- বইয়ের নামঃ রিটিন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ তাম্রলিপি
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১-০২. বিশাল হলঘরের মাঝখানে
রিটিন
রিটিন ঘুরে তাকাল, প্রায় তার বয়সী একটা মেয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করেছে। মেয়েটির মুখ ভাবলেশহীন, অন্তত সে নিজে এরকম একটা ভাব দেখানোর চেষ্টা করছে। রিটিন অবশ্যি এই ভাবলেশহীন মুখের পেছনে খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের উত্তেজনা লক্ষ করল। রিটিন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?”
০১.
বিশাল হলঘরের মাঝখানে একটা গ্রানাইটের টেবিল। টেবিলের অন্যপাশে সোনালি চুলের মাঝবয়সী একজন মহিলা বসে তীক্ষ্ণ চোখে রিটিনের দিকে তাকিয়ে আছে। রিটিন খুব মনোযোগ দিয়ে তার হাতের নখগুলো পরীক্ষা করছে, তাকে দেখলে মনে হবে এই মুহূর্তে তার হাতের নখগুলো দেখা খুবই জরুরি।
সোনালি চুলের মহিলা জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “তুমি কী করতে চাও?”
রিটিন বলল, “আমি তোমাকে বলেছি। আমি লেখাপড়া করতে চাই। লেখাপড়া করে গবেষণা করতে চাই।”
সোনালি চুলের মহিলা বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কেন আমাকে এটা বলছ! তুমি খুব ভালো করে জান কে কী করবে সেটি পূর্ব নির্ধারিত। গত একশ বছর থেকে মানুষকে জেনেটিক উপায়ে ডিজাইন করা হয়। যারা লেখাপড়া করবে তাদের সেভাবে ডিজাইন করতে হয়। তোমাকে করা হয়নি।”
রিটিন তার হাতের আঙুল থেকে চোখ সরিয়ে সোনালি চুলের মহিলাটির দিকে তাকাল, বলল, “সেটা আমার দোষ নয়। আমাকে আমি ডিজাইন করিনি।”
“তোমার বাবা-মায়ের দায়িত্ব ছিল তোমাকে জেনেটিক ডিজাইন করা। তোমাকে করা হয়নি, তুমি ক্যাটাগরি সি মানুষ। ক্যাটাগরি সি মানুষ লেখাপড়া করে না, গবেষণা করে না। তারা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে”
রিটিন সোনালি চুলের মহিলাকে বাধা দিয়ে বলল, “আমি এসব জানি। যদি আমার লেখাপড়ার সুযোগ থাকত আমি সায়েন্স ইনস্টিটিউটে গিয়ে ভর্তি হয়ে যেতাম। তার নিয়ম নেই, তারা আমাকে সেখানে ঢুকতেই দেবে না। তাই আমি তোমার কাছে এসেছি। যেখানে নিয়ম থাকে সেখানেই নিয়ম পরিবর্তনের উপায় থাকে।”
মহিলাটি এবারে হাসির মতো শব্দ করল, বলল, “তুমি কোথা থেকে এসব তথ্য পেয়েছ আমি জানি না। নিয়ম ভাঙার জন্যে নিয়ম করা হয় না–”
“নিয়ম ভাঙা আর নিয়ম পরিবর্তন করা এক জিনিস নয়। আমি নিয়ম ভাঙতে চাইছি না একটুখানি পরিবর্তন করতে চাইছি।”
“একটুখানি?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ একটুখানি। আমাকে পরীক্ষা করে দেখা হোক আমি লেখাপড়া করার উপযুক্ত কি না। দেখা হোক আমি ক্যাটাগরি এ মানুষের সমান পর্যায়ের কি না। তার পরে সুযোগ দেয়া হোক!”
সোনালি চুলের মহিলা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “তুমি যে পরীক্ষা করার কথা বলছ সেটা করা হয়ে গেছে। সেই পরীক্ষাটার ফল অনুযায়ী তুমি ক্যাটাগরি সি–”
রিটিন হঠাৎ একটু ঝুঁকে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি মানুষ না রোবট?”
মহিলাটি হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “কী বললে?”
“আমি জানতে চাইছি তুমি মানুষ নাকি রোবট।”
সোনালি চুলের মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, “আমরা যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছি তার সাথে তোমার এই প্রশ্নের কোনো সম্পর্ক নেই।”
“আছে। সম্পর্ক আছে। তুমি যদি রোবট না হয়ে মানুষ হতে তাহলে তুমি সম্পর্কটা ধরতে পারতে। যেহেতু ধরতে পারছ না তার অর্থ তুমি রোবট। আমি শুধু শুধু একটা রোবটের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করলাম।”
মহিলাটি কেমন যেন রাগী রাগী চেহারায় বলল, “রোবট আর মানুষের মাঝে পার্থক্য কতোটুকু তুমি জান?”
রিটিন বলল, “আমার জানার প্রয়োজন নেই। ইচ্ছাও নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে টেবিলের ঐ পাশে তুমি কি আসলেই আছ নাকি এটাও একটা হলোগ্রাফিক ছবি। আমি কি তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে পারি?”
মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, “না, তুমি ছুঁয়ে দেখতে পার না। এটি শালীনতার মাঝে পড়ে না।”
রিটিন হাহা করে হাসল, বলল, “একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে জাপটে ধরে, কেউ একবারও শালীনতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর একটা হলোগ্রাফিক ছবিকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলে শালীনতা নষ্ট হয়?”
“আমি প্রক্রিয়াটির কথা বলছি না, প্রক্রিয়াটি করার পেছনের মানসিকতাটির কথা বলছি!”
রিটিন তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, বলল, “যখন একটা রোবট মানুষকে মানসিকতার উপর লেকচার দেয় তখন বুঝতে হবে কোথাও খুব বড় গোলমাল আছে। তবে–”
“তবে কী?”
রিটিন হাসি হাসি মুখে সোনালি চুলের মহিলাটির দিকে তাকাল, “লল, “তোমাকে একটা কবিতা শোনাই, সংখ্যার কবিতা, নয় আট আট এক আট তিন চার সাত নয় সাত সাত পাঁচ তিন পাঁচ–”
মহিলাটি আর্ত চিৎকার করে বলল, “না! না! মেটাকোড–”
রিটিন মহিলাটির কথার কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বলে যেতে থাকে, “ছয় ছয় তিন ছয় নয় আট শূন্য–”
মহিলাটি তীক্ষ্ণ একটি যন্ত্রণার শব্দ করল, তারপর থরথর করে কাঁপতে থাকলে। কপালের ভেতর থেকে একটা আলো জ্বলতে শুরু করে, শরীরে কেমন জানি খিচুনি হতে থাকে। রিটিন বিকল হতে শুরু করা রোবটটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকল, “সাত চার দুই ছয় পাঁচ চার দুই পাঁচ–”
ইচ্ছা করলে সে আরো বলতে পারত কিন্তু আর প্রয়োজন নেই। রোবটটি পুরোপুরি বিকল হয়ে গেছে! সংখ্যা বলা থামিয়ে রিটিন হেঁটে যেতে থাকে। বিশাল হলঘরের শেষ মাথায় দরজা। রিটিন জানে আসলে এটা বিশাল হলঘর নয়, এটা ছোট একটা খুপরি। আলো অন্ধকারের খেলা দিয়ে বিশাল হলঘরের একটা অনুভূতি দেয়া হয়েছে। এই যে সে দরজার দিকে হেঁটে যাচ্ছে, তার মনে হচ্ছে অনেক দূরে হলঘরের শেষ মাথায় দরজা, আসলে দরজাটি একেবারে হাতের কাছে, পায়ের নিচে মেঝেটুকু সরে যাচ্ছে তাই পৌঁছাতে সময় লাগছে। সবকিছুই আসলে এক ধরনের প্রতারণা। সত্যি বিষয়গুলো কখনোই কাউকে জানানো হয় না, সবসময়েই প্রতারণা করা হয়। এটাকে কেউ অবশ্যি আর প্রতারণা মনে করে না। সবাই এটাকেই জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছে।
হলঘরের দরজা খুলে বের হয়ে রিটিন একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার জীবনের একটাই স্বপ্ন ছিল সে লেখাপড়া করবে, গবেষণা করবে। ক্যাটাগরি সি মানুষের সেই সুযোগ নেই এটাও সে জানে। কিন্তু তার ধারণা ছিল তাকে কথা বলার সুযোগ দিলে সে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে পারবে। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে সে কথা বলার সুযোগটা তৈরি করেছিল কিন্তু সে একবারও ভাবেনি পুরো বিষয়টা হবে একধরনের প্রতারণা, চতুর্থ শ্রেণির একটা রোবটকে মাঝবয়সী একটা মহিলা সাজিয়ে বসিয়ে রাখবে–যে রোবটটাকে সে একেবারে হাস্যকর ছেলেমানুষি একটা মেটাকোড দিয়ে অচল করে দিতে পারবে।
রিটিন রাস্তায় নেমে আসে। ব্যস্ত শহর, উঁচু দালানের নিচে সরু রাস্তা ধরে মানুষ যাচ্ছে এবং আসছে। তাদের ভেতর কতজন সত্যিকারের মানুষ কে জানে! রোবটগুলোকে কেন দেখতে মানুষের মতো হতে হবে? মাথার উপর দিয়ে ছোট ছোট বাই ভার্বাল উড়ে যাচ্ছে। মাটির নিচ দিয়ে একটু পরপর পাতাল ট্রেন ছুটে যাচ্ছে, রিটিন তার কম্পন অনুভব করে। হাঁটতে হাঁটতে রিটিন আনমনা হয়ে যায়, একজন মানুষের জীবন কেন এরকম অর্থহীন হতে হবে? কেন তাকে একজন শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে হবে? কেন সপ্তাহ শেষে কিছু ইউনিটের জন্যে অর্থহীন পরিশ্রম করতে হবে? কেন সে তার পছন্দের একটা জীবন বেছে নিতে পারবে না? কেন তার বাবা-মা তাকে অন্যদের মতো জেনেটিক ডিজাইন করে ক্যাটাগরি এ মানুষ হিসেবে জন্ম দিল না?
রিটিনের ভেতরে তার মা-বাবার বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভের জন্ম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে নিজের ভেতরে কোনো ক্ষোভ অনুভব করল না। রিটিন তার ছেলেমানুষ খামখেয়ালি বাবা-মায়ের জন্যে গভীর এক ধরনের মমতা অনুভব করে। তার মা-বাবা জেনেটিক ডিজাইন করে ক্যাটাগরি এ শিশু জন্ম দেয়া বিশ্বাস করতো না। তারা সাধারণ মানুষ হিসেবে সাদামাটা একটা জীবনে বিশ্বাস করত—তাদের সন্তানকে নিয়ে তারা একটা পর্বতের পাদদেশে জীবন কাটাতে চেয়েছিল। কিন্তু পর্বতের হিমবাহ প্রবাহে তার বাবা-মা হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। সে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে। সে যদি ক্যাটাগরি এ শিশু হতো তাহলে তাকে অনাথ আশ্রমে বড় হতে হতো না, তাহলে সে সত্যিকারের একটা পরিবারের সাথে বড় হতে পারত। কিন্তু ক্যাটাগরি সি মানুষ হিসেবে তাকে কোনো পরিবার পালকপুত্র হিসেবে বেছে নেয়নি। তাই তাকে অনাথ আশ্রমে অন্য ক্যাটাগরি সি শিশুদের সাথে বড় হতে হয়েছে। জন্মের মুহূর্তে তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। রিটিন বুঝতে পারে না কেন তাকে এখন জন্ম নিতে হলো, কেন সে আরো কয়েক শ বছর আগে জন্ম নিতে পারল না!
রিটিন একটা উঁচু বিল্ডিংয়ের নিচে দাঁড়িয়েছিল, তার সামনে দিয়ে অসংখ্য মানুষ এবং রোবটেরা হেঁটে যাচ্ছে। যন্ত্রে তার কোনো আগ্রহ নেই কিন্তু মানুষ দেখতে তার খুব ভালো লাগে। সে পথের ধারে কোনো একটা বেঞ্চে বসে বসে সারাদিন সারারাত মানুষ দেখতে পারবে। মানুষের মুখে কত বিচিত্র অনুভূতির ছাপ, সেই অনুভূতির পরিবর্তনগুলো কত সূক্ষ্ম! মানুষ শুধুমাত্র আনন্দ দুঃখ হাসি কান্না এরকম অল্প কয়টি মোটা দাগের অনুভূতি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে অথচ এর বাইরেও আরো কত সূক্ষ্ম অনুভূতি রয়েছে। রিটিনের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সে এই অনুভূতিগুলোর একটি একটি করে নাম দেবে। যেমন ধরা যাক প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে গিয়ে চোখে পানি এসে যাচ্ছে কিন্তু তাকে চোখের পানি দেখতে দেবে না বলে ফিক করে হেসে দিল, চোখে পানি কিন্তু মুখে হাসি এই অনুভূতিটির কী নাম দেয়া যায়?
রিটিন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ মনে হলো কেউ তার কাঁধে স্পর্শ করেছে।
রিটিন ঘুরে তাকাল, প্রায় তার বয়সী একটা মেয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করেছে। মেয়েটির মুখ ভাবলেশহীন, অন্তত সে নিজে এরকম একটা ভাব দেখানোর চেষ্টা করছে। রিটিন অবশ্যি এই ভাবলেশহীন মুখের পেছনে খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের উত্তেজনা লক্ষ করল। রিটিন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ।” মেয়েটি মাথা নাড়ল, “বলব। তুমি কী করেছ? তোমার ট্রাকিওশান থেকে অ্যালার্ট সিগন্যাল বের হচ্ছে।”
রিটিন অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কী বললে?”
মেয়েটি বলল, “তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি। কেউ যখন অপরাধ করে তখন তার ট্র্যাকিওশান থেকে এই সিগন্যাল বের হয়। তুমি কী করেছ? খুন? ড্রাগ? ডাকাতি? ভায়োলেন্স?”
“আমি কিছু করি নাই।”
মেয়েটা হাসল। বলল, “পুলিশকে সেটা বোঝাতে পারবে? চিন্তা করে দেখো; নিশ্চয়ই কিছু একটা করেছ।”
“আমি আমি–” রিটিন হঠাৎ থেমে গেল, ভ্রূ কুঁচকে বলল, “একটু আগে মেটাকোড দিয়ে একটা রোবটকে ক্র্যাশ করিয়েছি। খুবই নির্বোধ রোবট–পাইয়ের একটা সিকোয়েন্স দিয়ে ক্র্যাশ করানো যায়!”
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, “হ্যাঁ, এটাও অপরাধ! এই অপরাধের জন্যে তোমার ট্র্যাকিওশানকে ট্রিগার করতে পারে।”
“কিন্তু আমি এটা পেয়েছি একটা বাথরুমের দেয়ালের লেখা থেকে–”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “বাথরুমের দেয়ালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানের কথা লেখা থাকে। আমি অনেক কিছু শিখেছি। যাই হোক তোমাকে জানিয়ে রাখলাম তোমার ট্র্যাকিওশান ট্রিগার করেছে। যেকোনো সময় পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে! গুডলাক–” বলে মেয়েটা পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করে।
রিটিন এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে মেয়েটার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করল। গলা উঁচিয়ে মেয়েটাকে ডেকে বলল, “এই যে তুমি শোনো–”
মেয়েটা দাঁড়াল, মাথা ঘুরিয়ে বলল, “কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ। দুটো জিনিস জানতে চাই, তুমি কেমন করে বুঝলে আমার ট্র্যাকিওশান ট্রিগার করেছে? আর ট্র্যাকিওশান ট্রিগার করলে কী করতে হয়?”
“তোমার ট্র্যাকিওশান ট্রিগার করেছে আমি সেটা জানি কারণ আমার কাছে ট্রাকিওশান ট্র্যাকার আছে।”
রিটিন ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তোমার কাছে কেন ট্র্যাকিওশান ট্র্যাকার আছে? তুমি কি পুলিশ?”
“না, আমি পুলিশ না! আমার যাদের সাথে সময় কাটাতে হয়। তাদের ট্র্যাকিওশান সবসময়েই ট্রিগার করে–আমার সেটা জানা দরকার হয়, তাই আমার সাথে এই ট্র্যাকারটা থাকে।”
রিটিন বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু তারপরও বোঝার ভান করল। মেয়েটা বলল, “আর তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর কেউ জানে না। ট্রাকিওশান ট্রিগার করলে কী করা বুদ্ধিমানের কাজ সেটা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। তবে—”
“তবে কী?”
“কারো ট্র্যাকিওশান একবার ট্রিগার করলে তার কপালে কী আছে সেটা নিয়ে কোনো মতভেদ নেই।”
“তার কপালে কী আছে?”
“বড় ক্রিমিনাল হওয়ার সৌভাগ্য।”
রিটিন চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বললে?”
“তুমি শুনেছ আমি কী বলেছি। তোমার ট্র্যাকিওশান যেহেতু ট্রিগার করেছে তাই আগে হোক পরে হোক তোমাকে পুলিশ ধরবে। তোমার ট্র্যাকিওশানকে তখন অ্যালার্ট মোডে রাখবে–যার অর্থ ছোট থেকে ছোট অপরাধ করলেও পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। তখন–”
“তখন কী?”
“তখন তুমি অতিষ্ঠ হয়ে সত্যি সত্যি একটা বড় অপরাধ করবে।”
“সেটি কী?”
“তোমার শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান বের করে নেবে।”
রিটিন কোনো কথা না বলে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা বলল, “ক্যাটাগরি সি মানুষের এটাই হচ্ছে ভবিষ্যৎ।”
রিটিন এবারেও কোনো কথা বলল না, মেয়েটা হাসার ভঙ্গি করে বলল, “পার্কের কাছে ক্রস রোডে উত্তেজক পানীয়ের একটা জয়েন্ট আছে, নাম ক্রিমিজিম। ওখানে ঘাঘু ক্রিমিনালরা আড্ডা দেয়, যদি তুমি কখনো ঠিক করো ক্রিমিনাল হয়ে যাবে তখন ক্রিমিজিমে এসো।”
মেয়েটা হাত নেড়ে আবার হাঁটতে শুরু করে। রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখন কোথায় যাচ্ছ।”
মেয়েটা না থেমেই বলল, “ক্রিমিজিমে।”
ঠিক কী কারণ জানা নেই রিটিনের মনে হলো মেয়েটি এই উত্তরটাই দেবে।
.
রাত বারোটার সময় রিটিনের বাসায় পুলিশ এল। রিটিন তখন মাত্র বিছানায় শুয়েছে, হঠাৎ ঘরের ভেতর ভিডি স্ক্রিন চালু হয়ে ঘরটা উজ্জ্বল আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল। রিটিন ভিডি স্ক্রিনে একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, “সি পি ছয় ছয় নয় শূন্য তিন ক্যাটাগরি সি রিটি রিটিন?”
রিটিন বিছানায় উঠে বসল, বলল, “কথা বলছি।”
“আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেট্রল বাহিনী, তোমার সাথে। দেখা করতে চাই।”
রিটিন শুকনো গলায় বলল, “অবশ্যই। অবশ্যই। তোমরা কি ভেতরে আসবে, নাকি আমি বের হব?”
“আমরা ভেতরে আসছি।”
রিটিন উঠে দরজা খুলবে কি না বুঝতে পারছিল না। কিন্তু কিছু করার আগেই খুট করে একটা শব্দ হলো এবং দরজা খুলে ভেতরে কালো পোশাক পরা কয়েকজন মানুষ এসে ঢুকল। তাদের সারা শরীর থেকে ভয়াবহ নানারকম অস্ত্র ঝুলছে।
মানুষগুলো ঘরের চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখে তার দিকে এগিয়ে এল। মাঝবয়সী একজন মানুষ ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি রিটি রিটিন?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি বেআইনি মেটাকোড ব্যবহার কর?”
রিটিন কী বলবে বুঝতে না পেরে ইতস্তত করে বলল, “একবার মাত্র করেছি। আসলে হয়েছে কী–”
“এটি সাত মাত্রার অপরাধ। যদি দ্বিতীয়বার কর তখন এটা হবে ছয় মাত্রার। ছয় মাত্রার অপরাধ করলে বিচারপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বিচার প্রক্রিয়ার তিনটি ধাপ। প্রথম ধাপে…”
মানুষটি টানা কথা বলে যেতে থাকে এবং রিটিন বুঝতে পারে আইনশৃঙ্খলার এই মানুষগুলো আসলে নিচু শ্রেণির রোবট। মেটাকোড ব্যবহার করে রোবটকে বিকল করা কোনো গুরুতর অপরাধ নয়, তাই তাকে সাবধান করার জন্য এই নিচু শ্রেণির রোবট পাঠিয়েছে। তাকে এখন ধৈর্য ধরে এই নির্বোধ রোবটগুলোর বক্তৃতা শুনতে হবে। রোবটকে অচল করার আরেকটা মেটাকোড সে জানে, এগুলোর উপর চেষ্টা করে দেখবে কি না এরকম একটা চিন্তা তার মাথার মাঝে একবার খেলে গেল কিন্তু সে চিন্তাটাকে দূর করে দিয়ে নিঃশব্দে বসে রইল। একঘেয়ে কথা শুনতে শুনতে সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে শুনতে পেল তাকে রোবটগুলো কিছু একটা প্রশ্ন করছে, রিটিন প্রশ্নটা শোনার চেষ্টা করল, রোবট পুলিশটি তাকে জিজ্ঞেস করছে, “তুমি ক্যাটাগরি সি মানুষ হয়ে কেন লেখাপড়া করতে চাও?”
একটা নিচু শ্রেণির রোবটের কাছে এরকম একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে রিটিন একটু অপমানিত বোধ করছিল, কিন্তু কিছু একটা বলতে হবে, তা না হলে রোবটগুলো তাকে বিরক্ত করে যাবে। রিটিন বলল, “আমি মনে করি সব মানুষেরই নতুন জিনিস জানার অধিকার আছে।”
পুলিশের পোশাক পরা রোবটটা বলল, “কিন্তু নতুন জিনিস জানার জন্যে মস্তিষ্কের বিশেষ গঠন থাকতে হয়। তোমার মতো ক্যাটাগরি সি মানুষের মস্তিষ্কের সেই গঠন নেই।”
এই রোবটটার সাথে তর্ক করার কোনো অর্থ হয় না, তাই রিটিন রোবটটার কথা মেনে নিয়ে বলল, “আমার মনে হয় তুমি ঠিকই। বলেছ। আমার লেখাপড়া করার সিদ্ধান্ত নেয়াটা সঠিক হয়নি।”
রোবটটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি এই কথাটা আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে বলেছ। কথাটি তুমি বিশ্বাস করো না। কেন তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলছ?”
রিটিন উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না, একটু চিন্তা করে বলল, “এই মুহূর্তে হয়তো কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করি না কিন্তু যেহেতু কথাটার মাঝে যুক্তি আছে আমাকে আগে হোক পরে হোক মেনে নিতে হবে।”
“তুমি গবেষণা করার কথা বলেছ। তুমি কী নিয়ে গবেষণা করতে চাও?”
রিটিন বলল, “আমি এখনো বিশেষ কিছু জানি না। তাই কী নিয়ে গবেষণা করতে চাই সেটা পরিষ্কারভাবে বলা সম্ভব নয়।”
পুলিশটি বলল, “কিছু একটার কথা বলো। তুমি সবসময়ই নতুন তথ্য সংগ্রহ করছ।”
কী বললে রোবটটা কী বুঝবে সেটা নিয়ে রিটিন একটু দুর্ভাবনার মাঝে ছিল, তারপরও সে অনিশ্চিতের মতো বলল, “সময় পরিভ্রমণের বিষয়টা আমাকে খুবই কৌতূহলী করে–”
কথাটা শেষ করার আগেই এবারে পুলিশগুলো চিৎকার করে রিটিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিছু বোঝার আগেই রিটিন আবিষ্কার করল সে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পুলিশগুলো তার হাত দুটো পেছনে নিয়ে সেখানে হ্যাঁন্ডকাফ লাগাচ্ছে। রিটিন বলার চেষ্টা করল, “কী হয়েছে?”
তার আগেই সে ঘাড়ের কাছে একটা খোঁচা অনুভব করল, সাথে সাথে পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যায়।
.
০২.
অনেক মানুষের কথা শুনতে শুনতে রিটিনের জ্ঞান ফিরে এল। মনে হচ্ছিল অনেক দূর থেকে বুঝি কথাগুলো ভেসে আসছে, ঢেউয়ের মতো কখনো কথাগুলো কাছে আসে আবার দূরে চলে যায়। রিটিন একসময় চোখ খুলে তাকাল, সে নোংরা একটা শক্ত মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। রিটিন সাবধানে মাথা তুলে তাকাল, সাথে সাথে মনে হলো মাথার ভেতর কিছু একটা যেন ছিঁড়ে গেল, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আবার মেঝেতে মাথা রেখে রিটিন কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। শুয়ে থেকেই রিটিন চোখ খুলে পিট পিট করে দেখার চেষ্টা করল। ঘরটাতে সে একা নয়, অনেক মানুষ। কেউ কেউ তার মতো নোংরা মেঝেতে অচেতন হয়ে শুয়ে আছে। কেউ কেউ মাথা নিচু করে বসে আছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষগুলো নিজেদের মাঝে নিচু স্বরে কথা বলছে। রিটিন ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করল, তখন শুনতে পেল কেউ একজন বলল, “এই যে আরেকজনের জ্ঞান ফিরেছে।”
কথাটা রিটিনকেই বলেছে কি না বোঝা গেল না, রিটিন তার মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই মাথার ভেতরে কোথায় জানি চিন চিন করে ব্যথা করে উঠল। রিটিন তাই আর চেষ্টা করল না, হাঁটুতে মাথা রেখে প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। আগের মানুষটা আবার বলল, “বসে থাকলে হবে না, উঠে দাঁড়াও। হাঁটো।”
রিটিন কোনোমতে মাথা ঘুরিয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে বলছ?”
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, লাল চোখ, এলোমেলো চুলের একজন মানুষ একটা বেঞ্চে পিঠ সোজা করে বসে আছে, সে মাথা নেড়ে বলল, “আর কাকে বলব? তোমাকেই বলছি।”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়?”
রিটিনের কথা শুনে মানুষটা হাহা করে হেসে উঠল, আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে বলল, “জিজ্ঞেস করছে সে কোথায়? এখনো জানে না সে কোথায়।”
মোটামুটি একই চেহারার কিন্তু গায়ের রং মৃত মানুষের মতো ধবধবে সাদা একজন বলল, “তুমি কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে। কেউ যখন কোনো অপরাধ করে তখন তাকে এখানে আনে।”
রিটিন বলল, “আমি কোনো অপরাধ করিনি।”
তার কথাটা শুনে এবারে মনে হলো আরো অনেকে খুব মজা পেল। তারা আনন্দে হাহা করে হাসতে থাকে। একজন হাসি থামিয়ে বলল, “যখন কেউ এখানে আসে তখন সে সবসময় বলে সে কোনো অপরাধ করেনি।”
রিটিন বলল, “আমি শুধু মেটাকোড বলে একটা রোবটকে অচল করেছিলাম।”
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি মানুষটা বলল, “আর কিছু করনি? একটা দুইটা মার্ডার?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না। মার্ডার করিনি।”
“ড্রাগস? সাইড বিজনেস? ব্ল্যাক মার্কেট খুব ভালো ভিচুরিয়াস এসেছে।”
রিটিন বলল, “না আমি ড্রাগস বিজনেস করিনি।”
“করেছ। নিশ্চয়ই করেছ। তা না হলে তোমাকে এখানে আনবে কেন? তোমার নিশ্চয়ই এখন মনে নেই।”
রিটিন আর তর্ক করল না। ধবধবে সাদা মানুষটা বলল, “চেক আপের সময় সব বের হয়ে আসবে।”
“চেক আপ? কিসের চেক আপ?”
“এখনো জান না চেক আপ কী?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না, জানি না।”
একজন বলল, “প্রথমবার এসেছে তো তাই কিছু জানে না।”
আরেকজন বলল, “আস্তে আস্তে জেনে যাবে। প্রথমবার একটু ঝামেলা হয়, তারপর অভ্যাস হয়ে যায়।”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তোমরা আগে এখানে এসেছ?”
“অনেকবার।”
“কী করে এখানে?”
“ধোলাই। ধোলাই করে তোমাকে সিধে করে দেবে।”
খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা বলল, “কেন শুধু শুধু ছেলেটাকে ভয় দেখাচ্ছ?”
“কে বলেছে ভয় দেখাচ্ছি, মোটেও ভয় দেখাচ্ছি না। সত্যি কথা বলে প্রস্তুত থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
ঠিক তখন একটা দরজা খুলে গেল এবং ধূসর পোশাক পরা একটা রোবট ঢুকে হাতের ট্র্যাকারটা উঁচু করে মানুষগুলোর দিকে তাক করে সুইচ টিপে দিল। সাথে সাথে একজন লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়, সবাই দেখল তার পুরো শরীরটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে শুরু করেছে। মানুষটা কোনোভাবে নিজের কাঁপুনিটা থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, “আসছি! আসছি!”
মানুষটা দরজার দিকে প্রায় ছুটে গেল। রোবটটা তার ট্র্যাকারটা নামিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে হাঁটতে থাকল, মানুষটাও তার পাশে পাশে কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে যেতে থাকে।
কাঁপতে থাকা মানুষটা বের হওয়ার সাথে সাথে খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা বলল, “খুবই অপমানজনক ব্যাপার।”
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কোনটা অপমানজনক?”
“এই যে একটা রোবট ট্র্যাকার দিয়ে ট্র্যাকিওশান অনুরণিত করে একজন একজন করে ধরে নিয়ে যায়। আমরা তো আর রোবট না, হাজার হলেও আমরা মানুষ, আমাদের নাম ধরে ডাকতে পারে। আমাদের সবার একটা করে নাম আছে।”
রিটিন খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, “রোবটটা ঐ মানুষটাকে ধরে নিয়ে গেল কেন?”
“চেক আপ করে দেখবে অপরাধী কি না।”
“কীভাবে দেখবে।”
“তাদের উপায় আছে। নিখুঁত উপায়।”
“যদি অপরাধী হয় তাহলে কী করবে?”
খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা বলল, “আগে হলে মেরে টেরে ফেলত। এখন মনে হয় স্মৃতি ধ্বংস করে নতুন স্মৃতি ঢুকিয়ে দেয়।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন বলল, “স্মৃতি ধ্বংস করার থেকে মেরে ফেলাই ভালো ছিল।”
ধবধবে ফর্সা মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, “স্মৃতি ধ্বংস করা আর মেরে ফেলার মাঝে কোনো পার্থক্য নাই।”
“আছে।” অন্যজন কঠোর গলায় বলল, “মেরে ফেললে শেষ। কিন্তু স্মৃতি ধ্বংস করলে আমার শরীরটা থেকে যায়, সেখানে অন্য একজন মানুষ বেঁচে থাকে। অন্য একজন মানুষ কেন আমার শরীরে বেঁচে থাকবে? আমার শরীরে আমি যদি বেঁচে থাকতে না পারি তাহলে আর কেউ বেঁচে থাকতে পারবে না।”
“কেন বেঁচে থাকতে পারবে না? এটা কোন ধরনের কথা?”
রিটিন দেখল মানুষগুলোর গলায় স্বর উঁচু হতে থাকে। তারা 1ৎকার করতে থাকে, হই হল্লা করতে থাকে। রিটিন তখন একটু সরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করল।
রিটিন অপেক্ষা করতে করতে লক্ষ করে নির্দিষ্ট সময় পরপর ধূসর পোশাক পরা একটি রোবট এসে ট্র্যাকিওশান ট্র্যাকার দিয়ে লক করে একজন একজন করে মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যাকে ধরে নিতে যাচ্ছে তার ট্র্যাকিওশানে সিগন্যাল পাঠিয়ে মানুষটির স্নায়ুতে এক ধরনের কম্পন তৈরি করে। সেই কম্পনে একেকজনের প্রতিক্রিয়া হয় একেকরকম। কেউ কাঁপতে থাকে, কেউ ছটফট করতে থাকে, কেউ যন্ত্রণার কাতর শব্দ করতে থাকে। খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটি ঠিকই বলেছিল, এখানে মানুষগুলোকে ঠিক মানুষের সম্মান দেয়া হয় না।
বসে থাকতে থাকতে রিটিনের মনে হয় একটু ঝিমুনির মতো এসেছিল, হঠাৎ সে শরীরের ভেতর ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো ঝাঁকুনি অনুভব করল। সাথে সাথে সে বুঝে গেল ধূসর রোবটটা তাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। রিটিন চোখ খুলে তাকিয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তখন সে আবার নিজের ভেতর একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে, এবারে সেটি আগের থেকে তীব্র এবং যন্ত্রণাময়। রিটিন হাত তুলে বলল, “আসছি। আমি আসছি।”
রোবটটি তারপরও ট্র্যাকারটা তার দিকে ধরে রাখল এবং রিটিন নিজের শরীরের ভেতর তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করতে থাকল। রিটিন কোনোভাবে পা ফেলে দরজার দিকে ছুটে যেতে থাকে। ছুটে যেতে যেতে শুনতে পেল খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা উচ্চ স্বরে তাকে লক্ষ করে বলছে “ভয় পাবার কিছু নাই ছেলে, দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকো।”
কোথায় দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকতে হবে সে বুঝতে পারল, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা বোঝারও চেষ্টা করল না। দ্রুত রোবটের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। শরীরের ভেতর ঝাঁকুনিটা তখন একটু কমে গেল কিন্তু পুরোপুরি চলে গেল না।
রোবটটার পাশে পাশে হেঁটে সে ছোট খুপরির মতো একটা ঘরের সামনে এসে থেমে গেল, কেউ বলে দেয়নি কিন্তু সে বুঝতে পারল এই ঘরটিতেই তার স্ক্যানিং হবে।
খুপরির মতো ঘরের ভেতর থেকে কোনো একজন বলল, “চলে এসো।”
রিটিন ঘরের ভেতর ঢুকল। ঘরের মাঝামাঝি একটা চেয়ার, চেয়ারের চারপাশে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। কাছেই একটা ডেস্কের পেছনে একজন মাঝবয়সী মানুষ নিরাসক্ত দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকাল।
রিটিন বলল, “নিশ্চয়ই কিছু ভুল হয়েছে। আমি আসলে কিছু করিনি, একটা রোবটকে মেটাকোড দিয়ে অচল করে দিয়েছিলাম, খুবই নির্বুদ্ধিতা হয়েছিল কাজটি, কিন্তু সেটা তো বড় অপরাধ নয়। নির্বুদ্ধিতা তো অপরাধ হতে পারে না”
মানুষটি কোনো কথা না বলে যেভাবে তার দিকে তাকিয়েছিল সেভাবেই তাকিয়ে রইল। তার কোনো কথা শুনেছে কি না বোঝা গেল না। রিটিন আবার শুরু করল, “আমাকে মনে হয় তোমরা চলে যেতে দিতে পার–”
“বসো।” মানুষটি চেয়ারটা দেখিয়ে তাকে বসতে বলল।
রিটিন বলল, “তোমার সময় নষ্ট করতে চাই না আমি-”
মানুষটা আবার বলল, “বসো।”
রিটিন বলল, “বসার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আমি তোমাকে বলছি আমি কোনো অপরাধ করিনি, বিশ্বাস করো। আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি–”
মানুষটি একই ভঙ্গিতে নিরাসক্তভাবে বলল, “চেয়ারটাতে বসো।”
রিটিন তখন একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারটাতে বসল। বসে বলল, “ঠিক আছে বসছি। কিন্তু তোমাকে আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে।”
“মাথাটা হেলান দাও।”
রির্টিন মাথাটা হেলান দিল এবং তখন হঠাৎ দুই পাশ থেকে দুটো সিলিন্ডারের মতো কিছু এসে তার মাথাটাকে আটকে ফেলল। রিটিন ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী করছ? কী করছ তুমি?”
মানুষটা কোনো উত্তর দিল না, সামনে রাখা একটা প্যানেলে যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করতে লাগল। রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি রোবট?”
মানুষটা এবারেও তার কথার উত্তর দিল না। রিটিন বলল, “রোবট হলে তোমাকে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু মানুষ হলে আমি জানতে চাই তুমি ঠিক কী করতে যাচ্ছ?”
মানুষটা বলল, “আমি তোমার মস্তিষ্কের ভেতর দেখতে চাই।”
“মস্তিষ্কের ভেতরে?”
“হ্যাঁ। তুমি কী কর, কী চিন্তা কর, কী করেছ, কী করতে চাও। সবকিছু আমি দেখতে পাব। কাজেই চুপচাপ বসে থাকো।”
“কীভাবে দেখবে? মাথার ভেতরে ফুটো করে কিছু ঢোকাবে না তো?”
“না।”
“তাহলে?”
“কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকো। নিজেই দেখবে।”
হঠাৎ করে রিটিনের চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়, সে চোখ খুলে তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছু দেখছে না। ভয়ে আতঙ্কে সে চিৎকার করে উঠতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই সে বিচিত্র কিছু রং দেখতে পায়, রংগুলো স্থির নয়, কুণ্ডলী পাকিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধীরে ধীরে নড়ছে। রিটিন অবাক হয়ে বুঝতে পারল, সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে কিন্তু সে চোখ দিয়ে দেখছে না। দেখার অনুভূতিটি আসছে অন্য কোনোভাবে। মাথার কাছে যন্ত্রপাতির একটা ভোঁতা শব্দ হচ্ছিল, হঠাৎ করে সেই শব্দ ছাপিয়ে সে অন্য এক ধরনের শব্দ শুনতে পায়। এত বিচিত্র শব্দ সে তার জীবনে আগে কখনো শোনেনি, শব্দগুলো ঢেউয়ের মতো আসছে এবং যাচ্ছে।
চারপাশে কী হচ্ছিল প্রথম প্রথম রিটিন সেটা অনুভব করতে পারছিল কিন্তু ধীরে ধীরে সেই অনুভূতি চলে যেতে থাকে। রিটিন বুঝতে পারে তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। সে তার আঙুলটাও আর নাড়াতে পারছে না। তার ভেতরে একটা আতঙ্ক হওয়ায় কথা ছিল কিন্তু কোনো একটা কারণে এই মুহূর্তে ভয়ভীতি আতঙ্ক বা অন্য কোনো অনুভূতিই তার মাঝে নেই। তার মনে হতে থাকে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।
রিটিন হঠাৎ শীত শীত অনুভব করতে থাকে, মুখের ভেতর তীব্র একটা লোনা ভাব, সাথে সাথে বিচিত্র একটা গন্ধ। সেই অস্বাভাবিক গন্ধে তার সারা শরীর কুঞ্চিত হয়ে যায়। শীত শীত ভাবটা সরে গিয়ে হঠাৎ করে সে উষ্ণতা অনুভব করতে থাকে, হঠাৎ করে মনে হয় শরীরের চামড়া খুলে যেতে শুরু করেছে, কিছুক্ষণের জন্য তীব্র যন্ত্রণা, হঠাৎ করে সেই যন্ত্রণা সরে গিয়ে সমস্ত শরীর অনুভূতিহীন হয়ে যায়, মুখের ভেতর বিস্বাদ এক ধরনের মিষ্টি অনুভূতি, নাকে কটু গন্ধ। রিটিনের মনে হতে থাকে অনেক দূর থেকে একটা শিশু তাকে ডাকছে–সেই ডাকটি শুনে নিজের ভেতরে সীমাহীন এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকে। রিটিনের মনে হয় সে বেঁচে নেই, মনে হয় বেঁচে থাকা কিংবা না থাকার কোনো অর্থ নেই, কোনো গুরুত্ব নেই।
রিটিন কতক্ষণ এভাবে ছিল সে জানে না, হঠাৎ করে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সে পুরোপুরি জেগে উঠল। সামনে একটা ডেস্ক সেখানে মানুষটি যন্ত্রপাতির প্যানেলটির দিকে তাকিয়ে আছে। যন্ত্রপাতির ভোঁতা শব্দটি সে আবার শুনতে পেল, দেখল তার সারা শরীর কুলকুল করে ঘামছে।
মাথাকে শক্ত করে আটকে রাখা সিলিন্ডার দুটো আস্তে আস্তে সরে গেল, রিটিন মাথাটা মুক্ত করে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগল।
যন্ত্রপাতির প্যানেলের সামনে বসে থাকা মানুষটা রিটিনের দিকে তাকিয়েই বলল, “রিটিন, তুমি চেয়ার থেকে নেমে আসতে পার।”
রিটিন চেয়ার থেকে নামল। মানুষটি বলল, “তুমি চলে যেতে পার। বাইরে পি-টু তোমাকে বের হওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেবে।”
রিটিন ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু–”
মানুষটি নিরাসক্ত দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকাল। রিটিন বলল, “স্ক্যানিং করে তুমি কী দেখলে?”
“দেখলাম ক্যাটাগরি সি এর মানুষ হিসেবে তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটু বেশি। তুমি তোমার জন্যে ঠিক করে রাখা প্রোগ্রামের বাইরে লেখাপড়া করতে চাও।”
“সেটা কি অপরাধ?”
“না, সেটা অপরাধ না, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ। এই রকম মানুষেরা বিপজ্জনক হতে পারে।”
“আমি কি বিপজ্জনক?”
“এখনো হওনি। তোমার পক্ষে একটা ভালো যুক্তি আছে। শহরকেন্দ্রে একটা মেয়ে তোমাকে ক্রিমিজিমের নাম বলেছে, তারপরও তুমি সেখানে যাওনি। তোমার ভেতরে অপরাধপ্রবণতা নেই।”
“আর কিছু?”
“সময় পরিভ্রমণ নিয়ে লেখাপড়া করার চিন্তা মাথা থেকে দূর করো। এ সম্পর্কে তোমার চিন্তাভাবনা হাস্যকর। তুমি কখনো সেই সুযোগ পাবে না।”
“আর কিছু?”
“হিমবাহ প্রবাহে তোমার বাবা-মা আর তুমি ভেসে গিয়েছিলে, তোমার মা তোমাকে বাঁচানোর জন্যে মারা গিয়েছে, তোমার বাবা তোমার মাকে বাঁচানোর জন্যে মারা গিয়েছে, তোমার সেরকম একটা স্মৃতি আছে।”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আছে।” শৈশবের সেই স্মৃতি রিটিনের পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়, মায়ের সেই শেষ দৃষ্টিটি এখনো তাকে অস্থির করে তুলল। ২৮
মানুষটি বলল, “সেই স্মৃতিটি সত্যি নয়। তোমার মস্তিষ্ক সেই স্মৃতিটি তৈরি করেছে। সেরকম কিছু ঘটেনি।”
রিটিন বলল, “কী বলছ তুমি, আমার স্পষ্ট মনে আছে”
“আমি জানি, তোমার স্পষ্ট মনে আছে। মস্তিষ্ক এরকম স্পষ্ট মনে থাকা স্মৃতি তৈরি করে।”
“কিন্তু–”
“আর কিন্তু নয়। তুমি এখন যাও।”
রিটিন তবু ইতস্তত করতে থাকে, “আমার কি কিছু করতে হবে?”
“না। তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি যদি তোমার বাড়াবাড়ি এবং অযৌক্তিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা দূর করে তোমার জন্য নির্ধারিত স্বাভাবিক একটা জীবনে ফিরে যাও তোমার কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।”
“আমার ট্র্যাকিওশানে একটা অ্যালার্ট সিগন্যাল ছিল।”
“আমি সেটা বন্ধ করে দিয়েছি। তুমি এখন স্বাভাবিক একজন মানুষ। তোমাকে কোনো রোবট জ্বালাতন করবে না।”
“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”
মানুষটি প্রথম তার দিকে তাকাল, নরম গলায় বলল, “যাও। বাড়ি যাও। ঠান্ডা পানিতে গোসল করে একটা ঘুম দাও। আর শোনো”
রিটিন দাঁড়াল। মানুষটি এই প্রথম হাসি হাসি মুখে বলল, “এভোকাডো ফলটা খারাপ না। খেয়ে দেখো, ভালো লাগবে।”
রিটিন অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাল। সে দুই চোখে এভোকাডো নামক ফলটি দেখতে পারে না, মানুষটি সেটাও জানে! এই মানুষটির কাছে তার জীবনের গোপন কিছু নেই।
ঘরের বাইরে পি-টু রোবটটি অপেক্ষা করছিল, লম্বা পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসে।
রিটিন বলল, “খবরদার, বেশি কাছে আসবে না। দূরে দূরে থাকো। রোবট নিয়ে আমার অ্যালার্জি আছে।”
পি-টু বলল, “পি-টু রোবটটি পুরোপুরি জৈব নিষ্ক্রিয় পদার্থ দিয়ে তৈরি। অ্যালার্জি হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। মানবশরীরের অ্যালার্জিবিষয়ক প্রতিক্রিয়াটি গত শতকে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, এখন এটি একটা একাডেমিক বিষয় ছাড়া কিছু নয়। সাম্প্রতিক একটি বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে-”
রিটিন ধমক দিয়ে বলল, “চুপ করবে তুমি।”
পি-টু চুপ করে গেল।
০৩-০৪. ক্যাম্পের বাইরে সরু একটা রাস্তা
০৩.
ক্যাম্পের বাইরে সরু একটা রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ। গাছের ছায়ায় শুকনো পাতা মাড়িয়ে রিটিন অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকে। রাস্তাটা ঘুরে যেতেই রিটিন ছোট একটা পানীয়ের ঘর দেখতে পেল। ঘরটা চোখে পড়তেই সে বুঝতে পারল তার আসলে খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।
ঘরের সামনে দাঁড়াতেই দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। ঘরের এক কোনায় সোনালি চুলের একটা কম বয়সী মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজের ভেতরকার উদ্বেগটুকু লুকিয়ে রাখতে কিন্তু রিটিন বুঝতে পারল মেয়েটার ভেতরে চাপা উত্তেজনা।
রিটিন ছোট একটা গ্লাসে এক গ্লাস উত্তেজক পানীয় ঢেলে নেয়, তারপর গ্লাসটি নিয়ে মেয়েটির কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসে। মেয়েটির সাথে চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি নার্ভাস ভাবে একটু হাসল। বলল, “ক্যাম্প থেকে এসেছ?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“মিশিকেও গত রাতে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে। এতক্ষণে মনে হয় ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছে।”
রিটিন ভাবল জিজ্ঞেস করে মিশি কে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। মেয়েটা নিজে থেকেই বলল, “মিশি আমার অনেক দিনের বন্ধু। এই শীতে আমরা বিয়ে করব।”
রিটিন চলল, “ও আচ্ছা। চমৎকার।”
“হ্যাঁ। অনেক কষ্ট করে, অনুমতি পেয়েছি। ক্যাটাগরি সি মানুষদের বিয়ের অনুমতি দিতে চায় না।”
রিটিন তার গ্লাসের পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, “মিশিকে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে কেন?”
মেয়েটা নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করল, বলল, “শুধু শুধু। একেবারেই শুধু শুধু। কোনো কারণ নেই। ব্রেন স্ক্যানিং করে যখন দেখবে শুধু শুধু ধরে নিয়েছে তখন ছেড়ে দেবে, তাই না?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। স্ক্যান করে কিছু পায়নি।”
মেয়েটা ছটফটে চোখে রিটিনের চোখের দিকে তাকাল, বলল, “কিছু পায়নি?”
“না। কিন্তু ব্রেনের ভেতরে কী আছে সব জেনে গেছে।”
মেয়েটার চোখে এবারে উদ্বেগের একটা চিহ্ন ফুটে উঠল। শুকনো ঠোঁটগুলো জিব দিয়ে ভেজানোর চেষ্টা করে বলল, “সব জেনে যায়?”
“হ্যাঁ।” রিটিন মাথা নাড়ল, “পুরো মাথাটার ভেতরে ঢুকে যায়। একটা একটা করে স্মৃতি খুলে খুলে দেখে–”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। আমি যে এভোকাডো খেতে পছন্দ করি না সেটা পর্যন্ত জানে।”
মেয়েটা তার হাতের পানীয়ের গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিয়ে বলল, “মিশির ব্রেনে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু পাবে না।”
রিটিন বলল, “না, নিশ্চয়ই পাবে না।”
মেয়েটা অস্বস্তিতে ছটফট করতে থাকে। একটু পর গলা পরিষ্কার করে বলল, “কিন্তু যদি ভুলে কিছু একটা পেয়ে যায় তাহলে কী হবে?”
রিটিন বলল, “ভুল করে কিছু পাবার কথা না।”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “তা ঠিক।”
রিটিন তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে চোখের কোনা দিয়ে মেয়েটাকে লক্ষ করে। মেয়েটা বাইরে যতই শান্ত ভাব দেখাক ভেতরে ভেতরে সে অস্থির হয়ে আছে।
ঠিক এরকম সময় দরজাটা খুলে গেল এবং রিটিনের বয়সী একজন মানুষ ঘরের ভেতর এসে ঢুকল। মেয়েটি সাথে সাথে লাফ দিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “মিশি।”
মিশি মেয়েটার কথা শুনল বলে মনে হয় না। সে পানীয় ডিসপেন্সরের কাছে গিয়ে নিজের জন্যে একটা পানীয় বেছে নেয়। মেয়েটা দুই হাত উপরে তুলে মিশির দিকে ছুটে যেতে থাকে, চিৎকার করে বলতে থাকে, “আমি তোমার জন্যে সেই সকাল থেকে বসে আছি, মিশি–”
রিটিন দেখল মিশি একটু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল, বলল, “তুমি আমাকে বলছ?”
“তোমাকে না বললে আমি কাকে বলব? মিশি–মিশি–”
রিটিন দেখল মেয়েটি মিশিকে জাপটে ধরল আর সাথে সাথে মিশি একটা ঝটকা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। মেয়েটা প্রস্তুত ছিল না, পড়ে যেতে যেতে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে অবাক হয়ে কাতর গলায় বলল, “মিশি–”
মিশি বলল, “আমি মিশি না।”
মেয়েটা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “কী বলছ তুমি?”
“আমি ঠিকই বলছি। আমার নাম ক্লড।”
“মিশি! তুমি কী বলছ এসব? তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি গ্লানা।”
মানুষটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “আমি তোমাকে চিনি না। কখনো দেখিনি।”
রিটিন দেখল মেয়েটা আতঙ্কে থর থর করে কেঁপে উঠল। কাঁপা গলায় বলল, “মিশি–মিশি–”
মানুষটা কঠিন গলায় বলল, “আমি মিশি না। তুমি কিছু একটা ভুল করছ।”
“না, আমি ভুল করছি না মিশি! তোমার মনে নেই তোমাকে ক্যাম্পে নিয়ে গেল, তুমি আমাকে বললে-”
মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “না, আমি কাউকে কিছু বলিনি। তোমার দেখাও ভুল হয়েছে।”
“আমার কোথাও ভুল হয়নি মিশি, তুমি মনে করার চেষ্টা করো, আমি আর তুমি”
মানুষটা একধরনের বিস্ময় নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর কঠিন গলায় বলল, “তুমি কেন আমাকে এসব বলছ? আমি তোমাকে চিনি না, আমি তোমাকে কখনো দেখিনি”
মেয়েটা হঠাৎ আকুল হয়ে কেঁদে উঠল, আর্তচিৎকার করে চলল, “মিশি, আমার মিশি–”
মানুষটা তার পানীয়টা নিয়ে সরে গিয়ে একধরনের বিস্ময় নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বলল, “মিশি, সোনা আমার–আমি সারাটি জীবন তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি, এখন তুমি কেন আমাকে চিনতে পারছ না? আমার দিকে একবার তাকাও, ভালো করে তাকাও”
মানুষটা বিড়বিড় করে বলল, “তুমি ভুল করছ। ভুল-”
রিটিন উঠে দাঁড়াল, পানীয়ের গ্লাসটা টেবিলে রেখে সে মেয়েটার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরল, নরম গলায় বলল, “গ্লানা, আমার কথা শোনো”
মেয়েটা রিটিনের দিকে তাকাল। রিটিন নিচু গলায় বলল, “তোমার মিশির মস্তিষ্ককে প্রতিস্থাপন করে দিয়েছে–এই মানুষটি মিশি না।”
৩৪
“মিশি কোথায়?”
রিটিন মাথা নিচু করল, শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, “মিশি নেই। মিশির এই শরীরটা আছে কিন্তু সেখানে মিশি নেই–সেখানে অন্য কোনো মানুষ–”
গ্লানা নামের মেয়েটা আর্তনাদ করে বলল, “না-না, আমি বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করি না–বিশ্বাস করি না–”
রিটিন শক্ত করে মেয়েটাকে ধরে রাখল, বিচিত্র একধরনের বেদনায় তার বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যেতে থাকে।
.
রিটিন দীর্ঘ সময় শহরের শেষ মাথায় নদীর তীরে একটা পাথরের বেঞ্চে বসে রইল। নদী থেকে একধরনের উথালপাতাল মন খারাপ করা বাতাস বইছে। নদীর তীরে বড় বড় ঝাউগাছ, বাতাসে তার পাতা শিরশির করে কাঁপছে, গাছের পাতার শব্দে তার মন আনমনা হয়ে যায়।
আজ সকালের ঘটনাটি তার ভেতরে সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। মিশি আর গ্লানার খুব সুন্দর একটা জীবন হতে পারত, চিন্তু ক্যাটাগরি সি মানুষের সেই সুন্দর জীবনের অধিকার নেই। এই পৃথিবীর একেবারে ছকে বাঁধা মানুষ না হলে ক্যাটাগরি সি মানুষকে পাল্টে দেয়া হয়। রিটিন অনেক চেষ্টা করেও হঠাৎ করে দেখা হওয়া রানা নামের মেয়েটির আকুল হয়ে কান্নার কথা ভুলতে পারছে না। এই মেয়েটির সাথে তার হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। তার কথা মনে করে এরকম বিচলিত হওয়ার নিশ্চয়ই কোনো অর্থ নেই। কিন্তু তারপরও রিটিন বিচলিত হয়ে নদীর তীরে একা একা বসে রইল।
অন্ধকার নেমে আসার পর রিটিন উঠে দাঁড়ায়। সে এখন কোথায় যাবে জানে না। উদ্দেশ্যহীনভাবে শহরে ঘুরে বেড়াবে, যখন শরীর ক্লান্ত হয়ে উঠবে সে তার ছোট ঘরটাতে ফিরে যাবে। ঘরে যদি কোনো খাবারের প্যাকেট থাকে ভালো, যদি না থাকে কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে। ঠিক কী কারণ জানা নেই এই জীবনটিকে টেনে নিতে রিটিন আর কোনো আগ্রহ অনুভব করছে না।
রিটিনের ধারণা ছিল সে পুরোপুরি উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে, কিন্তু সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল হেঁটে হেঁটে কীভাবে কীভাবে জানি সে একটা আলোকোজ্জ্বল উত্তেজক পানীয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উপরে জ্বলজ্বলে আলোতে লেখা ‘ক্রিমিজিম’। গতকাল একটি মেয়ে তাকে বলেছে এখানে ঘাঘু ক্রিমিনালরা আড্ডা দেয়। কেউ যদি তার শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান খুলে ফেলে দিতে চায় তাকে এখানে আসতে হবে। রিটিনের ট্র্যাকিওশানে এখন কোনো সমস্যা নেই–তার এখানে আসার কথা নয় কিন্তু সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সে ক্রিমিজিমের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
ভেতরে অনেক নারী-পুরুষ উত্তেজক পানীয় খেতে খেতে হইহল্লা করছে। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার, তার মাঝে দ্রুতলয়ের একধরনের সঙ্গীতের সুর, রিটিন নিজের অজান্তেই সেই সুরের সাথে তাল দিতে দিতে সামনে এগিয়ে যায়।
ঘরের মাঝামাঝি পৌঁছানোর আগেই কম বয়সী একটা মেয়ে স্বচ্ছ একটা ট্রেতে বেশ কয়েক ধরনের পানীয়ের গ্লাস নিয়ে রিটিনের দিকে এগিয়ে আসে, মেয়েটি শরীরে কিছু একটা মেখে এসেছে, যার কারণে তার শরীর থেকে হালকা নীল একধরনের আলো বের হচ্ছে। মেয়েটি আহ্লাদী গলায় রিটিনকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী খাবে গো ছেলে? আমাদের নতুন পানীয়ের চালান এসেছে।”
“আমি কিছু খাব না।”
“তুমি কিছু না খেলে এখানে কেন এসেছ? এখানে এলে কিছু না কিছু খেতে হয়।”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না, আমার মাথা শীতল রাখতে হবে। আমি এখানে একটা কাজে এসেছি।”
মেয়েটির গলার স্বর হঠাৎ হঠাৎ করে স্বাভাবিক হয়ে যায়। সে তীক্ষ্ণ চোখে রিটিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কী কাজ?”
“আমি আমার শরীর থেকে ট্র্যাকিওশানটা বের করে ফেলতে এসেছি। শুনেছি এখানে নাকি সেটা করা যাবে!”
মেয়েটি পলকহীন চোখে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি কাকে খুন করে এসেছ?”
“আমি কাউকে খুন করিনি।”
“তাহলে তুমি কেন তোমার ট্র্যাকিওশান সরিয়ে ফেলতে চাইছ? তুমি জান শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান সরিয়ে ফেললে একজন মানুষ আর একটি ব্যাকটেরিয়ার মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না?”
রিটিন হাসল, বলল, “আমি ক্যাটাগরি সি মানুষ। ক্যাটাগরি সি মানুষ আর একটি ব্যাকটেরিয়ার মাঝে এমনিতেই কোনো পার্থক্য নেই।”
শরীর থেকে হালকা নীল আলো বের হওয়া মেয়েটি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দূরে একটি চতুষ্কোণ দরজা দেখিয়ে বলল, “ওই দরজাটি দিয়ে ভেতরে ঢোকো।”
রিটিন বলল, “ধন্যবাদ তোমাকে।”
মনে রেখো, “তুমি দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকবে কিন্তু আর কখনোই বের হতে পারবে না।”
রিটিন হাসল, বলল, “ব্যাকটেরিয়া নিজের ইচ্ছেয় কোথাও ঢোকে না, কোথাও বের হয় না।”
মেয়েটি বলল, “চমৎকার। যাও।”
রিটিন হেঁটে যেতে থাকে তখন পেছন থেকে মেয়েটি আবার তাকে ডাকল। রিটিন ঘুরে তাকাতেই মেয়েটি তার ট্রে থেকে হালকা গোলাপি রঙের একটা পানীয়ের গ্লাস তুলে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এক চুমুক দিয়ে এই পানীয়টা খেয়ে ফেলো। ভালো লাগবে। ভয় নেই তোমার মস্তিষ্ক উত্তেজিত হবে না।”
রিটিন পানীয়ের গ্লাসটা হাতে নেয়। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।”
রিটিন এক চুমুকে পানীয়টি খেয়ে মেয়েটিকে গ্লাসটি ফেরত দিল। তার সারা শরীরে এক ধরনের কোমল উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে, নিজের ভেতর সে বিচিত্র এক ধরনের সজীবতা অনুভব করে। হঠাৎ করে তার বিষণ্ণতাটুকু কেটে সেখানে একধরনের ফুরফুরে আনন্দ এসে ভর করে।
মেয়েটি বলল, “অপরাধী জীবনে স্বাগতম। তোমার অপরাধী জীবন আনন্দময় হোক।”
রিটিন কোনো কথা না বলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে এক মুহূর্ত দ্বিধান্বিতভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল।
.
০৪.
ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার। রিটিন একটা চেয়ারে বসে আছে। সামনে বড় টেবিল, টেবিলের অন্য পাশে একজন মাঝবয়সী মানুষ। টেবিলের উপর একটা ল্যাম্প, ল্যাম্পটা সরাসরি তার দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে, কাজেই মানুষটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মানুষটা তৃতীয়বার তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার শরীর থেকে তুমি ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলতে চাও?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“তোমার শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান সরিয়ে ফেললে তোমার দৈনন্দিন জীবনটা কীভাবে পাল্টে যাবে তুমি জান?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না, জানি না। জানতেও চাই না।”
“কেন জানতে চাও না?”
“আমি বুঝতে পেরেছি ক্যাটাগরি সি মানুষ হিসেবে আমার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। এর চাইতে একজন অপরাধীর জীবন হয়তো বেশি আকর্ষণীয়।”
মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “অপরাধী হয়ে তুমি কী কী অপরাধ করবে বলে ঠিক করেছ?”
রিটিন হেসে ফেলল, বলল, “আইন ভাঙা হলে সেটাকে বলা হয় অপরাধ। অনেক আইন আছে যেটা থাকা উচিত না। সেই আইনগুলো ভাঙাও অপরাধ কিন্তু আমি আনন্দের সাথে সেগুলো ভাঙব। শুধু মানুষ খুন করে কিংবা মাদকের ব্যবসা করে অপরাধী হতে হবে কে বলেছে?”
“একটা উদাহরণ দিতে পারবে?”
“ক্যাটাগরি সি মানুষ হিসেবে আমি যদি সময় পরিভ্রমণ নিয়ে কাজ করি সেটাও একটা অপরাধ-আমার সেই অপরাধ করতে কোনো দ্বিধা নেই।”
রিটিন টের পেল টেবিলের অন্য পাশের মানুষটি হঠাৎ সোজা হয়ে বসেছে। সামনে একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, “তুমি সময় পরিভ্রমণ বিষয়টির কথা কেন বললে?”
“আমি অনুমান করছি সময় পরিভ্রমণ নিয়ে একটা বড় আবিষ্কার হয়েছে। মানুষ হয়তো সময় পরিভ্রমণ করার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।”
“তুমি কেমন করে সেটি অনুমান করেছ?”
“আমার বাসায় শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটা রোবট রুটিন চেক আপের জন্যে এসেছিল। যেই মুহূর্তে আমি সময় পরিভ্রমণ কথাটি উচ্চারণ করেছি তখনই আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে অচেতন করে ধরে নিয়ে গেছে। আমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করেছে। কাজেই আমি ধরে নিচ্ছি সময় পরিভ্রমণ খুব স্পর্শকাতর একটা বিষয়।”
“স্পর্শকাতর? কেন?”
“সম্ভবত ক্যাটাগরি সি মানুষের কাছেও কোনো না কোনোভাবে সময় পরিভ্রমণের প্রযুক্তি চলে এসেছে।”
টেবিলের অন্যপাশে বসে থাকা মানুষটা বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল, তারপর বলল, “তুমি যে কথাগুলো বলেছ সেগুলো তুমি সত্যি বলেছ কি না আমাদের জানা প্রয়োজন।”
রিটিন বলল, “আমি সত্যি বলেছি।”
“তোমার মুখের কথা যথেষ্ট নয়। আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”
“কীভাবে পরীক্ষা করবে?”
“সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা। কিন্তু আমরা এখনো মস্তিষ্ক স্ক্যানার জোগাড় করতে পারিনি। তাই তোমার মস্তিষ্কের ভেতরে দেখতে পারব না। তোমাকে আমরা প্রশ্ন করব। প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় তোমার মস্তিষ্কের কোন জায়গাটা অনুরণিত হচ্ছে আমরা দেখব। সেখান থেকে বুঝতে পারব তুমি সত্যি কথা বলছ নাকি মিথ্যা কথা বলছ।”
রিটিন কোনো কথা বলল না।
মানুষটা বলল, “কেউ যখন আমাদের কাছে আসে আমাদের নিশ্চিত হতে হয় যে সে সত্যি কথা বলছে।”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “কেউ সত্যি কথা না বললে তখন তোমরা কী কর?”
মানুষটি বলল, “তুমি আমাকে সেটা জিজ্ঞেস কোরো না, আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।”
রিটিন আর কোনো প্রশ্ন করল না, সে তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।
.
রিটিনের পরীক্ষাটি হলো দীর্ঘ। প্রথমে তার শরীরে একটা ইনজেকশান দেয়া হলো, সেখানে কী ছিল কে জানে কিন্তু রিটিন অনুভব করতে থাকে কোনো বিষয় নিয়ে সে আর দীর্ঘ সময় চিন্তা করতে পারছে না। তাকে যখনই কোনো একটা প্রশ্ন করা হয় সে তাৎক্ষণিকভাবে তার উত্তর দিয়ে দেয়, উত্তরগুলো হয় সংক্ষিপ্ত এবং সুনির্দিষ্ট। পুরো সময়টিতে তার মাথার মাঝে অসংখ্য প্রোব লাগানো ছিল এবং সেই সিগনালগুলোর সাথে প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে তার সত্যি-মিথ্যা বের করে নেয়া হয়।
পরীক্ষার শেষের দিকে তাকে বলা হলো প্রত্যেকটা প্রশ্নে ভুল উত্তর দেয়ার জন্যে। রিটিন আবিষ্কার করল যেকোনো কারণেই হোক সেটি এখন তার জন্যে যথেষ্ট কঠিন। ভুল উত্তর দেয়ার জন্যে তাকে একটু চিন্তা করতে হয় কিন্তু সে এখন আর চিন্তা করতে পারছে না।
রিটিনের মনে হতে থাকে তার পরীক্ষা বুঝি কখনো শেষ হবে না। কিন্তু একসময় সেটি শেষ হলো। মাঝবয়সী মানুষটি এসে তার সাথে হাত মিলিয়ে নরম গলায় বলল, “পরীক্ষায় পাস করেছ। তোমাকে আমরা আমাদের সংগঠনে নিতে পারি। তোমার ট্র্যাকিওশান আমরা সরিয়ে দেব।”
রিটিন জড়িত গলায় বলল, “ধন্যবাদ।”
“তোমার শরীরে ইনজেক্ট করে দেয়া গ্লিফারুলটিকে মেটাবলাইজ করার জন্যে তোমার এখন ঘুমাতে হবে।”
“হ্যাঁ। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”
“এসো, আমার সাথে এসো।”
মানুষটি রিটিনকে ছোট একটা খুপরির মতো ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে পরিপাটি করে সাজানো একটা বিছানা। রিটিন কোনো কথা বলে সাথে সাথে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল এবং কিছু বোঝার আগেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল।
রিটিনের ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে। বিছানায় উঠে বসার পর সে কোথায় সেটি বুঝতে তার কিছুক্ষণ সময় লাগল। হঠাৎ করেই তার সবকিছু মনে পড়ে যায়। রিটিন তখন বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বের হয়ে আসে। দরজার বাইরে একটা টানা বারান্দা, বারান্দার শেষ মাথায় একটি ঘরে আলো জ্বলছে। রিটিন বারান্দা দিয়ে হেঁটে ঘরটিতে উঁকি দেয়, ঘরের মাঝখানে একটা চতুষ্কোণ গ্রানাইটের টেবিল, টেবিলে হাত রেখে মাঝবয়সী একজন মানুষ ভিডি টিউবে কিছু একটা দেখছে। রিটিনকে দেখে মানুষটি মুখে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করে বলল, “ঘুম ভাঙল?”
রিটিন নিঃশব্দে মাথা নেড়ে ঘরটির ভেতরে ঢুকে মানুষটির সামনে একটা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করল, “আমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?”
মানুষটি ভিডিও টিউব থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, “অনেকক্ষণ।”
রিটিন বলল, “আমার খুব খিদে পেয়েছে।”
মানুষটি বলল, “পাবার কথা। পাশের ঘরে কিচেন, সেখানে খাবার রয়েছে। খেয়ে এসো। সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
রিটিন অবাক হয়ে বলল, “আমার জন্যে?”
“হ্যাঁ। তোমাদের মতো কয়েকজন আছে তাদের নিয়ে ট্রানা এক সাথে বসবে। যাও খেয়ে এসো।”
রিটিন সচরাচর খায় কিচেনে বসে তার থেকে অনেক বেশি খেয়ে ফেলল। খাওয়া শেষে একটা গ্লাসে তার পছন্দের একটা পানীয় নিয়ে সে মানুষটির কাছে ফিরে আসে। মানুষটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো যাই।”
বেশ কয়েকটা সরু করিডর ধরে হেঁটে দুজনে একটা বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল, মানুষটি দরজা খুলে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “যাও। ভেতরে সবাই আছে।”
রিটিন ভেতরে ঢুকল। ঘরের মাঝখানে একটা কালো টেবিল, টেবিলের চারপাশে আরামদায়ক চেয়ার কিন্তু কেউ চেয়ারে বসে নেই। ঘরের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাঁচজন মানুষ, দুজন পুরুষ, তিনজন মহিলা। মানুষগুলো সবাই মধ্যবয়স্ক, সম্ভবত এদের মাঝে রিটিনের বয়স সবচেয়ে কম। রিটিন ঘরে ঢোকার সাথে সাথে সবাই মুখ তুলে তার দিকে তাকাল, রুপালি চুলের একজন মহিলা বলল, “তুমি নিশ্চয়ই রিটিন। এসো রিটিন, আমরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।”
রিটিন তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি দুঃখিত। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তোমাদের দেরি করিয়ে দিলাম।“
রুপালি চুলের মহিলাটি বলল, “না, তুমি দেরি করিয়ে দাওনি। তোমার শরীরের মেটাবলিজম যথেষ্ট বেশি, তুমি অনেক তাড়াতাড়ি উঠেছ। এসো বসো। আমার নাম ট্রানা। আমাকে তোমাদের ব্রিফিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।”
ঘরের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো এবারে টেবিলের চারপাশের আরামদায়ক চেয়ারগুলোতে বসে পড়ল। রিটিন টেবিলটা স্পর্শ করতেই সেখানে স্বচ্ছ একটা স্ক্রিন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সেখানে টেবিলের অনন্য মানুষগুলোর পরিচয় ভেসে উঠল। একজন মেকানিক, দুজন শিক্ষক এবং আরেকজন নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করত। মধ্যবয়স্ক মেকানিকটির বয়স পঁয়তাল্লিশ, মহিলা দুজন ত্রিশ এবং পঁয়ত্রিশ। রিটিনের বিপরীতে বসে থাকা কঠিন চেহারার নিরাপত্তাকর্মীর বয়স ত্রিশ, এদের মাঝে রিটিনের বয়স সবচেয়ে কম, মাত্র তেইশ।
ট্রানা বলল, “তোমাদের শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান এখনো সরিয়ে নেয়া হয়নি, তাই টেবিলে রাখা ভিডি স্ক্রিনে তোমরা একে অন্যের পরিচয় জেনে নিতে পারছ। ট্রাকিওশান সরিয়ে নেয়ার পর তোমাদের আর কোনো পরিচয় থাকবে না। আমি সরাসরি কাজের কথায় চলে আসি।”
রিটিন তার চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসে উৎসুক চোখে ট্রানার দিকে তাকাল। ট্রানা বলল, “পৃথিবীর মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ক্যাটাগরি এ এবং সি। তোমরা যারা এখানে এসেছ সবাই ক্যাটাগরি সি। তোমরা সবাই তোমাদের জীবনে কোনো না কোনো বৈষম্যের শিকার হয়েছ, সেই বৈষম্য থেকে তোমাদের কোনো এক ধরনের আত্মোপলব্ধি হয়েছে, তোমরা বুঝতে পেরেছ এই বৈষম্যটি অমানবিক, মানুষ হিসেবে অসম্মানজনক। তোমরা কীভাবে তার প্রতিবাদ করবে সেটি বুঝতে পারোনি, তাই এখানে এসেছ কোনো কোনোভাবে প্রতিবাদ করার জন্যে। তোমাদের ধন্যবাদ।”
“প্রথমেই তোমাদের কিছু তথ্য দিই। পৃথিবীতে ক্যাটাগরি এ এবং সি মানুষের সংখ্যা সমান নয়। ক্যাটাগরি সি-এর মানুষ ক্যাটাগরি এ থেকে প্রায় দশ গুণ বেশি। অর্থাৎ পৃথিবীর দশ ভাগের এক ভাগ মানুষ অন্যদের উপর একধরনের কর্তৃত্ব করে যাচ্ছে–”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “ক্যাটাগরি এ এবং সি আছে। ক্যাটাগরি বি নেই কেন?”
ট্রানা হাসল, বলল, “আমি জানতাম তোমাদের কেউ না কেউ এই প্রশ্নটা করবে। সব মানুষকে শুধু দুটি ভাগে ভাগ করলে বিভাজনটি দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে, তাই মাঝখানে একটা কাল্পনিক প্যাডিং রাখা হয়েছে। সবাই ধরে নেয় ক্যাটাগরি বিও নিশ্চয়ই আছে।”
টেবিলের চারপাশে বসে থাকা সবাই বিস্ময়ের মৃদু শব্দ করল, একজন মহিলা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ট্রানা বলল, “আমি জানি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছ না যে, অল্পসংখ্যক ক্যাটাগরি এ মানুষ বিপুলসংখ্যক ক্যাটাগরি সি মানুষকে পায়ের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু জেনে রাখো আমি তোমাদের ভুল বলছি না। গত কয়েক শতাব্দীর ভেতরে মানুষ অনেক ধরনের সামাজিক উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গিয়েছে, সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে মানুষকে তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া, তাদের মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া যে, তাদের জন্ম হয়েছে। নির্দিষ্ট একধরনের কাজ করার জন্যে। তারা শুধু সেই কাজটি করতে পারবে, এর চাইতে ভিন্ন কোনো কাজ করার ক্ষমতা তাদের নেই।”
রিটিন নিজের অজান্তেই তার মাথা নাড়ল। ট্রানা মুখে প্রায় জোর করে একধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, “মানুষের মাঝে বিভাজন করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার এই পদ্ধতিটি অনেক প্রাচীন এবং খুবই কার্যকরি। গত কয়েক শতাব্দীতে মানুষের সমাজে কোনো সংঘাত হয়নি।”
“কিন্তু তোমরা যে রকম নিজ থেকে এই পদ্ধতিটির সমস্যাটি ধরতে পেরেছ, এর একটি সমাধান বের করতে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছ এবং নিজের জীবনের উপর অচিন্তনীয় একটা ঝুঁকি নিয়েছ। ঠিক সেরকম আরো অনেকেই তোমাদের আগে এই কাজটি করে এসেছে। তারা সংগঠিত হয়েছে, তারা সুনির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যখন সময় হবে তোমরা সেগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে।”
কঠিন চেহারার নিরাপত্তারক্ষীটি বলল, “আমাদের একটা সশস্ত্র বিপ্লব করা উচিত–”
ট্রানা হেসে ফেলল, বলল, “সশস্ত্র বিপ্লব জাতীয় বিষয়গুলো কয়েক শতাব্দী আগেই পরিত্যক্ত হয়ে গেছে–তবে হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমাদের সশস্ত্র হতে হয়, ছোটখাটো গোলাগুলি বিস্ফোরণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তোমরাও নিশ্চয়ই যাবে।”
নিরাপত্তারক্ষীটি বলল, “আমি নিজের হাতে ক্যাটাগরি এ মানুষকে খুন করতে চাই।”
ট্রানার হাসিমুখটিতে হঠাৎ একধরনের কাঠিন্য চলে আসে, সে মাথা নেড়ে বলল, “তোমাদের এখনই কিছু বিষয় বলে দেয়া দরকার। আমরা সংখ্যায় এখনো খুবই কম, কাজেই আমাদের টিকে থাকার উপায় মাত্র একটি। সেটি হচ্ছে আমরা কেউ নিজেদের ভিন্ন একটি মানুষ বলে মনে করব না। আমরা সবসময়ই মনে করব আমরা সবাই মিলে একটা অস্তিত্ব। কাজেই আমাদের কাউকেই নিজেদের গন্ডীর বাইরে যাওয়া চলবে না। যতদিন আমরা পৃথিবীর এই বিভাজনটি দূর করতে না পারব ততদিন আমরা আমাদের উপর দেয়া সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের বাইরে কিছু করব না। আমার ক্যাটাগরি মানুষকে খুন করে ফেলার ইচ্ছা করলেও সেটা মুখে উচ্চারণ পর্যন্ত করব না।”
শিক্ষিকা একজন মহিলা বলল, “ট্রানা–”
ট্রানা মহিলাটির দিকে ঘুরে তাকাল, “বলো।”
“আমরা কি সত্যি একদিন পৃথিবীর এই বিভাজন দূর করতে পারব?”
ট্রানা হাসল, বলল, “সেই পুরানো কথাটি শুনোনি? লক্ষ্যে পৌঁছানো আমাদের উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যে চেষ্টা করা আমাদের উদ্দেশ্য।”
রিটিন বলল, “আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাব ট্রানা।”
“পৌঁছাব?”
“হ্যাঁ, আমরা নিশ্চয়ই পৃথিবীর মানুষের মাঝে এই ভাগাভাগি দূর করে ফেলতে পারব।”
ট্রানা একধরনের অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মেকানিক মানুষটি বলল, “আমরা কেমন করে অগ্রসর হব ট্রানা? আমাদের পরিকল্পনাটা কী?”
ট্রানা হাসল, বলল, “সময় হলেই জানতে পারবে। খুঁটিনাটি সবকিছু আমরা জানি না। নিরাপত্তার জন্যে সবাইকে সবকিছু জানানো হয় না। তবে তুমি জেনে রাখো আমাদের একটা পরিকল্পনা আছে।”
রিটিন বলল, “আমি বলব পরিকল্পনাটা কী?”
ট্রানা একটু অবাক হয়ে বলল, “তুমি জানো?”
“না। জানি না, অনুমান করতে পারি।”
“শুনি তোমার অনুমান।”
রিটিন গলার স্বরটা যথাসম্ভব গম্ভীর করে বলল, “পৃথিবীর মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার আগে তাদের সব রকম তথ্যের দরকার। সব তথ্য সংগ্রহ করা হয় ট্র্যাকিওশান দিয়ে। ট্রাকিওশানের তথ্য প্রক্রিয়া করার জন্যে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও একটা তথ্যভান্ডার আছে, বিশাল নেটওয়ার্ক আছে। আমাদের সেই তথ্যভান্ডার ধ্বংস করে নেটওয়ার্ক ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে। সাথে সাথে পুরো পৃথিবীর সব মানুষ মুক্ত হয়ে যাবে!”
মেকানিক মানুষটি বলল, “তুমি মনে হয় ঠিকই বলেছ ছেলে। তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে, কেমন করে তুমি ক্যাটাগরি সি হলে বুঝতে পারছি না!”
নিরাপত্তাকর্মী মানুষটি বলল, “ছেলে, তুমি একটা জিনিস ভুলে যাচ্ছ।”
“কী জিনিস?”
“পৃথিবীর সব তথ্য সংরক্ষণ করার জন্যে যে বিল্ডিংটি আছে সেটার ভেতরে কোনো মানুষ কখনো যেতে পারবে না। থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা ফেলেও সেটার দেয়ালে একটা ফাটল তৈরি করা যাবে না। এর ভেতরে যে নিরাপত্তা সেই নিরাপত্তা ভেঙে একটা মানুষ দূরে থাকুক একটা ব্যাকটেরিয়া পর্যন্ত যেতে পারবে না।”
রিটিন কঠিন মুখে বলল, “তুমি কেমন করে জানো?” “আমি নিরাপত্তাকর্মী। আমি জানি।”
রিটিন কঠিন মুখে বলল, “তবুও নিশ্চয়ই মূল তথ্যভান্ডার ধ্বংস করা যাবে। নিশ্চয়ই করা যাবে।”
নিরাপত্তাকর্মী কঠিন মুখে বলল, “মাত্র চার বিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাহলে সূর্য রেড জায়ান্টে পরিণত হয়ে পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলার সাথে সাথে তোমার তথ্য ভান্ডারকেও–” কথা শেষ করে মানুষটি কাঠ কাঠ শব্দে হেসে উঠল।
রিটিন হঠাৎ করে বুঝতে পারল কেন মানুষটি এত কম হাসে–কারণ নিরাপত্তাকর্মীর হাসিটির ভেতর কোনো আনন্দ ছিল না। আনন্দহীন হাসির মতো অসুন্দর জিনিস বুঝি পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
০৫-০৬. ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলার প্রক্রিয়া
০৫.
ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলার প্রক্রিয়াটি ছিল যন্ত্রণাহীন, তবে খুবই সময়সাপেক্ষ। এটি রক্তের সাথে মিশে শরীরের ভেতর দিয়ে হৃৎপিণ্ডের ভেতর একটি জায়গায় স্থিতি হয়। সেখান থেকে এটাকে মুক্ত করে ধমনির ভেতর দিয়ে হাতের কোনো একটা আঙুলের মাঝে নিয়ে আসা হয়, এই সময়টিতে খুব সতর্ক থাকতে হয় যেন এটি কোনোভাবে রক্তের প্রবাহের সাথে মস্তিষ্ক চলে না যায়, একবার সেটি মস্তিষ্কে হাজির হলে আর মুক্ত করে আনা যায় না। এছাড়া ট্রাকিওশানের সিগন্যাল আদান-প্রদান মস্তিষ্কে একধরনের অনুরণন তৈরি করে, সে কারণে তখন মানুষের হ্যাঁলুসিনেশন শুরু হতে পারে।
রিটিন একটা অপারেশন টেবিলে শুয়ে ছিল, তার শরীরের বিভিন্ন জায়গা টেবিলের সাথে আঁটকে রাখা হয়েছে–মাঝে মাঝে তাকেই নানা ধরনের শারীরিক প্রক্রিয়া করতে বলা হচ্ছিল এবং সে বাধ্য ছেলের মতো সেগুলো করে যাচ্ছে। তার উপর একজন মানুষ এবং দুইটা রোবট ঝুঁকে আছে। তারা চাপা স্বরে কথা বলছে, হঠাৎ করে তাদের মাঝে একধরনের উত্তেজনা দেখা গেল, একজন তার ডান হাতের তর্জনীটি চেপে ধরল, রোবটটি একটা সিরিঞ্জ দিয়ে তার ৩র্জনীর মাথা থেকে এক ফোঁটা রক্ত টেনে বের করে নেয় এবং তখন সম্মিলিতভাবে সবাই একটা আনন্দধ্বনি করে। রিটিন বুঝতে পারল ট্রাকিওশানটি বের করা সম্ভব হয়েছে।
মানুষ দুজন তার শরীরের বাঁধন খুলতে থাকে। একটি রোবট বলল, “তোমাকে অভিনন্দন ছেলে, তুমি এখন একজন ট্র্যাকিওশান মুক্ত মানুষ।”
মানুষটি বলল “অভিনন্দন শব্দটি যথার্থ হলো কি না বুঝতে পারলাম না। সম্ভবত বলা উচিত তুমি এখন থেকে একজন অভিশপ্ত মানুষ।” কথা শেষ করে মানুষটি আনন্দহীন একধরনের হাসি হাসতে থাকে।
একটি রোবট রিটিনের ট্র্যাকিওশানসহ রক্তের ফোঁটাটি সিরিঞ্জের ভেতর থেকে একটা এম্পুলে ঢুকিয়ে দিতে থাকে। রিটিন উঠে বসতে বসতে বলল, “আমার ট্র্যাকিওশানটি এখন কী করবে?”
মানুষটি বলল, “সংরক্ষণ করব, অনেক সময় পুরানো ট্র্যাকিওশান কাজে লাগানো যায়।”
“আমি শুনেছি শরীর থেকে বের করলে সেটা অকেজো হয়ে যায়।”
“হ্যাঁ। সেটাকে রক্তের প্রবাহে রাখতে হয়। যোগাযোগ না থাকলে ট্রাকিওশান নিজ থেকে বন্ধ হয়ে যায়।”
রিটিন টেবিল থেকে নামতে নামতে বলল, “আমি কি এখন যেতে পারি?”
“হ্যাঁ যেতে পারো। শরীর থেকে ট্র্যাকিওশান বের করার পর সবাইকে একটা কঠিন ট্রেনিংয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। তোমাকেও যেতে হবে।”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
.
রিটিন ভেবেছিল কঠিন শব্দটি একটি কথার কথা। কিন্তু সে আবিষ্কার করল ট্রেনিংটি সত্যিকার অর্থেই কঠিন। যেহেতু পুরো পৃথিবীটাকে সাজানো হয়েছে ট্র্যাকিওশানের তথ্যের উপর নির্ভর করে, সব মানুষ এটার ব্যবহার এত অভ্যস্ত হয়ে যায় যে, হঠাৎ করে সেটা শরীর থেকে সরিয়ে নেয়া হলে সে খুব সহজেই বিপদে পড়ে যাবে। অবাক হয়ে লক্ষ করবে ট্রেনের দরজা খুলছে না, দোকানে ঢুকতে পারছে না, রাস্তা পার হতে পারছে না, এক বোতল পানি পর্যন্ত কিনতে পারছে না। একজন মানুষ হঠাৎ করে অনুভব করতে থাকবে একটি দেহ থাকার পরও সে যেন অদৃশ্য, কেউ যেন আর তাকে দেখতে পাচ্ছে না।
কাজেই ট্রেনিংয়ের মাঝে রিটিনকে অসংখ্যবার একই জিনিস করতে হলো যতক্ষণ পর্যন্ত মাথার মাঝে সেটা ঢুকে না যায়। শুধু মাথার মাঝে নয় যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টুকু তার অবচেতন মনেও ঢুকে না যায়। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ পর রিটিনের ইন্ট্রাক্টর ঘোষণা করল সে ইচ্ছে করলে এখন শহরে যেতে পারবে। রাস্তায় হাঁটতে পারবে। দোকানে ঢুকতে পারবে–এমনকি একটা তরুণীকে নিয়ে ক্যাফেতে পানীয় খেতেও যেতে পারবে। তবে প্রতিটি মুহূর্ত তাকে সতর্ক থাকতে হবে, এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারবে না যে এখন সে কার্যত অদৃশ্য একজন মানুষ!
পরদিন রিটিন প্রথমবার তার গোপন আস্তানা থেকে বের হলো। জায়গাটা শহরতলিতে একটা নির্জন এলাকা। এক পাশে একটি অরণ্য, অন্য পাশে সারি সারি ওয়ারহাউস। বড় বড় স্বয়ংক্রিয় লরি ট্রাক যাচ্ছে-আসছে। রোবটেরা সেখান থেকে মালপত্র নামাচ্ছে এবং তুলছে। রিটিন পাশের সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেল এবং প্রথমবার ট্র্যাকিওশানহীনভাবে একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রামে উঠে গেল। নিয়মটি সহজ–অন্য একজন মানুষের সাথে সাথে উঠে যেতে হবে–কারণ তার জন্যে ট্রামের দরজা খুলবে না কিংবা বন্ধ হবে না। শহরকেন্দ্রে অন্যান্য মানুষের ভিড়ে নেমে গিয়ে সে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করল, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মানুষজনকে যেতে-আসতে দেখল এবং তাদের মাঝে রোবটদের আলাদা করার চেষ্টা করতে থাকল। শুধু তাই নয় নিম্নশ্রেণির একটা সাইবর্গকে পেয়ে সে পাশাপাশি হেঁটে যেতে যেতে একটা মেটাকোড বলে সেটাকে অচল করে দিল। দূর থেকে লক্ষ করল সেটি একটি ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে থেমে গিয়ে হঠাৎ করে পুরোপুরি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে শুরু করে এবং মুহূর্তের মাঝে অসংখ্য স্বয়ংক্রিয় গাড়ি এবং বাইভার্বালের একটি জটলা তৈরি হয়ে যায়।
রিটিন দূর থেকে জটলাটি কিছুক্ষণ উপভোগ করে নিজের আস্তানায় ফিরে এল।
.
সন্ধেবেলা ডাইনিং টেবিলে একটা ঘটনা ঘটল। সে অন্যদের সাথে খেতে বসেছে, তখন হঠাৎ বুঝতে পারল ঘরের মাঝে একধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, কারণটি বোঝার জন্যে সে পাশের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
মেয়েটি বলল, “ক্লিওন।”
“ক্লিওন কে?”
মেয়েটি চাপা গলায় বলল, “তুমি ক্লিওনের নাম শোননি? আমাদের পুরো আন্দোলনের নেতা।”
রিটিন অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কেউ আমাকে বলেনি। আমি কেমন করে জানব?”
রিটিন মাথা ঘুরিয়ে ক্যাটাগরি সি মানব প্রজাতির অধিকার আদায়ের নেতা ক্লিওনকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, “কোন জন ক্লিওন?”
“ওই যে বয়স্ক মানুষটি, খাবারের ট্রে থেকে খাবার নিচ্ছে।”
ঠিক কী কারণ জানা নেই রিটিন ভেবেছিল এরকম গুরুত্বপূর্ণ মানুষটিকে নিশ্চয়ই আলাদাভাবে চোখে পড়বে কিন্তু সে দেখল ক্লিওন মানুষটির চেহারা খুবই সাধারণ। এলোমেলো চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে একটা রং জ্বলে যাওয়া শার্ট এবং একটা বর্ণহীন ট্রাউজার।
মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, “কখনো ডাইনিং রুমে খেতে আসে না, আজকে কেন এসেছে কে জানে!”
রিটিন খেতে খেতে চোখের কোনা দিয়ে ক্লিওনকে লক্ষ করার চেষ্টা করল। দেখল ক্লিওন তার ট্রেতে খাবার তুলে ডাইনিং হলের মানুষগুলোকে দেখার চেষ্টা করছে। মনে হলো সে কাউকে খুঁজছে।
ক্লিওন রিটিনদের টেবিলের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে তাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কাছাকাছি এসে থেমে গিয়ে রিটিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি নিশ্চয়ই রিটিন?”
টেবিলের সবাই তখন খাওয়া বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেছে, রিটিনও দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, “জি। আমি রিটিন।”
ক্লিওন বলল, “আমি কি তোমাদের টেবিলে বসতে পারি?”
টেবিলের সবাই একসাথে বলল, “অবশ্যই অবশ্যই।”
একজন উঠে প্রায় দৌড়ে গিয়ে ক্লিওনের জন্যে একটা চেয়ার নিয়ে এল। ক্লিওন ঠিক রিটিনের সামনের চেয়ারটিতে বসে খাবারের ট্রেটা টেবিলের উপর রাখে। তারপর প্লেটের খাবার এবং বাটির স্যুপের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “স্যুপের চেহারা দেখেছ? মনে হচ্ছে হাতধোয়া পানি!”
রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি বলল, “কিন্তু এটি খুব পুষ্টিকর। এর মাঝে কিশিনি ফর্টি টু আছে।”
ক্লিওন হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “সেটাই হচ্ছে সমস্যা। জৈব খাবার উঠে সব কৃত্রিম খাবার। আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে জন্ম নেয়া উচিত ছিল–তাহলে সত্যিকারের জৈব খাবার খেতে পারতাম। না জানি সেগুলো খেতে কেমন ছিল!”
রিটিন সাহস করে আলোচনায় যোগ দিল, বলল, “আমি প্রাচীন সাহিত্যে দেখেছি সেখানে সবসময় খাবারের বর্ণনা থাকে। সেই সময় খাবারে অনেক বৈচিত্র্য ছিল।”
ক্লিওন মাথা নাড়ল বলল, “হ্যাঁ, মানুষ তখন সভ্য ছিল। এখন আমরা অসভ্য। বর্বর।”
ক্লিওনের কথার ভঙ্গি দেখে সবাই হেসে ওঠে। ক্লিওন এক চামচ স্যুপ খেয়ে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আসলে তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি।”
রিটিনের গলায় খাবার আটকে গেল, কোনোমতে সেটা গলা দিয়ে নিচে নামিয়ে অবাক হয়ে বলল, “আমার সাথে?”
“হ্যাঁ। তোমার সাথে।” ক্লিওন আরেক চামচ স্যুপ মুখে দিয়ে বলল, “ট্রাকিওশান সরানোর পর আজকে তুমি প্রথমবার বাইরে গিয়েছিলে?”
রিটিন হঠাৎ একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। ট্র্যাক্রিওশান ছাড়া বের হবার পর তাদের খুব সতর্ক থাকার কথা। সে প্রথম দিকে সতর্ক ছিল কিন্তু ধীরে ধীরে তার ভেতর খানিকটা নির্বোধ আত্মবিশ্বাস চলে এসেছিল, শহরের কেন্দ্রে সে একটা নিচু শ্রেণির সাইবর্গকে মেটাকোড দিয়ে অচল করে দিয়েছিল।
রিটিন যেটা ভয় পাচ্ছিল সেটাই হলো। ক্লিওন জিজ্ঞেস করল, “প্রথম দিন তুমি ঘর থেকে বের হয়ে শহরের কেন্দ্রে গাড়ি বাইভার্বাল ট্রাক লরির মহা জটলা লাগিয়ে চলে এসেছ?”
রিটিন শুকনো মুখে মাথা নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু ক্লিওন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “সেটা ঘটিয়েছ খুব কায়দা করে, একটা পিক্সি সাইবর্গকে মেটাকোড় দিয়ে অচল করে। এমনভাবে অচল করেছ যে রাস্তার ঠিক কেন্দ্রে গিয়ে তার কোঅর্ডিনেশন নষ্ট হয়েছে।”
রিটিন আবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। ক্লিওন হাসি হাসি মুখে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার একটি প্রশ্ন।”
রিটিন শুকনো গলায় বলল, “কী প্রশ্ন?”
“তোমার ভয় করেনি? কাজটি অসম্ভব বিপজ্জনক ছিল। এত অবলীলায় এত বিপজ্জনক কাজ করতে তোমার ভয় করেনি?”
রিটিন বলল “না, ভয় করেনি।”
“কাঁদের ভয় করে না, বলো দেখি।”
“নির্বোধদের। নির্বোধদের ভয় করে না।”
“তুমি কি নির্বোধ?”
রিটিন নিচু গলায় বলল, “আমি নিজেকে নির্বোধ মনে করি না। কিন্তু কী কারণ জানা নেই আমার নিজের উপর খুব বিশ্বাস–মনে
হয় কিছু হবে না।”
ক্লিওন কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “আমি তোমার মতো একজনকে খুঁজছি। যে নির্বোধ না কিন্তু নির্বোধদের মতো যার কোনো কিছু ভয় করে না।”
“কেন?”
“একটা মিশনে পাঠাব। এই মিশনে পাঠানোর জন্যে আমার বিশেষ একজন মানুষ দরকার। তুমি রাজি আছ?”
“আছি। রাজি আছি।” রিটিন উত্তেজিত গলায় বলল, “অবশ্যই রাজি আছি।”
ক্লিওন হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বলল, “মিশনটা সম্পর্কে কিছুই না জেনে তুমি রাজি হয়ে গেলে?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমি কিছু জানতে চাই না। জানলে যদি ভয় পেয়ে যাই সে জন্যে আমি কিছু জানতে চাই না।”
ক্লিওন কিছুক্ষণ রিটিনের দিকে তাকিয়ে থেকে তার স্যুপটা আরেক চামচ মুখে দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যুপটাতে একটা ঝাঝালো গন্ধ আছে। এটা কোথা থেকে এসেছে বলে মনে হয়?”
সবাই বুঝল ক্লিওন রিটিনের বিষয়টি নিয়ে আর কারো সাথে কোনো কথা বলবে না। রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি বলল, “এটি সিটিলা নাইন্টি টু। সিটিলা নাইন্টি টু এই ঝাঁঝালো গন্ধটি দেয়।”
সবাই খাবার নিয়ে আলোচনা করে, মনে হতে থাকে কী দিয়ে খাবার তৈরি হয় সেটাই বুঝি আলোচনার জন্যে খুবই বিচিত্র একটা বিষয়।
.
০৬.
গভীর রাতে ছোট একটা বাইভার্বাল রিটিনকে কন্ট্রোল সেন্টারের কাছাকাছি একটা রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে গেল। রিটিন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কন্ট্রোল সেন্টারটির দিকে তাকায়। এর ভেতরে ঢুকে নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের মূল কোয়ার্টজ ওয়েব গাইডগুলোর একটি অংশ তাকে ধ্বংস করতে হবে। তার কাছে কিছু সি নাইন্টি বিস্ফোরক এবং নিজেকে রক্ষা করার জন্যে একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দেয়া হয়েছে। মুখ ছাড়া তার সারা শরীর কালো নিওপলিমার দিয়ে ঢাকা, অপরেশনের আগের মুহূর্তে সে মুখটিকেও ঢেকে নেবে। এই নিওপলিমার পোশাকটি অনেক যত্ন করে তৈরি হয়েছে। এটি যেকোনো বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ একদিকে শোষণ করে নিয়ে অন্যদিক দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। নিরাপত্তার জন্যে যে অবলাল এবং অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করা হয় সেগুলোর কাছে এই পোশাকটি অদৃশ্য। মানুষের চোখে নয়।
মানুষের চোখের সামনে না পড়ে তাকে ভেতরে ঢুকতে হবে, কাজ শেষ করতে হবে এবং বের হতে হবে। এর আগে একাধিকবার চেষ্টা করা হয়েছে, যারা চেষ্টা করছে তারা সবাই মারা গেছে, কেউ কোয়ার্টজ ওয়েব গাইডগুলো ধ্বংস করতে পারেনি। রিটিনও পারবে না–কিন্তু তবু সে চেষ্টা করবে। প্রত্যেকবার আগের বার থেকে একটু বেশি সাফল্য আসে, এভাবে একসময় সফল হবে। অন্যবারের অভিযানের তুলনায় এবারে পার্থক্য একটাই, পুরো ব্যাপারটি নিয়ে রিটিনের ভেতর খানিকটা দুর্ভাবনা আছে কিন্তু কোনো আতঙ্ক নেই।
রিটিন এই কন্ট্রোল সেন্টারের ভেতরে কখনো যায়নি কিন্তু যারা আগে যাওয়ার চেষ্টা করেছে তাদের মস্তিষ্ক থেকে স্মৃতি সংগ্রহ করে তার মস্তিষ্কের ভেতর সেটা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তাই রিটিন এই কন্ট্রোল সেন্টারটি সম্পর্কে এখন খুব ভালো করে জানে। কোথায় কী ধরনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সে সম্পর্কে তার পরিষ্কার একটা ধারণা রয়েছে।
এর আগে যারা ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছে তারা সবাই প্রতিরক্ষা দেয়াল পার হয়ে ঢুকেছে, রিটিন সেদিক দিয়ে ঢুকবে না। সে ঠিক করেছে মূল গেট দিয়ে ঢুকবে। তার শরীরে ট্র্যাকিওশান নেই তাই মূল নিরাপত্তা সিস্টেমে সে নিশ্চয়ই অদৃশ্য।
রিটিন তার মুখটা ঢেকে মূল গেটে এসে দাঁড়াল, এখানে কোনো মানুষ নেই, থাকার প্রয়োজনও নেই। সে গেটের উপরের দিকে তাকাল, হাই ভোল্টেজ তার এবং অদৃশ্য অবলাল রশ্মি থাকার কথা। রিটিন মাথা ঘামাল না, সে তার হুক লাগানো কর্ডটি উপরে ছুঁড়ে দিল সাথে সাথে সে একটা ক্ষীণ অ্যালার্মের শব্দ শুনতে পেল।
রিটিন অপেক্ষা না করে কর্ড ধরে দ্রুত উপরে উঠে যায় এবং একাধিকবার শরীরে তীব্র অবলাল রশ্মির উত্তাপ অনুভব করে। পোশাকটি তাকে রক্ষা করবে–তাই রিটিন সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাল না।
গেটের উপর থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ার সাথে সাথে কয়েকজন গার্ড তার দিকে ছুটে আসে। গার্ডগুলো রোবট হলে দুর্ভাবনার কিছু নেই। তার কাছে যে জ্যামার আছে সেটা মেটাকোড ব্যবহার করে সবগুলোকে অচল করে দেবে। রিটিন কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল এবং সত্যি সত্যি রোবটগুলো অচল হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলতে শুরু করে। একটি রোবট তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে আকাশের দিকে গুলি করতে থাকে এবং সেই শব্দ শুনে আরো অনেকে দৌড়ে আসতে থাকে।
রিটিন অপেক্ষা না করে গেটের পাশে ছোট ঘরটায় ঢুকে পড়ল। বিস্মিত গার্ড তার দিকে তাকিয়ে তার অস্ত্রটি হাতে নেয়ার চেষ্টা করল, রিটিন সেই সুযোগ দিল না। নিজের হাতের অস্ত্রটি তুলে ফিস ফিস করে বলল, “তুমি ক্যাটাগরি এ নাকি সি?”
গার্ডটি কিছু বলল না। রিটিন ফিস ফিস করে বলল, “বলে ফেল। ক্যাটাগরি এ হলে মেরে ফেলতে হবে। সি হলে শুধু অচেতন করে রাখব।”
গার্ডটি শুকনো গলায় বলল, “ক্যাটাগরি সি।” সাথে সাথে রিটিন ট্রিগার টেনে ধরল এবং ধুপ করে একটা শব্দ হলো। গার্ডটি অচেতন অবস্থায় কাত হয়ে পড়ে যায়, চোখ দুটো তখনো খোলা, সেই চোখে বিস্ময়, কিন্তু কিছু দেখছে বলে মনে হলো না।
এখন পর্যন্ত সবকিছু পরিকল্পনামতো হয়েছে, তবে কঠিন কাজটুকু এখনো শুরু হয়নি, এখন শুরু হবে। রিটিন সময় বাঁচানোর জন্যে সি নাইন্টি বিস্ফোরকগুলো বের করে হাতে নিয়ে নেয়। তারপর গার্ড রুম থেকে বের হয়ে কন্ট্রোল সেন্টারের মূল গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করে–রিটিন ইতস্তত গুলির শব্দ শুনতে পায়, সে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। তার শরীরে ট্র্যাকিওশান নেই, কেউ তাকে লক করে গুলি করতে পারবে না। ভাগ্যক্রমে যদি তাকে লাগাতে পারে শুধু তাহলে লাগবে। আজকে এখানে একটা ভাগ্য পরীক্ষা হচ্ছে রিটিনের ভাগ্য বনাম কন্ট্রোল সেন্টারের ভাগ্য।
মূল গেটের কাছে গিয়ে রিটিন মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর হাত বাড়িয়ে সি নাইন্টি বিস্ফোরকটি উপরে ছুঁড়ে দেয়। একটি ধাতব শব্দ করে সেটি মূল গেটের লকিং মডিউলে আটকে গেল। রিটিন তখন গড়িয়ে সরে গিয়ে কানে হাত দিল। এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গোনার আগেই চোখধাঁধানো একটা বিস্ফোরণ হলো, প্রচণ্ড উত্তাপের একটা হলকা রিটিনের উপর দিয়ে ছুটে গেল, সে মানুষের চিৎকার এবং তীক্ষ্ণ অ্যালার্মের শব্দ শুনতে পেল। তীব্র আলোতে চারদিক হঠাৎ করে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়।
রিটিন মাটিতে শুয়ে শুয়ে বড় বড় সার্চলাইটগুলোতে গুলি করে কয়েকটাকে অন্ধকার করে দিল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে সে বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। গেটটিতে ধোয়া এবং আগুন, রিটিন সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাল না। হাতের কব্জিতে লাগানো কন্ট্রোল প্যানেলে সুইচ টিপে দিতেই পায়ের তালুতে একধরনের ঝাঁকুনি অনুভব করে, সেখানে এখন হাই টিসি সুপার কন্ডাক্টরে বিদ্যুৎপ্রবাহ করিয়ে জুতোর তলায় তীব্র ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হওয়ার কথা। রিটিন সেগুলো ব্যবহার করে একটি সরীসৃপের মতো দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে গেল, নিচে মানুষ ছোটাছুটি করছে, চট করে কেউ এখন তাকে খুঁজে পাবে না।
রিটিন বাতাস প্রবাহের বড় ডাক্টটা খুঁজে বের করল, এটার ভেতর দিয়ে সে নিরাপদে নেটওয়ার্ক সেন্টারে চলে যেতে পারবে, রিটিন দেরি না করে ডাক্টের ভেতর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায়। ডাক্টটাকে একটা গোলকধাঁধার মতো মনে হলেও রিটিন সেটাকে হাতের তালুর মতো চিনতে পারে, তার মস্তিষ্কে এটি প্রতিস্থাপন করা আছে।
কিছুক্ষণের ভেতরেই সে আবার গুলির শব্দ শুনতে পেল, তার অবস্থানটি টের পেয়ে গেছে। রিটিন কয়েক মুহূর্ত ঘাপটি মেরে তার দ্বিতীয় পি নাইন্টিটি ব্যবহার করল। আবার একটি চোখধাঁধানো বিস্ফোরণ। ডাক্টটির বড় অংশ এবারে প্রচণ্ড শব্দ করে নিচে আছড়ে পড়ল এবং রিটিন কাত হয়ে থাকা সেই ডাক্ট বেয়ে নিচে এসে পড়ল। শরীরের কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই আঘাত পেয়েছে কিন্তু তার ভেতরে যন্ত্রণার কোনো অনুভূতি নেই। থাকার কথা নয়, আগামী দুই ঘণ্টার জন্যে তার মস্তিষ্কে যন্ত্রণার অনুভূতি অবদমিত করে রাখা আছে।
রিটিন উঠে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে এই মুহূর্তে কোথায় আছে। দেয়ালে বড় বড় করে কিছু একটা লেখা, রিটিন লেখাটা চিনতে পারে। এটি নিরাপত্তার একটি কোড, নেটওয়ার্ক কক্ষের পাশের ঘরে এটি থাকার কথা।
রিটিন নেটওয়ার্ক সেন্টারের দরজাটা খুঁজে বের করল। তারপর ধোয়া এবং ধুলোতে প্রায় অন্ধকার হয়ে থাকা ঘরটির ভেতর দিয়ে নেটওয়ার্ক সেন্টারের দরজার দিকে ছুটে গেল। দরজাটি স্পর্শ করতেই সেটি খুলে গেল। রিটিনেরও সেরকম ধারণা ছিল। নেটওয়ার্ক ঘরটি তুলনামূলকভাবে অক্ষত রয়েছে, রিটিন দ্রুত কোয়ার্টজের ওয়েব গাইডগুলো খুঁজে বের করল। সেন্টারের এক কোনায় কয়েকজন মানুষ হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কী শুরু হয়েছে তারা বুঝতে পারছে না।
রিটিন তার মুখের উপর থেকে নিওপলিমারের টুকরোটুকু সরিয়ে সহজ গলায় বলল, “বন্ধুরা। আমরা কন্ট্রোল সেন্টার দখল করে ফেলেছি। পুরোটা আমাদের দখলে। তোমরা মিছিমিছি কোনো ঝামেলা কোরো না।”
কাঁপা গলায় একজন মেয়ে বলল, “তোমরা কারা?”
“তুমি যদি ক্যাটাগরি সি মানুষ হয়ে থাক তাহলে আমরা আসলে তোমাদের মতো মানুষ! পৃথিবী থেকে মানুষে মানুষে বিভাজনের জন্যে কাজ করছি।”
মেয়েটি বলল, “কিন্তু–”
রিটিন বাধা দিল, বলল, “আমি জানি এই বিষয়টা নিয়ে খুবই চমৎকার একটা বিতর্ক করা যেতে পারে কিন্তু আমার হাতে এখন সেটি শুরু করার সময় নেই। আমাকে এই নেটওয়ার্ক সেন্টারের কিছু অংশ উড়িয়ে দিতে পাঠানো হয়েছে। এখন সেটাই করতে হবে। যে বিস্ফোরণটি হবে তার ঝাঁপটায় তোমাদের রীতিমতো ঝাঁঝরা হয়ে উড়ে যাবার কথা। কাজেই আমার একান্ত অনুরোধ থাকবে তোমরা ঘরটা ছেড়ে বের হয়ে যাও।”
রিটিনের কথায় কাজ হলো, মানুষগুলো রীতিমতো হুটোপুটি করে নেটওয়ার্ক ঘরটি থেকে বের হতে শুরু করে।
রিটিন কোয়ার্টজের ওয়েব গাইডগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। চারটি গাইডের একটিকে অক্ষত রেখে বাকি তিনটিকে ধ্বংস করতে হবে। রিটিন জানে না কেন একটাকে অক্ষত রাখতে হবে। চারটি একই সাথে ধ্বংস করা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ ছিল।
রিটিন নির্দিষ্ট জায়গায় বিস্ফোরক লাগিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল। এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গোনার আগেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে পুরো বিল্ডিং কেঁপে উঠল। কাজটা ঠিকমতো হয়েছে কি না এখন আর দেখার সময় নেই। তার কব্জিতে লাগানো ছোট প্যানেলে অ্যালার্ট সিগন্যাল আসতে শুরু করেছে, তাকে এখন বের হতে হবে। তাকে সরিয়ে নেবার জন্যে একটি ড্রোন কন্ট্রোল সেন্টারের উপরে চলে এসেছে, দেরি করার কোনো সুযোগ নেই।
নেটওয়ার্ক সেন্টারের বড় দরজাটিতে কিছু মানুষ আর রোবট এসে ভিড় করেছে। রোবটগুলো নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই, তার জ্যামার থেকে মেটাকোড সবগুলোকে অচল করে দেবে। মানুষগুলোকে নিয়ে সমস্যা। তাকে লক্ষ করে গুলি করার চেষ্টা করছে। শরীরে ট্র্যাকিওশান নেই বলে লক করে লক্ষ্যভেদ করতে পারছে না। রিটিন পাল্টা গুলি করতে করতে বড় দরজাটি দিয়ে বাইরে বের হয়ে এল। পায়ের চৌম্বকীয় জুতো চালু করে সে আবার সরীসৃপের মতো দেয়াল বেয়ে উঠে যায়, তারপর ছাদ থেকে ঝুলে ঝুলে শ খানেক মিটার ছুটে গিয়ে বড় একটি জানালা দিয়ে বাইরে চলে এল।
মাঝখানে ফাঁকা জায়গা, রিটিন সেখানে দাঁড়াতেই উপর থেকে একটা ড্রোন নিচে নেমে আসে, তারপর চোখের পলকে তাকে জাপটে ধরে সেটি আবার উপরে উঠে যায়। রিটিন ইতস্তত গুলির শব্দ শুনতে পায় কিন্তু সে জানে তাকে সেগুলো আর তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। দুই ঘণ্টা পর রিটিনের সাথে ক্লিওনের দেখা হলো। ক্লিওন একটা টেবিলে পা তুলে চেয়ারে মাথা হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে ছিল, রিটিনকে দেখে সে সোজা হয়ে বসে বলল, “এসো রিটিন।”
রিটিন বলল, “মিশন শেষ হয়েছে।”
ক্লিওন বলল, “আমরা সেই খবর পেয়েছি। আমরা একটা কোয়ার্টজ গাইডের কিছু তথ্য এখন বের করে ফেলতে পারব। তোমাকে বলা হয়েছিল সেটা অক্ষত রেখে অন্যগুলো ধ্বংস করতে।”
“মনে হয় করতে পেরেছি।”
“হ্যাঁ। তুমি করতে পেরেছ। এখন সবগুলো কোয়ার্টজের ওয়েব গাইডের তথ্যগুলো এটা দিয়ে যাবে। আমরা বিশাল একটা তথ্যভান্ডার পেয়ে যাব। তোমাকে ধন্যবাদ রিটিন।”
রিটিন হাসল, বলল, “আমাকে ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই ক্লিওন। তুমি জানো আমাকে প্রায় প্রোগ্রাম করে পাঠানো হয়েছিল। আমি নিজে কিছু করিনি, যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছিল ঠিক সেভাবে যখন যেটা করার কথা সেটা করে গেছি!”
ক্লিওন বলল, “এর আগে আমরা যাদের পাঠিয়েছিলাম তাদেরও আমরা ঠিক তোমার মতো প্রোগ্রাম করে পাঠিয়েছিলাম। তাদের কেউ তোমার মতো বেঁচে ফিরে আসতে পারেনি।”
রিটিন বলল, “আমি নিশ্চয়ই অনেক ভাগ্যবান একজন মানুষ।”
ক্লিওন মাথা নাড়ল, বলল, “না, শুধু ভাগ্য দিয়ে এটা সম্ভব না। অন্য কিছু প্রয়োজন।”
রিটিন একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “অন্য কিছু? অন্য কিছু কী? আজকের আগে আমি জীবনে একটি অস্ত্র কখনো স্পর্শ করিনি–এখানে আমার নিজের বিন্দুমাত্র দক্ষতা ছিল না।”
ক্লিওন বলল, “আমি তোমার দক্ষতার কথা বলছি না।”
“তাহলে কিসের কথা বলছ?”
“আমরা সবাই মিলে একটু আগে তোমার মিশনের খুঁটিনাটি দেখেছি, আমাদের সিস্টেম দিয়ে বিশ্লেষণ করিয়েছি। আমরা যেটা দেখেছি সেটি অবিশ্বাস্য–”
“সেটি কী?”
“এই মিশন থেকে তোমার জীবিত ফিরে আসার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। তোমাকে লক্ষ করে মানুষ রোবট এবং স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষা অস্ত্র অসংখ্যবার গুলি করেছে। মিশন শুরু করার পাঁচ মিনিটের ভেতর তোমার সারা শরীর গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
“কিন্তু একটি গুলিও তেমার শরীরে লাগেনি। মনে হয়েছে” ক্লিওন কথা শেষ না করে থেমে গেল।
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “কী মনে হয়েছে?”
ক্লিওন একটা নিঃশ্বাস নিল, নিজের হাতের দিকে তাকাল তারপর ঘুরে রিটিনের দিকে তাকাল। বলল, “মনে হয়েছে কেউ তোমাকে খুব যত্ন করে রক্ষা করছে।”
“রক্ষা করছে? আমাকে?”
“হ্যাঁ।”
রিটিন প্রায় হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কে রক্ষা করবে?”
“প্রকৃতি।”
“প্রকৃতি?” রিটিন হকচকিত হয়ে ক্লিওনের দিকে তাকাল; জিজ্ঞেস করল, “প্রকৃতি একজন মানুষকে রক্ষা করতে পারে?”
ক্লিওন মাথা নাড়ল, বলল, “নিশ্চয়ই পারে। তা নাহলে তুমি কেমন করে জীবন্ত ফিরে এলে? প্রকৃতির নিশ্চয়ই যেকোনো মূল্যে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তোমার নিশ্চয়ই কোনো একটি কাজ করার কথা যেটি আমরা জানি না। প্রকৃতি জানে, সে জন্যে তোমাকে রক্ষা করেছে।”
রিটিন মাথা নেড়ে বলল, “তুমি কী বলছ এসব? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
ক্লিওন হাসার চেষ্টা করল, বলল, “আমি কী বলছি সেটা আসলে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। কিন্তু এছাড়া আমার আর কোনো ব্যাখ্যা নেই। তোমার এখনো কোনো একটা কাজ করা বাকি। গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ।”
রিটিন হকচকিতের মতো ক্লিওনের দিকে তাকিয়ে রইল।
০৭-০৮. প্রথম কয়েকদিন রিটিন
০৭.
প্রথম কয়েকদিন রিটিন ক্লিওনের কথাগুলো নিজের ভেতর নানাভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল। ক্লিওনের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এই পৃথিবীর সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত। কোনো না কোনোভাবে নির্ধারণ করা হয়ে আছে যে রিটিনকে ভবিষ্যতে কোনো একটা বিশেষ কাজ করতে হবে, সেই কাজটি যেন সে করতে পারে সেজন্যে প্রকৃতির তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে! ভাবনাটিই অতি বিচিত্র, প্রকৃতি কেমন করে জানবে যে তাকে ভবিষ্যতে একটা কাজ করতে হবে? ভবিষ্যৎটি এখনো আসেনি কাজেই সেই বিশেষ কাজটি তাকে দিয়েই করাতে হবে সেটি কে বলেছে?
অনেক ভেবে ভেবে সে যখন এই বিচিত্র ধাঁধাটি সমাধান করতে পারল না তখন সে ব্যাপারটি ভুলে যাবার চেষ্টা করল। ধরে নিল কন্ট্রোল সেন্টারের মিশনে তার জীবন্ত ফিরে আসার ব্যাপারটি হচ্ছে একটি কাকতালীয় ঘটনা। এটি ছিল অস্বাভাবিক কম সম্ভাবনার একটি ঘটনা কিন্তু তারপরও সেটি ঘটে গেছে। ব্যাপারটি এভাবে মেনে নেয়ার পর রিটিনের পুরো ঘটনাটি ভুলে যাবার কথা ছিল কিন্তু কোনো একটি বিচিত্র কারণে রিটিন ঘটনাটি ভুলতে পারল না। সেই ভয়ংকর রাতটিতে যেকোনো মুহূর্তে সে গুলি খেয়ে মারা যেতে পারত কিন্তু তার মাথায় একটিবারও মৃত্যুভয় আসেনি। একবারও মনে হয়নি সে গুলি খেয়ে মারা যাবে, এই অতি বিচিত্র আত্মবিশ্বাসটি কেমন করে তার ভেতরে জন্ম নিয়েছিল? সত্যিই কি প্রকৃতির সাথে সাথে সেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ না করা পর্যন্ত তার মৃত্যু নেই? সে এখন মারা যেতে পারে না? কী আশ্চর্য!
কন্ট্রোল সেন্টারে মিশনটি শেষ করার কারণে খুব বড় একটা লাভ হয়েছে বলে মনে হলো। ক্যাটাগরি সি মানুষের দলটি বিশাল একটি তথ্যভান্ডার সংগ্রহ করতে পেরেছে, যেটি অন্য কোনোভাবে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। উপরের দিকের নেতৃস্থানীয় মানুষেরা খুবই উত্তেজিত। ঠিক কী ধরনের তথ্য পেয়েছে সেটি রিটিন কিংবা রিটিনের মতো মানুষেরা কিছুই জানে না। সম্ভবত জানার দরকারও নেই–যদি কখনো জানার দরকার হয় নিশ্চয়ই জানিয়ে দেবে। রিটিন তারপরও একদিন সেটা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করল।
ডাইনিং টেবিলে আরেক দিন ক্লিওন খাবারের ট্রে নিয়ে রিটিনদের টেবিলে এসে বসল। আগেরবারের মতো ক্লিওন এবারেও খাবারের মান নিয়ে নানা ধরনের কথা বলল এবং একসময় তারা কে
কী করছে সেটা জানতে চাইল। রিটিন নিজের কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, “কন্ট্রোল সেন্টারের মিশন শেষ করে আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি। সেগুলো কী ধরনের তথ্য আমাদের বলবে?”
ক্লিওন বলল, “এই তথ্যগুলো আসলে গোপন, তোমাদের জানার কথা নয়। কিন্তু তুমি যেহেতু জিজ্ঞেস করেছ বলি–”
রিটিন প্রস্তুত হয়ে বলল, “না না। গোপন হলে আমাদের বলতে হবে না। আমি বুঝতে পারিনি।”
ক্লিওন শুকনো এক টুকরো রুটি স্যুপে ভিজিয়ে নরম করে চিবুতে চিবুতে বলল, “তোমার কারণে আমরা এই তথ্যগুলো পেয়েছি, তাই তোমার নিশ্চয়ই জানার অধিকার আছে।”
টেবিলে দাঁড়ানো অন্যেরা দ্রতা করে উঠে দাঁড়িয়ে অন্য টেবিলে চলে যেতে চাইল যেন ক্লিওন নিরিবিলি রিটিনের সাথে কথা বলতে পারে, ক্লিওন হাত তুলে তাদের থামাল। বলল, “তোমরাও শুনতে পারবে। কোনো গুরুতর অন্যায় হয়ে যাবে না। তা ছাড়া কেউ যদি বুদ্ধিমান হয় তাহলে নিজেরাই চিন্তা করে এগুলো বের করে ফেলতে পারবে।”
রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি হেসে বলল, “আমাদের মাঝে সেরকম বুদ্ধিমান কেউ আছে বলে মনে হয় না।”
ক্লিওন হাসল, বলল, “আছে, নিশ্চয়ই আছে। যাই হোক কন্ট্রোল সেন্টারের ওয়েভ গাইড দিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে তথ্য আদান প্রদান করে। কাজেই বেশির ভাগ তথ্য নিরাপত্তা নিয়ে। কোথায় কোথায় নিয়ন্ত্রণ ভবন আছে সেগুলো আমরা মোটামুটি জানতাম এখন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি।”
রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “আমরা শুনেছি মূল যে নিয়ন্ত্রণ ভবন সেটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা দিয়েও ধ্বংস করা যায় না? শুধুমাত্র পৃথিবী ধ্বংস হলেই সেটা ধ্বংস হবে?”
ক্লিওন মাথা নাড়ল। বলল, “তোমরা ঠিকই শুনেছ। মূল ভবনটি আসলেই এরকম। মনে হয় পৃথিবীটা ধ্বংস হলেও এই ভবনটি ধ্বংস হবে না।”
রিটিন বলল, “এর ভেতরে যারা থাকে তারা বের হয় কেমন করে?”
ক্লিওন বলল, “বের হয় না। ওটার ভেতরেই তাদের জীবন।”
“তাহলে নিশ্চয়ই রোবট?”
“না। রোবট না। মানুষ। যারা মানুষের মাঝে বিভাজন করেছে তারা নিশ্চয়ই মানুষ।”
আলোচনার এই পর্যায়ে মানুষে মানুষে বিভাজন, পৃথিবীর সমাজব্যবস্থা, পৃথিবীর ইতিহাস এরকম একটা আলোচনা শুরু হয়ে গেল। রিটিন একধরনের বিস্ময় নিয়ে অবিষ্কার করল ক্লিওনের ভেতরে কোনো কিছু নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই। সে সবকিছুকে মেনে নিতে পারে এবং সবকিছু মেনে নিয়েও তার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ করে যেতে পারে। রিটিন অবাক হয়ে ভাবল সে যখন ক্লিওনের বয়সে পৌঁছাবে তখন সেও কি ক্লিওনের মতো বুকের ভেতর থেকে সব ক্ষোভ, সব প্রতিহিংসা দূর করে দিতে পারবে?
খাবার শেষ করে ক্লিওন উঠে যাবার আগে রিটিন জিজ্ঞেস করল, “কন্ট্রোল সেন্টার ধ্বংস হবার পর আমরা কি আর কোনো তথ্য পেয়েছি?”
ক্লিওন মাথা নাড়ল, বলল, “পেয়েছি। আমরা গবেষণার অনেক তথ্য পেয়েছি। কিন্তু সেগুলো বেশির ভাগ আমরা ব্যবহার করতে পারব না।”
“সময় পরিভ্রমণ নিয়ে কোনো তথ্য?”
“হ্যাঁ পেয়েছি। কেন?”
রিটিন একটু লজ্জা পেয়ে গেল, লাজুক মুখে বলল, “সময় পরিভ্রমণ নিয়ে আমার খুব কৌতূহল। আমার এই বিষয় নিয়ে কাজ করার খুব শখ।”
ক্লিওন শব্দ করে হাসল। হেসে বলল, “একজন মানুষের শখ কখনো অপূর্ণ রাখতে হয় না। বিশেষ করে তোমার শখ অবশ্যই আমাদের পূরণ করতে হবে। তুমি হচ্ছ বিশেষ মানুষ, প্রকৃতি তোমাকে নিজের হাতে রক্ষা করে”
হঠাৎ করে ক্লিওন মাথা ঘুরিয়ে রিটিনের দিকে তাকাল। তার চোখে-মুখে হঠাৎ করে এক সাথে বিচিত্র একধরনের উত্তেজনা এবং অবিশ্বাস উঁকি দিয়ে যায়। রিটিন বুঝতে পারল ক্লিওন তার ভেতরকার এই অনুভূতিটি জোর করে চেপে রাখার চেষ্টা করেছে। সে কয়েক সেকেন্ড বিস্ফারিত দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর অনেকটা জোর করে রিটিন থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিল এবং একধরনের হতবিহ্বলভাবে খাবারের খালি ট্রে হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল।
রিটিনের পাশে বসে থাকা মেয়েটি অবাক হয়ে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হলো? হঠাৎ করে ক্লিওন এত বিচলিত হলো কেন?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না।”
.
ক্লিওন হঠাৎ করে কেন এমনভাবে বিচলিত হয়েছিল সেটি অবশ্যি রিটিন সেদিন বিকেলবেলাতেই জানতে পারল। একজন এসে তাকে আবাসস্থালের শেষ মাথায় দুর্ভেদ্য অংশটুকুতে ডেকে নিয়ে গেল। নিরাপত্তার তিনটি স্তর পার হওয়ার পর একটা মাঝারি কনফারেন্স রুমে হাজির হয়ে রিটিন আবিষ্কার করে একটা গোল গ্রানাইটের টেবিলকে ঘিরে বেশ কয়েকজন বসে আছে, একটা চেয়ার আলাদাভাবে তার জন্যে খালি করে রাখা আছে। যারা বসে আছে তাদের মাঝে রিটিন শুধু ক্লিওনকে চিনতে পারল, অন্যেরা সবাই ক্লিওনের বয়েসী কিংবা তার থেকেও বৃদ্ধ কিন্তু তাদের কাউকে সে আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে ক্যাটাগরি সি মানুষদের সংগ্রামে এরা সবাই বড় বড় দায়িত্বে থাকে।
ক্লিওন রিটিনকে বলল, “রিটিন, তুমি বসো। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”
সবাই স্থির দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে আছে, রিটিন একধরনের অস্বস্তি অনুভব করে। সে জোর করে অস্বস্তিটুকু কাটিয়ে তার জন্য আলাদা করে রাখা চেয়ারটাতে বসল।
ক্লিওন তার সামনে রাখা একটা ফ্লাক্স থেকে খানিকটা পানীয় একটা গ্লাসে ঢেলে গ্লাসটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, “নাও খাও। এটা তোমার স্নায়ুকে শীতল করবে। আমরা এখন তোমাকে যেটা বলব সেটা শোনার জন্যে তোমার স্নায়ুকে শীতল রাখতে হবে।”
রিটিন পানীয়ের গ্লাসটি হাতে নিয়ে ইতস্তত করে বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে?”
“বলছি। তার আগে পানীয়টাতে চুমুক দাও। সত্যি সত্যি তোমার স্নায়ু শীতল রাখা দরকার। আমরা সবাই আমাদের পানীয় খাচ্ছি।”
রিটিন তার পানীয়তে চুমুক দিল এবং সত্যি সত্যি তার শরীরে আরামদায়ক এক ধরনের শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। রিটিন দ্বিতীয়বার পানীয়টিতে চুমুক দিয়ে ক্লিওনের দিকে উৎসুক চোখে তাকাল।
ক্লিওন বলল, “আমি তোমাকে এখন একটি ছবি দেখাব। সত্যি ছবি। ছবিটি দেখে তোমার বলতে হবে ছবিটি কার।”
রিটিনের কাছে ক্লিওনের কথাগুলো একধরনের হেঁয়ালির মতো মনে হলেও সে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে। ক্লিওন তার সামনে অদৃশ্য মনিটরটি স্পর্শ করতেই দেয়ালে একটা ছবি ফুটে উঠল, সাদা কালো একটি ছবি। ছবিতে রিটিন হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তার কোলে একটি চার-পাঁচ বছরের শিশু, পাশে একটি হাসিখুশি তরুণী।
ক্লিওন জিজ্ঞেস করল, “চিনতে পারছ?”
রিটিন অনিশ্চিতের মতো বলল, “হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। এটি আমার ছবি। কিন্তু এই ছবিটি আমি কখন তুলেছি মনে করতে পারছি না। এই মেয়েটি কে আমি জানি না–শিশুটি কে সেটাও জানি না।”
ক্লিওন বলল, “তুমি এই মেয়েটিকে চিনবে না, শিশুটিকেও চিনবে না কারণ তোমার সাথে এখনো তাদের দেখা হয়নি। ছবিটি কখন তোলা হয়েছে তুমি সেটিও জানো না কারণ ছবিটিও এখনো তোলা হয়নি। তবে ছবিটি তোলা হবে।”
রিটিন ইতস্তত করে বলল, “ভবিষ্যতে কখনো আমি এই ছবিটি তুলব? তোমরা ভবিষ্যতের একটা ছবি এখন পেয়ে গেছ?”
ক্লিওন মাথা নাড়ল, বলল, “তোমার প্রশ্নের উত্তর একই সাথে হ্যাঁ এবং না। হ্যাঁ–তুমি তোমার জীবনের ভবিষ্যতে এই ছবিটি তুলবে এবং না–ভবিষ্যতে কখনো এই ছবিটি তোলা হবে না। এই ছবিটা তোলার জন্যে তুমি আজ থেকে পাঁচশত বছর অতীতে যাবে। সেভাবে দেখলে বলা যায় ছবিটা তোলা হয়ে গেছে! পাঁচশ বছর আগে এই ছবিটি তোলা হয়ে গেছে! আমরা পুরাতন আর্কাইভে এই ছবিটি পেয়েছি! এই ছবিটি বহুদিন আগে আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। কে পাঠিয়েছে কেন পাঠিয়েছে আমরা জানতাম না। এখন আমরা অনুমান করছি”
রিটিন কাঁপা গলায় বলল, “আমি পাঠিয়েছি তোমাদের কাছে?”
“হ্যাঁ। তুমি পাঠিয়েছ আমাদের কাছে। যেন আমরা এটা পাই এবং বুঝতে পারি সময় পরিভ্রমণের সর্বশেষ যে তাত্ত্বিক গবেষণাটি এসেছে সেটি সত্যি। সেটি ব্যবহার করে সত্যি সত্যি সময় পরিভ্রমণ করে অতীতে যাওয়া সম্ভব।”
রিটিনের মাথাটি হঠাৎ কেমন জানি ঝিমঝিম করতে থাকে। সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারে না। হাতের গ্লাসে যেটুকু পানীয় ছিল সে এক টেকে পুরোটুকু শেষ করে দিয়ে বলল, “তার মানে সময় পরিভ্রমণ করে আমি অতীতে যাব?”
“হ্যাঁ রিটিন, সময় পরিভ্রমণ করে তুমি অতীতে যাবে।”
“কেন যাব সেটা কি আমরা জানি?”
ক্লিওনের পাশে বসে থাকা ধবধবে সাদা চুলের বৃদ্ধমানুষটি এবারে রিটিনের প্রশ্নের উত্তর দিল। বলল, “না, আমরা এখনো পুরোপুরি জানি না। শুধু অনুমান করতে পারি।”
“কী অনুমান করেছ?”
“তুমি যাবে নিয়ন্ত্রণ ভবন ধ্বংস করতে।”
রিটিন চোখ বড় বড় করে তাকাল, বলল, “যে নিয়ন্ত্রণ ভবন থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে ধ্বংস করা যায় না, পৃথিবী ধ্বংস হলেও যেটা ধ্বংস হবে না, আমি সেটা ধ্বংস করব?”
“হ্যাঁ।”
“কীভাবে?”
“কারণ তুমি কিছু বিস্ফোরক নিয়ে এই ভবনটির ভেতর হাজির হবে। বাইরে থেকে ভবনের ভেতর ঢোকা যাবে না–কিন্তু যেখানে ভবনটি তৈরি হবে তুমি সেখানে হাজির থাকবে।”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।” রিটিন অসহায়ের মতো মাথা নাড়ল, বলল, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
রিটিনের কাছাকাছি বসে থাকা মধ্যবয়সী একজন মহিলা কোমল গলায় বলল, “তোমার এখন কিছু বুঝতে হবে না রিটিন। যখন বোঝার সময় হবে তখন বুঝলেই হবে। আমরাও এখনো সবকিছু বুঝে উঠতে পারিনি।”
রিটিন হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, “কিন্তু, কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
“সময়ে যদি সত্যি পরিভ্রমণ করা সম্ভব হয় তাহলে আমি যদি অতীতে গিয়ে আমার বাবাকে কিংবা মাকে খুন করে ফেলি তাহলে আমার জন্ম হবে কেমন করে?”
ক্লিওন বলল, “সময় পরিভ্রমণ নিয়ে শেষ যে তত্ত্বটি আমরা পেয়েছি সেখানে এর ব্যাখ্যা দেয়া আছে। আমরা পুরোটা এখনো বুঝতে পারিনি। জটিল জটিল সমীকরণ দিয়ে যেটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেটা হচ্ছে, সময় পরিভ্রমণ করে তুমি নিকট অতীতে যেতে পারবে না যেখানে তুমি নিজের ভবিষ্যৎকে পরিবর্তন করতে পারো। চেষ্টা করলে ভয়ংকর কিছু ঘটবে। তোমাকে যেতে হবে দূর অতীতে যেন কোনো পরিবর্তন করলেও তার প্রভাব তোমার ভবিষ্যতে চলে আসে। অর্থাৎ তুমি যদি যথেষ্ট অতীতে গিয়ে তোমার কোনো পূর্বপুরুষকে হত্যা করো তারপরও তোমার জন্ম হবে অন্য কোনো পূর্বপুরুষ দিয়ে–”
রিটিন ভয় পাওয়া গলায় বলল, “তাহলে সবকিছু পূর্ব নির্ধারিত?”
রিটিনের বিপরীতে বসে থাকা একজন বৃদ্ধ বলল, “এই প্রশ্নটির কোনো অর্থ নেই। যদি পূর্ব নির্ধারিত হয়েও থাকে আমরা সেটা জানি শুধুমাত্র সেটা ঘটার পর। কাজেই পূর্ব নির্ধারিত হওয়া না হওয়ায় জগৎ সংসারের কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না!”
রিটিন একধরনের শূন্য দৃষ্টিতে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর শুকনো গলায় বলে, “এখন তোমরা কী করবে?”
ক্লিওন বলল, “আমরা তোমাকে অতীতে পাঠাব রিটিন। অতীতে একটি মেয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।”
মধ্যবয়স্ক মহিলাটি নিচু গলায় বলল, “শুধু সে জানে না যে সে তোমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।”
রিটিন দেয়ালে বড় ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসিখুশি একটি মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো ক্ষোভ নেই, অভিযোগ নেই, সেই চোখে শুধু বিস্ময়কর এক সারল্য।
রিটিন হঠাৎ করে এই অপরিচিত মেয়েটির জন্যে তার বুকের ভেতর গভীর এক ধরনের মমতা অনুভব করে।
.
০৮.
প্রফেসর রাইখ চমকে উঠে দেখলেন তার সামনে একটা ছোট বাইভার্বাল থেমেছে। সে স্পেস টাইমের যে সমীকরণটির সমাধান তার মস্তিষ্কের ভেতর প্রায় শেষ করে এনেছিল সেটি এলোমেলো হয়ে গেল। প্রফেসর রাইখ খুব বিরক্ত হয়ে বাইভার্বালটির দিকে তাকাল এবং দেখল তার দরজা খুলে ভেতর থেকে কম বয়সী একজন তরুণ নেমে এসেছে। তরুণটি যে রিটিন, প্রফেসর রাইখের সেটি জানার কোনো উপায় ছিল না।
রিটিন প্রফেসর রাইখের দিকে কয়েক পা এগিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “শুভসন্ধ্যা প্রফেসর রাইখ। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।”
রিটিনের কথা শুনে প্রফেসর রাইখের বিরক্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছাল। সে জ কুঁচকে বলল, “আমি নিজে নিজে আমার বাসায় যেতে পারব। কাউকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে না।”
রিটিন তার মুখের হাসিটি আরেকটু বিস্তৃত করে বলল, “তুমি আমার কথাটি ঠিক বুঝতে পারোনি। আমি তোমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতে এসেছি।”
প্রফেসর রাইখ অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ, সে সাথে সাথে বিপদটুকু আঁচ করতে পারল। মুখে একটা শান্তভাব ফুটিয়ে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই এরকম একটি কাজ করবে না। কেন আমাকে ধরে নিতে এসেছ আমি জানি না, কিন্তু আমি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় আছি–আমাকে ধরে নিয়ে তুমি হজম করতে পারবে না।”
রিটিন বলল, “তোমাকে কে বলেছে আমি তোমাকে হজম করতে চাই। আমি তোমাকে খানিকটা ব্যবহার করতে চাই।”
“জোর করে কাউকে ব্যবহার করা যায় না।”
“কে বলেছে তোমাকে আমি জোর করে ব্যবহার করব? আমাদের কাছে তোমার জন্যে এমন চমকপ্রদ একটি সমস্যা আছে যে, দেখবে সেটা সমাধান করার জন্যে তুমি রীতিমতো পাগল হয়ে যাবে!”
রিটিন এবার দুই পা এগিয়ে গিয়ে খপ করে প্রফেসর রাইখকে ধরে ফেলল, তারপর বলল, “এখানে সময় নষ্ট করা খুব বুদ্ধিহীন মানুষের কাজ হবে। তোমাকে রক্ষা করার জন্যে মনে হয় নিরাপত্তা বাহিনী ড্রোন আর বাইভার্বালের বহর রওনা দিয়ে দিয়েছে।” কথা শেষ করে রিটিন হ্যাঁচকা টান দিয়ে প্রফেসর রাইখকে বাইভার্বালের উপরে তুলে ফেলল। ড্রোনের দরজাটি সাথে সাথে বন্ধ হয়ে উপরে উঠে গেল।
প্রফেসর রাইখ বলল, “তুমি নিতান্তই নির্বোধ। তুমি বুঝতে পারছ না আগামী পনেরো মিনিটের ভেতর তুমি মারা পড়বে।”
রিটিন বাইভার্বালের কন্ট্রোল প্যানেলে হাত রেখে স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করছি না। আমি সম্ভবত যথেষ্ট নির্বোধ। কিন্তু তুমি একটা জায়গায় ভুল করছ। আমি মারা পড়ব না। আমাকে পৃথিবীর কেউ হত্যা করতে পারবে না। সময় পরিভ্রমণ করে আমি আনুমানিক পাঁচশ বৎসর অতীতে যাব, আমি যে গিয়েছিলাম তার প্রমাণ আছে। কেউ আমাকে মেরে ফেললে আমি কেমন করে যাব? তাই এখন কেউ আমাকে মারতে পারবে না। প্রকৃতি আমাকে রক্ষা করছে।”
প্রফেসর রাইখ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল। তাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসার আগে সে স্পেস টাইমের ঠিক এই সমস্যার একটি সমাধান বের করার চেষ্টা করছিল–তবে সেটি জীবন্ত একটি মানুষকে নিয়ে নয়, এক জোড়া ইলেকট্রন পজিট্রন নিয়ে। প্রফেসর রাইখ অবিশ্বাসের গলায় বলল, “কী বলছ তুমি?”
“আমি সত্যি কথা বলছি। তুমি কিছুক্ষণের ভেতর নিজেই দেখতে পাবে।”
“তোমরা কারা?”
“আমরা ক্যাটাগরি সি মানুষ! তুমি যেহেতু বড় প্রফেসর জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করো তাই ধরে নিচ্ছি তুমি ক্যাটাগরি এ মানুষ।”
“অবশ্যই আমি ক্যাটাগরি এ।”
রিটিন হাসল, বলল, “পদার্থবিজ্ঞানে তোমার যথেষ্ট জ্ঞান থাকলেও মানবসমাজ বা পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ে তুমি বিশেষ কিছু জানো না। মানুষের ভেতর এই ক্যাটাগরি এ এবং সি বিভাজনের পুরো ব্যাপারটা আসলে ভুয়া। তোমার আর আমার মাঝে আসলে কোনো পার্থক্য নেই।”
প্রফেসর রাইখ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আছে। আমাদের মস্তিষ্কের গঠন এবং তোমাদের মস্তিষ্কের গঠনে মৌলিক পার্থক্য আছে। নিউরনের সংখ্যায় পার্থক্য আছে। তাদের সিনান্স সংখ্যায় পার্থক্য আছে। কাজেই চিন্তা করার ক্ষমতার পার্থক্য আছে!”
“তোমাদেরকে সেটা বোঝানো হয়েছে। সেটা সত্যি নয়, আমাদের সুযোগ না দেয়ার কারণে আমরা আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়েছি তার বেশি কিছু নয়।”
“ক্যাটাগরি এ মানুষের মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে।”
“আমি তোমার সাথে তর্ক করব না। খুব সহজ একটা প্রশ্ন করি। আমি ক্যাটাগরি সি মানুষ। আমার পক্ষে কি রিকি ভাষা শেখা সম্ভব?”
প্রফেসর রাইখ একটু অবাক হয়ে রিটিনের দিকে তাকাল, “তুমি রিকিভ ভাষা জানো?”
“হ্যাঁ জানি। আমাকে কেউ শেখায়নি–আমি স্কুল কলেজ যেতে পারিনি কিন্তু আমি নিজে নিজে শিখেছি। বিশ্বাস না করলে রিকিভ ভাষার সিংগুলারিটিগুলো জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো-–কমপ্লেক্স তলে সেটি কীভাবে অসিলেট করে জিজ্ঞেস করতে পারো।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি। সিংগুলারিটিগুলো কীভাবে অসিলেট করে বিষয়টা কেউ যদি জানে তাহলে সে আসলেই রিকিভ ভাষা জানে।”
“রিকভ ভাষা জানার কারণে আমি যেকোনো রোবটের মেটাকোড বের করে ফেলতে পারি। আমার সামনে কোনো রোবট নিরাপদ নয়।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি। আমি একজন মাত্র উদাহরণ। খারাপ উদাহরণ। আমার থেকে অনেক ভালো উদাহরণ আছে। আরো কয়েক বছর পরে হলে তোমাকে জোর করে ধরে নিতে হতো না। আমাদের নিজেদেরই একজন ক্যাটাগরি সি প্রফেসর রাইখ পেয়ে যেতাম।”
“আমাকে কী করতে হবে?”
“আমরা একটা সমীকরণ পেয়েছি। কীভাবে পেয়েছি জিজ্ঞেস কোরো না। সমীকরণটির সমাধান করে দেবে।”
“সমীকরণ সমাধান করে দেব?”
“হ্যাঁ। সমাধান করার পর আমি নিজে এসে তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দেব।”
রিটিন কথা শেষ করার আগেই একটি গুলি বাইভার্বাল ভেদ করে চলে গেল। প্রফেসর রাইখ আতঙ্কে চিৎকার করে মাথা নিচু করে বসে গেল, রিটিন শব্দ করে হেসে বলল, “তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার ট্র্যাকিওশান তোমাকে রক্ষা করবে। নিরাপত্তাকর্মীরা কখনোই তোমাকে গুলি করবে না। আমাকে রক্ষা করবে প্রকৃতি।” কথা শেষ করে রিটিন বাইভার্বালটিকে একটি ভয়ংকর ঘূর্ণন দিয়ে নিচে নামাতে থাকে।
প্রফেসর রাইখ চিৎকার করে বলল, “এখন কী হবে?”
”কিছু হবে না। তুমি ভয় পেয়ো না। আমরা জানি এটা ঘটবে। আমাদের মানুষেরা নিরাপত্তাকর্মীদের সরিয়ে নেবে, আমরা আমাদের এলাকায় পৌঁছে যাব।”
“তুমি কেমন করে জানো?”
“এটা সেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে। তোমার ধারণা হতে পারে ক্যাটাগরি সি মানুষ বুদ্ধিহীন নির্বোধ–কিন্তু আসলে আমরা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সত্যি কথা বলতে কি আমাদের বাস্তব বুদ্ধি তোমাদের থেকে অনেক বেশি!”
আরো কয়েক পশলা গুলি বাইভার্বাল ভেদ করে গেল, তারপর হঠাৎ সবকিছু শান্ত হয়ে গেল। রিটিন খুশি খুশি গলায় বলল, “এখন আমরা নিশ্চিন্তে আমাদের আস্তানায় যেতে পরি। তার আগে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।”
“কী করতে হবে?”
“তোমাকে এই ক্যাপসুলের মাঝে ঢুকতে হবে–”
“ক্যাপসুল? কিসের ক্যাপসুল?”
“তোমার শরীরে একটা ট্র্যাকিওশান আছে, সেটা থেকে তোমাকে ট্র্যাক করা সম্ভব।”
প্রফেসর রাইখ অবাক হয়ে বলল, “তোমার শরীরে নেই?”
“না। আমরা প্রথমেই একটা জঞ্জালের মতো এটাকে ফেলে দিই।”
“কী আশ্চর্য!”
“আশ্চর্যের কিছু নয়। প্রফেসর রাইখ, তুমি ক্যাপসুলের মাঝে ঢোকো।”
প্রফেসর রাইখ ক্যাপসুলটি দেখে চিৎকার করে বলল, “না। আমি ঢুকব না। এই ছোট ক্যাপসুলের মাঝে আমি ঢুকব না–”
রিটিন মুখ হাসি হাসি করে বলল, “তুমি না ঢুকলে আমি তোমাকে জোর করে ঢোকাব, তুমি বলো, তুমি কি সেটা চাও।”
প্রফেসর রাইখ চোখ দিয়ে আগুন ছড়িয়ে ক্যাপসুলের ভেতর ঢুকল। ক্যাপসুলটা বন্ধ করতেই প্রফেসর রাইখের দুই চোখ বন্ধ হয়ে গেল।
.
কয়েক ঘণ্টা পর প্রফেসর রাইখকে সময় পরিভ্রমণসংক্রান্ত সমীকরণটি দেয়া হলো। সমীকরণটি দেখে প্রফেসর রাইখ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঞ্চিত করে রাখল, তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে সমীকরণটি ভালো করে দেখল, তারপর হঠাৎ করে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। সে ভিডি টিউবে কিছু সংখ্যা লিখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর মাথার চুলে হাত ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে।
গভীর রাতে রিটিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রফেসর রাইখের ঘরে উঁকি দিল। তার টেবিলের পাশে খাবারের ট্রে, প্রফেসর রাইখ সেগুলো স্পর্শ করেনি। শুধুমাত্র পানীয়ের বোতলটি খালি, সেখান থেকে পানীয়টুকু খেয়েছে। প্রফেসর রাইখ গভীর মনোযোগ দিয়ে ভিডি স্ক্রিনের স্বচ্ছ মনিটরটির দিকে তাকিয়ে আছে, এক হাতে মাথার চুল খামচে ধরেছে। মুখ কঠিন, দেখে মনে হয় সে বুঝি অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটি কাজ করতে যাচ্ছে–এই মানুষটির চিন্তা করার পদ্ধতিটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। রিটিন একবার ভাবল প্রফেসর রাইখকে কিছু একটা খেয়ে নিতে বলবে, শেষ পর্যন্ত কিছু বলল না। এই মানুষটির চিন্তার প্রক্রিয়ায় সে কোনো রকম বিচ্যুতি ঘটাতে চায় না।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে রিটিন আবার প্রফেসর রাইখের ঘরে উঁকি দিল। প্রফেসর রাইখ ঠিক একইভাবে তার মাথার একটা চুলের গোছা খামচি দিয়ে ধরে ঠিক আগের মতো নিঃশব্দে বসে আছে। সারা রাত মানুষটি তার চোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যেও বন্ধ করেছে বলে মনে হলো না। রিটিনের মনে হলো এখন তার সাথে একটু কথা বলা দরকার, এই খ্যাপা প্রফেসরকে একটু বিশ্রাম নিতে পাঠানো দরকার।
রিটিন ঘরের ভেতর ঢুকে নরম গলায় ডাকল, “প্রফেসর রাইখ।”
প্রফেসর রাইখ পেছনে ফিরে রিটিনের দিকে তাকাল। তার দুই চোখ টকটকে লাল, মাথার চুল এলোমেলো, চোখের নিচে কালি, শুধু চোখ দুটো শ্বাপদের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছে। রিটিন বলল, “প্রফেসর রাইখ। তোমার মনে হয় একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার।”
প্রফেসর রাইখ রিটিনের কথা শুনল বলে মনে হলো না। রিটিনের দিকে অনিশ্চিতের মতো তাকিয়ে রইল। রিটিন আবার বলল, “প্রফেসর রাইখ, তোমার মনে হয় এখন একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার।”
প্রফেসর রাইখ বিড়বিড় করে বলল, “হয়ে গেছে।”
“কী হয়ে গেছে?”
“সমাধান হয়ে গেছে।”
রিটিন হাসিমুখে একটুখানি এগিয়ে গিয়ে বলল, “সমাধান হয়ে গেছে? চমৎকার! তোমাকে অভিনন্দন প্রফেসর রাইখ।”
“তার মানে জানো?”
“কী? তার মানে কী?”
“এই সমাধান থেকে আমি বলতে পারি যে সময় পরিভ্রমণ সম্ভব।”
রিটিন বলল, “আমি তোমাকে আগেই বলেছি সময় পরিভ্রমণ সম্ভব! আমি আমার ছবি দেখেছি–”
প্রফেসর রাইখ মাথা নেড়ে বলল, “আমি তোমার গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করিনি! কিন্তু এখন দেখছি সময় পরিভ্রমণ সম্ভব। একজন মানুষকে অতীতে পাঠানোর জন্যে একটা ক্যাপসুল তৈরি করা সম্ভব। এর জন্যে ওয়ার্ম হোলের প্রয়োজন নেই। স্পেস টাইম ফেব্রিকে খুব সূক্ষ্ম একটা ফুটো করে সেখান দিয়ে একটা ক্যাপসুলকে ঠেলে দেয়া সম্ভব! যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন সেই পরিমাণ শক্তি বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা সম্ভব। নিউক্লিয়ার প্লাজমা-”
রিটিন হাত তুলে প্রফেসর রাইখকে থামাল। বলল, “খুঁটিনাটি নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। আমার মনে হয় তোমার এখন একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার।”
প্রফেসর রাইখ মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমি বিশ্রাম নিতে পারব না। আমার মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে আছে। আমি ঘুমাতে পারব না। খেতে পারব না।”
রিটিন বলল, “ক্লিওন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে তোমাকে দেখাশোনা করার জন্যে। সে যখন দেখবে আমি তোমাকে কোনো কিছু খাওয়াতে পারিনি, বিশ্রাম নেয়াতে পারিনি তখন সে আমার উপর খুব রাগ করবে।”
প্রফেসর রাইখ রিটিনের কথা শুনল বলে মনে হয় না। তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “একটা বিন্দুতে শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে হবে। গামা লেজার দিয়েও করা যায়। ধরা যাক, দুই ডজন। গামা লেজার এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করা হলো, স্পেস টাইম ফেব্রিককে তখন ফুটো করা সম্ভব—”
প্রফেসর রাইখ আপন মনে বিড়বিড় করে কথা বলে যেতে লাগল। রিটিন তখন আবার চেষ্টা করল, বলল, “আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম সমীকরণটি সমাধান করা হলে আমি তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দেব। এখন তোমার সমাধান হয়ে গেছে। আমি ক্লিওনের কাছে অনুমতি নিয়ে তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”
প্রফেসর রাইখ এই প্রথমবার রিটিনের কথা শুনতে পেল। রিটিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “না, না আমি এখন বাসায় যেতে চাই না।”
“বাসায় যেতে চাও না?”
“না। আমি যদি বাসায় না যাই তাহলে আমার স্ত্রী মনে হয় খুশিই হবে।”
“তুমি এখানে থাকতে চাও?”
“হ্যাঁ। টাইম ক্যাপসুল তৈরি করার সময় আমি থাকতে চাই। আমি সমীকরণটির সমাধান করেছি কিন্তু খুঁটিনাটি হিসেব করিনি। তুমি যদি টাইম ক্যাপসুল তৈরি করতে চাও তাহলে শক্তিক্ষয়ের একটা হিসেব করতে হবে। তোমরা সেই হিসেব করতে পারবে না। আমাকে করতে হবে। তা ছাড়া–”
“তা ছাড়া কী?”
প্রফেসর রাইখ একটু বিব্রত হয়ে বলল, “না কিছু না।”
“তুমি বলে ফেল কী বলতে চাইছিলে।”
প্রফেসর রাইখ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “আমার মনে হয় ক্যাটাগরি এ মানুষেরা ক্যাটাগরি সি মানুষদের উপর খুব বড় অবিচার করছে। ক্যাটাগরি এ মানুষ হিসেবে সেজন্যে আমি লজ্জিত। এবং নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি তোমাদের সাথে কাজ করে আমাদের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই!”
রিটিন কী বলবে বুঝতে পারল না, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে প্রফেসর রাইখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “এই গোপন আবাসস্থলটিতে আমি খুব ছোট একজন মানুষ। তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম বলে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তোমাকে দেখে শুনে রাখার জন্যে। খাবার, পানীয়, ঘুমের ব্যবস্থা করার জন্যে! তুমি এখন যে কথাগুলো বলছ সেগুলো আমার মতো ছোট মানুষের কাছে বলার কথা নয়। এগুলো অনেক বড় কথা, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা। এই কথাগুলো তোমার আমাদের সুপ্রিম কাউন্সিলের কাছে বলা দরকার। তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি তাদের ডেকে নিয়ে আসি।”
প্রফেসর রাইখ মাথা নেড়ে বলল, “না, না, না, তুমি সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্যদের ডেকে এনো না! আমার যা বলার তোমাকেই বলব। দরকার হলে তুমি অন্যদের বলো। তোমার সাথে আমার এক ধরনের আত্মিক যোগাযোগ হয়েছে–অন্যদের সাথে হয়নি।”
রিটিন বলল, “তোমার মতো একজন মানুষের সাথে আমার আত্মিক যোগাযোগ হয়েছে, এটি আমার জন্যে অনেক বড় ব্যাপার।”
প্রফেসর রাইখ রিটিনের কথাটি শুনতে পেল বলে মনে হলো না, অন্যমনস্কভাবে বলল, “শক্তির ব্যাপারটা এখনই নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু সময়ের ব্যাপারটা কী হবে বুঝতে পারছি না। একটু উনিশ বিশ হলেই সময়ের বিশাল গোলমাল হয়ে যাবে। হয়তো একেবারে ডাইনোসরের এলাকায় গিয়ে হাজির হবে।”
প্রফেসর রাইখ হাহা করে হেসে উঠল। রিটিন লক্ষ করল মানুষটি যখন হাসে তখন তাকে হঠাত করে খুব সহজ সরল সাধারণ একজন মানুষ বলে মনে হয়!
০৯-১০. সময় পরিভ্রমণের সমীকরণ
০৯.
সময় পরিভ্রমণের সমীকরণটি প্রফেসর রাইখ এক রাতে সমাধান করে ফেলেছিল কিন্তু সময় পরিভ্রমণ করার জন্যে টাইম ক্যাপসুলটি তৈরি করার বিষয়টি মোটেও এক রাতের ব্যাপার নয়। সত্যি কথা বলতে কি সেটি কীভাবে তৈরি হবে সে সম্পর্কে পৃথিবীর কারো কোনো ধারণা নেই। প্রফেসর রাইখ নিজের পরিবারকে ছেড়ে ক্যাটাগরি সি মানুষদের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত না নিলে এটি একটি অসম্ভব প্রোজেক্ট হয়ে দাঁড়াত।
প্রায় প্রতিদিনই প্রফেসর রাইখ এখানকার বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে বসে। প্রফেসর রাইখ ক্যাটাগরি এ মানুষ, যাদের বিরুদ্ধে এখানে সবাই সংগ্রাম করছে কাজেই প্রথম দিকে তাকে নিয়ে সবার ভেতরেই একধরনের সন্দেহ এবং অবিশ্বাস ছিল। প্রথমবার বসার পরেই সেটি অনেকখানি কেটে গেল। একেবারে প্রথম দিন রিটিন সুপ্রিম কাউন্সিলের সবার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথে ক্লিওন জ কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল, “প্রফেসর রাইখ, তোমাকে একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্যে এখানে আনা হয়েছিল। কাজ শেষ হয়েছে এখন তুমি কেন ফিরে যাচ্ছ না?”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমি বিজ্ঞানের মানুষ। বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ আমার ভালো লাগে–তোমাদের এখানে যে চ্যালেঞ্জ শুরু হয়েছে তার তুলনা নেই।”
“শুধু তাই? তুমি ক্যাটাগরি এ মানুষ আমাদের পুরো প্রোগ্রামটুকু হচ্ছে তোমাদের বিরুদ্ধে। তোমাকে এখানে রাখা আমাদের জন্যে মোটেও নিরাপদ নয়।”
প্রফেসর রাইখ একটু রেগে উঠল, বলল, “তোমরা আমাকে অবিশ্বাস করছ?”
একজন কমবয়সী তরুণ যে এখানে কাজ চালানোর মতো ইঞ্জিনিয়ারিং শিখেছে, মুখ শক্ত করে বলল, “একজন ক্যাটাগরি এ মানুষকে আমরা কখনো বিশ্বাস করি না।”
“আমাকে ক্যাটাগরি এ মানুষ হিসেবে না দেখে একজন মানুষ হিসেবে দেখো।”
“কেন?”
প্রফেসর রাইখ গলা উঁচু করে বলল, “তোমরা বলেছ এবং আমি পরীক্ষা করে দেখেছি যে, মানুষের মাঝে এই বিভাজন কৃত্রিম। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তোমরা এবং আমরা একই মানুষ।”
কমবয়সী তরুণটি আরো বেশি গলা উঁচু করে বলল, “কিন্তু তারপরও তোমরা শত শত বৎসর থেকে আমাদের উপর অবিচার করে যাচ্ছ, অত্যাচার করে যাচ্ছ।”
প্রফেসর রাইখ তখন গলা নরম করে বলল, “আমি সেজন্যে ক্ষমা চাইছি। আমি আমার ব্যক্তিগত অপরাধের গ্লানি কমাতে চাই–তাই আমি আমার পরিবারকে ছেড়ে এখানে থাকতে চাই!”
কমবয়সী তরুণটি আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ক্লিওন হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রফেসর রাইখের দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রফেসর রাইখ, আমরা তোমাকে সাদরে আমাদের ক্যাটাগরি সি পরিবারে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। শুধুমাত্র আমরা আশা করব আমাদের নিরাপত্তার জন্যে তুমি আমাদের নিয়মকানুনগুলো মেনে চলবে।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো।”
“চমৎকার! আমরা তাহলে কাজের কথা শুরু করে দিই।” ক্লিওন সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা সবাই জানো রিটিনকে পাঁচশ বছর অতীতে পাঠানোর জন্যে আমাদের একটা টাইম ক্যাপসুল বানাতে হবে। কীভাবে বানাব আমরা জানি না কিন্তু আমরা যে শেষ পর্যন্ত বানাতে পারব সেটা জানি। কারণ আমরা দেখেছি রিটিন অতীতে পৌঁছেছে।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “আমরা কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকি না কেন? প্রকৃতির দায়িত্ব তাকে অতীতে পৌঁছে দেয়া!”
প্রফেসর রাইখ জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, না, না। সেটা হবে ভয়ংকর বিপজ্জনক একটা কাজ। তোমরা যখন রিটিনকে কন্ট্রোল সেন্টারে পঠিয়েছিল সেটাও ছিল ভয়ংকর বিপজ্জনক একটা কাজ–তার শরীরে যদি একটা গুলি কোনোভাবে লেগে যেত তাহলে পুরো প্রকৃতি ওলটপালট হয়ে যেত–”
“মানে?”
“তোমাদেরকে আমি সবকিছু বোঝাতে পারব কি না জানি না। এটা বোঝার জন্যে আমাকে স্পেস টাইম ফেব্রিক স্ট্রেচিং মাল্টিডাইমেনশনাল সমীকরণ সমাধান করতে হয়েছে। তার সমাধানের একটা অংশ হচ্ছে একটা ঘটনা ঘটার প্রোবাবিলিটি বা সম্ভাবনা। প্রকৃতির নিজস্ব পরিকল্পনার সাথে যতটুকু সম্ভব মিল রেখে একটা পরিবেশ তৈরি করে দিতে হয় যেন প্রকৃতি সেটা করে নিতে পারে। প্রকৃতিকে সাহায্য করতে হয় যেন প্রকৃতি সেটা করতে পারে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেতে হয় না। সেটা হচ্ছে আত্মহত্যা। আমার সমীকরণে জিটা নটের মানটা দেখো, এটা কমপ্লেক্স, যার অর্থ–”
ক্লিওন হাত তুলে প্রফেসর রাইখকে থামাল, বলল, “আমাদের বেশির ভাগ তোমার জিটা নটের মানের মাথামুণ্ডু বুঝব না। সেটা থাকুক। আমরা যেভাবে বুঝি সেভাবে বলো।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “ঠিক আছে। প্রথমে মূল পরিকল্পনায় আসা যাক। তোমাদের মূল উদ্দেশ্যটা তোমরা বলো। কিছু গোপন করবে না।”
ক্লিওন কয়েক মুহূর্ত কিছু একটা চিন্তা করল। তারপর বলল, “আমি নিজেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না একজন ক্যাটাগরি এ মানুষের গুরুত্বপূর্ণ একজন বিজ্ঞানীর সামনে আমি আমাদের সবচাইতে গোপন পরিকল্পনাটা প্রকাশ করে দিচ্ছি।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমি আর ক্যাটাগরি এ মানুষ নই। আমি শুধু মানুষ। তোমরাও আর ক্যাটাগরি সি মানুষ নও। তোমরাও শুধু মানুষ।”
“ঠিক আছে।” ক্লিওন বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “অল্প কিছু ক্যাটাগরি এ মানুষের পক্ষে বিশালসংখ্যক ক্যাটাগরি সি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সেটি করা সম্ভব হয়েছে কারণ তারা আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকটা মানুষকে তার ট্র্যাকিওশান দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই ট্র্যাকিওশান হচ্ছে আসলে এক ধরনের দাসত্ব। এটি দিয়ে তারা আলাদা আলাদাভাবে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
“আমরা ট্র্যাকিওশান ফেলেও দিতে পারি না। কারণ ট্র্যাকিওশান বের করে ফেলে দিলে হঠাৎ করে পুরো নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাই। তখন আমি আর মানুষ থাকি না, অস্তিত্ববিহীন একটি অশরীরী হয়ে যাই। কোথাও যেতে পারি না, কিছু খেতে পারি না, কোনো রকম দুর্ঘটনা হলে চিকিৎসাটাও পাই না। তা ছাড়া ট্র্যাকিওশান সরিয়ে ফেলা ভয়ংকর একটি অপরাধ। ট্রাকিওশান ছাড়া অবস্থায় কাউকে ধরা হলে তার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন না করে সাথে সাথে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মেডিকেল ভল্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমাদের অনেক কর্মী এভাবে ধরা পড়ে জীবন হারিয়েছে।”
“তারপরেও প্রায় নিয়মিতভাবে ক্যাটাগরি সি মানুষ আমাদের দলে যোগ দিচ্ছে এবং তাদের ট্র্যাকিওশান ফেলে দিচ্ছে। আমাদের রিটিন সেরকম একজন মানুষ।”
“যাই হোক, আমরা পৃথিবীর মানুষকে সত্যটুকু জানাতে চাই। ক্যাটাগরি এ এবং ক্যাটাগরি সি বলে যে কিছু নেই সেটি সবার কাছে প্রকাশ করতে চাই। পৃথিবীর সকল ক্যাটাগরি সি মানুষকে মুক্ত করতে চাই। সেটি করা সম্ভব যদি যেখানে পৃথিবীর সকল মানুষের সকল তথ্য রক্ষা করা হয় এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয় সেটি ধ্বংস করতে পারি। সেটি যে ভবনে আছে সেটি কোথায় আমরা জানি। ভবনটি অসম্ভব সুরক্ষিত। বিশ্বাস করা হয় নিউক্লিয়ার কিংবা থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা দিয়েও সেই ভবন ধ্বংস করা সম্ভব নয়। এর কোনো দরজা নেই, এর ভেতরে কিছু মানুষ থাকে তারা কখনো বের হতে পারে না। সেই মানুষগুলোই যন্ত্রগুলো রক্ষা করে পৃথিবীর সকল মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে।”
“আমরা যেহেতু কোনোভাবেই এই ভবনটির ভেতরে ঢুকে ভবনের ভেতরকার তথ্যগুলো ধ্বংস করে মানবসমাজকে উদ্ধার করতে পারব না তাই এখন আমাদের একটিমাত্র পথ খোলা আছে। সেটি হচ্ছে ভবনটি যখন তৈরি হয়নি তখন সেই ভবনটির ভূখণ্ডের নিচে রিটিনকে একটি টাইম ক্যাপসুলে ভরে রেখে আসা। ধরা যাক আজ থেকে পাঁচশত বছর আগে। তারপর কোনো এক সময় সেই ভূখণ্ডের উপরে নিয়ন্ত্রণ ভবন তৈরি হবে-যারা তৈরি করবে তারা জানবে না নিচে একটা টাইম ক্যাপসুলে একজন বসে আছে ভয়ংকর বিস্ফোরক নিয়ে। কোনো একটা নির্ধারিত সময়ে মাটি খুঁড়ে মেঝে ভেদ করে সে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এসে ঢুকবে, নিয়ন্ত্রণ কক্ষের তথ্যভান্ডার ধ্বংস করবে। আমরা মুক্ত হব।”
রিটিন হকচকিতের মতো ক্লিওনের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “তার মানে আমি এই মুহূর্তে একটি টাইম ক্যাপসুলে করে নিয়ন্ত্রণ ভবনের নিচে অপেক্ষা করছি–কিংবা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে উপরে উঠে ভবনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছি।” রিটিন নিজের বুকে থাবা দিয়ে বলল, “তাহলে এই আমিটি কে? কিংবা কোন আমিটি সত্যি?”
ক্লিওন মাথা চুলকাল, বলল, “আমি এটার উত্তর জানি না–”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমি জানি। আমি উত্তর দেবার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, যদি সবকিছু আমাদের পরিকল্পনা মতো অগ্রসর হয় তাহলে এই মুহূর্তে তোমার আরেকটি অবস্থা নিয়ন্ত্রণ ভবনের নিচে অপেক্ষা করছে। মনে রেখো প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখার জন্যে তোমাদের দুটি অবস্থান কোনোভাবেই একত্র হতে পারবে না। তোমাদের দুজনের জগৎ হতে হবে আলাদা। কাজেই আমরা যখন টাইম ক্যাপসুল বলি তখন আমরা কী বোঝাই জানো?”
কয়েকজন জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“আমরা বোঝাই এমন একটি ক্যাপসুল যার ভেতর থেকে একটি অণু কিংবা পরমাণুও বের হতে পারবে না। কোনোভাবে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। একটা পরিপূর্ণ আবদ্ধ জগৎ যার সাথে এই পৃথিবীর কোনো রকম সম্পর্ক থাকবে না। কাজেই রিটিনের একটি অবস্থা যদি আসলেই নিয়ন্ত্রণ ভবনের নিচে অপেক্ষা করছে তার ভেতরে আসলে কী আছে সেটি সম্পর্কে এই জগতের কেউ নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারবে না। অর্থাৎ রিটিন আসলে আছে কি নেই সেটা কেউ জানে না, প্রকৃতি এভাবে তার চরিত্র রক্ষা করে।”
কেউ একজন কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কিন্তু রিটিন উঠে দাঁড়িয়ে অনেকটা আর্তনাদের মতো করে বলল, “প্রফেসর রাইখ, তুমি কী বলতে চাইছ? আরেকটা রিটিনকে পাঁচশ বছরের জন্যে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছে? পাঁচশ বছর? পাঁচশ–”
প্রফেসর রাইখ মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।”
“কেন পাঁচশ বছর পুঁতে রাখতে হবে? সময় পরিভ্রমণ করে পাঁচশ বছর কেন তাড়াতাড়ি অতিক্রম করা যায় না।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “কে বলেছে যায় না। অবশ্যই অতিক্রম করা যায়, সেটা হচ্ছে স্পেস টাইম ফেব্রিক পারফোরেশনের সৌন্দর্য। তোমাকে যখন অতীতে পাঠানো হবে তুমি এভাবে যাবে, অনেকটা চোখের পলকে। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“আমরা তোমাকে সময় পরিভ্রমণে পাঠাতে পারব, কারণ এখানে আমরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটা বিন্দুতে অচিন্তনীয় শক্তি জমা করে স্পেস টাইম ফেব্রিকে ফুটো করে তোমাকে অতীতে পাঠাব। কিন্তু তুমি যখন পাঁচশ বছর অতীতে যাবে তখন সেখানে তোমার কোনো প্রযুক্তি থাকবে না! তোমাকে ভবিষ্যতে পাঠাবে কে?”
“আমার টাইম ক্যাপসুলে সেই প্রযুক্তি দিয়ে দাও।”
প্রফেসর রাইখ এমনভাবে হাসল যেন রিটিন খুব হাস্যকর একটা কথা বলেছে। তার হাসিতে কেউ যোগ দিল না দেখে প্রফেসর রাইখ হাসি থামিয়ে বলল, “সেই প্রযুক্তি ছোট একটা ক্যাপসুলে ঢোকানো সম্ভব না। তার জন্যে বিশাল অতিকায় প্রায় আস্ত শহরের মতো বড় একটা ক্যাপসুল দরকার। তা ছাড়া—”
“তা ছাড়া কী?”
“তুমি যে পাঁচশ বছর টাইম ক্যাপসুলে মাটির নিচে থাকবে তুমি তো আর তখন জেগে থাকতে পারবে না। তোমাকে ঘুমিয়ে পড়তে হবে, তোমার দেহকে পুরোপুরি একটা জড় পদার্থে পরিণত করে ফেলতে হবে। সেটা করার জন্যে তোমার শরীরের তাপমাত্রা চার ডিগ্রি কেলভিনে নামিয়ে আনতে হবে–মানুষের শরীরের মতো বড় একটা কিছুকে চার ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় নামিয়ে সেটাকে পাঁচশ বৎসর রেখে দিতে যে পরিমাণ শক্তির দরকার হবে সেই শক্তিটা তুমি কোথায় পাবে? সেটাও এখান থেকে ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে দিতে হবে। বুঝেছ?”
রিটিন অনিশ্চিতের মতো মাথা নেড়ে বলল, “বুঝেছি। কিন্তু মনে হচ্ছে, না বুঝলেই বুঝি ভালো হতো।”
প্রফেসর রাইখ বলল, “এখনো শেষ হয়নি।”
রিটিন চিন্তিত মুখে বলল, “শেষ হয়নি?”
“না। তোমার পাঁচশত বছর পার হওয়ার পর তোমার জেগে উঠতে হবে। তারপর ক্যাপসুল থেকে বের হওয়ার পর মাটি খুঁড়ে উপরে উঠতে হবে।”
ক্লিওন বলল, “এই অংশটা মনে হয় বেশ সোজা হবে। আমরা রিটিনের হাতে একটা ছোট নিও মিসাইল দিয়ে দেব। সেটা দিয়ে ব্লাস্ট করে পুরো মাটি কংক্রিট নিয়ন্ত্রণ ভবনের বেস ফুটো করে ফেলতে পারবে! তখন সেই ফুটো দিয়ে একটা জেট ব্যবহার করে বের হতে পারবে। একবার বের হতে পারলে বাকি কাজ পানির মতো সোজা। বিস্ফোরকগুলো এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভেতরের সবকিছু তছনছ করে দেওয়া!”
প্রফেসর রাইখ বলল, “আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খুব ছোট একটা ক্যাপসুলের ভেতর এইসব যন্ত্রপাতি অস্ত্র বিস্ফোরক বসানো! এটার নিয়ন্ত্রণটি অত্যন্ত যত্ন করে তৈরি করা।”
ক্লিওন বলল, “অন্যান্য সামাজিক ব্যাপারও আছে, পাঁচশ বছর আগের মানুষের ভাষা, রীতিনীতি শেখা। সেখানে তুমি যখন পৌঁছাবে কিছুতেই কাউকে জানানো যাবে না তুমি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছ। সেই সময়ের মানুষ তোমাকে কীভাবে গ্রহণ করবে আমরা জানি না!”
এখানে একজন বিজ্ঞান শিখছে সেরকম একজন মেয়ে একটুখানি হেসে বলল, “অতীত থেকে আমরা যে ছবিটা পেয়েছি সেখানে অবশ্যি দেখছি রিটিন মায়া মায়া চেহারার একটা মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। যার অর্থ সে নিশ্চয়ই অন্তত পক্ষে একজন মেয়েকে পাবে যে তাকে গ্রহণ করবে।”
রিটিন কিছু বলল না। কেউ জানে না দূর অতীতের একটি মেয়ে, যার সঙ্গে তার কখনো দেখা হয়নি রিটিন তার জন্যে নিজের ভেতর একধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে শুরু করেছে।
রিটিন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ শুনল ক্লিওন বলছে, “আমরা এখন একটুখানি উত্তেজক পানীয় খেয়ে নিই। তারপর টাইম ক্যাপসুলের ডিজাইনের কাজ শুরু করি।”
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “চমৎকার আইডিয়া।”
.
ছয়মাস টানা কাজ করে শেষ পর্যন্ত একটি টাইম ক্যাপসুল তৈরি হলো। ক্যাপসুলটি আসলে তিন মিটার ব্যাসের দুটি টাইটেনিয়াম সিলঝিনিয়ামের সঙ্কর ধাতুর অর্ধগোলক। অর্ধগোলাকের দুটি অংশ জুড়ে দেয়ার পর সেটি আক্ষরিক অর্থে একটি গোলক হয়ে যায়। ভেতরে একটি প্লাটিনামের সিলিন্ডার, যেখানে রিটিন শুয়ে থাকবে। তার শরীরের সাথে মিল রেখে সিলিন্ডারের কনট্র তৈরি করা হয়েছে। শরীরের নিচে একটা ফিউসান জেনারেটর যেটি পাঁচশত বৎসর তার শরীরকে চার ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় নামিয়ে শরীরটাকে জড় পদার্থে পরিণত করে ফেলবে। তার বাম পাশে একটি নিও মিসাইল। অতীত থেকে ফিরে আসার পর সে এটি দিয়ে মাটির নিচ থেকে নিয়ন্ত্রণ ভবনের মেঝে পর্যন্ত ফুটো করে ফেলবে। ডান পাশে থাকবে কিছু বিস্ফোরক এবং প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র। গোলকের ফাঁকা জায়গাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের ফটো ইলেকট্রনিক নিউট্রিনিয়াল সার্কিট। একবার ভেতরে ঢুকে গোলকটি বন্ধ করে দেয়ার পর রিটিন সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে আলাদা হয়ে পড়বে।
এই টাইম ক্যাপসুল নিজে থেকে সময় পরিভ্রমণ করতে পারবে না। এটাকে স্পেস টাইম ফেব্রিকের একটা ছোট ফুটো দিয়ে ঠেলে দিতে হবে। সেই ফুটোটা করার জন্যে অচিন্তনীয় পরিমাণ শক্তি একটা বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শক্তি যখন ক্রিটিক্যাল মানটুকু অতিক্রম করবে তখন টাইম ক্যাপসুলটির উপর থেকে ছেড়ে দেয়া হবে। ক্যাপসুলটি সেই ফুটো দিয়ে সবার চোখ থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। এটি কোথায় গিয়ে বের হবে সেটি নিয়ে প্রফেসর রাইখের একটুখানি দুর্ভাবনা আছে তবে যেহেতু পাঁচশ বছর অতীতের একটা ছবি আছে, প্রফেসর রাইখ অনুমান করছে তবে হিসেব ঠিক আছে এবং রিটিন প্রায় পাঁচশত বৎসর আগেই পৌঁছাবে। সেখানে কোথায় কীভাবে হাজির হবে সেটি এখানে কেউ জানে না। জানার উপায়ও নেই। তবে ক্যাপসুলের ভেতর রিটিনের নিজেকে রক্ষা করার জন্যে যথেষ্ট যন্ত্রপাতি এবং রসদ দেয়া হয়েছে। খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও রিটিন যেন নিজেকে রক্ষা করতে পারে তাকে সেভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত সবকিছু শেষ হলো। সুপার কন্ডাক্টিং ম্যাগনেট দিয়ে পুরো ক্যাপসুলটিকে লেভিটেড করে শূন্যে ঝোলানো হয়েছে। চারদিক থেকে দুশ ছাপ্পান্নটি গামা লেজার এক বিন্দুতে ফোকাস করে আছে। সেখানে ট্রিটিয়ামের একটা ক্ষুদ্র এম্পুল রয়েছে। গামা লেজার যখন এম্পুলটিকে উত্তপ্ত করবে তখন ফিউসান বিক্রিয়ায় যে শক্তি বের হবে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র দিয়ে সেটাকে কেন্দ্রীভূত করে রাখবে। সেই অচিন্তনীয় শক্তি স্পেস টাইমকে ফুটো করে ফেলবে।
সেই ফুটো দিয়ে অণু-পরমাণু ঢুকে যাবার সময় ঘর্ষণে আয়নিত হয়ে এক্সরে স্পেকট্রাম দিতে শুরু করবে। বোঝা যাবে স্পেস টাইমে ফুটো হয়েছে। টাইম ক্যাপসুলটিকে তখন ছেড়ে দেয়া হবে, খুবই সূক্ষ্মভাবে তার গতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে যেন সেটি একটা নির্দিষ্ট তৃরণে ফুটো দিয়ে ঢুকে যায়, কারণ সেটাই নির্ধারণ করবে টাইম ক্যাপসুলটি কতখানি অতীতে যাবে।
সবকিছু প্রস্তুত। এখন শুধু রিটিনের রওনা দেয়ার অপেক্ষা। সময় পরিভ্রমণের দিনক্ষণ ঠিক করে রাখা হয়েছে, শুধু সেটি রিটিনকে জানানো হয়নি। ঠিক রওনা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে তাকে জানানো হবে। রিটিন তাই অপেক্ষা করছে।
.
১০.
রিটিন ঘুম থেকে উঠে দেখল তার ঘরে সাদা পোশাক পরা কয়েকজন টেকনিশিয়ান অপেক্ষা করছে। রিটিন বুঝতে পারল আজকে সেই দিন। তার বুকের ভেতর রক্ত ছলাত করে উঠল। এটুকুই–বাড়তি কোনো উত্তেজনা কিংবা আতঙ্ক কিছুই হলো না। সাদা পোশাক পরা মানুষগুলোর পিছু পিছু সে হেঁটে যেতে থাকে। তারা তাকে সময় পরিভ্রমণের জন্যে প্রস্তুত করিয়ে দেবে।
তাকে কিছু খেতে হলো, শরীরে কিছু ইনজেকশান দেয়া হলো, শরীরের ভেতর কিছু এঙ্গুল ঢোকানো হলো। শরীরের নানা জায়গায় মনিটর লাগানো হলো। বিশেষ একটা পোশাক পরতে হলো, সেই পোশাক পরিয়ে তাকে যখন করিডর ধরে টাইম ক্যাপসুলের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন রিটিন দেখল করিডরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ক্লিওন একটা সুন্দর পোশাক পরে আছে, সুপ্রিম কাউন্সিলের সব সদস্যই তাদের বুকে ব্যাজ লাগিয়ে এসেছে। সবাই রিটিনের সাথে হাত মিলাল, দুই-একটা ভদ্রতার কথা বলল। বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়াররাও সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। রিটিন তাদের সাথেও হাত মিলিয়ে ছোটখাটো ভদ্রতার কথা বলে এগিয়ে যায়। সবার শেষে প্রফেসর রাইখ দাঁড়িয়ে আছে, সে রিটিনের দুই কাঁধ ধরে ছোট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “মনে রেখো, পৌঁছেই তোমার বান্ধবীর সাথে ছবি তুলে আমাদের পাঠাবে!”
রিটিন বলল, “পাঠাব!”
টাইম ক্যাপসুলটি স্ট্যান্ডের উপর বসিয়ে রাখা হয়েছে। রিটিনকে ঢুকিয়ে ঢাকনাটি ফেলে ক্যাপসুলটি বন্ধ করে দেবার পর সেটাকে সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেট দিয়ে লেভিটেড করা হবে, সেটি তখন শূন্যে ঝুলে থাকবে।
সাদা কাপড় পরা টেকনিশিয়ানরা রিটিনকে টাইম ক্যাপসুলের ভেতর ঢুকিয়ে সিলিন্ডারের সাথে স্ট্যাপ দিয়ে আটকে দিতে থাকে। শরীরের মনিটরগুলো পরীক্ষা করে, যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করে।
তখন একজন একটা চেক লিস্ট ধরে রিটিনকে শেষ মুহূর্তের জন্যে সবকিছু বুঝিয়ে দেয়। বিদায় নেবার আগে টেকনিশিয়ানরা নিজেদের উত্তেজনা ঢেকে জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “তোমার সময় পরিভ্রমণ শুভ হোক, রিটিন।”
রিটিনও মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।
“তোমাকে অচেতন করা হবে না, তাই পরিভ্রমণ পুরোটাই তুমি অনুভব করবে। যদি দেখা যায়, তোমার কোনো এক ধরনের শারীরিক কষ্ট হচ্ছে শুধুমাত্র তখন তোমাকে অচেতন করে দেয়া হবে। বুঝেছ?”
“বুঝেছি।”
“তোমার নিরাপত্তার জন্যে একটা অ্যাটমিক ক্লাস্টার দেয়া হয়েছে। যদিও আমরা আশা করছি সেটা তোমাকে কখনো ব্যবহার করতে হবে না।”
“ঠিক আছে।”
“নিও মিসাইল আর বিস্ফোরকগুলো দেখে নিয়ো।”
“দেখে নেব।”
“তোমার দুই আঙুলে দুটো বিস্ফোরক আছে। মনে আছে তো?”
“হ্যাঁ। মনে আছে।”
“ঢাকনাটা ফেলে দেয়ার পর আমাদের সাথে তোমার আর কোনো যোগাযোগ থাকবে না। তোমার অন বোর্ড প্রসেসর তোমার সব দয়িত্ব নেবে।”
“চমৎকার।”
“আমরা তাহলে যাই? কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে।”
“যাও।”
টেকনিশিয়ানরা সামরিক কায়দায় স্যালুট দিয়ে ঢাকনাটা নামিয়ে দিতে থাকে। ধাতব একটা শব্দ করতে করতে ঢাকনাটা নেমে আসে। গোলকটাকে স্পর্শ করার সাথে সাথে ক্লিক করে একটা শব্দ হলো। সাথে সাথে রিটিন পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে আলাদা হয়ে গেল। এখন এই টাইম ক্যাপসুলের ভেতর থেকে একটি অণু বা পরমাণুও বের হতে পারবে না।
রিটিন সিলিন্ডারের ভেতর লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। সে খুব সূক্ষ্ম একটা কম্পন অনুভব করে, বাইরে কী হচ্ছে সে আর কোনো দিন জানতে পারবে না। যেকোনো মুহূর্তে সে সময় পরিভ্রমণের যাত্রা শুরু করবে, রিটিন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে। এর আগে কেউ কখনো স্পেস টাইম ফেব্রিক ভেদ করে যাত্রা করেনি, কেউ জানে না অভিজ্ঞতাটি কী রকম, রিটিন সেই মুহূর্তটির জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। মাথার ভেতর কিছু একটা দপদপ করছে, রিটিন জোর করে তার সমস্ত চিন্তা দূর করে মস্তিষ্কের ভেতরটুকু শূন্য করে ফেলার চেষ্টা করে।
.
বাইরে বড় একটা মনিটরের সামনে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল একটি গোলক শূন্যে ঝুলে আছে, দৃশ্যটি খানিকটা অস্বাভাবিক। সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে আছে কখন একটি বিন্দুতে অচিন্তনীয় শক্তি কেন্দ্রীভূত করে স্পেস টাইমকে ফুটো করে ফেলা হবে।
কোনো একটা স্পিকার থেকে কাউন্ট ডাউনের শব্দ শোনা যেতে থাকে। কাঁপা গলায় কেউ একজন বলছে, “দশ নয় আট সাত ছয় পাঁচ চার তিন দুই এক শূন্য–”
সাথে সাথে দুশ ছাপ্পান্নটি গামা লেজার থেকে অদৃশ্য রশ্মি ট্রিটিয়ামের ছোট এম্পুলটিকে আঘাত করল। ফিউসানের প্রচণ্ড শক্তি ক্ষুদ্র একটা বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়, তার তীব্র আলো ঝলসে উঠে মনিটরটিকে মুহূর্তের জন্যে বর্ণহীন করে দেয়। প্রচণ্ড একটি বিস্ফোরণে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং সবগুলো বিপদসূচক অ্যালার্ম এক সাথে আর্তনাদ করে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত পর মনিটরটি আবার চালু হয়, তীব্র আলোতে চারদিক ধাধিয়ে গেছে, পরিষ্কার করে দেখা যায় না, আবছাভাবে দেখা গেল গোলকটি দুলতে শুরু করেছে। হঠাৎ করে এক্সরে ডিটেক্টরগুলো একসাথে শব্দ করে ওঠে, প্রফেসর রাইখ উত্তেজিত গলায় বলল, “স্পেস টাইম ফেব্রিকে ফুটো হয়েছে! ফুটো হয়েছে!”
সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে, এখন গোলকটি নেমে আসবে তারপর সেই ফুটো দিয়ে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে, টাইম ক্যাপসুলের গোলকটি দুলতে শুরু করেছে, হঠাৎ সেটি মুক্ত হয়ে নিচে নামতে শুরু করে। একটা ফুটো দিয়ে অদৃশ্য হওয়ার বদলে হঠাৎ করে সেটি কোথায় যেন আটকে গেল, দেখে মনে হতে থাকে অদৃশ্য একটা পর্দার মাঝে গোলকটি ঝুলে আছে। এটি নিচে নামতে পারছে না!
প্রফেসর রাইখ মুখ বিকৃত করে নিজের চুল খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, “সর্বনাশ!”
ক্লিওন জানতে চাইল, “কী হয়েছে?”
“দেখছ না, স্পেস টাইম ফেব্রিকের ফুটোটা যথেষ্ট বড় না, এটা ঢুকতে পারছে না!”
“এখন কী হবে?”
কী হবে কেউ জানে না, সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে এবং তখন হঠাৎ মনে হলো নিচের অদৃশ্য পর্দাটা ছিঁড়ে গেল। সবাই সবিস্ময়ে দেখল গোলকটি নিচে নামতে নামতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সাথে সাথে হঠাৎ করে সবকিছু নীরব হয়ে যায়। অ্যালার্মের আর্তনাদ, এক্সরে ডিটেক্টরের শব্দ, যন্ত্রপাতির গুঞ্জন সবকিছু থেমে যায়। এই নীরবতাটুকু কেমন জানি অস্বাভাবিক মনে হতে থাকে। প্রফেসর রাইখ বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি বের করে দিয়ে কাঁপা গলায় বলল, “পৃথিবীর ইতিহাসের জন্যে এটি একটি মাইলফলক! আমরা প্রথমবার একজন অভিযাত্রীকে সময় পরিভ্রমণে পাঠাতে পেরেছি।”
ঘরের সবাই তখন এক সাথে আনন্দোৎসবের মতো করে চিৎকার করে হাততালি দিতে শুরু করে।
ক্লিওন প্রফেসর রাইখের কাঁধে হাত রেখে নিচু গলায় বলল, “আমি দুঃখিত প্রফেসর রাইখ, বিজ্ঞানের এত বড় একটা ঘটনার কথা পৃথিবীর কাউকে আমরা জানাতে পারছি না।”
ক্লিওনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা সিকিউরিটির মানুষটি নিচু গলায় বলল, “আমরা জানাতে না চাইলেও এটা জানাজানি হয়ে গেছে ক্লিওন।”
ক্লিওন চমকে উঠে বলল, “কী বললে?”
“আমার কাছে তথ্য এসেছে আমাদের এই গোপন আবাসস্থলের কথা জানাজানি হয়ে গেছে। একটু আগে এখানে যে অচিন্তনীয় শক্তি কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল সেটা গোপন রাখা সম্ভব নয়।”
ক্লিওন একটা নিঃশ্বাস ফেলল, সারাটি জীবন সে গোপন একটি আস্তানা থেকে আরেকটি আস্তানায় পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে, তার কাছে এটি নতুন নয়। সে ক্লান্ত গলায় বলল, “সবাইকে নিরাপদে সরে যেতে বলো।”
“তুমি?”
“আমি এখানেই থাকব।”
সিকিউরিটি অফিসার ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকাল, বলল, “তুমি শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা দেবে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
ক্লিওন হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমি জানি না কেন। হয়তো প্রফেসর রাইখের কথাই সত্যি। প্রকৃতি যেভাবে চায় তাকে সেভাবে সাহায্য করতে হয়। আমি প্রকৃতিকে সাহায্য করি।”
প্রফেসর রাইখ হাসার ভঙ্গি করে বলল, “আমিও তাহলে প্রকৃতিকে সাহায্য করি। আমিও তোমার সাথে থাকি।”
ক্লিওন বলল, “চমৎকার। চলো তাহলে স্নায়ু শীতল করার চমৎকার এক বোতল পানীয় পাওয়া গেছে। সময় পরিভ্রমণের এই বিশাল সাফল্যটা আমরা সেই পানীয় খেয়ে উদযাপন করি!”
প্রফেসর রাইখ বলল, “চলো।”
দুজন শান্ত ভঙ্গিতে করিডর ধরে হেঁটে যেতে থাকে। দুজনেই ক্লান্ত। খুবই ক্লান্ত।
১১-১২. টাইম ক্যাপসুলের ভেতরে বসে
১১.
টাইম ক্যাপসুলের ভেতরে বসে বাইরে কী ঘটছে সেটা সম্পর্কে রিটিনের বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা ছিল না। সে জানত তাকে স্পেস টাইমের ফেব্রিকের ফুটো দিয়ে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়া হবে, এরপরের অভিজ্ঞতাটা কেমন হবে সেটি পৃথিবীর কেউ জানে না। রিটিন সেটা দেখার জন্যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ রিটিনের মনে হলো সে পড়ে যেতে শুরু করেছে। যেরকম হঠাৎ করে এই অনুভূতিটি শুরু হয়েছে ঠিক সেভাবেই আবার মনে হলো সে কোথাও আটকে গেছে। সে সত্যিই টাইম ক্যাপসুল দিয়ে সময় পরিভ্রমণ করতে শুরু করেছে কি না বুঝতে পারল না। যদি সত্যিই সে পরিভ্রমণ শুরু করে থাকে তাহলে বুঝতে হবে অভিজ্ঞতাটুকু চমকপ্রদ কিছু নয়।
ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ রিটিনের মনে হলো তার সমস্ত শরীর বিস্ময়কর এক শক্তির আকর্ষণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সে সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করল কিন্তু মনে হলো তার শরীরের প্রতিটি অণু পরমাণু বুঝি শরীর থেকে খুলে বের হয়ে যেতে শুরু করেছে। চোখের সামনে লাল একটি পর্দা নেমে আসে, সে কিছু দেখতে পায় না, সে কিছু চিন্তা করতে পারে না, কিছু শুনতে পায় না। রিটিনের সমস্ত অনুভূতি লোপ পেয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য তারপরও রিটিনের নিজের অস্তিত্বের অনুভূতিটি লোপ পেল না। তার ভেতরে কোথা থেকে কে জানি তাকে মনে করিয়ে দিতে থাকে, আমি আছি। আমি আছি। আমি আছি।
ধীরে ধীরে রিটিনের সময়ের অনুভূতি লোপ পেতে থাকে। এই টাইম ক্যাপসুলে সে কী এক মুহূর্তের জন্যে আছে না এক সহস্র বছরের জন্যে আছে সে বুঝতে পারে না। তার মনে হতে থাকে সময় বলে কিছু নেই, কখনো ছিল না, কখনো থাকবে না।
রিটিনের মনে হতে থাকে সবকিছু স্থির হতে শুরু করেছে, তার হৃৎস্পন্দন যেন ধীরে ধীরে থেমে আসতে শুরু করেছে। একটি হৃৎস্পন্দন থেকে অন্য হৃৎস্পন্দনের ভেতর অনন্তকাল সময় পার হয়ে যেতে থাকে কিন্তু তবু তার মনে হতে থাকে সে বেঁচে আছে। তার অস্তিত্ব বেঁচে আছে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথায় আছে সে জানে না কিন্তু সে যে আছে সেটি সে জানে।
এভাবে কতকাল কেটে গেছে রিটিন জানে না। তার মনে হতে থাকে সেটি জানা না জানার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো কিছুতে তার আর কিছু আসে যায় না। তাকে শুধু অনন্তকাল এভাবে বেঁচে থাকতে হবে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে শেষকাল সে এভাবে স্থির সময়ে ভেসে থাকবে। যার কোনো শুরু নেই। যার কোনো শেষ নেই।
.
১২.
রিটিন চোখ খুলে তাকাল। তীব্র আলোতে তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সে আবার তার চোখ বন্ধ করে ফেলে মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। সে কোথায়। খুব ধীরে ধীরে তার মনে পড়তে থাকে সে সময় পরিভ্রমণের জন্যে একটা টাইম ক্যাপসুলে করে রওনা দিয়েছিল। সে কি তাহলে তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে?
রিটিন আবার চোখ খুলে তাকাল, তীব্র আলোতে চোখ অভ্যন্ত হয়ে যাবার পর সে টাইম ক্যাপসুলটি চিনতে পারে। সিলিন্ডারের মতো একটা খুপরির মাঝে সে শুয়ে আছে। শরীরের অনেকগুলো জায়গা স্ট্যাপ দিয়ে বাঁধা। রিটিন তার মাথাটা একটু নাড়ল, মাথার ভেতরে কোথায় জানি দপ দপ করে ওঠে। সে নিজের শরীরটা নাড়ানোর চেষ্টা করে, সাথে সাথে কোথায় জানি তীক্ষ্ণ ব্যথার একটি স্পন্দন অনুভব করে। রিটিন দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথার অনুভূতিটি কমে যাবার জন্যে অপেক্ষা করে তারপর আবার চারদিকে তাকাল।
রিটিন বুঝতে পারল তার টাইম ক্যাপসুলটি কোথাও আঘাত করেছে, সেই আঘাতের কারণে তার নিজের শরীরে এই যন্ত্রণার অনুভূতি। কিন্তু যন্ত্রণার অনুভূতি থাকবে না। তার ডান হাতের চামড়ার নিচে যে ছোট ডিস্কটি রয়েছে সেটি তার শরীরের সকল যন্ত্রণা কিংবা রোগশোকের চিকিৎসা করবে, তাকে সেটা নিয়ে দুর্ভাবনা করতে হবে না।
রিটিন কিছুক্ষণ নিঃশব্দে শুয়ে রইল। সত্যি সত্যি তার শরীরের ব্যথার অনুভূতি কমতে কমতে একসময় সারা শরীরে আরামের এক ধরনের কোমল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রিটিন তখন তার কুঠুরির ভেতর উঠে বসে হাত-পা এবং শরীরের স্ট্যাপগুলো খুলে নেয়। তারপর সে তার নির্ধারিত কাজগুলো করতে শুরু করে। টাইম ক্যাপসুলের ভেতর থেকে একটি অণু বা পরমাণুও বের হতে পারবে না, ভেতর থেকে বাইরে কিছু দেখারও কোনো উপায় নেই। এখন সে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে, এখন বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। টাইম ক্যাপসুলের দেয়ালে ভেতর থেকে কাঁপন সৃষ্টি করে সেই কম্পনের প্রতিধ্বনি শুনে বাইরে কী আছে সেটা অনুমান করার একটা ছোট যন্ত্র দেয়া হয়েছে, রিটিন এখন সেটা ব্যবহার করতে শুরু করল।
সে দেখতে পেল তার ডানে, বামে, সামনে, পেছনে এবং নিচে বহুদূর পর্যন্ত কোনো এক ধরনের কঠিন পদার্থ, ঘনত্ব দেখে মনে হয় মাটি। উপরেও সেই একই পদার্থ তবে কয়েক মিটারের বেশি নয়। অর্থাৎ সে সম্ভবত, কোনো একটি জায়গায় মাটির নিচে এসে উপস্থিত হয়েছে। এটা নিয়ে অনুমান করার চেষ্টা না করে তার এর ভেতর থেকে বের হওয়া উচিত। সে সাবধানে টাইম ক্যাপসুলের ঢাকনাটি খুলতে শুরু করল।
উপরে অনেকখানি মাটি, টাইম ক্যাপসুলের হাইড্রোলিক সিস্টেম ঠেলে ঢাকনাটা খুলতে থাকে। বাইরে কী আছে সে জানে না, প্রথমেই তার বের হওয়া ঠিক হবে না। রিটিন মাটি ফুটো করে উপরে একটি প্রোব পাঠাল এবং সেটার ভেতর দিয়ে প্রথমবার চারপাশের পৃথিবীটা দেখতে পেল। জায়গাটি নির্জন, আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। ঝোঁপঝাড় আছে এবং কয়েকটা বড় বড় গাছ আছে। রিটিন একটা প্রজাপতিকে উড়ে যেতে দেখলো। বাতাসে গাছের পাতা নড়তে দেখল এবং তার একটি শিরশির শব্দ শুনতে পেল।
জায়গাটি নিরাপদ, রিটিন ইচ্ছে করলে বের হতে পারে। তাকে পাঁচশ বছর আগের মানুষের পোশাক দেয়া হয়েছে, এই সময়ের টাকার নোট, কিছু ছোট খাটো যন্ত্রপাতিও আছে। রিটিন পোশাক পাল্টে একটা ছোট ব্যাগে কিছু দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে, ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বাইরে বের হওয়ার কাজ শুরু করে দিল।
খানিকটা মাটি সরিয়ে একটা গর্তের মতো করা হয়েছে, রিটিন সেই গর্ত দিয়ে বের হয়ে আসে। শরীরে মাটি লেগে গিয়েছিল। সে হাত দিয়ে পরিষ্কার করে গর্তের মাঝে পা ঝুলিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল। একবার সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল, বাতাসে বিচিত্র এক ধরনের সজীবতা, সাথে একধরনের বুনো ফুলের গন্ধ। রিটিন আকাশের দিকে তাকাল, নীল আকাশে সাদা মেঘ, সময়টা মনে হয় শরৎকাল। সূর্য ঢলে পড়েছে মনে হয়, একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসবে।
রিটিন উঠে দাঁড়াল, সে কোথায় আছে জানতে হবে। মানুষের জনবসতি খুঁজে বের করতে হবে। পৃথিবীতে এখন কত সাল সেটি জানতে হবে সবার আগে। তার কাছে এগুলো বের করার যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলোকে এই সময়ের উপযোগী যন্ত্রপাতির মতো একটা রূপও দেয়া হয়েছে, হঠাৎ করে কেউ দেখলে সন্দেহ করবে না। কিন্তু রিটিন এখনই সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হতে চাইছে না–তার কোনো তাড়াহুড়ো নেই, বলা যেতে পারে, তার হাতে অফুরন্ত সময়।
এখানে তার কালো চুলের হাসিখুশি একটা মেয়ের সাথে দেখা হওয়ার কথা। মেয়েটাকে সে কেমন করে খুঁজে বের করবে জানে না। সেটি নিয়ে রিটিন অবশ্যি চিন্তিত নয়, প্রকৃতি নিশ্চয়ই তাদের দুজনের দেখা করিয়ে দেবে।
রিটিন তার ছোট ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকে। জায়গাটা সুন্দর, সবুজ বড় বড় ঘাস, ঝোঁপঝাড় এবং মাঝে মাঝে বড় গাছ। এগুলো কী গাছ কে জানে, তার নিজের পৃথিবীতে যতদিন তার ট্র্যাকিওশান ছিল সেটা ব্যবহার করে মুহূর্তের মাঝে সব তথ্য বের ১০৪
করে ফেলতে পারত। ট্র্যাকিওশান ফেলে দেয়ার পর সে আর কোনো তথ্য যখন খুশি জানতে পারত না। পাঁচশ বছর আগের পৃথিবীটা তার কাছে এখন ট্র্যাকিওশানহীন পৃথিবীর মতো। একটা গাছ দেখলেও সেটি কী গাছ সে নিজে নিজে কখনো জানতে পারবে না।
হাঁটতে হাঁটতে রিটিনের মনে হলো সে একটা জলধারার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। রিটিন কোনো দিন একটা প্রাকৃতিক পরিবেশে কোনো জলধারা বয়ে যেতে দেখেনি। এই পৃথিবীতে হয়তো সে প্রথমবার সেটি দেখতে পাবে। রিটিন জলধারার সেই ক্ষীণ শব্দ অনুসরণ করে হাঁটতে থাকে।
ধীরে ধীরে শব্দটি আরো স্পষ্ট হলো এবং রিটিন আবিষ্কার করল সামনে হঠাৎ করে মাটি নিচে নেমে গিয়েছে। নিচে পাথর এবং সেই পাথরের উপর দিয়ে একটা জলধারা অনেকটা নিজের মনে বয়ে যাচ্ছে। পানির স্রোত বেশ প্রবল এবং পাথরে ধাক্কা খেয়ে পানির একটি বিচিত্র শব্দ এলাকাটিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
পুরো এলাকাটি আশ্চর্য রকম নির্জন, পানির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। রিটিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। পাথরে ভর করে নিচে নেমে পানিটাকে তার হাত দিয়ে স্পর্শ করার প্রবল ইচ্ছা হলো! ঠিক কোন দিক দিয়ে নামা সবচেয়ে সহজ হবে বোঝার জন্যে সে ডানে বামে তাকাল এবং হঠাৎ করে সে চমকে উঠল। নিচে একটা বড় পাথরের পাশে একটি শিশু পড়ে আছে। শিশুটি নড়ছে না, বেঁচে আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
রিটিন তার ব্যাগ থেকে স্পেস ভিউয়ার বের করে চোখে লাগিয়ে শিশুটিকে দেখার চেষ্টা করল। শিশুটি বেঁচে আছে, তবে জ্ঞান নেই। হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক, পাঁজর এবং পায়ের হাড় ভেঙে গেছে, সাথে সাথে মাথায়ও আঘাত পেয়েছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এই মুহূর্তে উদ্ধার করে চিকিৎসা করা দরকার। রিটিনের পৃথিবীতে এই শিশুটিকে বাঁচানো সম্ভব, এই পাঁচশ বছর আগের এই পৃথিবীতে সম্ভব কি না রিটিন সেটি জানে না।
রিটিন সময় নষ্ট না করে পাথরের উপর পা দিয়ে দ্রুত নিচে নামতে থাকে। নিচে নেমে সে ছোট নদীটির পাশে ছোট-বড় পাথরে পা দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে শিশুটির কাছে পৌঁছাল। রিটিন তার জীবনে গুরুতর আহত কোনো মানুষকে কখনো দেখেনি, তাদেরকে কীভাবে দেখতে হয় সে জানে না। শিশুটি উপর থেকে গড়িয়ে নিচে এসে পড়েছে, শরীর ক্ষত-বিক্ষত। শরীরের হাড় ভেঙেছে কিন্তু সবচেয়ে গুরুতর হচ্ছে মাথার আঘাত। করোটির হাড় ভেঙে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রিটিন আবার তার স্পেস ভিউয়ার বের করে সেটার ভেতর দিয়ে শিশুটিকে দেখল, স্পেস ভিউয়ারে সে লালরঙের একটি অ্যালার্ম দেখতে পায়। শিশুটিকে দ্রুত চিকিৎসা দিতে হবে, তা না হলে তাকে বাঁচানো যাবে না। কীভাবে চিকিৎসা করতে হবে, সেটাও রিটিন স্পেস ভিউয়ারে দেখতে পেল। দুই সিসি ট্র্যাকিনল তার শরীরের রক্তে মিশিয়ে দিতে হবে। তার কাছে কিছু ট্র্যাকিনলের এম্পুল আছে, সেগুলো দেয়ার সময় তাকে অনেকবার সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এগুলো কোনোভাবেই অর্ধসহস্র বছর আগের কোনো মানুষকে চিকিৎসা করার জন্যে ব্যবহার করা যাবে না। এগুলো একান্তভাবেই রিটিনের নিজের জন্যে, যদি সে কখনো গুরুতর আহত হয় তখন যেন সে নিজের জন্যে ব্যবহার করে–অন্য কারো জন্যে নয়।
রিটিন আপাতত নিয়ম-কানুনের মাঝে গেল না। ব্যাগ থেকে ট্র্যাকিনলের একটা এম্পুল নিয়ে সেখান থেকে দুই সিসি স্বচ্ছ তরল সিরিঞ্জ দিয়ে বের করে শিশুটির গলার কাছে একটা আর্টারিতে ঢুকিয়ে দিল। তারপর সাবধানে শিশুটিকে পাঁজকোলা করে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। দুই পা অগ্রসর হতেই সে দেখল একটা খেলনা ডাইনোসর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। নিশ্চয়ই এই শিশুটির ডাইনোসর, সম্ভবত উপর থেকে সেটি নিচে পড়ে গেছে। শিশুটি তার প্রিয় খেলনাটিকে উদ্ধার করার জন্যে পাথর বেয়ে নামতে চেষ্টা করেছে–মাঝখানে পা পিছলে নিচে এসে পড়ছে।
রিটিন নিচু হয়ে এক হাতে খেলনাটি তুলে নিল। যে খেলনার জন্যে এত বড় বিপর্যয়, সেটি এভাবে এখানে ফেলে রেখে যাওয়া যাবে না।
শিশুটিকে পাঁজকোলা করে রিটিন সাবধানে উপরে উঠে এল, এখন তার বাবা-মাকে খুঁজে বের করতে হবে। এত ছোট শিশু নিশ্চয়ই একা একা এই নির্জন এলাকায় চলে আসেনি। তার বাবা-মা নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও আছে। স্পেস ভিউয়ারের সেটিং পাল্টে সে ইচ্ছে করলে আশপাশে জনবসতি খুঁজে বের করতে পারে, কিন্তু তাহলে শিশুটিকে প্রথমে নিচে নামিয়ে রাখতে হবে। রিটিন তাকে এখন মাটিতে শোয়াতে চাইল না, শিশুটিকে পাঁজকোলা করে ধরে সামনে এগোতে লাগল।
এমন সময় সে দূর থেকে একটা নারীকণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেল, কণ্ঠস্বরে একধরনের আতঙ্ক, প্রাণপণ চিৎকার করে সে কাউকে ডাকছে। রিটিন বুঝতে পারল নিশ্চয়ই এই শিশুটির মা, তার সন্তানকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
রিটিন গলার স্বর লক্ষ করে ছুটে যেতে থাকে এবং কয়েক মিনিটের মাঝেই সে মেয়েটির দেখা পেল। নীল জিনসের একটা ট্রাউজার আর হাতকাটা গোলাপি একটা গেঞ্জি পরে আছে। মাথায় একটা লালরঙের রুমাল বেঁধে রেখেছে। রিটিনকে পাজকোলা করে শিশুটিকে নিয়ে আসতে দেখে মেয়েটি একটা আর্তচিৎকার করে ছুটে এল। শিশুটিকে খপ করে ধরে চিৎকার করে ডাকল, “নীল! নীল–বাবা আমার।”
রিটিন মেয়েটির কথা বুঝতে পারছে, রওনা দেবার আগে তাকে এই প্রাচীন ভাষাটি শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। রিটিন সাবধানে যতটুকু সম্ভব সঠিক উচ্চারণ করে বলল, “একে হাসপাতালে নিতে হবে। এক্ষুনি।”
“হাসপাতাল?” মেয়েটা একধরনের অসহায় ব্যাকুল দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকাল, মনে হলো সে রিটিনের কথা বুঝতে পারছে না।
“হ্যাঁ। হাসপাতাল। উপর থেকে নিচে পড়ে গিয়ে অনেক ব্যথা পেয়েছে।”
মেয়েটা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল, শিশুটিকে জাপটে ধরে বলতে লাগল, “নীল! আমার নীল। বাবা আমার
রিটিন সাবধানে শিশুটিকে ধরে রেখে শান্ত গলায় বলল, “তুমি এখন একটু শান্ত হও। কীভাবে একে হাসপাতালে নেয়া যায় সেটি বলো। প্লিজ। সময় নেই আমাদের হাতে।”
“মেয়েটি চোখ মুছে ভাঙা গলায় বলল, আমার বাসার সামনে গাড়ি আছে।”
“চলো তাহলে। কোনদিকে যাব?”
মেয়েটা তখন কাঁদতে কাঁদতে ছুটতে থাকে। রিটিন তার পিছু পিছু শিশুটিকে নিয়ে যেতে থাকে। একটু সামনেই হঠাৎ করে একটা কাঠের বাসা দেখা গেল, তার সামনে একটা সাদা রঙের ভ্যান।
মেয়েটা ছুটে গিয়ে ভ্যানের দরজা খুলে রিটিনের দিকে তাকাল। রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি গাড়ি চালাতে পারবে?”
“পারব।”
“চমৎকার। তুমি গাড়ি চালাও। আমি পেছনে তোমার ছেলেকে কোলে নিয়ে বসছি।”
রিটিন শিশুটিকে কোলে নিয়ে গাড়ির পেছনে বসল। শিশুটির মাথা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে রিটিনের ট্রাউজার ভিজে যেতে থাকে।
মেয়েটি গাড়ি স্টার্ট করে প্রায় গুলির মতো সেটাকে ছুটিয়ে নিতে থাকে। স্টিয়ারিং হুইল শক্ত হাতে ধরে ভাঙা গলায় বলতে থাকে, “ছেলেটা এত দুষ্টু, ঘরে থাকতে চায় না, কখন যে বের হয়েছে জানি
–তুমি না থাকলে খুঁজে পেতে কতক্ষণ লাগত কে জানে! তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব–”
রিটিন বলল, “আমাকে তোমার ধন্যবাদ দিতে হবে না।”
মেয়েটি বলল, “কী মনে হয় তোমার? নীল কি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছে? ভালো হয়ে যাবে না? সুস্থ হয়ে যাবে না?”
রিটিন নরম গলায় বলল, “নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে যাবে।”
“হায় ঈশ্বর! বাপ-মরা ছেলেটার কপালে তুমি আর কত কষ্ট দেবে?”
মেয়েটি অনেকটা নিজের সাথে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাতে থাকে। সরু একটা রাস্তা, আঁকাবাঁকা পথ, মাঝেমধ্যে অন্যদিক থেকে কোনো একটা গাড়ি আসছে। একসময় একটা শহরতলির মাঝে গাড়ি ঢুকল। কিছু মানুষজন দেখা গেল। দোকানপাট রেস্টুরেন্ট নাইট ক্লাব পার হয়ে গাড়িটি হাসপাতালের সামনে দাঁড়াল। মেয়েটা গাড়ি থামিয়ে ছুটে এসে রিটিনের জন্যে দরজা খুলে দেয়। রিটিন শিশুটিকে পাঁজাকোলা করে গাড়ি থেকে নামল। হাসপাতালের ভেতর থেকে একজন একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসে, রিটিন সাবধানে শিশুটিকে সেখানে শুইয়ে দিতেই স্ট্রেচার ঠেলে তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। মেয়েটি স্ট্রেচারের সাথে সাথে ভেতরে ঢুকে গেল।
রিটিন এখন কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না। এখানে কোথায় অপেক্ষা করতে হয় সে ঠিক ভালো করে জানে না। পাঁচশ বছর আগের পৃথিবীটা তার পরিচিত পৃথিবী থেকে এত ভিন্ন যে রিটিন কেমন জানি অসহায় অনুভব করে। চারপাশে অনেক মানুষ, রিটিন একধরনের বিস্ময় নিয়ে এই মানুষগুলোকে দেখে। এদের মাঝে সব ধরনের মানুষ আছে। রিটিন অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার পৃথিবী থেকে এই পৃথিবীর মানুষের বৈচিত্র্য অনেক বেশি।
রিটিন ঠিক কী করবে বুঝতে পারছিল না। শিশুটির এমনিতে বেঁচে যাবার কোনো উপায় ছিল না। দুই সিসি ট্র্যাকিনল শিশুটির শরীরে দিয়ে দেয়ার কারণে সম্ভবত বেঁচে যাবে। ট্র্যাকিনল তার শরীরের ক্ষতস্থানগুলোতে নতুন কোষ তৈরি করা শুরু করবে। এই সময়ের ডাক্তাররা যদি ভালো করে পরীক্ষা করে তাহলে কী ঘটছে সেটা দেখে হতবাক হয়ে যাবে। কিন্তু ডাক্তারেরা নিশ্চয়ই পরীক্ষা করবে না, ধরে নেবে আঘাতটা নিশ্চয়ই গুরুতর ছিল না, মনে হয়েছিল গুরুতর।
রিটিন অপেক্ষা করার জায়গাটিতে পায়চারি করতে থাকে। চারপাশের পরিবেশটুকু তার কাছে প্রায় সুররিয়াল মনে হয়। মানুষগুলো বিচিত্র, কথা বলার ভঙ্গি বিস্ময়কর-পাঁচশ বছরে মানুষের কি অবিশ্বাস্য পরিবর্তন হয়েছে। যারা চারপাশে আছে তারা যদি কোনোভাবে বুঝতে পারে সে সুদূর ভবিষ্যৎ থেকে এসেছে তাহলে তাদের ভেতর কী রকম একটা প্রতিক্রিয়া হবে সে কল্পনাও করতে পারে না।
রিটিন কতক্ষণ পায়চারি করেছিল নিজেও বলতে পারবে না, হঠাৎ করে দেখতে পেল একটা দরজা খুলে মেয়েটি বের হয়ে আসছে। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই রিটিন বুঝতে পারল শিশুটির শরীরে ট্র্যাকিনল কাজ করেছে। মেয়েটির মুখে হাসি, পুরো চেহারাটি আনন্দে ঝলমল করছে। প্রায় ছুটে রিটিনের কাছে এসে বলল, “নীল ভালো আছে।”
রিটিন বলল, “বাহ! কী চমৎকার।”
মেয়েটি বলল, “একটু বেশিই ভালো আছে।”
রিটিন বলল, “বেশি ভালো?”
“হ্যাঁ। তুমি যখন তাকে কোলে করে আনছিলে আমার মনে হচ্ছিল মাথায় অনেক ব্যথা হয়েছে, মনে হচ্ছিল করোটি ভেঙে গেছে, আসলে কিছু হয় নি। শুধু চামড়া একটু কেটে গেছে।”
“সত্যি?”
মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। হাত-পা কেটে গিয়েছিল মনে আছে?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ মনে আছে।”
“এখন কোনো কাটা নেই। আশ্চর্য না?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “আশ্চর্য।”
“ডাক্তারেরা দৌড়াদৌড়ি করে অস্ত্রোপচার করার জন্যে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে গেছে, একটু পরে দেখে নীল অপারেশন থিয়েটারে পা তুলে বসে আছে!”
“সত্যি?”
“সত্যি। চারপাশে ডাক্তার নার্স দেখে ভয় পেয়ে কাঁদছিল, তখন আমাকে ডেকে নিয়ে গেছে।”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তারপর?”
“আমাকে দেখে তার ভয় কেটে গেল, তখন ডাক্তার নার্সের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে!”
রিটিন হাসল, বলল, “কী চমৎকার।”
মেয়েটা বলল, “আমি কি ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল নীল বুঝি মরেই যাবে।”
রিটিন কিছু বলল না। মেয়েটির মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়, সে নিচু গলায় বলল, “তুমি একটি জিনিস জানো?”
“কী জিনিস?”
“নীল কিন্তু আসলেই খুব গুরুতর আঘাত পেয়েছিল। আমি জানি। মায়ের মন কখনো মিথ্যা বলে না।”
রিটিন বলল, “কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ–”
“আমি যেটা দেখছি সেটা একটা স্বপ্নের মতো। সেটা হওয়া সম্ভব ছিল না–”
“কিন্তু হয়েছে।”
“হ্যাঁ হয়েছে। সে জন্যে আমি এটাকে প্রশ্ন করব না—কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
মেয়েটা হঠাৎ কথা না বলে রিটিনের মুখের দিকে তাকাল, তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
রিটিন হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমার নাম রিটিন। রিটি রিটিন। তোমার ছেলে নিয়ে আমরা এত ব্যস্ত ছিলাম যে পরিচয় করার কথা মনে পড়েনি।”
মেয়েটি তার হাতটা সামনে বাড়িয়ে বলল, “আমার নাম তানুস্কা।”
রিটিন বলল “তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম তানুস্কা।”
তানুস্কা নামের মেয়েটা বলল, “সত্যি করে বলো দেখি তুমি কে?”
“বলেছি।” রিটিন একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “আমি রিটিন।”
তানুস্কা হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়, তারপর মাথা ঘুরিয়ে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে তুমি বিচিত্র একটা উচ্চারণে কথা বলছ, আমার কেন জানি মনে হয়, এটা আমার খুব পরিচিত। এই যে তুমি বলছ তোমার নাম রিটিন, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই নামটাও আমি জানি। আর–”
“আর কী?”
“কেন জানি মনে হচ্ছে তোমাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার আগে দেখা হয়েছে!”
রিটিনের মনে হলো সে বলে যে, হ্যাঁ, আমার সাথে তোমার দেখা হয়েছে। তোমার সাথে আর নীলের সাথে আমার একটা ছবি আছে। সেই ছবিটাকে সত্যি করার জন্যে আমি পাঁচশ বছর ভবিষ্যৎ থেকে এসেছি। আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে। আমি সে জন্যে এই পৃথিবীতে এসেছি।
রিটিন অবশ্য তার কিছুই বলল না, সে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “মানুষের মস্তিষ্ক খুবই বিচিত্র! এটা কখন কীভাবে কাজ করবে কেউ বলতে পারে না।”
তানুস্কা কোনো কথা না বলে এক দৃষ্টে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল।
১৩-১৪. নীলকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে
১৩.
নীলকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তানুস্কা রান্নাঘরে ফিরে এল। রান্নাঘরের ছোট টেবিলটাতে বসে রিটিন তানুস্কা আর নীলের সাথে রাতের খাবার এইমাত্র শেষ করেছে। খাবার শেষ হবার আগেই নীলের চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের কাজকর্ম শেষ করে ফিরে আসতে আসতে বেশ রাত হয়েছে, নীলকে জাগিয়ে রাখাটাই মোটামুটিভাবে একটা কঠিন ব্যাপার ছিল। সবাই মিলে একসাথে টেবিলে বসে রাতের খাবার খাবে, সেটি আজকে বিকেলেও তানুস্কা কল্পনাও করেনি।
রান্নাঘরে ঢুকে তানুস্কা হাসিমুখে বলল, “আমি তো তোমাকে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি কিন্তু এরকম দায়সারা খাবার খেতে হবে তুমি নিশ্চয়ই কল্পনাও করোনি।”
রিটিনের শরীরে যে ডিস্কটি লাগিয়ে রেখেছে সেটি তার শরীরে পুষ্টির জোগান দিতে পারে, মাঝেমধ্যে এক-দুই গ্লাস পানি খেয়ে সে দুই-এক মাস কাটিয়ে দিতে পারবে, সত্যি কথা বলতে কী, তার কোনো কিছু খাওয়ারও প্রয়োজন নেই। কিন্তু রিটিন সেটা তানুস্কাকে জানাল না। বলল, “আমাকে রাত কাটানোর জন্যে একটা আশ্রয়, খাওয়ার জন্যে একটা রেস্টুরেন্ট খুঁজে নিতে হতো। তুমি আমাকে দুটোই দিয়েছ, কাজেই আমার অভিযোগ করার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া আমার জন্যে এটা মোটেও দায়সারা খাবার ছিল না। আমি বহুঁকাল সত্যিকারের বনমোরগের গোশত খাইনি।”
তানুস্কা বলল, “কাল রাতে আমি তোমাকে ভালো করে খাওয়াব। কথা দিচ্ছি।”
“কথা দিতে হবে না। আমার জন্যে আলাদা করে কোনো খাবারের আয়োজন করতে হবে না! আমি সবকিছু খেতে পারি।”
তানুস্কা বলল, “আমি তোমাকে কী ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না। তুমি না থাকলে কী যে হতো–”
রিটিন বলল, “কী আবার হতো। তুমি নীলকে খুঁজে পেতে, হাসপাতালে নিয়ে যেতে! তুমি তো দেখেছ তার আঘাত মোটেও গুরুতর ছিল না।”
তানুস্কা বলল, “ডাক্তাররা যাই বলুক আমি জানি ভয়ংকর গুরুতর ছিল। কোনো একটা ম্যাজিক হয়েছে। তুমি স্বীকার করছ না কিন্তু আমি জানি তোমার কারণে সেই ম্যাজিকটা হয়েছে।”
রিটিন হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, “ঠিক আছে তুমি যদি এটা ভেবেই শান্তি পেতে চাও আমি বাধা দেব না।”
তানুস্কা টেবিল থেকে খাবার প্লেট চামচ গ্লাস ন্যাপকিন তুলে নিতে নিতে বলল, “একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না।”
“কী জিনিস?”
“তুমি যথেষ্ট সুন্দর ভাষায় কথা বলো কিন্তু তোমার উচ্চারণটা একটু অন্যরকম।”
“কী রকম?”
“মনে হয় তুমি এই ভাষাটা জানো না। এই ভাষাটা শিখছ। মনে মনে অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ করে বলছ!”
রিটিন হাসল, বলল, “তুমি ঠিকই অনুমান করছ। আমি ভাষাটা জানি না, শিখছি। আমি এই এলাকার মানুষ নই, একটা কাজে এই এলাকায় এসেছি।”
তানুস্কা রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল, সে আশা করছিল রিটিন আরো কিছু বলবে। রিটিন অবশ্য আর কিছু বলল না।
তানুস্কা দুই মগ কফি তৈরি করে টেবিলে নিয়ে এসে রাখল। রিটিন কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, “বাহ! কী চমৎকার কফি।”
তানুস্কা বলল, “তুমি আমাকে খুশি করার জন্যে এই কথা বলছ। এটি মোটেও ভালো কফি নয়।”
“আমার জন্যে যথেষ্ট ভালো কফি। আমি যেখান থেকে এসেছি। সেখানে এরকম কফি পাওয়া যায় না।”
তানুস্কা জিজ্ঞেস করল, “সেখানে কী রকম কফি পাওয়া যায়?”
রিটিন বলতে পারল না মানুষ বহুঁকাল আগে জৈবিক কফি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, সব খাবারই এখন সিনথেটিক। সব খাবার কিংবা পানীয় এখন অজৈবিক। রিটিন তানুস্কার দিকে তাকিয়ে বলল, “সেখানকার কফি মুখে দিলে থু থু করে ফেলে দেবে।”
বাইরে তখন হঠাৎ করে কোনো এক ধরনের বুনো পশুর ডাক শোনা গেল। একটা রাতজাগা পাখি বাসার উপর দিয়ে শব্দ করতে করতে উড়ে গেল। রিটিন একধরনের বিস্ময় নিয়ে তানুস্কার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “ওটা কিসের ডাক?”
তানুস্কা খিল খিল করে হেসে উঠে বলল, “ওটা শেয়ালের ডাক। তুমি কখনো শেয়ালের ডাক শুনেননি?”
রিটিন বলল, “না। আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে শেয়াল নেই। শেয়ালের ডাক নেই।”
“আর কী কী নেই?”
“আরো অনেক কিছু নেই। বনজঙ্গল নেই! সব ধরনের মানুষ নেই। বনমোরগ নেই। যবের রুটি নেই।”
তানুস্কা হাসল, বলল, “তোমার এলাকাটা একবার গিয়ে দেখে আসতে হবে।”
রিটিন কোনো কথা বলল না, তার এলাকাটা তানুস্কা কখনো গিয়ে দেখে আসতে পারবে না।
তানুস্কা প্রায় অনুচ্চ স্বরে বলল, “আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ভাবতাম বড় হলে আমি পৃথিবীর সব দেশ ঘুরে বেড়াব। এখন বড় হয়েছি এখন এই বাসা আর বাসার বাইরে যবের ক্ষেত ছাড়া আর কোথাও যেতে পারি না!”
রিটিন কী বলবে বুঝতে না পেরে একটু ইতস্তত করে বলল, “তোমার তো সময় শেষ হয়ে যায়নি। তুমি তো এখনো পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে পারবে।”
তানুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, “সব দোষ জিহানের।”
“জিহান?”
“হ্যাঁ। নীলের বাবা জিহান। সে কেন হঠাৎ করে মারা গেল? কেন হঠাৎ করে সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে দিয়ে তাকে মরে যেতে হলো?”
রিটিন কী বলবে বুঝতে পারল না। তানুস্কার স্বামী জিহান কীভাবে মারা গিয়েছে, সেটাও সে জানে না। জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি না সেটাও সে বুঝতে পারছিল না। অবশ্য জিজ্ঞেস করতে হলো না, তানুস্কা নিজেই বলল, “গ্রীষ্মকালে সে দক্ষিণের বনাঞ্চলে গেল একটা কাজে। সেখান থেকে ফিরে এসে বলল শরীরটা ভালো লাগছে না। দেখতে দেখতে আকাশ-পাতাল জ্বর। হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, পরীক্ষা করে কিছু খুঁজে পেল না। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ভোরবেলা জ্ঞান হয়েছে, আমাকে ডাকল, কাছে গেলাম। হাত ধরে বলল, তানুস্কা তুমি নীলকে দেখে রেখো। আমি গেলাম। তারপর সে চোখ বন্ধ করে চলে গেল। ঠিক এইভাবে।”
রিটিন ভাবল তানুস্কা এখন আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে কিন্তু সে কাঁদল না। মুখটা শক্ত করে বসে রইল, তারপর বলল, “আমি খুব দুঃখিত রিটিন। আমার একেবারেই ব্যক্তিগত কথাগুলো কেন আমি তোমাকে বলেছি আমি জানি না। তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর এখনো চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়নি। আমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
রিটিন বলল, “না তানুস্কা, তোমার মাথা খারাপ হয়নি। মানুষ যখন কষ্টে থাকে তখন সেটা অন্য কাউকে বললে তার কষ্টটা একটু কমে। অনেক সময় পরিচিত কাউকে বলার ইচ্ছে করে না, অপরিচিত কাউকে বলা সহজ।”
তানুস্কা বলল, “আমি জানি না কী কারণ। তুমি বিচিত্র একটা উচ্চারণে কথা বলো, তোমাকে দেখতেও ঠিক আমাদের মানুষ বলে মনে হয় না, তোমার আচার-আচরণও কেমন জানি অন্যরকম, কিন্তু তারপরও কেন জানি মনে হয় তোমাকে আমি বহুদিন থেকে চিনি।”
রিটিন বলল, “শুনে আমি খুশি হলাম যে তুমি আমাকে চেনা মানুষ হিসেবে ভাবছ।”
তানুস্কা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “চেনা মানুষ হিসেবে ভাবলেও মনে হয় একটু যন্ত্রণা দিয়ে ফেলেছি। কাঁদুনি হিসেবে যা যা বলেছি সব ভুলে যাও। মনে করো কিছু বলিনি।”
রিটিন বলল, “তার প্রয়োজন নেই তানুস্কা। সবারই কথা বলার একজন থাকতে হয়, তুমি না হয় আমাকেই বললে, তা ছাড়া–” রিটিন থেমে গেল।
তানুস্কা জিজ্ঞেস করল, “তা ছাড়া কী?”
“তা ছাড়া তুমি এখনই হতাশ হয়ে যাচ্ছ কেন? তুমি নীলকে বড় করার জন্যে কোনো একজনকে তো পেয়েও যেতে পার। হৃদয়বান সুদর্শন একজন মানুষ। যে তোমাকে ভালোবাসবে, মাথায় তুলে রাখবে। নীলও একজন বাবা পাবে।”
তানুস্কা শব্দ করে হাসল, হাসতে হাসতে বলল, “বোঝাই যাচ্ছে তুমি অন্য জগতের মানুষ। যে মেয়ের চার বছরের ছটফটে একটা ছেলে আছে তার ধারে কাছে কোনো মানুষ আসে না! কয়দিন আগে একজন আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিল।
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। প্রস্তাবটি কী ছিল জানো?”
“কী?”
“প্রস্তাবটি ছিল এরকম, আমি যদি নীলকে একটা অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিই তাহলে সে আমাকে বিয়ে করবে।”
“তুমি কী বললে?”
তানুস্কা হিহি করে হেসে বলল, “সেটা আমি তোমাকে বলতে পারব না। আমি তার শরীরের বিশেষ একটা অংশ সার্জারি করে বিশেষ অন্য একটা অংশে সেটাকে ঢুকিয়ে রাখার কথা বলেছিলাম।”
তানুস্কার কথা বলার ভঙ্গি দেখে রিটিনও হাসতে শুরু করল।
গভীর রাতে রিটিন যখন দেখল তানুস্কার ঘরের বাতি নিভে গেছে তখন সে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে সাবধানে ঘর থেকে বের হয়ে এল। বাসার সামনে খোলা জায়গাটাতে বসে সে আকাশের নক্ষত্রের অবস্থানগুলো মাপতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই সে পৃথিবীর ঠিক কোন জায়গাটিতে আছে বের করে ফেলল। তাকে নিরাপত্তা ভবনের যে জায়গাটিতে যেতে হবে সেটি ঘটনাক্রমে খুব বেশি দূরে নয়, মাত্র বারো’শ পঞ্চাশ কিলোমিটার। জায়গাটি এখন একটি নির্জন বনভূমি। তাকে সেই বনভূমিতে গিয়ে মাটির নিচে একটা শীতল ঘরে পাঁচশ বছরের জন্যে ঘুমিয়ে যেতে হবে।
.
ভোরবেলা রিটিনের ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হলো। ঘুম ভাঙার পর সে দেখল তার বিছানার কাছে একটা চেয়ারে নীল গম্ভীর হয়ে বসে আছে। নীলের হাতে গতকাল উদ্ধার করে নিয়ে আসা সেই খেলনা ডাইনোসরটি।
রিটিন শুয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার নীল? তুমি এত সকালে এখানে কী মনে করে?”
নীল বলল, “মা বলেছে তোমাকে ধন্যবাদ দিতে।”
“ধন্যবাদ দিতে? আমাকে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ সে জন্যে।”
“আমি তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছি? কীভাবে?”
“আমি জানি না।”
রিটিন হাসল, বলল, “আমিও জানি না।”
চার বছরের শিশুটিকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, “তাহলে কী আমার প্রাণ বাঁচানো হয়নি? আমার কি প্রাণ নেই?”
রিটিন এবারে বিছানায় উঠে বসে বলল, “আছে আছে। নিশ্চয়ই আছে। তোমার প্রাণটা এতই শক্ত যে সেটা কাউকে বাঁচাতে হয় না। নিজে নিজে বেঁচে থাকে।”
নীল কিছুক্ষণ কথাটা নিয়ে চিন্তা করল, তারপর বলল, “তোমাকে ধন্যবাদ।”
“কেন আমাকে ধন্যবাদ।”
“আমি জানি না। মা বলেছে সবসময় সবাইকে ধন্যবাদ দিতে হয়।”
রিটিন বলল, “তোমার মা ঠিকই বলেছে। সবসময় সবাইকে ধন্যবাদ দেয়াটা খুবই ভালো একটা কাজ।”
নীল কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল। রিটিন বলল, “আমি তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছি কিনা সেটা জানি না। কিন্তু আমি তোমার ডাইনোসরটাকে বাঁচিয়েছি।”
নীল তার খেলনা ডাইনোসরটিকে বুকে চেপে ধরে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার টিটিন রেক্সকে বাঁচানোর জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।”
“এটার নাম টিটিন রেক্স?”
“হ্যাঁ।”
“আমার নাম রিটিন, তোমার ডাইনোসরের নাম টিটিন। আমাদের দুজনের নামের মাঝে মিল আছে।”
নীল ফিক করে হেসে ফেলল।
রিটিন বিছানা থেকে নেমে বলল, “তোমার মা কী করছে?”
“মাঠে ট্রাক্টর চালাচ্ছে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
রিটিন জানালায় দাঁড়িয়ে দেখল দূরে একটা মাঠে তানুস্কা একটা ট্রাক্টরে বসে মাটি চাষ করছে। পেছনে ধুলা উড়ছে। আকাশে সূর্যটা এর মাঝে উত্তপ্ত হয়ে উঠে তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। রিটিন জানালা থেকে চোখ সরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, পৃথিবীর মানুষ এখনো জানে না পাঁচশ বছর পর পৃথিবী থেকে চাষাবাদ উঠে যাবে। যখন যে খাবার দরকার সিনথেটিক উপায়ে সেটা তৈরি করে নেয়া হবে! মানুষকে আর এত কষ্ট করে মাটি চাষ করে ফসল লাগাতে হবে না।
“তুমি কি নাশতা করেছ, নীল?”
“না, আমি নাশতা করিনি। আমার সকালে নাশতা করতে ভালো লাগে না।”
“নাশতা করতে ভালো না লাগলেও এটা করতে হয়। তোমার মা কি নাশতা করে কাজে বের হয়েছে?”
“না। আমার মা বলেছে ট্রাক্টর দিয়ে পুরো মাঠ চষে তারপর বাসায় এসে নাশতা তৈরি করবে।”
“চলো, আমরা তোমার মায়ের জন্যে নাশতা তৈরি করে ফেলি।”
“তুমি নাশতা তৈরি করতে পারো?”
“একশবার। আমি খুব ভালো ডিম পোচ করতে পারি।”
নীল এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিটিনের দিকে তাকাল।
রিটিন রুটি টোস্ট করল। ঝুড়ি থেকে কমলা নিয়ে তার রস বের করল। ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে ডিম পোচ করল। পনির বের করে সেটাকে চিকন করে কাটল। দুধ বের করে গ্লাসে ঢেলে নিল। কফি মেকারে কফি দিয়ে সেটার সুইচ অন করে দিল, কিছুক্ষণেই পুরো রান্নাঘরটা কফির গন্ধে ভরে যায়।
তানুস্কা যখন ধূলি ধূসরিত হয়ে ঘরে ঢুকল, নীল চিৎকার করে বলল, “মা, আমি আর রিটিন মিলে তোমার জন্যে নাশতা তৈরি করেছি।”
তানুস্কা অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ মা।”
তানুস্কা বলল, “কী আশ্চর্য রিটিন! তুমি জানো নীলের বাবা জিশান আমার জন্যে ঠিক এই কাজটা করত?”
নীল বলল, “মা তাহলে রিটিন কি আমার বাবা হতে পারে না?”
তানুস্কার গাল লাল হয়ে উঠল, লজ্জা পেয়ে বলল, “বোকা ছেলে! শুধু নাশতা তৈরি করলেই বাবা হওয়া যায় না।”
রিটিন হঠাৎ করে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। তার মনে হতে থাকে নিয়ন্ত্রণ ভবন ধ্বংস করার জন্যে ভবিষ্যতে ফিরে না গিয়ে সত্যি সত্যি সে এখানে নীলের বাবা হয়ে থেকে যায় না কেন?
নাশতা করে তানুস্কা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি মাঠে যাই। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে আর কয়েকদিনের মাঝে বৃষ্টি নামবে। যদি এর মাঝে জমিটা প্রস্তুত না করি বীজ লাগাতে পারব না।”
রিটিন বলল, “আমি কি তোমার সাথে আসতে পারি?”
নীল বলল, “আমিও কি আসতে পারি?”
তানুস্কা জানতে চাইল, “কেন? এই বাসার দুজন পুরুষ মানুষ মাঠে যেতে চাইছে কেন?”
রিটিন বলল, “তোমাকে একটু সাহায্য করি।”
নীল বলল, “হ্যাঁ, একটু সাহায্য করি।”
রিটিন বলল, “তা ছাড়া আমি আগে কখনো মাঠে কাজ করিনি। তোমার কাছ থেকে একটু শিখে নিই!”
তানুস্কা বলল, “আমি প্রার্থনা করি যেন কোনো দিন তোমার মাঠে কাজ করার জ্ঞানটুকুর প্রয়োজন না হয়।”
রিটিন বলল, “একজন মানুষের জীবনে কখন কোন জ্ঞানের হঠাৎ করে প্রয়োজন হয়ে যাবে কেউ বলতে পারবে না! আমিই কি কখনো জানতাম যে আমার ডিম পোচ করার জ্ঞানটুকু আজকে এভাবে কাজে লেগে যাবে?”
তানুস্কা বলল, “ঠিক আছে তাহলে চলো। ডিম পোচ করার মতো আরেকটা প্রয়োজনীয় জ্ঞান তোমাকে শিখিয়ে দিই।”
নীল বলল, “আমাকেও শেখাবে মা?”
তানুস্কা বলল, “হ্যাঁ তোমাকেও শেখাব। কাজের সময় কীভাবে কাউকে বিরক্ত না করে চুপচাপ বসে থাকতে হয় আজকে আমি তোমাকে সেটা শেখাব।”
.
রিটিন সারাদিন তানুস্কাকে সাহায্য করল, ট্রাক্টর চালিয়ে মাঠ চাষ, সেখান থেকে আগাছা সরিয়ে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সার দিয়ে প্রস্তুত করল। মাঠটিতে মাটি সারি সারি করে বীজ লাগানোর জন্যে প্রস্তুত করল। পানি আনার জন্যে খালটুকু কেটে পরিষ্কার করল। পাহাড়ের উপর আটকে রাখা পানিটুকুর এক পাশের বাঁধ কেটে সেখান থেকে পানিকে মাঠের মাঝে প্রবাহিত হতে দিল। যখন গড়িয়ে গড়িয়ে পানি পুরো মাঠটিকে ভিজিয়ে দিতে শুরু করেছে তখন মাটির ভেতর থেকে এক ধরনের আদিম ঘ্রাণ বের হতে শুরু করে। রিটিন অনেকটা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “কী আশ্চর্য।”
তানুস্কা জানতে চাইল, “কোনটুকু আশ্চর্য?”
রিটিন বলল, “সবকিছু! মাটি থেকে এই যে ঘ্রাণ বের হচ্ছে এটা সবচেয়ে আশ্চর্য!” তারপর তানুস্কার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে এই চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা দেয়ার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, তানুস্কা!”
তানুস্কা খিল খিল করে হেসে বলল, “তুমি যদি এরকম চমৎকার অভিজ্ঞতা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাও তাহলে তোমাকে আমি আরো অনেক অভিজ্ঞতা দিতে পারব।”
।তারপর রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকেও ধন্যবাদ রিটিন, আমার যে কাজ করতে টানা তিনদিন লাগত তোমার জন্যে সেটা একদিনেই শেষ করে ফেলেছি!”
নীল বলল, “শুধু রিটিন নয় মা, আমিও তোমাকে সাহায্য করেছি। আমাকেও ধন্যবাদ দাও।”
তানুস্কা নিচু হয়ে নীলের গালে চুমু খেয়ে বলল, “হ্যাঁ বাবা তুমিও অনেক সাহায্য করেছ। তোমাকেও ধন্যবাদ। এখন চলো বাসায় গিয়ে কনকনে ঠান্ডা পানিতে গোসল করি। তারপর আজ রাতে আমরা একটা হাঁসের রোস্ট খাব। সাথে স্ট্রবেরি কেক।”
ঠিক কী কারণ জানা নেই, রিটিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
.
১৪.
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। এই এক সপ্তাহে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। একদিন তানুস্কা রিটিন আর নীলকে নিয়ে শহরে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গেল। খাওয়ার পর তারা যখন শহরের রাস্তা ধরে ইতস্তত হাঁটছে তখন হঠাৎ তারা একটা ফটো স্টুডিওর সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। তানুস্কা হাসি হাসি মুখে বলল, “চলো আজকের দিনটির স্মৃতি ধরে রাখার জন্যে আমরা একটা ছবি তুলি।”
রিটিন ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল, কারণ এটিই নিশ্চয়ই সেই ছবিটি যেটি দেখে ক্যাটাগরি সি মানুষেরা জানতে পারবে সময় পরিভ্রমণ সম্ভব। বাইরে শান্তভাব ধরে রেখে সে বলল, “চলো। ছবি তুলি।”
স্টুডিওর ভেতরে রিটিন নীলকে কোলে তুলে নেয়, তার পাশে তানুস্কা হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্ল্যাশের সাথে সাথে রিটিন নিজের ভেতরে বিস্ময়কর একধরনের চাপ অনুভব করে। এই ছবিটি তোলা হবে এটুকু পর্যন্ত সে নিশ্চিত ছিল, এরপর কী হবে কেউ জানে না! এই ছবিটি তুলে সে তার পুরো জীবনটি অনিশ্চিত করে তুলেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে শীতল ঘরে ঘুমিয়ে যেতে হবে। সেই ঘুম থেকে তাকে জেগে উঠতে হবে পাঁচশ বছর পর।
স্টুডিও থেকে বের হয়ে তারা একটা আইসক্রিম পার্লারে গিয়ে আইসক্রিম খেলো এবং যখন নীল ক্লান্ত হয়ে বলল তার ঘুম পাচ্ছে। তখন তারা আবার তাদের বাসায় রওনা দিল।
অন্ধকার নির্জন পথে গাড়ি চালিয়ে নিতে নিতে তানুস্কা বলল, “রিটিন, তুমি হঠাৎ করে একটু চুপচাপ হয়ে গেলে।”
রিটিন বলল, “হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ। আমি নিজেকে নিজে ভুলিয়ে রাখছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারছি আর ভুলিয়ে রাখা যাবে না। আমাকে–”
তানুস্কা একধরনের ভয় পাওয়া গলায় বলল, “তোমাকে?”
“আমাকে চলে যেতে হবে তানুস্কা।”
তানুস্কা গাড়ি চালাতে চালাতে একবার মাথা ঘুরিয়ে রিটিনের দিকে তাকাল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে হাসার চেষ্টা করে বলল, “হ্যাঁ রিটিন। আমি অনুমান করছিলাম তুমি নিশ্চয়ই একদিন চলে যাবে। তুমি তো আর একটা শিশুর সাথে খেলার জন্যে কিংবা একটা নিঃসঙ্গ মেয়ের ক্ষেত চষে দেবার জন্যে আসোনি! তোমার নিশ্চয়ই আরো বড় কিছু করার আছে!”
রিটিন একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমার জীবনটা যদি আমি নিজে ডিজাইন করতে পারতাম তাহলে আমি সত্যি সত্যি বাকি জীবনটা তোমার খেত চষে কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু তানুস্কা, তুমি বিশ্বাস করো আমার জীবনটা আমার হাতে নেই! আমাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেটি কী, তুমি আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না।”
তানুস্কা বলল, “জিজ্ঞেস করব না।”
রিটিন বলল, “আমাকে চলে যেতে হবে তানুস্কা।”
তানুস্কা বলল, “আমি বুঝতে পারছি রিটিন।”
রিটিন বলল, “আমার মনে হচ্ছে আমার যদি চলে যেতে না হতো, আমি যদি তোমার সাথে থাকতে পারতাম-”
তানুস্কা বলল, “আমরা এটা নিয়ে কথা না বলি রিটিন। সত্যিটাকে মেনে নিই। তুমি অল্প কয়েকদিনের জন্যে এসেছ। আমরা এই অল্প কয়টা দিন হাসিখুশিতে কাটিয়েছি। এখন তোমার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে, আমি আর নীল তোমাকে হাসি মুখ করে বিদায় দেব রিটিন। তুমি কোথায় যাবে কী করবে আমি জানি না। কিন্তু যেখানেই যাও তুমি যেন ভালো থাকো। আনন্দে থাকো”
কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে তানুস্কার গলা ধরে এল। তানুস্কা তখন চুপ করে যায়, নির্জন পথ ধরে নিঃশব্দে গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকে।
বাসায় পৌঁছানোর পর রিটিন ঘুমন্ত নীলকে কোলে নিয়ে তানুস্কার ঘরে শুইয়ে দিল।
সেদিন সে অনেক রাত পর্যন্ত বাসার বাইরে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল, সপ্তর্ষি মণ্ডলকে ধ্রুবতারাকে ঘিরে একটু একটু করে ঘুরে যেতে দেখল। বাতাসের শব্দ শুনল, গাছের পাতার শিরশির শব্দ শুনল, মাথার উপর দিয়ে একটা রাতজাগা পাখিকে করুণ সুরে ডাকতে ডাকতে উড়ে যেতে শুনল।
.
পরের কয়েকদিন রিটিন আর তানুস্কা দুজনেই ভান করতে লাগল যেন সবকিছুই স্বাভাবিক আছে, সবকিছুই আগের মতো আছে, যদিও দুজনেই জানে যে তাদের দুজনের সুন্দর সময়টা হঠাৎ করে শেষ হয়ে যেতে যাচ্ছে। তানুস্কা তার ট্রাক্টরে করে জমি চাষ করে যেতে লাগল, রিটিন ট্রাক্টরের পেছনে সার তুলে দিতে লাগল, পানির প্রবাহ শুরু করার জন্যে পাহাড়ের উপর আটকে থাকা পানির বাঁধে খাল কেটে দিতে লাগল।
রাতে তারা ডাইনিং টেবিলে বসে হইচই করে খেতে লাগল, খেতে খেতে হাসাহাসি করতে লাগল। রিটিন তানুস্কার দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভেতর একধরনের তীক্ষ্ণ বেদনা অনুভব করে। তার মনে হতে থাকে, কী হতো যদি সে ক্যাটাগরি সি মানুষকে বাঁচানোর জন্যে নিয়ন্ত্রণ ভবনের জন্যে নির্দিষ্ট করা জায়গাটিতে পাঁচশত বছরের জন্যে শীতল ঘরে আশ্রয় না নেয়? সে যদি পাঁচশ বছর ভবিষ্যতের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে না নিয়ে এই সাদামাটা প্রাচীন পৃথিবীতে তানুস্কা আর নীলকে নিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেয় তাহলে কী এমন ক্ষতি হবে? কেন তাকেই এত বড় দায়িত্ব নিতে হবে?
রিটিন যখন এরকম এলোমেলো চিন্তা করছিল ঠিক তখন একদিন গভীর রাতে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটল।
.
নীল ঘুমিয়ে গেছে। তানুস্কা আর রিটিন বাসার সামনে ডেক চেয়ারে আধশোয়া হয়ে গল্প করছে। রিটিন মাত্র আবিষ্কার করেছে তানুস্কার গলাটি খুব মিষ্টি, ইচ্ছে করলেই সে খুব সুন্দর গাইতে পারে। রিটিনের অনুরোধ রক্ষা করে সে প্রথম গানটি শেষ করে মাত্র দ্বিতীয় গানটি শুরু করেছে তখন হঠাৎ করে মাটি কেঁপে উঠল, জানালার কাঁচে ঝনঝন করে শব্দ করে উঠল। তানুস্কা গান থামিয়ে বলল, “ভূমিকম্প!”
।রিটিন ডেক চেয়ারে সোজা হয়ে বসল, সত্যিকারের ভূমিকম্প হয়ে থাকলে পায়ের নিচের মাটি শুধু একবার ঝটকা মেরে কেঁপে উঠবে না, এটি থরথর করে কাঁপতে থাকবে। কিন্তু মাটি আর কাঁপল না, পুরো পৃথিবী স্থির হয়ে রইল।
তানুস্কা বলল, “কী আশ্চর্য!”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “কোনটা আশ্চর্য।”
“এই যে একটা ঝটকা দিয়ে একবার কেঁপে ওঠা। তুমি যেদিন এসেছিলে সেদিনও ঠিক এভাবে মাটি এভাবে ঝটকা মেরে কেঁপে উঠেছিল।”
রিটিন চমকে উঠে তানুস্কার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “সত্যি।”
“হ্যাঁ।” তানুস্কা অবাক হয়ে বলল, “তুমি এত অবাক হলে কেন?”
রিটিন উত্তর দিতে পারল না, তানুস্কাকে বলতে পারল না তার টাইম ক্যাপসুল মাটির গহ্বরে আঘাত করায় আশপাশের মাটি কেঁপে উঠেছিল। এখন কি আবার আরেকটি টাইম ক্যাপসুল এসেছে? কেন এসেছে?
রিটিন উঠে দাঁড়াল। তানুস্কা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাও?”
“আসছি, আমি এক্ষুনি আসছি।”
রিটিনের গলার স্বরে কিছু একটা ছিল যেটি শুনে তানুস্কা হঠাৎ ভয় পেয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলল, “কী হয়েছে রিটিন? তুমি কোথা থেকে আসছ?”
রিটিন বলল, “কিছু হয়নি তানুস্কা। আসলে হয়তো কিছুই হয়নি। কিন্তু আমি একটু সাবধান থাকতে চাই। আমি আমার ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে আসি। আমার ব্যাগে নিরাপত্তার কিছু যন্ত্রপাতি আছে।”
রিটিন তার ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে এসে সেখান থেকে তার স্পেস ভিউয়ার বের করে এনে তার ভেতরে তাকাল। তানুস্কা অবাক হয়ে দেখল ভিউয়ারের স্ক্রিনে চারিদিক একেবারে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেখানে বহুদূরে চারজন মানুষকে হেঁটে আসতে দেখা গেল।
তানুস্কা অবাক হয়ে বলল, “এটা কী যন্ত্র? সবকিছু এত স্পষ্ট দেখা যায়! এত রাতে এখানে মানুষ কোথা থেকে আসছে?”
রিটিন তার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা ভয়ংকর দর্শন অস্ত্র বের করে আনে। অস্ত্রটিতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সচল করে চাপা গলায় বলল, “তানুস্কা, তুমি ভেতরে যাও।”
“কেন?”
“এখন আমার কাছে এটা জানতে চেয়ো না তানুস্কা। তুমি ভেতরে যাও, নীলকে বিছানা থেকে নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে রেখো। তুমিও তার পাশে শুয়ে থেকো।”
“তুমি কী বলছ রিটিন?” তানুস্কা ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হচ্ছে এখানে?”
“আমি তোমাকে এখন সবকিছু বুঝিয়ে বলতে পারব না। শুধু এটুকু বলতে পারি ঐ চারজন মানুষ সম্ভবত আমাকে মেরে ফেলতে আসছে।”
“কেন? তোমাকে মারবে কেন? তুমি কী করেছ?”
রিটিন চাপা গলায় বলল, “সেটা এখন বলতে পারব না, এখনই তুমি ভেতরে যাও। এদের কাছে ভয়ংকর অস্ত্র আছে, একবার লক করে ফেলতে পারলে কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। এখনো অনেক দূরে, লক করতে পারবে না।”
তানুস্কা কাঁপা গলায় বলল, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না–”
“তুমি বুঝতে পারবে না। শুধু জেনে রাখো ওরা যদি আমাকে মেরে ফেলতে পারে তুমি মন খারাপ করবে না। আমি শুধু একটা কথা বলে রাখি–আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি, জ্ঞান হওয়ার পর আমি কারো কাছে ভালোবাসা পাইনি। তুমি প্রথম আমাকে ভালোবাসা দিয়েছ। তোমার জন্যে আমার জীবনটা পরিপূর্ণ হয়েছে–”
তানুস্কা বলল, “না, তুমি এরকম করে কথা বোলো না”
“ঠিক আছে বলব না।”
“ভেতরে যাও তানুস্কা–”
“না। আমি ভেতরে যাব না। আমি তোমার সাথে থাকব।”
“অবুঝ হয়ো না তানুস্কা–”
“আমি অবুঝ হচ্ছি না। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।”
“ওরা শুধু আমার জন্যে আসছে। তুমি যদি আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করো তাহলে ওরা তোমাকেও ছাড়বে না।”
“না ছাড়ুক।”
রিটিন আবছা অন্ধকারে তানুস্কার দিকে তাকাল, সে হঠাৎ করে বুঝতে পারল এই মেয়েটি তাকে একা ফেলে রেখে ভেতরে যাবে না। কাজটি অর্থহীন এবং বিপজ্জনক। কিন্তু মেয়েটি এই পুরোপুরি অর্থহীন এবং বিপজ্জনক কাজটাই করবে।
রিটিন বলল, “তুমি যদি ভেতরে না যাবে তাহলে এসো আমরা দুজন এখন ট্রাক্টরটার পেছনে চলে যাই।”
দুইজন গুঁড়ি মেরে ট্রাক্টরের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে যায়। রিটিন স্পেস ভিউয়ারটিতে দূরের মানুষগুলোকে আরো একবার দেখে সেটা বন্ধ করে দিল, এটা চালু থাকলে দূর থেকে এটার সিগন্যাল পাওয়া সম্ভব হতে পারে।
দুজন নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকে, একসময় তারা মানুষগুলোর পায়ের শব্দ শুনতে পেল। শক্ত মাটিতে ভারী জুতোর শব্দ। কিছুক্ষণের মাঝেই মানুষগুলো বাসার সামনে এসে দাঁড়াল, তারা কিছুক্ষণ সেখানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর একজন উচ্চ স্বরে বলল, “রিটিন, আমরা জানি তুমি এখানে আছো। তুমি বের হয়ে এসো।”
রিটিন বের হয়ে গেল না, নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকল। মানুষটি বলল, “রিটিন, তুমি যেটা করতে চাইছ সেটা খুবই ভয়ংকর। তুমি সম্ভবত জানো না তুমি এখানে এসে কজালিটি ব্রেক করেছ। তুমি এখানে আসার কারণে বর্তমান পৃথিবীতে যা যা পরিবর্তন হয়েছে সেগুলো লক্ষ কোটি গুণ এমপ্লিফাইড হয়ে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে প্রভাবিত করবে। আরো কিছু করার আগে বের হয়ে এসো।”
আরেকজন বলল, “তুমি কোথায়?”
রিটিন এবারেও কোনো উত্তর দিল না।
মানুষটি বলল, “আমরা জানি তুমি আমাদের কথা শুনছ। তুমি যদি এই মুহূর্তে বের না হয়ে আসো আমরা এই বাসাটির ভেতর ঢুকব। এখানে যে কয়টি জীবিত প্রাণী আছে তাদের একজন একজন করে হত্যা করব।”
তানুস্কা আতঙ্কে শিউরে উঠে খপ করে রিটিনের হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, “সর্বনাশ! আমার নীল–”
রিটিন বলল, “ভয় পেয়ো না। ওরা আমার জন্যে এসেছে। আমাকে পেলে ওরা কারো কোনো ক্ষতি করবে না। আমি জানিয়ে দিই যে আমি এখানে।”
রিটিন ট্রাক্টরের পাশে দিয়ে মাথা বের করে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে হাতের অস্ত্রটা তুলে ট্রিগার টেনে ধরল। একটা আলোর ঝলকানির সাথে সাথে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। একজন মানুষ ছিটকে নিচে পড়ে গেল এবং সাথে সাথে অন্য সবাই ঝটকা মেরে ঘুরে গিয়ে ট্রাক্টরটির দিকে তাকাল। মানুষগুলো পেছনে হাত দিয়ে ভয়ংকর দর্শন অস্ত্র পিঠ থেকে তুলে নিয়ে ট্রাক্টরগুলোর দিকে তাক করে, একজন বলল, “রিটিন, তুমি কোথায় আমরা এখন জানি, হাত উপরে তুলে বের হয়ে এসো–”
রিটিন চিৎকার করে বলল, “তুমি জাহান্নামে যাও! তোমার চোদ্দগুষ্ঠি জাহান্নামে যাক–” কথা শেষ না করেই সে আবার ট্রিগার টেনে ধরল, আবার প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দের সাথে আলোর ঝলকানি বের হয়ে আসে। আরো একজন মানুষ ছিটকে পড়ল।
রিটিন ট্রিগার থেকে হতে সরিয়ে আবার মানুষগুলোর দিকে তাকাল। যে দুজন মানুষ ছিটকে পড়েছিল তাদের দুজনেই উঠে দাঁড়িয়েছে। তারাও অন্যদের সাথে এগিয়ে আসছে। এগুলো মানুষ নয়। এগুলো রোবট।
সবার সামনে যে মানুষটি ছিল সে তার অস্ত্রটা ট্রাক্টরের দিকে তাক করে শান্ত গলায় বলল, “রিটিন। তুমি নির্বোধের মতো ব্যবহার করো না। তুমি জানো আমরা প্রস্তুতি ছাড়া আসিনি। তুমি আমাদের কিছু করতে পারবে না। আমি একা এই পুরো এলাকা উড়িয়ে দিতে পারি। ট্রিগার টেনে ধরলে এই ট্রাক্টর আর তার পেছনে ঘাপটি মেরে থাকা তুমি সবকিছু মুহূর্তে ভস্মীভূত হয়ে যাবে।”
রিটিন বলল, “কিন্তু আমি জানি তোমার সেটা করার অনুমতি নেই। কজালিটি ব্রেক হলে কী হবে কেউ জানে না–তুমি কজালিটি ব্রেক করার সাহস পাবে না। শুধু তুমি না তোমার বাপ দাদা চোদ্দগুষ্ঠি সেই সাহস পাবে না”
কথা শেষ করে রিটিন আবার এক পশলা গুলি করল, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ এবং আলোর ঝলকানিতে জায়গাটা নারকীয় হয়ে ওঠে। কিছু ধোঁয়া সরে গেলে দেখা গেল মানুষগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে, সবাই ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করল, তারপর টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। হাতের অস্ত্রগুলো আবার ট্রাক্টরটির দিকে তাক করে মানুষগুলো আরো কয়েক পা এগিয়ে আসে।
একজন খসখসে ভাঙা গলায় বলল, “রিটিন, আমরা জানি ট্রাক্টরের পেছনে তুমি একা নও, তোমার সাথে আরেকজন আছে। একটি মেয়ে। তুমি দুই হাত উপরে তুলে বের হয়ে এসো, তা না হলে আমরা এই মেয়েটাকে খুন করে ফেলব।”
কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন বলল, “আমাদের সময়ের অভাব নেই, কিন্তু ধৈর্যের অভাব আছে। আমি তিন পর্যন্ত গুনব, তার ভেতরে যদি তুমি বের হয়ে না আসে তাহলে আমরা এই মেয়েটাকে গুলি করব। মেগাওয়াট এক্সরে লেজার তোমার ট্রাক্টর ফুটো করে পেছনের মেয়েটাকে টুকরো টুকরো করে দেবে।”
খসখসে গলায় মানুষটা বলল, “আমি গুনতে শুরু করছি। এক।”
তানুস্কা খপ করে রিটিনের হাত ধরে বলল, “রিটিন! এখন কী হবে?”
“যেটা হওয়ার সেটা হয়ে আছে। আমি দেখি সেটা কী।”
“তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।”
“তোমার বোক্সর প্রয়োজন নেই তানুস্কা। শুধু জেনে রাখো। তোমাকে আমাদের ব্যাপারে জড়ানো যাবে না।”
খসখসে গলার মানুষটি বলল, “দুই”।
রিটিন চিৎকার করে বলল, “ঠিক আছে আমি আসছি।”
খসখসে গলার মানুষটা বলল, “চমৎকার।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বলল, “দুই হাত উপরে তুলে বের হবে যেন আমরা তোমার অস্ত্রটা দেখতে পাই। যদিও তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ তোমার অস্ত্রটা আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”
রিটিন তানুস্কার দিকে তাকিয়ে বলল, “বিদায় তানুস্কা।” তারপর তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দুই হাত উপরে তুলে বের হয়ে এল।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা এগিয়ে এসে রিটিনের হাতের অস্ত্রটা ছিনিয়ে নেয়। তারপর তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে তাদের অস্ত্রগুলো তার দিকে তাক করল। রিটিন হাত উপরে তুলে বলল, “এক সেকেন্ড।”
খসখসে গলার মানুষটা বলল, “কী হয়েছে?”
রিটিন বলল, “খোলা মাঠে যখন সারি সারি টিউলিপ লাগানো
খসখসে গলার মানুষটা বলল, “খবরদার-খবরদার”
“তার মাঝে যখন একটা শিশু হেঁটে যায়। নেচে নেচে বলে-”
“খবরদার খবরদার–চুপ করো–”
“নেচে নেচে বলে আমি ফুলের সুবাস খাই আমি চাঁদের আলো খাই”
মানুষগুলো থর থর করে কাঁপতে থাকে, কাঁপতে কাঁপতে বিকৃত গলায় বলে, “চুপ করো, চু-চু-চুপ করো। চু-চু-চু-”
রিটিন বলল, “বলো। আমার সাথে বলো, আমি ফুলের রেণু মেখে স্নান করি, চাঁদের আলো খাই”
মানুষগুলো বলল, “ফুলের রেণু-মে-খে স্নান করি। চাঁদের আলো খাই।”
“বলো, কুয়াশার মাঝে ডুবে যাই মেঘের মাঝে ভেসে যাই–”
মানুষগুলো বলল, “কুয়াশার মাঝে ডুবে যাই–মেঘের মাঝে ভেসে যাই”
রিটিন তখন সাবধানে উঠে দাঁড়াল। তানুস্কা ট্রাক্টরের পেছন থেকে বের হয়ে রিটিনের কাছে এসে বলল, “কী হচ্ছে এখানে?”
“মেটাকোড।”
“মেটাকোড কী?”
“রোবটকে অচল করার কোড। আমি রিভিক ভাষা জানি, তাই যেকোনো বরোটকে অচল করতে পারি।”
“রোবট? এরা রোবট।”
“হ্যাঁ। এরা রোবট।”
“কী আশ্চর্য!”
তানুস্কা অবাক হয়ে বলল, “এরা কোথা থেকে এসেছে?”
“বলছি। তার আগে এগুলোকে পাকাঁপাকিভাবে অচল করে দিই। তা না হলে কিছুক্ষণের মাঝে আবার রিবুট করে চালু হয়ে যাবে।”
রিটিন তার অস্ত্রটা নিয়ে রোবটগুলোর খুব কাছাকাছি গিয়ে পাঁজরের নিচে গুলি করল। ঝনঝন শব্দ করে একটা একটা করে রোবট টুকরো টুকরো হয়ে গেল। রোবটদের মাথাগুলো শরীর থেকে আলাদা হয়ে গড়িয়ে যায় এবং সেভাবে সেগুলো ফাস ফাস করে বলতে থাকে, “ফুলের রেণু মেখে চাঁদের আলোতে স্নান করি”
তানুস্কা বলল, “কী ভয়ানক!”
রিটিন চুল ধরে একটা মাথা তুলে এনে তার কানের নিচে চাপ দিল, মাথাটি সাথে সাথে বিড়বিড় করে কথা বলা বন্ধ করে চোখ পিটপিট করে তাকাল। রিটিন রোবটের মাথাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাজটা ঠিক হয়নি।”
রোবটের মাথাটা ফাস ফঁসে গলায় বলল, “কোন কাজটা?”
“এই যে আমাকে মারার জন্যে চারটা মানুষ না পাঠিয়ে চারটা নির্বোধ রোবট পাঠিয়ে দিল। আমি রোবটকে খুব ঘৃণা করি, তোমরা
জানো না?”
“মানুষ রোবটকে বানিয়েছে। রোবটকে ঘৃণা করা ঠিক না।”
রিটিন রোবটের মাথাটাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “ব্যস অনেক হয়েছে। আমাকে তোমার জ্ঞান দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
“ঠিক আছে।”
“তোমাদের কেন পাঠানো হয়েছে?”
“তোমাকে খুন করার জন্যে।”
“আমাকে খুন করতে হবে, সেটা কেমন করে জানতে পারল? আর আমাকে এখানে পাবে সেটা কেমন করে বুঝতে পারলে?”
রোবটের মাথাটা চুপ করে রইল। রিটিন বলল, “বলো। কথা বলো। আমি তোমাদের সিকিউরিটি ভেঙেছি। আমার কাছে তোমার গোপন করার ক্ষমতা নেই।”
“না, নেই।”
“বলো কেমন করে নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল জানতে পারল আমাকে খুন করতে হবে?”
“তোমাদের ক্লিওনের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে সবকিছু জেনে গেছে।”
“আর এখানে পাঠানোর জন্যে টাইম ক্যাপসুল কেমন করে তৈরি করা হয়েছে?”
“প্রফেসর রাইখের মস্তিষ্ক স্ক্যান করেছে।”
“তার মানে আমি এখানে কী করতে এসেছি সেটা জানাজানি হয়ে গেছে।”
রোবটের মাথাটা বলল, “মনে হয়। আমি তুচ্ছ পি ফরটিটু রোবট, আমি খুঁটিনাটি জানি না। ভাসা ভাসা জানি।”
রিটিন রোবটের মাথাটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়ে থামল, জিজ্ঞেস করল, “আমাকে মারতে পেরেছ কি পারনি সেই তথ্যটা কীভাবে পাঠাবে?”
রোবটের মাথাটা চুপ করে রইল। রিটিন ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কথা বলো।”
“বলছি। আমাদের কাছে একটা রেডিও অ্যাকটিভ গ্যাসের এম্পুল আছে। হাফ লাইভ একশ বছরের মতো। সেই এন্ডুলটা কন্ট্রোল করার একটা অ্যাকটিভ সার্কিট আছে। তোমাকে হত্যা করার পর তোমার শরীরের এক ফোঁটা রক্ত সেই সার্কিটের কন্ট্রোলে দিতে হবে। এটা তাহলে পাঁচশ বছর পরে নির্দিষ্ট সময়ে খুলে যাবে। বাতাসে রেডিও অ্যাকটিভ গ্যাসটা মিশে যাবে। পৃথিবীর মানুষ যখন দেখবে হঠাৎ করে বাতাসে এই রেডিও অ্যাকটিভ গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গেছে বুঝে নেবে মিশন সফল হয়েছে। তোমাকে খুন করা হয়েছে।”
রিটিন বলল, “এই তথ্যটা দেয়ার জন্যে আমার তোমাকে একবার চুমু খাওয়া দরকার, কিন্তু তোমার মাথাটা দেখে আমার এত ঘেন্না করছে যে আমার পক্ষে চুমু খাওয়া সম্ভব নয়।”
“আমাকে চুমু খেতে হবে না।”
“এখন চট করে আমাকে বলো রেডিও অ্যাকটিভ গ্যাসের এলটা কোথায়।”
“আমাকে আমার শরীরের কাছে নিয়ে যাও। আমি দেখাই।”
“রিটিন বলল, তোমার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।”
“তাতে সমস্যা নেই। আমি চিনতে পারব।”
রিটিন রোবটের মাথাটি নিয়ে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া শরীরের অংশগুলোর ভেতর খুঁজে রেডিও অ্যাকটিভ গ্যাসের এম্পুলটি বের করল। রোবটের মাথাটি ছুঁড়ে দেবার আগে মাথাটি কাতর গলায় বলল, “রিটিন। তোমাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?”
“কী অনুরোধ?”
“আমার সার্কিটটা অফ করে ব্যাটারিটা খুলে নিতে পারবে? আমি এভাবে বেঁচে থাকতে চাই না।”
রিটিন বলল, “ঠিক আছে।”
সে রোবটের মাথায় কানের নিচে হাত দিয়ে সুইচটা অফ করে ব্যাটারিটা খুলে নিল।
তানুস্কা এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। এবারে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখানে কী হচ্ছে তুমি আমাকে বলবে?”
“বলব। তোমাকে বলতেই হবে, কারণ তোমার সাহায্য দরকার।”
“তার আগে আমাকে একটু সময় দাও, আমি দেখে আসি নীল কী করছে! এখানে এত খুনোখুনি হয়ে গেল সে কি কিছু টের পায়নি।”
রিটিন বলল, “মনে হয় পায়নি। জেগে উঠলে এতক্ষণে বাইরে চলে আসত।”
তানুস্কা বাসার দিকে ছুটে যেতে লাগল।
১৫-১৬. নির্জন রাস্তা দিয়ে তানুস্কা
১৫.
নির্জন রাস্তা দিয়ে তানুস্কা তার ভ্যানটি চালিয়ে নিচ্ছে। তানুস্কার পাশে রিটিন নিঃশব্দে বসে আছে। পেছনের সিটে নীল ঘুমিয়ে আছে। তাদেরকে প্রায় বারোশত কিলোমিটার যেতে হবে, একটানা গাড়ি চালিয়ে গেলেও চব্বিশ ঘণ্টা থেকে বেশি লেগে যাবে। একটানা গাড়ি চালানো সম্ভব নয়, রিটিন গাড়ি চালাতে পারে না। সে যে পৃথিবী থেকে এসেছে সেখানে কোনো মানুষ গাড়ি চালায় না। একজন মানুষ যে গাড়ি নামের এই বিপজ্জনক যন্ত্রটাকে সরু একটা রাস্তার উপর দিয়ে ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে পারে সেটি নিজের চোখে দেখেও রিটিনের এখনো বিশ্বাস হয় না।
ভ্যানের পেছনে রিটিনের যন্ত্রপাতি। একটি ধাতব টিউব, এর ভেতরে সে পাঁচশত বছরের জন্যে ঘুমিয়ে যাবে। এই টিউবটিকে শীতল রাখার জন্যে ছোট একটি ফিউসান ইঞ্জিন, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যন্ত্রপাতি। মাটি খুঁড়ে নিচে নামার জন্যে কিছু ভারী যন্ত্রপাতি। পাঁচশ বছর পর আবার এই যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করে সে উপরে উঠে নিয়ন্ত্রণ ভবনে ঢুকে যাবে। নিয়ন্ত্রণ ভবন ধ্বংস করার জন্যে তার কাছে প্রচুর বিস্ফোরক, যে বিস্ফোরক দিয়ে সম্ভবত পৃথিবীর একটা বড় শহর ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। এছাড়া আছে কিছু ভয়ংকর দর্শন অস্ত্র। বারোশত কিলোমিটার যাবার সময় পথে যদি কোনো কারণে পুলিশ তাদের থামিয়ে পেছনে কী আছে সেটা পরীক্ষা করতে চায় তাহলে খুব বড় বিপদে পড়ে যেতে পারে! তবে পাঁচশ বছর পরের প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি এই মুহূর্তে কেউ যেন চিনতে না পারে সে জন্যে যথেষ্ট যত্ন করে নকল খোলস দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে এগুলোকে পানির পাম্প, সার ছিটানোর স্প্রে, ট্রাক্টরের ইঞ্জিন এরকম মনে হবে।
রিটিন তানুস্কাকে সবকিছু খুলে বলেছে। তানুস্কা সবকিছু খুঁটিনাটি বুঝেছে তা নয় কিন্তু অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছে তার সাথে হঠাৎ করে ক্ষণিকের পরিচয়ের এই মানুষটির উপর ভবিষ্যতের পৃথিবীর বিশাল একটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই মানুষটিকে ধরে রাখা যায় না। ভবিষ্যৎ থেকে একজন মানুষ তার কাছে চলে এসেছে এই বিষয়টিই সে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না।
নির্জন পথে গাড়ি চালাতে চালাতে দুজনে কথা বলছে। প্রথম প্রথম তাদের কথা হয়েছে নিজেদের জগৎ নিয়ে, একসময় সেই কথার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তখন কথা শুরু হয়েছে নিজেদের নিয়ে। নিজেদের কথা শেষ হওয়ার পর কথা হয়েছে একজন অপরজনকে নিয়ে।
গাড়ি চালাতে চালাতে একসময় তানুস্কা গাড়ি থামিয়েছে। কোনো একটা পার্কে কিংবা বনভূমিতে গাড়ি থামিয়ে বিশ্রাম নিয়েছে। তানুস্কা গাড়ির সিট লম্বা করে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে গেছে, রিটিন নীলকে কোলে নিয়ে তার সাথে গল্প করছে।
যখন তাদের ক্ষুধা পেয়েছে তখন তারা পথের ধারে কোনো একটা ছোট ক্যাফেতে গাড়ি থামিয়ে কিছু একটা খেয়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ যদি নদীতীরে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে অপূর্ব একটি দৃশ্য ফুটে ওঠে তখন তারা সেখানে তাদের গাড়ি থামিয়ে পথের ধারে পা ছড়িয়ে বসে থেকেছে। কখনো দুজনে নিচু গলায় কথা বলে, কখনো চুপচাপ বসে থাকে। কখনো তানুস্কা করুণ সুরে একটি গান গায়। তানুস্কার মিষ্টি গলার স্বর শুনে রিটিন আনমনা হয়ে যায়। বুকের ভেতর থেকে হাহাকারের মতো একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।
তৃতীয় দিন সকাল বেলা তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছাল। রাস্তা থেকে নেমে তাদের আরো ভেতরে যেতে হবে, পুরো এলাকাটি একটি বনভূমি। এখানে কেমন করে এত যন্ত্রপাতি নিয়ে যাবে তানুস্কা ঠিক অনুমান করতে পারছিল না, কিন্তু সে দেখল কাজটি বেশ সহজ। রিটিন যেসব যন্ত্রপাতি এনেছে তার মাঝে একটি হচ্ছে মিনি বাইভার্বাল। তার উপর সবকিছু চাপিয়ে রিটিন কিছুক্ষণের মাঝেই সবাইকে নিয়ে বনভূমির গভীরে ঢুকে গেল।
ঠিক কোথায় হিমঘরটি বসাবে সেটি রিটিন খুব নিখুঁতভাবে বের করল। জায়গাটি নিশ্চিত করার পর রিটিন যন্ত্র দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করল। প্রায় পাঁচশ মিটার গভীরে পাথরের নানা স্তর ভেদ করে সে একটা ছোট ঘর তৈরি করে নেয়, তারপর সেখানে যন্ত্রপাতি নামাতে থাকে।
সন্ধেবেলার আগেই তার কাজ শেষ হয়ে যায়। এখন শুধু ভেতরে গিয়ে টিউবের ভেতরে আশ্রয় নেয়া। পুরো সময়টুকু তানুস্কা একটা গাছের গুঁড়িতে চুপচাপ বসে ছিল। নির্জন বনভূমিতে পাখির ডাক, গাছের পাতার শব্দ কিংবা বুনো পশুর পদচারণা কিছুই সে শুনছিল না। যখন রিটিন তার কাছে বিদায় নিতে এল তখন তানুস্কা প্রথমবার ভেঙে পড়ল। রিটিনকে গভীর আলিঙ্গনে কিছুক্ষণ ধরে রেখে ছেড়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে ছেড়ে দিতে মন চাইছে না রিটিন। মনে হচ্ছে তোমাকে বুকে চেপে ধরে রাখি।”
রিটিন নিচু গলায় বলল, “যে কষ্ট মানুষ সইতে পারে না, মানুষকে সেই কষ্ট কেন পেতে হয় আমি জানি না।” তারপর মুখে জোর করে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, “অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে তানুস্কা। তুমি এখন যাও, তোমাকে অনেকটা পথ যেতে হবে।”
তানুস্কা চোখের পানি লুকিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। কয়েক পা গিয়ে হঠাৎ করে সে আবার ছুটে ফিরে আসে। রিটিনকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি পারব না রিটিন। আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারব না, আমাকে তুমি তোমার সাথে নিয়ে যাও।”
নীল অনুচ্চ স্বরে বলল, “মা। রিটিন তোমাকে নিয়ে গেলে আমি কার সাথে থাকব?”
রিটিন নিঃশব্দে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
দুই ঘণ্টা পর তানুস্কা তার ভ্যানটি চালিয়ে উত্তরে যেতে থাকে। সে তার মস্তিষ্কটিকে পুরোপুরি শূন্য করে রাখার চেষ্টা করছে।
ঠিক তখন রিটিন মাটির পাঁচশ মিটার নিচে একটা টিউবের ভেতর শুয়ে তার মাথার কাছে একটা যন্ত্রপাতির প্যানেলের সুইচ টিপে দেয়। খুব অস্পষ্ট একটা চাপা গুঞ্জন শুনতে পেল। টিউবের ভেতর একধরনের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রিটিনের চোখে ঘুম নেমে আসতে থাকে।
সুদীর্ঘ একটি ঘুম। টানা পাঁচশ বছরের ঘুম।
.
১৬.
খুব ধীরে ধীরে রিটিনের ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে কিছুক্ষণ রিটিন বুঝতে পারে না সে কোথায় আছে, কেন আছে। ধীরে ধীরে তার চেতনা ফিরে আসতে থাকে এবং হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ে যায়। তানুস্কা তাকে গভীর আলিঙ্গনে ধরে রেখে আকুল হয়ে কাঁদছে, দৃশ্যটার কথা সে ভুলতে পারছে না, কিন্তু সেই ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে। পাঁচশ বছর দীর্ঘ সময়, এই সময়ে পুরো পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেছে। পৃথিবীর এই সময়ে তানুস্কা নেই–রিটিন সেটি মেনে নিতে পারছিল না। তার মনে হতে থাকে ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এলেই দেখবে ঘন অরণ্য। সামনে ছুটে গেলেই দেখবে তানুস্কা তার ভ্যানটিতে হেলান দিয়ে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে দাঁড়িয়ে আছে নীল, তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে।
রিটিন জানে আসলে গত পাঁচশ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সে মাটির গহ্বরে যে কক্ষটিতে শুয়ে আছে তার উপরে সেই অভিশপ্ত নিয়ন্ত্রণকক্ষ। তাকে সেখানে যেতে হবে, কক্ষটিকে ধ্বংস করতে হবে। তানুস্কা নেই। নীল নেই, কয়েকদিনের সেই দিনগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। সেটি শুধুমাত্র স্মৃতি। তার মস্তিষ্কের কিছু কিছু নিউরনে জমা করে রাখা একটি পরাবাস্তব স্মৃতি।
রিটিন তার মাথা থেকে সব চিন্তা জোর করে সরিয়ে দিল। তাকে যে কাজ করার জন্যে পাঠানো হয়েছে তাকে সেই কাজটি শেষ করতে হবে। পৃথিবীতে মানুষের বিভাজনটি শেষ হবে কি হবে সেটা নির্ভর করছে সামনের কয়েকটি ঘণ্টায় সে ঠিক করে তার দায়িত্বটি শেষ করতে পারবে কি না তার উপর।
রিটিন সরু ক্যাপসুলটিতে উঠে বসে। মাথার কাছে রাখা মনিটরটির দিকে তাকায়, ছোট প্যানেলটির কয়েকটি জায়গা স্পর্শ করতেই তার শরীরে কিছু উত্তেজক তরল প্রবাহিত হতে শুরু করে এবং প্রায় সাথে সাথেই রিটিন সতেজ অনুভব করতে থাকে।
রিটিন ছোট ক্যাপসুলটির ভেতর বসে তার ব্যাক প্যাকটি পরীক্ষা করল। এর ভেতর যে পরিমাণ বিস্ফোরক আছে সেটি দিয়ে পুরো একটি শহরকে মুহূর্তে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। রিটিন তার পোশাক পাল্টে নেয়, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে তারপর উপরের মাটি ভেদ করে বের হয়ে আসার কাজে লেগে যায়।
রিটিন পুরো সিস্টেমটি পরীক্ষা করল, সবকিছু ঠিকভাবে কাজ করছে। এখন কয়েকটি বোতাম টিপে তাকে অপেক্ষা করতে হবে। নিও মিসাইল উপরের মাটি পাথর কংক্রিট ধাতব শিলা সবকিছু কেটে একটা গোল গর্ত তৈরি করে দেবে। রিটিনকে সেই গর্ত দিয়ে নিয়ন্ত্রণকক্ষের ভেতর ঢুকে যেতে হবে। সেখানে কী দেখবে সে জানে না।
রিটিন কন্ট্রোল প্যানেলের বোতামগুলো স্পর্শ করল। সাথে সাথে সে একটি ঝাঁকুনি অনুভব করল এবং ভোতা একটি যান্ত্রিক শব্দ শোনা যেতে থাকে। রিটিন মনিটরের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।
রিটিন ভেবেছিল গর্তটি করতে বুঝি অনেক সময় নেবে। কিন্তু বেশি সময় নিল না, হঠাৎ করে যান্ত্রিক শব্দটি থেমে যায় এবং মনিটরে একটা লাল বাতি জ্বলতে থাকে। রিটিনের বের হবার সময় হয়েছে।
রিটিন তখন ক্যাপসুল খুলে বের হয়ে আসে। ঠিক তার মাথার উপর গোল একটি গর্ত। মাটি পাথর ধাতব দেয়াল আর কংক্রিট কেটে গর্ত করা হলে নিচে যে পরিমাণ জঞ্জাল আর ধুলো বালি থাকার কথা সেরকম নেই। গর্ত করায় যে নিও মিসাইলটি ব্যবহার হয়েছে সেটি নিশ্চয়ই প্রথম শ্রেণির যন্ত্র।
রিটিন তার শরীরে জেট প্যাক লাগিয়ে নিল, তারপর ব্যাক প্যাকের বিস্ফোরকের সুইচটা টিপে সেটাকে ট্রিগার করে নিল। তারপর গর্তের নিচে দাঁড়িয়ে জেট প্যাকটির কন্ট্রোল রডটি ধরে চাপ দিতেই সে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করে। উপরে কী আছে সে জানে না। বের হওয়ামাত্রই গুলি করে তাকে ছিন্নভিন্ন। করে দেবে কি না সেটাও সে জানে না। দিলেও ক্ষতি নেই, সে যতক্ষণ বেঁচে থাকবে বিস্ফোরকটি নিজে নিজে বিস্ফোরিত হবে না, তার নিজের হাতে সেটিকে বিস্ফোরিত করতে হবে। কিন্তু কোনো কারণে সে মারা গেলে বিস্ফোরকটি নিজে নিজে বিস্ফোরিত হবে।
গর্তটির মুখের কাছে এসে সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে, তারপর একটা ঝটকা দিয়ে উপরে উঠে আসে। একটা আলোকোজ্জ্বল হলঘর, চারপাশে থরে থরে যন্ত্রপাতি সাজানো। যন্ত্রপাতিগুলো আশ্চর্য রকম নীরব, এতগুলো যন্ত্র থেকে বিন্দুমাত্র শব্দ বের হচ্ছে না। রিটিন অস্ত্রটি হাতে নিয়ে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়। অনেকগুলো মানুষ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে তার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মানুষগুলো সবাই একই রকম। সাদা ওভার অল পরে আছে। আর সবচেয়ে যেটি আশ্চর্য সেটি হচ্ছে সবগুলো মানুষ শুধু যে দেখতে একরকম তা নয় মানুষগুলোর মুখের অভিব্যক্তি এক রকম। তারা সবাই একসাথে মুখটা উপরে তুলে রিটিনের দিকে তাকাল, তারপর এক সাথে সবাই চোখের দৃষ্টি নামিয়ে আনে।
রিটিন শক্ত করে অস্ত্রটা ধরে রাখল, যদি মানুষগুলো বিন্দুমাত্র বিপদের আভাস দেয় এক পশলা গুলি দিয়ে সবাইকে শেষ করে দেবে। কিন্তু মানুষগুলো একটু নড়ল না, কোনো রকম বিপজ্জনক কিছু করল না, শুধুমাত্র স্থির দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল।
রিটিন মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে আনার চেষ্টা করে বলল, “শুভ সকাল।”
মানুষগুলো কোনো উত্তর না দিয়ে তার দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। রিটিন বলল, “আমি বলেছি শুভ সকাল।”
এবারে মানুষগুলো একজন কিংবা বেশ কয়েকজন মিলে বলল, “আসলে সময়টা সকাল না। সন্ধে হয়ে গেছে।”
গলার স্বর যান্ত্রিক। রিটিন অস্ত্রটা তাক করে রেখে বলল, “তোমরা কী রোবট?”
মানুষগুলো পুতুলের মতো একসাথে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, “না, আমরা রোবট না। আমরা মানুষ।”
রিটিন অবাক হয়ে লক্ষ করল সবগুলো মানুষ মিলে কথা বলছে কিন্তু তারা এক সাথে কথা বলছে না, একেকজন একেকটা শব্দ উচ্চারণ করছে, কিন্তু এত বিস্ময়করভাবে একজনের পর আরেকজন কথা বলে যাচ্ছে যে শুনে মনে হচ্ছে বুঝি একজন কথা বলছে।
রিটিন অস্ত্রটা তাক করে ধরে রেখে বলল, “তোমরা ক্লোন।”
“হ্যাঁ, আমরা একে অপরের ক্লোন।”
রিটিন কী বলবে বুঝতে পারল না। একটু ইতস্তত করে বলল, “তোমাদের সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।”
মানুষগুলো উত্তর দিল না, তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। রিটিন বলল, “আমি একটা বিশেষ কাজ করতে এসেছি। আশা করি তোমরা আমাকে কাজটা করতে দেবে। আমার কাজে বাধা দেবে না।”
“কী কাজ?”
“আমি এই যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে এসেছি। যদি আমার কাজে বাধা দাও আমায় তোমাদেরকে মেরে ফেলতে হবে।”
মানুষগুলো নিচু গলায় কিছু একটা বলল, রিটিন ঠিক বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, “কী, বললে তোমরা?”
“বলেছি যন্ত্রগুলো ধ্বংস করলে আমরা এমনিতেই মরে যাব।”
“এমনিতেই মরে যাবে? কেন?”
“আমরা হচ্ছি যন্ত্রগুলোর আত্মা। যন্ত্রগুলো আমাদের শরীর। শরীর ধ্বংস হলে আত্মা বেঁচে থাকে না।”
রিটিন শব্দ করে হাসল। বলল, “যন্ত্র হচ্ছে যন্ত্র। যন্ত্রের আত্মা থাকে না। তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো তোমরা মারা যাবে না। কিন্তু আমার কাজে বাধা দিলে তোমাদের অবশ্যই মেরে ফেলতে হবে।”
মানুষগুলো কোনো কথা না বলে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল। রিটিন বলল, “তোমরা পেছন দিকে সরে যাও আমি এখন যন্ত্রগুলোতে বিস্ফোরক লাগাব।”
মানুষগুলো জিজ্ঞেস করল, “কেন তুমি যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে চাও?”
“এই যন্ত্রগুলো দিয়ে পৃথিবীর মানুষের বিভাজন করা হয়। আমরা বিভাজন দূর করে দিতে চাই।”
“পৃথিবীতে কি অনেক মানুষ?”
রিটিন একটু অবাক হয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “তোমরা পৃথিবীর কিছু জানো না?”
মানুষগুলো বলল, “এটা আমাদের পৃথিবী। এই যন্ত্রগুলো আমাদের শরীর, আমরা যন্ত্রগুলোর আত্মা। বাইরের পৃথিবীতে কী আছে আমরা জানি না। জানতেও চাই না।”
এই নিয়ে দ্বিতীয়বার মানুষগুলো যন্ত্রের আত্মা কথাটি বলেছে। কেন বলেছে কে জানে। রিটিন তার কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাকটা খুলে ভেতর থেকে বিস্ফোরকগুলো বের করতে থাকে। ছোট ছোট চতুষ্কোণ ব্লক। উপরে একটি ডায়াল, ডায়ালটিতে সময় নির্ধারণ করে দিতে হয়। নির্ধারিত সময়ে বিস্ফোরকগুলো বিস্ফোরিত হয়।
রিটিন একটা বিস্ফোরক হাতে নিয়ে মানুষগুলোকে লক্ষ করে বলল, “তোমরা পেছনে সরে যাও, এই বিস্ফোরকগুলো প্রচণ্ড শক্তিশালী। যখন যন্ত্রগুলো ধ্বংস হবে তখন দূরে থাকতে হবে।”
মানুষগুলো বলল, “আমরা কি যন্ত্রগুলোর কাছে থাকতে পারি?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না। পারো না।”
“জন্ম থেকে আমরা এই যন্ত্রগুলোকে লালন করেছি। মৃত্যুর সময় আমরা তার পাশে থাকতে চাই।”
রিটিন কঠিন মুখ করে বলল, “না, আমি যখন যন্ত্রগুলো ধ্বংস করব তখন তোমরা তার কাছে থাকতে পারবে না। আমি যন্ত্র ধ্বংস করতে এসেছি, মানুষ ধ্বংস করতে আসিনি। যাও, পিছিয়ে যাও।”
মানুষগুলো পিছিয়ে গেল না। বলল, “তুমি কেন যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে চাও? যন্ত্রগুলো ধ্বংস করলে আমরাও ধ্বংস হয়ে যাব।”
“না, তোমরা ধ্বংস হবে না।”
“এই যন্ত্র ছাড়া আমাদের জীবনে আর কিছু নেই।”
“এখন থাকবে। এখান থেকে বের হওয়ার পর তোমাদের নতুন একটা জীবন হবে।”
“কিন্তু কেন যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে চাও?”
রিটিন মাথা ঘুরিয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা কি জানো এই যন্ত্রগুলো কী করে?”
“না। জানি না।”
“তাহলে জেনে রাখো। এই যন্ত্রগুলো পৃথিবীর সব মানুষের সব তথ্য সংরক্ষণ করে। সেই তথ্য দিয়ে মানুষের সাথে মানুষের বিভাজন করা হয়। যদি এই যন্ত্রগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয় তাহলে মানুষে মানুষে আর বিভাজন থাকবে না।”
মানুষগুলো এক সাথে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “যন্ত্র দিয়ে কী হয় আমরা জানতে চাই না, আমরা শুধু যন্ত্রটা চাই।”
রিটিন মানুষগুলোর দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল এই মানুষগুলো কিছুতেই তাকে যন্ত্রগুলোর মাঝে বিস্ফোরক লাগাতে দেবে না। শুধু তাই নয়, এই মানুষগুলো একে অপরের ক্লোন, তারা এক সাথে একভাবে চিন্তা করে, তাই হঠাৎ করে সবাই যদি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে তাদের থামাতে পারবে না। মানুষগুলোর মাথায় কী আছে সে জানে না। তারা কী ভাবছে সেটাও সে জানে না।
রিটিন অস্ত্রটা হাতে ধরে চিৎকার করে বলল, “তোমরা সবাই পিছিয়ে যাও। নইলে আমি গুলি করব। পিছিয়ে যাও।”
মানুষগুলো যন্ত্রের মতো এক পা পিছিয়ে গেল। শুধু পিছিয়ে গেল না, একজন থেকে আরেকজন সরে গেল। এরা নিজেদের ভেতর একটা দূরত্ব তৈরি করছে।
রিটিন আবার চিৎকার করল, “পিছিয়ে যাও।”
মানুষগুলো আবার এক পা পিছিয়ে গেল, রিটিন লক্ষ করল কেউ একটু বেশি পিছিয়েছে, কেউ কম। মানুষগুলো আসলে বৃত্তাকারে তাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। রিটিন প্রথমবার এক ধরনের বিপদ আঁচ করতে পারে, কিছু একটা ঘটছে যেটা সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে তার কী মনে হলো কে জানে, সে মাথা ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাল, দেখল পেছন থেকে নিঃশব্দে অনেকগুলো ক্লোন তার দিকে এগিয়ে আসছে।
কিছু বোঝার আগেই সবগুলো ক্লোন এক সাথে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রিটিন হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা দিয়ে গুলি করার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, কেউ একজন পেছন থেকে তার মাথায় আঘাত করেছে। কী হচ্ছে বোঝার আগেই চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। রিটিন শক্ত গ্রানাইটের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগে আবছা আবছা দেখতে পেল অসংখ্য ক্লোন হিংস্র মুখে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, মনে হচ্ছে তার সমস্ত শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
জ্ঞান হারানোর আগে রিটিন হঠাৎ করে নিজের ভেতর এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে। ক্লোনগুলো তাকে এখানে মেরে ফেলবে। তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না। বিস্ফোরকগুলো তার শরীরের সাথে ট্রিগার করে রাখা আছে। তার হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়া মাত্রই বিস্ফোরকগুলো বিস্ফোরিত হয়ে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলবে।
সে বেঁচে থাকবে না কিন্তু মৃত্যুর ভেতর দিয়ে তার দায়িত্ব সে পালন করে যাবে। ক্লোনগুলোর হিংস্র আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হতে হতে রিটিন তার চোখ বন্ধ করল। ধীরে ধীরে সে অচেতন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, জীবনের শেষ মুহূর্তটি সে সুন্দর কিছু ভাবতে চায়।
রিটিনের চোখের সামনে তানুস্কার চেহারাটি ভেসে ওঠে। রিটিন দেখল তানুস্কা গভীর মমতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রিটিন তখন জ্ঞান হারাল।
১৭-১৮. রিটিনের জ্ঞান ফিরে আসে
১৭.
খুব ধীরে ধীরে রিটিনের জ্ঞান ফিরে আসে। রিটিনের প্রথম অনুভূতিটি হয় তীব্র ঠান্ডার, তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। রিটিন চোখ খুলে তাকাল, হঠাৎ করে তার মনে হয় সে বুঝি একটি পরাবাস্তব দৃশ্য দেখছে। থরে থরে যন্ত্র সাজানো এবং সেই যন্ত্রগুলোকে পরম মমতা এবং ভালোবাসায় ক্লোনগুলো আদর করছে। মানুষ যেমন করে তার ভালোবাসার মানুষটিকে আদর করে, ক্লোনগুলোর যন্ত্রগুলোকে আদর করার ভঙ্গি তার থেকেও বেশি বাস্তব। তার থেকেও বেশি তীব্র।
রিটিন চোখ বন্ধ করে। এই যন্ত্রগুলোকে দেখেশুনে রাখার জন্যে মানুষ কী বিচিত্র একটা পদ্ধতি বের করেছে।
রিটিন একটা নিঃশ্বাস ফেলল, সে এখনো বেঁচে আছে। সে বেঁচে আছে বলে বিস্ফোরকগুলো এখনো বিস্ফোরিত হয়নি। তার দাঁতের ভেতর ছোট একটা ক্যাপসুলে একটা সায়ানাইডের এম্পুল আছে। একটা বিশেষ নিয়মে কামড় দিলে এম্পুলটি ভেঙে যাবে, সাথে সাথে মৃত্যু হবে তার। ক্লোনগুলো কিছু বোঝার আগেই পুরো ভবনটি ধ্বংস হয়ে যাবে। রিটিন কি এখন তার দাঁতের কামড় দেবে? ভেঙে ফেলবে সায়ানাইডের এম্পুলটিকে?
আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক। মৃত্যু যখন নিশ্চিত তখন সেটি কয়েক মুহূর্ত পরে এলেও ক্ষতি নেই। রিটিন আবার চোখ খুলে তাকাল। যন্ত্রকে আদর করার পরাবাস্তব দৃশ্যটি আবার ফিরে এল তার চোখের সামনে। রিটিন দৃশ্যটি দেখতে দেখতে হঠাৎ আবার শীতে থরথর করে কেঁপে ওঠে। এত ঠান্ডা লাগছে কেন?
রিটিন ভালো করে তাকাল। জ্ঞান হারানোর পর তাকে টেনে ঘরের এক কোনায় এনে ফেলে রেখেছে। ঘরের এই কোনা দিয়ে মোটা মোটা কিছু পাইপ গিয়েছে, পাইপগুলো হিমশীতল। এই হিম শীতল পাইপগুলোর উপর পড়ে থাকার কারণে সে শীতে থরথর করে কাঁপছে। পাইপগুলোর উপর থেকে সরে যাবার একটু চেষ্টা করতেই তার সারা শরীর যন্ত্রণায় শিউরে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে সে যন্ত্রণার ঢেউটি নিজের শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে যেতে দিল এই হিমশীতল পাইপগুলো এখানে কী করছে? পাইপগুলো এত হিমশীতল কেন?
হঠাৎ করে রিটিন চমকে উঠল। নিয়ন্ত্রণ ভবনের ভেতর থরে থরে সাজানো যন্ত্রগুলোকে শীতল রাখার জন্যে এই পাইপগুলোর ভেতর দিয়ে কোনো এক ধরনের তরল পাঠানো হচ্ছে। অনেক পুরানো কিন্তু কার্যকর পদ্ধতি। যন্ত্রগুলোর ভেতর যে পরিমাণ তাপ তৈরি হচ্ছে সেটাকে শীতল করতে বিশাল পরিমাণ হিমশীতল তরল পাঠাতে হয়। এই হিমশীতল প্রবাহ কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে মুহূর্তে সবগুলো যন্ত্র প্রচণ্ড তাপে বাষ্পীভূত হয়ে যাবে! তাকে কোনো বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে না, এই হিমশীতল তরলের প্রবাহটি শুধু এক মুহূর্তের জন্যে থামতে হবে।
সায়ানাইডের এম্পুলে কামড় না দিয়ে সে কি কোনোভাবে এই হিমশীতল তরল প্রবাহ কয়েক মুহূর্তের জন্যে বন্ধ করতে পারে না? রিটিন হঠাৎ করে নিজের ভেতর একধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। তার এখন শরীরে কয়েক সিসি ট্র্যাকিনল দরকার। তার শরীরের ভেতরেই একটা এম্পুল রয়েছে, সেটাকে ভেঙে দিয়ে রক্তের প্রবাহের সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। রিটিন সাবধানে কনুইয়ের একটু উপরে হাত দিয়ে চামড়ার নিচে ট্রাকিনলের এম্পুলটি খুঁজে বের করে দুই পাশ থেকে চাপ দিল। কয়েকবার চেষ্টা করতেই এম্পুলটা ভেঙে তার রক্তের মাঝে ট্র্যাকিনলও মিশে যেতে থাকে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর রিটিন সতেজ অনুভব করতে থাকে।
রিটিন আধশোয়া হয়ে চারদিকে তাকাল। ক্লোনগুলো তার দিকে তাকাচ্ছে না, তারপরও সে কোনো ঝুঁকি নিল না। নিশ্চল হয়ে শুয়ে থেকে সাবধানে চারদিকে তাকায়, হিমশীতল তরল বয়ে নিয়ে যাওয়া পাইপগুলো বাইরে থেকে এসেছে। ডান দিকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে ছোট একটা ঘর, এই ঘরের ভেতর থেকে হিমশীতল তরলগুলোকে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। যন্ত্রগুলোর ভেতর থেকে তাপ নিয়ে যাওয়া উষ্ণ তরলের পাইপগুলোও রিটিন খুঁজে বের করল। হাত দিয়ে স্পর্শ করে নিশ্চিত হতে পারলে ভালো হতো কিন্তু ক্লোনগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে সেটি করা সম্ভব নয় বলে রিটিন তার চেষ্টা করল না।
পঞ্চাশ মিটার দূরে ছোট ঘরটাতে ঢুকতে পারলে সে সম্ভবত হিমশীতল তরলের প্রবাহটি বন্ধ করতে পারবে। ঢোকার জন্যে কোনো একটা দরজা ভাঙতে হবে–সেটিও খুব সোজা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু রিটিন সেটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করল না। তার দুই হাতের দুটি আঙুলে চার মাত্রার দুটি বিস্ফোরক আছে। এগুলো দিয়ে সে বড় ধরনের কিছু ধ্বংস করতে পারবে না কিন্তু ডিস্ট্রিবিউশান ঘরটির দরজা নিশ্চয়ই ভাঙতে পারবে।
রিটিনকে এখন শুধু ডিস্ট্রিবিউশান ঘরটিতে পৌঁছাতে হবে। ক্লোনদের দৃষ্টি এড়িয়ে সেটি করা সম্ভব হবে না, কিন্তু যতটুকু সম্ভব সে চেষ্টা করবে।
রিটিন দুই হাতে ভর দিয়ে খুব সাবধানে ঘরটির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ক্লোনগুলো তাকে লক্ষ করছে না, যখন সে ঘরটির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তখন হঠাৎ একটি ক্লোন তাকে প্রথমবার লক্ষ করল, ক্লোনটি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল এবং সাথে সাথে সবাই একসাথে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। ক্লোনগুলোর আলাদা অস্তিত্ব নেই, সবাই একসাথে একভাবে সবকিছু অনুভব করে।
ক্লোনগুলো যে যেখানে ছিল সেখানে থেমে গেল। তারপর এক সারিতে দ্রুত পদক্ষেপে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। তাদের মাঝে কোনো ব্যস্ততা নেই, শুধু একটুখানি বিস্ময় আছে।
রিটিনকে এখন আর গোপনে গুঁড়ি মেরে যেতে হবে না, তাই সে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াল। সে দৌড়ে ঘরটার কাছে ছুটে যায়। দরজার হ্যাঁন্ডেল ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে খোলার চেষ্টা করল, দরজাটি খুলল না, খুলবে সেটি সে আশাও করেনি।
এবার ডান হাতের তর্জনীটি দরজার হাতলের দিকে লক্ষ করে বুড়ো আঙুলের গোড়ায় চাপ দিল, সাথে সাথে আঙুলের চামড়া ভেদ করে একটি ছোট বিস্ফোরক ছুটে গেল, বিস্ফোরণের শব্দের সাথে সাথে দরজার হ্যাঁন্ডলটি খুলে আসে। রিটিন লাথি দিতেই এবারে দরজাটা খুলে গেল। রিটিন তখন ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তার ভাগ্য ভালো দরজাটা বন্ধ রাখার জন্যে ভেতরে আরো একটা লক আছে, দ্রুত সে লকটা লাগিয়ে দেয়। ক্লোনগুলো সহজে এখন ভেতরে ঢুকতে পারবে না।
রিটিন ঘরের ভেতরে তাকাল। চারদিক থেকে বড় বড় পাইপ এসে জড়ো হয়েছে। একদিক থেকে হিমশীতল পাইপগুলো বের হয়েছে, অন্যদিক দিয়ে উষ্ণ পাইপগুলো ফিরে এসেছে। দেয়ালে একটা বড় কন্ট্রোল প্যানেল, সেটি দেখার আর সময় নেই। রিটিন পাইপের ভাল্বগুলোর দিকে তাকাল, সেগুলো বন্ধ করে দিতে পারলেই হিমশীতল তরলের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সে কি খালি হাতে এত বড় বড় ভাল্ব বন্ধ করতে পারবে?
এখন চিন্তা করার সময় নেই, রিটিন তাই তার চেষ্টাও করল না। সে বড় একটা ভাল্ব ধরে সেটাকে টেনে বন্ধ করার চেষ্টা করল, কোনো লাভ হলো না। গোড়ায় একটা ছোট কন্ট্রোল বক্স রয়েছে, সেটা অকেজো না করা পর্যন্ত ভাটা বন্ধ করা যাবে না। রিটিনের অন্য হাতের আঙুলে এখনো আরেকটি বিস্ফোরক লুকানো আছে, সেটি এখন ব্যবহার করতে পারে।
বাম হাতের তর্জনীটি কন্ট্রোল বক্সের দিকে তাক করে সে তার বুড়ো আঙুলটি টেনে ধরে, সাথে সাথে আগুলের চামড়া ভেদ করে ক্ষুদ্র বিস্ফোরকটি ছুটে বের হয়ে কন্ট্রোল বক্সটাকে আঘাত করল। বিস্ফোরণের ঝলকানির সাথে সাথে কন্ট্রোল বক্সটা হাট হয়ে খুলে যায়। ভেতরে কিছু সার্কিট, রিটিন লাথি দিয়ে সার্কিটগুলো গুঁড়ো করে দিয়ে আবার বড় ভাল্বটাকে ধরে টান দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করল। প্রথমে সেটি নড়তে চাইল না কিন্তু একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই ঘড় ঘড় শব্দ করে ভাটা বন্ধ হয়ে গেল।
শীতল প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতেই ভবনের মাঝে থরে থরে সাজানো যন্ত্রগুলো মুহূর্তের মাঝে গনগনে লাল হয়ে ওঠে, তারপর প্রচণ্ড বিস্ফোরণ করে একটি পর একটি বাষ্পীভূত হয়ে যেতে থাকে। লকলকে আগুনের শিখা আর কুচকুচে কালো ধোঁয়ায় ভবনটি অন্ধকার হয়ে যায়।
সারি বেঁধে ছুটে আসা ক্লোনগুলো থমকে দাঁড়িয়ে গেল, তারপর কাতর আর্তনাদ করে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে। এই যন্ত্রগুলো তাদের অস্তিত্ব, যদি এগুলো ধ্বংস হয়ে যায় তাদের বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই।
রিটিন হতবাক হয়ে দেখতে পেলো ভবনটির যন্ত্রগুলোর একটার পর একটাকে আগুনে গ্রাস করে ফেলছে–সেই গনগনে লাল আগুনে একটির পর একটি ক্লোন ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কী ভয়ংকর দৃশ্য, রিটিন আর দেখতে পারছিল না, সে দুই হাতে মুখ ঢেকে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
.
১৮.
বড় টেবিলটার এক পাশে বসে স্যুপের বাটি থেকে এক চামচ স্যুপ মুখে দিয়ে ক্লিওন বলল, “তোমাকে ধন্যবাদ রিটিন।”
রিটিন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “কেন?”
“তোমার কারণে পৃথিবীতে মানুষের সাথে মানুষের বিভাজন দূর করার প্রক্রিয়াটি আমরা শুরু করতে পেরেছি।”
রিটিন স্যুপের চামচে চুমুক দিয়ে বলল, “শুরু করা সহজ, কিন্তু শেষ কি করা যাবে? মানুষে মানুষে বিভাজন কি দূর হবে?”
“নিশ্চয়ই হবে। সত্যি কথা বলতে কী কাজ শুরু হয়ে গেছে। ভিডি টিউবে দেখনি সব বাচ্চা মিলে দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে?”
“হ্যাঁ, দেখেছি।”
“এর থেকে সুন্দর দৃশ্য কি পৃথিবীতে আছে?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না, নেই।”
দুজন আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে স্যুপের বাটি থেকে স্যুপ খেতে থাকে। রিটিন জিজ্ঞেস করল, “প্রফেসর রাইখ কেমন আছে?”
“এখন অনেকটুকু ভালো। টাইম ক্যাপসুল তৈরি করার জন্যে তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। মস্তিষ্ক স্ক্যান করার সময় তার মস্তিষ্কের কিছু ক্ষতি করেছে।”
“সুস্থ হবে তো?”
“হ্যাঁ, হবে। তুমি যদি নিয়ন্ত্রণ ভবন উড়িয়ে না দিতে তাহলে কী হতো আমরা জানি না।”
ক্লিওন রিটিনের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ রিটিন।”
রিটিন শব্দ করে হাসল, বলল, “তুমি কেন আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছ। আমি নিজে কিছু করিনি-প্রকৃতি যেটা করতে চেয়েছে সেটা হয়েছে। আমি শুধু সেটাকে সাহায্য করেছি।”
“আমি সে জন্যেই তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি রিটিন। প্রকৃতি কী চায় সেটা কতজন জানে?”
স্যুপের বাটিটা সামনে ঠেলে ক্লিওন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি চাও বলো রিটিন। পৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে আমরা তোমাকে কিছু একটা দিতে চাই।”
“আমি কিছু চাই না।”
“কেন কিছু চাইবে না! কিছু একটা চাও, তোমাকে দেব আমরা।”
“গ্লানা নামের একটা মেয়ের ভালোবাসার মানুষটির নাম ছিল মিশি। তার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন করে দিয়েছিল–তাকে আবার মিশি করে দাও।”
ক্লিওন হাসল, বলল, “এগুলো তো আমরাই করে দিচ্ছি। সব মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন ঠিক করে দিয়েছি। তুমি নিজের জন্যে কিছু চাও।”
“একজন মানুষ যা কিছু চাইতে পারে তার সবকিছু আমি পেয়েছি। আমি আর কী চাইব। আমি কিছু চাই না।”
“ঠিক আছে, তুমি সময় নাও। তারপর কিছু একটা চাও। তুমি যা চাইবে আমরা তোমাকে সেটাই দেব।”
রিটিন ক্লিওনের দিকে বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “সত্যি?”
“সত্যি।”
.
শেষ কথা
প্রায় বারোশত কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে তানুস্কা নীলকে নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছে। বাসার সামনে ভ্যানটি থামিয়ে পাশে বসে থাকা নীলের দিকে তাকিয়ে তানুস্কা বলল, “ আমার বাসার ভেতরে ঢুকতে মন চাইছে না।”
নীল তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন, তোমার ঢুকতে মন চাইছে না মা?”
“শুধু রিটিনের কথা মনে হচ্ছে! তাকে কোথায় এক জঙ্গলের ভেতর মাটির নিচে রেখে এসেছি। পাঁচশ বছর সেখানে ঘুমিয়ে থাকবে।”
নীল কোনো কথা না বলে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কেন পাঁচশ বছর ঘুমিয়ে থাকতে হবে? কেন আমাদের সাথে থাকল না?”
তানুস্কা বলল, “তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে নীল। কোনো কোনো মানুষকে পৃথিবীর অনেক বড় বড় দায়িত্ব নিতে হয়। এই বড় বড় দায়িত্ব নেয়ার জন্যে আমাদের মতো মানুষকে ছেড়ে চলে যেতে হয়। রিটিনকে তাই আমাদের ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।”
কথা বলতে বলতে তানুস্কা ছেলের হাত ধরে সিঁড়িতে দাঁড়াল। দরজা খোলার জন্যে চাবি বের করতে গিয়ে দেখল দরজাটা খোলা।
সে অবাক হয়ে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কফির গন্ধ পেল। সে আরেকটু এগিয়ে খাবার ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখল খাবার টেবিলে প্লেটের মাঝে রুটি টোস্ট। ছোট গ্লাসে ফলের রস। হাফ প্লেটে ডিম পোচ। ছোট একটা বাটিতে টুকরো করে কাটা পনির। কেউ একজন টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছে।
ঠিক তখন রান্নাঘর থেকে দরজা খুলে রিটিন বের হয়ে আসে। যেন কিছুই হয়নি, সেরকম ভান করে বলল, “ভালো আছ তানুস্কা?”
“তুমি?”
“হ্যাঁ। আমি।”
“তুমি? তুমি?”
“হ্যাঁ। আমি তানুস্কা। আমি পাঁচশ বছর কাটিয়ে পৃথিবীতে গিয়েছি। তারপর পুরো পৃথিবীকে ওলটপালট করে ফেলেছি।”
রিটিন একটু এগিয়ে যায়। দুই হাত বাড়িয়ে তানুস্কাকে আলিঙ্গন করে বলল, “তারপর আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি তানুস্কা। পৃথিবীর মানুষ আমাকে কিছু একটা উপহার দিতে চেয়েছিল। আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি। তোমাকে আর নীলকে।”
তানুস্কা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না রিটিন।”
“তোমার কিছু বুঝতে হবে না তানুস্কা। শুধু বলো–”
“কী বলব?”
“প্রতিদিন ভোরে তুমি আমাকে তোমার জন্যে ডিম পোচ করতে দেবে”
তানুস্কা কথা না বলে রিটিনকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
নীল মায়ের কাপড় ধরে টেনে বলল, “মা, তুমি বলো তুমি রাজি আছো। বলো। তাড়াতাড়ি বলো।”