- বইয়ের নামঃ শাহনাজ ও ক্যাপ্টেন ডাবলু
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০২. সোমা হচ্ছে শাহনাজের আম্মার
সোমা হচ্ছে শাহনাজের আম্মার ছোটমামার একজন দূর-সম্পর্কের বনের মেয়ে। সম্পর্ক হিসাব করে ডাকাডাকি করলে শাহনাজকে মনে হয় সোমা খালা–টালা–এই ধরণের কিছু একটা ডাকা উচিত কিন্তু এত হিসাব করে তো আর কেউ ডাকাডাকি করে না। সোমার আব্বা শাহনাজের আব্বার খুব ভালো বন্ধু। অফিসের কাজে একবার ঢাকা এসে কয়দিন শাহনাজদের বাসায় ছিলেন। তখন থেকেই পরিচয়। সোমা বয়সে শাহনাজ থেকে একটু বড়, তাই তাকে সোমা আপু বলে ডাকে।
সোমা একেবারে অসাধারণ একজন মেয়ে। কেউ যদি সোমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়, সে তা হলে পড়ে গিয়েও খিলখিল করে হেসে উঠে বলবে, ইস্! তুমি কী সুন্দর ল্যাং মারতে পার! কোথায় শিখেছ এত সুন্দর করে ল্যাং মারা? রাস্তায় যদি কোনো ছিনতাইকারী তার গলার হার ছিনিয়ে নিয়ে যায় তা হলেও খুশিতে ঝলমল করে বলে উঠবে, লোকটার নিশ্চয়ই আমার বয়সী একটা মেয়ে আছে, মেয়েটা এই হারটা পেয়ে কী খুশিই না হবে! কেউ যদি সোমার নাকে ঘুসি মেরে বসে তা হলে সোমা ব্যথাটা সহ্য করে হেসে বলবে, কী মজার একটা ব্যাপার হল! ঘুসি খেলে কী রকম লাগে সবসময় আমার জানার কৌতূহল। ছিল, এবারে জেনে গেলাম! যারা সোমাকে চেনে না তারা এ রকম কথাবার্তা শুনে মনে। করতে পারে সে বুঝি বোকাসোকা একটা মেয়ে, কিছুই বোঝে না, আর বুঝলেও না বোঝার ভান করে সারাক্ষণ ন্যাকা ন্যাকা কথা বলে। কিন্তু একটু ঘনিষ্ঠতা হলেই বোঝা যায় আসলে সোমা একেবারেই বোকা নয়, তার মাঝে এতটুকুও ন্যাকামো নেই। সোমা সত্যি সত্যি পণ করেছে পৃথিবীর সবকিছু থেকে সে আনন্দ খুঁজে বের করবে। একটা ব্যাপারে অন্যেরা যখন রেগেমেগে কেঁদেকেটে একটা অনর্থ করে ফেলে, সোমা ঠিক তখনো তার মাঝখান থেকে আনন্দ পাবার আর খুশি হবার একটি বিষয় খুঁজে বের করে ফেলে।
সোমারা থাকে চট্টগ্রামের একটা পাহাড়ি এলাকায়। তার আব্বা সেখানকার একটা ছবির মতো দেখতে চা–বাগানের ম্যানেজার। চা–বাগানে যারা থাকে তারা মনে হয় একটু একা একা থাকে, তাই কেউ বেড়াতে গেলে তারা ভারি খুশি হয়। সোমা কয়দিন পরে পরেই শাহনাজকে চিঠি লিখে সেখানে বেড়াতে যেতে বলে। শাহনাজেরও খুব ইচ্ছে, কিন্তু পরীক্ষার জন্য সবরকম জল্পনা–কল্পনা বন্ধ করে রাখা ছিল। পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলে আব্বা এখন তাকে যেতে দিতে রাজি হয়েছেন। আনন্দে শাহনাজের মাটিতে আর পা পড়ে না।
পৃথিবীতে অবশ্য কোনো জিনিসই পুরোপুরি পাওয়া যায় না। আম খেলে ভিতরে আঁটি থাকে, চকোলেট খেলে দাঁতে ক্যাভিটি হয়, পড়াশোনায় বেশি ভালো হলে বন্ধুবান্ধবেরা। ভ্যাবলা বলে ধরে নেয়। ঠিক সেরকম সোমার কাছে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দটুকু পুরোপুরি পাওয়া গেল না, কারণ আম্বা ইমতিয়াজের ওপর ভার দিলেন শাহনাজকে সোমাদের বাসায় নিয়ে যেতে। ইমতিয়াজ প্রথমে অবশ্য বলে দিল সে শাহনাজকে নিয়ে যেতে পারবে না, কারণ তার নাকি কবিতা লেখার ওপরে একটা ওয়ার্কশপ আছে। আব্বা যখন একটা ছোটখাটো ধমক দিলেন তখন সে খুব অনিচ্ছার ভান করে রাজি হল। শাহনাজকে নিয়ে যাবার সময় পুরো রাস্তাটুকু ইমতিয়াজ কী রকম যন্ত্রণা দেবে সেটা চিন্তা করে শাহনাজের প্রায় এক শ দুই ডিগ্রি জ্বর উঠে যাবার মতো অবস্থা, কিন্তু একবার পৌঁছে যাবার পর যখন সোমার সাথে দেখা হবে তখন কতরকম মজা হবে চিন্তা করে সে নিজেকে শান্ত করল।
সোমাদের বাসায় যাবার জন্য সে তার ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। বেড়ানোর জন্য জামা–কাপড়, চা–বাগানের টিলায় টিলায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য টেনিস শু, রোদ থেকে বাচার জন্য বেসবল টুপি এবং কালো চশমা, ছুটিতে পড়ার জন্য জমিয়ে রাখা গল্পের বই, বেড়ানোর অভিজ্ঞতা লিখে রাখার জন্য নোটবই এবং কলম, ছবি আঁকার খাতা, ফটো তোলার জন্য আব্বার ক্যামেরা, সোমার জন্য কিছু উপহার, সোমার আব্বার জন্য পড়ে কিছু বোঝা যায় না এরকম জ্ঞানের একটা বই আর সোমার আম্মার জন্য গানের সিডি। ইমতিয়াজ। ভান করল পুরো ব্যাপারটিই হচ্ছে এক ধরনের সময় নষ্ট, তাই মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব। করে রাখল, কিন্তু নিজের ব্যাগ গোছানোর সময় সেখানে রাজ্যের জিনিস এনে হাজির করল।
নির্দিষ্ট দিনে আব্বা–আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শাহনাজ আর ইমতিয়াজ রওনা দিয়েছে, কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছে সময়মতো। ট্রেনে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে শাহনাজের খুব ভালো লাগে, একেবারে সাধারণ জিনিসগুলো তখন একেবারে অসাধারণ বলে মনে হয়। ব্যাগ থেকে সে একটা রগরগে এ্যাডভেঞ্চারের বই বের করে আরাম করে বসল। ইমতিয়াজ মুখ খুব গম্ভীর করে চুলের ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে সেগুলো এলোমেলো করতে করতে একটা মোটা বই বের করল। বইটার নাম খুব কটমটে, শাহনাজ কয়েকবার চেষ্টা করে পড়ে আন্দাজ করল : মধ্যযুগীয় কাব্যে অতিপ্রাকৃত উপমার নান্দনিক ব্যবহার! এ রকম বই যে কেউ লিখতে পারে সেটা একটা বিস্ময় এবং কেউ যে নিজে থেকে সেটা পড়ার চেষ্টা করতে পারে সেটা তার থেকে বড় বিস্ময়।