- বইয়ের নামঃ রুহান রুহান
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ ঢাকা কমিক্স
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. পৃথিবীতে এখন খুব দুঃসময়
বৃদ্ধ কুরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীতে এখন খুব দুঃসময়।
ছোট শিশু অর্থহীন কথা বললে বড় মানুষেরা যেভাবে সকৌতুকে তার দিকে তাকায় অনেকে সেভাবে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। কেউ কোনো কথা বলল না। পৃথিবীর মানুষ আজকাল বেশি কথা বলে না, কী নিয়ে কথা বলবে। কেউ জানে না। বৃদ্ধ কুরুর মতো দুই-একজন ছাড়া সবাই জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে পৃথিবীতে খুব বড় দুঃসময়। সবাই সেটা মেনে নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছে, সেই বেঁচে থাকাটাও খুব অর্থপূর্ণ বেঁচে থাকা নয়। তাই কেউ সেগুলো নিয়ে কথা বলতে চায় না। সেটা নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগও করে না। শস্যক্ষেত্রের পাশে উঁচু ঢিবিতে দাঁড়িয়ে থেকে সবাই উত্তর দিকে তাকিয়ে রইল। বহুদূরে কোথাও আগুন লেগেছে, সেই আগুন থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে কালো ধোঁয়া আকাশে উঠছে। এটি কোনো নতুন দৃশ্য নয়, অনেকদিন থেকেই তারা দেখছে দূরে কোথা থেকে জানি মাঝে মাঝে কুণ্ডুলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া আকাশে ওঠে। যতই দিন যাচ্ছে সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলি আরো ঘন ঘন এবং আরো কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে। কে জানে কোনো একদিন হয়তো এই গ্রামটা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে। এই গ্রামের বাড়িঘর, শস্যক্ষেত্র সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে আর কুচকুচে কালো ধোঁয়া আকাশে পাক খেয়ে উঠতে থাকবে।
রুহান নিঃশব্দে দূরে তাকিয়ে রইল, কালো ধোয়ার রেখাঁটি একটি অশুভ সংকেতের মতো ঝুলছে, সেটি থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা যায় না। সেটা কত দূরে কেউ জানে না। পৃথিবীতে এখন কারো সাথে কারো যোগাযোগ নেই, তাই ঠিক কোথায় কী ঘটছে তা কেউ অনুমান করতে পারে না। মাঝে মাঝে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অপরিচিত কোনো মানুষ যখন এই গ্রামের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যায়, সবাই তখন তাকে ঘিরে ধরে তার কাছ থেকে জানতে চায়–সে কোথা থেকে এসেছে, কী দেখেছে। এছাড়া সেই মানুষগুলোর কেউ কেউ মুখ ফুটে কিছু বলতে চায় না, তাড়া খাওয়া পশুর মতো তারা ভীত আতঙ্কিত মুখে তাকিয়ে থাকে। মাথা নেড়ে বিড় বিড় করে অস্পষ্ট দুই একটি কথা বলে আরো দক্ষিণের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। কেউ কেউ উদাসী মুখে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব ঘটনার বর্ণনা দেয়, সেই সব ঘটনার সবকিছু বিশ্বাস করা যায় কী না সেটাও কেউ জানে না।
বৃদ্ধ কুর আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে। যাও সবাই নিজের কাজে যাও।
আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের দুই-একজন আবার মাথা নাড়ল কিন্তু কেউ চলে গেল না। দিনের আলো থাকতে থাকতে তারা মাঠে, শস্যক্ষেতে কাজ করে কিন্তু বেলা পড়ে এলে তাদের কারো বেশি কিছু করার থাকে না। বৃদ্ধ কুরু শেষবারের মতো ধোঁয়ার কুণ্ডলিটা একবার দেখে উঁচু ঢিবি থেকে নিচে নামতে শুরু করে।
এতক্ষণ রুহান চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, এবারে বৃদ্ধ কুরুকে বলল, কুরু আমি তোমার সাথে আসি?
আসবে? এসো।
রুহান হাত ধরে বৃদ্ধ কুরুকে উঁচু ঢিবি থেকে নামতে সাহায্য করল, ব্যাপারটি আজকাল একটু অস্বাভাবিক। মানুষ যখন দুঃসময়ে থাকে তখন ছোটখাটো দ্রতা বা ভালোবাসাটুকুও নিজের ভেতর আড়াল করে রাখে, অন্যদের সামনে প্রকাশ করতে চায় না। বৃদ্ধ কুরু একটু হেসে বলল, রুহান, তুমি জোয়ান ছেলে, আমার মতো বুড়ো মানুষের সাথে কী করবে? যাও নিজের বয়সী ছেলে-মেয়ের সাথে হৈ হুঁল্লোড় করো।
রুহান হাসল। বলল, সেটা তো সবসময়েই করি। মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যায় তখন হৈ হুঁল্লোড় করতে ভালো লাগে না।
বৃদ্ধ কুরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত, রুহান যে তোমার বয়সী একটা ছেলেকে এরকম কথা বলতে হচ্ছে। মন খারাপ তো তোমাদের হবার কথা নয়-মন খারাপ হবে আমাদের মতো বুড়ো মানুষদের।
রুহান কোনো কথা বলল না। বৃদ্ধ কুরুর পাশাপাশি নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। গ্রামের পাথর ছড়ানো পথের দুপাশে ঝোপঝাড়। বাসাগুলো লতাগুল্ম। দিয়ে ঢেকে আছে। বাসার ছাদে সোলার প্যানেলগুলোতে শেষ বিকেলের সোনালি আলো। বাতাসে শরতের হিমেল স্পর্শ।
বৃদ্ধ কুরু তার বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। ভারী দরজার সামনে লাগানো ছোট মডিউলে চোখের রেটিনা স্ক্যান করানোর সাথে নিঃশব্দে দরজাটা খুলে গেল। বৃদ্ধ কুরু ঘরের ভেতরে ঢুকে রুহানকে ডাকল, এসো রুহান।
রুহান ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তুমি এখন রেটিনা স্ক্যান করে ঘরে কে?
বৃদ্ধ কুরু দুর্বল ভঙ্গিতে হেসে বলল, ক্রিস্টালগুলোর জন্যে তা না হলে আমার ঘরে মূল্যবান কী আছে, বল?
রুহান মাথা ঘুরিয়ে বৃদ্ধ কুরুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার অনেকগুলো এস্টাল?
বলতে পারো। এত ক্রিস্টাল দিয়ে তুমি কী করবে?
বৃদ্ধ কুরু হাসার চেষ্টা করে বলল, জানি না কী করব। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন পুরো পৃথিবীতে নেটওয়ার্ক ছিল। পৃথিবীর যে কোনো মানুষ যে কোনো জায়গা থেকে তথ্য আনতে পারত। এখন তো আর পারে না। তাই ক্রিস্টালগুলো জোগাড় করেছিলাম—যতটুকু সম্ভব তথ্য জমা করে রাখার জন্যে এত তথ্য তো আমি সারাজীবনে দেখতে পারব না, তবু এক ধরনের সখ।
তোমার কাছে কীসের কীসের ক্রিস্টাল আছে কুরু?
বৃদ্ধ কুরু একটু হেসে বলল, কীসের নেই! ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাস থেকে শুরু করে নীল তিমি, পরমাণু থেকে গ্যালাক্সী, প্রেতচর্চা থেকে বিজ্ঞান সবকিছু আছে।