- বইয়ের নামঃ কুটু মিয়া
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, উপন্যাস, কল্পকাহিনী, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
আমার নাম কুটু মিয়া
আমার নাম কুটু মিয়া।
আলাউদ্দিন কুটু মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু মানুষ আছে যাদের ওপর চোখ পড়লে দৃষ্টি আটকে যায়। কুটু মিয়া সে-রকম একজন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে মানুষ না, পুরনো আমলের বাড়ির খাম্বা দাঁড়িয়ে আছে। খাম্বার মতো পুরো শরীরটার ভিতর গেল ভাব আছে। তেলতেল মুখ, চকচক করছে। গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। সাধারণত কালো মানুষের মাথা ভর্তি চুল থাকে। কুটু মিয়ার মাথায় খাবলা খাবলা চুল। কোনো বিচিত্র চর্ম রোগে মাথার চুল জায়গায় জায়গায় উঠে চকচকে তালু দেখা যাচ্ছে। লোকটার চোখ অতিরিক্ত ছোট বলে চোখের সাদা অংশ দেখা যাচ্ছে না। চোখের কালো মণি গায়ের কালো চামড়ার সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে হঠাৎ দেখলে মনে হয় লোকটার চোখ নেই। তারচেয়েও বড় সমস্য! একটা চোখ প্রায় বন্ধ।
আলাউদ্দিন পরিষ্কার শুনেছেন লোকটার নাম কুটু মিয়া। তারপরেও জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নামটা যেন কী? কথা খুঁজে না পেলে মানুষজন এই কাজটা করে একটা কথা নিয়ে পেঁচাতে থাকে।
স্যার, আমার নাম কুটু মিয়া।
আলাউদ্দিন বললেন, ও আচ্ছা, কুটু মিয়া নাম।
আলাউদ্দিন দ্রুত চিন্তা করছেন আর কী জিজ্ঞেস করা যায়। কোনো কথাই মনে আসছে না। লোকটার গা থেকে বাসি বাসি গন্ধ আসছে। কেমন টক টক গা গোলানো গন্ধ। কুটু মিয়া দুপা সামনে এগিয়ে এসে বলল, স্যার আপনের বাবুর্চি দরকার। আমি বাবুর্চির কাজ জানি।
কুটু মিয়া তার ফতুয়ার পকেট থেকে কাগজ বের করে এগিয়ে দিল। আলাউদ্দিন কাগজটা হাতে নিলেন। একটা টাইপ করা প্রশংসাপত্র। কাগজটা। লেমিনেট করা। বোঝাই যাচ্ছে খুবই যত্নে রাখা কাগজ।
প্রশংসাপত্র কে দিয়েছেন?
পাইলট স্যার দিয়েছেন। উনার বাড়িতে দুই বছর সার্ভিস করেছি। একটু পইড়া দেখেন।
আলাউদ্দিন প্রশংসাপত্রে চোখ বুলালেন। ইংরেজিতে যে কথাগুলি লেখা তার সারম— কুটু মিয়ার রাধার হাত অসাধারণ। রন্ধন বিদ্যায় সে একজন কুশলী। যাদুকর। বাবুর্চি হিসেবে তাকে পাওয়া বিরল সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি তার সাফল্য কামনা করি।
আলাউদ্দিন বললেন, তুমি কী রান্না জানো?
কুটু মিয়া হাসি মুখে বলল, সব কিছু অল্প বিস্তর জানি। ইংলিশ, বেঙ্গলি, চাইনিজ, থাই।
তোমার কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে তুমি হোটেল রেস্টুরেন্টের প্রফেশনাল বাবুর্চি। আমার সে-রকম দরকার নেই। আমার কাজের লোক টাইপ একজন দরকার। ঘর ঝাট দিবে, বাথরুম পরিষ্কার করবে। রান্নাবান্না করবে, বাজার করবে।
আমি ঘরের কাজও জানি।
বেতন কত দিতে হবে?
আপনার দিলে যা চায় দিবেন। আমার কোনো দাবি নাই।
আলাউদ্দিন ধাধার মধ্যে পড়ে গেলেন। একটা কাজের লোকের তার খুবই প্রয়োজন। গত পনেরো দিনে তিনটা কাজের লোক চলে গেছে। সর্বশেষটির নাম জিতু মিয়া। সে খালি হাতে যায় নি। তিন ব্যান্ডের একটা দামি রেডিও এবং রাইস কুকারটা নিয়ে চলে গেছে। রাইস কুকার মাত্র গত মাসে কেনা হয়েছে। তার জন্য খুবই কাজের একটা জিনিস। এক পট চাল আধা পট পানি দিয়ে সুইচ অন করে দেন। ভাত হয়ে গরম থাকে। খেতে বসার আগে আগে একটা ডিম ভেজে নেয়া। এখন তিনি প্রায় অচল। দুই বেলা হোটেল খেকে খেয়ে আসতে হচ্ছে। হোটেলের বাবার এক দুই বেলা ভালো লাগে, তারপর আর মুখে দেয়া যায় না। গতকাল গোসল করতে পারেন নি। টংকে পানি ছিল না। কাজের একটা ছেলে থাকলে দুবালতি পানি নিয়ে আসত।
কুটু মিয়া নামের যে লোক সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে যত ভালো বাবুর্চিই হোক তাকে রাখা যাবে না। অত্যন্ত বলশালী মধ্যবয়স্ক একজন লোক মর ঝাট দিচ্ছে, কাপড় ধুচ্ছে— এটা মানায় না। তাছাড়া লোকটার চোখ দেখা যাচ্ছে না। চোখের দিকে তাকালেই অস্বস্তি বোধ হয়। এ রকম মানুষ আশেপাশে থাকলে সব সময় খুব সুক্ষ্ম টেনশান কাজ করবে। আলাউদ্দিন টেনশানবিহীন জীবন চাচ্ছেন।
তুমি চলে যাও, তোমাকে রাখব না— এ ধরনের কথা মুখের ওপর বলা মুশকিল। আলাউদ্দিন চিন্তা করতে লাগলেন বুদ্ধি খাটিয়ে একে বিদায় করা যায়। কি-না। সাপ মরবে কিন্তু লাঠি ভাঙবে না— এ রকম কিছু। বুদ্ধিটাই মাথায় আসছে না।
কুটু মিয়া!
জ্বি স্যার।
আমি দরিদ্র মানুষ। কলেজে মাস্টারি করতাম, এখন রিটায়ার করেছি। একা বাস করি তারপরেও সংসার চলে না। আগে যে কাজের ছেলেটা ছিল তাকে মাসে তিনশ টাকা দিতাম। তিনশ টাকায় নিশ্চয় তোমার চলবে না। তিনশ টাকার বেশি দেয়া আমার সম্ভব না।
কুটু মিয়া শান্ত গলায় বলল, স্যার আপনাকে তো বলেছি। যা আপনার দিল চায় তাই দিবেন।
তুমি থাকবে তিনশ টাকায়?
জি।
আলাউদ্দিন ইতস্তত করে বললেন, আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। দেশের বাড়ি থেকে একটা কাজের ছেলের আসার কথা। সে এলে তোমাকে চলে যেতে হবে।
কবে আসবে?
এটা তো জানি না। কাল পরশু আসতে পারে। আবার দুই একদিন দেরিও হতে পারে। মোট কথা তোমার চাকরি টেম্পরারি। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
রান্নাঘরের পাশে একটা ঘর আছে। সেই ঘরে থাকবে। ফ্যান নেই, গরমে কষ্ট হবে। আমার এখানে থাকতে হলে কষ্ট করতে হবে। মাঝে মাঝে পানি থাকে না, তখন রাস্তার কল থেকে পানি আনতে হবে। অনেক কষ্ট। পারবে কিনা ভেবে দেখ।
পারব স্যার।
যদি পার তাহলে তো ঠিকই আছে। যাও তোমার জিনিসপত্র নিয়ে চলে আস।
জিনিসপত্র সবই সাথে আছে স্যার।
তাহলে তো ভালোই।
কাজের লোকদের জিনিসপত্র কলাতে একটা ব্যাগ থাকে। তারচেয়ে বেশি কিছু থাকলে একটা পুটলি। কুটু মিয়ার ক্ষেত্রে উল্টোটা দেখা গেল। আলাউদ্দিন ভুরু কুচকে লক্ষ করলেন কুটু বারান্দা থেকে তার জিনিসপত্র আনছে। দুটা বড় স্যুটকেস, একটা হ্যান্ড ব্যাগ। ফলের ঝুড়ির মতো ঝুড়ি। ফ্লাস্ক, পানির বোতল। ছোট্ট চামড়ার একটা ব্যাগও দেখা গেল। দূর থেকে মনে হচ্ছে ক্যামেরার ব্যাগ।
আলাউদ্দিন বললেন, তোমার ঐ ব্যাগে কী? ক্যামেরা না-কি?
কুটু বিনীত গলায় বলল, জ্বি না স্যার। দুরবিন। বিদেশে যখন ছিলাম শখ করে কিনছিলাম।
বিদেশে ছিলে না কি?
জ্বি।
কোথায় ছিলে?
কুইত।
কুইত নামে কোনো বিদেশ আছে বলে তার মনে পড়ল না। কুয়েতকেই কি কুইত বলছে?
কুইতে কী কাজ করতে?
বাবুর্চির কাজ করতাম।
চলে এসেছ কেন?
মালিকের ইন্তেকাল হয়েছে। উনার বড় বিবি থাকতে বলেছিল। মন টিকল না। স্যার, রাতে খানা কয়টার সময় দিব?
আমি দশটা সাড়ে দশটার দিকে খাই। ফ্রিজ খুলে দেখ— একটা মুরগি থাকার কথা। গত পরশু কিনেছিলাম। ভেবেছিলাম নিজেই রাধব, পরে আর রাধা হয় নি। চাল ডাল আছে। মশলা আছে কিনা জানি না। গাদা খানিক ভাত রান্না করবে না। আমি খুবই অল্প খাই।
জি আচ্ছা।
কিছু পানি ফুটিয়ে রাখবে। পানি ফুটানো হয় না বলে কয়েক দিন ধরে ট্যাপের পানি খাচ্ছি। আরেকটা কথা— কাজকর্ম করবে নিঃশব্দে। আমি লেখালেখি করি। সাড়া শব্দ হলে আমার ডিসটার্ব হয়।
সকালে বেড টি খান?
পেলে খাই তবে বেড় টি-টা জরুরি না। ঐসব বড়লোকী চাল আমার জন্যে। আগেই বলেছি আমি গরীবের সন্তান।
বেড টি কয়টার সময় দিব?
ঘুম ভাঙলে দিবে। আমার ঘুম ভাঙার কোনো ঠিক নেই। কখনো কখনো খুব সকালে উঠি। আবার কোনো দিন নয়টা দশটা বেজে যায়। কত রাতে ঘুমাতে গিয়েছি তার ওপর নির্ভর। ঠিক আছে, এখন সামনে থেকে যাও। কাজ কর্ম করতে দাও।
জি আচ্ছা জনাব, শুকরিয়া।
কুটু মিয়া রান্নাঘরে ঢুকে গেল। আলাউদ্দিন ভুরু কুঁচকে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আসল কথাই কুটুকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। তার বাড়ি কোথায়? ঠিকানা কী? কে তাকে এখানে পাঠিয়েছে? হুট করে নতুন কোনো মানুষকে ঘরে ঢুকানো ঠিক না। দিনকাল আগের মতো নেই। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে কাজের মেয়ের হাতে গৃহকর্তী খুন। এইসব খুনখারাবি অবশ্যি টাকা পয়সার কারণে হয়। আলাউদ্দিন সাহেবের একটা বড় সুবিধা তার টাকা পয়সা নেই। ঘরের দামি জিনিসপত্রের মধ্যে আছে একটা পুরনো ফ্রিজ। পুরনো ফ্রিজের জন্য। তাকে কেউ খুন করবে এ রকম মনে হয় না। একটা ১৪ ইঞ্চি টিভি কেনার কথা কয়েকবার ভেবেছেন। তাঁর নিজের জন্য না, ঘরের কাজের লোকের জন্য। যে বাড়িতে টিভি নেই সে বাড়িতে কোনো কাজের লোক থাকে না এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। টিভি এখনো কেনা হয় নি, তবে টিভি কেনার টাকা আলাদা করা আছে।
আলাউদ্দিন নেত্রকোনার শেখ ইসলামুদ্দিন কলেজের ইসলামিক ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। রিটায়ার করে এখন ঢাকা শহরে স্থায়ী হয়েছেন। আশা ছিল। কোনো কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হবেন। তিনি শুনেছেন কোচিং সেন্টারগুলির রমরমা ব্যবসা। অনেক ছোটাছুটি করেও তিনি কোনো সুবিধা করতে পারেন নি। ভূতের গলিতে একটা ফ্লাটের অর্ধেকটায় তিনি থাকেন। বাকি অর্ধেকটায়। গার্মেন্টস কোম্পানির এক ম্যানেজার থাকে। নাম সাইফুদ্দিন। লোকটা অবিবাহিত। কিন্তু প্রায়ই গভীর রাতে তার ঘর থেকে মেয়ে মানুষের গলা শোনা যায়। ছুটির দিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাস খেলা হয়। তাদের আড়া বসলেও কোনো হৈচৈ হয় না। সাইফুদ্দিন লোকটি ভদ্র এবং বিনয়ী। আলাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হলে খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলে, প্রফেসর সাহেব ডাকে। আলাউদ্দিনও তার ওপর সস্তুষ্ট। কারণ ফ্ল্যাটের অর্ধেক ভাগাভাগিতে রান্নাঘর আলাউদ্দিনের ভাগে পড়েছে। কথা ছিল প্রয়োজনে রান্নাঘর সাইফুদ্দিনও ব্যবহার করবে। সাইফুদ্দিন সেটা কখনো করে নি। সে ইলেকট্রিক চুল কিনে আলাদা রান্নাঘর বানিয়েছে।
আলাউদ্দিন রিটায়ার করছেন ঠিকই, কিন্তু কোনো অর্থেই অবসর জীবন যাপন করছেন না। তিনি এখন পেশাদার লেখক। ছদ্ম নামে বেশ কিছু বইপত্র লিখেছেন। এখনো লিখছেন। তার সমস্ত বই-এর প্রকাশক মুক্তি প্রকাশনার মালিক হাজী একরামুল্লাহ। কখন কোন বই লিখতে হবে, কীভাবে লিখতে হবে হাজী একরামুল্লাহ তা সুন্দর করে বুঝিয়ে দেন। মুক্তি প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত আলাউদ্দিনের প্রথম বইটার নাম— সহজ দেশী বিদেশী ও চাইনিজ রান্না। হাজী একরামুল্লাহ পাঁচটা রান্নার বই তাকে দিয়ে বলেছেন, বই দেখে দেখে নিজের মতো করে সাজিয়ে দেন। ভাষাটা যেন সহজ হয়। কচকচানি কম। আলাউদ্দিন তাই করেছেন। একশ পৃষ্ঠার বই চার রঙের প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছে। প্রচ্ছদে একজন তরুণীর ছবি। সে রান্না করছে। তরুণীর পাশে সুদর্শন যুবক। সে পেছন থেকে তরুণীর কোমর জড়িয়ে ধরে তরুণীর মাথার পাশ থেকে নিজের মাথা বের করে অবাক হয়ে রান্না দেখছে। বইটির কয়েকটি বিষয়ে আলাউদ্দিন আপত্তি করেছিলেন। অর্ধনগ্ন তরুণী মূর্তি এবং গোঁফওয়ালা যুবক যেভাবে সেই তরুণীর কোমর ধরে আছে সেটা রান্নার বই-এ মানাচ্ছে না। বই এর দামও তার কাছে ঠিক মনে হয় নি। দেশী বিদেশী ও চাইনিজ রান্না। চাইনিজ রান্না তো বিদেশী রান্নার মধ্যেই পড়ে। আলাদা করে চাইনিজ রান্না বলার দরকার কী?
হাজী একরামুল্লাহ আলাউদ্দিনকে ধমক দিয়ে বলেছেন— তোমার কাজ হলো অন্য বই থেকে সুন্দর করে কপি করা। কপি করবে, পাণ্ডুলিপি জমা দিবে, ক্যাশ টাকা নিয়ে চলে যাবে। প্রচ্ছদ কী হবে, বই-এর নাম কী হবে, লেখকের কোন নাম যাবে এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ক্লিয়ার?
আলাউদ্দিন বিনীত ভঙ্গিতে বলেছেন, ক্লিয়ার।
হাজী একরামুল্লাহর বয়স আলাউদ্দিনের চেয়ে খুব বেশি না। তবে তিনি আলাউদ্দিনকে তুমি করেই বলেন। আলাউদ্দিন তাতে কিছু মনে করেন না।
রান্নার বইটাতে লেখক হিসেবে নাম ছাপা হয়েছে অধ্যাপিকা হামিদা বানুর। বই-এর ফ্ল্যাপে লেখিকার ছবি এবং জীবনবৃত্তান্ত ছাপা হয়েছে। লেখিকা পৃথিবীর নানান দেশ ভ্রমণ করেছেন। মালয়েশিয়ার পেনাং-এ একটি আন্তর্জাতিক রন্ধন প্রতিযোগিতায় সিনিয়র গ্রুপে স্বর্ণপদক পেয়েছেন।
আলাউদ্দিনের দ্বিতীয় বইটির নাম ছোটদের হাদিসের কথা। বই-এর প্রচ্ছদে খেজুর গাছের ছবি। খেজুর গাছের নিচে একটা উট। অনেক দুরে মসজিদের মিনার। বইটিতে লেখকের নাম ছাপা হয়েছে- মৌলানা সৈয়দ আশরাফুজ্জামান খান।
আলাউদ্দিন বর্তমানে লিখছেন হাত দেখার বই। বইটার নাম সহজ হস্তরেখা বিদ্যা এবং তিল তথ্য। হাজী একরামুল্লাহ আলাউদ্দিনকে বলে দিয়েছেন এই বইটার ভাষা হবে খটমটা। এসেছি, গিয়েছি টাইপ ভাষা না। সাধু ভাষা। কারণ। বইটির লেখক হিসেবে নাম যাচ্ছে স্বামী অভেদানন্দের। স্বামী অভেদানন্দ জটিল ভাষায় লিখবেন এটাই স্বাভাবিক।
এইসব বই-এর পাশাপাশি পাঠ্য বই-এর নোটও তিনি লেখেন। সেখানে নাম যায়—কে, এন, লাল, এক্স প্রিন্সিপ্যাল এন্ড কালি নারায়ণ স্কলার।
খাটের ওপর একটা টুলবক্স। আলাউদ্দিন খাটে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছেন। চিন্তা শেষ করে এ4 কাগজে পেন্সিল দিয়ে লিখছেন। লেখায় কাটাকুটি তার অপছন্দ। লেখা যা পছন্দ হচ্ছে না তা তিনি ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলছেন। টুলবক্সের ওপর তিনটা পেনসিল সাজানো। পেনসিলের পাশে ইরেজার। যে সব বই দেখে দেখে তিনি লিখছেন সেই বইগুলি খাটে ছড়ানো।
আজ সন্ধ্যা থেকেই শিররেখার চ্যাপ্টারটা লিখছেন। লেখা যত দ্রুত হওয়া উচিত তত দ্রুত হচ্ছে না। লিখে আরাম পাচ্ছেন না। কখনো মনে হচ্ছে ভাষা বেশি খটমটে হয়ে যাচ্ছে, আবার কখনো মনে হচ্ছে বেশি সহজ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সাইফুদ্দিন সাহেবের বাসা থেকে অল্প বয়স্ক একটা মেয়ের খিলখিল হাসি শোনা যাচ্ছে। এই মেয়ের হাসি অত্যন্ত তীক্ষ। শব্দটা কানের ভেতর দিয়ে চট করে মগজে ঢুকে যায়। মগজ রিনরিন করে কাঁপতে থাকে। লেখার কনসানট্রেশন থাকে না। আলাউদ্দিন তারপরেও লিখে যাচ্ছেন, শুধু মেয়েটা যখন হাসছে তখন লেখা খেমে যাচ্ছে। আলাউদ্দিন লিখছেন—
মানুষের পরিচয় মন ও মস্তিষ্কে। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ মন ও মস্তিষ্কের সোনালি ফসল। মন নিয়ন্ত্রণ করে মানবিক আবেগ, যথা প্রেম ভালোবাসা, রাগ, অনুরাগ। মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে মেধা। হস্তরেখা বিজ্ঞানে শিররেখা মস্তিষ্কের পরিচায়ক। হৃদয়রেখা মনের পরিচায়ক। মন এবং মস্তিষ্ক যেমন সমান্তরাল চলে, হৃদয়রেখা এবং মস্তিষ্করেখারও হাতের তালুতে সমান্তরাল অবস্থান। এ যেন সেই চিরন্তন কথা— রেল লাইন বহে সমান্তরাল।
লেখাটা আলাউদ্দিনের ভালো লাগছে না। স্বামী অভেদানন্দের লেখা বলে মনে হচ্ছে না। লেখার মাঝখানে হে বৎস জাতীয় কথা থাকা প্রয়োজন। গুরু জ্ঞান দিচ্ছেন ছাত্রকে। মানুষ না লিখে লেখা উচিত মানব। হাতের তালু না লিখে অন্য কোনো প্রতিশব্দ ব্যবহার করা উচিত। হাতের তালু খুব কাছের কিছু মনে হচ্ছে। হাতের তালুর সংস্কৃত ক তিনি জানেন না। হাতের সংস্কৃত হস্ত। হস্ততালু নতে আবার তেমন ভালো লাগছে না।
এক বৈঠকে আলাউদ্দিন অনেকক্ষণ লিখতে পারেন। তেমন ক্লান্তি বোধ করেন না। লেখাটা দ্রুত শেষ করতে হবে। হাজী সাহেব নতুন একটা পরিকল্পনা নিয়ে বসে আছেন। আলাউদ্দিনের দেরি হলে নতুনটা অন্য কেউ নিয়ে যাবে। তিনিই যে মুক্তি প্রকাশনীর একমাত্র ফরমায়েশি লেখক তা না। আরো লেখক আছে।
সার, খানা তৈরি।
আলাউদ্দিন রীতিমতো চমকে উঠলেন। ঘরে যে একজন বাবুর্চি আছে, সে রান্না করছে। এই ব্যাপারটা মাথার মধ্যে ছিল না। আলাউদ্দিন বলেন, রেঁধেছ কী?
কুটু মিয়া তার জবাবে হাসল। ম্যাজিসিয়ানরা ম্যাজিক দেখাবার সময় যে ভঙ্গিতে হাসে সেই ভঙ্গির হাসি। আলাউদ্দিন খাট থেকে নামতে নামতে বললেন, তোমার চোখে কি কোনো সমস্যা আছে? কীভাবে যেন তাকাচ্ছে।
কুটু বলল, একটা চোখে দেখি না।
সে কী! কোন চোখে।
বাম চোখে।
জন্ম থেকেই এরকম, না কোনো ব্যথা ট্যথা পেয়েছিলে?
কুটু জবাব দিল না। আলাউদ্দিন সাহেবের মনে হলো এই প্রশ্ন করা ঠিক হয় নি। চোখ নষ্ট হওয়া বিরাট দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে কষ্ট দেয়া ঠিক না। চোখ জন্ম থেকেই কষ্ট না পরে নষ্ট হয়েছে এই তথ্য জেনেও তো তার কোনো লাভ হচ্ছে না।
আলাউদ্দিন খেতে বসলেন। থালা বাসন ঝকঝক করছে। কাচের গ্লাস এত পরিষ্কার যে আলো জমকাচ্ছে। যে ছোট টেবিলটায় বসে তিনি খাওয়া দাওয়া করেন সেই টেবিল পরিষ্কার করা হয়েছে। টেবিলের ওপর ধবধবে সাদা টেবিল ক্লথ। তার যে টেবিল ক্লথ আছে এটাই তিনি জানতেন না।
খাবারের মেনু খুবই সাধারণ। আলু ভাজি, মুরগির মাংসের ঝোল, ডাল। এক পাশে পিরিচে লেবু, কাচা মরিচ। আলাউদ্দিন আলু ভাজি নিয়ে খেতে গিয়ে চমকে উঠলেন— ব্যাপারটা কী, সামান্য আলু ভাজি তো এত স্বাদ হবে না। তার কাছে মনে হচ্ছে শুধুমাত্র আলু ভাজি দিয়েই তিনি এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারবেন। আলু ভাজি করেছেও কত সুন্দর। চুলের মতো সরু করে কাটা কাটা আলুর একটা টুকরা আর অন্যটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে না। সামান্য আলু ভাজিই খেতে এ রকম, মুরণির ঝোলটা না জানি কেমন! আলু ভাজি খাওয়া বন্ধ রেখে তিনি মুরগির ঝোল নিলেন। তিনি মনে মনে বললেন, কী আশ্চর্য! পাইলট সাহেব যে লিখেছেন— কুটুমিয়ার রাধার হাত অসাধারণ। রন্ধন বিদ্যায় সে একজন কুশলি জাদুকর। ঠিকই লিখেছেন, বরং একটু কম লিখেছেন। মুরগির ঝোল রান্নার কোনো কম্পিটিশনে এই মুরগির ঝোল পাঠিয়ে দিলে গোল্ড মেডেল নিয়ে চলে আসবে। রান্নার বইটা তিনি না লিখে কুটু মিয়াকে দিয়ে লেখানো দরকার ছিল।
ডাল এক চামচ নেবেন কি-না আলাউদ্দিন বুঝতে পারছেন না। ডালটা দেখে খুব ভালো মনে হচ্ছে না। মুরগির ঝোলের স্বাদটা মুখে রেখে খাওয়াটা শেষ হওয়া দরকার। নেহায়েত কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে তিনি এক চামচ ডাল নিলেন। তখন মনে হলো বিরাট ভুল হয়েছে, ডাল দিয়েই খাওয়া শুরু করা দরকার ছিল। আলু ভাজি এবং মুরগির ঝোলের প্রয়োজন ছিল না, শুধু ডাল দিয়েই তিনি এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারেন।
কুটু মিয়া আশেপাশে নেই— এটাও একটা শান্তি। কেউ আশেপাশে থাকলে তিনি খেতে পারেন না। দীর্ঘদিন একা একা থেকে এই এক বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে। তার সমস্যা হয় না শুধু বিয়ে বাড়িতে। অনেকের সঙ্গে খেতে বসা যায়। তখন কেউ কারো দিকে তাকায় না।
আলাউদ্দিন খাওয়া শেষ করে ডাকলেন, কুটু মিয়া!
কুটু পাশে দাঁড়াল। আলাউদ্দিন বললেন, তোমার রান্না খারাপ না। চলবে।
কুটু বলল, শুকরিয়া।
আলাউদ্দিন ইচ্ছা করেই প্রশংসা চেপে রাখলেন। বাঙালি প্রশংসা নিতে পারে। প্রশংসা করলেই তারা মাথায় উঠে যায়। অদ্ভুত এক জাতি।
সকালে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাজার সদাই করে আনবে।
জ্বি আচ্ছা।
ছোট মাছ, ভাজি ভুজি ভর্তা। এইসব। পোলাও-কোরমা-রোস্ট মুরগি মুসাল্লাম এইসবের প্রতি আমার লোভ নেই। গরিবের সন্তান, গরিবি খাদ্য খেয়ে অভ্যাস। বুঝতে পারছ?
জি।
তেল মশলা কম দিয়ে রাঁধবে। অনেকে মনে করে গাদাখানিক তেল মশলা হলেই তরকারি ভালো হয়। রান্নার পরে আমার লেখা একটা বই আছে— সহজ দেশী বিদেশী ও চাইনীজ রান্না। সেই বই-এ এই ব্যাপারটা বিশদভাবে লিখেছি। বইটা পড়ে দেখতে পার। তোমার উপকার হবে। বই-এ খাদ্যের পুষ্টির উপর আলাদা একটা চ্যাপ্টার আছে।
আমি স্যার পড়তে জানি না।
সে কী! অ আ ক খ কিছুই না?
জ্বি না।
খুবই দুঃখের কথা। আমি নিজে শিক্ষক ছিলাম তো। বয়স্ক একজন কেউ যদি বলে লেখাপড়া জানি না তখন রাগ লাগে। যাই হোক, আমি বাংলাবাজার থেকে শিশু শিক্ষার একটা বই নিয়ে আসব। অবসরে পড়বে। শুধু রান্না জানলেই হবে না। লেখাপড়া জানতে হবে। ঠিক কিনা বল?
জ্বি।
রান্না না জানাটা দোষের না, কিন্তু লেখাপড়া না জানাটা দোষের। বুঝাতে শার।
জ্বি।
রান্না যে জানে না তাকে কেউ গালি দেয় না। কিন্তু যে লেখাপড়া জানে না তাকে সবাই মূর্খ বলে গালি দেয়।
লেখাপড়ার ওপর বক্তৃতাটা দিয়ে আলাউদ্দিনের ভালো লাগছে। একটু ক্লান্তি ও লাগছে। মনে হচ্ছে অনেক বেশি কথা বলা হয়েছে। কারণ খাওয়াটা বেশি হয়ে। গেছে। শরীর হাঁসফাস লাগছে। একটা মিষ্টি পান খেতে পারলে ভালো হতো। তিনি এম্নিতে পান খান না তবে বিয়ে শাদির খাওয়ার পর মিষ্টি পানি খেতে ভালো লাগে। পানের সঙ্গে একটা সিগারেট পান হজমের সহায়ক। সিগারেট ও মনে হয় তাই।
কুটু মিয়া।
জ্বি।
দোকানে যাও, একটা মিষ্টি পান নিয়ে আসি। একটা সিগারেটও আনবে। ভালো কষ্মা, একটা মোমবাতি ও আনবে। কারেন্ট চলে গেলে অন্ধকার ঘরে বসে। থাকতে হয়। রোজ ভারি মোমবাতি আনব, মনে থাকে না। আমি আবার অন্ধকার সহ্য করতে পারি না।
রাত বেশি হয় নি। এগারোটা চল্লিশ। আলাউদ্দিন রাত দুটা আড়াইটার আগে কখনো ঘুমাতে যান না। গভীর রাতেই তার লেখালেখি ভালো হয়। আজ ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। তার মুখে পান, হাতে সিগারেট। তার মনে হচ্ছে মুখ ভর্তি পান এবং হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে তিনি খাটে আধশোয়া হয়েই ঘুমিয়ে। পড়বেন। হাত থেকে সিগারেটটা মেলতেও পারছেন না। আধো ঘুম আধো জাগরণ অবস্থায় সিগারেটের ধোয়া টানতে তার খুবই ভালো লাগছে। তার কাছে হঠাৎ মনে হচ্ছে জীবনটা সুখের।
আলাউদ্দিন আধশোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লেন। গ ঘুম। ঘরের বাতি জ্বলছে, মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। দক্ষিণের জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। সেই বাতাসও আরামদায়ক শীতল। তার ঘুম ভালো হঠাৎ। ঘরে বাতি নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাথার ওপর ফান চলছে না। তার বুক ধক করে উঠল। চারদিকে এত অন্ধকার কলা ঘরের বাতি এখন শোনা কে এ মনা তা এত অন্ধকার ঘাকে না। এপার্টমেন্ট হাউসের আলো এসে ঘরে ঢুকে। রাস্তার আলো কে। অন্ধকারেও বোঝা যায় ঘরের কোথায় কী আছে। ঘুমের মধ্যে এমন কিছু কি হয়েছে যে তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন? তার এক দূর সম্পর্কের চাচার এ রকম। হয়েছিল। তিনি হাটে গরু নিয়ে গিয়েছিলেন বিক্রির জন্য। দরে বললো না বলে গরু বিক্রি হলো না। মেজাজ খারাপ করে তিনি গেলেন চা খেতে। চা খেয়ে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। টোস্ট বিসর্কিট দিয়ে চা খেয়ে চায়ের নাম দিতে যাবেন, হঠাৎ চেঁচিয়ে বললেন— কী হইছে আন্ধাইর ক্যান? এই যে তার কাছে পৃখিবী হঠাৎ আন্ধাইর হলো— আলো আর ফিরল না।
তাঁর বেলায় এরকম কিছু কি হয়েছে? না-কি গোটা শহরের ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় শহরই অন্ধকার হয়ে গেছে? কোথাও আলো নেই। ঘটনা মনে হয় এ রকমই। ইলেকট্রিসিটি নেই বলেই ফ্যান ঘুরছে না। ফ্যান ঘুরলে ফ্যানের ক্যাট ক্যাট আওয়াজটা থাকত। কুটু মিয়া মোমবাতি এনে রেখেছিল— মোমবাতিটা কোথায় আলাউদ্দিনের মনে পড়ছে না। খাটের পাশের টেবিলে রাখার কথা। টেবিলটা কোথায়? গভীর অন্ধকার ও এক সময় চোখে সয়ে যায়। এই অন্ধকার চোখে সইছে না কেন? এ খাটের নিচে শব্দ হলো। ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ। আলাউদ্দিন চমকে উঠলেন। হঠাৎ তার মানে হলো জীবিত কোনো প্রাণী খাটের নিচে আছে। প্রকা কোনো প্রাণী চার পায়ে খাটের নিচে ঘুরছে। প্রাণীটার নিয়মিত নিঃশ্বাসের শব্দ এখন তিনি পাচ্ছেন। ফো-ফোস। ফো-ফোস। তার গায়ের বোটকা গন্ধ নাকে লাগছে। খাটের নিচে গাদা কর খবরের কাগজ। এই তো প্রাণীটা এখন কাগজ ছিড়ছে। গলার ভেতর অস্পষ্ট শব্দও করছে। রাগী শব্দ।
বাদর না তো? পুরনো ঢাকায় প্রচুর বার আছে। জানালা খোলা থাকলে মাঝে মাঝে এৱা ঘরে ঢুকে পড়ে। নানানভাবে মানুষজনকে বিরক্ত করে। এই অঞ্চলেও হয়তো বাদ আছে— তিনি জানেন না।
আলাউদ্দিন কী করবেন ভেবে পেলেন না। একবার তাঁর মনে হলো এটা দুঃস্বপ্ন। রাতের খাওয়া বেশি হয়ে গেছে। বদহজম হয়েছে। বদহজম থেকে দুঃস্বপ্ন। দেখছেন। তিনি থাকেন ছয়তলায়। দরজা বন্ধ করে শুয়েছেন। বাদর আসবে কোথেকে! না, একটু ভুল হয়েছে। তার ঘরের দরজা খোলাই ছিল। দরজা বন্ধ করার আগেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর ঘরের দরজা খোলা থাকলে ও বন্য কোনো পশু এসে ঘরে ঢুকবে না। তিনি তো সুন্দরবনের ভেতর কোনো ফরেস্টের বাংলোতে বাস করছেন। সমস্যাটা কোথায়? খাটের নিচ কাগজ ছেঁড়া এখনো চলছে।
অদ্ভুই একটা কথা আলাউদ্দিনের মাথায় এলো— তাঁর খাটের নিচে কুটু মিয়া বসে নেই তো? হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে। কাগজ ছিড়ছে। মাথা খারাপ মানুষদের পক্ষে এই কাজটা অস্বাভাবিক কিছুই না। সেতাবগঞ্জের এক পাগল ছিল হামাগুড়ি দিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত। পাগলের নাম সওদাগর। কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, সওদাগর তুমি হট না কেন? সওদাগর বলত, হাঁটলে ব্যালেন্সের সমস্যা হয় ভাইজান। সওদাগর পাগলা অনেক ইংরেজি জানত। কথাবার্তা বলত খুবই স্বাভাবিকভাবে। শুধু হাঁটত চার পায়ে। কে জানে। কুটুও হয়তো সওদাগরের মতোই মানসিক রোগী। আলাউদ্দিন কাপা কাপা গলায় ডাকলেন, কুটু। খাটের নিচ থেকে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো, জ্বি স্যার।
আলাউদ্দিনের সারা শরীর হিম হয়ে গেল। এটা হতেই পারে না। খাটের নিচে কুটু মিয়া বসে থাকবে কেন? তিনি আবারো ডাকলেন, কুটু। কুটু সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি স্যার। আলাউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে কী করছ?
কিছু করছি না স্যার।
খাটের নিচে বসে আছ কেন?
কুটু জবাব দিল না। ফোঁ-ফোল, ফোঁ-ফোস শব্দ করতে লাগল। আলাউদ্দিন ভয়ে জমে গেলেন। বন্যপশুর চেয়ে মস্তিষ্ক বিকৃত মানুষ অনেক ভয়ংকর। কুটুর। উপর অশুভ কোনো কিছুর ভর হয় নি তো?
আলাউদ্দিন আয়াতুল কুরসি সূরাটা পড়ার চেষ্টা করলেন। এই সূরাটা একবার ঠিকমতো পড়ে হাততালি দিলে খারাপ জিনিস দূরে চলে যায়। হাততালির শব্দ যতদূর যায় অশুভ জিনিসগুলি তত দূরেই যায়। আলাউদ্দিন সূরা পড়ে শেষ করেছেন কিন্তু হাততালি দিতে পারছেন না। হাততালি দেবার ক্ষমতা তার নেই। দুটি হাতই অসাড় হয়ে পড়ে আছে। যেন এই হাত দুটা নিজের না। অন্য কারোর হাত। এই দুই হাতের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আলাউদ্দিন চিৎকার করতে যাবেন তখনই খুট করে শব্দ হলো। ঘরের বাতি জ্বলে উঠল, ফ্যান ঘুরতে লাগল। আলাউদ্দিন ভাঙা গলায় ডাকলেন, কুটু মিয়া কুটু মিয়া।
থপথপ শব্দ করে কে যেন আসছে। কুটু মিয়াই অসিদ্রে। সে ছাড়া আর কে হবে! তার ঘরের দরজা ভেজানো। কেউ এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে।
কুটু মিয়া।
জ্বি স্যার।
ভেতরে আস।
দরজা ঠেলে কুটু মিয়া ঢুকল। তার হাতে পানির গ্লাস। পানির গ্লাসে বরফ ভাসছে। পানির গ্লাস দেখে আলাউদ্দিনের মনে হলো তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে। এক গ্লাস পানিতে তার হবে না। এক কলসি পানি দরকার।
কুটুকে দেখে তার লজ্জা লাগছে। সহজ স্বাভাবিক একজন মানুষ। তিনি ডেকেছেন বলে বুদ্ধি করে পানির গ্লাস নিয়ে চলে এসেছে। অথচ তিনি তার সম্পর্কে কত কিছু ভেবেছেন। মস্তিষ্ক বিকৃত। ভূতের ভর হয়েছে। ছিঃ।
কুটু!
জি স্যার।
হঠাৎ কারেন্ট চলে গিয়েছিল। গরমে ঘুমটা গেল ভেঙ্গে। পানি এনে ভালো করেছ। খুবই পানির পিপাসা হয়েছিল।
আলাউদ্দিন এক নিঃশ্বাসে পানির গ্লাস শেষ করে কুটুকে বললেন- কুটু দেশ তো আমার খাটের নিচে কিছু আছে কি না।
কুটু নিচু হয়ে খাটের নিচ দেখল। নিচু গলায় বলল, কিছু নাই স্যার।
আলাউদ্দিন বললেন, একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। কোনো একটা জতু আমার খাটের নিচে বসে আছে।
হাতে মুখে একটু পানি দেন। দিক, হাতে মুখে পানি দিব। তুমি আরেক গ্লাস ঠাপ্ত পানি আন।
কুটু মিয়া পা থপথপ করতে করতে চলে গেল। আলাউদ্দিন খাট থেকে নামলেন। নিচু হয়ে খাটের নিচটায় উঁকি দিলেন। খাটের নিচে কেউ নেই তা ঠিক, তবে খাটের নিচে গাদা করে রাখা সমস্ত খবরের কাগজ কুচি কুচি করে ছেঁড়া। তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেন নি। কেউ একজন খাটের নিচে বসে সত্যি সত্যি কাগজ ছিঁড়েছে।
হাজী একরামুল্লাহ অবাক
হাজী একরামুল্লাহ অবাক হয়ে বললেন, তোমার ঘটনা কী?
আলাউদ্দিন চুপ করে রইলেন। একরামুল্লাহ সাহেব তাকে দেখে এত বিস্মিত হচ্ছেন কেন তা বুঝতে পারলেন না। এক সপ্তাহ পরে এসেছেন— এই জন্যেই কি? তিনি মুক্তি প্রকাশনীর পোষা লেখক। তাই বলে প্রতিদিন আসতে হবে এমন তো কথা নেই।
হাজী সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, তুমি আগে প্রতিদিনই একবার বাংলাবাজার আসতে, এবারে ছয় দিন পরে আসলে। তাও আমি লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছিলাম বলে আসা। ঘটনা কী?
কোনো ঘটনা না।
অসুখ বিসুখ হয় নি তো?
আলাউদ্দিন না-সূচক মাথা নাড়লেন।
অসুখ বিসুখ যে হয় নি সেটা তো তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। বরং ওজন বেড়েছে। তোমার শরীরে থলথলে ভাব চলে এসেছে। পাঞ্জাবির ভেতর দিয়ে ভুড়ি দেখা যাচ্ছে। ব্যাপার কী?
কোনো ব্যাপার না।
বিয়ে শাদি করেছ নাকি?
জ্বি না। এই বয়সে বিয়ে শাদি!
পুরুষ মানুষ যে-কোনো বয়সে বিয়ে করতে পারে। গোপনে বিয়ে করে থাকলে স্বীকার করতে অসুবিধা নাই।
বিয়ে করি নি।
চেহারা ফরসা হয়েছে। ইস্ত্রি কন্যা পায়জামা পাঞ্জাবি পরেছ। তোমাকে ইস্ত্রি করা কাপড়ে কোনোদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
একটা কাজের লোক আছে। সেই কাপড় ধুয়ে দেয়। লন্দ্রি থেকে ইস্ত্রি করিয়ে আনে। রান্নাবান্না করে। ভালো রান্না। কুয়েতে বাবুর্চির কাজ করেছে।
বলো কী! একেবারে বিদেশী বাবুর্চি? ভালো হয়েছে। চিরকুমার লোকদের যে জিনিসটা প্রথম দরকার সেটা হলো একজন ভালো বাবুর্চি। খাওয়া দাওয়ার কষ্টটাই চিরকুমার লোকদের আসল কষ্ট। ভাত আর ডিম ভাজি কতদিন খাওয়া যায়।
ঠিক বলেছেন।
তোমাকে দুটা কাজের জন্যে ডেকেছি। দুইটাই জরুরি। একটা আমার জন্য জরুরি, আরেকটা তোমার সন্য জরুরি।
জ্বি বলুন।
হাত দেখার বই-এর অবস্থা কী? একটা বই শেষ করতে তো এতদিন লাগার কথা না।
আলাউদ্দিন ইতস্তত করে বললেন, আগে দিনে লিখতাম। রাতে ও লিখতাম। এখন রাতে লিখতে পারি না।
হাজী সাহেব বললেন, রাতে লিখতে পার না কেন? রাতকানা রোগ হয়েছে। রাতে চোখে দেখ না?
খাওয়া দাওয়ার পর আলসেমি লাগে।
কর কী? আটটা বাজতেই ঘুমিয়ে পড়?
ঘুমাতে ঘুমাতে এগারোটা বেজে যায়। খবরের কাগজ পড়ি, টিভি দেখি।
টিভি কিনেছ না-কি?
জি। একটা চৌদ্দ ইঞ্চি টিভি কিনে ফেলেছি। কালার।
লার টিভি?
ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট কেনার ইচ্ছা ছিল। কুটু বলল, কিনবেন যখন কালার কিনেন। দেখলাম কুটুর কথার মধ্যে বিবেচনা আছে।
কুট কে?
কুটু আমার বাবুর্চি।
হাজী সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তোমার বাবুর্চি এখন বলে দিচ্ছে কী কিনবে কী কিনবে না?
আলাউদ্দিন মাথা নিচু করে বললেন, ওর বিবেচনা খারাপ না।
বেশি বিবেচনা হওয়াটা আবার ভালো না। শেষে দেখা যাবে তোমার বইপত্র সে লিখে দিচ্ছে। যাই হোক, সাত দিন সময়। এর মধ্যে বই শেষ করবে। আজ বুধার, আরেক বুধবারে পাণ্ডুলিপি নিয়ে চলে আসবে।
জি আচ্ছা, এখন উঠি।
হাজী সাহেব বললেন, তুমি এসেই যাই যাই করছ কেন? লক্ষ করেছি এর মধ্যে তিন চারবার ঘড়ি দেখেছ। চুপচাপ বস, দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে তারপর যাবে। মোরগপোলাও আনতে বলেছি। মোরগপোলাও খেয়ে তারপর যাবে। অসুবিধা আছে?
জ্বি না।
উসখুস করছ কেন? বারবার পকেটে হাত দিচ্ছ, পকেটে কী? পিস্তল নাকি? চাঁদাবাজরা পিস্তল নিয়ে যখন আসে বারবার পকেটে হাত দেয়। কী আছে পকেটে?
কিছু না।
কিছু একটা তো পকেটে নিশ্চয়ই আছে। বের কর দেখি জিনিসটা কী?
আলাউদ্দিন পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট এবং ম্যাচ বের করলেন। তাকে খুবই ব্ৰিত মনে হলো। হাজী সাহেব বললেন, তুমি সিগারেট খাও তা তো জানতাম না। আগেও খেতে, না সম্প্রতি ধরেছ?
এখন একটা দুটা খাই।
খাও ভালো কথা। এত লজ্জা পাচ্ছ কেন? ধরাও একটা সিগারেট। উসখুস করার কারণ এখন স্পষ্ট হলো। নেশাখোররা সময়মতো নেশা করতে না পারলে উসখুস করে। ধরাও একটা সিগারেট।
থাক।
থাকবে কেন, খাও। নেশার জিনিস সময়মতো না খেলে মেজাজ খারাপ হয়। আমি চাই না আমার সামনে মেজাজ খারাপ করে কেউ বসে থাকবে। দেখি আমাকে একটা সিগারেট দাও। তোমার সামনে ধরিয়ে তোমার লজ্জা ভেঙে দেই। আমি যে সিগারেট একেবারে খাই না তা না। তোমার ভাবির সঙ্গে ঝগড়া হলে। খাই।
হাজী সাহেব সিগারেট ধরালেন আলাউদ্দিনও ধরালেন, তবে তিনি খানিকটা সংকুচিত হয়ে রইলেন। কারণ তিনি একজন হাজী এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছেন— এই জন্যেই সংকোচ। তিনি বলেছেন একটা দুটা খাই। ঘটনা সে-রকম না। গত কয়েকদিন হলো প্রচুর সিগারেট খাচ্ছেন। বিশেষ করে রাতে খাওয়ার পর মুখে একটা পানি দিয়ে যখন টিভির সামনে বসেন তখন সিগারেট খেতে বড় ভালো লাগে। টিভি দেখার ব্যবস্থাটাও কুটু মিয়া খুব আরামদায়ক করেছে। টিভিটা বসিয়েছে লেখালেখির টেবিলে। তিনি এখন খাটে আধশোয়া অবস্থায় থেকে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন। টিভিতে বিশেষ কিছু যে দেখেন তা না। সিগারেট ধরিয়ে একটা চ্যানেল দেখতে থাকেন। সিগারেট শেষ হওয়া মাত্র অন্য একটা ধরিয়ে চ্যানেল বদলে দেন। ক্যাবল লাইন নেয়াতে এই সুবিধাটা হয়েছে। অনেকগুলি চ্যানেল।
আলাউদ্দিন?
জ্বি।
এখন আরেকটা জরুরি বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা আছে। মন দিয়ে শুনতে হবে।
জ্বি আচ্ছা।
তোমাকে আমি স্নেহ করি। এই ব্যাপারটা আশা করি তুমি জানো।
জ্বি জানি।
তুমি নির্বিরোধী মানুষ। অহঙ্কার নাই। ভদ্র, বিনয়ী। কখনো মিথ্যা বলো না। এই জন্যেই পছন্দ। আমি যে তোমার মঙ্গল চাই এ বিষয়ে কি তোমার কোনো সন্দেহ আছে?
জ্বি না।
হামিদা নামের আমার দূর সম্পর্কের একজন আত্মীয়া আছে। দুঃখি মেয়ে। প্রায় কুড়ি বছর আগে তার স্বামী মারা যায়। মেয়েটা পড়ে যায় অকুল সমুদ্রে। মেয়েটা রূপবতী। তাকে বিয়ে করানোর জন্যে আমরা চেষ্টা করেছি। সে রাজি হয় না। তার প্রতিজ্ঞা জীবনে বিবাহ করবে না। সে একটা চাকরি নিল। দুই মেয়েকে মানুষ করতে লাগল। যাকে বলে জীবন সংগ্রাম।
আলাউদ্দিনের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। তাঁর আরেকটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করছে। হাজী সাহেব কী মনে করবে এই ভেবে ধরাতে পারছেন না।
আলাউদ্দিন?
জ্বি।
এরকম উসখুস করছ কেন? যা বলছি মন দিয়ে শোন।
মন দিয়ে শুনছি হাজী সাহেব।
হামিদার মেয়ে দুটাই মায়ের মতো সুন্দরী হওয়ায় দুজনেরই খুব ভালো বিয়ে হয়েছে। দুটা মেয়েই এখন আছে বিদেশে। একজন থাকে স্বামীর সঙ্গে সিংগাপুর, আরেকজন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে।
আলাউদ্দিন বলেন, খুব ভালো।
হাজী সাহেব বললেন, যতটা ভালো মনে হচ্ছে তত ভালো না। হামিদা। পড়েছে মহাবিপদে। একা বাস করতে হয়, নিঃসঙ্গ জীবন। আজেবাজে দুষ্ট লোক তাকে নানানভাবে তাক্ত করে। বিয়ে করলে এই সমস্যা থেকে সে বাচবে। তাকে অনেক বুঝানোর পর এখন সে বিয়ে করার ব্যাপারে নিমরাজি হয়েছে। মেয়ে দুটি চাচ্ছে মা বিয়ে করে সুখী হোক। বাংলাদেশী মেয়ের বিধবা মায়ের বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী হয় না। এরা যে হয়েছে সেটা আল্লাহর রহমত বলতে হবে।
আলাউদ্দিন আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। হাজী সাহেব কিছু বললেন। বরং মুখ হাসি হাসি করে আলাউদ্দিনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলেন। নিচু গলায় বললেন— হামিদা বানুকে তুমি বিয়ে কর না কেন?
আলাউদিদন থতমত খেয়ে বললেন, আমি?
হ্যাঁ, তুমি। আমার ধারণা হামিদার পাত্র হিসেবে তুমি খুবই উপযুক্ত। মেয়েটা ভালো। তরুণী বয়সে সে অপূর্ব রূপবতী ছিল। সেই রূপের খানিকটা এখনো আছে। তাকে দেখে মনেই হয় না তার বয়স পঁয়তাল্লিশ। তুমি তার ছবি দেখেছ। সুন্দরী কি তুমিই বলো।
আমি ছবি কখন দেখলাম?
তোমার রান্নার বইয়ের ফ্ল্যাপে অধ্যাপিকা হামিদা বানুর ছবি আছে। এই হলো সেই হামিদা বানু।
উনি অধ্যাপিকা?
আরে না। বই চালাবার জন্যে লেখা। বিএ পড়ার সময় বিয়ে হয়ে গেল বলে আর পড়াশোনা হয় নি। এখন এজি অফিসে কাজ করে। জুনিয়ার অডিটর। মাসে সব মিলিয়ে ঝিলিয়ে ছয় সাত হাজার টাকার মতো বেতন পায়। তোমাদের দুজনের সংসার এই টাকায় চলে যাবার কথা। তোমার এই বিষয়ে মত কী?
আলাউদ্দিন ব্ৰিত গলায় বললেন, বিয়ের কথা কখনো ভাবি নি।
হাজী সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কখনো ভাব নি বলে যে কোনোদিন ভাববে না তা তো না; এখন ভাব।
এখন ভাবব?
তুমি এমন ভাব করছ যেন এই মুহূর্তেই তোমাকে বিয়ে করতে হবে। তুমি হ্যাঁ বলাবে আর আমি কাজী ডেকে নিয়ে আসব। চিন্তা-ভাবনা কর। সময় নাও। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলাপ করতে চাইলে আলাপ কর।
জি আচ্ছা।
তোমার বয়স কত?
এই নভেম্বরে ৫৩ হবে।
অনেক বয়স। বিয়ে করার বয়স না, কবরে চলে যাওয়ার বয়স। যাই হোক চিন্তা করে বলো।
জ্বি আচ্ছা।
মেয়েকে যদি দেখতে চাও, কথাবার্তা বলতে চাও, সেই ব্যবস্থাও করা যায়। একদিন বিকেলে বাসায় গিয়ে চা খেয়ে এলাম।
জি আচ্ছা।
কবে যাবে বলো?
আপনি যেদিন ঠিক করবেন সেদিনই যাব। আপনার বিবেচনা।
আমার বিবেচনা যদি হয় তাহলে আজই চল।
আলাউদ্দিন হতাশ গলায় বলল, আজ যাব?
হাজী সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কথা শুনে চিমশা মেরে গেলে কেন? আজ যাওয়াই তো ভালো। কোনো কিছু ঝুলিয়ে রেখে লাভ নাই। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে, বিকালে কোনো খবর না দিয়ে চলে গেলাম। হামিদাকে বললাম, হামিদা আমার এক লেখককে নিয়ে এসেছি। ভালো করে চা খাওয়া। অসুবিধা আছে?
জি না।
অসুবিধা থাকলে বলো। তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমি জোর করে তোময় বিয়ে দিচ্ছি। এখানে জোর করার কিছু নাই। হায়াত, মউত, রিজিক, ধনদৌলত এবং বিবাহ— এই পাঁচটা জিনি আল্লাহপাক নিজে দেখেন। আল্লাহপাক চাইলে বিবাহ হবে না।
জি, তা তো ঠিকই।
আলাউদ্দিন আরেকটা সিগারেট ধরালেন। তবে তাঁর মন খুবই খারাপ হয়ে গেল। বিবাহ সংক্রান্ত কথাবার্তায় যে মন খারাপ হয়েছে তা না। মন খারাপের প্রধান কারণ আজ দুপুরে মোরাগপোলাও খেতে হবে। হাজী সাহেব যে দোকান থেকে মোরগপোলাও আনান সেই দোকানের মোরণপোলাও অত্যন্ত ভালো। কিন্তু যত ভালোই হোক কুটু মিয়ার রান্নার পাশে কিছুই না। আজ দুপুরে কুটু মিয়া বিশেষ আয়োজন করেছে। ইলিশ মাছের ডিম রাধছে। ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল, ইলিশ মাছের ডিমের ভাজা। এই দুই জিনিস আগেও একদিন খেয়েছেন। মনে হয়েছে বেহেশতি কোনো খানা। আজ সেই দুই আইটেম আবার রাঁধতে বলে এসেছেন। কুটু এই দুটা তো রাধবেই, তার সঙ্গে বাড়তি এমন কোনো আইটেম করবে যে সম্পর্কে তিনি কোনো চিন্তাই করেন নি। কবে যেন পাতার একটা বাড়া খেয়েছেন— আহা কী জিনিস! বেসনে ভুবিয়ে গরম গরম ভেজে পাতে দিয়েছে। খাওয়ার সময় মনে হয়েছে বিশাল কোনো বটগাছের সব পাতা যদি এরকম বেসনে ভেজে দিয়ে দেয় তিনি খেয়ে ফেলতে পারবেন।
আলাউদ্দিন।
জ্বি।
তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে?
জ্বি না, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না।
তোমার মন না চাইলে থাকি যেতে হবে না। আমি আমার ভাগ্নিকে নিয়ে বিপদে পড়েছি তা কিন্তু না। হামিদার পত্র হিসাবে তোমাকে আমার পছন্দ। এটাই আমার আগ্রহের কারণ।
আমি আপনার সঙ্গে বিকালে যাব।
তোমার কথা শুনে ভালো লাগল। ভ্রামি নিশ্চিত আমার ভাগ্নির সঙ্গে কথা বলে তোমারও ভালো লাগবে। অতি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোমাদের দুইজনের মিলবেও ভালো। তোমার বুদ্ধি কিছু কম আছে। তোমার কম বুদ্ধি ঐ মেয়ে পুশিয়ে দিবে।
আলাউদ্দিন কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। হাজী সাহেব বললেন, তোমার বুদ্ধি কম বলেছি এতে রাগ কর নি তো?
জ্বি না।
তোমাকে অত্যধিক স্নেহ করি বলেই বলেছি। স্নেহ না করলে বলতাম না।
দুপুরে মোরগপালাও খুবই ভালো ছিল। আলাউদ্দিন তেমন মজা পেলেন না। তার মন পড়ে রইল ইলিশ মাছের ডিমে। দুপুরের খাওয়ার পর তিনি হাজী সাহেবের বই-এর দোকানে কিছুক্ষণ ঘুমালেন। বিকেলে গেলেন হাজী সাহেবের সঙ্গে তার ভাগ্নির বাসায় চা খেতে। এই ঘটনায় তিনি যে কোনো উত্তেজনা অনুভব করলেন তা না। দায়িত্ব পালনের মতো যাওয়া। একা একা বাস করে তিনি অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। বিয়ের মতো ঝামেলায় জড়ানো তার জন্যে বিরাট বোকামি হবে। জীবনে অনেক বোকামি তিনি করেছেন। হাজী সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে এই বোকামিটাও তিনি করে ফেলবেন বলে মনে হচ্ছে। তবে তা নিয়ে তিনি তেমন কোনো দুশ্চিন্তা বোধ করলেন না।
দরজা খুলে দিল হামিদা। সহজ দেশী বিদেশী ও চাইনিজ রান্নার বই-এর ম্যাপে যে মহিলার ছবি বাস্তবের মহিলা তার চেয়েও রুপবতী। দেখে মনে হচ্ছে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের মেয়ে। মহিলার দুটি মেয়ে আছে এবং দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে— এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। হাজী সাহেব বললেন, হামিদা কেমন আছিস রে মা?
হামিদা খুশি খুশি গলায় বলল, খুব ভালো আছি। মামা তুমি এতদিন পরে কী মনে করে?
তোর বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তোর এখানে এক কাপ চা! খেয়ে যাই। চায়ের পিপাসা হয়েছে।
তুমি আর দুই মিনিট পরে এলে আমাকে পেতে না। আমি বের হচ্ছিলাম, বেবিটেক্সি ডেকে এনেছি। বাসার সামনে বেবিটেক্সি দেখ নি?
যাচ্ছিস কোথায়?
ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে।
বেবিটেক্সি ফেরত পাঠিয়ে দে। আমি তোকে নামিয়ে দেব। আমি একজন লেখককে নিয়ে এসেছি। সহজ দেশী বিদেশী ও চাইনিজ রান্নার লেখক। প্রাইভেট কলেজে ইসলামিক ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। এখন হয়েছেন রান্নার বই-এর লেখক। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
হামিদা আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে দেখে আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছি। বই লিখেছেন আপনি, ছবি ছাপা হয়েছে অমির। মামা যে আমার ছবি নিয়ে এই কাজ করবেন আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমাকে ক্ষমা না করে আপনি যেতে পারবেন না।
আলাউদ্দিন কী বলবেন ভেবে পেলেন না। মেয়েটা এত সুন্দর করে কথা বলছে? এত সুন্দর করে বলল আমাকে ক্ষমা না করে আপনি যেতে পারবেন। না। সেই কথার উত্তরে তারও সুন্দর করে কিছু বলা উচিত। মুখে কোনো কথাই আসছে না।
হাজী সাহেব বললেন, ক্ষমা করার কিছু নাই। আলাউদ্দিন বই লেখে নাই। অন্যের বই থেকে কপি করেছে। আলাউদ্দিন যদি সত্যি সত্যি বই-এর লেখক হতো তাহলে ক্ষমা করার প্রশ্ন আসত।
আলাউদ্দিন আগ্রহ নিয়ে বসার ঘর দেখছেন। কী সুন্দর ছিমছাম। ঘরে অনেক আসবাবপত্র। তারপরেও কেমন যেন ফাকা ফাকা লাগছে। দেয়ালে অতি রূপবতী দুই তরুণীর ছবি। এরা যে হামিদা বানুর মেয়ে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অবিকল মায়ের মতো চেহারী।
মেয়ে দুটির ছবির উপরে একজন যুবকের ছবি। সানগ্লাস পুরা যুবক। সে বেলুন ফুলাচ্ছে। এই যুবকের সঙ্গে মেয়ে দুটির চেহারার মিল নেই। তারপরেও বলে দেয়া যায় এই যুবক মেয়ে দুটির বাবা।
হামিদা চা নিয়ে এসেছে। চায়ের ট্রে নামিয়ে রাখতে রাখতে সে লজ্জিত গলায় বলল, চায়ের সঙ্গে যে দেব এমন কিছু নেই। অন্যদিন বাসি চানাচুর হলেও থাকে আজ তাও নেই।
হাজী সাহেব বললেন, কিছু লাগবে না। হামিদা বলল, মামা তোমার লাগবে না। কিন্তু তুমি মেহমান নিয়ে এসেছ।
হাজী সাহেব বললেন, আলাউদ্দিন মোহমান না! সে বলতে গেলে ঘরের মানুষ। তোর মেয়েরা কেমন আছে?
চিঠিতে তো সব সময় লেখে খুব ভালো। তবে যতটু! ভালো আছে বলে লেখে ততটা ভালো আছে বলে মনে হয় না। অসুখ বিসুখ যখন হয় আমি দুশ্চিন্তা করব বলে আমাকে কখনো জানায় না।
হাজী সাহেব বললেন, এটাই তো ভালো।
হামিদা বলল, এটা ভালো না। আমি সব সময় সত্যিটা জানতে চাই। মিথ্যা ভালো সংবাদের চেয়ে সত্যি খারাপ সংবাদ অনেক ভালো।
হাজী সাহেব আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ঘটনা কী? বাড়িতে ঢোকার পর থেকে তুমি যে ঝিম ধরে বসে আছ। তোমার কিমা তো দেখি কাটছে না। কথা বলো।
আলাউদ্দিন ব্ৰিত গলায় বললেন, কী কথা বলব?
কিছু একটা বলো। কোনো কথাই যদি মনে না আসে হামিদাকে জিজ্ঞেস কর— আপনার দুই মেয়ের নাম কী?
আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার দুই মেয়ের নাম কী?
হামিদা হেসে ফেলল। তবে অতি দ্রুত হাসি থামিয়ে বলল, আমার এক মেয়ের নাম রু আরেক মেয়ের নাম নু। দুজনের মিলিত নাম রুনু।
আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ও আচ্ছা।
হামিদা বলল, মেয়েদের নাম এক অক্ষরের এটা শুনে আপনার অবাক লাগল?
আলাউদ্দিন বলল, সামান্য লেগেছে।
আপনার চেহারা দেখে সেটা বোঝা যায় নি। এক অক্ষরের নামের পেছনে সুন্দর। একটা গল্প আছে। গল্পটা বলি। এদের বাবার খুব শখ ছিল আমাদের প্রথম সন্তানটা মেয়ে হলে তার নাম হবে রুনু। মেয়ে হলো ঠিকই, জমজ মেয়ে হয়ে গেল। তার বাবা। রুনু নামটাকে ভেঙে একজনের নাম রাখল রু আরেকজনের নাম নু।
হাজী সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কই এই গল্প তো আমি জানি না!
হামিদ বলল, মামা তুমি আমার কোনো গল্পই জানো না। আমি শুধু যে দুঃখি মেয়ে তা-না, আমার জীবনের অনেক মজার মজার গল্প আছে।
হাজী সাহেব হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে বললেন, দশ মিনিটের জন্যে আমি একটু ঘুরে আসি।
আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। হাজী সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, তুমি যাচ্ছ কোথায়? তুমি বস, আমি দশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসি। আমার একজন লেখক থাকে ১২১ নম্বর বাসায়। তাকে একটা তাগাদা দিয়ে আসি।
অলাউদ্দিন বললেন, আমিও সঙ্গে আসি।
হাজী সাহেব বললেন, তোমাকে নিয়ে যাব না। এক লেখক আরেক লেখককে পছন্দ করে না। তুমি হামিদার সঙ্গে গল্প কর। আরেক কাপ চা খাও। চা শেষ হতে হতে আমি চলে আসব।
হাজী সাহেব হন্তদন্ত হয়ে বের হলেন। আলাউদ্দিক অস্বস্তি নিয়ে বসে আছেন। মেয়েদের সঙ্গে এমনিতেই তার কথা বলার অভ্যাস নেই। তার উপর যে মেয়েটি তার সামনে বসে আছে তার সঙ্গেই বিয়ের কথা হচ্ছে। ভালো ঝামেলায় পড়া গেল।
হামিদা বলল, আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন?
আলাউদ্দিন বললেন, জ্বি না। চা খাব না।
হামিদা বলল, মামা দশ মিনিটের মধ্যে আসবেন না। দেরি করবেন। আপনি ধরে রাখুন মামার ফিরতে আশ ন্টার মতো লাগবে। উনি আধ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন যাতে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। পাত্র হিসেবে উনি যে আপনাকে এখানে এনেছেন আমি বুঝতে পারি নি। হঠাৎ উনার মাথায় ঢুকেছে আমাকে বিয়ে দিতে হবে। আমি কিছুতেই তাকে বুঝাতে পারছি না যে আমি বিয়ে করব না। আপনি সত্যি করে বলুন তো মামা কি আপনাকে পাত্রী দেখার কথা বলে এখানে আনেন নি?
আলাউদ্দিন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। হামিদা বলল, কী লজ্জার কথা চিন্তা করুন। আমার এত বড় বড় মেয়ে। স্বামীর সঙ্গে ঘর সংসার করছে। এখন কিসের বিয়ে? বিয়ে যদি করতাম আগেই করতাম।
তা তো ঠিকই।
হামিদা বিরত্ত গলায় বলল, আগে বিয়ের কথা বললে চিৎকার চেঁচামেচি করতাম। এখন বিরক্ত হয়ে চুপ করে থাকি। এর থেকে আমার ধারণা হয়েছে আমি নিম রাজি। ছিঃ।
আলাউদ্দিন বললেন, আপনি আমার উপর রাগ করবেন না।
হামিদা বলল, আপনার উপর কেন রাগ করব! কেউ যদি ভুলিয়ে ভালিয়ে আপনাকে নিয়ে আসে আপনি কী করবেন?
আলাউদ্দিন বললেন, আমার খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। আমি বারান্দা। থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসি।
বারান্দায় সিগারেট খেতে হবে না। এখানেই খান।
সবচে ভালো হয় আমি যদি চলে যাই। আজ সারাদিন বাইরে কাটিয়েছি। শরীর ঘামে চট চট করছে।
মামা এসে যদি দেখেন আপনি নেই তাহলে আপনার উপর খুব রাগ করবেন। আপনি মামার রাগকে ভয় করেন না?
জ্বি করি।
তাহলে চুপচাপ বসে থাকুন। আমি আবার চা নিয়ে আসছি। চা খান। গল্প করে আধা ঘণ্টা সময় পার করে দিন।
আমি আসলে গল্প করতে পারি না।
আপনার জীবনের মজার কোনো ঘটনার কথা বলুন।
আলাউদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, আমার জীবনে আসলে মজার কোনো ঘটনা ঘটে নি।
কখনো ঘটে নি?
জ্বি না।
ঘটতেই হবে। আমার ধারণা আপনার জীবনে প্রচুর মজার ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না। যে পোকা মিষ্টি আমের ভেতর জন্মায় সে মিষ্টি রসের ব্যাপারটা ধরতে পারে না। সে মনে করে সে তার জীবনটা রসকষহীন অবস্থায় পার করে দিচ্ছে।
আলাউদ্দিন একটা সিগারেট ধরালেন। সিগারেট ধরাতে গিয়ে মনে হলো— রাতে হঠাৎ যে ভয় পেলেন সেই ঘটনা এই মহিলাকে কি বলা যায়। তার কাছে যে মনে হচ্ছিল কুটু তাঁর খাটের নিচে বসে আছে। তিনি কুটুর সঙ্গে কিছু কথাও বললেন। খাটের নিচের কাগজগুলি পাওয়া গেল ছেঁড়া। এই গল্প বলাটা কি ঠিক হবে? মনে হচ্ছে ঠিক হবে না।
হামিদা তাঁর দিকে ঝুঁকে এসে বলল, বলুন শুনি।
আলাউদ্দিন বললেন, কী বলব?
আপনার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আপনি একটা গল্প বলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আবার দ্বিধায় পড়ে গেছেন। গল্প বলাটা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছেন না। দ্বিধা দূর করে গল্পটা বলুন।
আলাউদ্দিন ব্ৰিত ভঙ্গিতে গল্প শুরু করলেন। হামিদা খুবই আগ্রহ নিয়ে গল্পটা শুনছে। এত আগ্রহ নিয়ে শোনার মতো কী গল্প? আলাউদ্দিন গল্প শেষ করলেন। হামিদা বলল, আপনি নিজে দেখলেন খাটের নিচের সব কাগজ ছেঁড়া?
জ্বি।
আপনার গল্পের খুব সহজ একটা ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যাটা দেই।
দিন।
যদিও আপনার জীবন কেটেছে একা একা তারপরেও আপনি খুব ভীতু টাইপ মানুষ। কারণ আপনি নিজেই বলেছেন আপনি অন্ধকার সহ্য করতে পারেন না। ঐ রাতে আপনি খুবই ভয় পেয়েছিলেন। অতিরিক্ত ভয় পেলে মানুষ মনগড়া জিনিস দেখে মনগড়া জিনিস কল্পনা করে। পুরোটাই আপনার কল্পনা।
আলাউদ্দিন বললেন, আমি যে দেখলাম আমার খাটের নিচের সব কাগজ ভেঁড়া।
আমার ধারণা আপনি কয়েকটা ছেঁড়া কাগজ দেখেছেন। আপনার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক সেই কয়েক টুকরা কাগজ দেখে ভেবেছে সব কাগজ ছেঁড়া। আপনি নিশ্চয়ই সকালে ভেঁড়া কাগজের টুকরা দেখেন নি। দেখেছেন?
জি না। কুটু ঘর ঝাট দিয়ে পরিষ্কার করে রাখে।
আপনার বাবুর্চি কুটু মানুষটা কেমন?
ভালো। খুব ভালো রান্না করে। এর রান্না একবার খেলে অন্য কোনো কিছু আপনি মুখে দিতে পারবেন না। আজ দুপুরে তার ইলিশ মাছের ডিম রান্না করার কথা।
হামিদা হাসতে হাসতে বলল, আপনি বলেছিলেন আপনি গল্প করতে পারেন। এতক্ষণ খুব সুন্দর গল্প করলেন। ত্রিশ মিনিট কিন্তু পার করে দিয়েছেন। মামাও চলে এসেছেন। তার পায়ের শব্দ পাচ্ছি। আপনি পাচ্ছেন না?
জি না।
আপনার কান তীক্ষ্ণ না। পায়ের শব্দ না পেলেও কলিং বেল বাজার শব্দ শুনবেন।
হামিদার কথা শেষ হবার আগেই কলিং বেল বাজল। হামিদা দরজা খুলে দিল। হাজী সাহেব ঘরে ঢুকলেন না। তাঁর নাকি অনেক দেরি হয়ে গেছে।
হামিদার বাসা থেকে বের হয়ে হাজী সাহেব নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আলাদ্দিন, আমার ভাগ্নিকে পছন্দ হয়েছে?
আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, জি।
তাহলে বিয়ের কথাবার্তা শুরু করি? কথাবার্তার অবশ্যি তেমন কিছু নেইও। হামিদার যদি তোমাকে পছন্দ হয় তাহলে আগামীকালও বিয়ে হতে পারে। তোমার কি আত্মীয়স্বজন কারো সঙ্গে কথা বলার দরকার আছে?
আলাউদ্দিন জবাব দিলেন না।
তোমার নিকট আত্মীয়স্বজন কে আছে?
আমার এক বোন আছে। ছোট বোন।
সে কোথায় থাকে?
কুষ্টিয়ার ভেড়ামাড়ায় থাকত। এখন বদলি হয়ে চিটাগাং গিয়েছে। চিটাগং এর ঠিকানা জানি না।
ঢাকা শহরে তোমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই?
আছে। তাদের ঠিকানা জানি না। যোগাযোগ নাই। এক ফুপু থাকেন যাত্রাবাড়িতে। তার বাসা চিনতাম। অনেক দিন যাওয়া হয় না। এখন চিনব কি না বুঝতে পারছি না।
যাই হোক তুমি সময় নাও। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ কর। আমিও হামিদাকে জিজ্ঞেস করে দেখি তার মতামত কী?
উনি বিবাহ করবেন না।
হামিদা বিয়ে করবে কি করবে না— সেটা তার বলার কথা। তুমি বলছ কেন? আগবাড়িয়ে কথা বলবে না।
জি আচ্ছা।
তোমার সঙ্গে তাহলে আগামী বুধবার আবার দেখা হবে।
জি।
লেখা শেষ করে নিয়ে আসবে।
জি আচ্ছা।
বলেই আলাউদ্দিন হাঁটা শুরু করলেন। যেন তাঁর বাড়ি ফেরার খুবই তাড়া। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না।
বাসায় ঢুকে আলাউদ্দিনের মন ভালো হয়ে গেল। তিনি স্বস্তি ও আনন্দের নিঃশ্বাস ফেললেন। এতক্ষণ বুকের উপর পাথর চেপে ছিল। এখন পাথরটা নেই। নিজেকে খুবই হালকা লাগছে। নিজের বাসায় ফিরে এত আনন্দ এর আগে তিনি পেয়েছেন বলে মনে পড়ল না।
কুটু মিয়া?
জ্বি স্যার।
গোসল করব। গরম পানি দাও। শরীর ঘামে ভর্তি। আজ গরম পানি দিয়ে সাবান দিয়ে হুলুস্থুল করব।
গরম পানি দেওয়া আছে স্যার।
বলো কী! তুমি দেখি অন্তর্যামী হয়ে যাচ্ছ। অন্তর্যামী কি জানো? যে মনের কথা বলতে পারে সে অন্তর্যামী। রাতের খাবার কী কুটু মিয়া?
রাতে মাংস করেছি স্যার।
ইলিশ মাছের ডিমের কী হলো?
ডিমও আছে।
গুড ভেরি গুড। হিলসা ফিস, এগ কারি।
আলাউদ্দিন বাথরুমে ঢুকলেন। বালতি ভর্তি গরম পানি। সাবান তোয়ালে সব সাজানো। বাথরুমের দরজার ওপাশ থেকে কুটু বলল, চা খাইবেন স্যার?
আলাউদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, গোসল করতে করতে চা খাব কীভাবে?
আপনি চা খাইবেন, আমি গায়ে সাবানের ডলা দিব।
আলাউদ্দিন ইতস্তত করতে লাগলেন। হ্যাঁ বলবেন না-কি না বলবেন মনস্থির করতে পারছেন না। কুটু মিয়া ঘরদুয়ার ঝকঝকে করে রাখে কিন্তু তাকে দেখে। নোংরা মনে হয়। মনে হয় দীর্ঘ দিন এই লোক গোসল করে নি। গা থেকে সব সময় বাসি তরকারির গন্ধের মতো গন্ধ আসে। আলাউদ্দিন বললেন, আন দেখি এক কাপ চা। আর ইয়ে, পিঠে সাবান ডলে দাও সারা শরীরে সাবান ডলার দরকার নেই।
চা মনে হয় তৈরিই ছিল। নিমেষের মধ্যে কুটু মিয়া চা এনে দিল। আলাউদ্দিন। একটা সিগারেট ধরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। কুটু মিয়া পিঠে সাবান ডলছে। গরম পানি ঢালছে। আলাউদ্দিনের কাছে মনে হচ্ছে তিনি এত আরাম তার সারা। জীবনে পান নি। আরামে বারবার তার চোখ বুজে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি ঘুমিয়ে পড়লেন। চা সিগারেট খেতে খেতে গোসলের এত আনন্দ কে জানত!
কুটু।
জ্বি স্যার।
দাও সারা শরীরেই সাবান মাখিয়ে দাও। যাহা বাহান্না তাহা তিপ্পান্ন।
জি আচ্ছা স্যার।
এত ভালো ম্যাসাজ শিখেছ কোথায়?
কোনো খানে শিখি নাই স্যার। পাইলট স্যারের শইল ম্যাসাজ করতাম।
উনিও কি চা সিগারেট খেতে খেতে গোসল করতেন?
জ্বি না। উনার বাড়িতে বাথটাব ছিল। বাথটাবে গরম পানি দিতাম। ফোম দিয়া ফেনা তুলতাম। উনি শুইয়া শুইয়া ব্লাডি মেরি খাইতেন আর আমি শইল টিপতাম।
ব্লাডিমরি কী জিনিস?
একটা মিকচার। খাইতে অতি সুস্বাদু।
তুমি বানাতে পার?
জ্বি পারি। পাইলট স্যারের কাছে শিখেছি।
বানাতে কী কী লাগে?
অনেক কিছু লাগে। তিন আংগুল ভদকার মধ্যে…
আলাউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, ভদকা মদ না?
কুটু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
থাক বলার দরকার নাই। আমি শিক্ষক মানুষ। মদ বিষয়ে কোনো কথা শোনাই আমার ঠিক না। আমার বাবা ছিলেন আমাদের অঞ্চলের জামে মসজিদের ইমাম। জীবনে কোনো ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেন নাই। আছর ওয়াক্তে তাঁর মৃত্যু হয়। আছরের নামাজও তাঁর কাজ হয় নাই। নামাজ শেষ করে বিছানায় শুয়েছেন, কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু।
কুটু মিয়া কথা বলছে না। নীরবে সাবান মাখিয়ে যাচ্ছে। গায়ে গরম পানি ঢালছে। শরীর ম্যাসাজ করছে। আলাউদ্দিন ভাবছেন এই আরামে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারলে মন্দ হতো না।
কুটু মিয়া।
জি স্যার।
তোমার পাইলট স্যার খুব মদ খেতেন?
চাকরি থেকে রিটায়ার করার পর খুব বেশি খাইতেন। একা মানুষ। কিছু করার নাই।
একা মানুষ কেন?
স্ত্রী মারা গেছিলেন। ছেলেমেয়েরা বড় হইয়া চইলা গেছে দেশে বিদেশে।
আমার মতো অবস্থা। সে ছিল নী আমি গরিব– বেশক এইটা, ঠিক না। প্রাইভেট কলেজের শিক্ষক ছিলাম। বেতনের কারবার নাই। ছাত্রই নাই বেতন কোত্থেকে আসবে। কলেজের বেশির ভাগ শিক্ষক এর তার বাড়িতে লজিং-এর মতো থাকত। নামেই কলেজের শিক্ষক। অসলে লবডঙ্কা। লবডঙ্কা মানে জানো?
জ্বি না।
মানে জানার দরকার নাই। শরীর টিপছ, শরীর টিপ।
জি আচ্ছা।
ব্লাডিমেরি জিনিসটা কীভাবে বানায় বলো তো শুনি। খাচ্ছি না যখন তখন তো আর দোষ হচ্ছে না। কীভাবে বানায় শুনে রাখি। তিন আঙুল ভদকা। তারপর কী?
ওয়েস্টার সস ছয় ফোঁটা, তাবাসসুম সাত ফোঁটা, গোল মরিচের গুঁড়া- লবণের চামচের আধা চামচ লেবুর রস চায়ের চামচে আধা চামচ, ট্রিপল সেক এক ফোঁটা। একটা কাচামরিচ মাঝখান দিয়া ছিইল্যা তার অর্ধেকটা। এইসব জিনিস এক সাখে মিশানোর পরে দিতে হইব টমেটো জুস। ডীপ ফ্রিজে রাখতে হইব দশ মিনিট। ডিপ ফ্রিজ থেইকা বাইর কইরা বরফের কুচি দিয়া খাইতে হইব।
বলো কী? এই জিনিস পাইলট সাহেব রোজ খেতেন?
জি। দিনে এই জিনিস, রাতে মার্গারিটা খাইতেন।
সেটা কী?
মার্গারিটা খাইতে খুবই সুস্বাদু।
যত সুস্বাদুই হোক আমি এর মধ্যে নেই। তাছাড়া তুমি যে সব জিনিসের কথা বললে বাংলাদেশে এইসব নিশ্চয়ই পাওয়া যায় না। ভদকা পাওয়া যায় রাশিয়াতে। রাশিয়া থেকে তোমার পাইলট সাহেবের পক্ষেই ভদকা আনা সম্বুল। আমার পক্ষে না।
কুটু গলা নামিয়ে বলল, ভদকা ঘরে আছে স্যার। ফ্রিজে এক বোতল আছে।
আলাউদ্দিন আঁতকে উঠে বললেন, ফ্রিজে ভদকা কোথেকে আসলো।
পাশের ফ্ল্যাটের সাইফুদ্দিন সাহেব রাইখা গেছেন। তার বন্ধুরা দেখলে খাইয়া ফেলবে এই জন্যে রাইখা গেছেন।
খবরদার তুমি ভদকা ফদকা দিয়ে কিছু বানাবে না। আমাদের পুরো পরিবার ইসলামিক লাইনের। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়কার কথা— এক রমজান মাসের শুক্রবার রোজা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম বলে জুম্মা নামাজের পরে সকল মুসুল্লীর সামনে আমাকে একশৰার কানে ধরে উঠবোস করতে হয়েছে। এই ছিল আমাদের পরিবার। মনে থাকবে?
জ্বি।
গরম পানি তো শেষ হয়ে গেছে। আরেক বালতি গরম পানি থাকলে ভালো হত।
এখন ঠাণ্ডা পানি ঢালব? এতে আরাম বেশি পাইবেন।
দাঁড়াও, আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নেই।
আলাউদ্দিন আরেকটা সিগারেট ধরালেন। কুটু তার মাথায় পানি ঢালছে। আরামে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
ঘরের বাতি নেভানো
ঘরের বাতি নেভানো। শুধু একটা ঘরেরই না, সব ঘরের বাতি নেভানো। আলাউদ্দিনের ঘরে টিভি চলছে। টিভি স্ক্রিনের নীলচে আলোয় তাঁর ঘরটা আলোকিত। বারান্দায় বাতি জ্বলছিল, কিছুক্ষণ আগে কুটু মিয়া সেই বাতিও নিভিয়ে দিয়েছে।
খাটের ওপর আলাউদ্দিন পা দুড়িয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। তার একটা পা। কোলবালিশে রাখা। দুটা কোলবালিশ কুটু মিয়া গত পরশু কিনে এনেছে। মাখনের মতো মোলায়েম কোলবালিশ। আলাউদ্দিন খুব আরাম পাচ্ছেন। নরম কোলবালিশে একটা পা উঠিয়ে দেয় যে এত আনন্দময় তা তিনি আগে বুঝতে পারেন নি। বুঝতে পারলে অনেক আগেই কোলবালিশ কিনতেন।
আলাউদ্দিনের হাতে টিভির রিমোট কনট্রোল। ক্যাবল লাইনে সতেরোটা চ্যানেল দেখা যায়। তিনি সতেরোটাই দেখেন। আগে প্রতিটি চ্যানেল বদলাবার আগে চার পাঁচ মিনিট দেখতেন। এখন কোনোটাই এক দেড় মিনিটের বেশি দেখেন না। কিছু বোঝার আগেই পর্দার দৃশ্য বদলে যায়। এই ব্যাপারটা তার খুবই ভালো লাগে। এই গান, এই খেলা, এই নাচ, এই খবর…
তার লেখার টেবিলটা এখন খাটের সঙ্গে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি প্রয়োজনীয় জিনিস টেৰিলে আছে। একবার টিভি দেখা শুরু করলে বিছানা থেকে নামার প্রয়োজন পড়ছে না। সিগারেটের প্যাকেট আছে, এঐে আছে, ম্যাচ আছে। তাঁর সর্দির ধাচ। একটু পর পর নাক ঝাড়তে হয়। সে জন্যে এক বাবা টিস্যু পেপার আছে। মাঝে মাঝে কান চুলকাতে তার খুবই আরাম লাগে। কান চুলকার এক বাক্স কটন বাড আছে। পানির বোতল আছে। গ্লাস আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই আয়োজনের জন্য কুটুকে কিছু বলতে হয় নি। সব মে নিজ থেকে করেছে। তাঁর আরামের দিকে কুটুর নজর দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। আগে তোষকের বিছানায় ঘুমাতেন, এখন ঘুমাচ্ছেন ফোমের বিছানায়।
অতিরিক্ত আরাম আয়াসের কারণ একটা ক্ষতি হচ্ছে লেখালেখি হচ্ছে না। হস্তরেখা বিজ্ঞান-এর শিররেখার চ্যাপ্টারটা এখনো শেষ হয় নি। বই শেষ করাটা খুবই জরুরি। রয়েলটির টাকাটা পাওয়া যাবে। একশ টাকা দামের বই যদি হয় সাড়ে বার পার্সেন্ট রয়েলটি হিসেব করলে খারাপ হয় না। তবে টাকা পয়সার সমস্যা নিয়ে আলাউদ্দিন এখন দুশ্চিন্তা করছেন না। হঠাৎ করে কিছু টাকা তার হাতে চলে এসেছে। এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকায় বসত বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। দেশের বাড়ি যাওয়া হয় না। মানুষ হয়েছে শহরবাসী। খামাখা বাড়ি পড়ে থাকবে। গরু-ছাগল চড়বে। দরকার কী!
একলা পঁচিশ হাজার টাকা আলাউদ্দিন ব্যাংকে জমা দেন নি। ঘরেই আছে। সুটকেসে তালাবন্ধ আছে। সুটকেসের চাবি আছে টেবিলের ড্রয়ারে। এটা নিয়ে। তিনি কোনো দুশ্চিন্তা বোধ করেন না। কারণ কুটু মিয়া টাকা পয়সার ব্যাপার অসম্ভব সৎ। তাছাড়া সারা দিন তো তিনি ঘরেই থাকেন। বেশির ভাগ সময় আধসোয়া হয়ে খাটের ওপরই থাকেন। এক ধরনের বিশ্রাম। এই বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। বিশ্রামের সময় টিভি দেখতে দেখতে নানান কথা চিন্তা করতে তার ভালো লাগে।
বেশির ভাগ সময় যে কল্পনাটা করেন তা হচ্ছে–হামিদা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। দুজনে বড় একটা খাটে আধাশোয়া হয়ে আছেন। দুজনের হাতেই টিভির রিমোট কন্ট্রোল। টিভি দেখতে দেখতে দুজনে গল্প করছেন। চ্যানেল বদলাচ্ছেন। কখনো তিনি বদলাচ্ছেন, কখনো বদলাচ্ছে হামিদ।
আলাউদ্দিন কিছুক্ষণের জন্যে টিভি বন্ধ করলেন। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কুটু মিয়া বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে দিল। টিভি বন্ধ হলে কোথাও না। কোথাও বাতি জ্বলে উঠবে। আলোর অভাব হবে না। আলাউদ্দিন মনে মনে বললেন, ভেরি হও। যতই দিন যাচ্ছে কট মিয়াকে তার ততই পছন্দ হচ্ছে। আলাউদ্দিন হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে পিরিচ দিয়ে ঢাকা গ্লাসটা নিলেন। গ্লাসে টমেটোর রস। গত কয়েক দিন হলো রাতের খাবারের আগে কুটু মিয়া দু গ্লাস টমেটোর রস বানিয়ে দিচ্ছে। টক টক, ঝাল ঝাল। অতি সুস্বাদু পানীয়। এর সঙ্গে সে ভদকা না না মিশাচ্ছে কি-না তিনি জানেন না। জানতে চাচ্ছেন না। যদি দুএক চামচ মিশিয়েও দেয় তাহলে দিল। তিনি তো আর বলেন নি কটু আমাকে ভদকা দিয়ে টমেটো সস দাও। তোমাদের পাইলট স্যার যে রকম খেলেন সে রকম। ব্লাড়িমরি না কী যেন নাম। কুটু যা করছে নিজ দায়িত্ব করছে। তাকেও ঠিক দোষ দেয়া যায় না। এইসব জিনিসই সে বানিয়ে অভ্যস্ত। আসল কথা হলো ক্রিনিসটা খেতে ভালো। দুটা গ্লাস খাওয়ার পর শরীরে চনমনে ভাব আসে। আবার একই সঙ্গে আলসেমিও লাগে।
আলাউদ্দিন হাতের গ্লাস শেষ করে টেবিলে রাখলেন। শব্দ করে যে রাখলেন তা না। স্বাভাবিকভাবেই রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা গ্লাস ভর্তি টমেটো জুস নিয়ে কুটু ঢুকল। খালি গ্লাসটা নিয়ে চলে গেল। আস্থা কুটু কি আড়াল থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে? তাকিয়ে না থাকলে তো বোঝা সম্ভব না– গ্লাস কখন খালি। হলো? কুটুর তো এটা করা ঠিক না। সে আড়াল থেকে তাকিয়ে থাকবে কেন? আলাউদ্দিন তাকে এই ব্যাপারটা কঠিন গলায় বুঝিয়ে দেবার জন্যে ডাকলেন। কুটু। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল। কুটুর গা থেকে মশলার গন্ধ আসদু। কিছু একটা ব্রাধছিল। নিশ্চয়ই। মশলার গন্ধেই তার ক্ষিধে লেগে গেল। কুটুকে কী জন্যে ডেকেছেন ভুলে গিয়ে বললেন, আজকের রান্না কী কুটু।
কৈ মাছের ঝোল।
আলাউদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, শুধু কৈ মাছের ঝোল?
সাথে একটা মুরগি রাঁধছি।
মুরগির ঝোল?
জ্বি না, একধরনের ফ্রাই। পাইলট স্যারের খুব পছন্দের রান্না ছিল। সপ্তাহে তিন চার দিন খাইতেন। দুইটা মুরগি তিনি একা খাইতেন।
বলো কী?
ঠিক মতো রান্না হইলে দুইটা মুরগি খাওয়া কোনো ব্যাপার না স্যার। আপনিও পারবেন।
আমি কীভাবে পারব? আমি কি বক রাক্ষস নাকি? মুরগি কটা বেঁধেছ?
দুইটা।
সর্বনাশ! তুমি তো আমাকে ফতুর বানিয়ে ছাড়বে। দিনে দুটা মুরগি মানে মাসে ষাটটা মুরগি। বৎসরে সাতশ বিশটা মুরগি। যাই হোক, জিনিসটার প্রিপারেশন কী?
কুটু মাথা নিচু করে বলল, এইটা বলা নিষেধ।
নিষেধ মানে? কার নিষেধ?
কুটু চুপ করে রইল। আলাউদ্দিন উদার গলায় বললেন, থাক বলতে হবে না। জেনেই আমি কী করব? আমি তো আর রাধতে বসব না। শোন কুটু, আমি শ্রোমার কাজকর্মে সন্তুষ্ট।
শুকরিয়া।
শুধু সন্তুষ্ট না। খুবই সন্তুষ্ট। বাঙালির সমস্যা হলো তার প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। একটু প্রশংসা করলেই তার লাফ দিয়ে মাথায় উঠে যায়। এই জন্যে প্রশংসা করা বাদ দিয়েছি।
কুটু কিছু বলছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আলাউদ্দিন হড়বড় করে কথা বলেই যাচ্ছেন। কথা বলতে তার খুবই ভালো লাগছে। ব্লাডিমেরি নামের জিনিসটার গুণ বা দোষ হলো এটা খেলেই কথা বলতে ইচ্ছে করে। পেটের ভেতর যত কথা আছে সব বুলবুলের মতো পেট থেকে বের হতে শুরু করে।
কুটু!
জ্বি স্যার।
আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট।
একবার বলেছেন সার।
একবার বলেছি তো কী হয়েছে? আরেকবার বলব। দরকার হলে আরো দশবার বলব। আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট। আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট। আমি তোমার কাজে কর্মে সন্তুষ্ট…
আলাউদ্দিন আঙুল গুণে গুণে দশবার বললেন। তার হাতের ব্লাডিমেরির গ্লাস শেষ হয়েছে। তিনি গ্লাস নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন তোমার বানানো এই টমেটোর রস আমার পছন্দ হয়েছে। টমেটোর রসে তুমি কী দিয়েছ না দিয়েছে জানতে চাচ্ছি না। হয়তো ভদকা দিয়েছ ৷ দিয়ে থাকলে খুবই অন্যায় করেছ। আমি তোমাকে বলেছিলাম মদ ফাদ আমি খাই না। আমি শিক্ষক মানুষ। ভদ্রঘরে সন্তান। আমার পিতা ছিলেন বিশিষ্ট আলেম। মৃত্যুর দিনও তার নামাজ কাজা হয়। নাই। বুঝতে পারছ?
জি স্যরি।
তবে টমেটোর রস অতি সুখাদ্য। দুগ্লাস খাওয়ার পর মনে হয় আরো দুগ্লাস খাই। তোমার পাইলট সার কয় গ্লাস খেত?
উনার জন্যে জগ ভর্তি বানায়ে রাখতাম। কোনো কোনো দিন পুরা জগ শেষ করতেন। কোনো কোনো দিন জগ থেইকা ঢাইলা সামান্য খাইতেন।
আমার জন্যেও তাই করবে। যতটুক খাই খাব। ইচ্ছা হলে খাব। ইচ্ছা হলে খব না।
জি আচ্ছা।
খানা কি তৈরি হয়েছে?
জি।
তাহলে খানা দাও।
যদি চান আরেক গ্লাস ব্লাডিমোরি বানায়ে দেই। রাত দশটা এখনো বাজে নাই। এখনই খানা খাইয়া ফেলবেন?
সেটাও একটা কথা। এখনই খানা খেয়ে ফেলা ঠিক না। পারে আবার ক্ষিধা লাগতে পারে। দাও তোমার ঐ জিনিস আরেক গ্রাম।
আপনার একটা চিঠি ছিল স্যার। চিঠিটা দিব? চিঠি কখন এসেছে?
সন্ধ্যাবেলায় আসছে। আপনি আরাম কইরা টিভি দেখতেছিলেন এই জন্যে তখন দেই নাই। এখন টিভি দেখছেন না এই জন্যে চিঠির কথা তুললাম।
ভালো বিবেচনা দেখিয়েছ। এই যে বললাম তোমার বিবেচনায় আমি সন্তুষ্ট। চিঠি নিয়ে আস। চিঠি আর জুস একসঙ্গে দাও। জুস খেতে খেতে চিঠি পড়ব। তার মজা অন্যরকম। চিঠি আবার আমাকে কে লিখবে! আমাকে চিঠি লেখার লোক নাই। এটা একদিক দিয়ে ভালো। ঝামেলা নাই। ঠিক না?
জ্বি ঠিক।
দাঁড়িয়ে আছ কেন? চিঠি আর জুস নিয়ে আস।
চিঠি লিখেছেন হাজী একরামুল্লাহ। তিনি লিখেছেন–
আলাউদ্দিন
দোয়াবরেষু,
বুধবারে তোমার হস্তরেখার পুস্তকটির পাণ্ডুলিপি আমাকে পৌছাইয়া দেওয়ার কথা। বুধবার চলিয়া গিয়াছে, আজ শনিবার। তোমার কোনোই সংবাদ নাই। এমন ঘটনা পূর্বে কখনো ঘটে নাই। আশা করি তোমার কোনো অসুখ বিসুখ হয় নাই। অসুখ হউক বা যাই হউক একটি সংবাদ তুমি দিতে পারিতে। নিজে আসিতে না পারিলে ও টেলিফোনের মাধ্যমে সংবাদটি দেওয়া যাইত। আমার বাসা এবং দোকানের টেলিফোন নাম্বার তোমার কাছে আছে। সম্প্রতি আমার মোবাইল নাম্বার ও তোমাকে দিয়াছি। তোমার নীরবতার আমি। কোনোই অর্থ বুঝিতে পারিতেছি না।
আমার মনে একটি ক্ষীণ সন্দেহ দেখা দিয়াছে। সন্দেহের ব্যাপারটি খোলাখুলি তোমাকে বলি। কোনোরকম অস্পষ্টতা থাক আমি কাঞ্ছনীয় মনে করি না। আমার সন্দেহ হামিলা বানুকে বিবাহের ব্যাপারে তোমার মত নাই। যেহেতু প্রস্তাব আমি দিয়াছি; চক্ষুলজ্জায় বিবাহ মত নাই— এই কথা বলিতে পারিতেছ না। এই সমস্যায় পড়িয়া তুমি আমার নিকট আসা বন্ধ করিয়াছ।
দীর্ঘদিন একা থাকিয়া থাকিয়া তোমার অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। এই বয়সে বিবাহিত জীবনের কল্পনা মনে ভীতির সঞ্চার করে। ইহাই স্বাভাবিক। তুমি ইহা নিয়া কেন সংকোচ বোধ করিতেছ? মনের দিক হইতে সাড়া না পাইলে অবশ্যই তুমি বিবাহ করিবে না।
পত্র পাঠ করিবা মাত্র বাংলাবাজারে চলিয়া আসি। হস্তরেখা বিজ্ঞানের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হইলে সঙ্গে নিয় আসি। পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ না হইলে ও যাহা হইয়াছে নিয়া আসিবা। আমি কম্পােজ ধল্লাইয়া দিব। খোজ নিয়া জানিয়াছি ইদানীং ক্রিকেট খেলার উপর লেখা বই ভালো চলিতেছে। ক্রিকেটের উপর একটি দশ ফর্মার বই অতি দ্রুত তোমাকে দিয়া লেখাইতে চাই। ক্রিকেট বিষয়ে লেখার জন্য প্রয়োজনীয় বইপত্র সংগ্রহ করার জন্যে তোমার বাংলাবাজার আসা প্রয়োত্তান।
আজ এই পর্যন্তই।
দোয়া গো, হাজী একরামুল্লাহ
পুনশ্চ : রয়েলটি বাবদ প্রাপ্ত এগারো হাজার পঁচিশ টাকা দোকানের ক্যাশিয়ার মালেক মিয়ার কাছে দেওয়া আছে।
টাকাটা সংগ্রহ করিও। চিঠি পড়ে আলাউদ্দিন স্বস্তি পেলেন। এমনিতেই তার মন আনন্দে ছিল। সেই আনন্দ অনেক বাড়ল। নিজেকে মহাসুখী মানুষদের একজন মনে হতে লাগল। টমেটো জুসটা খেতে এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি ভালো লাগছে। এই গ্রাস শেষ করার পরও তা হবে বলে মনে হচ্ছে না। পাইলট সাহেবের মতো ব্যবস্থা করতে হবে। জগ ভর্তি জুস থাকবে। নিজের ইচ্ছামতো যাবেন। কিছুক্ষণ পরপর কুটু মিয়াকে ডাকতে হবে না। কুটু মিয়ার জন্যেও ভালো। একবারে বানিয়ে রেখে দেয়া। বারবার বানাতে হবে না।
আলাউদ্দিন রিমোট কন্ট্রোলে টিভি ছাড়তে যাবেন— কুটু মিয়া ঘরে ঢুকল, বিড়বিড় করে বলল, স্যার আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে আসছে।
এত রাতে কে ভাসলো?
পাশের ফ্লাটের সাইফুল্লাহ সাহেব।
নিয়ে এসো। এখানে নিয়ে এসো।
এইখানে আনার দরকার নাই।
ঠিক বলে। এখানে মানার দরকার নাই। খাচ্ছি টমেটো জুস, হয়তো ভাববে অন্যকিছু খাচ্ছি। শুধু যে মনে করলে তা না মারো দশজনকে গিয়ে বলবে। বাঙালির স্বভাবই এই রকম। স্বভাবের কারণে বাঙালি কিছু করতে পারল না। কাজ করার সময়ই বাঙালির নাই। সারাক্ষণ এর কথা তার কাছে লাগাচ্ছে, কাজ করার সময় কোথায়? ঠিক বলছি না?
জ্বি স্যার ঠিক বলছেন। উনি বসার ঘরে বইসা আছেন।
কে বসার ঘরে বসে আছে?
সাইফুল্লাহ সাহেব।
সাইফুল্লাহ সাহেব বসার ঘরে বসে আছেন কেন?
আপনাকে একটু আগে বলছি।
একটু আগে কী বলেছ আমি ভুলে গেছি।
সাইফুল্লাহ সাহেব আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। কী কথা জানি বলবেন।
আলাউদ্দিন নিতান্ত অনিচ্ছায় বিছানা থেকে নামলেন। একবার বিছানায় উঠে পড়লে আর নামতে ইচ্ছে করে না। সাইফুল্লাহ না এলেও বিছানা থেকে নামতে হতো। প্রস্রাবের বেগ হয়েছে। কষ্ট করে চেপে রেখেছেন। এখন মনে হয় তলপেট ফেটে যাচ্ছে। বিছানাতেই বাথরুম করা যাচ্ছে এমন ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো।
সাইফুল্লাহ আলাউদ্দিনকে দেখে অবাক হয়ে বলল, ভাই আপনার শরীর খারাপ?
আলাউদ্দিন বললেন, না তো।
দেখে মনে হচ্ছে শরীরে পানি এসেছে। হাত-পা ফুলে গেছে।
আলাউদ্দিন কিছু বললেন না। সাইফুল্লাহ তাড়াতাড়ি বিদেয় হলে তিনি বাঁচেন। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে পারেন। টমেটো জুসের গ্লাসটায় এখনো অর্ধেকের মতো আছে। গ্লাসটা শেষ করা দরকার।
সাইফুল্লাহ গলা নামিয়ে বলল, আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছিলাম।
বলুন।
কথা আসলে একটা না, দুটা। কোনটা আগে বলব বুঝতে পারছি না।
যে কথাটা শুনতে ভালো লাগবে সেটা আগে বলুন।
দুটা কথাই শুনতে খারাপ লাগবে।
আলাউদ্দিন বসলেন। কাঠের চেয়ারে বসে তিনি আরাম পাচ্ছেন না। বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় থেকে থেকে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। শুয়ে না পড়া পর্যন্ত ভালো লাগে না। সাইফুল্লাহ কথাগুলি তাড়াতাড়ি শেষ করলে তিনি নিজের জায়গায় চলে যেতে পারেন। কোলবালিশে পা রেখে শুয়ে পড়তে পারেন।
প্রফেসর সাহেব, কাটা হচ্ছে আমি আপনার ফ্রিজে দুই বোতল ভদকা রেখেছিলাম। আমার বন্ধুর জিনিস। সে রাখতে দিয়েছিল। গত সপ্তাহে বোতল দুটা ফেরত নিয়েছি কিন্তু ভিতরে জিনিস নাই— পানি।
আপনার কথা বুঝলাম না।
দুটা বোতলের ভদকা সরিয়ে নিয়ে পানি ভরে রেখেছে।
কে সরিয়ে রেখেছে?
কে সরাবে আপনার কাজের ছেলে কুটু না ঘুটু কী যেন নাম।
সে ভদকা কী করেছে?
খেয়ে ফেলেছে। কিংবা বিক্রি করে দিয়েছে।
বলেন কী?
আমি তাকে ইনটারোগেট করেছি। কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না। এমনভাবে তাকায় যেন আমার কোনো প্রশ্নই বুঝতে পারছে না। এই চিড়িয়া জোগাড় করেছেন কোত্থেকে?
আলাউদ্দিন জবাব দিলেন না। সাইফুল্লাহ বলল, যত তাড়াতাড়ি পাবেন একে বিদায় করেন। যে ভদকার বোতলের ভদকা সরিয়ে পানি ভরে রাখতে পারে সে ছোটখাট চোর না। বড় চোর।
চিন্তার বিষয়।
অবশ্যই চিন্তার বিষয়। আপনি একা থাকেন, কখন আপনাকে কী করবে আপনি বুঝতে পারবেন না। দুপুরে ঘুমিয়ে আছেন, পেটে ছুরি মেরে টাকা পয়সা নিয়ে চলে গেল।
আলাউদ্দিন হাই তুলতে তুলতে বললেন, দ্বিতীয় খারাপ কথাটা কী?
সাইফুল্লাহ গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, আপনাকে তো ফ্ল্যাট সাবলেট দিয়েছিলাম। পুরো ফ্ল্যাটটাই এখন আমার দরকার। বাবা অসুস্থ। ঢাকায় থেকে চিকিৎসা করাবেন।
ফ্ল্যাট করে ছাড়তে হবে?
যত তাড়াতাড়ি পারেন এত ভালো। বাবাকে আমার ইমিডিয়েটলি ঢাকায় আনা দরকার।
উনার কী হয়েছে?
ওল্ড এজ ডিজিজ। স্পেসিফিক কিছু না। সর্দি, কাশি, বুকে ব্যথা।
আলাউদ্দিন হাই তুলতে তুলতে বললেন, আচ্ছা। এখন তার ঘনঘন হাই উঠছে। মনে হচ্ছে চেয়ারে বসা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়বেন।
কবে নাগাদ ছাড়তে পারবেন?
দেখি, যত তাড়াতাড়ি পারি।
এক সপ্তাহের মধ্যে পারলে আমার খুব উপকার হয়।
আলাউদ্দিন মুম ঘুম চোখে বললেন, আচ্ছা। কিছু ভেবে যে বললেন তা না। তিনি চাচ্ছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাইফুল্লাহকে বিদায় করতে।
সাইফুল্লাহ বলল, ঢাকা শহরে ভাড়া বাড়ির এখন আর ক্রাইসিস নাই। এত ফ্লাট হয়েছে। মানুষের চেয়ে ফ্ল্যাট বেশি। যেখানে যাবেন টু লেট। প্রফেসর সাহেব একটু চেষ্টা নেন, যেন সাতদিনের মধ্যে বাড়িটা খালি করতে পারেন। খুব উপকার হয়।
আলাউদ্দিন আবারো হাই তুলতে তুলতে বললেন, আচ্ছা।
দুটি মুরগির বিশেষ ভাজার পুরোটাই আলাউদ্দিন খেয়ে ফেললেন। শেষ টুকরাটা মুখে দিয়ে বললেন, খেতে খারাপ না। এরচে ভালো ভালো কথা বলা উচিত ছিল, কিন্তু আলাউদ্দিনের মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। শরীর দুলছে। এখন ভালো ভালো কথা বলার সময় না। তাছাড়া বাঙালিকে বেশি প্রশংসা করতে নেই। প্রশংসা করলেই বাঙালি এক লাফে আকাশে উঠে যায়। আকাশে উঠে গেলেও ক্ষতি ছিল না— আকাশ থেকে থুথু ফেলা শুরু করে। সেই থুথু এসে গায়ে পড়ে। এই জন্যেই বাঙালিকে মাঝে মাঝে কঠিন কঠিন কথা বলে সাইজ করতে হয়। আলাউদ্দিন ঠিক করলেন কুটু মিয়ার মুরগির ভাজা যত ভালোই হোক তাকে আজ সাইজ করতে হবে। ঘুমুতে যাবার আগে তাকে ডেকে পাঠাবেন এবং ইচ্ছামতো সাইজ করে দেবেন। সাইজ করার মতো কর্মকাণ্ড সে করছে। তিনি দেখেও নাদেখার ভান করছেন।
এই যেমন আরেক ভদ্রলোকের বোতলের জিনিস উধাও। বোতল আছে, জিনিস নাই। পানি ভরে দিয়ে দিয়েছে। অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে। এর শাস্তি দিতেই হবে।
তারপর আছে অন্ধকারে তার রান্না করার বিষয়টা। তিনি অনেক দিন থেকেই লক্ষ করছেন রাতেরবেলায় রান্নার সময় ঘরের সব আলো নেভানো থাকে। চুলার আগুনের শিখায় কিছুটা ভালো হয়। কটু হয়তো সেই আলোতেই দেখতে পায়। অনেকের দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে। কুটু হয়তো সেই অনেকের মধ্যে একজন। তবুও অন্ধকারে রান্না করা ঠিক না। পাতিলের ভেতর কোনো পোকামাকড় উড়ে পড়বে। কুটু সেটা দেখতে পাবে না। চিকেন ফ্রাই-এর পাশাপাশি মিডিয়াম সাইজ একটা মাকড়সাও ফ্রাই হয়ে পড়ে থাকল। তিনি পিয়াহ মনে করে খেয়ে ফেলবেন। কে জানে হয়তো এর মধ্যে খেয়েছেনও। এটা তো হতে দেয়া যায় না। কুটুকে এই বিষয়ে ধরতে হবে। কঠিন ধরা ধরতে হবে। আজ কুটুর ক্ষমা নেই। আজ কুটুকে সাইজ করা হবে। আজ হলো মহান সাইজ দিবস।
আলাউদ্দিন বিছানায় শুয়ে পড়েছেন। তার মুখে জর্দা দেয়া মিষ্টি পান। জর্দার পরিমাণ বেশি হয়েছে। একেকবার পানের রস গিলছেন আর মাথা কেমন চুকুর দিয়ে উঠছে। এই চক্করটা ভালো লাগছে। খুবই আরামের চক্কর। আলাউদ্দিনের আঙুলের ফাকে সিগারেট। কুটু লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিল। আলাউদ্দিন সিগারেটে টান দিয়ে বললেন, কুটু তোমাকে আজ কিছু কথা বলব।
কুটু বলল, জি আচ্ছা।
আলাউদ্দিন বললেন, কথাগুলি কঠিন। শুনে তুমি হয়তো মনে কষ্ট পাবে। কষ্ট পেলেও আমার কিছু করার নেই।
কুটু বলল, জি আচ্ছা।
আলাউদ্দিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে কথা বলার জন্যে প্রস্তুত হলেন। কী বলবেন মনে পড়ছে না। মাথা একেবারেই ফাকা হয়ে আছে। যে সব কথা বলবেন বলে ঠিক করেছিলেন সে সব কথা পয়েন্ট আকারে একটা কাগজে লিখে রাখা দরকার ছিল। বিরাট ভুল হয়েছে।
কুটু!
জ্বি স্যার।
তোমার অনেক জিনিস আছে যা আমার অপছন্দ। এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলব। তুমি যদি নিজেকে বদলাতে পার তাহলে তুমি থাকবে, বদলাতে না পারলে চলে যাবে। ভাত ফেললে কাকের অভাব হয় না। বেতন ফেললে বাবুর্চি পাওয়া যায়। বুঝতে পারছ?
জি।
আলাউদ্দিন অনেক চেষ্টা করলেন, কুটুকে সাইজ করার মতো কোনো কথাই মনে পড়ল না। তিনি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন— কুটু ঠিক আছে তুমি যাও। কথাবার্তা আজকের মতো মুলতবি। ঘুমের আগে আগে কঠিন কথাবার্তা না হওয়া ভালো। এতে সুনিদ্রার ব্যাঘাত হয়। একটা কাজ কর— আমাকে জর্দা দিয়ে আরেকটা পান দাও। জর্দা বেশি করে দিবে।
জি আচ্ছা।
আর টিভিটা চালু করে দাও। সাউন্ড দিও না। শুধু ছবি। টিভি দেখতে দেখতে ঘুমাব।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি মনে করো না যে তুমি ছাড়া পেয়ে গেলে। মামলা ডিসমিস হয়ে গেল। আসলে সাময়িক বিরতি। আদালত আবার বসবে। আমি নিজেই বাদি, আমিই বিচারক। তোমার খবর আছে কুটু মিয়া।
জর্দা ভর্তি পান মুখে নিয়ে আলাউদ্দিন ঘুমিয়ে পড়লেন। টিভি চলতে থাকল।
এক সময় আলাউদ্দিনের ঘুম ভাঙল। কোনো কারণ ছাড়াই তার বুক ধ্বক করে। উঠল। এই ঘরে কিছু একটা হয়েছে। ঘরটা বদলে গেছে। কোনো কিছুই মনে হচ্ছে আগের মতো নেই। ঘর ভর্তি ধোয়া। এত ধোয়া কোত্থেকে এলো। কোথাও কি আগুন লেগেছে! খড় পোড়ার গন্ধ ও নাকে আসছে। নাক জ্বালা করছে। খাটের নিচ থেকে গোঙানির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। হাঁটাহাঁটি হচ্ছে। মাঝে মাঝে ক্ষীণ গলায় কেউ একজন বলছে— বাঁচান, আমারে বাঁচান। সে কথা শেষ করতে পারছে না। তার আগেই কেউ একন তার মুখ চেপে ধরছে। আবারো হুটোপুটি হচ্ছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ।
আলাউদ্দিন টিভির দিকে তাকালেন। টিভি খোলা আছে। নাটকের মতো কী যেন হচ্ছে। মারামারির দৃশ্য। ঘটনা কি এ রকম যে টিভিতে মারামারি হচ্ছে, কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে শব্দটা আসছে খাটের নিচ থেকে। এটাই তো যুক্তিসঙ্গত কথা। কিন্তু ঘরে এত ধোয়া কেন? আলাউদ্দিন ক্ষীণ স্বরে ডাকলেন, কুটু মিয়া!
খাটের নিচ থেকে কেউ একজন ভারী শ্লেষ্মা জড়িত গলায় বলল, জি স্যার।
গলাটা কার? কুটু মিয়ার গলা? সে খাটের নিচে কী করছে? কাকে সে চেপে ধরেছে। আলাউদ্দিন আবারো কাপা কাঁপা গলায় বললেন— কুটু মিয়া?
জ্বি।
খাটের নিচে কী করছ?
কুটু জবাব দিল না। খাটের নিচের হুটোপুটি অনেক বাড়ল। এখন গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। আলাউদ্দিন বললেন, কী হচ্ছে ওখানে?
কুটু চাপা গলায় বলল, বালিশ দেন। স্যার, তাড়াতাড়ি একটা বালিশ দেন।
কী দিব?
বালিশ।
বালিশ দিয়ে কী হবে? হারামজাদার মুখের উপর বালিশ চাইপা ধরব।
কার মুখের উপর বালিশ চেপে ধরবে?
কটু জবাব দিল না। আলাউদ্দিন হতভম্ব হয়ে দেখলেন খাটের নিচ থেকে একটা হাত বের হয়ে আসছে। ময়লা নোংৱা হাত। বড় বড় নখ। পাখির নখের মতো বেঁকে গেছে। হাতটা কেন আসছে? তাকে ধরার জন্যে? আলাউদ্দিন ভয়ে শিটিয়ে গেলেন।
বালিশ দেন।
আলাউদ্দিন একটা বালিশ কুটুর হাতের দিকে এগিয়ে দিলেন। খাটের নিচ থেকে আঁ আঁ শব্দ হচ্ছে। বালিশে চাপা দিয়ে কাউকে কি মারা হচ্ছে? কোনো একটা সূরা পড়া উচিত। কোনো সূরা মনে আসছে না। তিনি কি দুঃস্বপ্ন দেখছেন? হ্যাঁ এটাই হবে। দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছু না। স্বপ্নটা ভেঙে গেলেই দেখবেন সব স্বাভাবিক আছে। তখন তিনি কুটুকে ডেকে চা দিতে বলবেন। চা খাওয়ার আগে গোসল করা দরকার। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। স্বপ্নটা কখন ভাবে? চিৎকার করে কুটকে ডাকলে কি ঘুম ভাঙলে? আলাউদ্দিন ফুসফুস ফাটিয়ে চিক্কার করলেন— কুটু! কুটু! গলা দিয়ে ফ্যাস ফ্যাস জাতীয় আওয়াজ হলো। এই স্বপ্ন মনে হয় ভাবে না। স্বপ্ন চলতেই থাকবে। মেয়েলি গলায় কে যেন কাঁদছে। দেয়ালে শব্দ হচ্ছে। সাইফুল্লাহলের বাড়িতে কি? না-কি এটা স্বপ্ন। আলাউদ্দিন ক্লান্ত হতভম্ব গলায় ডাকলেন, কুটু।
তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বসার ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। থপথপ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কুটু আসছে।
কুটু! কুটু তুমি কোথায়?
দরজা ঠেলে কুটু ঢুকল।
আলাউদ্দিন ধরা গলায় বললেন, বাতি জ্বালাও।
কুটু বাতি জ্বালাল। আলাউদ্দিন বললেন, দুঃস্বপ্ন দেখেছি।
কুটু বলল, চা খাইবেন স্যার?
আলাউদ্দিন বলেন, চা খাব।
চা আনতেছি।
আলাউদ্দিন বললেন, তুমি কি কোনো চিৎকার, হুটোপুটির শব্দ শুনেছ?
কুটু বলল, জ্বি না।
আলাউদ্দিন বললেন, শোনার কথাও না। স্বপ্ন দেখছি আমি। তুমি কেন শব্দ শুনবে! কুৎসিত স্বপ্ন। ধোয়া, চিৎকার, বালিশ দিয়ে মুখ চাপাচাপি।
চা নিয়া আসি স্যার।
যাও নিয়ে আস। চা আনার আগে একটা কাজ কর— আমার বালিশটা নিচে পড়ে গেছে। ধাক্কা খেয়ে খাটের নিচে চলে গেছে। বালিশটা দাও।
কুটু খাটের সামনে উপুড় হয়ে বসে বালিশটা এনে আলাউদ্দিনের হাতে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। আলাউদ্দিন বালিশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বালিশের এক পিঠে ছোপছোপ রক্ত লেগে আছে। টাটকা রক্ত, এখনো শুকিয়ে কালচে হয় নি।
আয়াতুল কুরশি সূন্নাটা মনে পড়েছে। আলাউদ্দিন বিড়বিড় করে আয়াতুল কুরশি পড়ছেন…
আল্লাহু লাইলাহা ইল্লাহুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম। লতা খুজুহু সিনাতাও ওয়ালা নাওম! লাহু মা ফিছছামাওয়াতে ওয়াল আরদ্বি…
খুবই আশ্চর্যজনকভাবে রাতে আলাউদ্দিনের ভালো ঘুম হলো। ঘুমের ভেতর তিনি স্বপ্নও দেখলেন। কাটা কাটা স্বপ্ন। একটা স্বপ্নে তার বাবা মুনশি মোহম্মদ দুশির তাকে জিজ্ঞেস করছেন, রোজা ভেঙ্গেছিস কী জন্যে? তিনি বললেন, এটা তো রমজান মাস না। এখন রোজা রাখার প্রশ্ন আসছে কে? উত্তর শুনে মুনশি মোহম্মদ ছগির খুব রেগে গিয়ে বললেন– পরহেজগার আদমির জন্যে সারা বছরই রমজান মাস। রোজা ভেঙ্গেছিস, তার শাস্তি আগামী জুম্মাবারে মুসুল্লিদের সামনে এক লক্ষার কানে ধরে উঠবোস করবি। আলাউদ্দিন বললেন, জ্বি আচ্ছা। এরপর শুরু হলো কানে ধরে উঠবোসের স্বপ্ন দেখা। ছাড়া ছাড়াভাবে এই স্বপ্ন চলল ঘুম না ভাঙ্গা পর্যন্ত। তিনি উঠবোস করেই যাচ্ছেন, মুসুল্লিরা হো হো করে হাসছে। ঘুম থেকে উঠে তিনি চা খেলেন। হো হো হাসির শব্দের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। টিভিতে দর্শকদের উপস্থিতিতে কী একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। উপস্থাপকের প্রতিটি কথায় দর্শক হাসছে। আলাউদ্দিন আগ্রহ নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে রইলেন। টিভির সাউন্ড অফ করা ছিল। এখন সাউন্ড আছে। আলাউদ্দিন সাউন্ড অফ করে দিলেন। তিনি রাতে যে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন এটা ভেবে তার একটু হাসিই পেল। হামিদা বানু ঠিকই বলেছে— উত্তপ্ত মস্তিষ্কের চিন্তা। শুধু যখন কুটুর কাছে শুনলেন গতকাল রাতে সাইফুল্লাহ সাহেবের বাড়িতে কী নাকি সমস্যা হয়েছে, সাইফুল্লাহ সাহেবের মাথা ফেটে গেছে, রক্তে বাড়ি ভেসে গেছে, শেষ রাতে এম্বুলেন্স এসেছে, পুলিশ এসেছে— তখন সামান্য খটকার মতো লাগল।
আলাউদ্দিন বললেন, পুলিশ এসেছিল কেন?
কুটু বলল, জানি না স্যার। সাইহি সাহেবের বাসায় কাইল রাইতে যে মেয়েটা ছিল পুলিশ তারে ধইরা নিয়া গেছে।
মেয়ে কী করেছে?
জানি না স্যার।
মেয়েটা কে?
গার্মেন্টসের এক মেয়ে। সাইফুল্লাহ সাহেবের এখানে একেক সময় একেক মেয়ে থাকে। নানান ভ্যাজাল।
ভ্যাজাল তো বটেই।
উনার যে অবস্থা দেখলাম স্যার, নাক মুখ দিয়া রক্ত পড়তেছে। কাউরে চিনতে পারে না। বাঁচে কি-না সন্দেহ।
দেখতে গিয়েছিলে?
জ্বি না। সিঁড়ি দিয়া নামানির সময় দেখলাম। মন খারাপ হইয়া গেল। কে জানে কী বৃত্তান্ত।
মন খারাপ হবার কথা। হাজার হোক প্রতিবেশী।
স্যার, চা আরেক কাপ দিব?
আলাউদ্দিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দাও। তিনি মাথা থেকে পুরো ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। নাশতা খেয়েই আজ বাংলাবাজার চলে যাবেন।
বালিশটা আরেকবার দেখতে ইচ্ছা করছে। কাল রাতে মনে হয়েছিল রক্ত লেগে আছে। এখনও কি তাই? রক্ত শুকিয়ে হয় কালো। কালো কোনো দাগ কি বালিশে আছে। আলাউদ্দিন দুটা বালিশই উল্টে পাল্টে দেখলেন। কোনো দাগ নেই। তিনি অনিন্দিত গলায় ডাকলেন, মাই ডিয়ার কুটু! আরেক কাপ চা দাও।
চোখ পিটপিট করতে লাগলেন
হাজী একরামুল্লাহ বললেন, তোমার কী হয়েছে?
আলাউদ্দিন জবাব না দিয়ে চোখ পিটপিট করতে লাগলেন। হাজী সাহেব বললেন, চোখ পিটপিট করছ কেন?
আলাউদ্দিন বললেন, রোদটা কড়া। চোখে লাগছে।
হাজী সাহেব বললেন, ঘরের ভেতরে রোদ কোথায়? চোখ পিটপিটানি বন্ধ করে বলো তো তোমার ঘটনা কী?
আলাউদ্দিন চুপ করে রইলেন। বলার মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি। দিনের পর দিন তিনি নিজের শোবার ঘরের খাটের ওপর ছিলেন। নদিন পর আজ প্রথম বাইরে এসেছেন। আলো চোখে লাগছে। দোকানের ভেতর রোদ নেই ঠিকই, কিন্তু বাইরে ভাদ্র মাসের রোদ ঝলমল করছে। রোদের দিকে তাকালেই চোখ জ্বালা করে।
হাজী সাহেব বললেন, তোমার শরীরে পানি এসেছে না-কি? হাত-পা-মুখ ফোলা ফোলা। সমস্ত শরীরে গোল ভাব চলে এসেছে। সারাদিন কী কর? ঘুমাও?
আলাউদ্দিন সিগারেট ধরালেন। হাজী সাহেব বললেন, সিগারেট খাচ্ছি কারখানার চিমনির মতো। দশ মিনিটও হয় নি এসেছু, এর মধ্যে চারটা সিগারেট খেয়ে ফেললে।
আলাউদ্দিন চুপ করেই আছেন। হাজী সাহেবের সিগারেটের হিসেবে ভুল হয়েছে। সিগারেট চারটা খাওয়া হয় নি, তিনটা খাওয়া হয়েছে। এই নিয়ে তর্ক শুরু করা যায় না। হাজী সাহেব রেগে আছেন। ব্লগের মুহূর্তে তর্ক চলে না।
হস্তরেখা বই-এর পাণ্ডুলিপি কোথায়? এনেছ?
আলাউদ্দিন ক্ষীণ গলায় বললেন, এনেছি।
শেষ করেছ?
জ্বি।
কই দেখি।
একটু পরে দেই। বুঝিয়ে দিতে হবে।
হাজী সাহেবের রাগী মুখ সহজ হয়ে এলো। আলাউদ্দিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এই স্বস্তি সাময়িক, কারণ তিনি হস্তরেখা বিজ্ঞান বই-এর পাণ্ডুলিপি আনেন নি। যে বই লেখাই হয় নি তার পাণ্ডুলিপি অনবে কীভাবে? শিররের চ্যাপ্টারটা মাত্র শুরু হয়েছিল। পাণ্ডুলিপি না এনেও বলা হয়েছে এনেছি। এই মিথ্যা শেষ পর্যন্ত কীভাবে সামাল দিবেন কে জানে। আলাউদ্দিনের বুকের ভেতর ধুক বুক শব্দ হতে লাগল। ভালো ঝামেলায় পড়া গেল।
হাজী সাহেব সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, দেখি তোমার একটা সিগারেট খেয়ে দেখি।
আলাউদ্দিন সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিলেন। হাজী সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমার আসার কথা ছিল বুধবারে। তুমি যখন বুধবারে এলে না, বৃহস্পতিবার চলে গেল, শুক্রবার চলে গেল তারপরেও তোমার খোঁজ নেই তখন একবার মনে হয়েছিল বই নিয়ে ব্যস্ত। বই শেষ না করে আসবে না। আমি ম্যানেজারকে সে-রকমই বলেছি। চা খাবে?
জ্বি না।
জি না আবার কী!চা খাও। মালাই চা।
জ্বি আচ্ছা।
আলাউদ্দিন মনে মনে দোয়া ইউনুল পড়ছেন। এই দোয়া পড়লে যে-কোনো বড় বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। আলাউদ্দিন ঠিক করলেন পাণ্ডুলিপির প্রসঙ্গ আবার না আসা পর্যন্ত তিনি এই দোয়া পড়তেই থাকবেন। এমন হওয়া বিচিত্র না। যে দেখা যাবে দোয়া ইউনুস পড়ার কারণে হাজী সাহেব পাণ্ডুলিপির প্রসঙ্গটা তুলতে ভুলে যাবেন। অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। এমন একটা ঘটনা টানো আল্লাহর জন্যে কোনো ব্যাপারই না।
চা চলে এসেছে। চা এবং পিরিচ ভর্তি জর্দা দেয়া পান। হাজী সাহেব অতি দ্রুত কয়েকটা চুমুক দিয়ে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে মুখ ভর্তি করে পান নিলেন। পান চিবাতে চিবাতে সহজ গলায় বললেন, আমার ভাগ্নি হামিদাকে বিবাহের কথা নিয়ে কিছু ভেবেছ? ইচ্ছা না থাকলে না বলে দাও। কোনো অসুবিধা নেই। হামিদাও বেঁকে বসেছে। শুরুতে হ্যাঁ বলেছিল, এখন না বলছে। মেয়েদের এই সমস্যা। স্থিরতা বলে কিছু নেই। সাগরের ঢেউ— এই আছে এই নাই। তোমার নিজেরও তো বিয়ের ব্যাপারে অনাগ্রহ আছে। ঠিক না। এই বয়সে সংসারের ঝামেলায় যেতে ইচ্ছা না করারই কথা।
আলাউদ্দিন বললেন, আমি বিবাহ করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তবে উনার মত না থাকলে তো কিছু করার নাই। সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা। উনার ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতা ও কালে না। আমরা তুচ্ছ।
হাজী সাহেব বললেন, তুমি বিবাহ করতে চাও?
আলাউদ্দিন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। মেয়ে যেখানে বেঁকে বসেছে সেখানে হ্যাঁ বলতে বাধা নাই। তিনি যতই হ্যাঁ বলুন বিয়ে তো হবে না।
ভালো মতো ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে?
জি।
তোমার কোনো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলেছ?
জি না। তবে কুটুকে বলেছি।
কুটুকে বলেছ। কুটু কে?
আমার বাবুর্চি।
আরে রাখ তোমার বাবুর্চি। বাবুর্চির সঙ্গে কেউ নিজের বিয়ে নিয়ে আলাপ করে না-কি?
আলাপ করার মতো আমার কেউ নাই।
আলাপ করার কেউ না থাকলে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে। ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে চাকর বাকরের সঙ্গে কেউ আলাপ করে? নাও, পান খাও।
আলাউদ্দিন আগ্রহের সঙ্গে পান মুখে দিলেন। মনে মনে দোয়া ইউনুস তিনি এখনো পড়ছেন। দোয়ায় মনে হয় একশন শুরু হয়েছে। হাজী সাহেব পাণ্ডুলিপির প্রসঙ্গে যাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে পাণ্ডুলিপির চেয়ে তিনি তার ভাগ্নি হামিদা বানুর বিবাহ নিয়ে বেশি উৰ্ঘিশ্ন।
হাজী সাহেব খানিকটা কুঁকে এসে বললেন, তুমি তাহলে বিবাহের ব্যাপারে পজেটিভ সিদ্ধান্ত নিয়েছ?
জ্বি।
তাহলে তো হামিদাকে রাজি করানো দরকার। রাজি কেন করানো দরকার এটা শোন। পাড়ার মাস্তানদের গডফাদার টাইপ এক লোকের চোখ পড়েছে হামিদার দিকে। বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। নানান ভাবে যন্ত্রণা করছে। অতি বদ লোক। অতি হারামজাদা। থাকে মদের উপর। গুণ্ডাপাত্তা পুষ। স্ত্রী মারা গেছে–আবার বিবাহ করবে। এর কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়া আর মেয়ের গলায় দড়ি দিয়ে নিজের হাতে তেতুল গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেয়া একই কথা। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
তুমি বুঝতে পারছ না। এই জাতীয় বদলি যে মানুষের উপর কী পরিমাণ জুলুম করতে পারে তোমার কোনো ধারণাই নেই। হামিদার রূপে পাগল হয়ে সে যে হামিদাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে তা কিন্তু না। হামিদাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। বাড়িটার জন্যে।
বাড়িটার জন্যে মানে?
হামিদার যে বাড়িতে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেটা হামিদার নিজের বাড়ি। তার স্বামী বানিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। ঢাকা শহরে পাঁচ কাঠা জমির উপর দোতলা বাড়ি সহজ ব্যাপার তো না। যে কটা পাত্র হামিদাকে বিয়ে করার আগ্রহ দেখিয়েছে সবার নজর বাড়িটার দিকে। এর মধ্যে একজন আবার বাড়ির দলিল দেখতে চেয়েছিল। বুঝ অবস্থা। একমাত্র তোমাকে দেখলাম এই ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নাই।
আলাউদ্দিন চুপ করে রইলেন। তিনি এখনো দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারছেন না। হাজী সাহেব যদি ফস করে বলে বসেন— পাণ্ডুলিপিটা কোথায়? বের কর দেখি কয় ফর্মা হয়েছে। তাহলে কী হবে?
আলাউদ্দিন জ্বি।
তুমি লোক ভালো। আমার ভাগ্নির জন্যে একজন ভালো মানুষ দরকার। আর কোনো কিছুরই দরকার নাই। তুমি যদি সত্যি সত্যি বিয়েতে রাজি থাক তাহলে আমি আমার ভাগ্নিকে রাজি করাব। কী বলো তুমি? তোমার মন ঠিক আছে তো?
আলাউদ্দিন ক্ষীণ স্বরে বললেন, জ্বি।
এই বয়সের বিয়েতে তো আর প্যান্ডেল বানানো হবে না। তুমিও পাগড়ি পরে ঘােড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাবে না। কাজীকে ডেকে আনব। তিনবার কবুল বলা হবে— মামলা ডিসমিস। না-কি উৎসব করতে চাও?
জ্বি না।
আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও তো তোমার যোগাযোগ নাই।
জ্বি না।
তাহলে আর কী? কাজী ডেকে ঝামেলা মিটিয়ে দেই। বিয়ের পরে না হয় কিছু লোকজন ডেকে চাইনিজ হোটেলে রিসিপসনের মতো করলে। কী বলে?
আলাউদ্দিন ক্ষীণ স্বরে বললেন, আপনি যা ভালো মনে করেন।
বিয়ে করবে তুমি, আমার ভালো মনে করাকরির তো কিছু নাই। এখনো সময় আছে। হ্যাঁ না ভেবে বলো। তুমি হ্যাঁ বললে আমি হামিদার কাছে চলে যাব। যেভাবে হোক তাকে রাজি করাব। বিয়েতে রাজি না হলে লোকমান ফকিরের খপ্পর থেকে তাকে উদ্ধার করার মাত্র ক্ষমতা আমার নাই।
লোকমান কির কে?
ঐ হারামজাদার কথা একটু আগে না বললাম? গুণ্ডাপাণ্ডা পুষে। ওয়ার্ড কমিশনার। মদ খেয়ে একদিন রাস্তার উপর পড়েছিল। যে-ই পাশ দিয়ে যায় হামাগুঁড়ি দিয়ে তার পায়ে ধরতে যায়।
জ্বি বুঝতে পেরেছি।
এখন তুমি বলো— হামিদাকে রাজি করাব?
জি আচ্ছা।
তাহলে তুমি আর দোকান থেকে বের হয়ো না। খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম। নাও। সব যদি ঠিকঠাক মতো হয় আমি কাঙ্খী ডেকে এনে আমার বাড়িতে বিয়ে পড়িয়ে দেব। এক জিনিস নিয়ে দিনের পর দিন আর কত ঘটঘট করব? ঠিক আছে?
জ্বি।
এত শুকনা গলায় জ্বি বলছ কেন? জোর করে ধরে বেন্ধে তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি এরকম মনে করছ না তো?
জি না।
ভেরি গুড। দাও আরেকটা সিগারেট দাও। সিগারেটের ধোয়া দিয়ে মাথা খোলাসা করে কাজে নেমে পড়ি।
আলাউদ্দিন দোয়া ইউনুস পড়া বন্ধ করলেন। দোয়া কাজ করেছে। হাজী সাহেব হস্তরেখা বিজ্ঞান বই-এর পাণ্ডুলিপি বিষয়ে কোনো কথা না বলেই উঠে পড়েছেন। তিনি যে বস্তুর সঙ্গে বের হয়েছেন তাতে মনে হয় না আজ আর পাণ্ডুলিপি প্রসঙ্গ উঠবে।
আলাউদ্দিনের দুপুরের খাওয়াটা ভালো হলো না। কুটুর হাতের রান্না খেয়ে এমন হয়েছে অন্য কোনো কিছুই আর মুখে স্কুচে না। দুপুরে তিনি লম্বা ঘুম দিলেন। ঘুম ভাঙ্গল বিকেলে। হাজী সাহেবের দােকানের ম্যানেজার বলল, আপনাকে থাকতে বলেছেন। আপনার জন্যে জরুরি খবর আছে।
আলাউদ্দিন বললেন, কী খবর?
ম্যানেজার বলল, কী খবর তা তো জানি না। চা নাশতা কী খাবেন বলেন। গোশত পরোটা আনাই।
আনাও।
ভরপেট গোশত পরোটা এবং দুকাপ চা খেয়ে আলাউদ্দিন আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যার পর। তিনি হয়তো আরো কিছুক্ষণ ঘুমাতেন, হাজী সাহেব নিজে গা ঝাকিয়ে ডেকে তুললেন। হাসি মুখে বললেন, আজই তোমার বিয়ে।
হাজী সাহেব আলাউদ্দিনের জন্যে নতুন পায়জামা পাঞ্জাবি কিনে এনেছেন। তিনি গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, তাড়াতাড়ি একটা সেলুন থেকে চুল কেটে আল। সাবান ডলা দিয়ে গোসল কর। পানির ব্যবস্থা দোকানেই করেছি।
আলাউদ্দিন কোনো কিছু না বুঝেই বললেন, জি আচ্ছা।
দেনমোহরের ব্যাপার আগেই ঠিক করে ফেলি। পাঁচ লাখ টাকা দেন মোহর। অর্ধেক উসুল। ঠিক আছে?
জি।
তুমি খুশি তো?
জি খুশি।
মুখে হাসি নাই কেন? হাস। আচ্ছা থাক, পরে হাসলেও হবে। সময়ের টানাটানি। ম্যানেজারকে সঙ্গে নিয়ে নাপিতের দোকান থেকে চুল কেটে আস। বিয়ের আগে চুল কাটতে হয়, নখ কাটতে হয় অনেক দিনের নিয়ম।
আলাউদ্দিন সুবোধ বালকের মতো ম্যানেজারকে নিয়ে চুল কাটতে গেলেন।
রাত আটটায় বিয়ে হয়ে গেল।
রাত আটটা চল্লিশে তিনি নিজের বাড়িতে চলে এলেন। কুটু দরজা খুলে দিল। আলাউদ্দিন বললেন, বাথরুমে গরম পানি আছে? গা কুট কুট করছে। গোসল করব।
কুটু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তিনি সরাসরি বাথরুমে ঢুকে গেলেন।
বাথরুমে শুধু যে গরম পানি আছে তা না। বাথরুমে কাঠের একটা চেয়ার নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চেয়ারের ওপর পিরিচ দিয়ে ঢাকা একটা জগ রাখা আছে। জগে লাল রঙের কোনো বস্তু। বরফ ভাসছে। পাশেই খালি গ্লসি। দেয়াশলাই, সিগারেট এবং এসট্রে সাজানো আছে। আলাউদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন- ইয়ে নাকি?
কুটু বলল, জি স্যার।
টমেটো জুস?
কুটু জবাব দিল না।
ইয়ে দেয়া আছে?
জ্বি স্যার।
পেয়েছ কোথায়?
দুটা ভদকার বোতল কিনা আনছি স্যার। গুলশানে পাওয়া যায়। আটশ টাকা কইরা নিছে। মোট ষোল শ।
টাকা পেয়েছ কোথায়?
আপনার সুটকেসে টাকা ছিল। চাবিটা ছিল ড্রয়ারে। ড্রয়ার থেইকা চাবি নিয়া স্যুটকেস খুইলা টাকা নিছি।
আলাউদ্দিন বললেন, ও। তিনি বুঝতে পারছেন না, তার রাগ করা উচিত কি। মনে হচ্ছে রাগ করা উচিত। তাকে না বলে স্যুটকেস খুলে টাকা নিয়ে যাবে এটা কেমন কথা? এ তো রীতিমতো চুরি। তার অবর্তমানে সুটকেস খোলা। আলাউদ্দিন গম্ভীর হয়ে গেলেন। গম্ভীর মুখেই গ্লাসে ঢেলে টমেটো জুস নিয়ে একটা চুমুক দিলেন। আজকের জুস অসাধারণ হয়েছে। তার রাগ পড়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে রাগ করা উচিত না। টাকা তো কুটু নিজের জন্যে নেয় নি। সংসারের কাজেই নিয়েছে। তিনি যখন ঘরে থাকেন না তখন হুটহাট করে টাকার দরকার পড়তে পারে। দেখা গেল ঘরে চাল নেই। চাল কিনতে হবে। স্যুটকেস থেকে টাকা না নিলে এইসব সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে?
কুটু!
জ্বি স্যার।
দাও, গোসল দিয়ে দাও।
আরামে আলাউদ্দিনের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এখন মনে হচ্ছে কুটু যে বুদ্ধি করে টাকা নিয়ে ভদকা কিনে এনেছে কাজটা খুবই ভালো করেছে। এই জিনিস না। আনলে এমন আরামের ব্যবস্থা হতো না। এমনিতেই আজ মনের উপর প্রচণ্ড চাপ। গিয়েছে। তিনি বছর বয়সে বিয়ে করে ফেলা সহজ ব্যাপার না। কলিজা নড়ে যায়।
কুটু!
জ্বি স্যার।
আজ একটা ঘটনা ঘটেছে। শুনলে তুমি বিশ্বাস করবে না। ভাববে বানিয়ে বলছি। যদিও বানিয়ে বলার অভ্যাস আমার নাই।
কী ঘটনা ঘটছে স্যার?
বিয়ে করে ফেলেছি।
কুটু গায়ে যেভাবে সাবান ডলছিল সে ভাবেই ডলতে থাকল। আলাউদ্দিনের কথায় তার কোনো ভাবান্তর হলো বলে মনে হলো না। কিংবা এও হতে পারে বিয়ে করা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা কুটু তা ধরতে পারছে না। তার কাছে হয়তো বিয়ে করা এবং নাপিতের দোকানে গিয়ে চুল কেটে আসা একই ব্যাপার।
কটু শুনেছ কী বলেছি? আজ আমি বিয়ে করেছি। বিবাহ। শুভ বিবাহ।
ভালো করছেন।
ভালো না মন্দ কে জানে! হাজী সাহেবের কথা ফেলতে পারলাম না। আমি এক সময় খুবই বিপদে পড়েছিলাম। না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা হয়েছিল। হাজী সাহেব তখন কাজ দিয়ে আমাকে বাঁচান। আজ তিনি ভাগ্নিকে নিয়ে বিপদে পড়েছেন। এই বিপদে আমি তাকে সাহায্য করব না তা হয় না। একজনের বিপদে অন্যজন দেখবে। এটাই মানব ধৰ্ম। ঠিক বলছি না কুটু?
জ্বি।
মেয়েটিও রূপবতী, নাম হামিদা বানু। নামটা একটু ইয়ে! স্কুলে হামিদ স্যার বলে আমার এক স্যার ছিলেন। খুবই রাগি। অঙ্ক না পারলে পেটের চামড়ায় ডুলা। দিতেন। হামিদা নামটা শুনলেই হামিদ স্যারের কথা মনে পড়ে। পেটে ব্যথার। মতো হয়।
নামটা বদলায়ে দেন।
তাই করতে হবে। সুন্দর কোনো নাম দিতে হবে। সে রাজি হবে কিনা কে জানে। কী নাম দেয়া যায় একটু চিন্তা করবে।
জি আচ্ছা।
আলাউদ্দিন প্রথম প্লাস শেষ করেছেন। দ্বিতীয় গ্লাস ঢালার পর জগের দিকে তাকিয়ে দেখেন জাগে এখনো অর্ধেক জুস আছে। দেখে বড়ই আনন্দ পেলেন। উদাস গলায় বললেন— মানুষ চিন্তা করে রাখে একটা, হয় আরেকটা। তবে যা হয় দেবী যায় সেটাই ভালো। এই জন্যে কথায় আছে— আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যে করেন। ঠিক না কুটু?
জ্বি।
যেমন ধর আজ কিন্তু আমার বাসায় ফেরার কথা ছিল না। বিয়ে হয়ে গেছে, স্ত্রীর সঙ্গে থাক— এটাই তো স্বাভাবিক। ব্যবস্থাও সেরকম ছিল। হাজী সাহেব বললেন তার বাড়িতেই বাসর হবে। তিন তলার একটা ঘর ঠিক করা হয়েছিল। ফুলটুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল। তখন লেগে গেল ঝামেলা।
কী ঝামেলা
হামিদা শুরু করল কান্না। হাউমাউ কাউ কাউ যাকে বলে মরা কান্না। সে রাতে আমার সঙ্গে ঘুমাবে না। তার কান্না দেখে হাজী সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, আচ্ছা থাক স্বামী স্ত্রীর আজকেই যে একসঙ্গে থাকতে হবে তা না। দুএকটা দিন যাক। হামিদা ধাতস্থ হোক।… কুটু!
জ্বি স্যার।
হামিদা নামটা তো বদলাতে হয়। যেই মুহূর্তে আমি বললাম হামিদা আমি স্যারকে চোখের সামনে দেখলাম। মনে হলো স্যার পেটের চামড়া চেপে ধরেছেন। স্যার এমনভাবে চাপ দিতেন যে পেটে জন্ম দাগের মতো দাগ পড়ে যেত। হামিদা নামটা বদলাতেই হবে। একটা নাম চিন্তা করে বের কর।
জামিলা নামটা কি আপনার পছন্দ হয়? জামিলা শব্দের অর্থ সুন্দরী।
খুব যে পছন্দ হচ্ছে তা না। হামিদা নামের মাঝের অক্ষর ম। আবার জামিলা নামের মাঝের অরও ম। এমন নাম দেয়া দকার যেখানে ম থাকবে না। তবে আপাতত জামিলা নামই থাকুক। ম ছাড়া নাম যখন পাওয়া যাবে তখন সেই নাম রেখে দেব। তুমি আরো নাম খুঁজতে থাক।
জ্বি আচ্ছা।
আলাউদ্দিন দ্বিতীয় গ্লাস শেষ করে তৃতীয় গ্লাসের মাঝামাঝিতে চলে এসেছেন। আরামে শরীর যেন কেমন করছে। ইচ্ছা করছে বালিশ নিয়ে বাথরুমের মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকেন। তিনি শুয়ে থাকবেন, কুটু গায়ের ওপর গরম পানি ঢালবে। সাবান ডলবে। মাঝে মাঝে কুটু তার মাথা উঁচু করে ধরবে, তিনি গ্লাসে চুমুক দিবেন।
কুটু!
জ্বি স্যার।
জামিলা তোমাকে পছন্দ করবে কিনা কে জানে। পছন্দ না করলে বিরাট বিপদ হবে। তোমার কি ধারণা পছন্দ করবে।
মনে হয় না।
তুমি ঠিক বলেছ— আমার ধারণা পছন্দ করবে না। কথায় আছে না পহেলা দর্শনধারী তারপরে গুণবিচারি। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটা সত্য না। দর্শনধারী হলেই হলো। তোমার আবার চেহারা খুবই খারাপ। চেহারা খারাপ বলতে রাগ কর নাই তো?
জি না। সত্য কথায় রাগ করতে নাই। তোমার চেহারা খুবই খারাপ। ছোট ছেলেমেয়েরা তোমাকে অন্ধকারে দেখলে ভয়ে চিৎকার দিবে। আমি নিজেই মাঝে মাঝে ভয় পাই। কুটু, আমাকে একটা সিগারেট ধরিয়ে দাও তো।
কুটু সিগারেট ধরিয়ে দিল। আলাউদ্দিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, ঘুম পাচ্ছে। ইচ্ছা করছে ঘুমিয়ে পড়ি। তোমাদের পাইলট স্যার কি বাথটাবে। ঘুমাতেন।
শেষের দিকে ঘুমাইতেন।
শেষের দিকে ঘুমাইতেন মানে কী?
উনার শরীরটা যখন খারাপ হইয়া গেল তখন বাথটাবে শুইয়া থাকতেন। সেইখানেই ঘুমাতেন।
শরীর খারাপ হয়ে গেল মানে কী? কী হয়েছিল?
ডাক্তার ধরতে পারে নাই। উনি অবশ্য ডাক্তারের কাছে যানও নাই। প্রথম দুই একদিন গেছিলেন, তারপর আর যান নাই।
অসুখটা কী ছিল?
শইল ফুইলা গেল। গা হাত পা মুখ ফুইলা গেল। গর্ভবতী মাইয়াগো শরীরে পানি আসলে যেই রকম হয় সেই রকম।
বলো কী। আমারও তো শরীরে পানি আসার মতো হয়েছে। হাজী সাহেব আজ আমাকে বললেন, তোমার কি শরীরে পানি এসেছে? যাই হোক পাইলট সাহেবের কথা বলো। শরীর ফোলা ছাড়া আর কী হয়েছিল?
শইল জ্বলত। পানি দিয়া শরীর ভিজাইয়া রাখলে জ্বলুনি কমত। এই জন্যেই কি বাথটাবে শুয়ে থাকতেন?
জ্বি।
আমার তো শরীর জ্বলছে না!
আপনার শইল কেন জ্বলব? আপনার তো কিছু হয় নাই।
তাও ঠিক। খাওয়া দাওয়া বেশি করছি এই জন্যে শরীর ভারী হয়ে গেছে আর কিছু না। পাইলট সাহেব কি শেষমেষ শরীর জ্বলুনি রোগেই মারা গেলেন?
জ্বি-না। সারা শইল দিয়া ফোসকার মতো বাইর হইল। পরিষ্কার ফোসকা। মনে হয় কাচের তৈরি। ফোসকা ভর্তি টলটলা পানি।
বলো কী?
ঐ পানির ভেতর পোকা হইয়া গেল। ছোট ছোট সাদা কৃমির মতো পোকা। তাব পোকাগুলির মাথা আছে। ছোট্ট মাথা। মাথার দুই দিকে চোখ। ব্যাঙাচির চোখের মতো। ঐ পোকাগুলা স্যাররে খুবই যন্ত্রণা দিছে।
কীভাবে?
এরা মাংস খাওয়া শুরু করল।
থাক, এই গল্প বন্ধ। উজগে টমেটো জুস যা ছিল আলাউদ্দিন পুরোটাই গ্লাসে ঢেলে নিলেন। পোকার গল্পটা শোনার পর থেকে শরীর কেমন যেন করছে।
কুটু!
জি স্যার।
ভালো করে দেখ তো আমার শরীরে ফোসকা জাতীয় কিছু কি আছে?
নাই সার।
গুড। ফোসকাগুলির ভেতর যে পোকা হয় সেই পোকার মাথা আছে? মাথার দুপাশে চোখ আছে?
জ্বি, খুব ছোট ছোট দাঁতও আছে।
খালি চোখে দেখা যায়?
জ্বি-না খালি চোখে দেখা যায় না। তবে একটা ফোসকা পাইলট স্যারের চোখের মনির উপর হইছিল। সেই ফোসকার ভিতরে যে দুইটা পোকা হইছিল। সেইগুলি উনি পরিষ্কার দেখতেন। চোখ নষ্ট হইবার আগ পর্যন্ত উনি পোকাগুলি দেখছেন। বড় কষ্ট পাইছেন।
চোখ নষ্ট হয়ে গেল?
পোকাগুলি ডিম পাড়ল। সেই ডিম থেইকা বাচ্চা বাইর হইবার পর তারা চোখটা খাইয়া ফেলল। বাম চোখ চইলা গেল।
তোমার নিজের তো ৰূম চোখ নষ্ট। ঠিক না।
জ্বি। স্যার, ব্লডিমেরি কি আরেকটু খাইবেন? আইনা দেব?
দাও আরেকটু, খাই। পোকার কথাগুলি শোনার পর থেকে শরীরটা যেন। কেমন করছে। গা গুলাচ্ছে। আরেকটা খৈলে মনে হয় ঠিক হবে। কুটু তুমি যাচ্ছ কোঘায়?
আপনি যে বললেন ব্লাডিমেরি আনতে।
একটু পরে যাও। গল্প করি। তোমার সঙ্গে তো গল্পই করা হয় না।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি কি বিয়ে করেছিলে?
জ্বি।
স্ত্রীর নাম কী?
নাম ইয়াদ নাই।
বলো কী–স্ত্রীর নাম ভুলে গেছ? জি। ছেলেমেয়ে আছে? একটা কন্যা সন্তান আছে স্যার। তার নাম মনে আছে? জ্বি না। ইয়াদ নাই।
কন্যার নামও ইয়াদ নাই। তুমি দেখি এবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর হয়ে যাচ্ছি। এটা ঠিক না। স্ত্রী এবং কন্যার নাম ইয়াদ করার চেষ্টা কর।
আচ্ছা করব।
করব না, এখনই কর। আমি এখনই তাদের নাম শুনতে চাই। আমি এক থেকে একশ শ্রেণব। এর মধ্যেই এই দুজনের নাম শুনতে চাই। এক-দুই-তিনচার-পাঁচ…
পঁচিশ পর্যন্ত এসেই আলাউদ্দিন বাথরুমের মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন।
হামিদার গলায় কৌতূহল, বিস্ময় এবং কিছুটা ঘেন্না
হামিদা বলল, তোমার নাম কুটু মিয়া।
হামিদার গলায় কৌতূহল, বিস্ময় এবং কিছুটা ঘেন্না। কুটু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে। হঠাৎ জেরার মুখোমুখি হবে এই প্রস্তুতি হয়তো তার ছিল না।
কুটু আজ সকালে তার বিছানাপত্র নিয়ে হামিদা বানুর বাড়িতে উঠেছে। আলাউদ্দিন সঙ্গে ছিলেন। তিনি কিছু কেনাকাটার জন্যে নিউ মার্কেটে গেছেন। স্ত্রীর সঙ্গে বাস করতে আসার প্রস্তুতি হিসেবে এইসব কেনাকাটা। কুটু বলে দিয়েছে কী কী লাগবে। কেনাকাটার লিস্টে আছে—
স্পঞ্জের স্যান্ডেল
গেঞ্জি
পায়জামা-পাঞ্জাবি
রুমাল
তোয়ালে
টুথপেস্ট
টুথব্রাশ…
রুমাল ছাড়া লিস্টের সব জিনিসই আলাউদ্দিনের আছে। তারপরেও কুটু বলে দিয়েছে এই জিনিসগুলি নতুন হলে ভালো হয়। কেন ভালো হয় আলাউদ্দিন জিজ্ঞেস করেন নি। কুটুর বিবেচনার উপর তার গভীর আস্থা।
ব্যবহারের জিনিসপত্র ছাড়া অন্য কিছু জিনিসের লিস্টও কুটু করে দিয়েছে— তার মধ্যে আছুে পনেরোটা বেলি ফুল, এক কেজি গরম জিলাপি, আধা কেজি নেসাস্তার হালুয়া। এই জিনিসগুলি হামিদা বানুর জন্যে এবং আনতেই হবে। এর ভেতরেও কুটুর হয়তো কোনো বিবেচনা আছে।
স্ত্রীর সঙ্গে বাস করতে আসার ব্যাপারে আলাউদ্দিন সাহেবের গভীর শংকা ছিল। অভ্যস্থ জীবন যাপনের বাইরে কিছু করার অর্থই ভীতি। কুটু এই ভীতি দূর করেছে। কুটুর কথাবার্তায় তিনি ভরসা পেয়েছেন। তবে একা একা টিভি দেখা, চ্যানেল বদলাতে বদলাতে ইয়ে মেশানো টমেটো জুস খাওয়া কীভাবে হবে তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। কুটু বলেছে, মানুষ যেমন চায় তার দুনিয়া তেমন হয়। আপনের চিন্তার কিছু নাই। কুটুর কথার অর্থ তার কাছে পরিষ্কার হয় নি, তবু তিনি। ভরসা পেয়েছেন। কারণ কুটু ভরসা দিয়ে কথা বলেছে। সান্ত্বনার কথা বলে নি।
কুটু এখন দাঁড়িয়ে আছে হামিদা বানুর বসার ঘরের মাঝখানে। হামিদা তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। হামিদার ভুরু কুঁচকে আছে। যে সব মেয়ে শুয়োপোকা ভয় পায় তাদের সামনে বিশাল আকৃতির শুয়োপোকা দাঁড়িয়ে থাকলে তাদের মুখের ভাব যেমন হয় হামিদার মুখের ভাব ঠিক সে-রকম।
কী ব্যাপার, তোমাকে প্রশ্ন করছি তুমি জবাব দিচ্ছ না কেন? তোমার নাম কুটু?
জ্বি আপা।
প্রথমবার যখন প্রশ্ন করলাম তখনই তো জবাব দিতে পারতে। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করতে হলো কেন?
কুটু বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আমার নাম তো আপা জানেন। জাইনাও জিজ্ঞাস করছেন এই জন্যে চুপ কইরাছিলাম।
ভবিষ্যতে কিছু জিজ্ঞেস করলে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেবে। চুপ করে থাকবে না।
জি আচ্ছা।
তুমি কি জানো তোমার মতো নোংরা মানুষ আমি আমার দীর্ঘ জীবনে দেখি নি? তোমার গা থেকে পচা গন্ধ আসছে— এটা তুমি জানো?
কুটু জবাব দিল না। হামিদার রাগ ক্রমেই বাড়ছে। সে রাগটা সামলাবার চেষ্টা করছে। সামলাতে পারছে না। আজকের দিনে সে রাগতে চায় না।
তুমি তো হাতের নখও কাট না। নখ বড় হয়ে পাখির নখের মত বেঁকে গেছে। হাতের নখ কাট না কেন?
একটু অসুবিধা আইে আপা।
বলো কী অসুবিধা।
আমার নখ শক্ত, ব্লেড দিয়া কাটে না। সারাদিন পানিতে ডুবাইয়া রাইখা নখ। নরম কইরা কাটতে হয়।
তোমার মাথার চুলও কি শক্ত? লম্বা চুল ঘাড় পর্যন্ত চলে এসেছে। আমি নিশ্চিত তোমার মাথা ভর্তি উকুন। তুমি যখন রান্না করতে লাসা তোমার মাথার উকুন এসে হাঁড়িতে পড়ে। বলো মাথার চুল কাট না কেন?
আমার মাথার তালুতেওঁ অসুখ আছে আপা। চুলে টান পড়লে ব্যথা লাগে।
হামিদা কঠিন গলায় বলল, তোমাকে আমি এই বাড়িতে রাখ না। অবশ্যই না। আমার রান্নাঘরের ত্রি-সীমানায় তোমার মতো কেউ ঘুরঘুর করছে ভাবতেই যেনা লাগছে। তুমি চলে যাও।
চইলা যাব?
অবশ্যই চলে যাবে। তোমার বেন যদি কিছু পাওনা থাকে, উনার কাছ থেকে এসে নিয়ে যাবে।
এখন চইলা যা আপা।
হ্যাঁ এখন চলে যাবে। পাঁচ মিনিটের মাথায় বিদায় হবে।
কুটু বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আপা একটা ছোট্ট কথা… যদি অনুমতি দেন বলি।
বলো। সংক্ষেপে বলো।
স্যারের সঙ্গে যদি দেখা না কইরা চইলা যাই স্যরি মনে খুব কষ্ট পাইবেন। উনি আমার স্নেহ করেন। স্যারের মানে মায়া মমতা বেশি।
মায়া মমতা যে বেশি তা তো দেখতেই পাচ্ছি। মায়া মমতা বেশি না হলে তোমার মতো কোনো জিনিসকে ঘরে রাখতে পারে না। তোমাকে ঘরে মানায় না। তোমাকে ম্যানহোলের নিচে মানায়।
কুটু প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, স্যারের খুব শখ ছিল আমার হাতের একটা রান্না আপনেরে খাওয়াইবেন। ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল।
তুমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শেফ হলেও আমি তোমার হাতের রান্না খাব না। আমার ঘেন্না খুব বেশি।
গোসল কইরা পরিষ্কার হইয়া নিব। নাপিতের কাছে গিয়া চুল কাটব। কাঠমিস্ত্রির কাছে গেলে ওরা নখ কাইটা দিব। ওদের কাছে যন্ত্রপাতি আছে।
ওরা করাত দিয়ে তোমার নখ কাটবে?
জ্বি।
আমি আমার জীবনে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত কথাবার্তা শুনেছি, তোমার মতো অদ্ভুত কথা শুনি নি। আমার সামনে থেকে যাও।
জ্বি আচ্ছা।
এখনই তোমাকে বিদায় হতে হবে না। তোমার স্যার আসুক। তার কাছে বিদায় নিয়ে তারপর যাবে।
চুলটা কাটায়ে আসব আপা?
হামিদা জবাব দিল না। সোফা থেকে উঠে চলে গেল। তার মন প্রচণ্ড খারাপ। মন খারাপটা এই পর্যায়ে গিয়েছে যে এখন শরীর খারাপ লাগছে। বিয়েতে রাজি হওয়াটা ভুল হয়েছিল এটা সে জানত। সেই ভুল যে এত বড় ভুল তা জানত না। আলাউদ্দিন নামের অজানা অচেনা লোক চলে এসেছে। হামিদা যে খাটে দীর্ঘ। জীবন একা শুয়েছে, সেই খাটের একটা অংশ দখল করে এই লোকটা পড়ে। থাকবে। সবচে বড় কথা তার দুই মেয়ের বাবার স্মৃতি এই খাটের সঙ্গে জড়িত। সে এবং শহীদ দুজনে মিলে গুলশানের কাঠের দোকান থেকে খাট কিনে এনেছিল। আর যাই হোক তাদের দুজনের খাটে বাইরের একজন মানুষকে শোয়ানো যায় না। হামিদার নিজেকে প্রসটিটিউটের মতো লাগছে। যে মেয়ে একেকবার একেকজনের সঙ্গে বিছানায় যায় সে প্রসটিটিউট ছাড়া আর কী। হামিদার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কান্না আসছে না। সে দরজা ভেজিয়ে নিজের ঘরের খাটে শুয়ে
আছে। তার ভাবতেই অদ্ভুত লাগছে এই ঘরটা তার নিজের ঘর আর নেই।
দরজায় টোকা পড়ল। হামিদার কাজের বুয়া আসিয়া মাথা বের করে ভীত গলায় বলল, চা দিমু আফা? হামিদা বলল, না। আসিয়া চলে গেল না, আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। হামিদা বলল, আরো কিছু বলবে?
আসিয়া ক্ষীণ গলায় বলল, উনি আসছেন।
উনিটা কে?
আসিয়া বিড়বিড় করে বলল, নতুন ভাইজান।
হামিদার খুব বিরক্তি লাগছে। একজন মানুষ এসে দীর্ঘদিনের সুশৃঙ্খল অবস্থাটা জল করে দিয়েছে। মিয়ার মতো প্রাণবন্ত মেয়ে ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। কথা ফিসফিস করে বলছে। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করছে। এই অবস্থার পরিবর্তন কখন হবে?
হামিদা বলল, তুমি উনাকে জিজ্ঞেস কর চা-টা কিছু খাবেন কি-না। আর শোন, বিড়বিড় করছ কেন? বিড়বিড় করার মতো কিছু কি হয়েছে? এখন দরজার সামনে থেকে যাও। দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যাও।
হামিদা চিন্তিত মুখে বসে আছে। বসার ঘরের দরজা ভেজানো। যে-কোনো মুহূর্তে আলাউদ্দিন নামের মানুষটা ঘরে ঢুকতে পারে। এই অধিকার নিয়েই সে এ বাড়িতে এসেছে। তার অধিকার শুধু ঘরে ঢোকাতেই সীমাবদ্ধ না, সে ইচ্ছা করলে গায়েও হাত দিতে পারে। ভাবতেই শরীর ঘিনঘিন করছে।
টেলিফোন বাজছে। হামিদা টেলিফোন ধরল। হাজী সাহেব টেলিফোন করেছেন। তাঁর গলা আনন্দময়।
কেমন আছ গো মা?
হামিদা বলল, ভালো না।
আবার নতুন করে কিছু হয়েছে?
হামিল কঠিন গলায় বলল, মামা নতুন কিছু হয় নি। পুরনোটাই সামলাতে পারছি না।
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমার অসহ্য লাগছে মামা। আমার ইচ্ছা করছে ছাদে উঠে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যাই।
আলাউদ্দিনের সঙ্গে তার কি কোনো ঘটনা ঘটেছে।
কোনো ঘটনাই ঘটে নি। সে আজ সকালে বিছানা, বালিশ, বাবুর্চি নিয়ে উঠেছে।
সে-রকমই তো কথা ছিল।
হ্যাঁ সে-রকম কথাই ছিল। কিন্তু মামা, আমি ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছি। মনে হচ্ছে আমার গা দিয়ে আগুনের হলকা বের হচ্ছে।
একটা কাজ করি। আলাউদ্দিনকে বলি আরো সপ্তাহখানিক পরে এসে যেন সে এ বাড়িতে উঠে। এই এক সপ্তাহ চিন্তা-ভাবনা করে নিজেকে গুছিয়ে নে।
এসব কিছু করতে হবে না। আমি তোমাদের কাছে চলে আসছি। তোমাদের সঙ্গে থাকব। তোমাদের সঙ্গে কথা বলব। ভাবব।
এটা মন্দ না। চলে আয়।
আমার জন্যে একটা ঘর খালি করে রাখ মামা। আমি কাউকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমুতে পারি না।
তুই তোর মামির সঙ্গে কথা বলবি? সে তোকে বোঝাতে পারত। মেয়েদের সমস্যা মেয়েরাই ভালো বুঝে।
আমি এখন কারো সঙ্গেই কথা বলব না। মামা শোন, তোমার লেখক সঙ্গে করে একজন বাবুর্চি নিয়ে এসেছে। কালা মিয়া না কী যেন নাম। দেখে মনে হয় কবর খুঁড়ে কবরের ভেতর থেকে নিয়ে এনেছে।
বিদেয় করে দে।
বিদেয় করে দিয়েছি। সে এখনো যায় নি, তবে চলে যাবে। মামা শোন, যে লোক কবরের নিচ থেকে একজনকে ধরে এনে বাবুর্চির চাকরি দেয় তার সঙ্গে কি। জীবন যাপন সম্ভব?
মা শোন, এইসব তো ছোট সমস্যা।
সমস্যা সমস্যাই। সমস্যার কোনো ছোট বড় নেই।
তুই কি কাঁদছিস না-কি?
আমি কাঁদছি না। রাগে আমার শরীর জ্বলছে মামা।
তুই হাত মুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হ। তারপর চলে আয় আমার এখানে। না-কি আরেকটা কাজ করব। আমি তোর মামিকে নিয়ে চলে আসি। তোর সঙ্গে কথা। বলি, আলাউদ্দিনের সঙ্গেও কথা বলি।
তোমাদের আসতে হবে না মামা, আমি আসছি।
টেলিফোন রেখে হামিদী বাথরুমে ঢুকল। তার শরীর আসলেই জ্বলছে। সে দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করল। শরীরের জ্বলুনি সামান্য কমল। পুরোপুরি গেল না। পুরোপুরি যাবার কথাও না। আলাউদ্দিনকে কী কথা বলবে সেগুলি গুছিয়ে নেয়া দরকার। হামিদা কোনো কিছুই গোছাতে পারছে না।
আলাউদ্দিন বসার ঘরে বসে আছে। শান্ত ভঙ্গিতেই বসে আছে। বসার ঘরের সোফাটা আরামদায়ক। শুধু সামনের টেবিলের উপর পা তুলে দিতে পারলে অনেক আরাম হতো। এই কাজটা করা যাচ্ছে না। অন্যের বাড়িতে এসে সোফায় বসে টেবিলে পা তোলা যায় না। তার স্ত্রীর বাড়ি। সেই অর্থে নিজেরই বাড়ি। এই বোধ এখনো হচ্ছে না। আলাউদ্দিনের ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কিছুক্ষণ ঘুমুতে পারলে ভালো লাগত। ঘুমানো ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছেন না। সকাল এগারটা বাজে। এগারোটার সময় কেউ ঘুমুতে যায় না। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর লম্বা একটা ঘুম দিতে হবে। আজ দুপুরের খাবার ব্যবস্থা কুট কী করেছে তিনি জানেন না। নতুন বাড়িতে প্রবেশ উপলক্ষে নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু করেছে। মেনু আগেভাগে জানা থাকলে সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যাবে।
আলাউদ্দিন সিগারেট ধরালেন। প্রথমবার হাজী সাহেবের সঙ্গে যখন এ বাড়িতে এসেছিলেন তখন সিগারেট ধরাতে সংকোচ লাগছিল, এখন লাগছে না। এটা একটা ভালো দিক। সিগারেটে দুটা টান দিতেই হামিদা এসে ঘরে ঢুকল। আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সম্মান দেখানো হলো। নিজের স্ত্রীকে এইভাবে সম্মান দেখানোর কোনো নিয়ম আছে কি-না তিনি জানেন না। আস্তে আস্তে সব নিয়মকানুন শিখে নিতে হবে। শিক্ষার কোনো শেষ নাই। করে যাবার আগের মুহূর্তেও মানুষ শিখতে পারে।
হামিদা বলল, বসুন।
আলাউদ্দিন ধপ করে বসে পড়লেন। হামিদা তার সামনে বসল। তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। চোখ ইষৎ লাল। মনে হচ্ছে তার জ্বর আসবে। গা শির শির করছে। আলাউদ্দিন বললেন, আপনার জন্য জিলাপি এনেছি। হামিদা চমকে উঠল। মনে হলো সে একটা ধাক্কার মতো খেয়েছে। ধাক্কা খাওয়ার কারণ আছে। শহীদের জিলাপি খুব পছন্দ ছিল। যখন তখন জিলাপি নিয়ে আসত। জিলাপি না পেলে নেসাস্তার হালুয়া। দুটা খাদ্যদ্রব্যই হামিদার অপছন্দ। শহীদের আরেকটা পছন্দের জিনিস ছিল বেলি ফুল। হামিদা কোনো পুরুষ মানুষকে বেলি ফুলের জন্য এত পাগল হতে দেখে নি। তার আনন্দময় গলা এখনো কানে বাজে হামিদা শোন, আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরই শুরু হবে বেলির সিজন। শহীদের মৃত্যুর পর দীর্ঘ দিন কেটে গেছে হামিদা বাড়িতে বেলি ফুল ঢুকতে দেয় নি। বেলি ফুলের গন্ধ কেমন হামিদা ভুলে গেছে।
জিলাপি এনেছেন কেন?
আলাউদ্দিন জবাব দিলেন না। কুটু মিয়া তাকে জিলাপি আনতে বলেছে বলে তিনি জিলাপি এনেছেন এটা বলতে ইচ্ছা করছে না। তার মন বলছে এই সত্যি কথাটা শুনলে হামিদা পছন্দ করবে না। নেসাস্তার হালুয়াও আনতে বলেছিল, হালুয়া খুঁজে পান নি।
হামিদা বলল, শুধু জিলাপি এনেছেন আর কিছু আনেন নি?
আলাউদ্দিন বলল, বেলি ফুল এনেছি।
বেলি ফুল এনেছেন?
জ্বি।
কই দেখি।
আলাউদ্দিন পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেলি ফুল বের করলেন। হামিদা বলল, বেলি ফুল, জিলাপি আপনি কি নিজ থেকে এনেছেন না কেউ আপনাকে আনতে বলেছে?
আলাউদ্দিন ব্রিত ভঙ্গিতে বললেন, নিজ থেকে এনেছি।
হামিদা বলল, জিলাপি আমি খাই না, আর বেলি আমার পছন্দের ফুল না। তারপরেও আপনাকে ধন্যবাদ।
আলাউদ্দিন পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করলেন। কিছুক্ষণ আগেই তিনি সিগারেট শেষ করেছেন। সেই সিগারেটের ধোঁয়া এখনো ঘরে আছে। এর মধ্যে আরেকটা সিগারেট ধরানো ঠিক হচ্ছে না। হামিদা নাক মুখ কুঁচকে আছে। যারা সিগারেট খায় না তারা সিগারেটের গন্ধ সহ্যই করতে পারে না। আলাউদ্দিন হামিদার চোখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে সিগারেট ঠোঁটে নিলেন। ধরালেন না। কাজটা পরীক্ষামূলক। তিনি যদি দেখেন হামিদা রেগে যাচ্ছে তাহলে আর সিগারেট ধরাবেন না। আর যদি দেখেন সে রাগছে না তাহলে ধরাবেন। তিনি লাইটার হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছেন। হামিদা বলল, আপনাকে কিছু জরুরি কথা বলা দরকার।
অত্যন্ত জরুরি।
জ্বি বলুন।
আজ আর বলব না। আমার শরীরটা খারাপ, মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলব বুঝতে পারছি না।
তাহলে আরেক দিন বলুন।
হ্যাঁ তাই করব। আমি এখন চলে যাব মামার কাছে। সেখানে কয়েক দিন থাকব। মনটা ঠিক করব।
আলাউদ্দিন অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল, অবশ্যই অবশাই। মন ঠিক করা অত্যন্ত জরুরি। প্রয়োজনে দশ বার দিন থাকবেন। আমার ব্যাপারে কিছু চিন্তা করতে হবে না। সঙ্গে বাবুর্চি আছে। সে আবার অত্যন্ত দক্ষ।
আপনার বাবুর্চির বিষয়েও কিছু কথা আছে।
বলুন কী কথা। আপনার সঙ্গে বেয়াদবী করলে সেটাও বলুন। ওকে সাইজ করা দরকার আছে। প্রায়ই ভাবি সাইজ করব। শেষে সাইজ করা হয় না।
বাবুর্চির বিষয়ে যে কথাগুলি বলতে চাচ্ছি সেগুলিও আজ না বলে অন্যদিন বলব। অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আপনি সিগারেট ধরাচ্ছেন না। একবার ঠোঁটে নিচ্ছেন একবার হাতে নিচ্ছেন। সিগারেট ধরান।
আলাউদ্দিন আনন্দের সঙ্গে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আপনি কখন যাবেন?
হামিদ বলল, এখনই যাব।
হামিদার কথা শেষ হবার আগেই কুটু ঢুকল। তার হাতে চায়ের কাপ। হামিদা কুটুকে দেখে আবারো ধাক্কার মতো খেল। এই কুটু মিয়া আগের কুটু মিয়া না। অতি অল্প সময়ে সে চুল কেটে এসেছে। হাতের নখ কেটেছে। গোসল করে ইস্ত্রি করা সার্ট প্যান্ট পরেছে। নোংরা ভাব তার শরীরে এখন একেবারেই নেই। তার গা থেকে লেবুর হালকা সুবাস আসছে। লেবুর গন্ধ হামিদার খুবই পছন্দ।
কুটু হামিদার দিকে তাকিয়ে বলল, আপা আপনের জন্য চা আনছি।
হামিদা বলল, আমি তো তোমার কাছে চা চাই নি।
কুটু বিনীত ভঙ্গিতে বলল, একটু খাইয়া দেখেন আপা। আপনের ভালো লাগব। এইটা মশলা আছে। ঘন কইরা দুধ চা বানাইয়া তার মধ্যে গরম মশলা দেওয়া হয়। নেপালীরা এই চা খুব পছন্দ করে। একটা চুমুক দেন।
হামিদা খুব অনাগ্রহের সঙ্গে চায়ে চুমুক দিল। শান্ত গলায় বলল, আমি চা খাচ্ছি। এখন দাঁড়িয়ে থেকো না। সামনে থেকে যাও।
কুটু বলল, চা-টা কি আপনার মন মতো হইছে আপা?
হামিদা বলল, চা ভালো হয়েছে।
কুটু বলল, শুকরিয়া।
বলেই সে সরে গেল। আলাউদ্দিন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, জামিলা শোন— কুটু অসাধারণ এক প্রতিভা।
হামিদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আপনি আমাকে কী নামে ডাকলেন?
আলাউদ্দিন গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, জামিলা বলেছি। দয়া করে রাগ করবেন না। আর বলব না।
জামিলা বলেছেন কেন? আমার নাম হামিদা, জামিল না।
জ্বি আমি জানি। হামিদ স্যার আমাদের অংক করাতেন। উনাকে খুবই ভয় পেতাম। হামিদা নামটা শুনলেই স্যারের কথা মনে হয়। এই জন্যই আপনাকে দামিলা বলেছি। আর বলব না। তবে জামিলা নামের অর্থ ভালো। জামিলা নামের অর্থ সুন্দরী।
হামিদা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি এখন চলে যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে। পরে কথা বলব। দু তিন দিন পরে যে-কোনো এক সময় কথা হবে।
আলাউদ্দিন বলেন, জ্বি আচ্ছা।
আমার কাজের মেয়েটিকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। আপনার বাবুর্চি আছে। আপনার অসুবিধা হবার কথা না।
কোনো অসুবিধা হবে না। আমাকে নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
হামিদা ক্লান্ত গলায় বলল, আমি আপনাকে নিয়ে চিন্তা করছি না। আমি নিজেকে নিয়ে চিন্তা করছি। আচ্ছা আমি এখন যাচ্ছি।
আলাউদ্দিন বাথটাবের পানিতে শুয়ে আছেন। তার মাথাটা শুধু ভেসে আছে। পুরো শরীর পানির নিচে। বাথটাব ভর্তি ফেনা। আলাউদ্দিনের মনে হচ্ছে এরচে সুন্দর সময় তিনি তাঁর জীবনে পার করেন নি। হামিদার বাড়িতে বাথটাব আছে এটাই তিনি কল্পনা করেন নি। বাথটাবে নামার সময় শুরুতে তার একটু ঠাণ্ডা লাগছিল। এখন আর লাগছে না। এখন মনে হচ্ছে পানির তাপমাত্রা এরচে বেশি হলে ভালো। লাগত না।
তিনি একাই আছেন। কুটু আশেপাশে নেই। একটু আগে হাতের কাছে একটা ট্রে নামিয়ে দিয়ে গেছে। ট্রেতে একটা জপ এবং একটা গ্লাস। জগে যে বস্তু আছে তার রঙ টমেটো জুসের লাল রঙ না, হালকা সোনালি রঙ। এটা নিশ্চয়ই অন্য কোনো জিনিস। যে জিনিসই হোক, অমৃতসম। এই জিনিস এক জগ খেলে তৃষ্ণা মিটবে না। এই জিনিস খেতে হবে এক বালতি। আলাউদ্দিন সিগারেট ধরালেন। পানিতে ভিজতে ভিজতে সিগারেট টানার একটাই সমস্যা। সিগারেট ভিজে যায়। পানিতে সিগারেট খাবার জন্য অন্যরকম সিগারেট থাকার দরকার ছিল। যে সিগারেট পার্টিতে ভিজবে না। কুটুাকে বললো একটা ব্যবস্থা সে নিশ্চয়ই করবে। অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন মানুষ। দরিদ্র দেশে পড়ে আছে বলে তার প্রতিভার কদর হলো না। কটু ইউরোপ আমেরিকায় জন্মালে তাকে নিয়ে। কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। আলাউদ্দিন ডাকলেন, কুটু! কুটু কোথায়?
কুটু সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে বাথরুমে ঢুকল। আলাউদ্দিন স্নেহের স্বরে বললেন, কেমন আছি কুটু?
কুটু বলল, ভালো।
আলাউদ্দিন বললেন, জীবনে এই প্রথম বাথটাবে গোসল করছি, এর আগে কখনো করি নি। বিয়েটা আমার জন্য শুভ হয়েছে কী বলা কুটু?
অবশ্যই শুভ হয়েছে।
আজকের দিনটা নিয়ে খুবই দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। দিনটা কীভাবে কাটবে এই নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। দিনটা তো মনে হয় ভালোই কাটবে।
অবশ্যই ভালো কাটবে।
আগামীকালও ভালো কাটবে। জামিলা আগামীকালও আসবে না। আমাকে বলে গেছে।
এইটা তো স্যার সুসংবাদ।
আলাউদ্দিন গ্রামে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, শুধু সুসংবাদ বললে কম বলা হয়। এটা হচ্ছে মহা সুসংবাদ।
জ্বি স্যার, মহা সুসংবাদ।
নিজের স্ত্রীর সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বললাম এর জন্যে সামান্য খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছিল কি জানো? মনে হচ্ছিল, আমি যে কলেজের শিক্ষক,
জামিলা সেই কলেজেরই প্রিন্সিপ্যাল।
স্যার আপনি খুব দ্রুত খাইতেছেন। আস্তে আস্তে খাওয়ার নিয়ম।
পাইলট সাহেব কি আস্তে আস্তে খেতেন?
জি।
উনি ছিলেন পাইলট, আর আমি দরিদ্র ঘরের সন্তান। উনার সঙ্গে আমাকে মিলালে তো হবে না। দুই জন দুই প্রান্তে।
তারপরেও আপনেদের মধ্যে মিল আছে।
এটা ঠিক বলেছ–আমাদের মধ্যে মিল আছে। উনি বাথটাবে শুয়ে থাকতেন। আমিও বাথটাবে শুয়ে আছি। উনি বাথটাবে শুয়ে জগ ভর্তি জিনিস খেতেন, আমিও বাথটাবে শুয়ে জগ ভর্তি জিনিস খাই। আমি উনার চেয়ে দ্রুত খাই। সামান্য একটু অমিল— তাই না?
জ্বি স্যার।
আলাউদ্দিন আরেক গ্লাস নিলেন। লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, আরো মিল আছে উনার বাবুর্চির নাম ছিল কুটু মিয়া, আমার বাবুর্চির নামও কুটু মিয়া। ঠিক বলছি কি-না বল।
অবশ্যই ঠিক বলছেন।
শোন কুটু, আজ আমি বাথটাব থেকে উঠব না। এখানেই খাওয়া দাওয়া করব। অসুবিধা আছে?
কোনো অসুবিধা নাই স্যার।
তোমার পাইলট স্যার কি কখনো বাথটাবে শুয়ে খাওয়া দাওয়া করতেন? জ্বি করতেন। উনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাথটাবে থাকতেন। বই পড়তেন। কী বই পড়তেন? কী বই পড়তেন তা বলতে পারব না স্যার। আমি লেখাপড়া জানি না।
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি লেখাপড়া জানো না। তোমাকে একবার বলেছিলাম বাংলাবাজার থেকে অ আ বই কিনে আনব, ভুলে গেছি।
এই বয়সে আর লেখাপড়া শিখা কী হইব!
জ্ঞান অর্জনের কোনো বয়স নাই কুটু। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করা যায়। তুমি এখন যাও তো কুটু, খুঁজে পেতে দেখ এই বাড়িতে কোনো বই টই আছে কি না। থাকলে নিয়ে এসো। শুয়ে শুয়ে পাইলট সাহেবের মতো বই পড়ব।
বাংলা বই আনব না ইংরাজি বই আনব? একটা আনলেই হবে। হাতের কাছে যা পাও নিয়ে এসো।
কুটু কিছুক্ষণের মধ্যেই বই নিয়ে ফিরে এলো। ইংরেজি বই। বই- এর লেখকের নাম উইলিয়াম গোল্ডিং। বই-এর নাম লর্ড অব দা হাইস। আলাউদ্দিন বই পড়তে শুরু করলেন। প্রথম চ্যাপ্টারের নাম The sound of the shaell.
দশ মিনিটের মতো পড়েই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। লর্ড অব দ্যা ফ্লাইস কিছুক্ষণ বাথটাবের পানিতে ভেসে রইল। তারপর পানিতে ডুবে গেল।
ভনিতা করছ কেন
হাজী একরামুল্লাহ বললেন, মা আমি যে তোর মঙ্গল চাই এটা কি তুই জানিস?
হামিদা বলল, আসল কথাটা বলে ফেল মামা। ভনিতা করছ কেন?
হাজী সাহেব বললেন, আমি তোর মঙ্গল চাই এটাই আসল কথা।
হামিদা বলল, ঠিক আছে তুমি আমার মঙ্গল চাও। আমার প্রতি এই শুভকামনার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।
এ রকম ক্যাটক্যাট করে কথা বলছিস কেন মা? আয় আমরা সহজভাবে কিছুক্ষণ আলাপ করি। চিন্তায় তোর চোখ মুখ ছোট হয়ে গেছে। এ রকম অবস্থায় থাকলে কিছুদিনের মধ্যে তোর সব চুল পেকে যাবে। তুই একটা সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিস। আয় তোর সমস্যার সমাধান করি।
তুমি আমার সমস্যার সমাধান করবে?
আমি একা করব কীভাবে। তুই আমি আমরা দুজনে আলাপ করব। দরকার হলে আলাউদ্দিনকে ডাকব।
উনাকে ডাকবে কেন?
তোর সমস্যাটা তো তাকে নিয়েই। তাকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে থাকছিস না।
হামিদা বলল, মামা আমি যে তোমার এখানে আছি তাতে কি তোমার অসুবিধা হচ্ছে? একটা বড় ঘর একা দখল করে আছি। অসুবিধা হবার কথা। যদি হয় খোলাখুলি বলে আমি চলে যাব।
কোথায় যাবি? নিজের বাসায় ফিরে যাবি?
না। মেয়েদের কোনো হোস্টেলে গিয়ে উঠব। চাকরিজীবী মহিলাদের জন্যে ঢাকা শহরে অনেক হোস্টেল তৈরি হয়েছে।
তোর নিজের বাড়িতে তুই যাবি না?
না। মামা তোমার কথা কি শেষ হয়েছে? আমি এখন উঠ। আমার মাথা ধরেছে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকব।
হাজী সাহেব বললেন, আচ্ছা যা।
হামিদা বলল, শেষ কোনো কথা থাকলে বলতে পার।
হাজী সাহেব বললেন, এ রকম দুটফট করলে তো শেষ কথা বলতে পারব। শান্ত হয়ে সে। নে একটা পান খা।
মামা আমি পান খাই না।
খেয়ে দেখ ভালো লাগবে। মিষ্টি পান।
হামিদা বলল, পানটান কিছু খাব না। শেষ কথা কী বলতে চাচ্ছে বলো। আমি মন দিয়ে শুনছি।
হাজী সাহেব একটা পানি মুখে দিলেন। হামিদার পিঠে হাত রেখে নরম গলায় বললেন, আমি তার মঙ্গল চাই।
হামিদা অস্পষ্টভাবে হাসল।
হাজী সাহেব বললেন, তুই যদি আলাউদ্দিনের সঙ্গে বাস করতে না পারিস তাহলে বিয়ে ভেঙে দেয়া উচিত। বিয়ে তো কোনো খেলা না। সিরিয়াস ব্যাপার। যদি তুই ভাবিস বিয়েটা ভুল হয়ে গেছে, তাহলে সেই ভুল হজম করতে হবে কেন?
হামিদা ক্ষীণস্বরে বলল, তুমি এই লাইনে কথা বলবে আমি বুঝতে পারি নি। থ্যাংক য়ু।
হাজী সাহেব বললেন, বিয়ে ভেঙে দেবার আগে তোক কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হবে ভুল হয়েছে।
পুরোপুরি নিশ্চিত কীভাবে হব?
পুরোপুরি নিশ্চিত হতে হলে তার নিজের বাড়িতে গিয়ে আলাউদ্দিনের সঙ্গে বাস করতে হবে। তাকে কাছাকাছি থেকে কিছুদিন দেখতে হবে। তোদের দুজনকে যে এক ঘরেই বাস করতে হবে তা তো না। তুই একটা ঘরে থাকবি। আলাউদ্দিন অন্য একটা ঘরে থাকবে। আলাউদ্দিন অবুঝ না। তাকে বললেই সে বুঝবে। আমি তোকে বেশি দিন থাকতে বলছি না। এক সপ্তাহ থাকলেই হবে।
এক সপ্তাহ?
হ্যাঁ এক সপ্তাহ। মা রাজি হয়ে যা। আমি বুড়ো মানুষ, আমি তোর কাছে হাতজোড় করছি।
হামিদা বিরক্ত হয়ে বলল, যাত্রা থিয়েটার করবে না মামা। হাতজোড় করা। আবার কী? ঠিক আছে আমি থাকব এক সপ্তাহ।
তাহলে একটা তারিখ ঠিক করে ফেলি। কবে যাবি সেই তারিখ।
ঠিক কর।
বুধবার, নয় তারিখ। ঠিক আছে? বুধবার নয় তারিখ সকালে তোকে আমি ঐ বাড়িতে রেখে আসব।
বুধবার কেন? বুধবার কি বিশেষ কোনো দিন?
একটা দিন ঠিক করতে হয় এই জন্যে ঠিক করা।
হামিদা ছোট্র নিঃশ্বাস ফেলে বলল–আমার ধারণা কী জানো মামা? আমার ধারণা তুমি আলাউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আগেই আলাপ করে এই দিনটা ঠিক করে এসেছ। তার সঙ্গে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে এসেছ আমার কাছে। আমি কি ভুল বললাম?
হাজী সাহেব জবাব দিলেন না।
হামিদা বলল, মামা আমার বুদ্ধি কেমন?
হাজী সাহেব বললেন, তোর বুদ্ধি ভালো। মাশাল্লাহ।
হামিদা বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথায় চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে। মাথাব্যথার ওষুধে এই যন্ত্রণা যাবে না। মাথার ভোতা যন্ত্রণা বিয়ের পর থেকেই শুরু হয়েছে। বাড়ছে কমছে, পুরোপুরি কখনো যাচ্ছে না। হামিদা এখন প্রায় নিশ্চিত এই যন্ত্রণা কখনো যাবে না। কোনো কিছু নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকলে যন্ত্রণা সাময়িকভাবে ভুলে থাকা যায়। ব্যস্ত রাখার মতো কিছু হামিদা খুঁজে পাচ্ছে না।
দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে। হামিদ বিরক্ত গলায় বলল, কে?
হাজী সাহেবের কাজের মেয়ে বলল, ভাত খাইতে আসেন।
হামিদা বলল, আমি রাতে কিছু খাব না। তুমি মামিকে গিয়ে বলবে খাওয়া নিয়ে একটু পরে পরে আমাকে যেন বিরক্ত না করে। আমার ঘরেও যেন খাবার না পাঠায়। বুঝতে পারছ কী বলছি?
জি।
এখন যাও। খবরদার আবার ফিরে আসবে না। আমার মেজাজ খুবই খারাপ। আবার যদি তুমি ফিরে আস, কিংবা অন্য কেউ ভাত খাওয়া খাওয়ির জন্যে সাধাসাধি করতে আসে তাহলে আমি কোনো একটা হোটেলে গিয়ে উঠল।
হামিদা বিছানা থেকে উঠে দরজার ছিটকিনি লাগাল। কাগজ কলম নিয়ে। মেয়েদের চিঠি লিখতে বসল। এখানে কী ঘটছে মেয়েদের জানানো প্রয়োজন। তার বিয়ের পর মেয়েদের সঙ্গে টেলিফোনে দুতিন মিনিট করে কথা বেশ কয়েকবার হয়েছে। তাতে তাদেরকে তেমন কিছুই বলা হয় নি। পুরো ব্যাপারটা ভালো মতো উজানাতে হবে। চিঠি লিখতে হবে সাবধানে, কারণ মেয়েরা এই চিঠি শুধু যে নিজেরা পড়বে তা না— তাদের স্বামীদেরও পড়াবে। বিবাহিত মেয়েদের কাছে একান্তই ব্যক্তিগত কোনো চিঠি পাঠানো যায় না। তারা আহ্লাদ দেখানোর জনেঃ ব্যক্তিগত সবকিছুই স্বামীকে দেখায়। চিঠি একটা লিখে ফটোকপি করে দু মেয়েকে পাঠালে হবে না। দুজনকে আলাদা করে লিখতে হবে।
হামিদার মাথার যন্ত্রণা বাড়তে শুরু করেছে। আরো বাড়ার আগেই চিঠি শেষ করা দরকার। মেয়েদেরকে চিঠিতে অনেক আহাদ আহ্লাদী কথা লিখতে হয়। মাথার যন্ত্রণা বেড়ে গেলে আহ্লাদী কথাগুলি আসবে না।
আমার প্রিয় মা ‘রু’,
কেমন আছ গো মা মণি? কেমন চলছে তোমার সংসার? জামাই কেমন আছে? তার পায়ের পাতায় কোড়া হয়েছিল বলেছিলে। সেটার অবস্থা কী? মা গো তুমি মোজা নিয়মিত ধুয়ে দাও তো? তোমার ওয়াশিং মেশিন আছে। কাপড় ধোয়া সমস্যা হবার কথা না। আল্ডার গার্মেন্টস প্রতিদিন ধোয়া প্রয়োজন। সুজির হালুয়ার রং শাদা হয়ে যাচ্ছে কেন জানতে চেয়েছিলে। সুজি সামান্য ভেজে নিতে পার। অনেকে আবার জাফরান দিয়েও রং করে। হলুদ দিয়ে রং করতে যেও না। হলুদের তিতা একটা স্বাদ আছে। মিষ্টি জাতীয় খাবারে হলুদ দেয়া যায় না। কাচা হলুদের রস একি ফোঁটা দিল সুন্দর রঙ হয়। তোমাদের দেশে কাচা হলুদ আছে কি-না, তা তো জানি না।
এখন নিজের প্রসঙ্গে আসি। কিছু কিছু কাজ আছে, মানুষ জানে কাজটা ভুল, তারপরেও কাজটা করে। কাজটা করার পর ভুলটা যে কত বড় তা ধরতে পারে। তখন আর ভুল শোধরানোর উপায় থাকে না। আমি এ ধরনের একটা ভুল করে ফেলেছি। এখন আমার মাথা আউলা হয়ে আছে। মাথা আউলা শব্দটা তোমার বাবা ব্যবহার করতেন। মানুষটা নেই কিন্তু সে তার অনেক কথাবার্তা ছড়িয়ে রেখে গেছে। ঐ যে বিখ্যাত লাইন— পাখি উড়ে চলে গেলেও পাখির পালক পড়ে থাকে।
আমি আমার নিজের ভুলের কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে লেখার জন্যে তোমাকে চিঠি লিখতে বসি নি। তোমার সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টাও করছি না। সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টাটা আমার কাছে সব সময় খুব অরুচিকর মনে হয়েছে। তোমার বাবার মৃত্যুর পর তোমাদেরকে নিয়ে আমি যখন গভীর জলে পড়ে গেলাম তখন অনেকেই সহানুভূতি দেখাতে এগিয়ে এসেছিলেন। রাগে আমার এখন গা জ্বলতো। এখনো জ্বলে। আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। এই সমস্যার সমাধান আমি নিজেই করব। তার জন্যে তোমাদের কাছে কখনো মাল না। এবং আমি আশা করব যে আমি দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি এই ভেবে তোমরা আমাকে সহানুভূতি দেখতে আসবে না।
এখন কিছু অদ্ভুত ঘটনা তোমাকে বলি। ঘটনাগুলি কাকতালীয়। কিন্তু একের পর এক কয়েকটা কাকতালীয় ব্যাপার ঘটবে তাও আমি মানতে পারছি না। ব্যাপারটা কী শান— আগের কথামতো আলাউদ্দিন সাহেব এক সকালে তার বাবুর্চিকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। আমার সঙ্গে দেখা হলো না। তিনি জিনিসপত্র নামিয়ে বাজারে চলে গেলেন, জরুরি কী সব কেনাকাটা না-কি বাকি আছে। তার সঙ্গে দেখা হলো দুপুরে। তিনি জিলাপি এবং বেলি ফুল নিয়ে এসেছেন। কাকতালীয় ব্যাপারটা বুঝতে পার? বুঝতে পারা উচিত। তোমাদেরকে আমি অনেকবার বলেছি– জিলাপি এবং বেলি ফুল তোমার বাবার খুবই পছন্দের জিনিস। সে বাজারে গেলেই খুঁজে পেতে জিলাপি নিয়ে আসত। বেলি ফুলের সিজনে সে বেলি ফুল ছাড়া বাসায় এসেছে এরকম কখনো হয় নি। আলাউদ্দিন নামের মানুষটা বেছে বেছে প্রথম দিনেই জিলাপি এবং বেলি ফুল আনবে কেন? আচ্ছা ধরে নিলাম। কাকালীয়। আমাদের পৃথিবীতে বিস্মিত হবার মতো কাকতালীয় ব্যাপার যে ঘটে না তা-না। অবশ্যই ঘটে। পর পর ঘটে না।
দ্বিতীয় কাকতালীয় ব্যাপারটা সেদিনই ঘটল। আলাউদ্দিন সাহেব হঠাৎ এক সময় আমাকে জামিলা ডাকতে লাগলেন। তোমাদের আমি বলেছি যে তোমার বাবা ঠাট্টা করে আমাকে ডাকতেন— মিসেস ঝামিল। আমি শুধু ঝামেলা করি, এই জন্যেই আমার নাম মিসেস ঝামিলী। জামিলা এবং ঝামিলা এই দুটি নাম কী পরিমাণ কাছাকাছি তা কি বুঝতে পারছ? উনি যখন অবিকল তোমার বাবার মতো গলায় আমাকে জামিলা ডাকলেন আমি এতই মাক হলাম যে মাথায় একটা চক্কর দিয়ে উঠল। উনি কেন আমাকে জামিলা ডাকলেন তার একটা ব্যাখ্যা দিলেন। ব্যাখ্যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। আমার কাছে মনে হলো (এখনো মনে হচ্ছে) ব্যাখ্যার বাইরে অন্য কিছু আছে। সেই অন্য কিছুটা যে কী হ। ধরতে পারছি না।
আলাউদ্দিন সাহেব সঙ্গে করে একজন বাবুর্চি নিয়ে এসেছেন। নাম কুটু মিয়া। অলিউদ্দিন সাহেবের আচার ব্যবহার এবং চলাফেরায় কোনো রহস্যময়তা নেই। তিনি আর দশটা মানুষের মতোই, কিন্তু কুটু মিয়া নামের মানুষটা অন্যরকম। প্রথম দেখাতেই আমি তাকে যতটা অপছন্দ করেছি আর কাউকে এর একশ ভাগের এক ভাগ অপছন্দও করি নি। তাকে দেখে প্রথম যে ধারণাটা হয় তা হলো এই লোক মানুষের সমাজে বাস করে না, এ বাস করে ম্যানহোলের। ভেতরের কোনো জগতে। সে আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়াল। চায়ে মুখ দিয়েই মনে হলো কোথাও কোনো গগোল মাই। কারণ চা-টা ছিল মশলা চা। তোমাদের জন্ম হবার আগে তোমাদের বাবা একবার মামাকে নিয়ে চারদিনের জন্যে কাঠম গিয়েছিলেন। সেখানেই আমি প্রথম। মশলা চা খাই। সেই চায়ের স্বাদ আমার মুখে লেগে ছিল। কুটু মিয়া বেছে বেছে অবিকল সেই চা-ই কেন বানিয়ে দিল? ঘটনা কী?
ঘটনা অবশ্যই আছে। ঘটনার ব্যাখ্যাও আছে। আমার মাথা তোমার বাবার ভাষায় আউলা হয়ে আছে বলে ঘটনার ব্যাখ্যা বের করতে পারছি না। আমি নিশ্চিত একদিন পারব। তোমার মাথায় কোনো ব্যাখ্যা এলে আমাকে চিঠি লিখে জানি।
এখন আলাউদ্দিন সাহেব তাঁর বাবুর্চিকে নিয়ে আমার বালায় বাস করছেন। আমি চলে এসেছি বড় মামার বাড়িতে। এই অবস্থা কত দিন চলবে বুঝতে পারছি না।
এদিকে আবার আরেক সমস্যা আমার বাড়ির এক তলায় যে ভাড়াটে থাকতেন, ইঞ্জিনিয়ার শফিক সাহেব, উনি গতকাল সকালে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি প্রায় সাত বছর ছিলেন। তার মতো ভালো ভাড়াটে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাকে আমি বড় ভাইয়ের মতো দেখতাম। বিপদে আপদে তার সাহায্য নিতাম। তিনি চলে যাওয়ায় আমি খানিকটা অসহায় বোধ করছি। তার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণটিও বিচিত্র। তিনি যা বললেন সেটা হচ্ছে— আলাউদ্দিন সাহেব কুটু মিয়াকে নিয়ে যেদিন ঐ বাড়িতে উঠলেন সেদিন সন্ধ্যায় রাস্তার একটা কালো কুকুর এসে বাড়ির বারান্দায় স্থায়ী হলো। সন্ধ্যার পর থেকে ঐ কুকুর বাড়ির চারদিকে চক্কর দেয় এবং মানুষের মতো করে কাঁদে। বাড়ির চারপাশে চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে কুকুর বিড়ালের কান্না খুবই অশুভ বলে বিবেচনা করা হয়। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মা অস্থির হয়ে গেলেন। কুকুরটাকে দূর করার চেষ্টা করা হলো— লাঠি দিয়ে তাড়া করলে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার চলে আসে।
পরদিন এই কালো কুকুরটার সঙ্গে আরো দুটা কুকুর যুক্ত হলো। দিনের বেলা এরা কিছু করে না। চুপচাপ বারান্দায় বসে থাকে। সন্ধ্যা মিলার পর থেকেই বাড়ির চারপাশে হাঁটা শুরু করে এবং কান্না শুরু করে। শফিক সাহেব মিউনিসিপালিটিকে খবর দিলেন। ওরা কুকুর ধরা গাড়ি নিয়ে এলো কিন্তু কুকুর ধরতে পারল না। শফিক সাহেব বাজার থেকে মাংস কিনে এনে তাতে বিষ মিশিয়ে খেতে দিলেন। ওরা সেই মাংসে মুখ দিল না।
গত মঙ্গলবার থেকে কুকুরের সংখ্যা হয়েছে চার। এর মধ্যে একটা কুকুর শফিক সাহেবের মেজো মেয়ে এবং কাজের বুয়াকে কামড়েছে। উনার বাচ্চারা কুকুরের ভয়ে ঘর থেকে বের হতে পারে না এমন অবস্থা। উনারা যে চলে গেছেন আমি তাদের দোষ ও দিতে পারছি না। আবার একের পর এক কুকুর এসে জুটছে এটাও মেনে নিতে পারছি না। আগে তো কখনো এই সমস্যা হয় নি। এখন কেন হচ্ছে?
বড় মামার সঙ্গে কথা বলেছি— উনি একজন দারোয়ানের ব্যবস্থা করেছেন। যার একমাত্র কাজ হলো কুকুর আটকানো। আজ সকালে খবর পেয়েছি দারোয়ানকে কুকুর কামড়েছে। একসঙ্গে দুটা কুকুর দুপায়ে কামড়ে ফালা ফালা করে দিয়েছে। নানান জায়গা থেকে খাবলে গোশত নিয়ে নিয়েছে। বড় মামা তাকে নিয়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছেন। তাকে পেথিড্রিন ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে লাখা হয়েছে।
এই হচ্ছে অবস্থা। খুব যে ভালো অবস্থা না, তা তো বুঝতেই পারছ। তবে এইসব নিয়ে তোমরা মোটেই দুশ্চিন্তা করবে না। আমি নিশ্চিত প্রতিটি সমস্যারই আমি সমাধান করব। আমি যে খুব শক্ত মেয়ে তা আর কেউ জানুক বা না জানুক তোমরা দুই বোন জানোকাজেই দুশ্চিন্তা করবে না। আগামীকাল সকালে আমি আমার নিজের বাড়িতে যাব। কুকুরের সমস্যাটা কী নিজের চোখে দেখে আসব। অফিস থেকে দশ দিনের ছুটি নিয়েছিলাম। আগামীকাল ছুটি শেষ। অফিস করতে হবে ভেবেই খারাপ লাগছে। আমার এক মাসের রিক্রিয়েশন লিভ পাওনা আছে। ভাবছি এ ছুটিটা নেব। এবং সব হলে তোমাদের দুবোনকে দেখে আসব। আমার মাথার আউলা ভাব দূর করার জন্যে এটা খুবই দরকার। মা। তোমরা ভালো থেকো। আল্লাহ পাকের দরবারে এই আমার প্রার্থনা।
হামিদা চিঠি শেষ করে উঠল। মাথার চাপা যন্ত্রণাটা এতক্ষণ ছিল না। এখন। আবার শুরু হয়েছে। ক্ষিধেও লেগেছে। নিচে গিয়ে কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। হামিদা বাথরুমে ঢুকে ভালো মতো হাতে মুখে পানি দিল। দুটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে। বিছানায় শুয়ে পড়ল। গত এক সপ্তাহ ধরেই তার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। তার কাছে মনে হচ্ছে অনেক দিন হয়ে গেল সে তৃপ্তি মতো ঘুমুতে পারছে না। কে জানে হয়তো। এই জীবনে সে আর কোনোদিনও তৃপ্তি নিয়ে ঘুমুতে পারবে না।
অনেক দূরে কোথায় যেন কুকুর ডাকছে। ভারী গলায় ডাকছে। শহরে কুকুরের ডাক শোনা অস্বাভাবিক কিছুই না। কিন্তু এই কুকুরটা কি অন্যরকম করে ডাকছে? হামিদা পাশ ফিরল। তার নিজের উপরই বিরক্তি লাগছে। সে এমন দুর্বল। হয়ে যাচ্ছে কেন? কুকুর যেভাবে ডাকে এই কুকুরটাও সেইভাবেই ডাকছে। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে ডাকটা অন্যরকম। মন দুর্বল হলে এ রকম হয়। স্বাভাবিককে মনে হয় অস্বাভাবিক। হামিদা মাথা থেকে কুকুরের ডাকটা সরাবার চেষ্টা করল। সরানো যাচ্ছে না। কুকুরটা ডেকেই যাচ্ছে। এই ডাক বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত হামিদা। ঘুমুতে পারবে না।
দরজায় টোকা পড়ল। হামিদা বলল, কে?
হামিদার কাজের মেয়ে আসিয়া ভীত গলায় বলল, আফা আমি।
হামিদা বলল, কী চাও এত রাতে?
আফনের খাওন আনছি।
আমি তো বলে দিয়েছি রাতে খাব না।
মামি পাঠাইছে। সাথে দুধ আনছি। কিছু না খাইলে দুধটা খান।
হামিদা দরজা খুলল। তার ভালোই ক্ষিধে পেয়েছে। কিছু না খেলে ঘুম ও আসবে না। কুকুরটা ভালো যন্ত্রণা করছে। এখনো ডাকছে। মনে হয় তার গায়ে গরম মড়ি ফেলে দিয়েছে কেউ। ব্যথা না কমা পর্যন্ত সে ডাকতেই থাকবে। হামিদা বলল, লতিফঃ তুমি কি কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছ? বিশ্রী করে একটা কুকুর ডাকছে।
লতিফা বলল, কুত্তার ডাক তো শুনি না আফা।
অনেক দূরে একটা কুকুর ড্রাকছে, শুনতে পাচ্ছ না?
জি না।
হামিদা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। লতিফা কিছু শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু কুকুর ঠিকই ডাকছে। একটা কুকুরের সঙ্গে আরো কয়েকটা কুকুর যুক্ত হয়েছে। আসলে ঘটছে কী?
হামিদা চোখ মুখ শক্ত করে বলল, ভাত দুধ কিছুই খাব না। নিয়ে যাও।
হামিদা চেয়ারে এসে বসল। আর তখনই সে বুঝতে পারল কুকুর দূরে কোথাও ডাকছে না। কুকুর ডাকছে তার মাথার ভেতর। এই লক্ষণ ভালো না। বিরাট অসুস্থতার লক্ষণ। হামিদার এখন উচিত অতি দ্রুত ভালো কোনো ডাক্তারকে দেখানো।
আলাউদ্দিন বললেন, কুটু কুকুরগুলি বড় যন্ত্রণা করছে।
কুটু বলল, জ্বি স্যার।
আলাউদ্দিন বলেন, রাত হলেই ঘেউ ঘেউ। তোমার বিরক্ত লাগে না?
কুটু বলল, কুকুরের কারণে কেউ এদিকে আসে না এইটা একটা ভালো দিক।
তা ঠিক। আমরা নিরিবিলি আছি, তাই না কুটু? কেউ আমাদের বিরক্ত করছে। হাজী সাহেব পাণ্ডুলিপির খোজে আমার কাছে আসবেন না।
জ্বি স্যার।
এদিকে জামিল আসছে না। এটাও খারাপ না।
জ্বি স্যার, এইটাও ভালো। আমার মনে হয় উনি আর এই বাড়িতে আসবেন না।
না এলে আমাদের তো কিছু করার নাই। আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি না আসতেই হবে। না এলে হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা। তুমি আমার স্ত্রী। লিগ্যাল ওয়াইফ।
জ্বি না এরকম বলবেন কেন? আমরা কিন্তু আমাদের মতো। উনি থাকবেন উনার মতো।
আলাউদ্দিন আনন্দিত গলায় বললেন, অবশ্যই।
কুটু বলল, না কি এখন খাইবেন না আরো পরে দিব?
আজকের খানা-টা কী? নতুন কিছু?
জি।
কী রান্না করেছ বলো দেখি।
গরুর মাংস।
ভেরি গুড। আজ সকাল থেকেই গরুর মাংস খেতে ইচ্ছা করছিল। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। ঝাল ঝাল গরুর মাংস, সঙ্গে আলু। তুমি কি মাংসে আলু দিয়েছ?
জ্বি স্যার।
মাঝে মাঝে তোমার কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয় তুমি মনের কথা বুঝতে পার। সত্যি করে বলো তো, তুমি মনের কথা বুঝতে পার?
কুটু প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, খানা খাইতে কি দেরি হইব স্যার?
আলাউদ্দিন বললেন, তাড়াহুড়া করার দরকার কী! ধীরে সুস্থে পাই। এখন যে জিনিসটা খাচ্ছি তার নাম কী?
এর নাম স্যার জিন।
অতি সুস্বাদু। পাইলট স্যার কি এই জিনিস খেতেন?
জ্বি খাইতেন। উনার পছন্দের জিনিস ছিল জিন এবং রাম।
রাম আবার কী?
মিষ্টি জাতীয়। খাইতে ভালো।
তোমার সঙ্গে থেকে অনেক কিছু শিখলাম। রাম, লক্ষণ, সীতা… হা হা হা। রাম তো খাওয়া হয় নি। একদিন ব্যবস্থা করা।
জি আচ্ছা।
আমি একা একা এতসব ভালো জিনিস খাচ্ছি— আমার খারাপই লাগে। তুমি থাও না কেন? তুমিও খাও। কোনো অসুবিধা নেই। আমার কাছে সব মানুষ সমান। বাবুর্চিও যা খাদ্যমন্ত্রী ও তা। যাও, একটা গ্লাস নিয়ে এসো। খেতে খেতে দুজনে গল্প করি।
আমি এইসব জিনিস খাই না স্যার।
খাও না?
জ্বি না।
কোনোদিনই খাও নি?
জ্বি না।
আফসোস, একটা ভালো জিনিস থেকে বঞ্চিত থেকে গেলে। খুবই আফসোসের কথা। কুটু শোন, তোমার কি গরম লাগছে?
স্যার আইজ গরম ভালো পড়ছে।
এক কাজ কর— বাঘটাৰে পানি দাও। পানির মধ্যে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি।
এখন রাইত একটা বাজে। এত রাইতে বাথটাবে নামবেন?
কোনো অসুবিধা আছে?
জি না।
আমি ঠিক করেছি আজ বাথটাবেই ঘুমাব। কেন ঠিক করেছি বলতে পারবে?
গরম লাগছে এই জন্যে।
হয় নাই। দশে শূন্য পেয়েছ। আজ বাথটাবে গোসল করব, কারণ হলো— মানুষের যখন যা করতে ইচ্ছা হয় তা করা উচিত। মানুষ আর বাজে কত দিন! ঠিক না?
জ্বি।
একটা কচ্ছপ তিনশ বছর বাঁচে। আর মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখ। যাট হয়েছে কী শেষ। আমার হয়েছে তিপ্পান, আর মাত্র সাত বছর বাকি। কাজেই আমি ঠিক করেছি এখন থেকে যা করতে ইচ্ছা করবে তাই করব? কে কী চিন্তা করছে
এইসব নিয়ে ভাবব না।
জি আচ্ছা।
বাথটাবে পানি লাগাও। গ্লাস শেষ হয়ে গেছে, এই জিনিস আরো দাও।
জি আচ্ছা।
আমাদের সুখের দিন শেষ হয়ে আসছে কুটু। বুধবার জামিল চলে আসবে।
তাই না?
জি।
চলে এলেও কিছু করার নেই, সব নিয়তি।
জ্বি স্যার নিয়তি।
কুকুরের ডাক মনে হয় একটু কমেছে।
জ্বি কমছে।
সর্বমোট কয়টা কুকুর?
এখন আছে পাঁচটা।
এরা কী করছে? বাড়ির চারদিকে চক্কর দিচ্ছে?
জ্বি স্যার।
খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা। এদের কারণে বাইরের কেউ আমাদের কাছে আসতে পারছে না— এই একটা ভালো দিক। তুমি এখন থেকে এদের এক থালা করে খাবার দিও। জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিচ্ছে ঈশ্বর। কথাগুলি কে বলেছে ভুলে গেছি কিন্তু খুবই দামি কথা। রোজ এদের ভালোমন্দ খাওয়াবে।
জ্বি আচ্ছা।
বাথটাবে কি পানি দেওয়া হয়েছে?
আপনার সঙ্গে কথা বলছি তো স্যার।
বাথরুমে যাই নাই।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বাথরুম থেকে কথা বলো। গ্লাসটা খালি। তাড়াতাড়ি তোমার জিনিস নিয়ে আস। টাইম ইজ শর্ট। অর্থাৎ সময় সীমিত। মাত্র আট বছরেই সব শেষ। আমার আছে মাত্র সাত বছর। বিরাট আফসোস।
রাত তিনটা। বাথটাবে শরীর ডুবিয়ে আলাউদ্দিন শুয়ে আছেন। বাড়ির সমস্ত বাতি নেভানো। তবে বাথরুমে সামান্য আলো আছে। শোবার ঘরে টিভি চলছে। টিভি স্ক্রিনের নীলাভ আলো বাথরুমে পর্যন্ত এসেছে। কুটু মিয়া বাথটাবের পাশে বসে আছে। আলাউদ্দিন চোখ মেলতে পারছেন না। তাঁর কথাও জড়িয়ে আসছে। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। তবে তিনি ঘুমুচ্ছেন না— কষ্ট করে জেগে আছেন। তিনি খুবই আনন্দ। পাচ্ছেন। ঘুমিয়ে পড়লেই তো সব আনন্দ শেষ। আনন্দ উপভোগ করতে হলে। জেগে থাকতে হয়।
কুটু?
জ্বি স্যার।
বড় আনন্দ লাগছে কুট। শুধু চোখ মেলে রাখতে পারছি না— এইটাই সমস্যা।
চোখ বন্ধ কইরা রাখেন স্যার।
রাতে আর ভাত খাব না।
জ্বি আচ্ছা।
এখন থেকে একবেলা ভাত খাব। কুকুরদের যখন খেতে দিবে তখন আমাকেও দিও। ওরা যা খাবে আমিও তাই খাব। কুকুর বলে ওদের অবহেলা করা ঠিক হবে না। কবি বলেছেন— জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। কুকুর ও একটা জীব।
জ্বি।
পাইলট সাহেব কি কুকুর পছন্দ করতেন?
খুবই পছন্দ করতেন। উনার তিন জাতের কুকুর ছিল। এ্যালশেশিয়ান ছিল, জার্মান একটা কুকুর ছিল থাবরা নাকী, আর দুইটা কুকুর ছিল পর্তুগালের। মেয়ে কুকুর। উনি ঐগুলারে আদর কইরা ইকড়ি মিকড়ি নামে ডাকতেন।
উনার বিদেশী আর আমার দেশী নেড়ি কুত্তা। যাই হোক, আমার কাছে দেশী বিদেশী সবই সমান। গাহি সাম্যের গান। আমার চক্ষে দেশী বিদেশী কোনো ভেদাভেদ নাই… আচ্ছা কুটু শোন, প্রায়ই ভাবি একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করব। পরে আর মনে থাকে না। এখন মনে পড়েছে। জিজ্ঞেস করি?
জ্বি স্যার করেন।
পাইলট সাহেব ছাড়াও তো কুয়েতি এক ভদ্রলোকের বাড়িতে তুমি কাজ করতে। তার কথা তো তুমি কিছু বলে না। উনি লোক কেমন ছিলেন?
অতি ভালো লোক ছিলেন স্যার। উনার তিন স্ত্রী ছিল। স্ত্রীদের সঙ্গে বনিবনা হইল না। আলাদা বাড়ি বানায়ে থাকা শুরু করলেন।
শুধু তুমি আর উনি?
জি।
উনার বাড়িতে কি বাথটাব ছিল?
উনি আশীর মানুষ, উনার বাড়িতে বাথটাব তো থাকবই। উনার বাথটাবের সব ফিটিংস ছিল সোনার।
বলো কী?
উনার বাথরুমে সোয়ানা ছিল, জুকুচি ছিল।
ঐগুলা কী?
সোয়ানা হইল পানির গরম ভাপ গোসলের ব্যবস্থা। আর জুকুচি বাথটাবের মতো পানির বুদবুদ হয়। শইলে পানি দিয়া আপনা আপনি ম্যাসাজ হয়।
উনার নাম কী?
শেখ আব্দাল রহমান। অত্যন্ত পরহেজগার আদমি ছিলেন স্যার। যখন উনার শরীরে গোটা গোটা ফোসকা উঠল, উনি বিছানা থেইকা উঠতে পারেন না–তখনো নামাজ কাজা করে নাই। শুইয়া শুইয়া আঙুলের ইশারায় নামাজ পড়ছেন।
আলাউদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, উনার শরীরেও ফোসকা উঠেছিল না কি?
কুটু বলল, জ্বি।
সালাউদ্দিন বললেন, ফোসকার ভেতরে পোকাও ছিল?
জ্বি।
এটা খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা তোমার ভাগ্যে সব ফোসকাওয়ালা লোক পড়ে যাচ্ছে।
জ্বি। এইটা ভাই মনটা খারাপ।
আলাউদ্দিন কুটুকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন, মন খারাপ করবে না। তাদের কপালে ছিল ফোসকা। তুমি আমি কী করব বলো। তোমার আমার কিছুই করার নাই…।
বাক্য শেষ করার আগেই আলাউদ্দিন ঘুমিয়ে পড়লেন। মাঝে মাঝে কুকুরের চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে। তিনি ভীত গলায় ডাকেন— কুটু।
কুটু তার ঘর থেকে সাড়া দেয়— জ্বি স্যার।
আলাউদ্দিন সাহেবের ভয় কেটে যায়, তখন তার গল্প করতে ইচ্ছা করে।
তাঁর কাছে মনে হয় আহারে মানব জনম বড়ই মধুর। আল্লাহপাক মানুষ বানিয়ে তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে বলেই না তিনি এত আনন্দ করতে পারছেন। মুরগি বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠালে তো কুটু মিয়া জাতীয় কেউ একজন তাকে রান্না করে ফেলত। লোক খেয়ে বলত— মজা হয়েছে তবে ঝাল একটু বেশি। গরু বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠালে লোকজন তার শরীরের চামড়ায় জুতা বানিয়ে হাঁটাহাঁটি। করত। তার কত সৌভাগ্য মানুষ হয়ে তিনি পৃথিবীতে এসেছেন। পাইলট স্যারের মতো ভাগ্যবান হতে পারেন নাই। জীবনে কখনো বিমানে চড়েন নাই পাইলট হওয়া তো দূরের কথা। পাইলট না হয়েও তিনি যা পেয়েছেন তাও তো কম না। এই পরম সৌভাগ্য নিয়ে কথা বলার জন্যে তিনি ছটফট করতে থাকেন। এক সময় অস্থির হয়ে ডাকেন, কুটু কুটু কুটু।
কুটু সাড়া দেয় না। কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করতে থাকে।
কে দেখা করতে এসেছে
আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে? কে দেখা করতে এসেছে?
ঐ যে লোকটা শইল্যে বন ঘেরান।
কুটু মিয়া?
জ্বে কুটু মিয়া। আাগো আমার ডর লাগতাছে।
হামিদা বিছানায় শুয়ে ছিল, উঠে বসল। তার ইচ্ছা আসিয়াকে একটা কড়া। ধমক দেয়। আহ্লাদী ধরনের কথা অসহ্য লাগে। আমার ভয় লাগতাছে মানে কী? ভর লাগার কী হয়েছে? এইসব হচ্ছে মন রাখার কথা। আলিয়া বুঝতে পারছে কুটুকে তার আপা অপছন্দ করছে- কাজেই সে ডুর লাগার কথা বলছে। যদি এমন হতো সে কুটুকে পছন্দ করত তাহলে আসিয়া বলত— লোকটা এমুন ভালো। দেখলেই মনে শান্তি শান্তি লাগে।
হামিদা বলল, সে কী চায়?
আফনের সাথে কথা বলতে চায়। হাতে আইসক্রিমের বাটি। মনে হয় তরকারি আনছে। আফাগো হের তরকারি খাইয়েন না। হের শইল দিয়া ভুরভুর কইরা পচা গোবরের বাস আসতাছে।
হামিদা বলল, আসিয়া এত কথা বলার দরকার নেই। আমি ওর তরকারি খাব কি খাব না সেটা আমি ঠিক করব। আজ কি বার?
বুধবার।
আজ কি নয় তারিখ?
জানি না আফা।
আজ যে নয় তারিখ, বুধবার এই তথ্য হামিদার জানা আছে। তারপরেও অন্যের কাছে জানতে চাওয়ার অর্থ কি এই যে হামিদা চাচ্ছে না আজকের দিনটা বুধবার হোক? তার অবচেতন মন আসিয়ার কাছ থেকে অন্য কিছু শুনতে চাচ্ছে। হামিদা খাট থেকে নামল। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের কোণার দিকে তাকাল। দুটা সুটকেস রেডি করা আছে। কুটুর হাতে স্যুটকেস দুটা দিয়ে সে এখনই চলে যেতে পারে। যেতেই মুম্বন হবে আগে যাওয়াই কি ভালো না? কিন্তু মন টুনিছে না। একেবারেই মন টানছে না।
হাজী সাহেবের বসার ঘরে কুটু দাঁড়িয়ে আছে। হামিদাকে দেখে সে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিল। হামিদা বলল, কী ব্যাপার কুটু?
কুটু জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কুটুর গা থেকে কোনো পচা গন্ধ আসছে না। লেবুর গন্ধের মতো গন্ধ আসছে। অতি হালকা ঘ্রাণ কিন্তু স্পষ্ট। লেবু বাগানে যখন লেবু ফুল ফুটে তখন বাগানের আশেপাশে এমন সৌরভ পাওয়া যায়। আসিয়া বলছিল পচা গোবরের গন্ধ। আসিয়ার কথা সত্যি না।
হামিদা দ্রুত চিন্তা করছে। কুটুর গা থেকে আগেও একবার লেবুর গন্ধ এসেছিল। আজ আসছে। এর পেছনে কোনো কারণ কি আছে? কুটু কি জানে লেবুর গন্ধ তার খুব পছন্দের?
কুটু বলল, আপনার জন্য তরকারি আনছি। কাইল রাইতে এই তরকারিটা খাইয়া স্যার খুব পছন্দ করছিলেন। স্যার বললেন, আপনার জন্য এক বাটি পাঠাইতে।
হামিদা বলল, তুমি কিসের তরকারি এনে আমি একটু আন্দাজ করি। দেখি আমার আন্দাজ ঠিক হয় কি-না। তুমি এনেছ শিং মাছের ডিমের তরকারি। আমার আন্দাজ কি ঠিক হয়েছে?
কুটু চাপা গলায় বলল, জ্বি আপা।
হামিদা বলল, আমার অনুমান করার শক্তি দেখে তুমি মুগ্ধ হও নি?
কুটু জবাব দিল না। হামিদা বলল, আমি নিজে কিন্তু মুগ্ধ হয়েছি। অনুমান। কীভাবে করলাম জানো? শিং মাছের ডিমের কোল আমার খুব পছন্দের। দেশের বাড়িতে মা এই রান্নাটা রাধতেন। ভালো কোনো খাবারের কথা মনে হলেই আমার শিং মাছের ডিমের কথা মনে হয়। আমার পছন্দের জিনিসগুলি তুমি কীভাবে টের পাচ্ছ?
কুটু মেঝের দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে। যে আইসক্রিমের বাটিতে করে সে ডিম নিয়ে এসেছিল সেই বাটি সে এখন পিঠের দিকে সরিয়ে রেখেছে।
হামিদা বলল, তুমি কি মানুষের মনের কষ্মা বুঝতে পার? দাঁড়িয়ে থেক না। কথার উত্তর দাও।
কুটু না-সূচক মাথা নাড়ল।
হামিদা বলল, তুমি আমাকে চা বানিয়ে খাইয়েছিলে। দেখা গেল যে চা আমাকে খাইয়ে সেই মশলা চা অনেক দিন থেকেই আমার খাওয়ার শঙ্খ। আমার জন; তরকারি নিয়ে এসেছ। দেখা গেল যে তরকারি এনেছ সেই তরকারি অনেক দিন থেকে আমার খাওয়ার শখ। আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।
কুটু বিড়বিড় করে বলল, আমি নিজেও কিছু বুঝি না আপা।
হামিদা বলল, আজ আমি ঐ বাড়িতে যাচ্ছি। সে-রকম কথা আছে। তুমি কি সেটা জানো?
জানি।
যদি জানো তাহলে তরকারি নিয়ে এলে কেন?
কুটু নিচু গলায় বলল, আপনারে বলতে আসছি যেন আপনি না যান।
আমার নিজের বাড়িতে আমি যাব না?
অবশ্যই যাইবেন আপা। কয়েকটা দিন পরে যাইবেন। কয়েকটা কুত্তা আইসা। জুটছে। কুত্তাগুলা খুবই উপদ্রব করতেছে। এর মধ্যে একটা কুত্তার হইছে জ্বলাতঙ্ক। পাগলা কুত্তা।
তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? আমি আমার নিজের বাড়িতে যাব না— কুকুরের ভয়ে? আমি অবশই যাব। আজই যাব।
জ্বি আচ্ছা।
কুটু শোন, বাড়িতে গিয়ে আমি যেন তোমাকে দেখতে না পাই। তোমার চাকরি অনেক দিন হয়েছে। এখন চাকরি শেষ। বুঝতে পারছ কী বলছি?
জ্বি। তরকারিটা কি রাইখা যাব, না নিয়ে যাব?
হামিদা ক্লান্ত গলায় বলল, তরকারি যা ইচ্ছা কর। ঐ তরকারি আমি খাব না। এখন আমার সামনে থেকে বিদেয় হও। সাময়িক বিদায় না পুরোপুরি বিদায়। আমি আমার বাড়িতে যখন যাব তখন যেন তোমাকে না দেখি।
হাজী সাহেব বইয়ের দোকানে বসে আছেন। তাঁর চোখ মুখ শুকনা। মুখ হা করা। তিনি পান খাচ্ছিলেন। পান চিবানো বন্ধ হওয়ায় মুখে পানের রসের আস্তরণ জমে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার মুখের ভিতরে খয়েরি রং করে দিয়েছে। হাজী সাহেব দশ মিনিট আগে খবর পেয়েছেন ইয়াকুব ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে। কুকুরের কামড়ে কেউ মারা গেছে এটা তিনি আগে শুনেন নি। কুকুর সুন্দরবনের বাঘ না। ঝেড়ে লাথি দিলে কুকুর পালাবার পথ পায় না। সেই কুকুর কামড়ে মানুষ মেরে ফেলেছে— এটা কেমন কথা!
ইয়াকুবের এক চাচাতো ভাই দোকানের সামনে এসে বিরাট হৈচৈ শুরু করেছে। তাকে ঘিরে মানুষের ভিড়। সে আকাশ ফাটিয়ে চিক্কার করছে— কুত্তা দিয়া আমার ভাইরে খাওয়াইছে। কী সর্বনাশ করছে গো! কুত্তা দিয়া আমার ভাইরে খাওয়াইছে। আফনেরা বিচার করেন। আমার আদরের ভাইরে কুত্তা খাইয়া সেলাইই।
হাজী সাহেব ম্যানেজারকে বললেন, টাকা দিয়ে যেন এর মুখ বন্ধ করা হয়। তারপর আড়ালে নিয়ে যেন শক্ত থাপ্পড় দেয়া হয়।
হাজী সাহেবের মেজাজ খুবই খারাপ হয়েছে। তার সামনে নানান ঝামেলা। হাসপাতাল থেকে ডেডবড়ি আসবে। সেই ডেডবড়ি গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে। সঙ্গে টাকা পয়সা দিতে হবে। পুলিশের ঝামেলা ও হবে। গন্ধে গন্ধে পুলিশ চলে আসবে। অস্বাভাবিক মৃত্যু মানেই পুলিশের মুখে হাসি। ওসি সাহেব তদন্তে আসবেন। গলা নিচু করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলবেন- ইয়াকুব হলো প্রেসের কর্মচারী। সে তো দারোয়ানের কাজ জানে না। তারপরেও তাকে আপনি দারোয়ানের কাজে কেন পাঠালেন?
যে কুকুরগুলি মানুষ মেরেছে তারা তো আপনার ভাগ্নির পোষা কুকুর। আমরা গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি কুকুরগুলি আপনাদের লোকের ইশারায় ঝাপিয়ে পড়েছে। ঘটনা কি সত্যি সত্যি হোক আর মিথ্যা হোক, আপনাকে আর আপনার ভাগ্নিকে একটু থানায় যেতে হবে।
পুলিশের হয়রানি থেকে বাঁচার জন্যে ম্যানেজারকে আগেভাগেই থানায় পাঠানো দরকার। হামিদার বাড়িতেও যাওয়া দরকার। আলাউদ্দিনকে সবকিছু বুঝিয়ে আসতে হবে। পুলিশ যদি তদন্তে আসে তাহলে যেন উল্টাপাল্টা কিছু না। বলে। তাকে বলতে হবে নকশন কুকুর কামড়েছে আমি কিছুই জানি না। আমার শরীর খারাপ ছিল। আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছিলাম।
লাশের সুরতহাল হবে। সুরতহালের রিপোর্টে যেন কিছু না থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সুরতহাল যে ডাক্তার করবে তাকে টাকা খাইয়ে রাখতে হবে। যেন সে ঠিকঠাক লেখে কুকুরের কামড়ে মৃত্যু। উল্টাপাল্টা কোনো লাইন লিখে ফেললে সাড়ে সর্বনাশ।
হাজী সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। সভাবে মরেও রক্ষা নাই। চারদিকে টাকা খাওয়াতে হচ্ছে। এরচে আফসোসের কারণ আর কী হতে পারে! ইয়াকুবের ভাইয়ের চিঙ্কার বন্ধ হয়েছে। তাকে সাতশ টাকা দেয়া হয়েছে। সে এখন বেশ খুশি মনেই দোকানের এক কোণায় বসে পিরিচে ঢেলে চা খাচ্ছে। দোকানের সামনে মানুষের ভিড় কমছে না। বরং বাড়ছে।
হাজী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। আজ আর দোকান খোলা রাখা যাবে না। বসতে হলে প্রেসে গিয়ে বসতে হবে। তারও আগে আলাউদ্দিনের কাছে যেতে হবে। হামিদাকে আজ কেন আনলেন সেটা তাকে বলা দরকার। সে নিশ্চয়ই আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। হয়তো দেখা যাবে হামিদার বাড়ির সামনে ও রাজ্যের ভিড়। টিভি ক্যামেরা চলে এসেছে। চ্যানেল গুলি চালু হওয়ায় আজকাল নতুন জিনিস শুরু হয়েছে। অন দা স্পট নিউজ। চেংড়া কোনো ছেলে হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে হামিদার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট করবে—
এই সেই ঘাতক বাড়ি। এই বাড়িরই দুটি কুকুরের আক্রমণ প্রাণ দিতে হলো নিরীহ ইয়াকুবকে। ঐ যে দেখা যাচ্ছে ঘাতক কুকুর দুটিকে। তাদের শান্ত চেহারা, আলস্যের লেজ নাড়া লেখে কে বলবে এরা দুই হন্তারক!
হাজী সাহেব হামিদার বাড়ির সামনে এসে খুবই অবাক হলেন। নিরিবিলি বাড়ি পড়ে আছে। চারপাশে কেউ নেই। হাজী সাহেব ভয়ে ভয়ে গেট খুললেন। তার মনে শঙ্কা কখন কুকুর দুটি ছুটে আসে। বাড়ির আশেপাশে কোনো কুকুরই নেই। দোতলায় উঠার সিড়ির গোড়ায় একটা কালো কুকুর দেখা গেল। সে হাজী। সাহেবকে দেখে কুঁই কুঁই করে উঠে চলে গেল। কুকুরটাকে মোটেই ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। রাস্তার নেড়ি কুকুর কখনো ভয়ঙ্কর হয় না। এদের জীবন কাটে ডাস্টবিনে ডাস্টবিনে খাবারের সন্ধানে। কুকুরসুলভ গুণাবলী এদের মধ্যে দেখা যায় না। হাজী সাহেব কুকুরটার দিকে তাকিয়ে যাহ বলতেই কুকুরটা যেভাবে চমকে লাফিয়ে উঠল এবং কুই কুই করতে করতে পালিয়ে গেল তা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় মানুষকে কামড়ানোর সাহস এই কুকুর কোনোদিনও সংগ্রহ করতে পারবে না।
কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিল কুটু। সে হাজী সাহেবকে দেখে বিয়ে। প্রায় নুয়ে গেল। হাজী সাহেব বললেন, কেমন আছ?
কুটু বলল, ভালো আছি জনাব।
আলাউদ্দিন বাসায় আছে?
জি আছেন। শুয়ে আছেন।
শুয়ে আছে কেন? শরীর খারাপ
জি।
হয়েছে কী–জ্বর?
জ্বর সামান্য আছে। শইলে পানি আইছে।
বলো কি? ডাক্তার দেখিয়েই?
জ্বি না। দেখি স্যার যদি রাজি হন তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়া যাব।
আলাউদ্দিনকে দেখে হাজী সাহেব চমকে উঠলেন। এই কদিনে কী হয়েছে। মানুষটাকে তো চেনাই যাচ্ছে না। মুখ এ ফুলেছ যে চোখই ঢাকা পড়ার অবস্থা। জায়গায় জায়গায় চুল উঠে যাচ্ছে। এখন তাঁর মাথায় খাবলা খাবলা চুল। শরীরে মনে হয় রক্ত নেই। মুখ সাদা, ঠোঁট সাদা। হাজী সাহেব কুটুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘরে বিকটু পচা গন্ধ। গন্ধটা কোথেকে আসছে?
কুটু বলল, ইঁদুর মইরা পইচা গেছে। পচা ইঁদুরের গন্ধ। কোন চিপা চাপায় মরছে খুঁইজা পাইতেছি না।
দরজা জানালাও তো সব বন্ধ। দরজা জানালা খোল, পর্দা সরাও, ঘরে আলো বাতাস আসুক। দরজা জানালা খুলে রাখলে পচা গন্ধ কিছু কমবে। মেঝে ফিনাইল। দিয়ে ধুয়ে দাও।
কুটু মিয়া বলল, জ্বি আচ্ছা।
হাজী সাহেব আলাউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ব্যাপারটা কী বলো তো?
আলাউদ্দিন ফিসফিস করে বললেন, আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাই।
হাজী সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ক্ষমা চাচ্ছ কেন? অপরাধটা কী করেছ?
বইটা লিখতে পারছি না। হস্তরেখা বিজ্ঞান।
তোমার শরীরের যে অবস্থা— এই অবস্থায় বই লেখা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুমি অতি দ্রুত কোনো হাসপাতালে বা ক্লিনিকে ভর্তি হও। আজ কালের মধ্যে ভর্তি হও।
আলাউদ্দিন বললেন, আমার শরীরটা দুর্বল, এছাড়া আর কোনো অসুখ বিসুখ নাই।
হাজী সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কী বলছ অসুখ বিসুখ নাই! তোমার তো হাত পায়ের সব আঙুল নীল হয়ে আছে। আমার ধারণা তোমার সিরিয়াস কিছু হয়েছে। অবশ্যই তুমি আজ ডাক্তারের কাছে যাবে। আমি সন্ধ্যাবেলা গাড়ি নিয়ে আসব। তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ডাক্তার বললে হাসপাতালে ভর্তি হবে।
আলাউদ্দিন বললেন, জি আচ্ছা।
তুমি তৈরি থাকবে। আমি ঠিক চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে চলে আসব। হামিদাকে আজ আর অনলাম না। তোমাকে ডাক্তার নিশ্চয়ই হাসপাতালে ভর্তি করবে। হামিদা খালি বাড়িতে এসে কী করবে! ও কয়েক দিন পরে আসুক। আমি তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।
জি আচ্ছা। আপনার অনেক মেহেরবানি।
মেহেরবানির কিছু না, এটা আমার কর্তব্য। তুমি তো বাইরের কেউ না। তুমি এখন আমার আত্মীয়। ভাগ্নিজামাই। তোমাকে তো আমি আসল কথাই বলতে ভুলে গিয়েছি। তোমার কাছে পুলিশ আসতে পারে। যদি আসে, বলবে আমি কিছুই জানি না। আমার শরীর খারাপ। রাত আটটার সময় দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছি।
আলাউদ্দিন বলল, আপনার কথা বুঝতে পারছি না। আমি কী জানি না?
ইয়াকুবকে কখন কুকুরে কামড়েছে আর কখন সে মারা গেছে কিছুই জানো। না।
আমি তো আসলেই কিছু জানি না। ইয়াকুব কে?
কিছু যদি না জানো তাহলে ইয়াকুব কে এটাও জানার দরকার নেই। এই জগতে যত কম জানা যায় ততই ভালো। আমি উঠলাম। বিকেলে আসব। হামিদাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসি। তুমি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাও।
আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। হাসপাতালে ভর্তি হতে বললে ভর্তি হব। যদি বলেন এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে আমি চলে যাব।
হাজী সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সেটা আমি জানি। তুমি নিতান্তই ভালো মানুষ। আফসোস, হামিদা এটা বুঝতে পারছে না। যাই হোক তোমার ঘরে আমি আর থাকতে পারছি না। পচা গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তোমার বাবুর্চিকে বলে সে যেন খাট পালঙ্ক সরিয়ে মরা ইঁদুর খুঁজে বের করে। গন্ধেই তো। মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে।
আলাউদ্দিন বললেন, আমার বাবুর্চি বিষয়ে একটা কথা ছিল। হামিদা বলেছে বাবুর্চিকে বিদায় করে দিতে। আজকেই চলে যেতে বলেছে। তাকে কি বিদায় করে দেব।
হাজী সাহেব বললেন, আরে না ও থাকুক। যেতে হলে পরে যাবে। এখন। তাকে বলে— পচা ইঁদুরটা খুঁজে বের করতে।
আলাউদ্দিন চুপ করে রইলেন। পচা ইদরটা কোথায় তিনি জানেন। বুক। শেলফের পেছনে। কুটু মিয়াই এনে রেখেছে। কুটুর যুক্তি হলো— মদ যারা খায়। তাদের মুখ থেকে মদের গন্ধ বের হয়। ঘরে কোনো পচা ইঁদুর থাকলে সেই ইঁদুরের বিকট গন্ধে অন্য গন্ধ কেউ টের পাবে না। আলাউদ্দিন কুটুর বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। আসলেই তো ঘটনা সে-রকম। হাজী সাহেব কিছুই টের পান নি। পচা ইঁদুরের গন্ধে আলাউদ্দিনের নিজের অসুবিধা হচ্ছে না। পচা গন্ধটা নাকে সয়ে গেছে।
হাজী সাহেব দোতলার সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন। সিঁড়ির গোড়ায় কালো কুকুরটা দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে আরেকটা কুকুর যুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় কুকুরটা ছোট। দুটা কুকুরই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাদের চোখ চকচক করছে। শ্বাপদ প্রাণীদের চোখ রাতে জ্বলে, এদের দেখা যাচ্ছে দিনেই জ্বলছে। হাজী সাহেব উপর থেকে বললেন- এই যাহ!
দুটা কুকুর দুদিকে সরে গেল। তবে বেশি দূর গেল না। মাঝখানে জায়গা রেখে দুপাশে দাঁড়াল। এবং তাকিয়ে রইল হাজী সাহেবের দিকে। এক মুহূর্তের জানো ও দৃষ্টি সরালি না।
হাজী সাহেব একবার ভাবলেন কুটুকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। হাতে লাঠিসোঠা থাকবে। কুকুর দুটিকে দেখতে ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। রাস্তার নেড়ি কুকুর যেরকম থাকে সে-রকম। কিন্তু এরাই তো ইয়াকুবকে কামড়ে মেরে ফেলেছে। যদি তাকে তাড়া করে। তাছাড়া এদের চোখের দৃষ্টি ভালো না। হাজী সাহেব নিচে নেমে এলেন। তিনি ঠিক করে রেখেছেন যদি তাকে দেখে কুকুর দুটা কাছে এগিয়ে আসে তাহলেই দোতলায় উঠে কুটুকে নিয়ে আসবেন। কুকুব দুটা যে-রকম দাঁড়িয়ে ছিল সে-রকম দাঁড়িয়ে রইল। হাজী সাহেব উঠোনে নামলেন।
কুকুর দুটা এখনো তাকিয়ে আছে। লেজ নাড়ছে, কিন্তু নড়ছে না। তিনি গেটের দিকে এগুচ্ছেন। কুকুর দুটা এখন তার পেছনে পেছনে আসছে। তার কাছে হঠাৎ মনে হলো এরা তাঁকে কামড়াবে। অবশ্যই কামড়াবে। যে-কোনো মুহূর্তে দুজন দুদিক থেকে তাঁর গায়ে ঝাপিয়ে পড়বে। আতঙ্কে হাজী সাহেবের শরীর হিম হয়ে গেল। তিনি শুনেছেন মানুষ যদি ভয় পায় কুকুর সেই ভয় বুঝতে পেরে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ভয় পাওয়া যাবে না। কিন্তু তিনি ভয়ের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। তার কপাল ঘামছে। প্রবল ইচ্ছা করছে দৌড় দিতে। তিনি গেটের কাছাকাছি চলে এসেছেন। কুকুর দুটার কিছু বোঝার আগেই তিনি দৌড়ে গেট পার হতে পারবেন। কিন্তু দৌড়ানো ঠিক হবে না। কুকুরের সামনে যারাই দৌড় দিয়েছে তারাই কুকুরের কামড় খেয়েছে। ইয়াকুব হঠাৎ ভয় পেয়ে দৌড় দিয়েছিল বলেই কামড় খেয়েছে।
হাজী সাহেব গেট পার হলেন। এখন তিনি রাস্তায়। রাস্তার পাশে গাছের নিচে একটা খালি রিকশা আছে। রিকশায় কোনোমতে উঠে পড়তে পারলে আর ভয় নেই। চলন্ত রিকশার কোনো যাত্রীকে কুকুর কামড়েছে বলে শোনা যায় না। এই কুকুর দুটা পাগলা কুকুরও না। পাগলা কুকুরের চালচলন আলাদা থাকে। এরা সারাক্ষণ মুখ হা করে থাকে। মুখ দিয়ে লালা পড়ে। পাগলা কুকুরের লেজ নামানো থাকে। এই কুকুর দুটির লেঞ্জ নামানো না। ভ্ৰাদের মুখ দিয়ে লালা ও পাড়ছে না।
হাজী সাহেব রিকশায় উঠলেন। রিকশাওয়ালাকে ক্ষীণ স্বরে বললেন, বাংলাবাজার যাও। রিকশাওয়ালা রিকশা চালাচ্ছে। কুকুর দুটা পেছনে পেছনে আসছে। আসুক, এখন আর কোনো সমস্যা নেই। হাজী সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আর তখনই কুকুর দুটা দুদিক থেকে এসে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। তিনি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। রিকশা উল্টে গেল। কুকুর দুটা পায়ের মাংসে দাঁত বসিয়ে দিয়েছে। রিকশা উল্টে যাবার পরও এরা পালিয়ে গেল না। দাত বসিয়ে রাখল।
তিনি দুই হাত দিয়ে কালো কুকুরটার মাথা সরাতে চেষ্টা করলেন। কালো কুকুরটা তার পা ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকাল। এবং তার মুখের দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। তার কাছে মনে হলো কুকুরটা প্রকাণ্ড হা করেছে। কুকুরটা এখন তার পুরো মাথাটাই তার মুখের ভেতর ঢুকিয়ে নেবে।
তিনি চিৎকার করে বললেন, বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও।
হাজী সাহেবকে যখন কুকুর কামড়ে ধরেছে তখন হামিদা বাথরুমে গোসল করছিল। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে শাওয়ারের নিচে মাথা দিয়েছে তখনই সে কুকুর দুটার গর্জন শুনল। সেই সঙ্গে স্পষ্ট শুনল— তার মামা চিৎকার করছেন, বাঁচাও আমাকে বাঁচাও।
বাথরুম থেকে আধভেজা হয়ে সে ছুটে বের হলো। সিড়ি দিয়ে সে ছুটে নামছিল এবং চিৎকার করছিল, মামাকে কুকুর মেরে ফেলছে। মামাকে কুকুর মেরে ফেলছে।
ঘরটা সুন্দর
ঘরটা সুন্দর।
ডাক্তারের চেম্বার বলে মনে হয় না। পরিষ্কার দেয়ালে সুন্দর সুন্দর ছবি। পেইন্টিং না, ফটোগ্রাফ। একটা ছবিতে আট ন বছরের একটি মেয়ে কাঁদছে। তার চোখের পাপড়িতে বৃষ্টির ফোঁটার মতো অশ্রু জমা হয়ে আছে। হামিদা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। ডাক্তার সাহেব বললেন, আমার মেয়ের ছবি। আমার তোলা ছবি।
হামিদা বলল, অপূর্ব।
ডাক্তার সাহেব বললেন, ছবিটা অপূর্ব ঠিকই। কিন্তু ছবিটার ভেতর ফাঁকি আছে। ফাঁকির কথাটা যেই আপনাকে বলব আপনার আর ছবিটা অপূর্ব মনে হবে না।
ফাঁকিটা কী?
আমার মেয়ে কাঁদছিল না। ড্রপার দিয়ে এক ফোঁটা পানি তার চোখের পাপড়িতে দিয়ে ছবিটা তোলা। বাইরে থেকে চোখের পাপড়িতে আলো ফেলা হয়েছে যেন নকল অশ্রু বিন্দু ঝকমক করতে থাকে। এখন কি আপনার কাছে ছবিটা আগের মতো সুন্দর লাগছে?
হামিদা বলল, না। কিন্তু আপনি যে ফাঁকির ঘটনা স্বীকার করলেন এই জন্যে ভালো লাগছে। আমরা সবাই নানানভাবে ফাঁকি দেই কিন্তু কখনো স্বীকার করি না।
ডাক্তার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন ফাঁকির ঘটনা স্বীকার করাও অমাির একটা টেকনিক। যখন রোগীর কাছে ফার্কির ব্যাপারটা স্বীকার করি তখন তারা আমাকে একজন সৎ এবং ভালো মানুষ হিসেবে গ্রহণ করে। আমার প্রতি তাদের এক ধরনের বিশ্বাস তৈরি হয়। রোগী ভরসা পায়। আমরা যারা মনোবিদ্যার চিকিৎসক তাদের জন্যে রোগীর কনফিডেন্সটা অসম্ভব দরকার।
হামিদা বলল, আপনার প্রতি আমার কনফিডেন্স তৈরি হয়েছে। আপনি যদি কিছু জানতে চান আমি বলব। আপনি আমার মাথার ভেতর থেকে কুকুরের ডাকটা দূর করে দিন।
ডাক্তার সাহেব বললেন, চা খাবেন?
হামিদা বলল, আমার ঘনঘন চা খাবার অভ্যাস নেই।
ডাক্তার সাহেব বললেন, চায়ের একটা কাপ হাতে থাকা মানে এক ধরনের ভরসা। অসহায় বোধ করলে চায়ের পেয়ালা স্পর্শ করবেন। গরম কাপের স্পর্শে মনে হবে জীবন্ত কেউ আপনার কাছে আছে।
হামিদা বলল, চা দিন।
ডাক্তার সাহেব ফ্লাস্ক থেকে এক মগ চা ঢেলে হামিদার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন— মাঝে মাঝে আমাদের কানে বাস্তব কিছু সমস্যা হয়। ইনার ইয়ারে খুব সূক্ষ্ম একটা হাড় থাকে। হাড়টা থাকে তরল পদার্থে ডুবানো। এই তরলে যখন কোনো সমস্যা হয় ঘনত্বের সমস্যা, ভিসকোসিটির সমস্যা, ইলেকট্রিক্যাল সমস্যা তখন মানুষ মাথার ভেতর নানা রকম শব্দ শুনে। কেউ শুনে ঝিঝির ডাক, কেউ শুনে ঘুণপোকার ডাক। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস আছে, নাম ঘুণপোকা। সেই উপন্যাসের নায়কের মাথার ভিতর সব সময় ঘুণপোকা ডাকত। আপনি কি উপন্যাসটা পড়েছেন?
জ্বি-না। আমার কানে কোনো সমস্যা নেই। ইএনটি স্পেশালিস্টকে দেখিয়েছি। তারা নানান রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এবং যে কুকুরগুলির ডাক আমি শুনি ওরা কল্পনার কোনো কুকুর না। এদের অস্তিত্ব আছে। আমি তো আপনাকে বলেছি এরা থাকে আমার বাড়িতে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, কুকুর নিয়ে আপনি খুব বেশি ভেবেছেন। কারণ এর আপনার সাজানো সংসারে সমস্যা তৈরি করেছে। কুকুরের কারণে ভাড়াটে চলে গেছে। অতিরিক্ত চিন্তার কারণে কুকুরের ডাক আপনার মাথায় ঢুকে গেছে। মস্তিষ্কের নিউরনে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ রকম যদি চলতে থাকে আপনি শুধু যে কুকুরের ডাক শুনবেন তা না। কুকুরগুলি দেখতেও পাবেন। হঠাৎ গভীর রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায় তাহলে দেখবেন আপনার ধারে কয়েকটা কুকুর বসে আছে। অডিটরি হেলুসিনেশন ভিস্যুয়েল হেলুসিনেশনে রূপ নেবে।
এর হাত থেকে বাঁচার উপায় কী?
বাচার একটাই উপায়— হেলসিনেশনের ব্যাখ্যাটা বিশ্বাস করা। এবং হেলুসিনেশনকে গুরুত্ব না দেয়া। তাছাড়া আমি আপনাকে ওষুধপত্র দেব। আগে মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে মনোরোগের চিকিৎসা করা হতো। এখন আমাদের হাতে অনেক পাওয়ারফুল ড্রাগস আছে। আমি যে কথাগুলি বলছি আপনি কি বিশ্বাস
হামিদা বলল, বিশ্বাস করার চেষ্টা করছি। পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না।
কেন পারছেন না?
আমি নিজে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। আপনাকে বলব?
বলুন।
আমি একশ ভাগ নিশ্চিত কেউ একজন পরিকল্পিতভাবে ঘটনাগুলি ঘটাচ্ছে। যেন আমি আমার বাড়িতে ফিরে না যাই। গোপন কিছু আমার বাড়িতে হচ্ছে। নিষিদ্ধ কোনো কর্মকাণ্ড। তারা চাচ্ছে না আমি সেই কর্মকাণ্ড জেনে ফেলি।
ডাক্তার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আপনার ধারণা নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড করছে আপনার স্বামী আলাউদ্দিন সাহেব এবং তার হেল্পিং হ্যান্ড মিস্টার কুটু মিয়া?
জি। কুটু মিয়ার সুপারন্যাচারেল কিছু ক্ষমতা আছে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি খুব একটা ভুল বিশ্বাস নিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা। করার চেষ্টা করছেন। মানুষকে নানান প্রতিভা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছেসাহিত্যের প্রতিভা, সঙ্গীতের প্রতিভা, বিজ্ঞানের প্রতিভা কিন্তু সুপারন্যাচারেল কোনো ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয় নি।
হামিদা বলল, মূসা নবীকে কিন্তু ক্ষমতা দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। তিনি হাতের লাঠি যখন মাটিতে ফেলতেন সেই লাঠি সাপ হয়ে যেত।
ডাক্তার সাহেব বললেন, ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানকে মিলানো ঠিক হবে না। থিওসফি এবং পদার্থবিদ্যা এক জিনিস না।
কুটুর যে সুপারন্যাচারাল ক্ষমতা আছে এটা আপনি বিশ্বাস করছেন না। আমি কিন্তু এ ব্যাপারে নিশ্চিত। আমি আপনাকে কিছু ঘটনার কথাও বলেছি। আপনার কি ধারণা আমি মিথ্যা কথা বলছি?
না, আপনি সত্যি কথাই বলছেন। আপনি যা সত্যি বলে বিশ্বাস করছেন তাই বলছেন। আপনার সত্যি এবং আমার সত্যি এক নাও হতে পারে। এক কাজ করলে কেমন হয়— আপনি কুটু মিয়াকে এখানে নিয়ে আসুন কিংবা আমাকে তার কাছে নিয়ে চলুন।
আপনি যাবেন?
অবশ্যই যাব। মানুষ হিসেবে আমি খুবই কৌতূহলী। আমি তাকে জিজ্ঞেস করব— আমার সবচে প্রিয় খাবারের নাম বলতে। তাকে সেই খাবার তৈরি করতে হবে না। নাম বললেই হবে। আমি নিশ্চিত সে বলতে পারবে না। আমার সবচে প্রিয় খাবার হলো হিদল ভর্তা। এবং আমার প্রিয় পারফিউম হলো— পয়জন। কুটু মিয়ার গা থেকে পয়জনের গন্ধ আসে কি-না দেখি। লেবু ফুলের গন্ধ যদি আসতে পারে পয়জনের গন্ধ আসবে না কেন?
কবে যাবেন?
কাল চলুন। দেরি করে লাভ কী? কাল সকাল দশটায় এখানে আসুন, আমি তৈরি থাকব। আজকের মতো বিদায়।
হামিদা বলল, আমাকে ওষুধ দেবেন না?
ডাক্তার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, কুটু মিয়ার সঙ্গে দেখা করার পর আপনাকে ওষুব দেব। আপনাকে কী ডোজে ওষুধ দিতে হবে এটা ঠিক করার জন্যে কুটু মিয়ার সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার।
হামিদা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল ডাক্তার সাহেব, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমি খুবই অনাগ্রহ নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে এসেছিলাম। সেই অনাগ্রহ এখন আর নেই। আমি নিশ্চিত আপনি আমার মাথা থেকে কুকুরের ডাক দূর করতে পারবেন। তবে, ডাক্তার সাহেব বললেন, তবে মানে! তবে কী?
আমার ধারণা কটু এমন কোনো ব্যবস্থা করবে যে আপনি তার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।
কুটর এত ক্ষমতা?
হ্যাঁ তার এত ক্ষমতা।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি কন্ডিশন্ড হয়ে আছেন। আপনার রোগ সারতে সময় নেবে। আমি আপনাকে ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। চৌদ্দ মিলিগ্রাম ডরমিকাম। অবশ্যই আজ রাতে আপনি ডরমিকাম খেয়ে ঘুমুবেন। একা ঘুমুবেন না। কাউকে না কাউকে সঙ্গে রাখবেন। আগামীকাল আমি তৈরি থাক। আপনি। চলে আসবেন সকাল দশটায়।
হামিদা বলল, আমি অবশ্যই আসব।
হামিদা ডাক্তারের কথা মতো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমুতে গেল। অন্যদিন ঘুমের ওষুধ খাবার পরেও ঘুম আসতে দেরি হয়। আজ দ্রুত ঘুম এসে গেল। গভীর গাঢ় ঘুম।
ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে হামিদার ঘুম ভাঙল। কেউ একজন তার কানের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। নিশ্বাসের গরম হাওয়া গালে লাগছে। হামিদার শরীর হিম হয়ে গেল। কানের কাছে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে কে?
ডাক্তার সাহেব তাকে একা ঘুমুতে নিষেধ করেছিলেন। তার পরেও সে একা ঘুমুচ্ছে। কাউকে সঙ্গে নিয়ে সে ঘুমুতে পারে না। মেঝেতে বিছানা করে আসিয়া ঘুমুতে পারত। কিন্তু সে ঘুমের মধ্যে কথা বলে। কাদে। কাজেই তাকে রাখা হয় নি। এখন মনে হচ্ছে ডাক্তার সাহেবের কথা শুনা উচিত ছিল।
হামিদার হাতের কাছেই সুইচ বোর্ড। সে ইচ্ছা করলে বাতি জ্বালাতে পারে। বাতি জ্বালাতে প্রচণ্ড ভয় লাগছে। যদি বাতি জ্বেলে দেখে কানের কাছে একটা ককর নিশ্বাস ফেলছে তাহলে কী হবে? এ রকম সম্ভাবনার কথা ডাক্তার সাহেব বলছেন।
হালকা শব্দ হলো ঘরের ভেতর। মেঝেতে কেউ একজন নড়ে উঠল। হামিদা নিশ্চিত অবশ্যই মেঝেতে বড়সড় একটা কুকুর। থাবা গেড়ে বসে আছে। এ রকম কিছু যদি হামিদা দেখে তাহলে ধরে নিতে হবে এই কুকুর সত্যি কুকুর না। এটা তার মনের কল্পনা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সত্যিকারের কুকুরের ঘরে। ঢোকার কোনো সম্ভাবনা নেই।
হামিদা বাতি জ্বালাল। মেঝেতে দুটা কুকুর বসে আছে। একটা কালো একটা বাদামি রঙের। কালো কুকুরটা প্রকাণ্ড, বাদামিটা ছোট। ছোট কুকুরটা হা করে আছে। তার মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। তারা এক দৃষ্টিতে হামিদার দিকে তাকিয়ে আছে। হামিদা মনে মনে বলল, আমি যা দেখছি তা ভুল। ভিসুয়াল হেলুসিনেশন হচ্ছে। আমাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। খুব ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আমি কুকুর দুটার দিকে তাকাব না। আমি খুব শান্ত ভঙ্গিতে খাট থেকে নামব। কুকুর দুটাকে পাশ কাটিয়ে দরজার কাছে যাব। দরজা খুলে ছাদে যাব। সিড়ি বেয়ে দোতলায় নেমে যাব। আসিয়াকে বলব— গরম এক কাপ চা বানিয়ে দিতে। উষ্ণ চায়ের কাপ বন্ধুর মতো এ জাতীয় কী একটা কথা যেন ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন।
হামিদা খাট থেকে নামল। দরজা খুলে ছাদে চলে এলো। কুকুর দুটা নিঃশব্দে তার পিছনে পিছনে আসছে। হামিদা ছাদ থেকে নামার সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। সিড়ি-ঘরে সব সময় বাতি জ্বলে, আজ বাতি নেই। কুকুর দুটা ঘড়ঘড় শব্দ। করছে। হামিদা তাকালো কুকুর দুটির দিকে। আতঙ্কে ও বিস্ময়ে হামিদা জমে গেল— কারণ কুকুর দুটি এখন তার উপর ঝাপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই তো লাফ দিল! হামিদা প্রাণপণে দৌড়াল। ছাদের শেষ মাথায় এসে পড়েছে। ছাদের এই অংশে রেলিং নেই। ভালোই হয়েছে। রেলিং থাকলে সে আটকা পড়ে যেত। হামিদা দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ল।
পিজি হাসপাতালের মনোবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক ডা. আরেফিন চৌধুরী হামিদার জন্যে সকাল দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। হামিদা এলো না। আরেফিন চৌধুরী বিস্মিত হলেন না। তিনি তার অভিজ্ঞতায় দেখেছেন শতকরা ষাট ভাগ মানসিক রোগী প্রথম সেশনের পর দ্বিতীয় সেশনে ডাক্তারের কাছে আসে না। হয় আপনা আপনি তাদের রোগ সেরে যায়–কিংবা মনোরোগ চিকিৎসকের। কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করে না।
কতক্ষণ পানিতে আছি
কুটু আমি কতক্ষণ পানিতে আছি?
আটতিরিশ ঘণ্টা।
শুধু ঘণ্টার হিসাব দিলে হবে না, মিনিটের হিসাবও লাগবে। আটত্রিশ ঘণ্টা কত মিনিট?
আটতিরিশ ঘণ্টা সাত মিনিট।
তোমার কি মনে হয় আমি পানিতে বাস করার বিশ্ব রেকর্ড করতে পারব?
মানুষ চেষ্টা নিলে সব পারে।
ভুল বললে কুটু। মানুষ চেষ্টা নিলেও সব কিছু পারে না। আমি হাজার চেষ্টা করলেও গান গাইতে পারব না। আমার গানের গলা নাই। গান গাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। সম্ভব হলো না। আমি যখন একা থাকতাম তখন মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান করতাম। এখন আমার সঙ্গে তুমি থাকি। লজ্জা লাগে বলে গাইতে পারি না।
কোন ধরনের গান করতেন।
বেশির ভাগ ইসলামি সঙ্গীত। তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে টাইপ।
আমি অন্য ঘরে যাই, আপনি গান করেন।
না তুমি থাক। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে গান গাওয়ার ইচ্ছা হলে তোমার সামনেই গাই। তুমি তো বাইরের কেউ না। তুমি হলে আপনা লোক। কুট, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি– অল্পদিনের মধ্যে তোমার মাথ্যার চুল। বড় হয়েছে, নখ বড় হয়েছে। তোমাকে দেখতে কিন্তু খারাপ লাগছে না।
শুকরিয়া।
হামিদার ধমক খেয়ে তুমি যে চুল কেটে বাবু হয়ে গিয়েছিলে। তোমাকে দেখতে তখন ভালো লাগছিল না। একেকজনকে একেকভাবে মানায়। কাউকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় মানায়। কাউকে আবার নোংরা অবস্থায় মানায়। কুট তুমি কি গোসল বন্ধ করে দিয়েছ?
জ্বি স্যার। পানি আমার শইলে সহ্য হয় না।
সহ্য না হলে গোসল করার কোনো দরকার দেখি না। আমি চলব আমার মতো। পছন্দ না হলে আসবে না। কী বলো কুটু, সত্যি বলছি না?
জ্বি স্যার।
ভদকার সাপ্লাই আছে তো?
তিন বোতল আছে।
আরো আনিয়ে রাখ। হঠাৎ সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে বিরাট বিপদে পড়ব। স্টক পাকা ভালো। টাকা সুটকেসে আছে। চাবি কোথায় আছে জানো?
আপনার বালিশের নিচে।
ভেরি গুড। যখন প্রয়োজন হবে টাকা নিয়ে খরচ করবে। আমি দরিদ্র হতে পারি কিন্তু আমার হার্ট অনেক বড়। হাট কী জানো?
না।
হার্ট হলো হৃদয়। হার্ট একটা ইংরেজি শব্দ। বানান হলো— HEART, গ্লাসে ঢেলে জিনিস দাও। একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবে আমার গ্রাস যেন কখনো খালি থাকে।
আইজ বেশি খাইয়া ফেলছেন স্যার। আর খাইলে বমি করবেন।
আমার বমি আমি করব। যেখানে ইচ্ছা সেখানে করব। বুঝতে পারছ?
জ্বি স্যার।
রাত এখন কত?
একটা বাজে স্যার।
তুমি সব সময় ঘণ্টায় উত্তর দাও কেন? একটা বেজে কত মিনিট সেটা বলো।
একটা পাঁচ।
পাঁচ মিনিট সময় যে তুমি অগ্রাহ্য করলে এটা ঠিক করলে না। পাঁচ মিনিট। অনেক লম্বা সময়। পাঁচ মিনিট হলো তিনশ সেকেন্ড।
স্যার যাই, রান্না করতে হইব।
রান্না করতে হবে না। আজ আমি সলিড কিছু খাব না। লিকুইড জিনিস খাব। শুয়ে আছি লিকুইডের ভেতর। খাবও লিকুইড। লিকুইড হলো একটা ইংরেজি শব্দ। অর্থ হলো তরল। লিকুইড বানান শিখে রাখ— LIQUID. কুটু মিয়া–
স্যার বলেন।
আজ তোমাকে আমি গান শুনাব। একবার যাত্রা দেখতে গিয়ে এই গান শুনেছি। গানটা অন্তরে গেঁথে আছে। সুর যদি ভুল ভাল হয় কিছু মনে করো না। এখন তুমি গল্প বলো। প্রথমে তোমার গল্প, তারপর আমার গান। আবার তোমার। শা, আবার আমার গান। এই ভাবে চলতে থাকবে। কালো, গল্প বলো।
গল্প জানি না স্যার।
তোমার নিজের কথা বলো। তোমার বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী পুত্র কন্যা ওদের কথা বলো। তোমার ঘর সংসারের কথা। এটাই গল্প। রাজারানীর গল্প তো তোমার কাছে শুনতে চাচ্ছি না।
নিজের সংসারের কথা কিছু ইয়াদ নাই স্যার। ভাসা ভাসা ইয়াদ আছে। স্ত্রীর চেহারা মনে আছে, নাম মনে নাই। মেয়েটার চেহারাও মনে নাই, নামও মনে নাই।
তোমার এই অসুখটার নাম হলো এমনেশিয়া। স্মৃতি শক্তি বিলোপ। স্মৃতি শক্তি কীভাবে নষ্ট হলো? মাথায় আঘাত পেয়েছিলে? তোমার মাথার চুলের যেমন খাবলা খাবলা অবস্থা। মনে হয় আঘাত পেয়েছ।
জ্বি না স্যার। আমার মৃত্যুর পর সব কেমন আউলা হইয়া গেছে। জীবিত যখন ছিলাম তখনকার কথা মনে নাই। ভাসা ভাসা ইয়াদ হয়। আবার বিস্মরণ। হয়। কবরের ভিতর আমার চুলগুলা পইড়া গেল। সব চুল পইড়া গেছিল। এখন কিছু কিছু উঠতেছে।
কুটুর কথা শুনে আলাউদ্দিন কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হাতে ধরা ভদকার গ্লাস একটানে শেষ করে বললেন আমি কানে ভুল শুনেছি কি না বুঝতে পারছি না। তুমি কী বললে, মৃত্যুর পর সব আউলা হয়ে গেছে।
জ্বি।
তুমি মারা গেছু না কি?
জ্বি স্যার।
কত দিন আগে মারা গেছ?
এই ধরেন কুড়ি বছর।
কুটু!
জ্বি স্যার।
তুমি যে খুবই বিস্ময়কর কথা বলছ এটা বুঝতে পারছ?
জ্বি না।
আমার ও ধারণা তুমি বুঝতে পারছ না। বুঝতে পারলে এ ধরনের কথা বলতে। আমি নিতান্ত ভদ্রলোক এবং ভালো মানুষ বলে তোমাকে কিছু বললাম না। অন্য কেউ মিথ্যা কথা বলার জন্য তোমাকে শত্রু ধমক দিত। হাজী সাহেবের সামনে এমন কথা বললে তিনি তোমাকে কানে ধরে উঠবোস করতেন। যাই হোক, তোমার গল্প বলার কথা তুমি গল্প বলেছ, এখন আমার গান শুনানোর পালা। তুমিও কোৱালে আমার সঙ্গে বরৰে। গানটা একটু অশীল আছে। কী করবে বলো— জগতের ভালো ভালো জিনিস সবই অশ্লীল।
আলাউদ্দিন গান ধরলেন। কুটু ও তার সঙ্গে কোরাসে শামিল হলো।
হাটু পানিতে নামিয়া কন্যা হাঁটু মাপ্তন করে
কন্যার হাঁটু দেখিয়া আমার দিল কুড়কুড় করে।
(কুটু এবং আলাউদ্দিন একত্রে কোরাস)
যমুনার জল দেখতে কালো
স্নান করিতে লাগে ভালো
যৌবন মিশিয়া গেল জলে।
নাড়ি পানিতে নামিয়া কন্যা নাভি মাঞ্জন করে।
কন্যার নাভি দেখিয়া আমার দিল কুড়কুড় করে।
(কোরাস)
যমুনার জল দেখতে কালো
স্নান করিতে লাগে ভালো
যৌবন মিশিয়া গেল জলে।
বুক পানিতে নামিয়া কন্যা বুক মাঞ্জন করে
কন্যার বুক দেখিয়া আমার দিল কুকুড় করে।
(কোরাস)
যমুনার জল দেখতে কাল
স্নান করিতে লাগে ভালো
যৌবন মিশিয়া গেল জলে…।
গান শেষ করে আলাউদ্দিন হুক্কার নল হাতে নিলেন। কুটু তাঁর জন্যে নয়াবাজার থেকে রবারের নল লাগানো হুক্কা কিনে এনেছে। পানিতে শুয়ে সিগারেট টানা যায় না। হুক্কা টানতে কোনো সমস্যা নেই। কুয়েতের শেখ আব্দাল রহমান পানিতে শুয়ে শুয়ে হুক্কা টানতেন। কুটু শুক্কার আইডিয়া সেখান থেকেই পেয়েছে। হুক্কা টানতে আলাউদ্দিনের খুবই ভালো লাগে। কেমন গুড়ুক গুড়ুক শব্দ হয়। সিগারেটের মতো না যে দুটা টান দিলেই শেষ। যতক্ষণ ইচ্ছা টানা যায়।
কুটু মিয়া?
জ্বি স্যার।
আমার গান শেষ হয়েছে, এখন তোমার গল্প বলার পালা। গরু শুরু কর। তবে এবার মিথ্যা গল্প বলবে না। যদি মিথ্যা গল্প কর তাহলে কিন্তু কানে ধরে উঠবোস করাব। দেরি করবে না। ওয়ান টু থ্রি— গো। গো হলো একটা ইংরেজি শব্দ। যার অর্থ শুরু কর। বানান হলো GO.
কুটু শুরু করল— আমার মৃত্যু হইছিল জুম্মাবার। সকালে মৃত্যু হইছে। নামাজে জানাজা হইছে জুম্মার পর। ইমাম সাহেব বললেন, কুটু মিয়ারে তোমরা তাড়াতাড়ি কবর দাও। দিন থাকতে থাকতে যদি কবর হয় তাহলে সোয়াব বেশি। গোর আজাবও হয় কম।
আলাউদ্দিন হুক্কার নলে লম্বা টান দিয়ে বললেন, ইমাম সাহেবের কথা তুমি শুনলে কীভাবে? তুমি তো মরেই গেছ।
কুটু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, সমস্যা তো স্যার এইখানেই। আমি মইরা গছি কিন্তু সবার সব কা ওছি। চোখ বন্ধ, চোখে কিছু দেশতছি না। তবে হালকাভাবে নিঃশ্বাস নিতেছি। নাক বন্ধ নাকের গর্তে তুলা দিয়া দিছে। মুখ দিয়া অল্প অল্প নিঃশ্বাস নিতেছি। কাফনের কাপড় মুখের উপরে থাকায় শ্বাস টানতে খুবই কষ্ট। চিক্কার কইরা বলতে ইচ্ছা করছে— আমি মরি নাই। আমারে তোরা কবর দিস না। মুখ দিয়া কথা বাইর হয় না। হাত নড়াইতে চাই, নড়াইতে পারি না।
এইভাবে তোমাকে কবর দিয়ে দিল।
জ্বি। কুকুর দিয়া সবাই চইলা গেল। কবরের ভিতরে কী যে গরম। আপনেরে কী বলব। মনে হইল গরম তাওয়ায় শুইয়া আছি। আহারে কী কষ্ট। শুরু হইল কুম বৃষ্টি। শইল ডুইবা গেল পানিতে। নকি মুখ পানির উপর, সমান ভাইসা আছি। মনে মনে ভাবতেছি— আমার নাম কুটু। আমি বাজি ধইরা সাঁতার দিয়া নদী পার হইছি আর আইজ আমার মৃত্যু হাঁটু পানিতে।
তারপর?
এক সময় মনে হইল আমি ছাড়াও কবরের ভিতরে আরেকজন কে যেন আছে। নড়ে চড়ে শব্দ পাই। হাসে— সেই শব্দ পাই। মেয়ে ছেলের হাসি। কাচের চুড়ির টুংটাং শব্দ। অল্প বয়সী মেয়ের হাসি।
এইগুলো তোমার মনের ধান্ধা। বেশি ভয় পেলে মনে ধান্ধা লাগে। আমার নিজেরও কয়েকবার লেগেছে। মনে হয়েছে খাটের নিচে তুমি বসে আছ। কখনো কাগজ ছিড়ছ, কখনো বা কারো মুখের উপর বালিশ চেপে ধরেছ।
মনের বান্ধা হইতে পারে। স্যার, ভয় পাইছিলাম অত্যাধিক। মাঝে মাঝে কবর কাঁপত। যখন কাঁপত তখন মেঘের ডাকের মতো শব্দ হইত।
তারপর কী হলো?
কত সময় যে পার হইল তার হিসাব নাই। তবে মেলা সময় পার করছি। এক সময় দেখলাম চোখ মেলতে পারি। চোখ মেললাম। ঘুটঘুট্টি আহ্মাইর। কবরের ভিতর দিনও যা রাতও তা। এই আন্ধাইর অন্তরের ভিতরে ঢুইকা যায়। আমার সমস্ত শইলে পোকা ধইরা গেল। আহা কী কষ্ট। পোকা কামড়ায়, হাত নড়াইতে পারি না। ডান চোখটা সেই সময় পোকা খাইয়া ফেলল। কিছুই করতে পারলাম না।
ক্ষুধা তৃষ্ণা ছিল না?
ক্ষুধা ছিল না, তবে পানির পিপাসা হইত। পানির পিপাসা হইত আবার চইলা যাইত।
তারপর কী হলো?
এক সময় দেখলাম হাত নড়াইতে পারি। পা নড়াইতে পারি। তখন কাফনের। ভিতর থেইকা বাইর হইলাম। মাটিতে হেলান দিয়া বসলাম।
কবরের ভেতর বসার জায়গা থাকে?
জি থাকে। কবর সেই ভাবে খোঁদা হয়।
তুমি করে বসে রইলে?
জি।
বের হবার চেষ্টা করলে না?
জ্বি না। আমার মনে হইল— ভালোই তো আছি। বাইর হইয়া কী লাভ? ক্ষুধা তৃষ্ণা কিছুই নাই। একটা আলাদা শান্তি। তবে কবর যখন কাঁপত তখন বড় অস্থির লাগত। বড়ই ভয় লাগত। ভয়ের চোটে পরায়ই পিশাব করে ফেলতাম।
কতদিন এইভাবে বসে ছিলে?
মনে হয় এক সপ্তাহ।
তুমি না বললে কবরের ভেতর ঘুটঘুট্রি অন্ধকার। দিন রাত্রি বুঝলে কী করে?
চোখ মেলার পরে বুঝলাম দিনের বেলা কবরের ভিতর সামান্য আলো থাকে। মাটির ফাঁক ফোঁকড় দিয়া ঢুকে। দিন রাত্রির হিসাব পাওয়া যায়।
এক সপ্তাহ পরে কবর থেকে বের হয়ে এলে?
জ্বি। রাতে বাইর হইছি। কাফনের কাপড়টা লুঙ্গির মতো প্যাচ দিয়া কোমরে পইরা গেলাম আমার বাড়িতে। স্ত্রীর নাম ধইরা ডাক দিলাম।
কী নাম?
সেই নাম এখন ইয়াদ নাই।
তোমার স্ত্রী বের হয়ে এলো?
জ্বি। সে বাইর হইল, আমার মা বাইর হইলেন। ছোট ভাই একটা ছিল, সে বাইর হইল। শুরু হইয়া গেল চিৎকার চেচামেচি। বিরাট ধুন্ধুমার। সবাই মনে করল আমি পিশাচ। কবর থেইক্যা উইঠা আসছি।
তারপর কী হলো?
পুরা গ্রাম জাইগ্যা গেল! এরী মশাল নিয়ে আমারে আগুনে পোড়ানোর জন্য দুইটা আসল। আমি দৌড় দিলাম। এরাও পিছে পিছে দৌড় দিল। কাফনের সাদা কাপড় দূর থেইকা দেখা যায়। আমি যেইখানে যাই এরা সেইখানে উপস্থিত হয়। শেষে কাপড় ফেইলা দিয়া ল্যাংটা হইয়া দৌড় দিলাম। অনেক কষ্টে জীবন নিয়া পালাইছি। চইলা আসলাম ঢাকা শহরে। অনেকদিন ভিক্ষা করছি।
গ্রামে আর ফিরে যাও নি?
জি না।
না গিয়ে ভালোই করেছ। তোমাকে দেখলেই ভাববে তুমি মৃত মানুষ। আবার তাড়া করবে। কী দরকার?
আমার গল্পটা কি স্যার বিশ্বাস হইছে?
না, বিশ্বাস হয় নাই। তাতে কিছু যায় আসে না কুটু। অন্যের বিশ্বাসের উপর তো কারোর হাত নাই। তোমার গল্প শেষ হয়েছে। এখন আমার গান শুরু হবে। আগেরটাই গাই— কি বলে?
জ্বি আচ্ছা।
তুমি কোরাসে সামিল হয়ে। একা একা গান গেয়ে মজা নাই।
আলাউদ্দিন গান ধরলেন–
যমুনার জল দেখতে কালো
স্নান করিতে লাগে ভালো
যৌবন ভাসিয়া গেল জলে।
কুটু ও তাঁর সঙ্গে গলা মিলাল। একসময় গান থামিয়ে আলাউদ্দিন আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, কুটু ঠিক করে বলো তো আমার শরীরে ফোকা উঠেছে?
কুটু বলল, পিঠের দিকে দুই একটা উঠছে।
ফোসকার ভিতর পোকা আছে?
কুটু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। আলাউদ্দিন বললেন, কবরের ভিতর তোমার শরীরে যে পোকা উঠেছিল এইগুলি কি সেই পোকা?
কুটু বলল, জ্বি একই পাকা।
আলাউদ্দিন বললেন, কুটু তুমি জীবিত মানুষ না মৃত মানুষ?
কুটু বলল, আমি জানি না।
আলাউদ্দিন আবারো গানে টান দিলেন–
নাভি পানিতে নামিয়া কন্যা নাভি মাঞ্জন করে।
কন্যার নাভি দেখিয়া আমার দিল কুকুড় করে।
দরজা জানালা সব বন্ধ
দরজা জানালা সব বন্ধ। প্রতিটি বন্ধ জানালায় ভারী পর্দা ঝুলছে। দিনের আলোতেও ঘর অন্ধকার। সামান্য যে আলো আসছে সে আলোও আলাউদ্দিন সহ্য করতে পারছেন না। আলো পড়লেই চোখ জ্বলে যাচ্ছে এ রকম হয়। একটা ভেজা তোয়ালে সারাক্ষণ তাকে চোখের উপর দিয়ে রাখতে হয়।
বাথটাব ভর্তি পানির ভেতর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে আলাউদ্দিন শুয়ে আছেন। অনেকদিন ধরেই এই অবস্থায় আছেন। তাঁর সমস্ত শরীর ফোসকায় ভরে গেছে। কিছু ফোসকা ফেটে ভেতরের পোকা বের হয়ে বাথটাবের পানিতে কিলবিল। করছে।
তীব্র যন্ত্রণায় আলাউদ্দিনের সমস্ত চেতনা আচ্ছান্ন। তিনি সারাক্ষণই চাপা আওয়াজ করেন। দূর থেকে সেই আওয়াজকে কুকুরের ঘড়ঘড় শব্দের মতো শোনায়। তার ক্ষুধা তৃষ্ণার সমস্ত বোধ লোপ পেয়েছে। তার কাছে এখন মনে হয় তিনি খুব ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছেন। যাত্রা শুরু হয়েছে অতল কোনো গম্বরের দিকে। সেই অতল গহ্বরে কিছু একটা অপেক্ষা করছে তার জন্যে। সেই কিছুটা কী?
বাথরুমের দরজা ধরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আলাউদ্দিনের চোখ বন্ধ। বন্ধ চোখের উপর ভেজা তোয়ালে। তারপরেও তিনি টের পেলেন কেউ একজন এসেছে। আলাউদ্দিন ভাঙা গলায় বললেন, কে?
জবাব দিল কুটু। নিচু গলায় বলল, স্যার আমি।
আলাউদ্দিন বললেন, কী চাও কুটু?
কুটু শান্ত গলায় বলল, চইলা যাইতেছি স্যার। আপনার কাছ থেইকা বিদায়। নিতে আসছি।
আলাউদ্দিন বললেন, আচ্ছা।
বেতনের টাকাটা শুধু নিছি। বাকি টাকা সুটকেসে আছে।
আচ্ছা।
স্যার তাইলে যাই?
যাও। তোমার রান্নায় তোমার সেবায় আমি সন্তুষ্ট। যদি ক্ষমতা থাকতো পাইলট সাহেবের মতো তোমাকে একটু সার্টিফিকেট দিতাম। আমার ক্ষমতা নাই।… কুটু!
জ্বি স্যার।
যাবার আগে একটা ছোট্ট কাজ করে দিয়ে যাও। খুব ভারী একটা তালা বাড়ির দরজায় লাগিয়ে দিয়ে যাও। যেন কেউ ঢুকতে না পারে। আমি চাই না আমাকে এই অবস্থায় কেউ দেখুক।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
আলাউদ্দিনের চোখ বন্ধ। চোখ খোলা থাকলে তিনি দেখতে পেতেন কুটু বড় একটা তালা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘরে তালা দিয়ে বলা হবে এটা যেন সে জানত। কুটুর মুখ বিষণ্ণ। বেদনায় কাতর।