত করা উচিত? ব্যক্তিগত দুঃখ যাপনের সময় উপস্থিত হওয়া যায় না।
চিত্রাকে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হল না। সাজেদা হাত ইশারায় তাকে ডাকলেন। চিত্রা বগীতে ঢোকামাত্র তিনি বললেন, আমার ছেলেটিকে দেখেছ?
চিত্রা বলল, জি না। আমি আপনার জন্যে জর্দা এনেছি।
সাজেদা বললেন, ফেলে দাও। আমি ঠিক করেছি জীবনে জর্দা খাব না।
চিত্রা বলল, আমি কি আপনার ছেলেকে খুঁজে বের করব?
খুঁজে বের করতে হবে না। তুমি বোস। দরজা বন্ধ করে বোস। তোমাকে আমি কিছু কথা বলব।
চিত্রা দরজা বন্ধ করে পাশে বসল। সাজেদা বললেন, আমার ছেলের চেহারা দেখে কি কেউ বলবে সে হাড় বজ্জাত? কেউ বলবে না। শান্ত শিষ্ট চেহারা! ভদ্র ব্যবহার। হাসি ছাড়া মুখে কথা নাই। তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই হেসে হেসে অনেক কথা বলেছে। বলে নাই?
জি, বলেছেন।
ম্যাজিক দেখায়েছে, তাই না?
চিত্রা বিস্মিত হয়ে বলল, না তো।
সাজেদা বললেন, গুণধর পুত্র। তার নানান গুন। তিনি একজন শখের ম্যাজিশিয়ান-টাকার ভিতর দিয়ে পেনসিল ঢুকাবে টাকা ছিড়বে না। হাতে পয়সা নিয়ে অদৃশ্য করে ফেলবে তারপর কারো নাক থেকে বের করবে। তাসের তিনটা সাহেব হয়ে যাবে তিনটা বিবি। ম্যাজিকের সব জিনিস সব সময় তার পকেটে থাকে। তোমাকে এখনো দেখায় নি?
না।
দেখাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখাবে। পয়সা বের করার কথা বলে তোমার কানে হাত দেবে। নাকে হাত দেবে। মেয়েছেলের গায়ে হাত দেয়ায় আনন্দ আছে না। মহানন্দ।
আপনি মনে হয় উনার উপর খুব রেগে আছেন।
সাজেদা কড়া গলায় বললেন, রেগে থাকব কেন? আমি তার উপর দিলখোশ। সে এখানে ঢুকলেই তাকে আমি কোলে বসিয়ে গালে চুমা দিব আর ও আমার বাবা ও আমার সোনা বলে মাথায় হাত বুলাব। সে একবার কামরায় ঢুকে দেখুক। কতবড় সাহস! আমার সঙ্গে গলা উঁচিয়ে কথা বলে। বুক ফুলিয়ে বলে, আমি কয়েকবার মদ খেয়েছি। কি বিরাট কাজ করে ফেলেছ। তোমার মা হিসেবে আমার কত গর্ব হচ্ছে। আমার সোনা মানিক মদ খায়, কি আনন্দ! এত আনন্দ আমি কোথায় রাখি। আমার সোনা মানিককে মদ খাওয়ার জন্যে সোনার মেডেল দেব। মেডেলে লেখা থাকবে মদারু শ্রেষ্ঠ।
কথাবার্তায় সাময়িক বিরতি পড়ল। সাজেদা পান সাজতে বসলেন। চিত্রার হাত থেকে জর্দার প্যাকেট নিয়ে এক গাদা জর্দা পানে ঢাললেন। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে চিত্রা বলল, রাতে আপনি কখন খাবেন? বুফে কারে খেতে হলে আগে অর্ডার দিতে হবে। ওরা তাই বলল।
সাজেদা বললেন, খাবার আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। হট পটে গরম খাবার আছে। তুমিও আমার সঙ্গে খাবে। আশহাব বাদ। মদারু ছেলের সাথে বসে আমি খাব না। মা, তুমি একটা কাজ কর–আমার মদারু পুত্রকে ডেকে আন। তুমি ওর সঙ্গে কামরায় ঢুকবে না। আমি এমন কিছু ঘটনা ঘটাব যা তোমার দেখা ঠিক হবে না। কথায় বলে সাপের পাঁচ পা দেখা—আমি মদারুটাকে সাপের পঞ্চাশ পা দেখাব।
চিত্রা বগী থেকে বের হল। করিডোরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সে রওনা হল বুফে কারের দিকে। বুফে কারে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়েছিল। অর্ডার ক্যানসেল করতে হবে। এই মহিলা তাকে না খাইয়ে ছাড়বেন না এটা বুঝা যাচ্ছে। শুধু যে খাওয়াবেন তা-না, নানান অত্যাচারও করবেন। ভালবাসা দেখাতে গিয়ে অত্যাচার।
রশীদ সাহেব ধাক্কার মতো খেয়েছেন। ডাক্তার ছেলেটা যে এত ওস্তাদ তিনি কল্পনাও করে নি। তাঁর মতো সজাগ চোখের একজন মানুষকে বোকা বানানো সম্পূর্ণ অসম্ভব। অথচ এই ছেলে তাই করেছে। চোখের সামনে পাঁচ টাকার একটা কয়েন অদৃশ্য করেছে। কোটের হাতায় লুকিয়ে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। কোটের হাতা সে গুটিয়ে নিয়েছে। একটা বস্তু হঠাৎ অদৃশ্য হতে পারে না। Volatile কোনো বস্তু অদৃশ্য হলে বলা যেত যে হাতের মুঠোর উত্তাপে বস্তুটা বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। পাঁচ টাকার কয়েন কোনো ভলাটাইল বস্তু না।
আশহাব বলল, স্যার, আপনার মনে হয় ম্যাজিকটা খুব পছন্দ হয়েছে।
রশীদ সাহেব বললেন, পছন্দ হবার কিছু না। এটা নতুন কেনা শার্ট না যে পছন্দ হবে। আমি বিভ্রান্ত হয়েছি। কেন বিভ্রান্ত হয়েছি এটা বের করতে হবে। আমি অল্প বুদ্ধির মানুষ না যে যাই দেখব তাতেই বিভ্রান্ত হব।
অতিবুদ্ধিমানরাই সহজে বিভ্রান্ত হয়।
Don’t talk nonsense.
আশহাব চুপ করে গেল। বৃদ্ধের হতচকিত অবস্থাটায় সে খুবই মজা পাচ্ছে। কাউকে ম্যাজিক দেখিয়ে এত আরাম এর আগে সে পায়নি।
স্যার, আরেকটা খেলা কি দেখাব? রুমালের কালার চেঞ্জ। লাল রঙের রুমাল প্রথমে হবে সবুজ তারপর শাদা।
যেটা দেখিয়েছ সেটার রহস্য আগে বের করি। সম্পূর্ণ নতুন দিক থেকে চিন্তা শুরু করেছি। এতে মনে হয় কাজ হবে।
রশীদ সাহেব গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বললেন, তোমাকে কি আরেক পেগ দেব?
দিন।
তোমার দুটা হয়েছে। এটা নিলে হবে থার্ড। মেজাজ ফুরফুরে করার জন্যে তিনটার বিকল্প হয় না। ইংরেজিতে এই কারণেই বলে থ্রি ইজ কোম্পানি।
সেটাতো মানুষের জন্যে।
মানুষের জন্যে যেটা সত্যি, হুইস্কির জন্যেও সত্যি।
আশহাব নিজের গ্লাস হাতে নিতে নিতে বলল, ম্যাজিকটার রহস্য উদ্ধারে নতুন কোন দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছেন একটু কি বলবেন?
বৃদ্ধ বললেন, অবশ্যই বলব। যখন চিন্তা শুরু করব তখন বলব। এখনো চিন্তা শুরু করিনি। এখন ব্রেইনকে রেস্ট দিচ্ছি।
কি ভাবে রেস্ট দিচ্ছেন?
সম্পূর্ণ অন্য বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি। অন্য বিষয়টা কি জানতে চাও?
চাই।
বৃদ্ধ সিটে পা তুলে আরাম করে বসতে বসতে বললেন, এই ট্রেনের যাত্রী সংখ্যা আমার কাছে আছে। সর্বমোট যাত্রী সংখ্যা ৬২২ যোগ ১৮ যোগ ৪ যোগ ২ যোগ ৩ অর্থাৎ ৬৪৯।
আশহাব বলল, এর মধ্যে কিছু বিভিন্ন স্টেশনে নামবে, কিছু উঠবে।
তা ঠিক। তবে গড় সংখ্যা ৬৪৯।
জি।
এই যাত্রীদের মধ্যে একজন মৃত।
জি।
একজন আছে যে সবচে জ্ঞানী।
আশহাব বলল, সবচে জ্ঞানী আপনি হওয়া সম্ভব।
বৃদ্ধ বললেন, তা সম্ভব। তবে আমার চেয়েও জ্ঞানী কেউ থাকতে পারে। আমার সাফল্য বেশি, সাফল্য এবং জ্ঞান এক না।
আশহাব বলল, মানলাম।
একজনকে পাওয়া যাবে সবচে বোকা, একজন থাকবেন সবচে ধার্মিক।
এক মাওলানা সাহেব যাচ্ছেন। সারাক্ষণ তসবি টানছেন। উনি হবেন সবচে ধার্মিক।
বৃদ্ধ বললেন, মাওলানাকে আমিও দেখেছি। হ্যাঁ সে হতে পারে। একজন হবে সবচে ক্ষমতাধর।
আশহাব বলল, সেটা কে আমি জানি। এই ট্রেনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যাচ্ছেন। তিনি সেলুন কারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কি সবচে ক্ষমতাধর?
জি স্যার।
বৃদ্ধ বললেন, উনার নামটা জানা দরকার।
নাম দিয়ে কি করবেন?
বৃদ্ধ বলল, নাম দিয়েও একটা খেলা করা যাবে। ধরো উনার নাম যদি হয় জলিল তাহলে আমরা দেখব যাত্রীদের মধ্যে কতজন জলিল আছে। এই জলিলদের মধ্যে সামাজিক অবস্থা কার কি। তাদের জন্ম তারিখ যদি বের করা যায় তাহলে আমরা হিসাব করব একই দিনে জন্মেও সামাজিক অবস্থানে এখাকে কোথায়?
আশহাব বলল, লাভ কি?
বৃদ্ধ বললেন, লাভ লোকসান নিয়ে চিন্তা করছ কেন? আমরা কি ট্রেনে ব্যবসা করতে এসেছি? আমাদের কি ব্যালেন্স শীট তৈরি করতে হবে? তুমি চেষ্টা করে দেখতে মন্ত্রীর নামটা জোগাড় করা যায় কি-না। গ্লাসটা শেষ করে তারপর যাও! লাষ্ট একটা কি খাবে? নাম্বার ফোর।
এখনই মাথা ঘুরছে! আর খাওয়া ঠিক হবে না।
পিথাগোরাসের ধারণা, চার একটি magical number। সংখ্যার ধারায় চার হচ্ছে প্রথম সংখ্যা যার বর্গমূল হয়। বর্গমূল আবার প্রাইম নাম্বার। দিক আছে চারটা পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ।
আশহাব বলল, আপনি যে ভাবে ব্যাখ্যা করলেন তাতে চার পর্যন্ত যাওয়া যায়। চার পর্যন্ত না গেলে পিথাগোরাসের প্রতি অসম্মান করা হবে।
ঠিক বলেছ। তুমি মন্ত্রীর নাম জেনে আস। ততক্ষণ আমি তোমার ম্যাজিকের রহস্যটা চিন্তা করি। তারপর আমরা মহান পিথাগোরাসকে সম্মান দেখাব।
আশহাব কামরা থেকে বের হয়েই চিত্রার সামনে পড়ে গেল। চিত্রা বলল, আপনাকেই তো খুঁজছি।
আশহাব বলল, কেন?
আপনার মা আপনার জন্যে ব্যস্ত হয়ে আছেন।
আশহাব বলল, তাকে আরো ব্যস্ত হতে বলুন। উনি আমার জন্যে ব্যস্ত কিন্তু আমি এই মুহূর্তে অন্য কাজে ব্যস্ত।
চিত্রা বলল, অন্য কাজটা কি?
এই ট্রেনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাচ্ছেন। আমার বর্তমান মিশন তার নাম জানা।
তাঁর নাম A K K।
A K K মানে?
আবুল খায়ের খান।
উনার জন্মতারিখ জানেন?
জন্মতারিখতো জানিনা। জন্মতারিখ দিয়ে কি হবে?
উনার রাশি গণনা করব। উনি কোন রাশির জাতক, উনার শুভ সংখ্যা কি ইত্যাদি বের করা হবে।
চিত্রা বলল, আপনার কি হয়েছে একটু বলবেন? আপনার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। আপনি এলোমেলো পা ফেলছেন।
আশহাব বলল, আমার কি হয়েছে আপনি সত্যি জানতে চান?
চাই।
আশহাব বলল, তিন পেগ হুইস্কি খেয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যে আরেক পেগ খাব। তখন হবে চার পেগ। পিথাগোরাসের মতে চার একটি ম্যাজিকেল সংখ্যা। চারের বর্গমূল হল দুই। এটি একটি প্রাইম সংখ্যা। মহান অংকবিদ পিথাগোরাসের কারণেই আমাকে চার পর্যন্ত যেতে হচ্ছে। আর কিছু জানতে চান?
চিত্রা বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। আশহাব বলল, আপনি কি আমার জন্যে একটা কাজ করতে পারবেন? ছোট্ট কাজ। কাজটা করলে আমার খুব উপকার হয়।
কাজটা কি?
আমার মাকে গিয়ে বলবেন যে তার গুণধর পুত্র মদ খাচ্ছে। গ্রীন লেভেল হুইস্কি। ভালো কথা, মন্ত্রীর নামটা আরেকবার বলুন। ভুলে গেছি।
আবুল খায়ের খান।
গুড।
মাওলানা সাহেবের নামটা জানতে পারলে ভাল হত। উনার নামের প্রয়োজন পড়তে পারে।
কোন মাওলানা?
আছেন একজন ৭ নাম্বার বগিতে আছেন। ধারণা করা যাচ্ছে তিনি ট্রেনের ৬৪৯ জন যাত্রীর মধ্যে সবচে ধার্মিক।
আশহাব রশীদ সাহেবের কামরায় ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে ফেলল। কামরার বাইরে হতভম্ব অবস্থায় চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে।
মাওলানা সাহেবের নাম আজিজুর রহমান। বয়স ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ। রোগা পাতলা চেহারা থুতনিতে সামান্য দাড়ি। মাওলানা সাহেব মনে হচ্ছে শৌখিন মানুষ। তাঁর গায়ের পাঞ্জাবীটা দামী। ফুলের নকশা কাটা। পাঞ্জাবীর উপর যে শালটা দিয়েছেন সেই শালও যথেষ্ট দামী। মাথার টুপিটা রঙিন নকশাদার।
মাওলানা স্ত্রীর সঙ্গে রাগারাগি করছেন তবে গলা নামিয়ে। রাগারাগির কারণ তাঁর স্ত্রী আফিয়া মাগরেবের নামাজ পড়ে নি।
মাওলানা বললেন, নামাজটা কেন পড়লে না একটু বলতো শুনি। তুমি জান নামাজ কাজা করতে দেখলে আমার ভাল লাগে না।
আফিয়া বলল, আমার শরীরের যে অবস্থা নিচু হতে পারি না। সেজদায় যাব কি ভাবে?
বসে বসে নামাজ পড়। তোমার এই অবস্থায় বসে নামাজ জায়েজ আছে।
আফিয়া বলল, আমার অবস্থা দেখলে আল্লাহপাক বলতেন, যা বেটি তোর নামাজ এখন মাফ।
মাওলানা স্ত্রীর বেয়াদবিতে কিছুক্ষণের জন্যে বাক্যহারা হলেন। নিজেকে সামলাতে সময় লাগল। ধর্ম কর্ম, আল্লাহপাক এই সব অতি গুরুতর বিষয় নিয়ে আফিয়ার হালকা কথাবার্তার অভ্যাস আছে। আগে অনেকবার লক্ষ্য করেছেন। অনেকবার নিষেধও করেছেন।
আফিয়া!
জি।
তুমি একটু আগে মস্তবড় একটা গুনার কাজ করেছ। তওবা কর। তওবা করার পর কাজা নামাজ পড়।
কি ভাবে তওবা করব?
আমার সঙ্গে তিনবার বল, আল্লাহুম্মাগ ফিরলি ওয়ার হামনি।
আফিয়া তিনবার বললেন।
তোমার অজু আছে না?
আছে।
জানালার সামনে বসে বসে পড়। জানালাটা পশ্চিম।
ট্রেন যখন ঘুরবে তখনতো কেবলা বদলে যাবে।
মাওলানা বিরক্ত গলায় বললেন, চলন্ত ট্রেনে নামাজে দাঁড়াবার সময় কেবলা ঠিক করে নিতে হয়। এরপরে কেবলা বদলে গেলে অসুবিধা নাই।
আফিয়া বললেন, আপনি আমার জন্যে আরেক বোতল পানি আনেন। পানি খেয়ে তারপর নামাজ পড়ব।
মাওলানা বললেন, আগের বোতলের পানিতে শেষ কর নাই অর্ধেক এখনো আছে। আফিয়া তুমি নামাজ না পড়ার বাহানা করছ। আল্লাহপাক খুবই রাগ হবেন।
আফিয়া বলল, আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি। আমি এখন নামাজ পড়লেই আল্লাহপাক রাগ হবেন। আমার পানি ভাঙছে। আপনি চিন্তায় পড়বেন বলে কিছু বলি নাই। ট্রেনেই আমার সন্তান হবে। আপনি খোঁজ নেন ট্রেনে কোনো ডাক্তার আছে কি-না।
কথা শেষ করার আগেই প্রবল ব্যাথায় আফিয়া মুখ বিকৃত করল। চাপা গলায় তার মাকে ডাকল—মা! মা গো। মাওলানা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। একি মুসিবত! আল্লাহপাকের এটা আবার কোন পরীক্ষা।
এই মুহূর্তে হতভম্ব অবস্থায় অন্য যে ব্যক্তি মোবাইল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তার নাম এ কে কে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল খায়ের খান। তিনি কোন দলের মন্ত্রী তা ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়োজন নেই, সব দলের মন্ত্রীই এক। তাদের মধ্যে গুণগত প্রভেদ যেমন নেই, দোষগত প্রভেদও নেই। তাঁদের সঙ্গে গ্রাম্য বাউলদের কিছু মিল আছে। বাউলরা যেমন বন্দনা না গেয়ে মূল গান গাইতে পারেন না, এরাও সে রকম নিজ নিজ নেত্রীর বন্দনা না গেয়ে কোনো কথা বলতে পারেন না।
আবুল খায়ের খান সাহেবের হাতে মোবাইল। তিনি মোবাইল বন্ধ করার পরেও মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর গলায় টক ভাব হচ্ছে। প্রচণ্ড এসিডিটি হলে এ রকম হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুক জ্বলা শুরু হবে।
মন্ত্রী মহোদয়ের বুক জ্বালা করার কারণ এসিডিটি না। তিনি এই মাত্র জেনেছেন তার মন্ত্রীত্ব নেই। আসল জায়গা থেকে খবর এখনো আসেনি। যে জায়গা থেকে এসেছে সেটাও নির্ভরযোগ্য। তিনি ইচ্ছা করলেই আরো কয়েকটা টেলিফোন করে মূল সত্যটা জানতে পারেন। এই মুহূর্তে ইচ্ছা। করছে না।
মন্ত্রী মহোদয়ের স্ত্রী সুরমা হাতে টমেটো জুস নিয়ে এগিয়ে এলেন। আহ্লাদি গলায় বললেন, এই, গান কখন শুরু হবে? যমুনা আর তার বর গান শুনতে চাচ্ছে।
যমুনা সুরমার ছোট বোন। গত সপ্তাহে সেনাকুঞ্জে তার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর তার মন্ত্রী দুলাভাই তাদের দেশের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছেন। আনন্দ ফুর্তি করতে করতে যাওয়া হবে ভেবেই ট্রেনে যাওয়া হচ্ছে। সেলুন কারে নানান আনন্দ ফুর্তির ব্যবস্থা। একটা ব্যান্ড দল যাচ্ছে। ব্যান্ডের নাম Hungry। ভিডিও ম্যান যাচ্ছে। তার দায়িত্ব ভিডিও করা। কোনো আনন্দ যেন বাদ না পড়ে। ঢাকা ক্লাব থেকে একজন বারটেনডার নেয়া হয়েছে যে ককটেল বানানোয় ওস্তাদ। সম্প্রতি সুরমার ককটেল আসক্তি হয়েছে। তিনি বিশেষ বিশেষ পার্টিতে ককটেলের ব্যবস্থা রাখেন। সিঙ্গাপুর থেকে ককটেল বানানোর উপর একটা বইও কিনেছেন। তাঁর ইচ্ছা আজ বই দেখে কয়েকটা আইটেম বানাবেন।
সুরমা বললেন, এই, কথা বলছ না কেন? গান কি শুরু হবে?
মন্ত্রী শুকনো গলায় বললেন, হুঁ।
তোমার শরীর খারাপ না-কি?
এসিডিটি হচ্ছে।
সুরমা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, এন্টাসিড খেয়ে এক গ্লাস ঠাণ্ডা দুধ খাও। দুধ নিয়ে এসেছি। দেব?
দাও।
একটু আগে টেলিফোন কে করেছে?
অফিস থেকে।
সুরমা বিরক্ত গলায় বললেন, তারা কি একটা সেকেন্ডের জন্যে তোমায় বিশ্রাম দেবে না! দিন রাত কাজ করতে হবে? মোবাইলটা অফ করে রাখতো। মন্ত্রী তো আরো আছে। একমাত্র তোমাকেই দেখলাম জীবনটা দিয়ে দিচ্ছ। নেত্রীর এত কাছের যে সালাম সাহেব সন্ধ্যার পরেইতো সে বোতল নিয়ে বসে। তখন তার টিকির দেখা পাওয়া যায় না।
মন্ত্রী বললেন, থামতো।
সুরমা বললেন, থামব কেন? সত্যি কথা বলতে আমি ভয় পাই না। আমি সালাম সাহেবের মুখের উপর এই কথা বলতে পারব। তার স্ত্রী গত এক মাসে তিনবার বিদেশ গিয়েছে। বেইজিং থেকে একটা খাট কিনে এনেছে একুশ হাজার ডলার দামে। টাকা কোত্থেকে আসে আমি জানি না? আমি চামচে দুধ খাওয়া মেয়ে না।
সুরমা টমেটো জুসের গ্লাস নিয়ে খাস কামরার দিকে রওনা হয়েছেন। যমুনা তার স্বামী ফয়সলকে নিয়ে সেই কামরাতেই আছে। দুজন হাত ধরাধরি করে বসা ছিল। সুরমাকে দেখে হাত ছেড়ে দিল। সুরমা বললেন, ফয়সল তুমি আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছ কেন বল তো? স্ত্রীর হাত ধরে বসে থাকবে না তো কার হাত ধরে বসবে। আমার মধ্যে কোনোরকম প্রিজুডিস নেই। (সুরমার পড়াশোনা ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। তার দ্রুত উন্নতি হয়েছে। কথাবার্তায় তিনি এত চমৎকার করে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন যে তাঁর শিক্ষা দিক্ষা নিয়ে বিভ্রান্ত হতে হয়। প্রিজুডিস শব্দটা গত সপ্তাহে শিখেছেন—এর অর্থ মন খোলা। যে কোনো কিছুতেই কিছু মনে করে না।) সুযোগ পেলেই সুরমা প্রিজুডিস শব্দটা ব্যবহার করেন। যাতে সড়গড় হয়ে যায়।
সুরমা বসতে বসতে বললেন, ফয়সল এক গ্লাস টমেটো জুস খাবে? খেয়ে দেখতে পার। সামান্য ভদকা দেয়া হয়েছে টমেটোর গন্ধ দূর করার জন্যে। এরা ব্লাডি মেরী না-কি-কি যেন বলে।
ফয়সল বলল, খেয়ে দেখতে পারি।
যমুনা বলল, বড়পা, ও খেলে আমাকেও একটু দিতে হবে। আমি কোনদিন ভদকা খাইনি আজ খেয়ে রাশিয়ান হয়ে যাব। আমার নাম হবে যমুনাভস্কি।
সুরমা বললেন, তুই ভদকা খাবি মানে পাগল নাকি?
এইসব বললে হবে না, আমিও এক চুমুক খাব। এক চুমুক খেলে কি হয়? আমি যমুনাভস্কি হব।
সুরমা বললেন, ঠিক আছে তোকে দেব এক গ্লাস। ঘ্যান ঘ্যান বন্ধ করে তোর দুলাভাইকে এক গ্লাস দুধ দিয়ে আয়। ওর এসিডিটি হচ্ছে। কোনো বিশ্রাম নাই কিছু নাই শুধু কাজ আর কাজ—এসিডিটিতো হবেই। একটু বেড়াতে যাচ্ছে এরমধ্যেও টেলিফোনের পর টেলিফোন।
যমুনা বলল, আপা দুলাভাইকে বল মোবাইল সেটটা জানালা দিয়ে ফেলে দিতে। ময়মনসিংহ পৌঁছে আরেকটা কিনে নেবে।
সুরমা বললেন, তুই যে কি পাগলের মতো কথা বলিস। দিনের মধ্যে দশবার প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করেন। সেট ফেলে দিলে উনার কল কে রিসিভ করবে? প্রধানমন্ত্রীর সবচে কাছের মানুষ বলতে এখন সে।
মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে টেলিফোন এসেছে
মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে টেলিফোন এসেছে। টেলিফোন করেছে তার বড় ছেলে ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের গলার স্বর চাপা। ভীত ভাবও আছে।
বাবা!
হুঁ।
ভাল আছ বাবা?
হুঁ।
আমার বিষয়ে কেউ কি তোমাকে টেলিফোন করেছে?
না। তুই কি নতুন কোনো ঝামেলা পাকিয়েছিস?
উঁহুঁ। বাবা তোমরা কি মজা করছ? গানের দলটা কেমন?
জানিনা কেমন। গান শুরু হয় নি।
আচ্ছা বাবা শোন, আমি ছোট্ট একটা ঝামেলায় পড়েছি।
কি ঝামেলা?
কিছু দুষ্ট লোক আমাকে ফলস একুইজিশান দিচ্ছে। আমি নাকি একটা মেয়েকে রেপ করেছি। অথচ ঘটনা যখন ঘটে তখন আমি নারায়নগঞ্জে আমার এক বন্ধুর বাসায়। তুমি বিখ্যাত মানুষ হওয়ায় সবাই লেগেছে আমার পেছনে। আমাকে দিয়ে তারা তোমার ক্যারিয়ার নষ্ট করতে চায়।
মেয়েটা এখন আছে কোথায়? হা
সপাতালে।
পুলিশ কেইস হয়েছে?
ওরা কেইস করতে গিয়েছিল। ওসি সাহেব কেইস নেননি। উনি খুবই ভদ্রলোক। আমাকে টেলিফোন করে বলেছেন, চিন্তা না করতে।
পত্রিকায় জানাজানি হয়েছে?
এখনো হয়নি। পত্রিকা চেক দেয়ার ব্যবস্থা করেছি।
কি ভাবে?
টাকা পয়সা দিয়ে। তৌহিদ আছে আমার ফ্রেন্ড। সে এইসব ব্যাপারে ওস্তাদ।
টেলিফোনের লাইন কেটে গেল। আবুল খায়ের খান সাহেব কপালের ঘাম মুছলেন। তার ছেলে এখনো মন্ত্রীত্ব যাবার খরবটা জানে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনে ফেলবে। তখন কি হবে? মন্ত্রীত্ব চলে যাওয়া পিতার পুত্ররা ভয়াবহ অবস্থায় পড়বে এটাতো জানা কথা। ইমতিয়াজ এ্যারেস্ট হবে আজ রাতেই। কোর্টে চালান করা মাত্র কোর্ট তিন দিনের রিমান্ড দিয়ে দেবে।
আবুল খায়ের খান সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মন্ত্রী থাকতে থাকতে ছেলের বিয়ে দিতে পারলেন না। দিতে পারলে উপহার দিয়ে ঘর ভরতি করে ফেলতে পারতেন। গাড়ি পাওয়া যেত কম করে হলেও দুটা। নিউ টেক্সটাইলের মালিক মজিদ সাহেবতো বলেই রেখেছেন, ছেলের বিয়ের অন্তত ছমাস আগে আমাকে খবর দিবেন। আমি জাপান থেকে ব্রান্ড নিউ গাড়ি আনিয়ে দেব। আপনার ছেলে তার চাচার কাছ থেকে একটা নতুন গাড়ি পাবে না তো কে পাবে?
সুরমা নিজেই গ্লাসে করে দুধ এনেছেন। তিনি স্বামীকে আদুরে গলায় বললেন, এক চুমুকে খেয়ে ফেলতো। এই নাও এন্টাসিড। দুধ খাওয়ার পর একটা ট্যাবলেট খাবে।
খায়ের সাহেব দুধের গ্লাসে চুমুক দিলেন। সত্যিই বুক জ্বালাপোড়া করছে।
সুরমা বললেন, এই শোনো, ইমতিয়াজ এই মাত্র টেলিফোন করেছে। শত্রুতা করে কে না-কি তাকে ফাসাতে চেষ্টা করছে। ধানমন্ডি থানার ওসি সাহেবকে একটু বলে দিও। না-কি আমি বলব?
তোমার বলার দরকার নেই।
আমি বলতে পারি। আমাকে উনি খুবই সম্মান করেন।
খায়ের সাহেব বললেন, বললাম তো তোমাকে টেলিফোন করতে হবে। কথা যা বলার আমি বলব।
বাবুর্চি জিজ্ঞেস করছিল ডিনার কখন দিবে। ঠিক দশটার সময় দিতে বলব?
বল।
দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে বসে আছ কেন। খাও।
তুমি তোমার কাজে যাও। আমি সময় মতো খেয়ে নেব।
সুরমা বললেন, তুমি একা একা আছ কেন? এসো সবাই গল্প করি।
খায়ের সাহেব বিরক্ত ভঙ্গিতে বললেন, আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও।
তোমার সমস্যা কি? দশটা না পনেরোটা না—একটা মাত্র শালী। আয়োজন করে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছ, একটা কথা বলছ না। ওরা কি মনে করবে? যমুনার হাসবেন্ড কি যে ভালো জোক বলতে পারে। শুনলে হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে। এসো জোক শুনে যাও।
একটা জরুরি টেলিফোন করে আসি। পাঁচটা মিনিট দাও।
মনে থাকে যেন পাঁচ মিনিট—আমি কিন্তু ঘড়ি দেখব। পাঁচ মিনিটের মধ্যে না এলে যমুনা এসে তোমাকে এ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।
সুরমা দ্রুত কেবিনের দিকে রওনা হলেন, তখনই ছোট্ট অঘটন ঘটল। সেলুন কারের একজন এটেনডেন্টের সঙ্গে তাঁর ধাক্কা লেগে গেল। এটেনডেন্টের হাতে ট্রে। ট্রে-তে তিনটা টমেটো জুসের গ্লাস। একটা গ্লাস গড়িয়ে পড়ল সুরমার শাড়িতে। সুরমা কঠিন গলায় বললেন, এই স্টুপিড। তুমি কি অন্ধ। জবাব দাও, তুমি কি অন্ধ? এই শাড়ির দাম জান?
এটেনডেন্ট বেচারা গেল হকচকিয়ে। এইবার তার হাতের ট্রে পড়ে গেল। দ্বিতীয় গ্লাসটাও গড়িয়ে পড়ল। সুরমা চেঁচিয়ে বললেন, এই স্টুপিডটাকে এখানে কে এনেছে? এই ব্যাটা বদমাশ কানে ধর। কানে ধর বললাম।
খায়ের সাহেব বললেন, সুরমা বাদ দাও তো।
সুরমা কঠিন গলায় বললেন, আমার এডমিনস্ট্রেশনে তুমি নাক গলাবে না। এদের শাস্তি না দিলে এরা ঠিক হবে না। হাদার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? কানে ধর। কানে ধর বললাম। গুড! এখন উঠবোস কর। আমি না বলা পর্যন্ত থামবে না।
সেলুন কারের যাত্রীরা বের হয়ে এসেছে। নতুন বিয়ে হওয়া মেয়েরা স্বামী আশে পাশে থাকলে আহ্লাদ করতে পছন্দ করে। যমুনা সেই কারণেই হয়ত বলল, ভিডিও ম্যান কোথায়? এই ভিডিও ম্যান! দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভিডিও করুন না। এমন একটা ইন্টারেস্টিং ইভেন্ট! আপনি ক্যামেরা নিয়ে হা করে আছেন।
ভিডিও ম্যান ভিডিও স্টার্ট করল। যমুনা বলল, আপা দেখ, ক্রিমিন্যাল মুখ বাঁকা করে আছে। কাদার চেষ্টা করছে। কাঁদতে পারছে না। হ্যালো ভিডিও ম্যান! আপনি ওর ফেসটা ক্লোজে ধরুন। বিগ ক্লোজ।
আবুল খায়ের সাহেব এই পর্যায়ে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেন। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, খুব জরুরি কথা, ঐদিকে চল। এক্ষুনি এসো। রাইট নাউ। সুরমা অনিচ্ছায় এগিয়ে গেলেন। কানে ধরে উঠবোসের দৃশ্য ভিডিও হচ্ছে। দেখতে তাঁর মজা লাগছে।
সুরমা বললেন, কি বলতে চাও?
আবুল খায়ের বললেন, আমার মন্ত্রীত্ব নেই।
কি বললে?
এক ঘণ্টা আগে খবর পেয়েছি। তোমরা আপসেট হবে বলে তোমাদের বলি নি।
সুরমা হতভম্ব গলায় বললেন, সর্বনাশ!
সর্বনাশ মানে, মহাসর্বনাশ। যাকে শাস্তি দিচ্ছ কিছুক্ষণের মধ্যে সেও জানবে আমি আর মন্ত্রী না। তখন কি হবে বুঝতে পারছ? যাও এক্ষুনি শাস্তি বন্ধ কর। যমুনা আর তার স্বামীকে এখনি কিছু বলার দরকার নেই। তাদেরকে পরে জানালেও হবে।
সুরমা কানে ধরে উঠবোস করা দৃশ্যের কাছে এগিয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, হয়েছে হয়েছে আর লাগবে না। একসিডেন্ট সবারই হয়। আমি নিজে কতবার হাত থেকে গ্লাস ফেলেছি। আমার নিজের মেজাজ অন্য একটা কারণে খারাপ ছিল। ওভার রি-এক্ট করেছি। এই তোমার নাম কি?
সবুর।
সুরমা হ্যান্ড ব্যাগ খুলতে খুলতে বললেন, একশটা টাকা রাখো। চা নাশতা খেও।
সবুর টাকা নিল না। মেঝেতে পড়ে থাকা গ্লাস নিয়ে সেলুন কার থেকে বের হয়ে গেল।
যমুনা বলল, কত বড় বেয়াদব দেখেছ আপা। থাপড়ায়ে এর দাঁত ফেলে দেয়া উচিত ছিল। তুমি আবার মহিলা হাজী মোহাম্মদ মহসীন হয়ে গেলে— একশ টাকা বখশিস।
মাওলানা আজিজুর রহমান স্ত্রীর হাত ধরে বসে আছেন। ভয়ে এবং আতংকে তিনি অস্থির। নিজের মনের ভয় কমানোর জন্যে তিনি ইয়া আহাদু একশবার পড়েছেন। মনের ভয় কমছে না। সত্যি সত্যি ট্রেনে কিছু হয়ে গেলে মহা বিপদ হবে। ট্রেনের এটেনডেন্ট বসিরকে কানে কানে বলেছেন একজন লেডি ডাক্তার আছে কি-না এই খোঁজ করতে। ব্যাটা খোঁজ করবে কি-না কে জানে। তিনি নিজেই প্রতিটি বগিতে গিয়ে ডাক্তার খুঁজতে পারেন। স্ত্রীকে ফেলে যেতে ইচ্ছা করছে না। তিনি মহাবিপদের দোয়া একমনে পড়ে যাচ্ছেন। দোয়া ইউনুস।
ব্যাথার একেকটা প্রবল ঝাপ্টা আসছে আফিয়া স্বামীকে খামচি দিয়ে ধরছে এবং ব্যাকুল গলায় বলছে আমার আম্মু কই। ও আম্মু আম্মু।
মাওলানা বললেন, আল্লা-খোদাকে ডাক। আম্মা আম্মা করছ কেন?
আফিয়া বলল, আল্লাহপাকরে তো আপনি ডাকতেছেন। আমি আম্মুরে ডাকি। ও আম্মু। আম্মু।
মাওলানা বললেন, সমস্যা তুমি তৈরি করেছ। আম্মার কাছে যাব। আম্মার কাছে যাব। এখন দেখেছ অবস্থা। তোমার মার কাছে যাবার জন্যে রওনা না দিলে এই বিপদ হত না।
আফিয়া বলল, চুপ করে বসে থাকেন। কথা বন্ধ। কথা বললে কানে ঝন ঝন করে।
মাওলানা চুপ করে গেলেন। তিনি মনে মনে দুরুদে-শেফা পাঠ করা শুরু করেছেন।
বসির আরেক দফা বরফ এনেছে। রশীদ সাহেব তার হাত ধরে বললেন—
You are a good boy
You will get a toy.
তবে এখন খেলার সময় নয়।
একটা খবর যে জোগাড় করতে হয়।
বসির বলল, স্যার! কি খবর জোগাড় করব?
রশীদ সাহেব বললেন, যে মৃত ব্যক্তিটি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে তার পরিচয় আমার জানা দরকার। জটিল গবেষণার মধ্যে পড়ে গেছি। মৃত ব্যক্তির নাম এবং আমাদের মন্ত্রী মহোদয়ের জন্ম তারিখ জানা অতি জরুরী।
বসির বলল, মরা মানুষ তো কেউ যাচ্ছে না।
তুমি তো খবর দিলে একটা ডেড বডি যাচ্ছে।
বসির লজ্জিত গলায় বলল, ভুল খবর দিয়েছিলাম স্যার। চাদর দিয়ে ঢেকে কামরায় তুলেছে তখন ভেবেছি লাশ।
এখন সে লাশ না?
জি-না। চা-কফি খেয়েছে।
ছেলে না মেয়ে?
ছেলে।
বয়স কত?
ত্রিশ পঁয়ত্রিশ।
নাম জিজ্ঞেস করেছ?
নাম জিজ্ঞেস করি নাই।
চাদর দিয়ে ঢেকে তাকে তুলেছে কেন?
জানি না।
রশীদ সাহেব বললেন, মিথ্যা কথা বলছ কেন বসির? হঠাৎ তোমার মিথ্যা বলার প্রয়োজন পড়ল কেন? আমি ঐ কামরায় গিয়েছিলাম। মৃত ছেলেটির মার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা ডেড বডি কফিনে করে নিয়ে যাচ্ছে। কফিনে প্রচুর বরফ এবং প্রচুর চা পাতা দেয়া হয়েছে। ঠিক বলছি না?
বসির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, জি স্যার।
বসির জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রশীদ সাহেব বললেন,
You are a naughty boy
You will not get a toy.
আমার সামনে থেকে দূর হবার হয়েছে সময়।
সামনে থেকে যাও।
বসির দ্রুত বের হতে গিয়ে দরজায় বাড়ি খেল। রশীদ সাহেব ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ছেলেটা মিথ্যা কথা কেন বলল?
আশহাব বলল, বুঝতে পারছি না। কারণ ছাড়াই হয়ত বলেছে।
রশীদ সাহেব বললেন, কারণ ছাড়া কেউ মিথ্যা বলে না। তবে প্যাথলজিক্যাল লায়াররা বলে। সমগ্র মানব গোষ্ঠীর অতি ক্ষুদ্র অংশই প্যাথলজিক্যাল লায়ার। বসির নামের এই ছেলের মিথ্যা বলার পেছনে অবশ্যই কারণ আছে। কারণটা বের করতে হবে।
আশহাব বলল, আপনি সব সময় কিছু না কিছু নিয়ে চিন্তা করেন।
রশীদ সাহেব বললেন, আমি একা না, তুমি নিজেও সব সময় কিছু না কিছু নিয়ে চিন্তা কর। ডাক্তার হিসেবে তুমি এই তথ্য নিশ্চয়ই জান যে মানুষের হার্ট এবং ব্রেইন কখনো বিশ্রাম নেয় না। হার্ট এবং ব্রেইনের বিশ্রাম নেয়ার অর্থ মৃত্যু। ঘুমের মধ্যে হার্ট যেমন কাজ করে ব্রেইনও কাজ করে। ভাল কথা, এই মাত্র তোমার ম্যাজিকের কৌশলটা আমি ধরে ফেলেছি।
সত্যি?
আমাকে কয়েনটা দাও আমি দেখাচ্ছি। ট্রেনে যাত্রীদের নিয়ে আমি যখন কনশাসলি চিন্তা করছিলাম তখন আমার ব্রেইন নিজের উদ্যোগে চিন্তা ভাবনা করে কৌশলটা বের করেছে।
আশহাব একটা কয়েন দিল। রশীদ সাহেব বললেন, তোমাকে ম্যাজিকটা দেখালে তুমি মজা পাবে না। কারণ তুমি কৌশলটা জান। এক কাজ কর ঐ মেয়েটাকে ডেকে আন। সে মজা পাবে।
দশটা মিনিট পরে যাই স্যার?
দশ মিনিট পরে যাবে কেন?
আশহাব বিব্রত গলায় বলল, আমার মা আমার উপর বিশেষ একটি কারণে খুবই রেগে আছেন। তার রাগ পড়ার সময় দিচ্ছি। আধাঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে সাধারণত তার রাগ পড়ে যায়।
তুমি হিসেব করে বের করেছ?
না। আমার বাবা হিসেব করে বের করেছেন। মা বেশির ভাগ রাগ বাবার সঙ্গে করতেন। বাবার সারভাইবেলের জন্যে হিসাবটা দরকার ছিল।
উনি কি করতেন?
ব্যাংকার।
গুড আমরা পনেরো মিনিট অপেক্ষা করব।
চিত্রা বসে আছে সাজেদার সামনে
চিত্রা বসে আছে সাজেদার সামনে। চিত্রার মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলা কিছুটা শান্ত হয়েছেন। তবে এখন তিনি ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছেন। কথারও আগা মাথা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে না। অর্থহীন কথা শুনতে চিত্রার আপত্তি নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিলির অর্থহীন কথা শুনে সে অভ্যস্ত। সমস্যা হল ভদ্রমহিলা তাকে বৌমা বলে সম্বোধন করছেন। চিত্রার উচিত তাকে মনে করিয়ে দেয়া যে তিনি ভুল করছেন। চিত্রার সঙ্গে এই প্রথম তার দেখা হয়েছে, এবং চিত্রা তাঁর বৌমা না। বৌমা হবার কোনো বাসনাও তার নেই।
বৌমা শোন, আমার ছেলে ইচ্ছা করে আমাকে অপমান করার জন্যে মদ গিলছে। সে কি করবে তোমাকে বলি। গলা পর্যন্ত মদ গিলবে তারপর টলতে টলতে কামরায় ঢুকবে। তোমার সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করবে। তখনতো আমি তাকে ছাড়ব না। মায়ের সামনে যে তার স্ত্রীকে অপমান করে তার মতো কুলাঙ্গার এই দুনিয়ায় জন্মায় নি। আমি সেই কুলাঙ্গারকে সহ্য করব না। আমি খাঁ বাড়ির মেয়ে। আমার দাদা আশরাফ আলীর নাম নিশ্চয় শুনেছ? আমি আশরাফ আলী খাঁ সাহেবের নাতনী। আশরাফ আলী খাঁ সাহেব প্রকাশ্য বাজারে থানার ডিউটি অফিসারকে কি করেছিলেন তা এখনো ইতিহাস। পুলিশের এস পি খবর পেয়ে জেলা হেড কোয়ার্টার থেকে দাঙ্গা পুলিশ নিয়ে এলেন। আমার দাদাজানের লোকজনও লাঠি-বৈঠা নিয়ে তৈরি হল। দাদাজান তার দুনলা বন্দুক বের করলেন। থমথমে অবস্থা। দাঙ্গা বেঁধে যায় এমন অবস্থা। শেষ পর্যন্ত এস পি সাহেবের বুদ্ধিতে সমস্যার সমাধান হল। এস পি সাহেব শাদা পোষাকে এসে দাদাজানের বাড়িতে ঢুকে বললেন, স্যার, আমার চাচা আপনার ছাত্র ছিলেন। দাদাজান সঙ্গে সঙ্গে এস পি সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বললেন, বাবা কেমন আছ? এস পি সাহেব বললেন, ভালো থাকব কি ভাবে? শুনেছি আমার এক অফিসার আপনার সঙ্গে বেয়াদবী করেছে। আমি এস পি। আমার অফিসারের বেয়াদবী আমি সহ্য করব না।
দাদাজানের রাগ সঙ্গে সঙ্গে পানি। তিনি বললেন, এটা কেমন কথা। অল্প বয়সের উত্তেজনায় একটা বেয়াদবী করেছে এটা কোনো ব্যাপার না। তুমি তাকে খবর দিয়ে আন হাত মিলাই।
এখন বুঝেছ আমি কোন বংশের?
চিত্রা বলল, জি বুঝেছি।
সাজেদা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি যাও আমার ছেলেকে ডেকে আন। আমি তাকে ক্ষমা করেছি। আমি যেমন রাগতে পারি ক্ষমাও করতে পারি। রাত দশটা বাজে। তার নিশ্চয়ই ক্ষিধে লেগেছে। নটা বাজতেই সে খেয়ে নেয়। ছোট বেলার অভ্যাস।
চিত্রা উঠে দাঁড়াল। মহিলার সঙ্গে কামরা শেয়ার করার ব্যাপারটা তার এখন আর ভাল লাগছে না। তারচে অনেক ভালবুডোর অংকের গল্প শুনে রাত কাটানো।
আশহাব কামরা থেকে বের হয়েছে তবে ঠিক মতো পা ফেলতে পারছে। তাকে এগুতে হচ্ছে দেয়াল ধরে। চিত্রার সামনে সে খানিকটা ব্ৰিতও বোধ করছে। চিত্রা বলল, আপনাদের মাতা-পুত্রের সমস্যায় হঠাৎ জড়িয়ে পড়েছি। ভাল লাগছে না।
আশহাব বলল, ভাল লাগার কথা না। সমস্যায় আপনি ইচ্ছে করে জড়িয়েছেন। মার সঙ্গে রুম শেয়ার করতে চেয়েছেন। মা কি তার দাদাজানের গল্প শুরু করেছেন?
হ্যাঁ করেছেন। উনার দাদাজানের গল্প সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে উনি মাঝে মাঝেই আমাকে বৌমা ডাকছেন। আপনি নিশ্চয়ই বিয়ে করেছিলেন। আপনার মায়ের একজন আদরের বৌমা ছিল। ছিল না?
জি না।
চিত্রা বলল, আগে বৌমা ডাকার অভ্যাস না থাকলে হঠাৎ করে কারো মুখ দিয়ে বৌমা বের হবে না।
আশহাব বলল, মার মুখ দিয়ে যে কোনো কিছু বের হবে। আমার মাকে আপনি চেনেন না। আমি চিনি। তিনি মানসিক ভাবে সামান্য অসুস্থ। মার হয়ে আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।
আশহাব হাত জোড় করল।
চিত্রা বলল, ক্ষমা চাইতে হবে না।
আশহাব বলল, মায়ের অসুখটা প্যারানয়ার অন্য এক ফরম। প্যারানয়ারের রোগী মনে করে সবাই ষড়যন্ত্র করছে তাকে মেরে ফেলার জন্যে। আর মা মনে করেন অপরিচিত যেই তার সঙ্গে কথা বলছে সেই তার পরম আত্মীয়। আপনি এখন মার কাছে আমার চেয়ে একশ গুন বেশি প্রিয়।
চিকিৎসা করাচ্ছেন না?
করাচ্ছি।
আপনি যদি কিছু মনে না করেন—আমি রাতে আপনার মার সঙ্গে থাকব না।
আশহাব বলল, মার সমস্যা একটাই—কথা বলা। এ ছাড়া তার আর কোনো সমস্যা নেই।
বুঝতে পারছি, আমার ভাল লাগছে না। আপনি আপনার মার কাছে যান। তিনি অপেক্ষা করছেন। আপনারা মাতা-পুত্র খাওয়া দাওয়া করুন। এর মধ্যে আমাকে ডাকবেন না প্লিজ। আমি বুফে কারে খাব। অর্ডার দিয়ে রেখেছি। আপনারা মাতা-পুত্রের মিলন দৃশ্য দেখার আগ্রহ যেমন আমার নেই, বিচ্ছেদ দেখার আগ্রহও আমার নেই।
মা আপনাকে ছাড়া খাবে না।
ব্যবস্থা করুন যেন খায়। প্লিজ।
আশহাবকে করিডোরে দাঁড় করিয়ে চিত্রা এগিয়ে গেল। তার সত্যিই অসহ্য লাগছে। মোবাইল টেলিফোনে পিং পিং শব্দ হচ্ছে। নিশ্চয়ই লিলি।
এই চিত্রা! Hello!
Hello!
ফান হচ্ছে?
খুব ফান হচ্ছে। ফানে ড়ুবে আছি। নাক পর্যন্ত ফান।
বাবারে একটু ধৈর্য্য ধর। ময়মনসিংহ জংশনে গাড়ি থামবে তুই চলে যাবি স্যালুনে। রাণীর মত থাকবি।
একবারতো বলেছিস। বার বার একই কথা শুনতে ভাল লাগে না।
এতো রেগে আছিস কি জন্যে?
এক মহিলা আমাকে বৌমা ডাকছেন।
সে কি! কেন? তোর চেহারা কি মহিলার অতি আদরের বৌমার মতো যে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। বাংলা সিনেমা?
চুপ কর তো। উনি মেন্টাল পেশেন্ট!
ওহ মাই গড।
রাতে ঐ মহিলার রুম আমার শেয়ার করার কথা।
ভুলেও ঐ কর্ম করবি না। শত হস্ত দূরেত থাকিথং। অর্থাৎ শত হস্ত দূরে থাকবি। নয়ত দেখা যাবে রাতে সে তোকে গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে।
উপদেশের জন্যে ধন্যবাদ।
ম্যাথমেটিশিয়ানের সঙ্গে কথা হয়েছে? এখনো না।
বুড়োরা তরুণী মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে খুব পছন্দ করে। মজার মজার গল্প বলে এরা তরুণীদের ভুলাতে চায়। তুই এককাজ কর। বুড়োর সঙ্গে গল্প করতে করতে চলে যা। তোর জায়গায় আমি থাকলে বুড়োর সঙ্গে এমনই গল্প জমাতাম যে বুড়ো ভাবতো—কিয়া মজা। খাব ব্যাঙ ভাজা। মেয়ে তো আমার প্রেমে ড়ুব সাঁতার দিচ্ছে।
লিলি আমার ধারণা তুই ভাবছিস যে খুব মজার কথা বলছিস। তোর কথাবার্তায় হিউমার ঝড়ে পড়ছে। ব্যাপারটা সে রকম না। তুই একই ভঙ্গিতে সবার সঙ্গে কথা বলিস। তোর কথাবার্তায় সামান্যতম ভেরিয়েসন নেই।
তোর কথায় ভয়ংকর দুঃখ পেলাম। দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছা করছে। এই দেখ মরে যাচ্ছি ওয়ান টু থ্রী। বলেই লিলি মোবাইল অফ করল। চিত্রা বলল, থ্যাংক গড।
মন্ত্রী সাহেবের সেলুন কারে আরো একজন বলল, থ্যাংক গড়। সেই একজন মন্ত্রী সাহেবের আদরের শ্যালিকা যমুনা। তার থ্যাংক গড বলার কারণ গান বাজনা শুরু হতে যাচ্ছে। ব্যান্ডের লম্বা চুলের ছেলে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে তৈরি করছে। সে অস্বাভাবিক চিকন গলায় বলল, শুরু করব Fusion Tagore দিয়ে।
ব্যান্ডের সুরে রবীন্দ্র সংগীত নামে নতুন এক জিনিস শুরু হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ইংরেজি এবং হিন্দি কথাবার্তাও আছে। মহা Fusion যাকে বলে। অল্প সময়ে তরুণ তরুণীদের হৃদয় এই সঙ্গীত হরণ করে নিয়েছে।
ব্যান্ডের পরিচালক যমুনার দিকে তাকিয়ে বলল, আপা এই গানটায় সবাইকে অংশ নিতে হবে।
যমুনা বলল, কি ভাবে অংশ নিব? আমি তো গান জানি না।
গান জানতে হবে না গানের মাঝখানে যতবার আমি হাততালি দেব ততবার আপনারা সবাই বলবেন—ঠেকাই মাথা। হাতের ইশারা না করা। পর্যন্ত ঠেকাই মাথা বলতেই থাকবেন। সুর নিয়ে চিন্তা করবেন না। যে ভাবে বলতে চান——বলবেন।
যমুনা আনন্দিত চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, কি মজা। এই মজা না?
যমুনার স্বামী বলল, মজা বলেইতো মনে হচ্ছে।
যমুনা তার বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, দুলাভাই জয়েন করবে না?
সুরমা বললেন, ওর শরীরটা খারাপ। ঐ যে এসিডিটি প্রবলেম।
যমুনা বলল, কয়েকবার ঠেকাই মাথা করলে এসিডিটি ঠিক হয়ে যেত।
সুরমা বললেন, তোরা শুরু কর আমি ওকে নিয়ে আসব।
সংগীত শুরু হয়েছে—
ও আমার দেশের মাটি
তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা
ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা।
My head down on your feet
Mother, mother, mother, mother.
ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা, ঠেকাই মাথা।
সংগীত জমে গেছে। ঠেকাই মাথা সুপার হিট হয়েছে। যমুনা আনন্দে স্বামীর গায়ে বার বার গড়িয়ে পড়ছে। আনন্দের তুঙ্গ মুহূর্তে সেলুন কারের বাতি নিভে গেল। বগী ড়ুবে গেল অন্ধকারে। সুরমা পা টিপে টিপে স্বামীর কাছে গিয়ে বললো, এই বাতি নিভে গেছে তো।
খায়ের সাহেব বললেন, দেখতে পাচ্ছি। আমি অন্ধ না।
সুরমা বললেন, ট্রেনের লোকজন কেউ তো আসছে না। মোমবাতি, চার্জার কিছু দেবে না?
না দিলে আমি কি করব? আমার হাতে কি ক্ষমতা আছে?
সুরমা বললেন, এরা কি জেনে গেছে?
জানতেও পারে।
সুরমা বললেন, আমি কিন্তু যমুনাকে কিছু বলি নি। ওদের ট্রিপটা নষ্ট করে লাভ কি?
এক সময় যেহেতু জানবে এখনি বলে দাও।
যমুনা এগিয়ে আসছে। তার হাতে মোবাইল। সে মোবাইল অন করে তার আলোয় সাবধানে এগুচ্ছে।
দুলাভাই?
বল শুনছি।
ট্রেনের প্রতিটি কামরায় লাইট আছে। শুধু আমাদেরটায় নেই। আমরা অন্ধকারে বসে আছি।
তাই না-কি?
হ্যাঁ। আপনি খোঁজ নিয়ে আসুন।
খোঁজ নিতে হবে না। তুমি বলছ এই যথেষ্ট। মনে হয় ইলেকট্রিকেল কানেকশনে কোনো ঝামেলা হয়েছে।
কানেকশনে ঝামেলা হলে রেলের লোকজন ছোটাছুটি করবে না? এরা এসে সমস্যা কি জানাবে না? দুলাভাই আপনি এক্ষুনি রেল মন্ত্রীকে টেলিফোন করুন। এদের সবাই যেন সাসপেন্ড হয়। মন্ত্রীর সেলুন কার যাচ্ছে। সেখানে ইলেকট্রিসিটি নেই। ওদের কোনো গরজও নেই। এরা ভেবেছে কি?
খায়ের সাহেব বললেন, ব্যবস্থা হবে। তোমরা গান বাজনা করতে থাক।
যমুনা বলল, অন্ধকারে কি গান বাজনা?
খায়ের সাহেব বললেন, অন্ধকারের গানে অন্য মজা আছে। তোমরা শুরু কর আমি দেখছি কি করা যায়।
গান আবার শুরু হয়েছে। খায়ের সাহেব সিগারেট ধরিয়েছেন। সুরমা আছেন স্বামীর পাশে। অন্য দিন সিগারেট ধরানো নিয়ে নানান কথাবার্তা বলতেন। আজ চুপচাপ। খায়ের সাহেব বললেন, কিছু বলবে?
সুরমা বললেন, আমার মন কু ডাক ডাকছে।
খায়ের সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, যা হবার তা তো হয়ে গেছে। আর কি কু ডাক?
সুরমা বললেন, সেলুন কারে বাতি নিভিয়ে দেয়াটা ইচ্ছাকৃত নয় তো? সব কামরায় বাতি জ্বলছে— সেলুন কারে বাতি নেই। এতক্ষণ হয়ে গেল একজন কেউ খোঁজ নিতে আসছে না।
খায়ের সাহেব কিছু বললেন না। সুরমা বললেন, কান ধরে উঠবোস করিয়েছি—এটার জন্যে কিছু না তো? সবাই মিলে ঠিক করেছে আমাদের শিক্ষা দেবে।
হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষা দিতে পছন্দ করে।
আমার ভয় লাগছে।
ভয় লাগাই স্বাভাবিক। এই দেশের অনেক মন্ত্রী, মন্ত্রিত্ব চলে যাবার পর পাবলিকের হাতে মার খেয়েছে।
মন্ত্রীত্ব যাবার পরে না, পার্টি ক্ষমতা থেকে যাবার পর কেউ কেউ হয়তোবা ইনসালটেড হয়েছে। তোমার পার্টিতো এখনো ক্ষমতায় আছে।
ক্ষমতায় থাকলেও আমি পার্টির গুড বুকে নেই। সবাই জানবে আমাকে লাথি দিলে এখন পার্টি কিছু বলবে না। বরং খুশি হবে। আমি লাথি খাচ্ছি এই দৃশ্য দেখলে অনেক নেতা-কর্মীরাই এখন খুশি হবে।
একজনকে কি পাঠাব রেলের যে কাউকে ডেকে নিয়ে আসবে। তুমি কথা বলবে। কথা বলে ঠিক করবে। কথা বলে মানুষকে ভুলাতে তো তুমি ওস্তাদ।
কাকে পাঠাবে?
বদরুলটা কে?
ঐ যে ভিডিও করে ছেলেটা।
পাঠাও। তবে আমার ধারণা ওকে মেরে তক্তা বানাবে।
সুরমা ভীত গলায় বললেন, ওকে মেরে তক্তা বানাবে কেন?
নানান কায়দায় কানে ধরে উঠবোসের ভিডিও করেছে ওকে ছাড়বে কেন? আমি হলেও তো মারতাম।
মারতে?
অবশ্যই।
তুমি আর কি করতে?
চেষ্টা করতাম এই অপমান যে মহিলা আমাকে করেছেন সবার সামনে তার গালে একটা থাপ্পড় বসাতে।
তাহলে কি বদরুলকে পাঠাব না?
পাঠাও-টেস্ট কেস হিসাবে পাঠাও। মার খেয়ে ফেরে কি-না দেখি।
সুরমা ভীত গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে রিভলবার আছে না?
আছে। গুলি মাত্র ছয়টা। সিন্ধুতে বিন্দু।
তুমিতো আর গুলি করতে যাচ্ছনা। অস্ত্র হাতে থাকাটাই ভরসা।
খায়ের সাহেব বললেন, মাঝে মাঝে অস্ত্র থাকলে সমস্যা। নিজের অস্ত্রে নিজে বধ। টান দিয়ে রিভলবার নিয়ে সেই রিভলবারে গুলি।
সুরমা বললেন, আজে বাজে কথা বলছ কেন?
ভাল ভাল কথা মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।
খায়ের সাহেব মোবাইল টেলিফোন বের করে বোতাম টিপতে শুরু করলেন। সুরমা বললেন, কাকে টেলিফোন কর?
খায়ের সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, কাকে তোমাকে বলতে হবে কেন? কাকে টেলিফোন করছি জানার তোমার প্রয়োজনটা কি?
জানলে অসুবিধা কি?
অসুবিধা আছে। সব ইনফরমেশন সবার জন্যে না।
আমি তোমার স্ত্রী।
খায়ের সাহেব বললেন, তুমি আমার সামনে থেকে যাও। তুমি ক্রমাগত আমাকে বিরক্ত করে যাচ্ছ। আমার চল্লিশ গজের ভিতর যেন তোমাকে না দেখি।
সুরমা হতভম্ব গলায় বললেন, যদি না যাই তাহলে কি করবে? মারবে?
খায়ের সাহেব বললেন, হ্যাঁ মারব। তোমার বোন আর বোনের স্বামী ঐ বান্দরটার সামনে কষে চড় মারব। অন্ধকার হলেও ওরা দেখতে পাবে।
সুরমা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বান্দর বলছ কাকে?
খায়ের সাহেব বিকট শব্দে ধমক দিলেন, Get lost you pig.
গান থেমে গেল। সবাই সুরমার দিকে তাকিয়ে আছে। যমুনা ভীত গলায় বলল, আপা কি হয়েছে?
সুরমা স্বাভাবিক গলায় বললেন, তোর দুলাভাই টেলিফোনে কাকে যেন ধমকাচ্ছে। ভিডিওর বদরুল কোথায়? আমার কাছে আসতে বল তো। সুরমা এগিয়ে গেলেন গানের দলের কাছে। তিনি এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেলছেন। নিজেকে দ্রুত সামলাতে চেষ্টা করছেন। এখনো সামলাতে পারেন নি। তবে পারবেন।
আবুল খায়ের খান টেলিফোন করেছেন পূর্ত মন্ত্রীকে। রিং হচ্ছে। কেউ টেলিফোন ধরছে না। রিং হতে হতে টেলিফোন থেমে গেল। একটা সময় ছিল দ্বিতীয় রিং শেষ হবার আগেই পূর্তমন্ত্রী বলতেন, গ্রেট খায়ের ভাই! কি ব্যাপার! বান্দা হাজির।
এখন সময় ভিন্ন। খায়ের ভাইয়ের গ্রেটনেস বলে কিছু নেই। তার টেলিফোন ধরতে হবে না। আবুল খায়ের আবার টেলিফোন করলেন। তার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। তিনি ঠিক করেছেন টেলিফোন করেই যাবেন। ব্যাটা যতক্ষণ না ধরবে ততক্ষণই টেলিফোন বাজতে থাকবে। শালার বাচ্চা শালা!
ভিডিও ম্যান বদরুল ফুরফুরে মেজাজে এগুচ্ছে। তার হাতে ভিডিও ক্যামেরা না থাকায় হাত খালি খালি লাগছে। শরীর ভার শূন্য। মনে হচ্ছে অফিস শেষ হয়েছে এখন তার ছুটি। ভিডিও ক্যামেরা হাতে থাকা মানেই অফিস। একেকজনের অফিস একেক রকম। কবির অফিস তার কাঁধের ঝোলায়। ভিডিওম্যানের অফিস ভিডিও ক্যামেরায়। লেখকের অফিস তাঁর মাথায়।
সেলুন কার পার হয়েই সে ঢুকল ডায়নামো কারে। বিকট সব যন্ত্রপাতি। শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ইলেকট্রিসিটি, বিভিন্ন কামরায় চলে যাচ্ছে। শুধু তাদের কামরাতেই আলো নেই। কিছুদূর এগুতেই রেলের কিছু লোকজন দেখা গেল। গোল হয়ে বসে চা খাচ্ছে। ক্রিমিনালটাকে দেখা যাচ্ছে না। সবাই অপরিচিত। বদরুল বলল, হ্যালো আপনারা রেলের লোক?
সবাই এক সঙ্গে তাকালো। কেউ জবাব দিল না।
বদরুল কঠিন গলায় বলল, মন্ত্রী মহোদয় আমাকে পাঠিয়েছেন। উনি জানতে চেয়েছেন সেলুন কার অন্ধকার কেন? অলরেডি রেলের বড় বড় অফিসারের কাছে টেলিফোন চলে গেছে।
দলের একজন (গোল মুখ, গোফ আছে। বডি বিল্ডারের মতো চেহারা) চায়ের কাপে শব্দ করে চুমুক দিয়ে বলল, আপনে কে?
বদরুল বলল, আমি কে তা দিয়ে আপনার প্রয়োজন কি? ধরে নিন আমি মন্ত্রী মহোদয়ের পি এস।
আপনার নাম বলেন।
আপনাকে নাম বলতে যাব কেন?
বদরুলের কথা শুনে সেই লোক চায়ের কাপ মেঝেতে রেখে শান্ত ভঙ্গিতে উঠে এল। বদরুল কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রচণ্ড শব্দে চড় বসালো। বদরুল ছিটকে পেছনের বেঞ্চে পড়ে গেল। বসে থাকা সবাই শব্দ করে হেসে উঠল। বডি বিল্ডার টাইপ লোকটা বলল, এখন প্রশ্ন করলে জবাব দিবে। তেড়িবেড়ি করবে না।
তোর নাম কি?
বদরুলের কপাল ফেটে গেছে। টপটপ করে রক্ত পড়ছে। সে কপালের রক্ত মুছে হতভম্ব গলায় বলল, এইসব কি? আপনারা সবাই আন্ডার এ্যারেস্ট। এক্ষুনি রেল পুলিশ আসবে। সবাইকে ডিটেনশনে যেতে হবে।
এই হারামীর পুত যা জিজ্ঞেস করব জবাব দিবি তোর নাম কি?
বদরুল।
তুই করস কি?
আমি ভিডিওম্যান। ভিডিও করি।
সবুরের ভিডিও তুই করেছিস? এইবার তোর ভিডিও করা হবে। এই তোমরা হারামীর বাচ্চাটার জামা কাপড় খুলে ফেলে একে নেংটা করে ফেল। নেংটা ভিডিও হবে।
বদরুল চেঁচিয়ে বলল, কি বলেন।
এরে পুরো নেংটা করে ফিরত পাঠাও। তারা বুঝুক ঘটনা কি।
বদরুল বলল, আমি মন্ত্রী মহোদয়ের লোক।
রাখ ব্যাটা মন্ত্রী মহোদয়। তোর মন্ত্রীর পাছায় এখন বাঁশ। সে আর মন্ত্রী নাই। তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। তোকে নেংটা অবস্থায় ছাড়বো। তুই তোর মন্ত্রীকে বলবি সবুরকে যে কানে ধরে উঠবোস করিয়েছে তাকেও কানে ধরে উঠবোস করতে হবে। তোকে নেংটো অবস্থায় দেখলে তারা বুঝবে খবর ভালো না। আমরা মানুষ খারাপ।
বদরুল বুঝতেই পারেনি যে তাকে সত্যি সত্যি নগ্ন করে ফেলা হবে। সে হা হয়ে গেল।
দাঁড়িয়ে থাকবি না যা। মন্ত্রী মহোদয় তোকে যেন ঠিকমতো দেখতে পায় সে জন্যে কিছুক্ষণের জন্যে সেলুন কারে কারেন্ট দেয়া হবে। এই তুই রওনা হ। নেংটো, হাত দিয়ে ঢাকাঢাকি করার চেষ্টা করবি না। চেষ্টা করলে হাত কেটে ফেলে দিব।
বদরুল কাতর গলায় বলল, আমি এইভাবে যেতে পারব না। ভাই আমি আপনাদের পায়ে ধরি।
পায়ে ধরে লাভ নেই। তুই এখন রওনা দে। এখন রওনা না দিলে তোকে কি করা হবে সেটা তোর কানে কানে বলব, তুই সঙ্গে সঙ্গে রওনা হবি। দৌড়ায়া যাবি। হা হা হা।
সবাই হাসছে। বদরুল আতংকে জমে গেল। ব্যাপারটা সত্যি ঘটেছে নাকি এটা কোনো ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন তা সে বুঝতে পারছে না। বডি বিল্ডার উঁচু গলায় বলল, সেলুন কারে কারেন্ট দাও।
একজন কি একটা হাতলে চাপ দিল।
সেলুন কারে বাতি
সেলুন কারে বাতি জ্বলে উঠেছে। এক সঙ্গে সবাই হৈ হৈ করে উঠল। যমুনা হাত তালি দিচ্ছে। যমুনার দেখাদেখি অন্যরাও হাত তালি দিচ্ছে। ব্যান্ডের একজন অতি দ্রুত ড্রামে কয়েকটা বাড়ি দিল। বিপুল হাত তালির ভেতর বদরুল ঢুকল। সেলুন কারে হঠাৎ যেন বজ্রপাত হল।
.
আশহাব মা’র পাশে বসে আছে। সাজেদা শান্ত। দেখে বুঝার উপায় নেই যে কিছুক্ষণ আগেও কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। তিনি হট পট খুলে খাবার বের করেছেন। পেপার প্লেট, নেপকিন বের হয়েছে। আচারের কৌটা, কাঁচামরিচ। আয়োজনে কোনো খুঁত নেই। একটা কাসুন্দির শিশিও দেখা যাচ্ছে।
সাজেদা বললেন, বৌমা আবার কোথায় গেল। ঘরের বউ হুট হাট করে বেড়াতে বের হওয়া আমার পছন্দ নয়। বৌমাকে ডেকে আন।
আশহাব বলল, মা তুমি বৌমা পেলে কোথায়? চিত্রা এই ট্রেনের একজন যাত্রী। কিছুক্ষণ আগে তার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে।
আমার সঙ্গে ফাজলামী করবি না। তোকে যা বলেছি কর। বৌমাকে ডেকে নিয়ে আয়।
মা তুমি কি সত্যি ভাবছ সে তোমার বৌমা? না-কি ইচ্ছা করে একটা নাটক করছ?
সাজেদা বললেন, তোর এতবড় সাহস? তুই এইভাবে আমার সঙ্গে কথা বলছিস? আমি আমার বৌমাকে চিনব না।
মা তোমাকে দু’টা ট্যাবলেট দিচ্ছি। ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়। তোমার ঘুম দরকার।
আমার সঙ্গে ডাক্তারী ফলাচ্ছিস? ফেল করা ডাক্তার।
ফেল করা ডাক্তার মানে?
নকল করে ধরা পড়লি মনে নাই। প্রিন্সিপ্যাল তোকে বের করে দিল।
মা তুমি এসব কি বলছ?
তুই আমাকে দিয়ে প্রিন্সিপ্যালের পায়ে ধরালি। একজন মানুষের সামনে কতটা নিচু তুই আমাকে করলি। বদমাশ ছেলে।
মা তোমার অবস্থাতো খুবই কাহিল। কি গল্প ফাঁদছ। এরকম গল্প তোমার মাথায় আসছে কেন? আমি দু’টা সাবজেক্টে হাইয়েস্ট পাওয়া। গোল্ড মেডেল তোমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলাম। মনে নাই?
মনে আছে।
তাহলে এইসব কি বলছ?
আর বলব না।
মাথা কি ঠিক হয়েছে?
হুঁ। হা কর মুখে ভাত দিয়ে দেই।
আশহাব হা করল। সাজেদা ছেলের মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন, আজ তুই আমার হাতে খাবি। তোর হাত নোংরা করার দরকার নেই।
আশহাব কিছু বলল না। সাজেদা বললেন, তুই মাঝে মাঝে এমন গাধার মতো কাজ করিস।
গাধার মতো কাজ কি করলাম?
বৌমাকে নিয়ে প্রথম যাচ্ছিস–তোরা দু’জন যাবি এক কামরায় আমি যাব আলাদা। তা-না তিনজন এক সঙ্গে যাচ্ছি। বেচারী মনটাতো এই জন্যেই খারাপ করেছে। একটু পর পর তোর খুঁজে যাচ্ছে। ওর মনের ভাব আমি পরিস্কার বুঝতে পারছি।
বুঝতে পারলে তো ভালো। মা আমাকে আর খাইয়ে দিতে হবে না। যথেষ্ট হয়েছে। এখন তুমি খাও।
তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেল। বৌমাকে রেখে আমি খেয়ে ফেললে সে কি মনে করবে। বাপ নেই, মা নেই একটা মেয়ে। স্নেহের কাঙ্গাল।
আশহাব বিড় বিড় করে বলল, মহা বিপদ।
সাজেদা বললেন, খাওয়া শেষ করে তুই বৌমাকে খুঁজে আনবি। আমি কামরা ছেড়ে দেব তোরা দুই জন এখানে ঘুমাবি। আদর ভালবাসা করতে চাইলে করবি। হুট করে আমি তোদের কামরায় ঢুকব এরকম ভুলেও মনে করবি না। এই বুদ্ধি আমার আছে।
অবশ্যই সেই বুদ্ধি তোমার আছে। ভাত চাবাচ্ছিস না কেন? মুখে দিচ্ছি আর কোৎ করে গিলে ফেলছিস। ভাল করে চাবাতে হবে না। আচার খাবি? একটু আচার দেই?
আশহাব বিড় বিড় করে বলল, Oh God, oh God.
.
চিত্রা রশীদ সাহেবের পাশে বসে আছে। তার চোখ উজ্জ্বল। সে আগ্রহ নিয়ে কথা শুনছে। বিজ্ঞানের অতি জটিল সব বিষয় এই মানুষ এত সহজে কিভাবে বলছে সে বুঝতে পারছে না। তার কাছে এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীতে জটিল বলে কিছু নেই।
রশীদ সাহেব বললেন, মা আমাকে তুমি বল একটা আপেল থ্রি ডাইমেনশনাল বডি না? এর দৈর্ঘ্য প্রস্থ এবং উচ্চতা আছে না?
চিত্রা বলল, জি। অবশ্যই।
রশীদ সাহেব বললেন, আপেলের খোসাটা কিন্তু টু ডাইমেনশনাল। আপেলের খোসার আছে শুধু দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ।
চিত্রা বলল, জি চাচা।
রশীদ সাহেব বললেন, তুমি কি এখন বুঝতে পারছ একটি থ্রি ডাইমেনশনাল বস্তুকে একটি টু ডাইমেনশনাল বস্তু ঘিরে রেখেছে।
জি।
এটা যে সম্ভব তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।
পারছি।
রশীদ সাহেব সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, একই লজিকে আমি যদি বলি থ্রিডাইমেনশনাল কোনো বস্তু দিয়ে ফোর ডাইমেনশনাল জগৎ আটকে রাখা
সম্ভব তাহলে কি বিশ্বাস করবে?
চিত্রা চিন্তিত গলায় বলল, বিশ্বাস করাইতো উচিত।
রশীদ সাহেব বললেন, তোমার কাছে কোনো কিছু যদি অস্পষ্ট মনে হয় আমাকে বলবে। বিজ্ঞান অস্পষ্টতা পছন্দ করে না যদিও হায়ার সায়েন্স পুরোটাই অস্পষ্ট।
কেন?
হায়ার সায়েন্স Big Bang আগে কি হচ্ছে বলতে পারছে না। সময় কি সুষ্ঠু ভাবে বলতে পারছে না, অতীত এবং ভবিষ্যত কি বলতে পারছে না। হায়ার সায়েন্স হঠাৎ বলছে হলগ্রাফিক ইউনিভার্সের কথা। হলোগ্রাফিক ইউনিভার্সের কথা শুনেছ?
না।
বলব?
অবশ্যই বলবেন।
মূল ডিসকাশান থেকে আমি কিন্তু সরে যাব।
মূল ডিসকাশনে পরে যাবেন–হলোগ্রাফিক ইউনিভার্সটা কি আগে বলুন।
রশীদ সাহেব বললেন, এই হাইপোথিসিসে বিশ্ব ভ্ৰহ্মাণ্ড একটা হলোগ্রাম ছাড়া আর কিছুই না…
খোলা দরজায় বসির মাথা বের করে বলল, বিরাট এক সমস্যা হয়েছে। আপা আপনি কি ডাক্তার?
চিত্রা বলল, না তো। আশহাব সাহেব ডাক্তার।
বসির বলল, একজন মহিলা ডাক্তার দরকার। পাঁচ নম্বর কেবিনে এক মহিলার ডেলিভারী পেইন শুরু হয়েছে। উনার হাসবেন্ড মাওলানা। উনি লেডি ডাক্তার ছাড়া তাঁর স্ত্রীকে দেখাবেন না। আমি পুরো ট্রেইন খুঁজে এসেছি। কোনো লেডি ডাক্তার নেই।
রশীদ সাহেব বললেন, ডাক্তারের আবার পুরুষ মহিলা কি? ডাক্তার হল ডাক্তার। আমি মাওলানার সঙ্গে কথা বলি। উনাকে বুঝিয়ে বলি।
বসির বলল, উনি বুঝ মানার লোক না স্যার। কঠিন মাওলানা।
রশীদ সাহেব বললেন, নিশ্চয়ই কেউ তাকে ঠিকমতো লজিক দিতে পারে নি। মানুষ এমন ভাবে তৈরি যে তাকে লজিকের কাছে সারেন্ডার করতেই হয়। উনি যেমন কঠিন মাওলানা, আমিও কঠিন তার্কিক।
বসির বলল, আপনার কথা উনাকে বলে দেখি উনি কথা শুনতে রাজি হন কি-না।
রশীদ সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ইন্টারমিডিয়েট কারোর প্রয়োজন দেখছি না। আমি সরাসরি কথা বলব। তুমি আমাকে নিয়ে চল।
চিত্রা বলল, চাচা আমিও আসি। আমি আপনার লজিক শুনব।
রশীদ সাহেব বললেন, এসো।
.
মাওলানা কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর কপালে ঘাম তবে চোখ মুখ কঠিন। তার একটা হাত পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকানো। মনে হচ্ছে ওই হাতে তসবি। কেবিনের দরজা বন্ধ। নারী কণ্ঠের চাপা কাতরানি শোনা যাচ্ছে।
রশীদ উদ্দিন এগিয়ে গেলেন। চিত্রা গেল তার পিছু পিছু। মাওলানা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। রশীদ সাহেব বললেন, আসোলামু আলায়কুম।
মাওলানা শীতল গলায় বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম।
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনার স্ত্রীর লেবার পেইন শুরু হয়েছে বলে শুনেছি। এইটাই কি আপনাদের প্রথম সন্তান?
জি।
ছেলে না মেয়ে?
কি করে বলব। সন্তানতো এখনো হয় নাই।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে আগে ভাগে জানার ব্যবস্থা আছে।
মাওলানা বললেন, আল্লাহপাক যদি চাইতেন আমরা আগে ভাগে জানি তাহলে মেয়েদের পেটের চামড়া পাতলা কাঁচের মতো বানাতেন আমরা পেটের ভেতরের সন্তান দেখতে পেতাম।
রশীদ উদ্দিন বললেন, আল্লাহ পাক মানুষকে ক্ষমতা দিয়েছেন যেন সে অজানাকে জানতে পারে। সূরা আল ইমরানে আছে…
মাওলানা বললেন, জনাব আমি আপনার সঙ্গে তর্কে যাব না। আমি বুঝতে পারছি আপনি তর্কে আমাকে পরাস্ত করার আনন্দ পেতে চান। আনন্দ আপনাকে দিলাম—আগেই পরাজয় মানলাম।
রশীদ উদ্দিন বললেন, একজন পুরুষ ডাক্তার আমাদের সঙ্গে আছেন।
আমি আমার স্ত্রীর পর্দা নষ্ট করব না। কোনো পুরুষ ডাক্তার তাকে দেখাব না।
আপনার সিদ্ধান্তের কারণে আপনার স্ত্রী বা সন্তানের সমূহ ক্ষতি কিন্তু হতে পারে। দুর্ঘটনা ঘটে তারাতো মারাও যেতে পারে।
যদি মারা যায় তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহপাক তাদের আয়ু দেন নাই। জনাব আপনার সঙ্গে আর বাক্যালাপ করব না। গোস্তাকি নিবেন না। আমার মন অস্থির। তর্ক করার মতো অবস্থায় আমি নাই।
মাওলানা কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
চিত্রা বলল, চাচাজি উনি কোনো লজিকই শুনবেন না।
রশীদ উদ্দিন বললেন, এ রকম হয়। এই মাওলানা নিশ্চয়ই লজিকের কারণে অনেক বার আহত হয়েছেন যে কারণে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। বড় বড় বিজ্ঞানীদের মধ্যেও এই জিনিস দেখা যায়। অন্য বিজ্ঞানীদের লজিক যাতে শুনতে না হয় তার জন্যে নিজে লজিক থেকে সরে যান।
চিত্রা বলল, আমরা কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব?
রশীদ উদ্দিন বললেন, আমি দাঁড়িয়ে থাকব। মাওলানা আবার যখন বের হবেন তাকে আবার ধরব। ভাল কথা তোমার কাছে কি কোনো কয়েন আছে।
কেন বলুন তো!
তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখাব।
এখন দেখাবেন। এইখানে?
Why not.
চিত্রা হ্যান্ডব্যাগ খুঁজে কোনো কয়েন পেল না। রশীদ উদ্দিন বললেন, কারো কাছ থেকে খুঁজে একটা কয়েন নিয়ে এসো তো।
বিস্মিত চিত্রা কয়েনের খোঁজে বের হল। মানুষটা কি পাগল? এই অবস্থায় কেউ ম্যাজিক দেখানোর কয়েন খোঁজে? বেশির ভাগ বিখ্যাত মানুষ একসেনট্রিক। এই একসিনট্রিসিটির কতটা সত্যি আর কতটা ভান? আমি আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো না। আমি আলাদা আমি অন্য রকম’ এই ধারণা বিখ্যাত মানুষরাই দিতে চেষ্টা করেন। সাধারণ মানুষদের এই সব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। আমি যা আমি তাই। Take me or leave me.
চিত্রা!
চিত্রা থমকে দাঁড়াল। ডাক্তার আশহাব। তাঁর মুখ চিন্তিত। চিত্রা বিস্মিত। এই ভদ্রলোক এত সহজে তাকে চিত্রা ডাকছে যেন সে তার ঘরের কেউ।
আশহাব বলল, আমার মায়ের মাথা পুরোপুরি গেছে। ব্রেইনের নিউরেনোল কানেকশনের চল্লিশ পার্সেন্ট মনে হয় অফ হয়ে গেছে। পরিচিত জগত সম্পর্কে যেখানে information থাকে সেখানে মনে হয় একটা havoc হয়ে গেছে।
আপনাকে চিনতে পারছেন না?
আমাকে এখনো চিনতে পারছেন তবে কিছুক্ষণ পরে মনে হয় চিনতে পারবেন না।
চিত্রা বলল, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে কিন্তু খুশি খুশি লাগছে।
আশহাব বলল, ঠিক ধরেছেন বিচিত্র কারণে আমি ফান পাচ্ছি। কেন পাচ্ছি নিজেও জানি না।।
চিত্রা বলল, আমি জানি।
আশহাব বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি কিভাবে জানবেন?
চিত্রা কঠিন গলায় বলল, আপনার মা আমাকে বৌমা বৌমা ডাকছেন এই বিষয়টাতে আপনি ফান পাচ্ছেন। যে কোনো মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করতে ছেলেরা ভালোবাসে এবং ফান পায়।
আশহাব বলল, আর মেয়েরা কিসে Fun পায়?
মেয়েরা বিয়ের আগে কোনো পুরুষকেই স্বামী ভেবে fun পায় না। তার প্রেমিককেও সে বিয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বামী ভাবে না। আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি আপনি যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করছেন। আপনার সঙ্গে কথা কাটাকাটি খেলার শখ এই মুহূর্তে হচ্ছে না। আপনার কাছে যদি কয়েন থাকে আমাকে একটা কয়েন দিন।
কয়েন দিয়ে কি করবেন?
ম্যাজিক দেখব। রশীদ সাহেব ম্যাজিক দেখাবেন।
আশহাব কয়েন বের করতে করতে ক্ষীণ স্বরে বলল, আমার মা আপনাকে ছাড়া ডিনার করবেন না।
চিত্রা বলল, না করলে নাই।
একজন অসুস্থ মানুষ। তার দিকটা দেখবেন না?
আমিও অসুস্থ।
.
রশীদ সাহেব কয়েন হাতে নিতে নিতে বললেন, চিত্রা মন দিয়ে দেখ কি করছি কয়েনটা কোন হাতে?
ডান হাতে।
এখন কোন হাতে নিয়েছি?
বাম হাতে। রশীদ সাহেব বাম হাত খুলে দেখালেন যে বাম হাত শূন্য। চিত্রা বলল, কয়েনটা ডান হাতেই আছে। আপনি ভঙ্গি করছেন কয়েনটা বাম হাতে নিয়েছেন আসলে নেন নি।
তোমার ধারণা কয়েনটা ডান হাতে?
জি।
রশীদ সাহেব ডান হাত খুলে দেখালেন। সেখানে কয়েন নেই। দুই হাতের কোথাও নেই। দু’টা হাতই খালি। চিত্রা বলল, কয়েন গেল কোথায়?
রশীদ সাহেব বললেন, আমারোতো একই প্রশ্ন। কয়েন গেল কোথায়। এ রকম জলজ্যান্ত একটা বস্তুতো উধাও হয়ে যেতে পারে না তাই না?
চিত্রা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। কয়েন অদৃশ্য করার খেলা সে আগে অনেকবার দেখেছে এ রকম কখনো দেখে নি।
রশীদ সাহেব বললেন, কয়েন ভ্যানিশের ম্যাজিকটা শেখায় আমার একটা বড় লাভ হয়েছে। পদার্থবিদ বন্ধুদের খেলাটা দেখাতে পারব। তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে মজা পাবে। ভিন্ন কারণটা শুনবে?
শুনব।
আগ্রহ নিয়ে শুনবে না-কি শুনতে হয় বলে শুনবে?
আগ্রহ নিয়ে শুনব। চাচা আমি নিজেও Physics-এর ছাত্রী।
রশীদ সাহেব বললেন, পদার্থবিদরা জগত সম্পর্কে হাইপোথিসিস, জগতের নিয়ম সম্পর্কে হাইপোথিসিস দাঁড়া করান। বিপুল উৎসাহে তারা অগ্রসর হন। ম্যাথমেটিকেল মডেল তৈরি হয়। তখন আমাদেরও ডাক পড়ে। কারণ বেশির ভাগ পদার্থবিদ অংকে দুর্বল। তোমাদের আইনস্টাইনের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। যাই হোক মূল কথায় ফিরে যাই। মনে করো পদার্থবিদ একটি সূত্র দাঁড় করালেন–
Y = BC + M + N^2
Y হল B, C, M এবং N–এর ফাংশান।
সব ঠিক মত চলছে হঠাৎ এক সময় নজরে আসবে M অদৃশ্য। শুরুতে M ছাড়া সূত্র কাজ করছে না, মাঝখানে M থাকলে সূত্র কাজ করছে না।
বুঝতে পারছ কি বলছি?
বুঝতে পারছি।
রশীদ সাহেব বললেন, তোমার কাছে কি মনে হচ্ছে না God পদার্থবিদদের সামান্য ম্যাজিক দেখালেন? হঠাৎ M অদৃশ্য করে দিলেন?
মনে হচ্ছে।
আরেকটা জিনিস কি মনে হচ্ছে–God M-কে অদৃশ্য করে দেন নি লুকিয়ে রেখেছেন। এমন এক সাধারণ জায়গায় লুকিয়েছেন যে আমাদের চোখে পড়ছে না।
চিত্রা বলল, আপনি শিক্ষক হিসেবে নিশ্চয়ই খুব ভাল।
রশীদ সাহেব বললেন, খুব ভাল না। মোটামুটি ভাল। তুমি কি মাওলানা সাহেবের স্ত্রীর কাত্রানী শুনতে পাচ্ছ।
পাচ্ছি।
খুব খারাপ লাগছে না? লাগছে।
অংক হচ্ছে যুক্তি। আমি অংকের Giant. সেই আমি যদি মাওলানা সাহেবকে যুক্তিতে পরাস্ত করতে না পারি তাহলে শিক্ষক হিসেবে আমি দুর্বল শিক্ষক।
চিত্রা বলল, উনাকে তো যুক্তি শুনতে হবে। যুক্তি না শুনলে আপনি তাঁকে পরাস্ত করবেন কিভাবে?
রশীদ সাহেব বললেন, ছাত্র আমার কথাই শুনতে চাচ্ছে না এটাও কি শিক্ষক হিসেবে আমার ব্যর্থতা না?
চিত্রা বলল, উনি তো আপনার ছাত্র না।
রশীদ সাহেব বললেন, একজন শিক্ষকের কাছে সবাই ছাত্র।
.
মাওলানা সাহেবের স্ত্রী আফিয়ার ৩৫ সপ্তাহ মাত্র চলছে। শিশু চল্লিশ সপ্তাহ মায়ের পেটে থেকে বড় হবে। এই চল্লিশ সপ্তাহ সে তার জগতে নিজের মত বড় হবে। সব শেষে তৈরী হবে তার ফুসফুস। ফুসফুস তৈরী হয়ে যাবার পর শিশু সিগন্যাল পাঠাবে মায়ের শরীরে–আমি এখন তৈরি। পৃথিবী দেখব। আমাকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দাও। মায়ের শরীর ব্যবস্থা নেবেন।
এখানে কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। সময়ের আগেই শিশু বন্দিদশা থেকে মুক্তি চাচ্ছে। আফিয়া বলল, পানি ভাঙছে। পানি।
মাওলানা বললেন, আল্লাহর নাম নাও।
আফিয়া বলল, ডাক্তার লাগবে ডাক্তার।
মাওলানা বললেন, আমি খোঁজ নিয়েছি ট্রেনে লেডি ডাক্তার নেই।
আমি মরে যাব না-কি?
আহারে চিৎকার করছ কেন। মেয়েদের গলার স্বর বাইরের পুরুষের শোনা ঠিক না। পর্দার বরখেলাফ হয়।
আফিয়া গোংগাতে গোংগাতে বলল, মরে গেলাম। আমি মরে গেলাম। মাগো আমি মরে গেলাম।
মাওলানা বিরক্ত গলায় বললেন, আল্লাহর নাম নাও, মা মা করছ কেন? এখানে যা করার আল্লাহপাক করবেন। তোমার মা কি করবেন?
আপনি সামনে থেকে যান। কোনো একজন মহিলাকে ডাকেন। যে কোনো মহিলা। আমার সন্তান বের হয়ে আসতেছে। আমি বুঝতেছি। মাগো তুমি কোথায় মা।
মাওলানা দরজা খুলে বের হয়েই দেখলেন দরজার বাইরে চিত্রা এবং রশীদ সাহেব। মাওলানা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিত্রাকে বললেন, আপনি কি একটু ভেতরে যাবেন?
চিত্রা বলল, আমি ভেতরে গিয়ে কি করব? উনার দরকার একজন ডাক্তার। আমাদের সঙ্গে ডাক্তার আছে। উনাকে ডেকে নিয়ে আসি?
মাওলানা বললেন, পুরুষ ডাক্তার আমি দেখাব না। অসম্ভব। কোনদিনও না।
চিত্রা বলল, আমি ভেতরে যাচ্ছি। বোকার মতো বসে থাকা ছাড়া আমি কিছু করতে পারব না।
চিত্রা ঢুকে গেল। রশীদ উদ্দিন সিগারেটের প্যাকেট বের করে বললেন, সিগারেট খাবেন। এতে টেনশান কিছু কমবে। নিকোটিনের নার্ভ সুদিং ক্ষমতা আছে।
আমি ধুমপান করি না।
গুড। ভেরি গুড। আমি আপনার দুই মিনিট সময় নিতে পারি? দুই মিনিটে আমি আপনাকে একটা গল্প বলব। গল্প শেষ করে আমি চলে যাব। আপনাকে আর বিরক্ত করব না। আমার হাত থেকে বাঁচার জন্যে আপনি আমাকে দুই মিনিট সময় দিন।
মাওলানা কঠিন গলায় বললেন, আপনাকে দুই মিনিট সময় দিলাম।
রশীদ সাহেব গল্প শুরু করলেন, দেশে একবার বন্যা শুরু হয়েছে। ঘরবাড়ি সব ডুবে যাচ্ছে। উদ্ধারকারী লোকজন নৌকা নিয়ে এসেছে। সবাই নৌকায় উঠে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেলেন। এক মাওলানা শুধু গেলেন না। উনি আল্লাহ ভক্ত মানুষ। উনি বললেন আল্লাহর উপর আমার ভরসা। আল্লাহপাক ব্যবস্থা করবেন।
বন্যার পানি ঘরের চাল পর্যন্ত উঠল। মাওলানা চালে উঠে বসলেন। তখন উদ্ধারকারী লঞ্চ এল। মাওলানা লঞ্চে উঠলেন না। উনার এক কথা, ‘আল্লাহপাক ব্যবস্থা করবেন’। বন্যার পানি আরো বাড়ল। মাওলানার বুক পর্যন্ত উঠল। এল উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার। মাওলানা তাতেও উঠলেন না। হেলিকপ্টার ফিরে গেল।
পানিতে ডুবে মাওলানা মারা গেলেন। মৃত্যুর পর আল্লাহকে গভীর আফসোসের সঙ্গে বললেন, আমি সারাজীবন একনিষ্ঠভাবে আপনাকে ডেকেছি আপনার উপর ভরসা করেছি আর আজ আমাকে কিনা ডুবে মরতে হল। কোনো সাহায্য আপনার কাছ থেকে এল না।
আল্লাহ বললেন, তোমাকে সাহায্য করার জন্যে আমি তিনবার ব্যবস্থা নিয়েছি। একবার নৌকা পাঠানো হয়েছে। তারপর গেল লঞ্চ। সর্বশেষে হেলিকপ্টারও পাঠালাম। বল আর কি করতে পারতাম?
আমার গল্প শেষ। আমি এখন বিদায় নেব।
মাওলানা বললেন, আপনার গল্পটা সুন্দর। গল্প কিন্তু গল্পই। আল্লাহপাক ইচ্ছা করলেই বন্যার পানি নামিয়ে দিতে পারতেন।
রশীদ উদ্দিন বললেন, তা অবশ্যই পারতেন। তিনি আপনার সন্তানের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারেন কিন্তু মাওলানা সাহেব আপনি কি একটা হাদিস জানেন? এই হাদিস অনুযায়ী আল্লাহপাক বলেছেন, তুমি যখন রোগগ্রস্ত হবে তখন একজন ভাল চিকিৎসকের কাছে যাবে সেই সঙ্গে রোগমুক্তির প্রার্থনা করবে।
মাওলানা বললেন, আমি এই হাদিসের কথা জানি না।
রশীদ উদ্দিন বললেন, আমি জানি। আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন। আমার প্রাথমিক পড়াশোনা মাদ্রাসায়। আপনি আমার কথা শুনুন, আমি ডাক্তার ছেলেটিকে ডাকি। সে আপনার স্ত্রীকে ‘মা’ সম্বোধন করে কামরায় ঢুকুক।
মা ডাকলেই মা হয় না।
রশীদ উদ্দিন বললেন, তাও ঠিক। কোরান শরীফেই আছে পালক পুত্র পুত্র নয়। তারপরেও এই ডাক্তারের কল্যাণে হয়ত আপনার সন্তান। তার মাকে মা ডাকবে। জগতের মধুরতম শব্দ আপনার স্ত্রী শুনবে।
মাওলানা বললেন, ঐ ডাক্তার ছেলে গলাপর্যন্ত মদ খেয়েছে। তার মুখ দিয়ে ভক ভক করে মদের গন্ধ, আসছে। ঐ গন্ধ আমি চিনি। কিছু মনে করবেন না জনাব আপনিও মদ খেয়েছেন।
রশীদ উদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, কথা সত্য। মদ খাওয়ায় ডাক্তারের শরীর এবং মন হয়ত অশুচি হয়েছে। তার বিদ্যা কিন্তু হয় নি।
রশীদ উদ্দিনের কথা শেষ হবার আগেই চিত্রা কামরা থেকে বের হল। উত্তেজিত গলায় বলল, ডাক্তার কোথায়? বাচ্চা বের হচ্ছে। মাথা বের হচ্ছে।
চিত্রা ছুটে চলে গেল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হতভম্ব মাওলানার সামনেই ডাক্তারের হাত ধরে টানতে টানতে কেবিনে ঢুকে গেল।
মাওলানা বললেন, কাজটা কি ঠিক হয়েছে?
রশীদ সাহেব বললেন, যদি আমার মতামত জানতে চান তাহলে বলব কাজ উত্তম হয়েছে। এখন আপনি নিশ্চিন্ত মনে আল্লাহপাককে ডাকতে পারেন।
.
চিত্রা ভয়ে কাঁদছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। আশহাব বলল, আপনি ঘাবড়াবেন না। মহিলার হাত ধরুন। ডেলিভারি নরম্যাল হবে। আমার ফুটন্ত পানি দরকার। ব্লেড দরকার, সূতা দরকার।
ব্লেড দিয়ে কি করবেন?
বাচ্চার নাড়ি কাটতে হবে না।
আফিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, আপনি কি ডাক্তার?
আশহাব বলল, আমি ডাক্তার, এবং খুব ভাল ডাক্তার। গাইনি আমার বিষয় না, তারপরেও কোনো সমস্যা নেই। আপনাকে যা করতে বলব করবেন আমাকে সাহায্য করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় চাপ আসবে তার জন্যে প্রস্তুত হোন। যখন নিঃশ্বাস চেপে রাখতে বলব তখন নিঃশ্বাস চাপবেন।
আফিয়া গোংগাতে গোংগাতে বলল, আমি পারব না। আমি পারব না।
.
রশীদ সাহেব মাওলানাকে বললেন, আপনি কি একটা ম্যাজিক দেখবেন?
হতভম্ব মাওলানা বললেন, ম্যাজিক?
পয়সা অদৃশ্য করার খেলা দেখাব। মজা পাবেন।
আপনার কি মাথা টাথা খারাপ এখন ম্যাজিক দেখাবেন?
মূল ম্যাজিক আল্লাহপাক কিছুক্ষণের মধ্যে দেখাবেন এখন আমারটা দেখুন। আমার ডান হাতে কি? পাঁচ টাকার একটা কয়েন না। কয়েনটা এখন নিলাম বাম হাতে। এখন দেখুন বাম হাত শূন্য। ডান হাতও শূন্য। বলুন কয়েনটা কোথায়?
জাহান্নামে।
খারাপ বলেন নি। From here to eternity.
চিত্রা দরজা খুলে বলল, ফুটন্ত পানি লাগবে, ব্লেড লাগবে, সূতা লাগবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেলিভারি হবে।
মাওলানা তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে চিত্রার কথা বুঝতে পারছে না। চিত্রা তাঁকে কঠিন ধমক দিল, হাদার মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ব্যবস্থা করুন।
.
সেলুন কারে বাতি জ্বলা নেভার খেলা চলছে। এই বাতি জ্বলছে এই নেই। সেলুন কারের যাত্রীরা আতংকে অস্থির। সবচেয়ে ভয় পেয়েছে যমুনা এবং তার স্বামী। যতবার বাতি নিভছে ততবার সে আতংকে অস্থির হয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরছে। ভয় সংক্রামক। যমুনার আতংক ছড়িয়ে পড়েছে সবার মধ্যে। বদরুলের কর্মকাণ্ডও সবাইকে ঘাবড়ে দিচ্ছে। তার মেন্টাল ব্রেক ডাউনের মত হয়েছে। সে যেসব কথাবার্তা বলছে তার কোনো অর্থই বুঝা যাচ্ছে না তবে মাঝে মাঝে যখন বলছে– “মেরে ফেলবে। সবাইকে মেরে ফেলবে” তখন সবাই আঁৎকে উঠছে। মেরে ফেলবে বাক্যের অর্থ না বুঝার কিছু না। খায়ের সাহেবের মন্ত্রীত্ব নেই এই খবর এখন সবাই জানে। মূল আতংক এখানেই।
খায়ের সাহেব পূর্ত প্রতিমন্ত্রী হেলাল উদ্দিনকে টেলিফোন করছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হেলাল টেলিফোন ধরেছেন এবং ধরেই বলেছেন, আপনার ব্যাপারটা শুনেছি। ভেরি স্যাড। দলের মধ্যে কান ভাঙানির লোক হয়েছে বেশি এরাই কাজটা করেছে। আপনি একজন সিনসিয়ার ওয়ার্কার। দলের জন্যে আপনার সেক্রিফাইস আছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সবাই একদিন ভুল বুঝতে পারবে।
আবুল খায়ের সাহেব বললেন, আমি এখন এক বিপদে আছি। তুমি কাউকে বলে কিছু করতে পারবে?
হেলাল উদ্দিন বললেন, কি বিপদ?
আবুল খায়ের বিপদটা মোটামুটি গুছিয়েই বললেন। বাতি জ্বালানো নিভানো অংশও বাদ দিলেন না।
হেলাল উদ্দিন বললেন, কি সর্বনাশ। এদের এটিচুডতে মোটেই ভাল মনে হচ্ছে না।
আবুল খায়ের বললেন, আমারো ভাল মনে হচ্ছে না।
হেলাল উদ্দিন বললেন, আপনাদেরটা কি সব শেষের কামরা?
হ্যাঁ।
বলেন কি। আরো বিপদ।
আরো বিপদ কেন?
হেলাল উদ্দিন বললেন, বদগুলা বগিটা খুলে দিতে পারে। মূল ট্রেন থেকে আলাদা করে দিতে পারে। পরে যখন ইনভেসটিগেসন হবে তখন বলবে একসিডেন্ট। আপনা আপনি খুলে গেছে।
তুমি তো আরো ভয় ধরিয়ে দিলে।
খায়ের ভাই এটাই বাস্তবতা।
এখন করব কি বল।
ঐ পার্টির কাউকে টাকা পয়সা দিয়ে হাত করতে হবে। বিপদ থেকে উদ্ধারের একটাই পথ।
তুমি রেলের কাউকে কিছু বলতে পার না?
আচ্ছা দেখি। কি করতে পারি আপনাকে জানাব।
দশ মিনিট পর আমি টেলিফোন করি?
হেলাল উদ্দিন বললেন, আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি জানাব।
আবুল খায়ের সাহেব চাপা নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি নিশ্চিত হেলাল উদ্দিন আর টেলিফোন করবে না। নিজের মোবাইলও অফ করে রেখে দেবে। হেলালকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তিনি নিজে অসংখ্যবার এই কাজ করেছেন। অন্যদের করতে দোষ কি? মহা বিপদে পড়ে কতবার লোকজন তাকে টেলিফোন করেছে তিনি বলেছেন, দেখি কি করা যায়। কিছু করতে পারলে জানাব আমাকে টেলিফোন করার দরকার নেই। বলেই লাইন কেটে দিয়েছেন।
ব্যান্ডদলের পরিচালকের নাম কাউসার। সে নিজের নাম লেখে ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে–Cowসার। নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলে বলে গরুর সার অর্থাৎ গোবর। Cowসার ডাকতে যদি সমস্যা হয় আমাকে গোবর ডাকতে পারেন, গোবর ভাইয়া ডাকতে পারেন কোনো অসুবিধা নেই।
কাউসারের রসবোধে তার ব্যান্ডের লোক যেমন মোহিত, বাইরের লোকজনও মোহিত। এই মুহূর্তে তার মধ্যে রসবোধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সে ঘন ঘন বাথরুমে যাচ্ছে। টেনশানে তার পেট নেমে গেছে। কাউসার আবুল খায়েরের দিকে এগিয়ে এল। খায়ের সাহেব বললেন, কিছু বলবে?
কাউসার বলল, বিনাকারণে আমরা ক্যাচালের মধ্যে পড়েছি। আমরা ঠিক করেছি সামনের স্টেশনে নেমে যাব। সঙ্গে অনেক টাকার ইনস্ট্রমেন্ট। নষ্ট হলে পথে বসব।
খায়ের সাহেব বললেন, সামনের ষ্টেশনে নামবে কি ভাবে? ট্রেন তো আর কোথাও থামবে না। ময়মনসিংহ থামবে।
তাহলে স্যার আমরা চেইন টেনে ট্রেন থামায়ে নেমে পড়ব।
জঙ্গলের মধ্যে কোথায় নামবে? ভাওয়ালের জঙ্গল।
কাউসার বলল, ভাওয়ালের জঙ্গলেই নামব। আপনি তো এখন কোনো প্রটেকশান দিতে পারবেন না। কোন ভরসায় থাকব?
যমুনার স্বামী ফয়সল বলল, আমি কাউসার সাহেবের সঙ্গে একমত। আমার মতে আমাদের সবারই নেমে যাওয়া উচিত।
খায়ের সাহেব বললেন, জঙ্গলে নেমে যে আরো বড় বিপদে পড়বে না কে বলল?
সুরমা রাগী গলায় বললেন, বোকার মতো কথা বলবে না। জঙ্গলে কিসের বিপদ? জঙ্গলে কি সিংহ আছে যে আমাদের খেয়ে ফেলবে?
কাউসার বলল, তাহলে ডিসিসান কি হল? আমরা চেইন টেনে ট্রেন থামাব?
খায়ের সাহেব কিছু বলার আগেই ফয়সল বলল, অবশ্যই। এখন দেখা যাবে চেইন টেনেও ট্রেন থামানো যাবে না। টানতে টানতে চেইন ছিঁড়ে ফেললাম ট্রেইন থামল না।
ফয়সলের কথা শেষ হবার আগেই বাতি আবার নিভে গেল। কাউসার চেইন ধরে ঝুলে পড়ল।
ঝাঁকুনি খেতে খেতে ট্রেন থেমে গেল। অস্বাভাবিক দক্ষতায় কাউসার দলবল নিয়ে নেমে পড়ল। ফয়সল নামল যমুনাকে নিয়ে। সুরমা স্বামীর হাত ধরে কিছুক্ষণ টানাটানি করে নিজেও ঝাঁপ দিয়ে পড়ে পা মচকে ফেললেন।
ট্রেনের ভিতর ছোটাছুটি ব্যস্ততা। অনেকেই চিৎকার করছে ডাকাত ডাকাত। রেল পুলিশ ঘন ঘন হুইসেল দিচ্ছে। ট্রেনের কয়েকটা কামরা থেকে টর্চের আলো দু’পাশের জঙ্গলে ফেলা হচ্ছে। একদল যাত্রী চেঁচাচ্ছে ঐ যে জঙ্গলে ঢুকে। জঙ্গলে ঢুকে। মেয়েছেলে নিয়ে পালায়ে যাচ্ছে। রেল পুলিশ দু’বার রাইফেলে ফাঁকা আওয়াজ করল।
.
রেল পুলিশের রাইফেলের গুলির আওয়াজের সঙ্গে নবজাত শিশুর কান্না মিশল। আশহাব বাচ্চাটাকে পা ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে। বাচ্চা একেকবার ফুসফুস ভর্তি করে বাতাস নিচ্ছে এবং চিৎকার করে কাঁদছে। অসময়ে চলে এলেও এই শিশু প্রাণশক্তিতে ভরপুর। সে তার উপস্থিতি সবাইকে জানান দেবেই। চিত্রা বলল, ছেলে না মেয়ে?
আশহাব বলল, ছেলেই হোক মেয়েই হোক একটি ‘শয়তানই’ যথেষ্ট।
আহা বলুন না। ছেলে না মেয়ে?
আশহাব বলল, মেয়ে হয়েছে।
চিত্রা দরজা খুলে বের হল আনন্দে সে ঝলমল করছে। মনে হল সে তার জীবনের সবচে আনন্দের সংবাদটা দিচ্ছে।
মাওলানা সাহেব! আপনার একটা পরীর মতো সুন্দর মেয়ে হয়েছে।
মাওলানা কিছু বলার আগেই রশীদ উদ্দিন বললেন, অতি সুসংবাদ। নবী এ করিম বলেছেন যার প্রথম সন্তান কন্যা সে মহা সৌভাগ্যভান। আজান দেয়া প্রয়োজন। মেয়েটার কানে আল্লাহর নাম ঢুকুক।
মাওলানা বললেন, মেয়েটার চেহারা দেখে তারপর আজান দেই?
রশীদ উদ্দিন বললেন, আগে আজান তারপর চেহারা।
মাওলানা আজান দিলেন।
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার…
শিশুটিকে শাড়ি দিয়ে জড়িয়ে মায়ের বুকের কাছে দেয়া হয়েছে। মা এই হাসছেন, এই কাঁদছেন। হঠাৎ তিনি চমকে উঠে বললেন, ডাক্তার আপনি না বললেন মেয়ে। এতো ছেলে।
আশহাব হাসতে হাসতে বলল, একটু ঠাট্টা করলাম।
ছেলের মা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসে বললেন, ডাক্তার তুমি এত দুষ্ট কেন?
মাওলানাকে আসল খবর দেয়ার পর তিনি আনন্দে অভিভূত হয়ে রশীদ উদ্দিনকে জড়িয়ে ধরলেন। মনে হচ্ছে কন্যা সন্তানের আনা ভাগ্যের তাঁর প্রয়োজন নেই। তার জন্যে ছেলেই যথেষ্ট।
.
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। সেলুন কারে বাতি এসেছে। আবুল খায়ের সাহেব একা বসে আছেন। তাকে ফেলে সবাই নেমে গেছে এই ধাক্কা থেকে তিনি এখনো মুক্ত হতে পারছেন না। তিনি সিগারেট ধরিয়েছেন। গলার টক ভাবটা চলে গেছে। সিগারেট টানতে তার খারাপ লাগছে না। ব্লাডি মেরি একটা খেলে মন্দ হত না।
স্যার!
আবুল খায়ের চমকে তাকালেন। তার পেছনে সবুর দাঁড়িয়ে। যার কানে ধরে উঠবোস করাতেই নাটকের শুরু।
স্যার সবাই কই?
নেমে গেছে।
কই নেমে গেছে?
জঙ্গলে।
কেন স্যার?
খায়ের সাহেব স্বাভাবিক গলায় বললেন, তোমরা একজনকে মেরে আধমরা করেছ, নেংটো করে পাঠিয়েছ এতে সবাই গেছে ভড়কে।
সবুর দুঃখিত গলায় বলল, কাজটা ঘটেছে মূসা ভাইয়ের কারণে। উনি ইউনিয়ন সেক্রেটারি। আমি উনার হাতে পায়ে ধরতে বাকি রাখছি।
মূসা সাহেবের এখনকার পরিকল্পনা কি?
কোনো পরিকল্পনা নাই স্যার। মূসা ভাই আপনার সঙ্গে দেখা করবে। ক্ষমা চাবে। তাকে নিয়ে আসি স্যার? আপনাকে চা দেব। চা খাবেন?
খাব।
ডিনার কখন দেব স্যার?
ভেবে দেখি।
খায়ের সাহেবের মোবাইল টেলিফোন বাজছে। সুরমা টেলিফোন করেছেন। মোবাইল বিপ্লবের ফসল। জঙ্গল থেকেও কথা বলা যাচ্ছে।
সুরমা বললেন, এই আমার মনে হয় পা ভেঙে গেছে। ট্রেন থেকে যখন পুলিশ আমাদের উপর গুলি করল তখন দৌড় দিতে গিয়ে খাদে পড়ে গেছি। এখন পা নড়াতে পারছি না।
সরি টু হিয়ার দ্যাট।
বার হাজার টাকা দামের শাড়ি। ছিঁড়ে কুটি কুটি।
সরি টু হিয়ার দ্যাট।
তোমার অবস্থা কি?
এখনো বেঁচে আছি। রাখি কেমন?
রাখি রাখি করছ কেন?
রাখি রাখি করছি কারণ মূসা সাহেবের সঙ্গে আমার এপয়েন্টমেন্ট। উনি যে কোনো সময় চলে আসবেন।
মূসা সাহেব কে?
আমাদের শাস্তি দেয়ার মূল পরিকল্পনা উনার। উনি রেল ইউনিয়নের লোক।
কি সর্বনাশ!
খায়ের সাহেব লাইন কেটে দিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার কাছে অতি জরুরি একটা টেলিফোন এল। তাঁকে জানানো হল মন্ত্রীত্ব চলে যাওয়া বিষয়ে যে কথা প্রাইম মিনিস্টারের অফিসের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে তা পুরোপুরিই গুজব। এ ধরনের গুজব রটনায় প্রাইম মিনিস্টার নিজে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন। গুজবের পেছনে কারা আছে বের করতে বলেছেন। প্রাইম মিনিস্টার নিজেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন।
আবুল খায়ের সাহেবের চা চলে এসেছে। তিনি চায়ে চুমুক দেয়া মাত্র প্রাইম মিনিস্টারের টেলিফোন এল। তিনি তিন চার মিনিট কথা বললেন।
সবুর বিনয়ী ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। টেলিফোন শেষ হওয়া মাত্র বলল, স্যার মূসা ভাইকে কি আনব?
এখন না।
চা কেমন হয়েছে স্যার?
চা ভালো হয়েছে। তুমি সামনে থেকে যাও। আমি কিছুক্ষণ একা থাকব।
সবুর চলে গেল। আবুল খায়ের টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি নিশ্চিত অন্ধকার কেটে গেছে এখন একের পর এক টেলিফোন আসতে থাকবে। সবার আগে রেলমন্ত্রীর টেলিফোন আসার কথা। এত দেরি হচ্ছে কেন?
টেলিফোন বাজছে। মন্ত্রী মহোদয় টেলিফোন ধরলেন না। কারণ সুরমা টেলিফোন করেছে। সুরমা’র টেলিফোন ধরার কিছু নেই। এখন হয়ত জানা যাবে যে সে এক পাটি স্যান্ডেল খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি বিড় বিড় করে বললেন, I have no business with you.
.
রেল মন্ত্রী না, প্রথম টেলিফোন করলেন পূর্ত প্রতিমন্ত্রী হেলালউদ্দিন, তাঁর গলায় আনন্দ।
খায়ের ভাই।
হুঁ।
মাঝখানে মোবাইল অফ রেখেছিলেন? কল করি লাইন যায় না।
অফ থাকতে পারে।
আরে গ্রেট খায়ের ভাই! আপনার ব্যাপারটা তো পুরো রিউমার। খবর পেয়েছেন না?
হুঁ।
একটা সোর্স থেকে খবর পেলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা হয়েছে।
হুঁ।
মাঝখানে রেলের একটা হাঙ্গামা হয়ে গেল। এই নিয়ে তোলপাড় হয়ে গেছে–আমি স্ট্রংলি কয়েকজনকে ধরেছি।
হেলাল রাখি? আমার শরীরটা ভাল লাগছে না।
সে কি! কি হয়েছে? আপনি এত কাজ করেন শরীর খারাপ হবারই কথা। ভাবী আছে ভাবীকে দিন। ভাবীর সঙ্গে কথা বলি।
‘তোমার ভাবী একটু ব্যস্ত আছেন।’ বলেই খায়ের সাহেব টেলিফোনের লাইন কেটে দিলেন। তিনি বসেছেন জানালার পাশে। ট্রেনের চাকায় ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে। জানালার ও পাশের বন জঙ্গল ঘরবাড়ি দ্রুত সরে যাচ্ছে। দেখতে ভাল লাগছে। সবচে ভাল লাগছে অনেক দূরের বাড়িঘরের হারিকেন বা কূপীর আলো। ছোটবেলায় এইসব আলো দেখতে ভয় ভয় লাগতো। তাকে কে যেন বলেছিল ঐগুলা জ্বীনের চোখ। জ্বীন কখনো তাকিয়ে থাকে, কখনো চোখ বন্ধ করে। এই জন্যেই দূরের আলো কখনো দেখা যায় কখনো দেখা যায় না।
খায়ের সাহেবের মনে হল ট্রেনে করে তিনি উল্টা যাত্রা শুরু করেছেন। ট্রেন অতি দ্রুত তাকে শৈশবে নিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে একজন লজিং মাস্টার থাকতেন। নাম আক্কাস। আক্কাস স্যার তাকে অংক আর ইংরেজি শেখাতেন। অংক এবং ইংরেজির বাইরে আরেকটা জিনিস শেখাতেন। তিনি সেই শিক্ষার নাম দিয়েছিলেন সত্য শিক্ষা।
মিথ্যা কথা মানুষ কি জন্যে বলে জানিস?
জি না।
মিথ্যা কথা বলতে আরাম এই জন্যে মানুষ মিথ্যা কথা বলে। সত্যি কথা বলতে বেআরাম।
বেআরাম কেন?
জানি না কেন। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি। মিথ্যা কথা হুট করে মুখ দিয়ে বের হয়। সত্যিটা বের হয় না। আজিব ব্যাপার।
তাদের এই লজিং স্যার পরে স্কুলেই চাকরি পান। সত্যি কথা বলার বদঅভ্যাসের কারণে তার চাকরি চলে যায়। সেবার স্কুলের উন্নয়নের জন্যে একশো বস্তা গম বরাদ্দ হয়েছিল। হেডমাস্টার সাহেব নিজে দশ বস্তা রেখে অন্য সব শিক্ষকদের দুই বস্তা করে দিলেন। স্কুল কমিটির সেক্রেটারি পেলেন পাঁচ বস্তা। গভর্নিং বডির মেম্বাররা তিন বস্তা করে। একজন শুধু গম নিলেন না, তার নাম আক্কাস মাস্টার। তিনি শুধু যে গম নিলেন না, তা-না জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত জানালেন। তদন্ত হল। তদন্তে প্রমাণিত হল আক্কাস আলি স্কুলের শিক্ষকদের সম্মান নষ্ট করার জন্যে এই কাজ করেছেন। নিজে সাধু সেজে অন্যদের চোর বানাতে চেয়েছেন।
আক্কাস মাস্টারের শুধু যে চাকরি গেল তা-না, অন্যদের নামে বিশেষ করে স্কুল কমিটির সেক্রেটারি রজব মিয়ার নামে মিথ্যা অভিযোগ আনার শাস্তিও হল। আক্কাস মাস্টারকে কানে ধরে রজব মিয়ার বাড়ির সামনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হল। তার পাঞ্জাবীর বুকে সেফটি পিন দিয়ে একটা কাগজ লাগিয়ে দেয়া হল। সেখানে লেখা
“আমি চোর”
আক্কাস মাস্টার কাঁদছিল। তাকে কাঁদতে দেখে বালক খায়েরের হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে গেল। সে ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। তার বাবা এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, বাবা কি হইছে? কান্দ কেন? সে কিছুই বলে না শুধু কাঁদে। তার মা তখন বললেন, আক্কাস মাস্টার কানে ধইরা কানতেছে এইটা দেইখা তোমার পুলা কানতেছে।
খায়েরের বাবা অতি বিস্মিত হয়ে বললেন, আমার পুলার অন্তরে এত মায়া? এত মায়া আমার পুলার অন্তরে! তিনি তৎক্ষণাৎ হাত তুলে দোয়া করলেন, হে আল্লাহপাক আমার ছেলের অন্তরের এই মায়া যেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকে। আমিন।
খায়েরের যখন আট বৎসর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। আজ তার বয়স ৫৯-এর কিছু বেশি। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর আজ তার বাবার কথা মনে পড়ল এবং চোখে পানি এসে পড়ল। তার পরহেজগার বাবার প্রার্থনা আল্লাহপাক শোনেন নি। শৈশবের মায়ার কিছুমাত্র তার মধ্যে নেই। তিনি এই সমাজে অতি দুষ্ট মানুষ হিসেবে পরিচিতি।
.
ট্রেন থেমে পড়েছে। স্টেশন ছাড়াই থেমেছে। দু’দিকে শালবন। নিঝুম এক জায়গা। জানা গেছে ইনজিনে কি এক ঝামেলা হয়েছে। ড্রাইভার ইনজিন সারাবার চেষ্টা করছে। কিছু যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে চিন্তিত মুখে হাঁটাহাঁটি করছে। অনেকে ভীড় করেছে ইনজিনের পাশে।
.
মাওলানার স্ত্রীর অবস্থা ভাল না। প্লেসেন্টা এখনো বের হয়নি। অস্বাভাবিক রক্তপাত হচ্ছে। এই মহিলাকে অতি দ্রুত হাসপাতালে নেয়া প্রয়োজন। জঙ্গলে ট্রেন থেমে থাকলে গুরুতর সমস্যা হবে। মাওলানা সমস্যার ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না। পুত্র লাভ উপলক্ষে তিনি শোকরানা নামাজ শেষ করেছেন। আনন্দিত মুখে বার বার তার কামরায় উঁকি দিচ্ছেন। বাচ্চা কোলে নিয়ে সাজেদা বেগম বসে আছেন। সমস্যার জটিলতা তিনি বুঝতে পারছেন। একটু পর পর তিনি চিত্রাকে বলছেন, বৌমা খোঁজ নাও ট্রেন কখন ছাড়বে। কামরায় আশহাব আছে। সে ক্ষণে ক্ষণে মার কাছ থেকে ধমক খাচ্ছে–তুই তো গাধা ডাক্তার। কিছু করতে পারছিস না এটা কেমন কথা। তুই কি নকল করে পাস করেছিস যে কিছু জানিস না। গাধার গাধা। তোর বাপ ছিল গাধা। তুইও গাধা!
এমন কঠিন সময়ে মাওলানা উঁকি দিল এবং সবগুলি দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করল, খালাম্মা ছেলে কি আমার মতো হয়েছে?
সাজেদা বললেন, ছেলের গালে ছাগলা দাড়ি নাই। ছেলে তোমার মতো হয় নাই। ছেলে কার মতো হয়েছে এই চিন্তা বাদ দাও। তোমার বৌকে বাঁচাবার চেষ্টা কর।
মাওলানা বললেন, কঠিন দোয়ার মধ্যে আছি খালাম্মা। দেখবেন কিছুক্ষণের মধ্যে ইনজিন ঠিক হবে ইনশাল্লাহ। আমরা একটানে ময়মনসিংহ পৌঁছে যাব।
সাজেদা বললেন, আল্লাহপাক কি ইনজিন ঠিক করার জন্যে ফেরেশতা পাঠায়েছেন?
মাওলানা বললেন, এই ধরনের কথা বলবেন না খালাম্মা। বিরাট পাপ হবে। এইসব খোদা নারাজি কথা।
খোদা তোমার আমার মতো না। এত্ত সহজে তিনি নারাজ হন না। তুমি আমার সামনে থেকে যাও। তুমি হচ্ছ রামছাগল। ট্রেন থেকে নেমে দেখ কাঁঠাল গাছ পও কি-না। যদি পাও পাতা ছিঁড়ে পাতা খাও।
.
ড্রাইভার সাহেব বলেছেন, ইনজিনের মূল পিস্টন ভেঙে গেছে। উদ্ধারকারী ইনজিন না এলে কিছু করা যাবে না। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। রশীদ উদ্দিন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন। তাঁর সামনে আশহাব চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে।
রশীদ উদ্দিন বললেন, মাওলানার স্ত্রীর অবস্থা কি? সে কি চার-পাঁচ ঘন্টা সারভাইভ করবে?
আশহাব বলল না, আমাদের হাতে বড় জোর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় আছে।
রশীদ উদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন।
আশহাব বলল, স্যার কোথায় যান।
রশীদ উদ্দিন জবাব দিলেন না।
.
আবুল খায়ের সাহেব সেলুন কারের সোফায় গা এলিয়ে বসে ছিলেন। হঠাৎ তিনি নড়ে চড়ে বসলেন। তাঁর কামরায় বৃদ্ধ যে মানুষটা ঢুকছে তার চেহারা অবিকল আক্কাস মাস্টারের মতো। অথচ আক্কাস মাস্টার চার বছর আগে মারা গেছেন। তিনি নিজে তার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন।
সেই লুঙ্গি পরা মানুষ। মাথায় মাফলার। আক্কাস মাস্টারেরও একই ব্যাপার ছিল। লুঙ্গি, শীত-গ্রীষ্মে মাফলার। খায়ের সাহেব উঠে দাঁড়াবেন না কি বসেই থাকবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি এক ধরনের অস্বস্থির মধ্যে পড়ে গেলেন।
আমার নাম রশীদ উদ্দিন। আমি আপনার কাছে একটি আবেদন নিয়ে এসেছি।
খায়ের সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কি আবেদন
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনার সামনে বসে বলি। আমাকে দুই মিনিট সময় যদি দেন।
বসুন।
রশীদ উদ্দিন বললেন, ট্রেনের একজন যাত্রী মহা বিপদে পড়েছে। তার একটি সন্তান হয়েছে। এখন শুনতে পাচ্ছি প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। তাকে অতি দ্রুত কোনো একটা হাসপাতালে ভর্তি করানো দরকার। আপনি যদি ব্যবস্থা করে দেন তাহলে মেয়েটি বেঁচে যায়।
খায়ের সাহেব বললেন, আমি কি ভাবে ব্যবস্থা করব? ইনজিন নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কখন ঠিক হবে তার নেই ঠিক।
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনি অতি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আপনার পক্ষে এই অবস্থাতেও ব্যবস্থা করা সম্ভব।
খায়ের সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আপনি একটা ভুল করছেন– মন্ত্রীদের হাতে আলাদিনের চেরাগ থাকে না। চেরাগ ঘসে তারা দৈত্য আনতে পারে না। যদি চেরাগ থাকতো আমি চেরাগের দৈত্যকে বলতাম সে ম্যাজিক কার্পেটে করে রোগী সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে নিয়ে চিকিৎসা করাতে।
রশীদ উদ্দিন সহজ গলায় বললেন, স্যার আপনার কাছে ম্যাজিক কার্পেট আছে।
আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?
জি-না। আমি অংকের শিক্ষক। অংকের শিক্ষকরা রসিকতা বুঝতেও পারে না। করতেও পারে না।
রশীদ উদ্দিন দ্বিতীয়বার চমকালেন। আক্কাস মাস্টারও অংকের শিক্ষক ছিলেন। খায়ের সাহেব বললেন, আপনার রোগীর প্রতি আমি যথেষ্ট সিমপ্যাথি বোধ করছি কিন্তু বুঝতেই পারছেন আমার কিছু করার নেই।
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনি টেলিফোন করেই একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে পারেন। দশ মিনিটে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার চলে আসবে। মহিলার জীবন রক্ষা হবে। আমি কি আমাদের পবিত্র গ্রন্থ থেকে একটা আয়াত বলব?
খায়ের সাহেব চুপ করে রইলেন। রশীদ উদ্দিন বললেন, আল্লাহপাক বলছেন, যে একটি জীবন রক্ষা করে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই রক্ষা করে আর যে একটি জীবন নষ্ট করে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই ধ্বংস করে।
খায়ের সাহেব পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন, আপনি এমন ভাবে কথা বলছেন যেন আমি ঢাকায় আমার বাড়ির ছাদে তিনটা হেলিকপ্টার রেখে দিয়েছি। টেলিফোন করব আর উড়ে চলে আসবে।
তার মানে কিছু করতে পারছেন না?
না।
দু-এক জায়গায় টেলিফোন করে দেখেন কাজ হতেও তো পারে। সিচুয়েশনটা চিন্তা করুন বনের মধ্যে ট্রেন আটকে আছে। একজন মৃত্যুপথযাত্রী। ট্রেনের এক যাত্রী মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি ঘটনা শুনে মর্মাহত হলেন। নানান ঝামেলা করে হেলিকপ্টার আনালেন। রোগী ঢাকা পাঠানো হল। হেলিকপ্টার যখন উড়তে শুরু করবে তখন ট্রেনের শত শত যাত্রী চিৎকার করে বলবে–আবুল খায়ের খান, জিন্দাবাদ। তারা মন থেকে বলবে। তাদেরকে ভাড়া করে আনতে হয়নি। নিজের পকেট থেকে একটা পয়সা খরচ না করেও আপনি স্বতস্ফূর্ত জিন্দাবাদ ধ্বনি শুনবেন।
আবুল খায়ের বললেন, আপনি কি বিদায় হবেন?
রশীদ উদ্দিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আপনাকে কুৎসিত একটা গালি দিতে ইচ্ছা করছে। যে গালি শুনলে আপনার পিত্তি জ্বলে যাবে এ রকম গালি। তা না দিয়ে একটা ভদ্র গালি দিচ্ছি। হাজার হলেও আপনি মন্ত্রী মানুষ–তুই গু খা। ফ্রেস গু না, তিন দিনের বাসি গু। যার উপর নীল রঙের মোটা মোটা মাছি ভোঁ ভোঁ করে উড়ছে। মন্ত্রীকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে রশীদ উদ্দিন বের হয়ে গেলেন।
.
এতক্ষণ খায়ের সাহেব সিগারেট হাতে বসেছিলেন এখন সিগারেট ধরালেন। তার ভুরু কুচকে আছে। টেবিলে রাখা টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। ধরবেন না, ধরবেন না করেও তিনি টেলিফোন ধরলেন। তাঁর স্ত্রী টেলিফোন করেছে।
সুরমা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, হ্যালো। হ্যালো।
হুঁ।
এতবড় একটা ঘটনা। তুমি আমাকে কিছুই জানাও নি। আমি খবরটা শোনার পরেই জঙ্গলের মধ্যে দুই রাকাত শুকরানা নামাজ পড়েছি। একটা ছাগল সদকা মানত করেছি। ময়মনসিংহ পৌঁছেই ছাগল দিয়ে দিব।
ভাল।
এই শোনো রেলমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনি নিজেই টেলিফোন করেছিলেন। আমরা জঙ্গলে পড়ে আছি শুনে উনি হতভম্ব। যাই হোক ব্যবস্থা করেছেন। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে।
খায়ের সাহেব বললেন, কি ভাবে?
তোমাদের ট্রেন আটকে বসে আছে না?
হ্যাঁ। ইনজিন নষ্ট।
ইনজিন নষ্ট তোমাকে কে বলেছে? ইনজিন ঠিকই আছে। রেলমন্ত্রীর নির্দেশে ট্রেন আটকা। আমাদেরকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে এক বগির একটা ট্রেন তোমাদের কাছে যাবে। আমরা সেলুনে উঠব তারপর ট্রেন ছাড়বে।
ও আচ্ছা।
তোমার কথাবার্তায় প্রাণ নেই কেন বল তো? এদিকে আমরা খুব হৈ চৈ করছি। জঙ্গলের মধ্যেই কনসার্ট। কি যে মজা হয়েছে। যমুনা এবং যমুনার স্বামী সাম্বা নাচ নেচেছে। ওরা যে সাম্বা নাচতে জানে আমার ধারণাই ছিল না। সেলুন কারে পৌঁছানোর পর ঐ নাচটা আবার করতে বলব।
আচ্ছা।
আমি আর কি ঠিক করেছি জান, এক রাতে জঙ্গলে প্রোগ্রাম করব। তোমার সব বন্ধু-বান্ধবরা থাকবে। জোছনা রাত। রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু হবে। ঐ যে উনার বিখ্যাত গান–’আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।‘
হুঁ।
.
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চিত্রা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। চোখের সামনে একটা মেয়ে মরে যাচ্ছে এই দৃশ্যটা সে নিতেই পারছে না। মাওলানার স্ত্রী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তার ছেলের দিকে। ছেলেও ড্যাব ড্যাব করে মা’কে দেখছে। কি অদ্ভুত এবং কি করুণ এক দৃশ্য। এই দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করা মুশকিল। চিত্রা বের হয়ে চলে এসেছে।
বাথরুমের পাশের ঘরের দরজা খুলল। একজন ভদ্রমহিলা এসে চিত্রার পাশে দাঁড়ালেন। চিত্রাকে চমকে দিয়ে তার পিঠে হাত রাখলেন। নরম গলায় বললেন, মাগো! আমি খবর পেয়েছি মেয়েটা মারা যাচ্ছে। কেঁদে কি আর মৃত্যু ফেরানো যায়।
চিত্রা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, মৃত্যু ফেরাবার জন্যে কাঁদছিনা। কষ্টে কাঁদছি। এক ঘণ্টা সময় হাতে পেলেও মৃত্যু ফেরানো যেত।
মহিলা বললেন, মা আমি ব্যবস্থা করছি। একটা হেলিকপ্টার আনার ব্যবস্থা করছি। এই জায়গার ঠিক লোকেশন দরকার। রেলের কাউকে খবর দিয়ে আনতে পারবে? যার মাধ্যমে ঠিক ঠিক লোকেশনটা আমি জানতে পারি?
হতভম্ব চিত্রা বলল, আপনি কিভাবে হেলিকপ্টার আনবেন? আপনার পরিচয় জানতে পারি?
মহিলা বললেন, আমার একটাই পরিচয়। আমি একজন দুঃখী মা। ছেলের ডেডবডি নিয়ে গ্রামে যাচ্ছি। আমার একটাই ছেলে। ছেলের বাবা মারা গেছেন দশ বছর আগে। সময় নষ্ট করে লাভ নেই তুমি রেলের কোনো একজনকে ডাক।
.
ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার রওনা হয়েছে। দু’জন মাত্র যেতে পারবে। রোগীর সঙ্গে যাচ্ছে তার ছেলে এবং আশহাবের মা সাজেদা বেগম। তিনি চিত্রাকে ডেকে কঠিন ভঙ্গিতে বলেছেন–বৌমা আমার ছেলেকে তোমার হাতে রেখে গেলাম। চোখে চোখে রাখবে। সুযোগ পেলেই যেন চুকচুক করে কিছু না খায়। এতদিন আমি দেখেছি। এখন তুমি বাড়ির বৌ তুমি দেখবে।
রশীদ উদ্দিন পাশেই ছিলেন। তিনি চমকে উঠে বললেন, তোমরা এই ফাঁকে বিয়েও করে ফেলেছ। আশ্চর্য তো!
সাজেদা বিরক্ত হয়ে বললেন, আশ্চর্য হবার কি আছে? বয়স হয়েছে বিয়ে করবে না? ধেং ধেং করে প্রেম করে বেড়াবে? কৃষ্ণ লীলা আমার পছন্দ না। আমি প্রেম করার বিপক্ষে। প্রেম যদি করতেই হয়–বিয়ের পরে করা উচিত। সবচে ভাল হয় না করলে।
রশীদ উদ্দিন বললেন, আপনার কথাবার্তা আমার অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। আপনার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হওয়া অতীব জরুরি।
সাজেদা আঁচল তুলে ঘোমটা দিতে দিতে চিত্রাকে বললেন, বৌমা। বুড়াটাকে আমার সামনে থেকে যেতে বলো। বেলাজ বুড়া।
.
মন্ত্রী সাহেবের আত্মীয়স্বজন চলে এসেছেন। তারা সেলুন কারে উঠেছেন।
ট্রেনের ইনজিন ঠিক হয়ে গেছে। এক্ষুনি ট্রেন ছাড়বে। যাত্রীরা হেলিকপ্টারের চারদিকে ভীড় করে আছে বলে ট্রেন ছাড়া যাচ্ছে না।
হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করেছে। যাত্রীরা বিকট শ্লোগান দিল, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবুল খায়ের! জিন্দাবাদ’। তারা ধরেই নিয়েছে এই কাজটা মন্ত্রী সাহেব থাকাতেই সম্ভব হয়েছে।
সুরমা তার বোন এবং ভগ্নিপতির সঙ্গে হাত-পা নাড়িয়ে গল্প করছেন– তোর দুলাভাইয়ের মানুষের প্রতি মমতাটা কি রকম দেখলি। চিনে না, জানে
একজনের জন্যে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেছে। তার যত মমতা পাবলিকের জন্যে নিজের ফ্যামিলির দিকে সে ফিরেও তাকায় না।
যমুনা বলল, আপা তুমি দুলাভাইকে একটা বক্সিং দাও।
সুরমা বললেন, আমি পারব না। তুই দিয়ে আয়।
যমুনা উঠে গেল। খায়ের সাহেবের পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, দুলাভাই! আপনি এত ভাল কেন?
.
কিছুক্ষণের গল্প শেষ। পাঠকদের সামান্য কৌতূহল থাকতে পারে চিত্রা এবং আশহাবের কি হল। ওরা কি বিয়ে করেছে? না-কি যে যার পথে গিয়েছে। অংকবিদ রশীদ উদ্দিনেরই বা কি হল?
রশীদ উদ্দিনের কি হল বলতে পারছি না। উনি পোটলা পুটলি নিয়ে ভুল এক স্টেশনে নেমে পড়েছেন। তার পিছনে পিছনে কি মনে করে জানি মাওলানাও নেমে পড়েছেন।
চিত্রা সাজেদা বেগমের কামরায় ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। গভীর রাতে বাতি-টাতি নিভিয়ে সে ফিস ফিস করে লিলিকে টেলিফোন করল–
এই লিলি হ্যালো। একটা গোপন কথা শুনবি?
অবশ্যই শুনব।
আমি একজনের প্রেমে পড়েছি।
বলিস কি?
অনেকক্ষণ তাকে দেখতে পাচ্ছি না, দুঃখে-কষ্টে আমার মন ভেঙে যাচ্ছে।
লোকটা কে?
ডাক্তার। আশহাব নাম।
উনি কোথায়?
আমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
লিলি বলল, গাধামী করবি না। এক্ষুনি দরজা খুলে তাকে ভেতরে ডেকে নে।
কি অজুহাতে ডাকব?
যে কোনো অজুহাতে ডাকবি। মেয়েদের অজুহাতের অভাব আছে নাকি? চিত্রা দরজা খুলে বলল, আমার ক্ষিধে লেগেছে। খাব। খাবারগুলি গরম করে আনার ব্যবস্থা করো তো। চিত্রা মানুষটাকে তুমি তুমি করে বলছে তার মোটেও খারাপ লাগছে না। তার মাথায় একটা দুষ্টামিও ঢুকেছে। সে ঠিক করেছে খাবার সময় আশহাবকে চমকে দিয়ে বলবে, আমি হা করছি আমাকে খাইয়ে দাও।
.
ট্রেন অন্ধকারে ছুটে চলছে। সেলুন কারে গান হচ্ছে–আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে। ট্রেনের যাত্রা কি জোছনা স্নাত কোনো অলৌকিক বনের দিকে?