- বইয়ের নামঃ রিটিন
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ তাম্রলিপি
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১-০২. বিশাল হলঘরের মাঝখানে
রিটিন
রিটিন ঘুরে তাকাল, প্রায় তার বয়সী একটা মেয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করেছে। মেয়েটির মুখ ভাবলেশহীন, অন্তত সে নিজে এরকম একটা ভাব দেখানোর চেষ্টা করছে। রিটিন অবশ্যি এই ভাবলেশহীন মুখের পেছনে খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের উত্তেজনা লক্ষ করল। রিটিন মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?”
০১.
বিশাল হলঘরের মাঝখানে একটা গ্রানাইটের টেবিল। টেবিলের অন্যপাশে সোনালি চুলের মাঝবয়সী একজন মহিলা বসে তীক্ষ্ণ চোখে রিটিনের দিকে তাকিয়ে আছে। রিটিন খুব মনোযোগ দিয়ে তার হাতের নখগুলো পরীক্ষা করছে, তাকে দেখলে মনে হবে এই মুহূর্তে তার হাতের নখগুলো দেখা খুবই জরুরি।
সোনালি চুলের মহিলা জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “তুমি কী করতে চাও?”
রিটিন বলল, “আমি তোমাকে বলেছি। আমি লেখাপড়া করতে চাই। লেখাপড়া করে গবেষণা করতে চাই।”
সোনালি চুলের মহিলা বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কেন আমাকে এটা বলছ! তুমি খুব ভালো করে জান কে কী করবে সেটি পূর্ব নির্ধারিত। গত একশ বছর থেকে মানুষকে জেনেটিক উপায়ে ডিজাইন করা হয়। যারা লেখাপড়া করবে তাদের সেভাবে ডিজাইন করতে হয়। তোমাকে করা হয়নি।”
রিটিন তার হাতের আঙুল থেকে চোখ সরিয়ে সোনালি চুলের মহিলাটির দিকে তাকাল, বলল, “সেটা আমার দোষ নয়। আমাকে আমি ডিজাইন করিনি।”
“তোমার বাবা-মায়ের দায়িত্ব ছিল তোমাকে জেনেটিক ডিজাইন করা। তোমাকে করা হয়নি, তুমি ক্যাটাগরি সি মানুষ। ক্যাটাগরি সি মানুষ লেখাপড়া করে না, গবেষণা করে না। তারা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে”
রিটিন সোনালি চুলের মহিলাকে বাধা দিয়ে বলল, “আমি এসব জানি। যদি আমার লেখাপড়ার সুযোগ থাকত আমি সায়েন্স ইনস্টিটিউটে গিয়ে ভর্তি হয়ে যেতাম। তার নিয়ম নেই, তারা আমাকে সেখানে ঢুকতেই দেবে না। তাই আমি তোমার কাছে এসেছি। যেখানে নিয়ম থাকে সেখানেই নিয়ম পরিবর্তনের উপায় থাকে।”
মহিলাটি এবারে হাসির মতো শব্দ করল, বলল, “তুমি কোথা থেকে এসব তথ্য পেয়েছ আমি জানি না। নিয়ম ভাঙার জন্যে নিয়ম করা হয় না–”
“নিয়ম ভাঙা আর নিয়ম পরিবর্তন করা এক জিনিস নয়। আমি নিয়ম ভাঙতে চাইছি না একটুখানি পরিবর্তন করতে চাইছি।”
“একটুখানি?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ একটুখানি। আমাকে পরীক্ষা করে দেখা হোক আমি লেখাপড়া করার উপযুক্ত কি না। দেখা হোক আমি ক্যাটাগরি এ মানুষের সমান পর্যায়ের কি না। তার পরে সুযোগ দেয়া হোক!”
সোনালি চুলের মহিলা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “তুমি যে পরীক্ষা করার কথা বলছ সেটা করা হয়ে গেছে। সেই পরীক্ষাটার ফল অনুযায়ী তুমি ক্যাটাগরি সি–”
রিটিন হঠাৎ একটু ঝুঁকে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি মানুষ না রোবট?”
মহিলাটি হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “কী বললে?”
“আমি জানতে চাইছি তুমি মানুষ নাকি রোবট।”
সোনালি চুলের মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, “আমরা যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করছি তার সাথে তোমার এই প্রশ্নের কোনো সম্পর্ক নেই।”
“আছে। সম্পর্ক আছে। তুমি যদি রোবট না হয়ে মানুষ হতে তাহলে তুমি সম্পর্কটা ধরতে পারতে। যেহেতু ধরতে পারছ না তার অর্থ তুমি রোবট। আমি শুধু শুধু একটা রোবটের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করলাম।”
মহিলাটি কেমন যেন রাগী রাগী চেহারায় বলল, “রোবট আর মানুষের মাঝে পার্থক্য কতোটুকু তুমি জান?”
রিটিন বলল, “আমার জানার প্রয়োজন নেই। ইচ্ছাও নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে টেবিলের ঐ পাশে তুমি কি আসলেই আছ নাকি এটাও একটা হলোগ্রাফিক ছবি। আমি কি তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে পারি?”
মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, “না, তুমি ছুঁয়ে দেখতে পার না। এটি শালীনতার মাঝে পড়ে না।”
রিটিন হাহা করে হাসল, বলল, “একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে জাপটে ধরে, কেউ একবারও শালীনতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর একটা হলোগ্রাফিক ছবিকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলে শালীনতা নষ্ট হয়?”
“আমি প্রক্রিয়াটির কথা বলছি না, প্রক্রিয়াটি করার পেছনের মানসিকতাটির কথা বলছি!”
রিটিন তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, বলল, “যখন একটা রোবট মানুষকে মানসিকতার উপর লেকচার দেয় তখন বুঝতে হবে কোথাও খুব বড় গোলমাল আছে। তবে–”
“তবে কী?”
রিটিন হাসি হাসি মুখে সোনালি চুলের মহিলাটির দিকে তাকাল, “লল, “তোমাকে একটা কবিতা শোনাই, সংখ্যার কবিতা, নয় আট আট এক আট তিন চার সাত নয় সাত সাত পাঁচ তিন পাঁচ–”
মহিলাটি আর্ত চিৎকার করে বলল, “না! না! মেটাকোড–”
রিটিন মহিলাটির কথার কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বলে যেতে থাকে, “ছয় ছয় তিন ছয় নয় আট শূন্য–”
মহিলাটি তীক্ষ্ণ একটি যন্ত্রণার শব্দ করল, তারপর থরথর করে কাঁপতে থাকলে। কপালের ভেতর থেকে একটা আলো জ্বলতে শুরু করে, শরীরে কেমন জানি খিচুনি হতে থাকে। রিটিন বিকল হতে শুরু করা রোবটটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকল, “সাত চার দুই ছয় পাঁচ চার দুই পাঁচ–”
ইচ্ছা করলে সে আরো বলতে পারত কিন্তু আর প্রয়োজন নেই। রোবটটি পুরোপুরি বিকল হয়ে গেছে! সংখ্যা বলা থামিয়ে রিটিন হেঁটে যেতে থাকে। বিশাল হলঘরের শেষ মাথায় দরজা। রিটিন জানে আসলে এটা বিশাল হলঘর নয়, এটা ছোট একটা খুপরি। আলো অন্ধকারের খেলা দিয়ে বিশাল হলঘরের একটা অনুভূতি দেয়া হয়েছে। এই যে সে দরজার দিকে হেঁটে যাচ্ছে, তার মনে হচ্ছে অনেক দূরে হলঘরের শেষ মাথায় দরজা, আসলে দরজাটি একেবারে হাতের কাছে, পায়ের নিচে মেঝেটুকু সরে যাচ্ছে তাই পৌঁছাতে সময় লাগছে। সবকিছুই আসলে এক ধরনের প্রতারণা। সত্যি বিষয়গুলো কখনোই কাউকে জানানো হয় না, সবসময়েই প্রতারণা করা হয়। এটাকে কেউ অবশ্যি আর প্রতারণা মনে করে না। সবাই এটাকেই জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছে।