- বইয়ের নামঃ কুটু মিয়া
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, উপন্যাস, কল্পকাহিনী, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
আমার নাম কুটু মিয়া
আমার নাম কুটু মিয়া।
আলাউদ্দিন কুটু মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু মানুষ আছে যাদের ওপর চোখ পড়লে দৃষ্টি আটকে যায়। কুটু মিয়া সে-রকম একজন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে মানুষ না, পুরনো আমলের বাড়ির খাম্বা দাঁড়িয়ে আছে। খাম্বার মতো পুরো শরীরটার ভিতর গেল ভাব আছে। তেলতেল মুখ, চকচক করছে। গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। সাধারণত কালো মানুষের মাথা ভর্তি চুল থাকে। কুটু মিয়ার মাথায় খাবলা খাবলা চুল। কোনো বিচিত্র চর্ম রোগে মাথার চুল জায়গায় জায়গায় উঠে চকচকে তালু দেখা যাচ্ছে। লোকটার চোখ অতিরিক্ত ছোট বলে চোখের সাদা অংশ দেখা যাচ্ছে না। চোখের কালো মণি গায়ের কালো চামড়ার সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে হঠাৎ দেখলে মনে হয় লোকটার চোখ নেই। তারচেয়েও বড় সমস্য! একটা চোখ প্রায় বন্ধ।
আলাউদ্দিন পরিষ্কার শুনেছেন লোকটার নাম কুটু মিয়া। তারপরেও জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নামটা যেন কী? কথা খুঁজে না পেলে মানুষজন এই কাজটা করে একটা কথা নিয়ে পেঁচাতে থাকে।
স্যার, আমার নাম কুটু মিয়া।
আলাউদ্দিন বললেন, ও আচ্ছা, কুটু মিয়া নাম।
আলাউদ্দিন দ্রুত চিন্তা করছেন আর কী জিজ্ঞেস করা যায়। কোনো কথাই মনে আসছে না। লোকটার গা থেকে বাসি বাসি গন্ধ আসছে। কেমন টক টক গা গোলানো গন্ধ। কুটু মিয়া দুপা সামনে এগিয়ে এসে বলল, স্যার আপনের বাবুর্চি দরকার। আমি বাবুর্চির কাজ জানি।
কুটু মিয়া তার ফতুয়ার পকেট থেকে কাগজ বের করে এগিয়ে দিল। আলাউদ্দিন কাগজটা হাতে নিলেন। একটা টাইপ করা প্রশংসাপত্র। কাগজটা। লেমিনেট করা। বোঝাই যাচ্ছে খুবই যত্নে রাখা কাগজ।
প্রশংসাপত্র কে দিয়েছেন?
পাইলট স্যার দিয়েছেন। উনার বাড়িতে দুই বছর সার্ভিস করেছি। একটু পইড়া দেখেন।
আলাউদ্দিন প্রশংসাপত্রে চোখ বুলালেন। ইংরেজিতে যে কথাগুলি লেখা তার সারম— কুটু মিয়ার রাধার হাত অসাধারণ। রন্ধন বিদ্যায় সে একজন কুশলী। যাদুকর। বাবুর্চি হিসেবে তাকে পাওয়া বিরল সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি তার সাফল্য কামনা করি।
আলাউদ্দিন বললেন, তুমি কী রান্না জানো?
কুটু মিয়া হাসি মুখে বলল, সব কিছু অল্প বিস্তর জানি। ইংলিশ, বেঙ্গলি, চাইনিজ, থাই।
তোমার কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে তুমি হোটেল রেস্টুরেন্টের প্রফেশনাল বাবুর্চি। আমার সে-রকম দরকার নেই। আমার কাজের লোক টাইপ একজন দরকার। ঘর ঝাট দিবে, বাথরুম পরিষ্কার করবে। রান্নাবান্না করবে, বাজার করবে।
আমি ঘরের কাজও জানি।
বেতন কত দিতে হবে?
আপনার দিলে যা চায় দিবেন। আমার কোনো দাবি নাই।
আলাউদ্দিন ধাধার মধ্যে পড়ে গেলেন। একটা কাজের লোকের তার খুবই প্রয়োজন। গত পনেরো দিনে তিনটা কাজের লোক চলে গেছে। সর্বশেষটির নাম জিতু মিয়া। সে খালি হাতে যায় নি। তিন ব্যান্ডের একটা দামি রেডিও এবং রাইস কুকারটা নিয়ে চলে গেছে। রাইস কুকার মাত্র গত মাসে কেনা হয়েছে। তার জন্য খুবই কাজের একটা জিনিস। এক পট চাল আধা পট পানি দিয়ে সুইচ অন করে দেন। ভাত হয়ে গরম থাকে। খেতে বসার আগে আগে একটা ডিম ভেজে নেয়া। এখন তিনি প্রায় অচল। দুই বেলা হোটেল খেকে খেয়ে আসতে হচ্ছে। হোটেলের বাবার এক দুই বেলা ভালো লাগে, তারপর আর মুখে দেয়া যায় না। গতকাল গোসল করতে পারেন নি। টংকে পানি ছিল না। কাজের একটা ছেলে থাকলে দুবালতি পানি নিয়ে আসত।
কুটু মিয়া নামের যে লোক সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে যত ভালো বাবুর্চিই হোক তাকে রাখা যাবে না। অত্যন্ত বলশালী মধ্যবয়স্ক একজন লোক মর ঝাট দিচ্ছে, কাপড় ধুচ্ছে— এটা মানায় না। তাছাড়া লোকটার চোখ দেখা যাচ্ছে না। চোখের দিকে তাকালেই অস্বস্তি বোধ হয়। এ রকম মানুষ আশেপাশে থাকলে সব সময় খুব সুক্ষ্ম টেনশান কাজ করবে। আলাউদ্দিন টেনশানবিহীন জীবন চাচ্ছেন।
তুমি চলে যাও, তোমাকে রাখব না— এ ধরনের কথা মুখের ওপর বলা মুশকিল। আলাউদ্দিন চিন্তা করতে লাগলেন বুদ্ধি খাটিয়ে একে বিদায় করা যায়। কি-না। সাপ মরবে কিন্তু লাঠি ভাঙবে না— এ রকম কিছু। বুদ্ধিটাই মাথায় আসছে না।
কুটু মিয়া!
জ্বি স্যার।
আমি দরিদ্র মানুষ। কলেজে মাস্টারি করতাম, এখন রিটায়ার করেছি। একা বাস করি তারপরেও সংসার চলে না। আগে যে কাজের ছেলেটা ছিল তাকে মাসে তিনশ টাকা দিতাম। তিনশ টাকায় নিশ্চয় তোমার চলবে না। তিনশ টাকার বেশি দেয়া আমার সম্ভব না।
কুটু মিয়া শান্ত গলায় বলল, স্যার আপনাকে তো বলেছি। যা আপনার দিল চায় তাই দিবেন।
তুমি থাকবে তিনশ টাকায়?
জি।
আলাউদ্দিন ইতস্তত করে বললেন, আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। দেশের বাড়ি থেকে একটা কাজের ছেলের আসার কথা। সে এলে তোমাকে চলে যেতে হবে।
কবে আসবে?
এটা তো জানি না। কাল পরশু আসতে পারে। আবার দুই একদিন দেরিও হতে পারে। মোট কথা তোমার চাকরি টেম্পরারি। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
রান্নাঘরের পাশে একটা ঘর আছে। সেই ঘরে থাকবে। ফ্যান নেই, গরমে কষ্ট হবে। আমার এখানে থাকতে হলে কষ্ট করতে হবে। মাঝে মাঝে পানি থাকে না, তখন রাস্তার কল থেকে পানি আনতে হবে। অনেক কষ্ট। পারবে কিনা ভেবে দেখ।