“ও।” মানুষটা ভুরু কুঁচকে শামীমের দিকে তাকাল, চোখের দৃষ্টি দেখে শামীমের মনে হল সে নিশ্চয়ই কোনো একটা ভুল করে ফেলেছে।
শামীম বলল,”আমি নিজেও আসলে ডাক্তার।”
মানুষটা বলল, “ও! রোগী কেমন দেখলেন?”
“ভালো না। খুব ক্রিটিক্যাল মনে হয় আরেকটু কেয়ার দরকার ছিল।”
ডাক্তার মানুষটা বলল, “কেয়ার দরকার মনে করলে কেয়ার দেন। আপনাকে বাধা দিচ্ছে কে?”
শামীম মানুষটার কথা শুনে রীতিমতো চমকে উঠল। এ-রকম ভাষায় কেউ তার সাথে কথা বলতে পারে শুনেও সে বিশ্বাস করতে পারে না। মানুষটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “তাকে চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে?”
“এর জন্যে আপনার এতো দরদ কেন?”
“দরদ?” শামীম হতচকিতের মতো এদিক সেদিক তাকাল। ভর্তি করানোর সময় কমবয়সী কলেজ ছাত্রীর মতো দেখতে মহিলা ডাক্তারটা কী। সুন্দর করে কথা বলেছে, আর এই গরিলার মতো মানুষটা কী শুরু করেছে? মানুষটা এমন ভাবে শামীমের দিকে এগিয়ে এল যে তার মনে হল বুঝি তাকে মারতে আসছে। একেবারে তার মুখের কাছে মুখ এনে হিস হিস করে বলল, “এই বাস্টার্ডের মা তাকে বাঁচাতে চায় নাই, ডোবায় ফেলে দিয়েছে। আপনি কেন তুলে এনেছেন?”
“কী বলছেন আপনি?”
“এই পাপের সন্তানকে বাঁচানো আমার মাথা ব্যথা কেন হবে?”
শামীম পাথরের মতো মুখ করে বলল, “কী বলছেন আপনি? আপনি একজন ডাক্তার। আপনি হিপোক্রেটাসের ওথ নিয়েছেন—”
“গুলি মারি আমি হিপেক্রেটাসকে। ঘেন্না হয় আমার। আমার কেন আবর্জনা ঘাটতে হবে? নর্দমার আবর্জনা কেন তুলে এনেছেন? এইখানে সত্যিকারের মা বাবার সত্যিকার বাচ্চা আছে। আমি তাদের চিকিৎসা করব। পাপের সন্তানকে আমি কেন ছোঁব? যার জন্ম হয়েছে দোজখে যাবার জন্যে তার জন্যে আমার কী দায়িত্ব?”
অসহ্য ক্রোধে শামীমের শরীরে জ্বালা ধরে যায়। গরিলার মতো মানুষটা হিস হিস করে বলল, “এই বাস্টার্ডের চিকিৎসা করার আমার কোনো সখ নাই। একে বাঁচাতে চাইলে আপনি নিয়ে যান এখান থেকে। এই ওয়ার্ডে অনেক সত্যিকার মানুষের সত্যিকার বাচ্চা আছে যাদের চিকিৎসা দরকার।”
অনেক কষ্ট করে শামীম নিজেকে শান্ত রাখল তারপর শীতল গলায় বলল, “ঠিক আছে আমি নিয়ে যাব। তার আগে আমার একটু প্রিপারেশান দরকার। আমি প্রিপারেশন নিয়ে আসছি। আপনার কাছে অনুরোধ–”
“কী অনুরোধ?”
“আমি প্রিপারেশান নিয়ে আসার আগে আপনি এই বাচ্চাটাকে গলা টিপে মেরে ফেলবেন না।”
মানুষটা তীব্র দৃষ্টিতে শামীমের দিকে তাকিয়ে রইল। শামীম নিচু গলায় বলল, “যদি মেরে ফেলেন তাহলে আমি গলা টিপে আপনাকে মেরে ফেলব। মানুষ মারলে অপরাধ হয়-জানোয়ার মারলে অপরাধ হয় না।”
.
দুই ঘন্টা পর, শিশুটি শামীমের বাসায় তার ডাইনিং টেবিলে শুয়ে আছে। শামীম ফ্যান থেকে একটা দড়ি ঝুলিয়ে সেখানে একটা স্যালাইনের ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখেছে। বাচ্চাটিকে একটা কম্বল দিয়ে মুড়ে ঢেকে রেখেছে। মাথার কাছে একটা ছোট অক্সিজেন সিলিন্ডার, সেখান থেকে তার নাকে সরু প্লাস্টিকের নল দিয়ে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। সে স্টেথিস্কোপ দিয়ে শিশুটির বুক পরীক্ষা করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেওয়ালে টানানো তার মেয়ে রিতুর ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলি রিতু। বাচ্চাটার অবস্থা ভালো না। যে বাচ্চা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডোবায় ডুবে থাকতে পারে তাকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না, কেমন লাগে বল।”
শামীম গলার স্বর নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো করে বলল, “আমার কী মনে হচ্ছে জানিস রিতু? আমার মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটি আসলে পানির ভেতর নিশ্বাস নিতে পারে এখন তাকে বাচঁতে হলে পানিতে ডোবাতে হবে। কিন্তু তুইই বল, এটা কী বিশ্বাসযোগ্য কথা?”
শামীম ওঠে সারাঘরে একবার পায়চারী করল, তারপর টেলিফোনটা হাতে নিয়ে একটা নম্বরে না। জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে তার এককালীন সহকর্মী আলেক্সের নম্বর। এই সময়টাতে তার খুব ব্যস্ত থাকার কথা টেলিফোনটা ধরবে তার সম্ভাবনা খুব কম, কিন্তু শামীম অবাক হয়ে দেখল আলেক্স টেলিফোনটা ধরে তার বিচিত্র ইংরেজী উচ্চারণে বলল, “আলেক্স বলছি।”
শামীম ইংরেজীতে বলল, “আলেক্স আমি শামীম।” অন্য পাশ থেকে আলেক্সের আনন্দোচ্ছাস শোনা গেল, “হেই শামীম। লং টাইম নো সি, লং টাইম নো টক, লং টাইম নো ই-মেইল তোমার হয়েছেটা কী? বেঁচে আছ?”
“হ্যাঁ। বেঁচে আছি। তোমার কী খবর।”
আলেক্স চিৎকার করে বলল, “আমার সব রকম খবর আছে। ভালো, খারাপ, মাঝারী রকমের ভালো, মাঝারী রকমের খারাপ, খুব ভালো, খুব খারাপ, কোনটা শুনতে চাও?”
শামীম হেসে ফেলল, বলল, “সবগুলো শুনি। খারাপ থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে ভালোর দিকে যাও।”
আলেক্স হড়বড় করে কথা বলতে থাকে। দুই বন্ধু বেশ খানিকক্ষণ পুরানো দিনের কথা বলে একে অন্যের খবর নেয়। এক সময় আলেক্স বলল, “ঠিক আছে শামীম, এখন বল তুমি কেন ফোন করেছ? ধরেই নিচ্ছি তুমি তোমার পুরনো বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড তাকে কী রকম দাগাবাজী করেছে তার খবর নেওয়ার জন্য ফোন করো নাই।”
শামীম বলল, “তুমি ঠিকই বলেছ। আমি তোমার কাছে একটা জিনিস জানার জন্য ফোন করেছি। ইন্টারনেটের হালকা তথ্য দিয়ে হবে না। আমার খাঁটি বৈজ্ঞানিক তথ্য দরকার।”
“ঠিক আছে, বল।”