রিটিন দেখল মেয়েটা আতঙ্কে থর থর করে কেঁপে উঠল। কাঁপা গলায় বলল, “মিশি–মিশি–”
মানুষটা কঠিন গলায় বলল, “আমি মিশি না। তুমি কিছু একটা ভুল করছ।”
“না, আমি ভুল করছি না মিশি! তোমার মনে নেই তোমাকে ক্যাম্পে নিয়ে গেল, তুমি আমাকে বললে-”
মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “না, আমি কাউকে কিছু বলিনি। তোমার দেখাও ভুল হয়েছে।”
“আমার কোথাও ভুল হয়নি মিশি, তুমি মনে করার চেষ্টা করো, আমি আর তুমি”
মানুষটা একধরনের বিস্ময় নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর কঠিন গলায় বলল, “তুমি কেন আমাকে এসব বলছ? আমি তোমাকে চিনি না, আমি তোমাকে কখনো দেখিনি”
মেয়েটা হঠাৎ আকুল হয়ে কেঁদে উঠল, আর্তচিৎকার করে চলল, “মিশি, আমার মিশি–”
মানুষটা তার পানীয়টা নিয়ে সরে গিয়ে একধরনের বিস্ময় নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বলল, “মিশি, সোনা আমার–আমি সারাটি জীবন তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি, এখন তুমি কেন আমাকে চিনতে পারছ না? আমার দিকে একবার তাকাও, ভালো করে তাকাও”
মানুষটা বিড়বিড় করে বলল, “তুমি ভুল করছ। ভুল-”
রিটিন উঠে দাঁড়াল, পানীয়ের গ্লাসটা টেবিলে রেখে সে মেয়েটার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরল, নরম গলায় বলল, “গ্লানা, আমার কথা শোনো”
মেয়েটা রিটিনের দিকে তাকাল। রিটিন নিচু গলায় বলল, “তোমার মিশির মস্তিষ্ককে প্রতিস্থাপন করে দিয়েছে–এই মানুষটি মিশি না।”
৩৪
“মিশি কোথায়?”
রিটিন মাথা নিচু করল, শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, “মিশি নেই। মিশির এই শরীরটা আছে কিন্তু সেখানে মিশি নেই–সেখানে অন্য কোনো মানুষ–”
গ্লানা নামের মেয়েটা আর্তনাদ করে বলল, “না-না, আমি বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি না–বিশ্বাস করি না–”
রিটিন শক্ত করে মেয়েটাকে ধরে রাখল, বিচিত্র একধরনের বেদনায় তার বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যেতে থাকে।
.
রিটিন দীর্ঘ সময় শহরের শেষ মাথায় নদীর তীরে একটা পাথরের বেঞ্চে বসে রইল। নদী থেকে একধরনের উথালপাতাল মন খারাপ করা বাতাস বইছে। নদীর তীরে বড় বড় ঝাউগাছ, বাতাসে তার পাতা শিরশির করে কাঁপছে, গাছের পাতার শব্দে তার মন আনমনা হয়ে যায়।
আজ সকালের ঘটনাটি তার ভেতরে সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। মিশি আর গ্লানার খুব সুন্দর একটা জীবন হতে পারত, চিন্তু ক্যাটাগরি সি মানুষের সেই সুন্দর জীবনের অধিকার নেই। এই পৃথিবীর একেবারে ছকে বাঁধা মানুষ না হলে ক্যাটাগরি সি মানুষকে পাল্টে দেয়া হয়। রিটিন অনেক চেষ্টা করেও হঠাৎ করে দেখা হওয়া রানা নামের মেয়েটির আকুল হয়ে কান্নার কথা ভুলতে পারছে না। এই মেয়েটির সাথে তার হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। তার কথা মনে করে এরকম বিচলিত হওয়ার নিশ্চয়ই কোনো অর্থ নেই। কিন্তু তারপরও রিটিন বিচলিত হয়ে নদীর তীরে একা একা বসে রইল।
অন্ধকার নেমে আসার পর রিটিন উঠে দাঁড়ায়। সে এখন কোথায় যাবে জানে না। উদ্দেশ্যহীনভাবে শহরে ঘুরে বেড়াবে, যখন শরীর ক্লান্ত হয়ে উঠবে সে তার ছোট ঘরটাতে ফিরে যাবে। ঘরে যদি কোনো খাবারের প্যাকেট থাকে ভালো, যদি না থাকে কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে। ঠিক কী কারণ জানা নেই এই জীবনটিকে টেনে নিতে রিটিন আর কোনো আগ্রহ অনুভব করছে না।
রিটিনের ধারণা ছিল সে পুরোপুরি উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে, কিন্তু সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল হেঁটে হেঁটে কীভাবে কীভাবে জানি সে একটা আলোকোজ্জ্বল উত্তেজক পানীয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উপরে জ্বলজ্বলে আলোতে লেখা ‘ক্রিমিজিম’। গতকাল একটি মেয়ে তাকে বলেছে এখানে ঘাঘু ক্রিমিনালরা আড্ডা দেয়। কেউ যদি তার শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান খুলে ফেলে দিতে চায় তাকে এখানে আসতে হবে। রিটিনের ট্র্যাকিওশানে এখন কোনো সমস্যা নেই–তার এখানে আসার কথা নয় কিন্তু সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সে ক্রিমিজিমের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরে অনেক নারী-পুরুষ উত্তেজক পানীয় খেতে খেতে হইহল্লা করছে। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার, তার মাঝে দ্রুতলয়ের একধরনের সঙ্গীতের সুর, রিটিন নিজের অজান্তেই সেই সুরের সাথে তাল দিতে দিতে সামনে এগিয়ে যায়।
ঘরের মাঝামাঝি পৌঁছানোর আগেই কম বয়সী একটা মেয়ে স্বচ্ছ একটা ট্রেতে বেশ কয়েক ধরনের পানীয়ের গ্লাস নিয়ে রিটিনের দিকে এগিয়ে আসে, মেয়েটি শরীরে কিছু একটা মেখে এসেছে, যার কারণে তার শরীর থেকে হালকা নীল একধরনের আলো বের হচ্ছে। মেয়েটি আহ্লাদী গলায় রিটিনকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী খাবে গো ছেলে? আমাদের নতুন পানীয়ের চালান এসেছে।”
“আমি কিছু খাব না।”
“তুমি কিছু না খেলে এখানে কেন এসেছ? এখানে এলে কিছু না কিছু খেতে হয়।”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না, আমার মাথা শীতল রাখতে হবে। আমি এখানে একটা কাজে এসেছি।”
মেয়েটির গলার স্বর হঠাৎ হঠাৎ করে স্বাভাবিক হয়ে যায়। সে তীক্ষ্ণ চোখে রিটিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কী কাজ?”
“আমি আমার শরীর থেকে ট্র্যাকিওশানটা বের করে ফেলতে এসেছি। শুনেছি এখানে নাকি সেটা করা যাবে!”
মেয়েটি পলকহীন চোখে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি কাকে খুন করে এসেছ?”