- বইয়ের নামঃ রুহান রুহান
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ ঢাকা কমিক্স
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. পৃথিবীতে এখন খুব দুঃসময়
বৃদ্ধ কুরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীতে এখন খুব দুঃসময়।
ছোট শিশু অর্থহীন কথা বললে বড় মানুষেরা যেভাবে সকৌতুকে তার দিকে তাকায় অনেকে সেভাবে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। কেউ কোনো কথা বলল না। পৃথিবীর মানুষ আজকাল বেশি কথা বলে না, কী নিয়ে কথা বলবে। কেউ জানে না। বৃদ্ধ কুরুর মতো দুই-একজন ছাড়া সবাই জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে পৃথিবীতে খুব বড় দুঃসময়। সবাই সেটা মেনে নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছে, সেই বেঁচে থাকাটাও খুব অর্থপূর্ণ বেঁচে থাকা নয়। তাই কেউ সেগুলো নিয়ে কথা বলতে চায় না। সেটা নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগও করে না। শস্যক্ষেত্রের পাশে উঁচু ঢিবিতে দাঁড়িয়ে থেকে সবাই উত্তর দিকে তাকিয়ে রইল। বহুদূরে কোথাও আগুন লেগেছে, সেই আগুন থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে কালো ধোঁয়া আকাশে উঠছে। এটি কোনো নতুন দৃশ্য নয়, অনেকদিন থেকেই তারা দেখছে দূরে কোথা থেকে জানি মাঝে মাঝে কুণ্ডুলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া আকাশে ওঠে। যতই দিন যাচ্ছে সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলি আরো ঘন ঘন এবং আরো কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে। কে জানে কোনো একদিন হয়তো এই গ্রামটা দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে। এই গ্রামের বাড়িঘর, শস্যক্ষেত্র সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে আর কুচকুচে কালো ধোঁয়া আকাশে পাক খেয়ে উঠতে থাকবে।
রুহান নিঃশব্দে দূরে তাকিয়ে রইল, কালো ধোয়ার রেখাঁটি একটি অশুভ সংকেতের মতো ঝুলছে, সেটি থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা যায় না। সেটা কত দূরে কেউ জানে না। পৃথিবীতে এখন কারো সাথে কারো যোগাযোগ নেই, তাই ঠিক কোথায় কী ঘটছে তা কেউ অনুমান করতে পারে না। মাঝে মাঝে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অপরিচিত কোনো মানুষ যখন এই গ্রামের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে যায়, সবাই তখন তাকে ঘিরে ধরে তার কাছ থেকে জানতে চায়–সে কোথা থেকে এসেছে, কী দেখেছে। এছাড়া সেই মানুষগুলোর কেউ কেউ মুখ ফুটে কিছু বলতে চায় না, তাড়া খাওয়া পশুর মতো তারা ভীত আতঙ্কিত মুখে তাকিয়ে থাকে। মাথা নেড়ে বিড় বিড় করে অস্পষ্ট দুই একটি কথা বলে আরো দক্ষিণের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। কেউ কেউ উদাসী মুখে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব ঘটনার বর্ণনা দেয়, সেই সব ঘটনার সবকিছু বিশ্বাস করা যায় কী না সেটাও কেউ জানে না।
বৃদ্ধ কুর আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে। যাও সবাই নিজের কাজে যাও।
আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের দুই-একজন আবার মাথা নাড়ল কিন্তু কেউ চলে গেল না। দিনের আলো থাকতে থাকতে তারা মাঠে, শস্যক্ষেতে কাজ করে কিন্তু বেলা পড়ে এলে তাদের কারো বেশি কিছু করার থাকে না। বৃদ্ধ কুরু শেষবারের মতো ধোঁয়ার কুণ্ডলিটা একবার দেখে উঁচু ঢিবি থেকে নিচে নামতে শুরু করে।
এতক্ষণ রুহান চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, এবারে বৃদ্ধ কুরুকে বলল, কুরু আমি তোমার সাথে আসি?
আসবে? এসো।
রুহান হাত ধরে বৃদ্ধ কুরুকে উঁচু ঢিবি থেকে নামতে সাহায্য করল, ব্যাপারটি আজকাল একটু অস্বাভাবিক। মানুষ যখন দুঃসময়ে থাকে তখন ছোটখাটো দ্রতা বা ভালোবাসাটুকুও নিজের ভেতর আড়াল করে রাখে, অন্যদের সামনে প্রকাশ করতে চায় না। বৃদ্ধ কুরু একটু হেসে বলল, রুহান, তুমি জোয়ান ছেলে, আমার মতো বুড়ো মানুষের সাথে কী করবে? যাও নিজের বয়সী ছেলে-মেয়ের সাথে হৈ হুঁল্লোড় করো।
রুহান হাসল। বলল, সেটা তো সবসময়েই করি। মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যায় তখন হৈ হুঁল্লোড় করতে ভালো লাগে না।
বৃদ্ধ কুরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত, রুহান যে তোমার বয়সী একটা ছেলেকে এরকম কথা বলতে হচ্ছে। মন খারাপ তো তোমাদের হবার কথা নয়-মন খারাপ হবে আমাদের মতো বুড়ো মানুষদের।
রুহান কোনো কথা বলল না। বৃদ্ধ কুরুর পাশাপাশি নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। গ্রামের পাথর ছড়ানো পথের দুপাশে ঝোপঝাড়। বাসাগুলো লতাগুল্ম। দিয়ে ঢেকে আছে। বাসার ছাদে সোলার প্যানেলগুলোতে শেষ বিকেলের সোনালি আলো। বাতাসে শরতের হিমেল স্পর্শ।
বৃদ্ধ কুরু তার বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। ভারী দরজার সামনে লাগানো ছোট মডিউলে চোখের রেটিনা স্ক্যান করানোর সাথে নিঃশব্দে দরজাটা খুলে গেল। বৃদ্ধ কুরু ঘরের ভেতরে ঢুকে রুহানকে ডাকল, এসো রুহান।
রুহান ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তুমি এখন রেটিনা স্ক্যান করে ঘরে কে?
বৃদ্ধ কুরু দুর্বল ভঙ্গিতে হেসে বলল, ক্রিস্টালগুলোর জন্যে তা না হলে আমার ঘরে মূল্যবান কী আছে, বল?
রুহান মাথা ঘুরিয়ে বৃদ্ধ কুরুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার অনেকগুলো এস্টাল?
বলতে পারো। এত ক্রিস্টাল দিয়ে তুমি কী করবে?
বৃদ্ধ কুরু হাসার চেষ্টা করে বলল, জানি না কী করব। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন পুরো পৃথিবীতে নেটওয়ার্ক ছিল। পৃথিবীর যে কোনো মানুষ যে কোনো জায়গা থেকে তথ্য আনতে পারত। এখন তো আর পারে না। তাই ক্রিস্টালগুলো জোগাড় করেছিলাম—যতটুকু সম্ভব তথ্য জমা করে রাখার জন্যে এত তথ্য তো আমি সারাজীবনে দেখতে পারব না, তবু এক ধরনের সখ।
তোমার কাছে কীসের কীসের ক্রিস্টাল আছে কুরু?
বৃদ্ধ কুরু একটু হেসে বলল, কীসের নেই! ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাস থেকে শুরু করে নীল তিমি, পরমাণু থেকে গ্যালাক্সী, প্রেতচর্চা থেকে বিজ্ঞান সবকিছু আছে।
পৃথিবীর সব ক্রিস্টাল কী কারো কাছে আছে?
উঁহু। সেটি সম্ভব না। জ্ঞান তো থেমে থাকে না। নতুন জ্ঞানের জন্ম হলেই নতুন ক্রিস্টালে সেটা রাখা হয়। তাই একজনের কাছে কখনোই সব ক্রিস্টাল থাকতে পারে না।
রুহান বৃদ্ধ কুরুর ঘরের একটা পুরানো চেয়ার টেনে সেখানে বসে বলল, কুরু, তোমার কী মনে হয় এখনো পৃথিবীতে নতুন জ্ঞানের জন্ম হচ্ছে? নতুন ক্রিস্টালে সেটা লেখা হচ্ছে?
বৃদ্ধ কুরু কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি জানি না রুহান। যদি সত্যি সত্যি সেটা বন্ধ হয়ে থাকে, তাহলে বুঝবে পৃথিবীতে সভ্যতা বলে আর কিছু নেই।
রুহান আর বৃদ্ধ কুরু কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, বাইরে পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যেতে থাকে, সন্ধ্যেবেলা মানুষের মতো সব পশুপাখিও মনে হয় ঘরে ফিরে আসে। রুহান উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ কুরুর দিকে তাকিয়ে বলল, কুরু, আমার মাঝে মাঝে মাথার মধ্যে খুব ভয়ানক একটা চিন্তা আসে।
বৃদ্ধ কুরু জিজ্ঞেস করল, কী চিন্তা?
আমাদের যে ক্রিস্টাল রিডারগুলো আছে, সেগুলো যদি এক সময় নষ্ট হয়ে যায় তখন কী হবে?
নষ্ট হয়ে যায়?
হ্যাঁ।
কিন্তু বৃদ্ধ কুরু ঠিক বুঝতে পারল না, ইতস্তত করে বলল, নষ্ট হয়ে যায় মানে কী?
এখন যদি আমি আমার কথা জমা করতে চাই, ক্রিস্টাল রিডারে সেটা জমা থাকে। শুনতে চাই ক্রিস্টাল রিডারে শুনতে পাই। কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে ক্রিস্টাল রিডারে খোঁজ করি। সবকিছু আমরা করি ক্রিস্টাল রিডার দিয়ে—
হ্যাঁ। বৃদ্ধ কুরু এখনো ঠিক বুঝতে পারছে না, ভুরু কুঁচকে বলল, ক্রিস্টাল রিডার দিয়েই তো করব।
রুহান বলল, কিন্তু ক্রিস্টাল রিডার তো একটা যন্ত্র। একটা যন্ত্র তো নষ্ট হতেই পারে। পারে না?
কিন্তু এটা তো সেরকম যন্ত্র না। এর মাঝে কিছু নড়ছে না, কিছু ঘুরছে না। ক্রিস্টালের অণুগুলোর মাঝে তথ্য সাজানো হয় সেখান থেকে তথ্য বের হয়ে আসে।
রুহান একটু উত্তেজিত গলায় বলল, কিন্তু তারপরেও সেটা তো নষ্ট হতে পারে। আমাদের গুরুনের ক্রিস্টাল রিডার নষ্ট হয়ে গেছে না?
বৃদ্ধ কুরু হেসে বলল, গুরুনের কথা ছেড়ে দাও। সে নিদানি পাতার নির্যাস খেয়ে নেশা করে তার ক্রিস্টাল রিডারটা ফায়ার প্লেসের আগুনে ফেলে দিয়েছে। সেটা নষ্ট হবে না তো কী হবে?
তা যাই হোক, কিন্তু তার ক্রিস্টাল রিডার তো নষ্ট হয়েছে। এখন সে পাগলের মতো একটা খুঁজছে-খুঁজে পাচ্ছে না। আমি শুনেছি পৃথিবীতে আর ক্রিস্টাল রিডার তৈরি হয় না।
বৃদ্ধ করু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি পৃথিবীর নেটওয়ার্ক ধ্বংস হবার পর আর ক্রিস্টাল রিডার তৈরি হয় না। শেষ ক্রিস্টাল রিডার তৈরি হয়েছে পঞ্চাশ বছর আগে।
রুহান বৃদ্ধ কুরুর সামনে একটা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলল, তাহলে? তাহলে হলে তুমি বল, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে কী হবে? যখন কারো কাছে ক্রিস্টাল রিডার থাকবে না, তখন কী হবে? ছোট বাচ্চারা স্কুলে গিয়ে নতুন কিছু কেমন করে শিখবে?
বৃদ্ধ কুরু বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর মাথা নেড়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি এভাবে চিন্তা করি নি। আমরা আমাদের সব তথ্য, সব জ্ঞানের বিনিময়, সব কিছু করি ক্রিস্টাল রিডার দিয়ে যদি আমাদের ক্রিস্টাল রিডার না থাকে তখন কী হবে আমি জানি না–
রুহান উত্তেজিত গলায় বলল, কিন্তু সবসময় তো ক্রিস্টাল রিডার ছিল না তখন মানুষ কী করত?
একসময় কম্পিউটার নামে একটা যন্ত্রে কথা বলত। তার আগে হাত দিয়ে কিছু সুইচে করে তথ্য পাঠাত, তার আগে ছিল কাগজ আর কলম। পাতলা এক ধরনের সেলুলয়েড আর কালি বের হবার এক ধরনের টিউব। তার আগে ছিল গাছের পাতা–তার আগে মাটির আস্তরণ–
রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। গাছের পাতা, মাটির আস্তরণ আর কাগজে কেমন করে তথ্য সংরক্ষণ করত। এগুলো তো যন্ত্র নয়, এর পরমাণু তো সংঘবদ্ধভাবে সাজানো থাকে না!
না না না। বৃদ্ধ কুরু মাথা নেড়ে বলল, তখন অন্য একটা ব্যাপার ছিল। সব ভাষার তখন লিখিত রূপ ছিল। অক্ষর ছিল, বর্ণ ছিল সেগুলো দিয়ে মানুষ তাদের কথাকে লিখে রাখত।
লিখে রাখত?
হ্যাঁ! এখন আমরা কিছু বললেই সেটা যেরকম সংরক্ষিত হয়ে যায় আগে সেটা ছিল না। আগে কিছু সংরক্ষণ করতে হলে সেটা বিশেষ বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করে লিখতে হতো। সেই চিহ্নগুলো মানুষ মনে রাখত, সেটা দেখে তারা বলতে পারত কী লেখা আছে। সব শিশুকেই তার জীবনের শুরুতে লেখা আর পড়া ব্যাপারটা শিখতে হতো। সেটা শেখার পর তারা জ্ঞান অর্জন শুরু করতে পারত।
কী আশ্চর্য! রুহান অবাক হয়ে বলল, কী জটিল একটা প্রক্রিয়া।
হ্যাঁ। এখন ক্রিস্টাল রিডারে চাপ দিলেই কথা! ছবি ও ভিডিও বের হয়ে আসে। আগে সেটা ছিল না। আগে যে চিহ্নগুলো দেখে মানুষ পড়তো, সেই চিহ্নগুলোর নাম ছিল বর্ণমালা বা এলফাবেট।
কী আশ্চর্য! রুহান মাথা নেড়ে বলল, তুমি এত কিছু কেমন করে জান?
বৃদ্ধ কুরু হেসে বলল, আমি বুড়ো মানুষ। আমার তো কোনো কাজকর্ম নেই, আমি তাই বসে বসে আমার ক্রিস্টালগুলো দেখি! প্রাচীন কালে মানুষ কী করত তা আমার জানতে বড় ভালো লাগে।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমারও এগুলো খুব জানার ইচ্ছে করে। এক সময় এসে তোমার ক্রিস্টালগুলো দেখে যাব
এসব জানার অনেক সময় পাবে রুহান। এখন গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এসব শেখ। চিকিৎসা বিজ্ঞান শেখ-যখন আমার মতো বুড়ো হবে তখন অন্য বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে পারবে।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি বুড়ো হতে হতে যদি সব ক্রিস্টাল রিডার নষ্ট হয়ে যায়, তখন?
বৃদ্ধ কুরু হাত দিয়ে নিজের বুক স্পর্শ করে বলল, দোহাই তোমার! এন্ড্রোমিডার দোহাই, এরকম ভয়ঙ্কর কথা বলো না। আমার ক্রিস্টাল রিডার নষ্ট হবার আগে যেন আমার মৃত্যু ঘটে।
তোমার মৃত্যু হলে তুমি বেঁচে যাবে। কিন্তু আমাদের কী হবে?
বৃদ্ধ কুরু মাথা নেড়ে বলল, এই মন খারাপ আলোচনা থাকুক রুহান। তার চাইতে বলো তুমি কী খাবে? আমার কাছে খুব ভালো স্নায়ু উত্তেজক একটা পানীয় আছে।
রুহান হেসে বলল, আমার স্নায়ু এমনিতেই অনেক উত্তেজিত। স্নায়ু শীতল করার কোনো পানীয় থাকলে আমাকে দাও।
বৃদ্ধ কুরু রান্নাঘরের শীতল কক্ষ থেকে একটা পানীয়ের বোতল বের করে দুটি স্বচ্ছ গ্লাসে সেটা ঢালতে ঢালতে বলল, স্নায়ুকে শীতল করে লাভ নেই। জোয়ান বয়সের ছেলে-মেয়ের স্নায়ু বুড়োদের মতো শীতল হবে কেন? তোমাদের স্নায়ুতে সবসময়েই থাকবে উত্তেজনা। একেবারে টান টান উত্তেজনা!
রুহান তার গ্লাসটি হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিতেই সারা শরীরে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বুকের ভেতর চেপে থাকা দুর্ভাবনাগুলো কেটে মাথার ভেতরে ফুরফুরে এক ধরনের আনন্দ এসে ভর করে। সে জিব দিয়ে একটা শব্দ করে বলল, চমক্কার পানীয় কুরু।
হ্যাঁ। খুব চমৎকার! এই পানীয় এমনি এমনি খেতে হয় না। চমক্কার একটা সঙ্গীত শুনতে শুনতে এটি খেতে হয়। প্রাচীন একটা সঙ্গীত।
রুহান সোজা হয়ে বসে বলল, শোনাবে কুরু?
কেন শোনাব না? তুমি হাট্টা কাট্টা জোয়ান একটা মানুষ, এই বুড়ো মানুষের ঘরে এসেছ, বুড়ো মানুষের প্রাচীন একটা সঙ্গীত তোমাকে তো শুনতেই হবে।
বৃদ্ধ কুরু উঠে গিয়ে শেলফে রাখা ক্রিস্টাল রিডারের কাছে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় একটা নির্দেশ দিতেই ঘরের ভেতরে হালকা নীল আলোর একটা বিচ্ছুরণ হলো এবং পর মুহূর্তে ঘরের কোণায় ত্রিমাত্রিক একটা কিশোরী মেয়েকে দেখা গেল। হলোগ্রাফিতে মেয়েটিকে একটি জীবন্ত রূপ দেয়া হয়েছে, সেই রূপটি এত নিখুঁত যে দেখে মনে হয় মেয়েটিকে বুঝি স্পর্শ করা যাবে। কিশোরী মেয়েটি এদিক সেদিক তাকিয়ে বৃদ্ধ কুরুর দিকে তাকিয়ে তার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলে, শরতের এই সন্ধ্যেবেলায় তুমি কেমন আছ কুরু?
মেয়েটি সত্যি নয়, এটি শুধুমাত্র একটি হলোগ্রাফিক ছবি, কিন্তু সেটি এত জীবন্ত যে তার সাথে সত্যিকারের মানুষের মতো কথা না বলে উপায় নেই। বৃদ্ধ কুরু তাই নরম গলায় বলল, আমি ভালোই আছি মেয়ে। আমাকে একটা প্রাচীন গান শোনাতে পারবে?
প্রাচীন? কত প্রাচীন?
এবারে রুহান উত্তর দিল। বলল, প্রাচীন। অনেক প্রাচীন। মানুষ যখন যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু করে নি, একে অন্যকে মারা শুরু করে নি সেই সময়কার গান।
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, সেরকম গান তো একটি দুটি নয়, অসংখ্য। তোমাকে আরো নির্দিষ্ট করে বলতে হবে।
রুহান বলল, ঠিক আছে, বলছি। সেই গানে নদী আর নদীর ঢেউয়ের কথা থাকতে হবে। আকাশ ভরা কালো মেঘের কথা থাকতে হবে। একটা মেয়ে আর একটা ছেলের ভালোবাসার কথা থাকতে হবে। বিরহের কথা থাকতে হবে-
আরো কিছু?
হ্যাঁ। যে গান শুনে বুকের ভেতর হাহাকার করতে থাকবে সেরকম একটা গান।
মেয়েটি মিষ্টি গলায় বলল, চমৎকার! প্রাচীন সঙ্গীত-কলার সবুজ ক্রিস্টালটা ঢোকাতে হবে।
কুরু শেলফের ডালা খুলে প্রাচীন সঙ্গীত-কলার সবুজ ক্রিস্টালটা ক্রিস্টাল রিডারে ঢুকিয়ে দিল। কয়েক মুহূর্ত পরে হলোগ্রাফের কিশোরী মেয়েটি আবছা হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে আর প্রায় সাথে সাথে সারা ঘরে বিষণ্ণ একটা সুর বেজে ওঠে। বহুদূর থেকে কোনো একজন একাকী নারীর করুণ কণ্ঠ শোনা যায়। সেই কণ্ঠে একই সাথে ভালোবাসা এবং বেদনা। আনন্দ এবং যন্ত্রণা। রুহান তার হাতের পানীয়ের গ্লাসটি হাতে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল।
রুহান যখন বৃদ্ধ কুরুর বাসা থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলো তখন বেশ রাত। আকাশে একটা ভাঙ্গা চাঁদ, চারিদিকে তার নরম জ্যোৎস্নার আলো। ঝিঁঝিপোকা ডাকছে এবং মাঝে মাঝে দূর বনাঞ্চল থেকে রাত জাগা পশুর ডাক শোনা যাচ্ছে। রুহান হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করে শরতের শুরুতেই বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। জ্যাকেটের কলার একটু উপরে তুলে সে হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। একটু আগে শুনে আসা প্রাচীন সঙ্গীতের রেশটুকু এখনো তার মাথার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। কী অপূর্ব আর মায়াময় সেই কণ্ঠস্বর, এখনো সেটি যেন তার বুকের ভেতর হাহাকারের মতো শূন্যতা তৈরি করে যাচ্ছে।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে রুহান হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, কাছাকাছি কোনো একটি বাসা থেকে একজন মানুষের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর আর একটি মেয়ের কান্নার শব্দ। ভেসে আসছে। রুহান শব্দ অনুসরণ করে এগিয়ে যায়, ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর আর কান্নার শব্দটি আসছে কিসিমার বাসা থেকে। তাদের এলাকার সবচেয়ে সাদাসিধে। সবচেয়ে শান্তশিষ্ঠ আর সবচেয়ে নিরীহ পরিরার হচ্ছে কিসিমাদের পরিরার। গাছপালায় ঢাকা তার ছোট বাসার সামনে কিছু মানুষের জটলা, রুহান-গেট খুলে ভিতরে ঢুকে গ্রাউসকে দেখতে পায়। গ্রাউসের সামনে কিসিমা এবং তাকে। শক্ত করে ধরে রেখেছে কিসিমার মেয়ে ত্রায়িনা। ত্রায়িনার চোখে মুখে আতঙ্ক, সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
গ্রাউসের বয়স রুহান থেকে খুব বেশি নয় কিন্তু তাকে অনেক বেশি বয়স্ক দেখায়। সে লম্বা এবং চওড়া, তার পেশীবহুল শক্ত দেহ, সোনালি চুল এবং নীল চোখ। গাউস সুদর্শন কিন্তু কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে তাকে দেখলে তার সুদর্শন চেহারাটুকু চোখে না পড়ে নিষ্ঠুর ভঙ্গিটুকু প্রথমে চোখে পড়ে।
রুহানকে ঢুকতে দেখে গ্রাউস ক্রুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখানে কী করতে এসেছ?
আমি এদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তোমাদের কথা শুনে এসেছি।
আমাদের কথা শুনে তোমার আসার কোনো প্রয়োজন নেই। গ্রাউস চোখ লাল করে বলল, তুমি যেখানে যাচ্ছিলে সেখানে যাও।
গ্রাউসের কথা শুনে রুহান একই সাথে এক ধরনের ক্রোধ এবং অপমান অনুভব করে। সে শীতল গলায় বলল, এটি কিসিমাদের বাসা। আমি এখানে থাকব না চলে যাব সেটি বলবে কিসিমা–তুমি নয়।
গ্রাউস হিংস্র পশুর মতো একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার বেশি সাহস হয়েছে, তাই না?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, না। আমার মোটেও সাহস বেশি হয় নি। তারপর মাথা ঘুরিয়ে কিসিমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে কিসিমা? এয়িনা কাঁদছে কেন?
কিসিমার মুখে এক ধরনের হতচকিত ভাব, দেখে মনে হয় একটা কিছু বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, গ্রাউস বলছে তার ত্রায়িনাকে দরকার।
রুহান চমকে উঠে গ্রাউসের মুখের দিকে তাকাল। গ্রাউসের মুখটি হঠাৎ আরো কঠোর হয়ে যায়। গলা উঁচিয়ে বলল, বলেছিই তো। বলেছি তো কী হয়েছে?
রুহান তীক্ষ্ণ চোখে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা তুমি কী বলছ। গ্রাউস?
গ্রাউস হঠাৎ হাত দিয়ে রুহানের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, তুমি কোথাকার মাস্তান, আমাকে উপদেশ দিতে এসেছ?।
রুহান পড়ে যেতে যেতে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে গ্রাউসের দিকে তাকাল। গ্রাউস হিংস্র মুখে বলল, রুহান, তুমি আমার সাথে লাগতে এসো না। তোমাকে আমি শেষ করে দেব।
রুহান তীক্ষ্ণ চোখে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে বলল, কাউকে শেষ করে দেয়া এত সহজ নয় গ্রাউস।
গ্রাউস হিংস্র মুখে বলল, তুমি দেখতে চাও?
না, আমি দেখতে চাই না। কিন্তু আমাদের গ্রামটি এখনো জঙ্গল হয়ে ওঠে নি যে যার যেটা ইচ্ছা সে সেটা করতে পারবে।
গ্রাউস এবারে শব্দ করে হেসে উঠে বলল, রুহান, তাহলে নতুন জীবনের জন্যে প্রস্তুত হও। তোমার প্রিয় গ্রামটাতে এখন নতুন পৃথিবীর নিয়ম আসতে যাচ্ছে।
তুমি কী বলতে চাইছ?
আমি বলতে চাইছি আমার যেটা ইচ্ছা আমি সেটা করব।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, না। আমরা সবাই মিলে কিছু নিয়ম ঠিক করেছি
রুহানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে গ্রাউস বলল, ঐ সব মান্ধাতা আমলের নিয়মের দিন শেষ। নতুন পৃথিবীতে এখন নতুন নিয়ম।
সেই নিয়মটা কী?
যার ক্ষমতা আছে তার ইচ্ছাটাই হচ্ছে নিয়ম।
রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে গ্রাউসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি সত্যি কেউ এরকম একটি কথা বলতে পারে সে নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করত না। খানিকক্ষণ নিঃশব্দে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার ক্ষমতা আছে?
আছে।
তোমার ইচ্ছাটি তাহলে নিয়ম?
হ্যাঁ।
রুহান একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, এখন তোমার ইচ্ছে কিসিমার ছোট মেয়ে ত্রায়িনাকে তুলে নিয়ে যাবে?
গ্রাউস মুখে একটা অশালীন ভঙ্গি করে বলল, সে মোটেই ছোট মেয়ে নয়। সে যথেষ্ট বড় হয়েছে।
বেশ। রুহান হঠাৎ করে নিজের ভেতরে এক ধরনের অদম্য ক্রোধ অনুভব করে। সে দাতে দাঁত ঘষে বলল, দেখি তাহলে তুমি কেমন করে ত্রায়িনাকে তুলে নিয়ে যাও। রুহান দুই পা এগিয়ে কিসিমা আর ত্রায়িনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, এসো।
গ্রাউস কয়েক মুহূর্ত স্থির চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, কাজটা ভালো করলে না রুহান।
রুহান কোনো কথা না বলে স্থির চোখে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রাউস হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে চলে যেতে শুরু করে, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ঘুরে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, এর জন্য তোমাকে মূল্য দিতে হবে রুহান।
রুহান নিচু গলায় বলল, দেব।
অনেক মূল্য।
দেব।
গ্রাউস চলে যাবার পর রুহান মাথা ঘুরিয়ে কিসিমা আর তার মেয়ে ত্রায়িনার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা ভেতরে যাও, অনেক রাত হয়েছে।
কিসিমা ভাঙ্গা গলায় বলল, তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব রুহান-
এখানে ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই।
ত্রায়িনা ফেঁপাতে ফোঁপাতে বলল, যদি আবার আসে?
আসবে না। তোমরা ভালো করে দরজা বন্ধ করে রেখ। আমি ভোরবেলা সবার সাথে কথা বলব। ভয় পাবার কিছু নেই।
ত্রায়িনা বড় বড় চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ। সত্যি–কথা বলবে গিয়ে রুহানের গলা কেঁপে উঠল, কারণ সে জানে কথাটি আসলে সত্যি নয়। নতুন পৃথিবীতে সবকিছু পাল্টে গেছে, এখন কোথাও কোনো নিয়ম নেই। এখানে যার শক্তি বেশি, যার ক্ষমতা বেশি তার ইচ্ছেটাই হচ্ছে নিয়ম। ঠিক গ্রাউস যেভাবে বলেছে।
খাবার টেবিলে মা বলল, রুহান এত রাত করে ফিরেছিস! দিন কাল ভালো না জানিস না?
রুহান প্লেটের শুকনো রুটিটা পাতলা স্যুপে ভিজিয়ে নরম করে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, কেন মা? দিন কাল নতুন করে আবার খারাপ হলো কেন?
দেখছিস না কী হচ্ছে? যার যা খুশি সেটা করা শুরু করেছে।
মা কী নিয়ে কথা বলছে রুহান সেটা ভালো করে জানে। পৃথিবীর এক এলাকার সাথে এখন অন্য এলাকার কোনো যোগাযোগ নেই, প্রত্যেকটা এলাকা। এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো কোনোভাবে টিকে আছে। কোথাও কোথাও পরিবেশ একেবারে নারকীয় কোথাও কোথাও সবাই মিলে এখনো মোটামুটি শান্তিতে বেঁচে আছে।
রুহানদের এলাকাটা এতদিন বেশ ভালোই ছিল, বেঁচে থাকার জন্য কিছু নিয়ম তৈরি করে সবাই দিন কাটাচ্ছে, কিন্তু সেটা আর থাকবে বলে মনে হয় না। একটু আগে সে নিজেই কিসিমার বাসায় গ্রাউসের কাজকর্ম দেখে এসেছে। তবুও সে কিছু না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করল, নতুন কিছু হয়েছে নাকি?
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললে বলল, হয়নি আবার। প্রত্যেকদিনই কিছু একটা হচ্ছে। এই তো সেদিন কয়জন এসে তিয়াশার বাসার একটা সোলার প্যানেল খুলে নিয়ে গেছে।
রুহান এটার কথাও জানে, তারপরেও না জানার ভান করে বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ। মা গলা নামিয়ে বলল, কিসিমার মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাবে বলে গ্রাউস কয়দিন থেকে হুমকি দিচ্ছে শুনেছিস?
রুহান একটু আগেই সেটা নিজের চোখে দেখে এসেছে, শেষ মুহূর্তে গ্রাউস পিছিয়ে না গেলে কিছু একটা হয়ে যেতে পারত কিন্তু মাকে সেটা বলার ইচ্ছে। করল না।
মা আড় চোখে তারা ছোট দুটি মেয়ে নুবা আর ত্রিনার দিকে তাকাল। তারপর ফিস ফিস করে বলল, এই দুজন যখন বড় হবে তখন যে কী হবে!
রুহান তার ছোট দুই বোনের দিকে তাকাল। সে তার মায়ের সাথে কী নিয়ে কথা বলছে সেটা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। এই মুহূর্তে ক্রিস্টাল রিডারে নতুন একটা ক্রিস্টাল ঢুকিয়ে বিচিত্র একটা সঙ্গীতের মর্মোদ্ধার করার চেষ্টা করছে। এই বয়সের ছেলে-মেয়ের নিজেদের একটা জগত আছে, তার বাইরে যারা থাকে তারা সেই জগতটার কিছুই বুঝতে পারে না।
মা নুবা আর ত্রিনার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হলো? তোরা খাবার টেবিলে বসে কী শুরু করেছিস? খাচ্ছিস না কেন?
নুবা ঠোঁট উল্টে বলল, তোমার এই শুকনো রুটি আর জ্যালজেলে স্যুপ দুই মিনিট পরে খেলে কিছু ক্ষতি হবে না।
মা একটু আহত গলায় বলল, এটাই যে পাচ্ছিস তার জন্যেই খুশি থাক। সামনে কী দিন আসছে কে জানে?
ক্রিস্টাল রিডার থেকে একটা বিদঘুটে শব্দ বের হয়ে এলো। সাথে সাথে দুই বোন হেসে কুটি কুটি হয়ে যায়। মা ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল, কী হচ্ছে? এই বিদঘুটে শব্দের মাঝে তোরা হাসির কী পেলি?
ত্রিনা মুখ গম্ভীর করে বলল, তুমি বিদঘুটে কী বলছ মা? এটা নতুন ধরনের সঙ্গীত। এটা যে তৈরি করেছে তার চেহারা দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। সবুজ রঙের চুল, গোলাপি-
ব্যস! অনেক হয়েছে। মা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, যে মানুষের চুল সবুজ, তাকে নিয়ে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না।
নুবা বলল, কী বলছ মা? ক্রোমোজমের একটা জিনকে পাল্টে দিলেই চুল সবুজ হয়ে যায়। আমার যদি একটা ছোট জিনেটিক ল্যাব থাকত-
থাক। এমনিতেই পারি না, এখন আবার জিনেটিক ল্যাব।
নুবা তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, রুহান, একটা জিনেটিক ল্যাব তৈরি করতে কত ইউনিট লাগবে?
রুহান লাল রঙের পানীয়টা এক ঢোক খেয়ে বলল, সেটা তো জানি না! এখন তো আর ইউনিটেরও কোনো মূল্য নেই। পৃথিবীতে যখন নেটওয়ার্ক ছিল তখন সবকিছু করা যেত। এখন তো কিছু করারও উপায় নেই।
ত্রিনা মাথা নেড়ে বলল, পৃথিবীটা কেন এরকম হয়ে গেলা রুহান?
রুহান একটু মাথা নেড়ে বলল, সেটাই যদি জানতাম তাহলে তো কাজই হতো!
ত্রিনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে, বার বছরের ছোট কচি একটা মুখের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান একটা বিষণ্ণতা সেখানে এসে ভর করে। বলে, সবাই মিলে
পৃথিবীকে কেন আগের মতো করে ফেলে না?
এই প্রশ্নটির উত্তর রুহানের জানা নেই। সে নিঃশব্দে খাবার টেবিলে বসে রইল।
০২. ঘুম থেকে উঠে
ঘুম থেকে উঠে কী হচ্ছে বুঝতে রুহানের একটু সময় লাগল। লাথি দিয়ে দরজা খুলে তার ঘরে কয়েকজন ঢুকে গেছে। কিছু বোঝার আগেই একজন রুহানকে টেনে বিছানা থেকে তুলে নেয়, তারপর ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। আবছা আলোয় মানুষগুলোর চেহারা স্পষ্ট দেখা যায় না, শুধু নিষ্ঠুরতার ছাপটুকু বোঝা যায়। তারা আলগোছে লেজার গাইডেড স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো ধরে রেখেছে, বুকের উপর গুলির বেল্ট, মাথায় রঙিন রুমাল বাঁধা। পিঠে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঠেকিয়ে যে মানুষটি রুহানকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে সে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
মানুষটি রুহানকে ধাক্কা দিয়ে একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করে বলল, এত খবরে তোমার দরকার কী?
রুহান হলঘরে এসে দেখল তার মা নুবা আর ত্রিনাকে দুইহাতে শক্ত করে ধরে রেখে ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের চোখে মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্ক, নুবা ত্রিনার মুখে বিস্ময়। রুহানকে ঠেলে নিয়ে আসতে দেখে মা কাতর গলায় জিজ্ঞেস করল, আমার ছেলে কী করেছে? তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
মানুষগুলো তার কথার কোনো উত্তর দিল না। তখন মা ছুটে এসে একজনের হাত ধরে বলল, কী হলো? তোমরা কথা বলছ না কেন? কী করেছে আমার ছেলে?
মানুষটি ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, তোমার ছেলে কিছু করে নাই।
তাহলে তাকে কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছ? এই সময়ে কিছু না করাটাই অপরাধ।
কম বয়সী হালকা পাতলা একটা মানুষ হা হা করে হেসে উঠল, যেন খুব মজার একটা কথা শুনতে পেয়েছে। হাসতে হাসতেই বলল, ঠিকই বলেছ। সারা দুনিয়াতে মারামারি হচ্ছে আর জোয়ান একটা ছেলে কিছু না করে ঘরে বসে থাকবে মানে?
মা পিছু পিছু এসে বলল, কিন্তু আমার ছেলে তো কখনো মারামারি করে নি। কখনো কোনো অন্যায় করেনি–
হালকা পাতলা মানুষটা বলল, আমরাই কী আগে করেছি নাকি? শিখে নিয়েছি। তোমার ছেলেও শিখে নেবে। যুদ্ধ করার জন্যে যৌবন কাল হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সময়।
মা মানুষটার হাত ধরে বলল, দোহাই লাগে তোমাদের। আমার ছেলেকে তোমরা ছেড়ে দাও। তোমাদের পায়ে পড়ি–
মানুষটি ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার মাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ধাক্কা সামলাতে গিয়ে মা পড়ে যেতে যেতে কোনোভাবে দেওয়াল ধরে। নিজেকে সামলে নেয়। নুবা আর ত্রিনা ভয় পেয়ে ছুটে এসে তাদের মাকে দুই পাশ থেকে জাপটে ধরে ভয় পেয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
রুহান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তাকে ধাক্কা মেরে বাসার বাইরে নিয়ে এলো। রাস্তায় বড় বড় কয়েকটা লরি হেডলাইট জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লরির ইঞ্জিনগুলো ঘরঘর শব্দ করছে। গ্রামের চারপাশে ভয়ঙ্কর ধরনের কিছু মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হেডলাইটের তীব্র আলোতে এই মানুষগুলোকে কেমন যেন অস্বাভাবিক হিংস্র দেখায়। রুহান দেখতে পেল গ্রামে তার বয়সী যত যুবক সবাইকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে, ভীত মুখে তারা দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগই ঘুমের পোশাকে, চুল উষ্কখুষ্ক, চোখে মুখে হতচকিত বিভ্রান্তির ছাপ স্পষ্ট। রুহান গ্রউসকেও দেখতে পেল, তাকেও একজন ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে আসছে।
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ আলগোছে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে রেখে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। তার মাথায় একটা রঙিন রুমাল বাঁধা, পরনে জলপাই রঙের সামরিক পোশাক। বুকের উপর গুলির বেল্ট এবং কোমর থেকে। যোগাযোগ মডিউল ঝুলছে। তার হাতে একটা জ্বলন্ত মশাল, সেটি হাতে নিয়ে
সে চিৎকার করে বলল, সবাই এক লাইনে দাঁড়াও।
ঠিক কীভাবে সবাই হঠাৎ করে এক লাইনে দাঁড়াবে, লাইনটি কী সামনে পিছনে হবে না পাশাপাশি হবে সেটা নিয়ে সবার ভেতরে এক ধরনের হুঁটোপুটি শুরু হয়ে যায়। মধ্যবয়স্ক মানুষটা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনের মুখে আঘাত মেরে চিৎকার করে বলল, ইঁদুরের বাচ্চার মতো ছুটাছুটি করছ কেন? পাশাপাশি দাঁড়াও সব নর্দমার পোকা।
রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে, সে অপমান কিংবা ক্রোধ অনুভব করে না, তার ভেতরে ভয় বা আতঙ্কও নেই। সত্যি কথা বলতে কী হঠাৎ করে তার বিস্মিত হবার ক্ষমতাটুকুও চলে গেছে। সে একটা অবিশ্বাস্য ঘোরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে, তার চারপাশে কী ঘটছে সে যেন ঠিক বুঝতেও পারে না। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এবং দেখল তার দুপাশে সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
নিষ্ঠুর চেহারার মধ্যবয়স্ক মানুষটি মশালের আলোতে খুব কাছে থেকে তাদের একজন একজন করে পরীক্ষা করল। যাদেরকে দুর্বল বা রুগ্ন মনে হলো। তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, যাও, নোংরা আবর্জনা, ছারপোকার বাচ্চারা–ভাগ এখান থেকে।
রুহানের সামনে মানুষটা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ রক্তাভ এবং শরীর থেকে এক ধরনের কটু গন্ধ বের হয়ে আসছে। রুহানের মনে হলো মানুষটা একটা কিছু বলবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু না বলে হেঁটে সামনে এগিয়ে গেল।
সবাইকে এক নজর দেখে মানুষটা আবার সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, হতভাগা জানোয়ারের বাচ্চারা, তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত, বিষ্ঠার সাগরে তোমাদের ড়ুবে মরা উচিত। ছারপোকার বাচ্চাদের মতো তোমাদের টিপে টিপে মারা উচিত। একেকজন এরকম দামড়া জোয়ান হয়ে তোমরা ঘরে বসে আছ, তোমাদের লজ্জা করে না?
মানুষটি সবার দিকে তাকাল, কেউ কোনো উত্তর দিল না।
কথা বলছ না কেন, আহাম্মকের বাচ্চারা?
এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না। মধ্যবয়স্ক মানুষটা মাটিতে থুতু ফেলে বলল, এই জঙ্গলের মাঝে থাক, দুনিয়ার কোনো খোঁজ খবর রাখ না। তোমরা কী জান সারা পৃথিবীতে এখন কী হচ্ছে? মানুষটা সবার দিকে একবার মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল, জান না! আমি জানতাম তোমরা জানবে না। সারা দুনিয়ায় এখন যুদ্ধ হচ্ছে। সবার সাথে সবার যুদ্ধ। যার গায়ে জোর আছে, যার শক্তি আছে সে টিকে থাকবে। যার জোর নাই, শক্তি নাই সে ধ্বংস হয়ে যাবে। এখন তোমরা বল, তোমরা কী টিকে থাকতে চাও নাকি ধ্বংস হতে চাও?
কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষটা তখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা বাঁকিয়ে বলল, কেউ কথা বল না কেন?
ভয় পেয়ে কয়েকজন বিড় বিড় করে বলল, টিকে থাকতে চাই।
চমৎকার! মানুষটা তার নোংরা দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করে বলল, আমরা তোমাদের টিকে থাকার একটা সুযোগ করে দেব। এই নতুন পৃথিবীতে নতুন নিয়ম। যার জোর আছে, ক্ষমতা আছে সে যেটা বলবে সেটাই হবে। নিয়ম। যার জোর নাই সে মাথা নিচু করে সেই নিয়ম মানবে। বুঝেছ?
রুহান একটু অবাক হয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকাল। গ্রাউস যে কথাগুলো বলেছিল এই মানুষটি ঠিক সেই কথাটাই বলছে। তাহলে কী নতুন পৃথিবীতে এইটাই নিয়ম? যার ক্ষমতা আছে সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে? পৃথিবীতে ন্যায় অন্যায় বলে কিছু থাকবে না? সত্যি-মিথ্যা বলে কিছু থাকবে না? যার ক্ষমতা আছে সে যত বড় দানবই হোক, তার ইচ্ছেটাই হবে সব?
ঠিক তখন কে যেন কিছু একটা বলল, মধ্যবয়স্ক মানুষটা সেদিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে মাথা উঁচু করে বলল, কে কথা বলে?
রুহান এবারে শুনল গ্রাউস বলছে, আমি। আমি কথা বলছি।
তুমি কী বলতে চাও ছেলে?
গ্রাউস উত্তেজিত গলায় বলল, তুমি যেটা বলছ আমিও সেটা বলি। আমাদের গ্রামে আমি সেটা শুরু করেছি।
তুমি শুরু করেছ?
হ্যাঁ।
কী শুরু করেছ?
এই গ্রামে আমার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি, আমি তাই সবাইকে বলেছি আমার ইচ্ছাটাই নিয়ম। আমি যা খুশি তা করতে পারি।
সত্যি?
হ্যাঁ। তুমি ওদের জিজ্ঞেস করে দেখ–সবাই এখন আমাকে ভয় পায়।
মধ্যবয়স্ক মানুষটার মুখে বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠল। মাথা নেড়ে বলল, তুমি সামনে এসো।
গ্রাউস তখন সামনে এগিয়ে গেল। মধ্যবয়স্ক মানুষটা মশালের আলোতে গ্রাউসকে ভালো করে দেখে তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা আসলেই একে ভয় পাও?
কয়েকজন বিড়বিড় করে অস্পষ্ট গলায় কিছু একটা বলল, তার উত্তর হ্যাঁ কিংবা না দুটোই হতে পারে।
গ্রাউস গলায় একটু উত্তেজনা এনে বলল, আমার সোলার প্যানেলটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি একজনের বাসা থেকে সেটা খুলে এনেছি। কেউ কিছু বলতে সাহস পায়নি। সেদিন কমবয়েসী একটা মেয়েকেও তুলে আনতে গিয়েছিলাম-
চমৎকার! মধ্যবয়স্ক মানুষটার মুখে হাসি আরও বিস্তৃত হয়, পৃথিবীর নতুন নিয়মটা তুমি তোমার গ্রামে চালু করে দিয়েছ, জোর যার ক্ষমতা তার?
গ্রাউসের মুখে বাঁকা একটা হাসি ফুটে ওঠে, সে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে গ্রাউসের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর হঠাৎ করে হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তুলে গ্রাউসের মাথায় ধরে বলল, দেখি তোমার কতটুকু ক্ষমতা।
মুহূর্তে গাউসের মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে বিস্ফারিত চোখে মধ্যবয়স্ক নিষ্ঠুর মানুষটার মুখের দিকে তাকাল। খুব বড় একটা রসিকতা হচ্ছে এরকম একটা ভান করে নিষ্ঠুর চেহারার মধ্যবয়সী মানুষটা ট্রিগার টেনে ধরে। কর্কশ কান ফাটানো একটা শব্দ হলো, রুহান শিউরে উঠে দেখল গ্রাউসের দেহটা একটু লাফিয়ে উঠে নিচে পড়ে যায়। রুহানের মনে হলো সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা আবার আলগোছে ধরে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আর কেউ আছে নাকি?
কেউ কোনো কথা বলল না। মধ্যবয়স্ক মানুষটা বলল, কী শিখলে তোমরা। এই ঘটনা থেকে?
এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষটা সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে বলল, আসলে তোমরা নতুন কিছু শেখ নাই। আমি যেটা বলেছি সেটা শুধু তোমাদের হাতে কলমে দেখালাম, এর বেশি কিছু নয়। আমার হাতে অস্ত্র তাই আমার কাছে ক্ষমতা। আমি যাকে ইচ্ছা খুন করতে পারি। পৃথিবীর কেউ কিছু করতে পারবে না। মধ্যবয়স্ক মানুষটা পা দিয়ে গ্রাউসকে দেখিয়ে বলল, এই আহাম্মকটা দাবি করছিল তার অনেক ক্ষমতা! আসলে তার কোনো ক্ষমতাই ছিল না। খালি হাতে ক্ষমতা হয় না! ক্ষমতার জন্যে দরকার অস্ত্র। বুঝেছ?
দুই-একজন দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল। মানুষটা হাতের মশালটা একটু উপরে তুলে বলল, তোমাদের সবার হাতে আমি অস্ত্র দেব। আমি দেখব তোমাদের কয়জন সেই অস্ত্রের মর্যাদা রাখতে পারে।
রুহান নিঃশব্দে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। তার এখনো বিশ্বাস হতে চায় না যে তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে সত্যিই একজন মানুষ! তার যে কথাগুলো সে শুনছে, সত্যিই একজন মানুষ সেগুলো বলছে।
মানুষটি এবার আস্তে আস্তে হেঁটে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। কাছাকাছি। এসে নিচু গলায় বলল, তোমরা সবাই এখন এই লরিগুলোর পিছনে গিয়ে ওঠ। আমি ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি।
সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একজন ভাঙ্গা গলায় বলল, আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে?
মানুষটি শীতল গলায় বলল, আমি কী তোমাদের বলেছি যে তোমরা আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবে? বলেছি?
কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষটি এবারে হুংকার দিয়ে বলল, সবাই গরিতে ওঠ। যে পিছনে পড়ে থাকবে সে পিছনেই পড়ে থাকবে। অকর্মা বেজন্মা আহম্মকদের এই পৃথিবীতে কোনো জায়গা নেই।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সশস্ত্র মানুষগুলো হঠাৎ করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো তুলে ২৩স্তত গুলি করতে থাকে। প্রচণ্ড গুলির শব্দে তাদের কানে তালা লেগে যায়। তার মাঝে ভয়ে আতঙ্কে অধীর হয়ে সবাই ছোটাছুটি করে লরিতে উঠতে থাকে। পায় সাথে সাথেই লরিগুলোর ইঞ্জিন গর্জন করে পাথুরে পথের উপর দিয়ে ছুটে (ঠতে শুরু করে। হৃদের পাশ দিয়ে যাবার সময় রুহান তাদের ছোট বাসাটা দেখতে পেল। বাসার দরজায় মূর্তির মতো তার মা ছোট বোন দুটিকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া হলো না, রুহান জানে না আর কোনোদিন তাদের সাথে দেখা হবে কি না।
লরির পিছনে পা ঝুলিয়ে চারজন সশস্ত্র মানুষ বসে আছে। একটু আগেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি করে তারা একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করছিল। লরি চলতে শুরু করার সাথে সাথে তারা বেশ সহজ ব্যবহার করতে শুরু করল। একজন বেসুরো গলায় গান গাওয়ার চেষ্টা করে, অন্যেরা সেটা নিয়ে হাসি তামাশা করে।
রুহানের পাশে তাদের গ্রামের সবচেয়ে নিরীহ ছেলে কিলি বসেছিল, অন্ধকারে দেখা যায় না কিন্তু রুহান মোটামুটি নিশ্চিত, সে বসে বসে কাঁদছে। এক সময় ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞেস করল, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে রুহান।
রুহান বলল, আমি জানি না।
তোমার কী মনে হয় রুহান, আমাদের কি মেরে ফেলবে?
কেন? শুধু শুধু মেরে ফেলবে কেন?
গ্রাউসকে যে মেরে ফেলল।
গ্রাউসকে মেরেছে কারণ সে ছিল আহাম্মক। তুমি আর আমি কী আহাম্মক?
কিলি মাথা নেড়ে বলল, না। আমরা আহাম্মক না। কিন্তু—
কিন্তু কী?
আমার খুব ভয় করছে।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যখন ভয় পাবার কথা তখন ভয় পেতে হয়। যারা কখনো ভয় পায় না তারা স্বাভাবিক না।
কিলি বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে লরিগুলো সারি বেঁধে ছুটে চলেছে। চাঁদ ড়ুবে গিয়ে বাইরে অন্ধকার। শরতের শেষ রাতের হিমেল বাতাসে রহান একটু শিউরে উঠল, এভাবে ধরে নিয়ে যাবে জানলে সে নিশ্চয়ই একটা গরম জ্যাকেট পরে আসত।
কিলি আবার গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, রুহান।
বলো।
ওরা আমাদের নিয়ে কী করবে বলে তোমার মনে হয়?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, জানি না।
আমাদের অস্ত্র চালানো শেখাবে, যুদ্ধ করতে শেখাবে এটা কী তোমার সত্যি মনে হয়।
হতেও পারে। পৃথিবীতে এখন খুব খারাপ সময়। সব জায়গায় যুদ্ধ হচ্ছে। পৃথিবীতে যুদ্ধ করার মানুষের খুব অভাব।
কিলি একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার খুব অস্থির লাগছে রুহান।
রুহান কিলির ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ধৈর্য ধরো কিলি, দেখবে এক সময়। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক এরকম সময়ে হঠাৎ করে চারদিক থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। পা ঝুলিয়ে বসে থাকা চারজন অস্ত্র তাক করে উবু হয়ে বসে গেল। একজন চাপা গলায় বলল, সবাই মেঝেতে মাথা নিচু করে শুয়ে থাক। উঠবে না। খবরদার।
রুহান অন্য সবার সাথে মাথা নিচু করে মেঝেতে শুয়ে থাকে। শুনতে পায় তাদের মাথার উপর দিয়ে শিস দেবার মতো শব্দ করে গুলি ছুটে যাচ্ছে। লরিতে বসে থাকা চারজন সশস্ত্র মানুষ ছাড়া ছাড়া ভাবে গুলি করছে, তার শব্দে তাদের কানে তালা লেগে যাবার মতো অবস্থা।
যেভাবে গুলি শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই হঠাৎ করে গুলি থেমে গেল। সশস্ত্র মানুষগুলো আবার পা ঝুলিয়ে বসে হালকা গলায় কথা বলতে শুরু করে। তাদের দেখে মনেই হয় না একটু আগে সবাই এত ভয়ঙ্কর গোলাগুলির ভেতর দিয়ে এসেছে। আর সেই ভয়ঙ্কর গোলাগুলিতে যে কেউ মারা পড়তে পারত।
রুহান একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, শোনো। তোমাদের সাথে আমি একটু কথা বলতে পারি।
একজন মাথা ঘুরিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা শক্ত করে ধরে রেখে বলল, কী কথা?
সাধারণ কথা।
মানুষটি কঠিন গলায় বলল, তোমরা ভেতরে এতজন আছ, নিজেদের ভেতরে কথা বল। আমাদের সাথে কেন কথা বলতে চাইছ?
রুহান বলল, ভেতরে যারা আছে এখন তাদের কারো কথা বলার আগ্রহ নেই।
সে খুব একটা মজার কথা বলেছে সেরকম ভাব করে মানুষটা শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, কেন? কথা বলার আগ্রহ নেই কেন?
তোমাদের যদি কেউ মাঝরাতে ঘর থেকে ধরে নিয়ে যেত তাহলে তোমাদেরও কথা বলার কোনো আগ্রহ থাকত না।
পা ঝুলিয়ে বসে থাকা অন্য একজন বলল, এই! এ তো কথাটা মিথ্যা বলে নাই। মনে আছে আমাদের যেদিন ধরে এনেছিল, তখন আমরা কী ভয় পেয়েছিলাম?
রুহান জিজ্ঞেস করল, তোমাদেরকেও ধরে এনেছিল!
ধরে না আনলে কেউ নিজে থেকে আসবে নাকি?
কেন ধরে এনেছিল?
মানুষটা হাত দিয়ে পুরো বিষয়টা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, দুদিন পরে তো নিজেরাই দেখবে। এখন এত কৌতূহল কেন?
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কৌতূহল খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
মানুষটা মাথা নাড়ল, চলন্ত লরি থেকে পিচিক করে নিচে একটু থুতু ফেলে বলল, ব্যবসা।
রুহান বলল, ব্যবসা?
হ্যাঁ। ব্যবসা।
কিসের ব্যবসা?
মানুষের। তোমাদের ধরে এনেছি বিক্রি করার জন্যে।
বিক্রি করার জন্যে?
হ্যাঁ।
রুহান নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, কার কাছে বিক্রি করবে?
যে ভালো দাম দেবে তার কাছে।
রুহান এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, যারা ভালো দাম দেবে তাদের কাছে বিক্রি করে দেবে?
হ্যাঁ। অনেক বড় বড় পার্টি আছে। এখন সবচেয়ে বড় যে পার্টি তার নাম ক্রিভান।
ক্রিভান?
হ্যাঁ। সে এখন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। রাতকে দিন করতে পারে দিনকে রাত।
তারা আমাদের নিয়ে কী করবে?
যুদ্ধ করার জন্যে অনেক মানুষের দরকার। ভালো যোদ্ধা পাওয়া খুব সোজা কথা না।
পা ঝুলিয়ে বসে থাকা অন্য একজন বলল, সবাইকে তো আর যুদ্ধ করার। জন্যে কেনে না, অন্য কাজেও কেনে।
অন্য কী কাজে কেনে?
যদি কারো ভালো বুদ্ধি-শুদ্ধি থাকে তাহলে তার মগজটা ব্যবহার করা হয়। মাথার মাঝে ফুটো করে ইলেকট্রড ঢুকিয়ে দেয়। বাইরে থেকে ইমপালস পাঠিয়ে হিসেব নিকেশ করে। তাদেরকে বলে সক্রেটিস।
রুহান নিজের অজান্তে কেমন যেন শিউরে উঠল, সশস্ত্র মানুষটি সেটা লক্ষ্য করল না। খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ক্লোন করার মেশিন তো আজকাল আর পাওয়া যায় না। তাই অনেক সময় হৃৎপিণ্ড, কিডনি, ফুসফুস এইগুলোর জন্যেও বিক্রি হয়। ভালো একজোড়া কিডনির অনেক দাম।
প্রথম মানুষটি বলল, সবচেয়ে বেশি দামে কী বিক্রি হয় জান?
কী?
খেলোয়াড়।
রুহান অবাক হয়ে বলল, খেলোয়াড়?
হ্যাঁ। একটা খেলোয়াড় মগজে ইলেকট্রড লাগানো সক্রেটিস থেকেও একশ দুইশ গুন বেশি দামে বিক্রি হয়।
কীসের খেলোয়াড়?
মানুষটি হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা শেষ করে দেবার ভঙ্গি করে বলল, সবকিছু আগেই জেনে ফেললে হবে কেমন করে? সময় হলে জানবে।
দ্বিতীয়জন বলল, এখন তোমরা ঘুমাও। অনেক দূর যেতে হবে।
প্রথমজন বলল, এত দামি কারগো নিচ্ছি রাস্তাঘাটে অনেক হামলা হবে। গোলাগুলি শুরু হলেই তোমরা মেঝেতে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকবে। বুঝেছ?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি।
রুহান তার নিজের জায়গায় ফিরে আসে। পা ছড়িয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মা আর দুই বোন নুবা আর ত্রিনা এখন কী করছে কে জানে। সে কী আর কোনোদিন তাদের কাছে ফিরে যেতে পারবে?
পাহাড়ী একটা পথ দিয়ে গর্জন করে লরিগুলো ছুটে যাচ্ছে। বাইরে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে কত রকম অজানা বিপদ গুড়ি মেরে আছে। রুহান জানে আজ রাতে তার চোখে ঘুম আসবে না।
কিন্তু নিজেকে অবাক করে দিয়ে সে একসময় ঘুমে ঢলে পড়ল।
০৩. ঘরঘর শব্দ করে
ঘরঘর শব্দ করে লরির পিছনের দরজাটা খুলে গেল, চোখে রোদ পড়তেই রুহান ধড়মড় করে জেগে ওঠে। একজন মানুষ তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটাতে। একটা ঝাকুনি দিয়ে চিৎকার করে বলল, নামো সবাই। কোনো সময় নষ্ট করবে না-তাহলে কপালে দুঃখ আছে।
কপালে কী ধরনের দুঃখ থাকতে পারে সেটা নিয়ে কেউ কৌতূহল দেখাল, সবাই হুঁটোপুটি করে নামতে শুরু করল। চারপাশে কংক্রীটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বড় একটা জায়গা, ছাড়া ছাড়াভাবে সেখানে কয়েকটা বড় গাছ, গাছে ধূলায় ধূসর বিবর্ণ পাতা। একটু সামনে কংক্রীটের একটা দালান। মাঝামাঝি একটা বড় লোহার দরজা, এ ছাড়া আর কোনো দরজা-জানলা নেই। এরকম কুৎসিত এবং মনখারাপ করা কোনো দালান রুহান আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না।
স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে মানুষগুলো সবাইকে ঘিরে রেখে এগিয়ে নিয়ে যায়। কুৎসিত দালানের সামনে পৌঁছতেই লোহার ভারী দরজাটা ঘরঘর শব্দ করে খুলে গেল। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু সবাই বুঝে গেল তাদের এখন ভেতরে ঢুকতে হবে। রুহান ভেতরে পা দেবার আগে একবার পিছন ফিরে তাকাল। তার কেন জানি মনে হলো একবার ভেতরে ঢুকে গেলে তার জীবনটা একেবারেই পাল্টে যাবে। সেই জীবন থেকে আর কখনোই সে আর ফিরে আসতে পারবে না।
লম্বা একটা করিডোর ধরে তারা এগিয়ে যায়। মাঝখানে একটা বড় হলঘরের মতো, সেখানে উঁচু ছাদ থেকে হলদে এক ধরনের আলো ঝুলছে। কংক্রীটের ধূসর দেয়াল, পাথরের অমসৃণ মেঝে। হলঘরের মাঝামাঝি কঠোর চেহারার একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা ঝাঁকিয়ে সে বলল, তোমাদের এক ঘণ্টা সময় দেয়া হলো প্রস্তুত হবার জন্যে। এর মাঝে তোমরা তোমাদের নোংরা পোশাক খুলে গরম পানি দিয়ে গোসল করো। টিবিলে গরম স্যুপ, মাংসের স্টু আর রুটি রাখা আছে-ঝটপট কিছু খেয়ে নাও। তারপর একাডেমীর পোশাক পরে বের হয়ে এসো।
কোথায় বের হয়ে আসবে, তারপর কী করবে এ ধরনের খুঁটিনাটি জিনিস জানার একধরনের কৌতূহল হচ্ছিল কিন্তু রুহান কিছু জিজ্ঞেস করার আগ্রহ পেল না। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে কঠোর চেহারার মানুষটা হলঘরের পিছনের দিকে একটা দরজা দেখিয়ে দেয় এবং সাথে সাথে সবাই হুঁটোপুটি করে সেদিকে ছুটে যেতে শুরু করে।
দরজার কাছাকাছি একজন রুহানের কনুই খামচে ধরল। রুহান মাথা ঘুরিয়ে কিলিকে দেখতে পায়। কিলি ফ্যাকাসে মুখে বলল, রুহান।
কী হয়েছে।
এখন আমাদের কী করবে বলে তোমার মনে হয়?
কেমন করে বলি!
আমাদের কী মেরে ফেলবে বলে মনে হয়?
রুহান হেসে বলল, যদি আমাদের মেরেই ফেলবে, তাহলে এত কষ্ট করে ধরে এনেছে কেন?
হয়তো আমাদের কিডনি, ফুসফুস, লিভার এগুলো কেটেকুটে নেবে।
যদি নিতে চায় নেবে, তার জন্যে আগে থেকে দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। সময় হলে দেখা যাবে। এখন যেটা করতে বলেছে সেটা করো। গোসল করো, নতুন পোশাক পরে পেট ভরে খাও।
কিলি মাথা নেড়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ।
রুহান গলা নামিয়ে বলল, এরা খুব খারাপ মানুষ। তাই সাবধান! আগ শাড়িয়ে কিছু করবে না, নিজে থেকে কিছু করবে না। তারা যেটা বলছে শুধু সেটা করবে। সবার আগে থাকবে না, সবার পিছেও থাকবে না। সবসময় মাঝামাঝি থাকবে। ঠিক আছে?
কিলি মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
প্রায় ফুটন্ত গরম পানিতে নগ্ন হয় সারা শরীর রগড়ে রগড়ে রুহান গোসল করল। দেয়ালে আলখাল্লার মতো কালো রঙের এক ধরনের পোশাক ঝুলছিল, সেটা পরে নিয়ে সে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। সবাই বুভুক্ষের মতো খাচ্ছে। বিষয়টি কেমন জানি অস্বস্তিকর, এভাবে কাড়াকাড়ি করে খাওয়ার দৃশ্যে এক ধরনের অমানবিক নিষ্ঠুরতা আছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, চোখ সরিয়ে নিতে হয়। রুহান এগিয়ে একটা ছোট বাটিতে খানিকটা স্টু ঢেলে একপাশে সরে দাঁড়াল। তার খুব খিদে পেয়েছে কিন্তু কেন জানি খেতে ইচ্ছে করছে না, মনে হচ্ছে এই পুরো বিষয়টিতে এক ধরনের লজ্জা ও এক ধরনের অসম্মান রয়েছে। রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে পুরো বিষয়টি নিজের ভেতর থেকে সরিয়ে ফেলতে চেষ্টা করে। অন্যমনস্কভাবে শুকনো রুটি ছিঁড়ে স্টুতে ভিজিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করে। বিস্বাদ খাবার, খুব খিদে পেয়েছে তা না হলে এরকম খাবার খেতে পারত কী না সন্দেহ রয়েছে।
খাবার পর সবাই আবার বড় হলঘরটির মাঝে একত্র হলো। হলঘরের মাঝামাঝি বেশ কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তারা সবাইকে সারি করে দাঁড় করাল। তারপর একজন একজন করে সামনে একটা ছোট ঘরে পাঠাতে শুরু করল।
ভেতরের ঘরগুলোতে কী হচ্ছে বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না। রুহান। অনুমান করতে পারে সেখানে সবাইকে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তাদেরকে ধরে এনেছে বিক্রি করার জন্যে, কার জন্যে কত দাম ধরা হবে সেটা নিশ্চয়ই এখন ঠিক করা হচ্ছে। সেটা কীভাবে ঠিক করা হবে? বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা নেবে? শারীরিক পরীক্ষা নেবে? মানুষকে যখন পণ্য হিসেবে বিক্রি করা হয়, তখন এই পরীক্ষাগুলোর কী কোনো অর্থ আছে? একেবারে সাধারণ একজন মানুষই কী উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় অসাধারণ হয়ে ওঠে না? তাকে যখন পণ্য হিসেবে বেচা-কেনা করা হয় তখন কী তার ভেতরে কোনোভাবে সেই উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা জন্ম নিতে পারে?
প্রথমে কিছুক্ষণ রুহানের ভেতর খানিকটা কৌতূহল ছিল। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় তার কৌতূহলটুকু উবে গেল। শেষ পর্যন্ত তাকে যখন ছোট ঘরটিতে ডেকে নেয়া হলো তখন রুহানের ভেতরে এক ধরনের ক্লান্তি এসে ভর করেছে।
ছোট ঘরটিতে একটা উঁচু বিছানা, তার পাশে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটি তার দিকে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ো।
রুহান কোনো কথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মহিলাটি উপর থেকে কিছু যন্ত্রপাতি নামিয়ে এনে তাকে পরীক্ষা করতে থাকে। ত্বক থেকে টিস্যু নিয়ে জিনেটিক কোডিং করা হলো, রক্ত নিয়ে তার শ্রেণীবিভাগ করা হলো, রক্তচাপ মাপা হলো, শরীরের ঘনত্ব মেপে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিন্যাস নির্ধারণ করা হলো, নিউরনের সংখ্যা সিনাঙ্গের ঘনত্ব পরীক্ষা করা হলো সবশেষে তার হাতের ত্বকে ছ্যাকা দিয়ে বেগুনি রঙের একটা বিদঘুটে চিহ্ন একে দেয়া হলো।
রুহান হাতটা নিজের কাছে টেনে এনে বলল, এটা তুমি কী করলে?
মহিলাটি একটু অবাক হয়ে রুহানের দিকে তাকাল, মনে হলো সে কারো প শুনতে অভ্যস্ত নয়। মহিলাটি প্রশ্নের উত্তর দেবে রুহান সেটা আশা করেনি। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মহিলাটি খসখসে গলায় বলল, এটা তোমার কোড। তোমার ত্বক কেটে পাকাপাকিভাবে লিখে দেয়া হয়েছে, এটা কখনো মুছে যাবে না।
রুহান ক্রুদ্ধ চোখে তার হাতের উপর একে দেয়া বিদঘুটে চিহ্নগুলো পরীক্ষা করতে করতে বলল, আমার কোডটা কী অন্যভাবে দেয়া যেত না?
আমরা এমনভাবে দিই যেন আমাদের কোড রিডার সেটা পড়তে পারে।
তোমাদের কোড রিডার?
হ্যাঁ। তোমার তথ্যগুলো আমাদের তথ্যকেন্দ্রে রাখতে হবে।
তার জন্যে আরো আধুনিক কোনো উপায় ব্যবহার করা যেত না? কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতি, কোনো বায়োজিনেটিক পদ্ধতি
মহিলাটির মুখে প্রথমবার এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, একজন মানুষের চেহারায় যত নিষ্ঠুরতার ছাপই থাকুক না কেন, হাসি সেটা সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু কোনো একটি বিচিত্র কারণে এই মহিলার বেলায় সেটি ঘটল না, তার মুখের হাসিতে তাকে কেমন যেন ভয়ঙ্কর দেখাতে থাকে। মহিলাটি সেই ভয়ঙ্কর মুখে ফিস ফিস করে বলল, ছেলে, তুমি পৃথিবীর কোনো খবর রাখ না?
রুহান একটু অবাক হয়ে বলল, কেন? কী হয়েছে?
পৃথিবীতে এখন ইলেকট্রনিক্স বা বায়োজিনেটিক পদ্ধতি বলে কিছু নেই। পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান নেই। কোনো প্রযুক্তি নেই। পৃথিবী এখন অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছে! যে যত তাড়াতাড়ি এই অন্ধকারে অভ্যস্ত হতে পারবে সে তত বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে। বুঝেছ?
রুহান তার হাতের বিচিত্র চিহ্নগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এই চিহ্নগুলো সেই অন্ধকারের চিহ্ন?
হ্যাঁ। প্রাচীনকালে মানুষ তাদের পশুদের হিসেব রাখার জন্যে লোহার শিক গরম করে কিছু চিহ্ন এঁকে দিত। এখন আমরা সেটা মানুষের জন্যে করি। মহিলাটি স্থির চোখে রুহানের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বুঝেছ?
বুঝেছি।
চমৎকার! এখন পাশের ঘরে যাও।
রুহান পাশের ঘরে যাবার জন্যে উঁচু বিছানা থেকে নেমে এলো। মহিলাটি বের হবার দরজাটি দেখিয়ে বলল, আর শোনো। তোমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগে কথা বলবে না। এটা স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি না, এখানে শেখার কিছু নেই। এটা একটা দোকান ঘর। তোমাদের ধরে এনে তোমাদের দাম ঠিক করা হচ্ছে, তার বেশি কিছু নয়।
রুহান পাশের ঘরে যেতে যেতে থেমে গিয়ে বলল, প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে কী হয়?
সেটা জানার জন্যে আগ্রহ দেখিও না। যাও। বিদায় হও।
রুহান পাশের ঘরে এসে দাঁড়াল। এখানে বসার জন্যে একটা চেয়ার, সামনে নিচু টেবিল। সেখানে বিচিত্র কিছু জিনিস। টেবিলের অন্য পাশে দুটি চেয়ারে দুজন মানুষ বসে আছে, মানুষ দুজনের মুখ ভাবলেশহীন, তারা রুহানের দিকে তাকিয়ে তাকে বসার জন্যে ইঙ্গিত করল।
রুহান বসে টেবিলের উপরে ভালো করে তাকায়, নানা ধরনের জ্যামিতিক নকশা, কিছু কাগজ, কিছু বিচিত্র ছবি তার সাথে ছোটখাটো কিছু যন্ত্রপাতি। মানুষ দুজনের একজন বলল, দেখি তোমার হাতটা দেখাও।
রুহান একটু আগে বিদঘুটে চিহ্ন এঁকে দেয়া হাতটা মানুষটার সামনে এগিয়ে দেয়। চিহ্নগুলোতে কিছু একটা ছিল যেটা দেখে মানুষটা একটু সোজা হয়ে বসে রুহানকে ভালো করে দেখল। সে টেবিল থেকে একটা ছবি তুলে এনে রুহানকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কীসের ছবি?
ছবিটা দেখে মনে হয় সেখানে সাদা এবং কালো রং বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু রুহান একটু ভালো করে দেখেই বুঝতে পারল, আসলে ছবিটি একটি মেয়ের। কালো চুল ছড়িয়ে সবগুলো দাঁত বের করে হাসছে, চট করে সেটা বোঝা যায় না। রুহান বলল, এটা একটা মেয়ের ছবি।
মানুষ দুজন এবার নিজেদের ভেতর দৃষ্টি বিনিময় করল। সম্ভবত খুব বেশি মানুষ বিক্ষিপ্ত সাদা কালো রঙের মাঝে মেয়ের ছবিটি খুঁজে পায় না। দুজন মানুষের ভেতর তুলনামূলকভাবে বয়স্ক মানুষটি গলা পরিষ্কার করে বলল, আমি তোমাকে কয়েকটা সংখ্যা বলব। সেগুলো শুনে তুমি তার পরের সংখ্যাটি বলবে।
রুহান তার গলায় ঝোলানো ক্রিস্টাল রিডারটি হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলল, ঠিক আছে।
তার আগে তোমার ক্রিস্টাল রিডার বন্ধ করে নাও।
রুহান অবাক হয়ে বলল, ক্রিস্টাল রিডার বন্ধ করে নেব?
হ্যাঁ।
তাহলে সংখ্যাগুলো মনে রাখব কেমন করে?
সংখ্যাগুলো তোমার মাথায় রাখতে হবে।
মাথায়?
হ্যাঁ। বন্ধ কর।
রুহান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মানুষ দুজনের দিকে তাকিয়ে ক্রিস্টাল রিডার বন্ধ করে দিল। বয়স্ক মানুষটি বলল, সংখ্যাগুলো হচ্ছে এক এক দুই তিন পাঁচ আট তেরো একুশ চৌত্রিশ–
ক্রিস্টাল রিডারটি চালু থাকলে সংখ্যাগুলো সেখানে রেকর্ড হয়ে যেত, তাকে নিচু গলায় শুনিয়ে দিত। এখন পুরোটা তাকে মনে রাখতে হচ্ছে। সংখ্যা হলো এক এক দুই তিন পাঁচ আট-হঠাৎ করে রুহান বুঝে ফেলে আগের দুটি সংখ্যা যোগ করে পরের সংখ্যাটি তৈরি হচ্ছে। তার মানে তারা যে সংখ্যাটি জানতে চাইছে সেটি হচ্ছে একুশ এবং চৌত্রিশের যোগফল, পঞ্চান্ন। রুহান একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পঞ্চান্ন।
মানুষ দুজনই এবারে সোজা হয়ে বসল। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় কিছু একটা বলল, তারপর আবার রুহানের দিকে তাকাল। তুলনামূলকভাবে কমবয়সী মানুষটি বলল, আমি তোমাকে ত্রিমাত্রিক একটা ছবি দেখাব। ছবিটি দেখে তোমাকে তার পৃষ্ঠদেশের ক্ষেত্রফল বলতে হবে।
আমি কী এবার ক্রিস্টাল রিডারটি চালু করতে পারি?
মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, না।
রুহান একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে।
মানুষটি টেবিল থেকে একটা কার্ড তুলে সোজা করে ধরল। বেশ কয়েকটি টিউব দিয়ে তৈরি একটি ত্রিমাত্রিক ছবি। পৃষ্ঠদেশের ক্ষেত্রফল বের করার জন্যে সামনে পিছনে ডানে বামে এবং উপর নিচে এই ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে টিউবগুলোর ক্ষেত্রফল বের করে যোগ দিতে হবে। ছবিটির দিকে তাকিয়ে রুহান হঠাৎ করে বুঝতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এর ক্ষেত্রফল বের করা সম্ভব। টিউবগুলো গুনে সেটাকে ছয় গুণ করতে হবে। সেখান থেকে যে পৃষ্ঠাগুলো একটা আরেকটাকে স্পর্শ করে আছে সেগুলো বাদ দিতে হবে। রুহান চট করে ত্রিমাত্রিক ছবিটির ক্ষেত্রফল বের করে নেয়।
কমবয়সী মানুষটি জিজ্ঞেস করল, কত?
উত্তরটা বলতে গিয়ে হঠাৎ রুহান থমকে গেল। তাদের যখন লরি করে আনছিল তখন মানুষগুলো তাদের একটা কথা বলেছিল। তারা বলেছিল যাদের বুদ্ধি থাকে তাদের মগজে ইলেকট্রড ঢুকিয়ে সেটাকে ব্যবহার করা হয়। তার বুদ্ধির পরীক্ষা নিচ্ছে, সে যদি এই পরীক্ষায় ভালো করে তাহলে কী তার মগজেও ইলেকট্রড ঢুকিয়ে দেবে? সর্বনাশ!
কী হলো? কমবয়সী মানুষটি বলল, উত্তর দাও।
রুহান উওর দিল। সঠিক উত্তরটি না দিয়ে সে একটা ভুল উত্তর দিল। সঠিক উত্তরের কাছাকাছি একটা ভুল উত্তর।
কমবয়সী মানুষটার চোখে মুখে একটা আশাভঙ্গের ছাপ পড়ে। সে খানিকটা কৌতূহল নিয়ে বলল, ঠিক করে বল।
রুহান আবার চিন্তা করার ভান করে নতুন একটা উত্তর দিল। সেটিও ভুল।
মানুষ দুজন আবার একজন আরেকজনের দিকে তাকায় তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে। রুহান চোখে মুখে হতাশার চিহ্ন ফুটিয়ে বলল, হয় নি?
না।
ক্রিস্টাল রিডারটা চালু করলেই বলতে পারতাম।
ক্রিস্টাল রিডার ছাড়াই বলতে হবে। এটাই নিয়ম।
ও।
বয়স্ক মানুষটি গোমড়া মুখে বলল, ঠিক আছে তোমাকে আবার কয়েকটি সংখ্যা বলি, তুমি তার পরেরটা বলবে।
ঠিক আছে। বল।
মানুষটা একটা কার্ড দেখে বলল, এক দুই দুই চার তিন আট চার ষোল।
রুহান সংখ্যাগুলো মনে রাখার চেষ্টা করে। সবসময় ক্রিস্টাল রিডার ব্যবহার করে কাজ করে এসেছে, কিছু একটা মনে রাখতে হলে ক্রিস্টাল রিডার সেটা মনে রেখেছে। যখন প্রয়োজন তাকে পড়ে শুনিয়েছে কিন্তু নিজের কানে শুনে নিজে মনে রাখা সম্পূর্ণ অন্য একটা ব্যাপার। রুহান সংখ্যাগুলো মাথার মাঝে সাজিয়ে নিয়ে ভেতরের মিলটুকু খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় কোনো মিল নেই কিন্তু একটু চিন্তা করতেই হঠাৎ করে পুরোটুকু স্পষ্ট হয়ে যায় এর মাঝে দুটো ধারা লুকানো, একটি এক দুই তিন চার অন্যটি দুই চার আট ষোল, তাই এর উত্তর হচ্ছে পাঁচ। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
বয়স্ক মানুষটি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কত?
রুহান নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, জানি না।
জানি না বললে হবে না। একটা উত্তর দিতে হবে।
ঠিক আছে। রুহান সরলভাবে বলল, বত্রিশ।
বয়স্ক মানুষটা বলল, হয় নি।
তাহলে কী চব্বিশ?
না। এবারেও হয় নি?
রুহান বলল, আমি দুঃখিত।
বয়স্ক মানুষটা বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে একটা ক্রিস্টাল রিডারে কিছু একটা রেকর্ড করিয়ে নিয়ে রুহানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, পাশের ঘরে যাও।
আমি কী পাস করেছি?
না, তুমি পাস করো নি। প্রথমে ভেবেছিলাম পাস করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত করতে পার নি।
কম বয়সী মানুষটা বলল, সেটা নিয়ে মন খারাপ করো না। তারপর নোংরা হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, তোমার কপাল ভালো যে পাস কর নাই। এই পরীক্ষায় পাস করলে কপালে দুঃখ আছে।
মানুষ দুজন দুলে দুলে হাসতে থাকে এবং সেটা দেখে রুহান কেমন যেন। শিউরে ওঠে। সে খুব বাচা বেঁচে গেছে, আর একটু হলেই এরা তার মাথায়। ইলেকট্রড বসিয়ে দিত।
রুহান পাশের ঘরের দিকে রওনা দেয়, ঘরটি বেশ দূরে এবং সেখানে যাবার জন্যে তাকে একটা সরু করিডোর ধরে হেঁটে যেতে হলো। যেতে যেতে সে গুলির শব্দ শুনতে পায়। থেমে থেমে এবং মাঝে মাঝে একটানা সে কোথায়। গাছে না জানলে এটাকে একটা যুদ্ধক্ষেত্র বলে ধরে নিত।
করিডোরের শেষে যে ঘরটিতে সে হাজির হলো সেটাকে দেখে একটা যুদ্ধক্ষেত্রের কমান্ড সেন্টার বলে মনে হতে পারে। রুহানের মতো আরো কয়েকজন সেখানে এর মাঝে হাজির হয়েছে, তাদের সবাইকে এক ধরনের সামরিক পোশাক পরানো হয়েছে। রুহানকেও সেটা পরতে হলো এবং তারপর তাদেরকে একটা ছোট দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো।
বন্ধ ঘর থেকে বের হতে পেরে রুহান এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করে। উপরে নীল আকাশ মাঝে মাঝে শরতের মেঘ। বড় বড় পাথরে ঢাকা পাহাড়ী অঞ্চল তার মাঝে নানা ধরনের গাছ-গাছালি, জায়গাটা একটা সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মতো। রুহান অন্য সবার সাথে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। অপেক্ষা করতে করতে যখন অধৈর্য হয়ে পড়ছিল ঠিক তখন কঠোর চেহারার একজন মাষ তাদের সামনে এসে দাঁড়াল, মাথার টুপিটা পিছনে সরিয়ে শুকনো খসখসে গলায় বলল, আমার নাম গ্রুজান। এই জায়গাটাকে সবাই আদর করে ডাকে গ্রুজানের নরক। তোমাদের সবাইকে গ্রুজানের নরকে আমন্ত্রণ।
রুহান গ্রুজান নামের এই মানুষটাকে ভালো করে লক্ষ্য করল। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা, নীল চোখগুলো অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো। সেখানে এক ধরনের অমানবিক নিষ্ঠুরতা উঁকি দিচ্ছে, হঠাৎ চোখ পড়লে বুক কেঁপে ওঠে।
গ্রুজান সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, তোমাদের এখানে কেন আনা হয়েছে জান?
কেউ কোনো কথা বলল না, একজন অনিশ্চিতের মতো মাথা নেড়ে বলল, না।
না জানাটাই ভালো ছিল, কিন্তু এখন তোমাদের জানতে হবে। এই এলাকাটা যেরকম গ্রুজানের নরক, এর বাইরে আরেকটা বড় নরক আছে। সেটার নাম পৃথিবী। পৃথিবী নামের এই নরকে এখন মারামারি কাটাকাটি চলছে। পৃথিবীর মানুষ প্রথম ভেবেছিল মারামারি কাটাকাটি বুঝি খুব খারাপ জিনিস–কিন্তু এখন দেখেছে এটা মোটেও খারাপ না, এটা অন্যরকম একটা জীবন। যারা সেটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তার এখন মহানন্দে আছে।
রুহান এক ধরনের অবিশ্বাস নিয়ে জান নামের মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে। জান নিঃশব্দে তাদের সবার সামনে দিয়ে একটু হেঁটে আবার আগের জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে বলল, পৃথিবীতে যখন মারামারি কাটাকাটি শুরু হয় তখন একটা জিনিসের খুব অভাব হয়। সেটা কী বলতে পারবে?
রুহানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী একটা ছেলে নিচু গলায় বলল, শুভ বুদ্ধি।
কী বললে? শুভ বুদ্ধি? জান কয়েক মুহূর্ত ছেলেটির দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ করে বিকট গলায় হাসতে শুরু করে, কিছুতেই হাসি থামাতে পারে না। শেষ পর্যন্ত অনেকটা জোর করে হাসি থামিয়ে চোখ মুছে বলল, না ছেলে, শুভ বুদ্ধি না। শুভ ন্যায় সত্য এই সব কথাগুলো বড় বড় কথা, কিন্তু আসলে এগুলো হচ্ছে অর্থহীন কথা। পৃথিবীতে শুভ ন্যায় সত্য বলে কিছু নেই। যার জোর বেশি সে যেটা বলবে সেটাই হচ্ছে সত্য। সেটাই ন্যায়। সেটাই শুভ। বুঝেছ?
কেউ কোনো কথা বলল না। জান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীতে মারামারি কাটাকাটি শুরু হবার পর যে জিনিসটার অভাব হয়েছে সেটা হচ্ছে বডি পার্টস। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। যুদ্ধে যারা মারা যায় তারা তো মরেই গেল। কিন্তু যারা বেঁচে থাকে তাদের কারো দরকার হৃৎপিণ্ড। কারো দরকার। কিডনি। কারো ফুসফুস। কারো হাত, কারো পা। কারো চোখ। কার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে দাম। জান চোখ নাচিয়ে বলল, তোমাদের শরীরে আছে সেই সব অদৃশ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। আমরা তোমাদের ধরে এনেছি সেগুলো কেটেকুটে বিক্রি করার জন্যে। তোমরা সবাই হচ্ছ আমাদের মূল্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাপ্লাই। বুঝেছ?
রুহান এবং তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য কয়েকজন এক ধরনের ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই কী তাদের কেটেকুটে মেরে ফেলার জন্যে ধরে এনেছে?
গ্রুজান চোখে মুখে এক ধরনের পরিতৃপ্তির ভাব নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখেই বোঝা যায় সে সবার আতঙ্কটুকু উপভোগ করছে। মুখে লোল টানার মতো এক ধরনের শব্দ করে বলল, তবে আমরা একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে কাঁচামাল এনে সেটাকে প্রক্রিয়া করে মূল্যবান জিনিস বানাই। তোমরা হচ্ছ কাঁচামাল, তোমাদের প্রক্রিয়া করে আরো মূল্যবান করা হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য। সেটা কীভাবে করা যায় জান?
কেউ কোনো কথা বলল না, জানও সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। বলল, তোমাদের মধ্যে যাদের মগজ ভালো তাদের মাথায় একটা ইলেট্রড ঢুকিয়ে খুব ভালো দামে বিক্রি করা যায়। তোমাদের মধ্যে যাদের মগজ ভালো এর মাঝে তাদের আলাদা করা হয়েছে–তোমরা তার মাঝে নেই। তোমরা হচ্ছ গাধা টাইপের। বুঝেছ? তোমাদের রাখা হয়েছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করার জন্যে। তবে–
গ্রুজান খানিকটা নাটকীয় ভাব করে হঠাৎ থেমে গিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর চোখ নাচিয়ে বলল, তোমাদের জানে বেঁচে যাবার এখনো খুব ছোট একটা সম্ভাবনা আছে। খুবই ছোট। সেটা কী জানতে চাও?
এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না।
আমরা বাজার যাচাই করে দেখেছি, তোমাদের কেটেকুটে বিক্রি করে আমরা যে পরিমাণ ইউনিট পাই, তার থেকে অল্প কিছু বেশি ইউনিট পাওয়া যায় যদি তোমাদের একজনকে সৈনিক হিসেবে বিক্রি করা যায়। তবে সমস্যাটা কী জান?
কয়েকজন দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে জানাল যে তারা সমস্যাটা জানে না। জান মুখে এক ধরনের হাসি টেনে এনে বলল, সমস্যাটা হচ্ছে সবাইকে। সৈনিক বানানো যায় না। শুধু তারাই সৈনিক হতে পারে, যাদের বুকে আছে সাহস এবং যাদের রিফ্লেক্স খুব ভালো। যারা শক্তিশালী এবং যারা কষ্ট সহ্য করতে পারে।
গ্রুজান নিঃশব্দে তাদের সামনে দিয়ে একটু হেঁটে এসে বলল, তোমাদের কেটেকুটে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করার আগে তাই আমরা তোমাদের সৈনিক হবার একটা সুযোগ দিই। সুযোগটা হচ্ছে এরকম-ঐ যে দূরে দেয়ালটা দেখছ সেই দেয়ালের আড়ালে তোমরা দাঁড়াবে। যখন আমি তোমাদের সংকেত দেব তখন সেখান থেকে বের হয়ে এই গাছগাছালী, পাথর, খাল, মাঠ পার হয়ে অন্য পাশের দেওয়ালের আড়ালে ছুটে যাবে। তোমার হাতে থাকবে একটা অস্ত্র, তুমি চাইলে সেটা ব্যবহার করতে পার। আমি এখান থেকে তোমাদের গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করব। বুঝেছ?
রুহান বিস্ফারিত চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটা সত্যি বলছে নাকি ঠাট্টা করছে সে ঠিক বুঝতে পারে না। একজন ভাঙ্গা গলায় বলল, আ-আমরা তোমার সাথে যুদ্ধ করব?
হ্যাঁ। বলতে পার সেটা এক ধরনের যুদ্ধ। তোমরা আমাকে গুলি করবে, আমি তোমাদের গুলি করব।
কিন্তু আমি কখনো কোনো অস্ত্র হাত দিয়ে ধরি নি।
যদি সেটা সত্যি হয় বুঝতে হবে তোমার কপাল খারাপ। তবে বেশি হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আজকালকার অস্ত্র খুব ভালো, খুব তাড়াতাড়ি ব্যবহার করা শেখা যায়।
রুহানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী ছেলেটা হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ল, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, আমি পারব না। আমি পারব না, আমাকে ছেড়ে দাও, প্লীজ।
গ্রুজান হা হা করে হেসে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে ছেড়ে দেব। সামনের এই খাল, পাথর, গাছগাছালির মধ্যে আমি তোমাকে ছেড়ে দেব, শুধু মনে রেখ এইখানে আমি অস্ত্র নিয়ে তোমার দিকে তাক করে থাকব! তোমাকে আমি পাখির মতো গুলি করে মারব। ছিচকাদুনে মানুষ সৈনিক হবার উপযুক্ত নয়।
রুহান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, এখনো পুরো ব্যাপারটি তার বিশ্বাস হচ্ছে। তার ভয় পাবার কথা কিন্তু সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার ভয় করছে। ভেতরে বিচিত্র একধরনের অনুভূতি, ভাবলেশহীন পাথরের মতো শীতল একধরনের অনুভূতি কিন্তু সেই অনুভূতিটি ভয়ের নয়, অন্য কিছুর।
০৪. হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি
হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে ছেলেটি দরদর করে ঘামছে। রুহানের দিকে শূন্য
দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমি কখনো অস্ত্র ব্যবহার করি নি।
রুহান ছেলেটির কাঁধ স্পর্শ করে বলল, আমরা কেউই করি নি! তাতে কিছু আসে যায় না।
ছেলেটি ভাঙ্গা গলায় বলল, আমাকে মেরে ফেলবে।
সম্ভবত। রুহান নরম গলায় বলল, আপাতত সেটা নিয়ে চিন্তা কর না।
আমি কী করব?
তুম এখন দৌড়ে ঐ দিকে দেয়ালের পিছনে যাবে।
কিন্তু–
রুহান বলল, এর মধ্যে কোনো কিন্তু নেই। এখন ভয় পেলে হবে না। যাও।
আমি কী গুলি করতে করতে যাব?
গুলি করতে করতে দ্রুত ছুটতে পারবে না। কোনো কিছুর আড়ালে থেকে ঐ গ্রুজান জানোয়ারটার দিকে এক পশলা গুলি কর, সে তখন নিজেকে বাঁচানোর জন্যে আড়ালে সরে যাবে। জানোয়ারটা আড়াল থেকে আবার বের হবার আগে ছুটে কোনো একটা কিছুর আড়ালে চলে যাবে। আবার বের হবার আগে আবার এক পশলা গুলি করবে।
ছেলেটি ফ্যাকাসে মুখে বলল, তোমার কী ধারণা তাহলে আমি যেতে পারব?
রুহান হাসার চেষ্টা করে। বলল, হ্যাঁ পারবে অবশ্যই পারবে। যাও।
ছেলেটা চোখ বন্ধ করে একবার সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে তারপর অস্ত্র হাতে এগিয়ে যায়।
দেয়ালের আড়াল থেকে অস্ত্রটা বের করে ছেলেটা ছাড়া ছাড়াভাবে কয়েকটা গুলি করল। জান সম্ভবত এর জন্যে প্রস্তুত ছিল না, তার গলায় কুৎসিত একটা গালি শোনা গেল। ছেলেটা দৌড়ে একটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে একটা বড় গাছের আড়ালে। আবার এক পশলা গুলি করে ছুটে আরেকটা পাথরের আড়ালে চলে গেল। জান সম্ভবত এরকম কিছু আশা করে নি, সে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করতে থাকে এবং তার মধ্যে ছেলেটা অন্যপাশে দেয়ালের আড়ালে চলে গেল।
রুহান মাথা ঘুরিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের বলল, দেখেছ?
অন্যেরা মাথা নাড়ল। রুহান বলল, এটাই হবে আমাদের টেকনিক। যাও পরেরজন। খুব সাবধান।
পরেরজনও ছাড়া ছাড়াভাবে গুলি করতে করতে এক পাথর থেকে অন্য পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে অন্য পাশে চলে গেল। তৃতীয়জন রওনা দেবার। আগে রুহানের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমি পারব না।
কেন পারবে না? দেখছ না দুজন চলে গেছে।
ছেলেটি শূন্য দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ভয় করে।
আমাদের সবার ভয় করে। কিন্তু সে জন্যে বসে থাকলে তো হবে না। যাও।
না। আমি পারব না।
তুমি পারবে। যাও।
ছেলেটা তবুও দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। তখন সামরিক পোশাক পরা একজন এসে ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। ছেলেটা হত বিহ্বলের মতো ফাঁকা জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে যে ছুটে যেতে হবে সেটাও যেন ভুলে গেছে।
রুহান চিৎকার করে বলল, দৌড়াও! দৌড়াও–
ছেলেটা রুহানের দিকে তাকাল, দেখে মনে হলো সে কী বলছে সেটা বুঝতে পারছে না। ঠিক তখন একটা গুলির শব্দ শোনা গেল এবং সাথে সাথে ছেলেটির শরীরটি মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে লাফিয়ে উঠে ধপ করে নিচে পড়ে গেল। রুহান তার চোখটি সরিয়ে নিতে চেষ্টা করল কিন্তু সরাতে পারল না, বিস্ফারিত চোখে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটির মুখে যন্ত্রণার। কোনো চিহ্ন নেই, সেখানে এক ধরনের বিস্ময়।
রুহান নিঃশব্দে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু মানুষের চিৎকার এবং হইচইয়ের শব্দ শোনা যায়। ছেলেটির দেহটি সরিয়ে নিচ্ছে, এক্ষুনি কাটাকাটি করে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সরিয়ে নেবে, তারপর সেগুলো প্যাকেটে সংরক্ষণ করে। চড়া দামে বিক্রি করা হবে।
রুহানের হাতে কে যেন একটা অস্ত্র ধরিয়ে দিয়েছে, রুহান মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। ভাবলেশহীন মুখে একজন মানুষ তাকে স্পর্শ করে বলল, এখন তুমি।
আমি?
হ্যাঁ। যাও।
রুহান সামনের খোলা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে বড় বড় কয়েকটা পাথর। গাছ-গাছালি, ছোট একটা খাল এবং ঝোপঝাড়। তার ভেতর দিয়ে তাকে ছুটে যেতে হবে। সে যখন ছুটে যাবে তখন গ্রুজান তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে তাক করে থাকবে তাকে গুলি করে মেরে ফেলার জন্যে। এটা যেন একটা খেলা। যাদের নিয়ে এই খেলাটি খেলা হচ্ছে তারা যেন মানুষ নয়, তারা যেন খেলার গুটি।
ভাবলেশহীন চেহারার মানুষটি রুহানকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, যাও।
রুহান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে দেয়ালের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। একটা পাথর থেকে অন্য পাথরের আড়ালে ছুটে না গিয়ে সে সোজা গ্রুজানের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।
পেছন থেকে কে যেন চিৎকার করে ওঠে, এই ছেলে তুমি কোথায় যাচ্ছ?
রুহান সেই কথায় কান দিল না।
গ্রুজান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অবাক হয়ে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হলো কিছু একটা বলবে কিন্তু কিছু বলল না। রুহান তার কাছাকাছি গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল। জানের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে, খসখসে গলায় বলল, তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
রুহান কোনো কথা না বলে স্থির চোখে জানের দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রুজান মুখ বিকৃত করে বলল, নর্দমার পোকা! তুমি যখন ছুটে যাবে তখন তোমাকে আমি পাখির মতো গুলি করে মারতে পারি। সামনাসামনি মারার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। যাও। ভাগো–পালাও।
রুহান এবারেও কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে জানের দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রুজান ধমক দিয়ে বলল, আহাম্মকের বাচ্চা! কী হলো তোমার?
কিছু হয় নি।
তাহলে?
রুহান ফিসফিস করে বলল, তোমার আর আমার মধ্যে কে বেঁচে থাকবে সেটা নির্ভর করছে–কে আগে তার অস্ত্রটি তুলতে পারে।
গ্রুজান হতচকিতের মতো রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তু-তু-তুমি?
হ্যাঁ।
আহাম্মকের বাচ্চা! তুমি ভাবছ তুমি আমাকে গুলি করবে?
আমি কিছু ভাবছি না। আমি তোমার দিকে তাকিয়ে আছি। যেই মুহূর্তে তুমি অস্ত্রটা তোলার চেষ্টা করবে, আমি তখন তোমাকে গুলি করব।
জান হতবাক হয়ে রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তু-তুমি?
হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত।
গ্রুজান রুহানের চোখের দিকে তাকাল। গ্রুজানের চোখে প্রথমে ছিল তাচ্ছিল্য, রুহানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেই দৃষ্টিতে প্রথম বিস্ময় তারপর খুব ধীরে ধীরে বিস্ময়কর এক ধরনের আতঙ্ক এসে ভর করে। রুহান দেখতে পায় গ্রুজানের সমস্ত শরীর ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে আসছে, দেখতে পায় তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠছে। গ্রুজান প্রথমে বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল তারপর ঠিক যেই মুহূর্তে অস্ত্রটি তোলার চেষ্টা করে রুহান সাথে সাথে তাকে গুলি করল।
রুজানের দেহটি গড়িয়ে তার পায়ের কাছে এসে পড়ল। রুহান স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। চারপাশে মানুষের চিকার, হইচই, চেচামেচি এবং পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রুহান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছুতেই তার কিছু আসে যায় না। সে কখনোই ভাবে নি যে সে কখনো কোনো মানুষকে খুন করবে, কিন্তু কী আশ্চর্য সে সত্যি সত্যি একটা মানুষকে খুন করেছে। সত্যিই কী যাকে খুন করেছে সে মানুষ?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি চতুর্থবারের মতো রুহানকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন করে জানকে হত্যা করেছ?
রুহান চতুর্থবারের মতো উত্তর দিল, আমি জানি না।
মধ্যবয়স্ক মানুষটির পাশে বসে থাকা লাল চুলের মহিলাটি বলল, তুমি জান না বললে তো হবে না। সবাই দেখেছে তুমি তাকে গুলি করে মেরেছ।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমি আসলে হত্যা, খুন এসব কখনো দেখি নি। যখন দেখলাম ছেলেটাকে গ্রুজান মেরে ফেলল–
না না না। লাল চুলের মহিলাটি মাথা নেড়ে বলল, তুমি কেন মেরেছ সেটা জিজ্ঞেস করি নি। জিজ্ঞেস করেছি কেমন করে মেরেছ।
রুহান একটু অবাক হয়ে বলল, আমাকে যে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা দিয়েছিল —
আমরা সেটা জানি! লাল চুলের মহিলাটি একটু অধৈর্য হয়ে বলল, আমরা জানতে চাইছি গ্রুজানের মতো এত বড় একজন যোদ্ধাকে তুমি কেমন করে হত্যা করলে?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, তুমি অস্ত্র ব্যবহার করা কোথায় শিখেছ?
আমি কোথাও শিখি নি। এটা ছিল আমার প্রথম অস্ত্র ব্যবহার।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, অসম্ভব!
না। অসম্ভব না। রুহান মাথা নেড়ে বলল, সত্যিই আমি এর আগে কখনো অস্ত্র হাতে নেই নি।
রুহানের সামনে বসে থাকা চারজন মানুষ কেমন যেন হতচকিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা দুজন নিজেদের ভেতরে নিচু গলায় একটু কথা বলল। তারপর রুহানের দিকে তাকাল, একজন বলল, তোমাকে অভিনন্দন ছেলে।
রুহান অবাক হয়ে বলল, অভিনন্দন?
হ্যাঁ।
আমি তোমাদের একজনকে মেরে ফেলেছি সে জন্যে তোমরা আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছ?
হ্যাঁ। তুমি যেভাবে গ্রুজানকে মেরেছ তার তুলনা নেই। মানুষটি জিব দিয়ে পরিতৃপ্ত ভঙ্গির একটা শব্দ করে বলল, তোমার মতো এরকম তড়িৎগতির মানুষ আমরা আগে কখনো দেখি নাই।
রুহান এখনো মানুষটির কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না, ইতস্তত করে বলল, কিন্তু তোমাদের জান?
মানুষটি হাত নেড়ে পুরো বিষয়টি উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, আরে ধেৎ, তোমার জান! এক গ্রুজান গিয়েছে তো আরেক গ্রুজান আসবে। সত্যি কথা বলতে কী গ্রুজান তো আর পুরোপুরি ক্ষতি হয় নি তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি *রে দিয়েছি। কিন্তু তোমাকে তো আমরা পেয়েছি।
আমাকে?
হ্যাঁ। আমরা একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান। মানুষ ধরে এনে তাকে বিক্রি করি। কখনো কেটেকুটে কখনো মগজে ইলেকট্রড বসিয়ে কখনো সৈনিক হিসেবে এবং যদি খুব কপাল ভালো হয় তখন আমরা তোমার মতো একজন পাই, যাকে আমরা খেলোয়াড় হিসেবে বিক্রি করতে পারি।
রুহান অবাক হয়ে বলল, খেলোয়াড়? কীসের খেলোয়াড়?
লাল চুলের মহিলাটি বলল, এক সময় পৃথিবীতে কত হাজার রকম বিনোদন ছিল! এখন কিছু নেই। এখন একমাত্র বিনোদন হচ্ছে এই খেলা—
কীসের খেলা?
একজন আরেকজনকে গুলি করার খেলা।
রুহান হতবাক হয়ে সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। সে এখনো পরিষ্কার করে বুঝতে পারছে না তারা কী নিয়ে কথা বলছে। মধ্যবয়স্ক মানুষটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমরা তোমাকে একেবারে প্রথম শ্রেণীর ট্রেনিং দিব। তোমাকে সব ধরনের অস্ত্র চালানো শেখাব তারপর তোমাকে লক্ষ ইউনিটে বিক্রি করব।।
লাল চুলের মহিলাটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তোমার উপর বাজি ধরা হবে।
বাজি?
হ্যাঁ। আমরা আশা করছি দেখতে দেখতে তোমার রেটিং উপরে উঠে যাবে। আমাদের নাম তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
রুহান খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তার সামনে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, এখানে তোমাকে ট্রেনিং দেয়া যাবে না। ট্রেনিংয়ের জন্যে তোমাকে আমাদের কেন্দ্রীয় অফিসে পাঠাতে হবে।
সেটা কোথায়?
লাল চুলের মহিলাটি বলল, এখান থেকে শ খানেক কিলোমিটার দূরে। পাহাড়ের উপর। চমত্তার জায়গা।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, হ্যাঁ চমৎকার জায়গা, পাহাড়ের উপর চমৎকার একটি হৃদ। সেই হৃদের পাশে অফিস।
সেখানে আজেবাজে মানুষের ভিড় নেই।
খাওয়া খুব ভালো। সব খাঁটি প্রাকৃতিক খাবার। মধ্যবয়স্ক মানুষটি জিব দিয়ে তার ঠোঁট চেটে বলল, তুমি যদি চাও তোমাকে সঙ্গিনী দেয়া হবে। চমৎকার সব মেয়ে আছে হেড অফিসে।
রুহান কোনো কথা না বলে মানুষগুলোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। লাল চুলের মহিলাটি বলল, তোমার কী কোনো প্রশ্ন আছে ছেলে?
আমার নাম রুহান।
ও, আচ্ছা। হ্যাঁ। রুহান–তোমার কী কোনো প্রশ্ন আছে রুহান?
হ্যাঁ। আমার একটা প্রশ্ন আছে।
কী প্রশ্ন?
আমি যদি তোমাদের প্রস্তাবে রাজি না হই? আমি যদি মানুষকে গুলি করে মারার এই খেলা খেলতে না চাই?
সামনে বসে থাকা মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখে একটু কৌতুকের হাসি ফুটে ওঠে এবং সে হঠাৎ শব্দ করে হেসে ওঠে।
রুহান বলল, কী হলো? তুমি হাসছ কেন?
মানুষটি হাসি থামিয়ে বলল, তোমার কথা শুনে। তোমার আগে কেউ কখনো এই প্রশ্ন করে নি।
ঠিক আছে। কিন্তু আমি এই প্রশ্ন করছি।
ঠিক আছে ছেলে–
আমার নাম রুহান।
ঠিক আছে রুহান, আমি তোমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিই। মধ্যবয়স্ক মানুষটা আবার জিব দিয়ে তার ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে বলল, পৃথিবীটা এখন আগের মতো নেই রুহান। মানুষ এখন নিজের ইচ্ছে মতো কিছু করতে পারে না। এখন মানুষ হয় আদেশ দেয় না হয় আদেশ শোনে। তোমার এখন আদেশ শোনার কথা। তুমি যদি আমাদের আদেশ না শোনো তাহলে তোমাকে আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই।
লাল চুলের মহিলাটি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, তোমাকে এখন আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু তোমার মস্তিষ্কটা আমরা ব্যবহার করতে পারব না, কিংবা তোমার হৃৎপিণ্ডটা কারো কাছে বিক্রি করতে পারব না সে কথাটা তো কেউ বলে দেয় নি। বুঝেছ?
রুহান একটু মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি।
চমৎকার! মধ্যবয়স্ক মানুষটা বলল, তুমি তাহলে প্রস্তুত হয়ে যাও। তোমাকে আমরা এখনই আমাদের কেন্দ্রীয় অফিসে পাঠাব।
সামনে বসে থাকা চারজন মানুষ উঠে দাঁড়ায় এবং রুহান হঠাৎ নিজের ভেতরে এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে। গভীর এক ধরনের ক্লান্তি।
০৫. রুহান তার ঘরের জানলা দিয়ে
রুহান তার ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সামনে বিশাল একটি হদ, সেইদকে ঘিরে গাঢ় সবুজ রঙের বনভূমি। দূরে পর্বতমালা, ধীরে ধীরে তার রং হালকা হয়ে মিলিয়ে গেছে। অপূর্ব এই প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে রুহান বুভুক্ষের মতো তাকিয়ে থাকে। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানলাটি তাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে সে আসলে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী। বাইরের এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য কোয়ার্টজের জানলা দিয়ে দেখতে পাবে কিন্তু কখনোই তার অংশ হতে পারবে না। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানলা দিয়ে তাকে এই প্রকৃতি থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে।
রুহান একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল এবং ঠিক তখন তার ঘরের ভেতর খুট করে একটা শব্দ হলো। রুহান মাথা ঘুরিয়ে তাকায় এবং দেখতে পায় তার ঘরের দরজা খুলে একজন কমবয়সী মেয়ে ভেতরে ঢুকছে। তার মুখটি শীর্ণ এবং চোখের নিচে কালি। মেয়েটির চুল উষ্কখুষ্ক এবং চোখ দুটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, প্রায় অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো। রুহান একটু অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শীর্ণ মেয়েটি কোনো কথা না বলে জ্বলজ্বলে চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল।
রুহান একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, তুমি কি আমার কাছে এসেছ?
মেয়েটি রুহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওমেগা ফাংশনের তৃতীয় সংখ্যাটি কত জান?
মেয়েটি কী বলছে রুহান তার কিছুই বুঝতে পারল না, মাথা নেড়ে বলল, না জানি না।
আমার ধারণা কমপ্লেক্স তলে তার কোনো রুট নেই। তোমার কী ধারণা?
আমি বলতে পারব না।
নেই। নিশ্চয় নেই। ওমেগা ফাংশনের সহগের উপর সেটা নির্ভর করার কথা। শীর্ণ মেয়েটি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে যেতে শুরু করে এবং তখন রুহান হঠাৎ করে শিউরে ওঠে। মেয়েটার মাথার পেছন থেকে একটা ধাতব ইলেকট্রড বের হয়ে আসছে। তার মস্তিষ্কের ভেতর সেটা প্রবেশ করানো রয়েছে।
শীর্ণ মেয়েটি দুই হাত পাশে ঝুলিয়ে একটি বিচিত্র ভঙ্গিতে করিডোর ধরে হটতে শুরু করে। রুহান মেয়েটিকে ডাকবে কী না বুঝতে পারে না। তার পিছু পিছু হেঁটে হেঁটে সে একটা হলঘরে হাজির হলো। সেখানে আরো বেশ কয়েকজন মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এক নজর দেখেই রুহান বুঝতে পারে তাদের সবার মস্তিষ্কে ইলেকট্রড প্রবেশ করিয়ে রাখা আছে। তাদের দৃষ্টি হয় অস্বাভাবিক উজ্জ্বল না হয় উদভ্রান্তের মতো। তারা সবাই বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলছে। দুই-একজনের একটি হাত হঠাৎ হঠাৎ নড়ে উঠছে, মনে হয় সেটার উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরো দৃশ্যটি এত অস্বাভাবিক যে রুহান স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
হলঘরের এক কোনা থেকে হঠাৎ একজন তার কাছে এগিয়ে আসে, ব্যস্ত গলায় বলল, এনেছ? এনেছ তুমি?
তার কী আনার কথা সে জানে না, সেটা নিয়ে সে কোনো প্রশ্ন না তুলে বলল, না আনি নি।
না আনলে কেমন করে হবে? উপাদানগুলোর পরিমাপ সমান হতে হবে। বিস্ফোরকের ক্ষমতা নির্ভর করে তার উপাদানগুলোর উপর। অক্সিজেন সমৃদ্ধ উপাদান। তুমি যদি না আনো- মানুষটি নিজের মনে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে সরে গেল।
রুহান খুব সাবধানে তার বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দেয়। আর একটু হলে সম্ভবত তারও এখানে এভাবে থাকতে হতো। বুদ্ধিমত্তা। পরীক্ষা করার সময় সে যদি প্রশ্নগুলোর উত্তর ইচ্ছে করে ভুল করে না দিত তাহলে কী তার মস্তিষ্কেও এভাবে ইলেকট্রড বসিয়ে দিত না?
কে যেন তার কাঁধে হালকাভাবে স্পর্শ করে। রুহান মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, একজন বয়স্ক মানুষ, চুল ধবধবে সাদা, মুখে বয়সের বলিরেখা। মানুষটি নরম গলায় বলল, তুমি কে? তোমার মাথায় তো ইলেকট্রড নেই, তুমি এখানে কী করছ?
রুহান বলল, আমার নাম রুহান। আমি জানি না আমি এখানে কী করছি।
বয়স্ক মানুষটি হেসে বলল, আমরা আসলে কেউই জানি না আমরা কী করছি। আমাদের জন্মাটাই একটা বড় রহস্য।
রুহান কথাটি সহজ অর্থেই বলেছিল, বৃদ্ধ মানুষটি অনেক ব্যাপক অর্থে দার্শনিকভাবে গ্রহণ করেছে।
বৃদ্ধ মানুষটি তার হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম কিহি। আমি সক্রেটিসদের দেখাশোনা করি।
রুহান ভুরু কুঁচকে বলল, কাদের দেখাশোনা করো?
কিহি হাত দিয়ে মস্তিষ্কে ইলেকট্রড বসানো চারপাশের অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোকে দেখিয়ে বলল, এই যে এই ছেলে-মেয়েগুলোকে। এদেরকে এখানে সক্রেটিস বলে।
এরাই তাহলে সেই সক্রেটিস! আমি এদের কথা শুনেছি।
হ্যাঁ। একটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর রসিকতা। সক্রেটিস খুব জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। এই ছেলে-মেয়েগুলোর মস্তিষ্কে যখন এই ইলেকট্রড দিয়ে ইম্পালস দেয়া হয় তখন এরাও কিছুক্ষণের জন্যে জ্ঞানী হয়ে যায়। সে জন্যে এদেরকে বলে সক্রেটিস।
এদের সবাইকে দেখে মনে হয় এরা অপ্রকৃতস্থ।
হ্যাঁ। এরা অপ্রকৃতস্থ। যখন মস্তিষ্কে ইম্পালস দেয়া হয় তখন এরা কিছুক্ষণের জন্যে স্বাভাবিক হয়। তখন তারা কোনো কোনো বিষয়ে অনেক বড় বিশেষজ্ঞ হয়ে যায়। তারা তখন অনেক বড় বড় সমস্যা সমাধান করতে পারে।
কিন্তু এমনিতে এরা অপ্রকৃতস্থ।
হ্যাঁ, এমনিতে এরা অপ্রকৃতস্থ।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এটি একটি অত্যন্ত বড় ধরনের নিষ্ঠুরতা।
হ্যাঁ। এটি অত্যন্ত বড় একটি নিষ্ঠুরতা।
রুহান কিহির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যদি জান এটি এক ধরনের নিষ্ঠুরতা তাহলে তুমি কেন এ ধরনের কাজ করো? কেন ছেড়েছুড়ে চলে যাও না?
কিহি একটু হাসার চেষ্টা করল কিন্তু সেই হাসিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলো না। নিচু গলায় বলল, পারলে চলে যেতাম। নিশ্চয় চলে যেতাম। কিন্তু পারছি না।
কেন পারছ না?
যারা আমাকে ধরে এনেছে তারা কী কখনো আমাকে যেতে দেবে?
রুহান ভালো করে কিহির দিকে তাকাল, সে বুঝতে পারে নি এই বৃদ্ধ মানুষটাও তাদের মতো একজন ধরে আনা বন্দী মানুষ। রুহান থতমত খেয়ে বলল, আমি দুঃখিত কিহি। আমি বুঝতে পারি নি। আমি ভেবেছিলাম এখানে বুঝি শুধু কমবয়সী তরুণদের ধরে আনে। আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি ওদের একজন।
কিহি মাথা নেড়ে বলল, না। আমি ওদের একজন নই। হাত দিয়ে চারপাশের অপ্রকৃতস্থ ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখিয়ে বলল, আমি এদের একজন। এই দুর্ভাগা ছেলে-মেয়েগুলোর দেখাশোনা করি। এদের মতো অসহায় পৃথিবীতে আর একজনও নেই। যতদিন এখানে থাকে আমি তাদের খানিকটা মমতা দিই, ভালোবাসা দিই। অপ্রকৃতস্থ হলেও তারা ভালোবাসা বুঝে। এখন কী মনে হয় জান?
কী?
আমাকে যদি এখন ছেড়েও দেয়। আমি সম্ভবত ওদের ছেড়ে চলে যেতে পারব না।
রুহান কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিহি অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অপ্রকৃতস্থ ছেলে-মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে আবার মাথা ঘুরিয়ে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে যারা আসে তাদের সবার মাথাতেই ইলেকট্রড বসানো থাকে। তুমি অন্যরকম, এখানে তোমাকে কেন এনেছে?
রুহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার মাথায় ইলেকট্রড নেই–মনে হয় সরাসরি বুলেট বসাবে!
কেন? এরকম কথা কেন বলছ?
আমি একজন খেলোয়াড়।
বৃদ্ধ কিহি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ফিসফিস করে বলল, খেলোয়াড়? মানুষকে গুলি করার যে খেলা সেই খেলার খেলোয়াড়?
হ্যাঁ। আমাকে ট্রেনিং দেবার জন্যে এনেছে।
কিহি কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর নিচু গলায় বলল, আমি জানি না কে বেশি দুর্ভাগা। তুমি নাকি এই সক্রেটিসের সন্তানেরা।
ঠিক এরকম সময় হলঘরের এক কোনায় দুজন উচ্চস্বরে কথা কাটাকাটি শুরু করে দেয়, অন্যেরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। কিহি এগিয়ে যায়, শান্ত গলায় বলে, কী হলো? তোমরা দুজন আবার কী নিয়ে ঝগড়া শুরু করলে?
যে দুজন চেচামেচি করছিল তারা প্রায় সাথে সাথে কিহির দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো একটু হাসার চেষ্টা করে চুপ করে গেল। কিহি ঠিকই বলেছে। এই মানুষগুলো অপ্রকৃতস্থ কিন্তু তারপরেও তারা কিহির মমতাটুকু অনুভব করতে পারে।
রুহান বলল, এরা তোমাকে খুব ভালোবাসে।
হ্যাঁ। কিহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মাথায় যখন ইলেকট্রড বসায় তখন মস্তিষ্কের কোথায় কী ক্ষতি হয় কে জানে কিন্তু এরা একেবারে শিশুর মতো হয়ে যায়।
ঠিক তখন কোথায় জানি ঘটাং করে একটা শব্দ হলো এবং ঘরঘর শব্দ করে কাছাকাছি একটা দেয়াল সরে যেতে শুরু করল। ঘরের ভেতরে অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোর মধ্যে হঠাৎ কেমন যেন একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, সবাই হুঁটোপুটি করে বড় হলঘরটার এক কোনে গিয়ে একজন আরেকজনকে ধরে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজার খোলা অংশটা দিয়ে চারজন মানুষ এসে ঢুকল। তাদের গায়ে নীল রঙের জাম্পস্যুট। ছোট করে ছাটা চুলের একজন মহিলার হাতে একটা ছোট ব্যাগ, সেখান থেকে কিছু যন্ত্রপাতি উঁকি দিচ্ছে। একজন মধ্যবয়স্ক ছোটখাটো মানুষ অন্য দুজন বিশাল দেহী।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি কিহির দিকে তাকিয়ে বলল, কী খবর বুড়ো। তোমার জ্ঞানী শিশুরা কেমন আছে?
কিহি কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা হাসি হাসি মুখে বলল, আমাদের দেখে ইঁদুরের ছানার মতো এক কোনায় কেমন জড়ো হয়েছে দেখেছ?
কিহি এবারেও কোনো কথা বলল না।
যন্ত্রপাতির ব্যাগ হাতে ছোট করে ছাটা চুলের মেয়েটি বলল, স্টিমুলেশন দেবার পর এরাই আবার কেমন গুছিয়ে কথা বলতে থাকে! দেখে বিশ্বাস হয় না।
কিহি জিজ্ঞেস করল, কাউকে নেবে?
হ্যাঁ।
কাকে?
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ তার ক্রিস্টাল রিডারটা দেখে বলল, ক্রানাকে।
দূরে জড়াজড়ি করে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর মধ্যে একটা মেয়ে হঠাৎ আতঙ্কের একটা শব্দ করে নিজের মুখ-ঢেকে আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে। রুহান চিনতে পারল, কিছুক্ষণ আগে এই মেয়েটিই তার ঘরে ঢুকে গিয়েছিল।
মেয়েটির আকুল হয়ে কান্না শুনে নীল জাম্পস্যুট পরা মানুষগুলো এক ধরনের কৌতুক অনুভব করে। তারা নিজেরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে হাসতে শুরু করে।
রুহান বলল, এর ভেতরে তোমরা হাসার মতো কী খুঁজে পেলে।
রুহানের কথা শুনে মানুষগুলো কেমন যেন অবাক হয়ে তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। মধ্যবয়স্ক মানুষটা অবাক হয়ে বলল, তুমি কে?
রুহান বলল, আমি এখানে নিজ থেকে আসি নি। তোমরা আমাকে ধরে এনেছ। তোমরা বলো আমি কে?
মানুষটার মুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। থমথমে গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ছোট করে চুল ছাটা মহিলাটি বলল, এর নাম রুহান। রুহান আমাদের নতুন খেলোয়াড়।
খে-খেলোয়াড়? মধ্যবয়স্ক মানুষটার পাথরের মতো কঠিন মুখটা দেখতে দেখতে কেমন জানি নরম হয়ে যায়। মুখে একধরনের বিস্ময়ের ভাব ফুটে ওঠে, বিগলিত ভঙ্গিতে বলে, তুমি খেলোয়াড়?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি সেটা শুনেছি। এখনো জানি না।
তোমাকে আমাদের সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। আমাদের এই ট্রেনিং সেন্টার তোমাকে নিশ্চয়ই একেবারে প্রথম শ্রেণীর একটা খেলোয়াড় বানিয়ে দেবে।
মানুষটির কথার সাথে সাথে অন্যেরাও কেমন জানি বিগলিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকে।
রুহান বলল, তোমরা এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি। কোন প্রশ্ন?
রুহান নিচু গলায় বলল, তোমাদের দেখে ও তোমাদের কথা শুনে মেয়েটি ভয় পেয়ে কাঁদছে। এর মধ্যে কোন অংশটুকু হাসির?
মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখে অপমানের একটা সূক্ষ্ম ছাপ পড়ল। সে হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভান করে বলল, তুমি সেটা এখন বুঝবে না। এখানে কিছুদিন থাক তাহলে নিজেই বুঝতে পারবে।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, মনে হয় না।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে ক্রানা কে?।
আকুল হয়ে কাঁদতে থাকা মেয়েটা আরো জোরে ড়ুকরে কেঁদে উঠল। মানুষটা বলল, তুমি?
মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ল।
এসো তাহলে। চলে এসো।
মেয়েটা মাথা নাড়ল, সে আসবে না।
না এলে চলবে না। মধ্যবয়স্ক মানুষটার কণ্ঠস্বর কঠোর হয়ে ওঠে, এসো।
মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল, না।
মানুষটা এবার পিছনে তাকাল, বিশাল দেহী দুজন মানুষ এবারে এগিয়ে যায়। ক্রানা নামের মেয়েটিকে দুইজন দুই পাশ থেকে ধরে ফেলে তারপর প্রায় শূন্যে তুলে সরিয়ে নিয়ে আসে। ক্রানা হাত পা ছুড়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে কিন্তু সেই কান্নায় মানুষগুলো এতটুকু বিচলিত হয় না।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা কিহির দিকে তাকিয়ে বলল, বুড়ো তুমি আস আমাদের সাথে।
কিহি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল। রুহান জিজ্ঞেস করল, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটিকে?
সিস্টেম লোড করার জন্যে। ছোট করে চুল ছাটা মহিলাটা বলল, ক্রিভন থেকে একটা অর্ডার এসেছে। ক্রিভন অনেক বড় যুদ্ধবাজ মানুষ। সে একটা যুদ্ধের এক্সপার্ট কিনতে চায়।
রুহান অবাক হয়ে বলল, এই বাচ্চা মেয়েটা যুদ্ধে এক্সপার্ট?
মহিলাটি হেসে বলল, আমরা যখন সিস্টেম ললাড করে দেব সে এক্সপার্ট হয়ে যাবে। এমনিতে কেউ বুঝবে না কিন্তু যখন স্টিমুলেশন দেবে তখন। বুঝবে।
কেমন করে স্টিমুলেশন দেয়?
মাথার পিছনে ইলেকট্রড লাগানো আছে সেখানে হাই ফ্ৰিকয়েন্সী পালস পাঠাতে হয়।
রুহানের শরীর কেমন যেন গুলিয়ে আসে, সে এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তার বিশ্বাস হতে চায় না একজন মানুষকে অন্য একজন মানুষ এভাবে ব্যবহার করতে পারে।
মহিলাটি রুহানের বিস্ময়টি ধরতে পারল না, বেশ সহজ গলায় বলল, তুমি দেখতে চাও আমরা কেমন করে সিস্টেম লোড করি?
রুহানের একবার মনে হলো বলে না, সে দেখতে চায় না। কিন্তু কী হলো কে জানে, সে বলল, হ্যাঁ দেখতে চাই।
তাহলে এসো আমাদের সাথে।
পাহাড়ের মতো দুজন মানুষ ক্রানা নামের মেয়েটাকে প্রায় টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার পিছু পিছু অন্যেরা হাঁটতে থাকে। রুহান সবার পিছনে পিছনে হেঁটে আসে। সে নিজের ভেতরে কেমন জানি গভীর এক ধরনের বিষণ্ণতা অনুভব করে।
মাঝারি আকারের একটা ঘরের ঠিক মাঝখানে উঁচু একটা শক্ত টেবিলে ক্রানাকে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হলো। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কিছু মনিটর লাগানো হয়েছে। ঘরের এক কোনায় বড় একটা যন্ত্রপাতির প্যানেল সেখানে ছোট করে চুল ছাটা মহিলাটি যন্ত্রপাতিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়স্ক মানুষটি। বিশালদেহী মানুষ দুজন দরজার কাছে দুটি টুলে চুপচাপ বসে আছে, তাদের মুখ ভাবলেশহীন, দেখে মনে হয় তাদের চারপাশে কী ঘটছে সেটা তারা জানে না।
কিহি ক্রানার হাত ধরে রেখে ফিসফিস করে তার সাথে কথা বলছে, তাকে শান্তনা দিচ্ছে সাহস দিচ্ছে। ক্রানার চোখের দৃষ্টি অপ্রকৃতস্থ, এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে সে উপরের দিকে তাকিয় আছে।
রুহান কিছুক্ষণ ক্ৰানার দিকে তাকিয়ে রইল, দৃশ্যটি তার কাছে অত্যন্ত নিষ্ঠুর বলে মনে হলো, সে হেঁটে ঘরের এক কোনায় বসানো যন্ত্রপাতিগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ছোট করে চুল ছাটা মহিলাটি দক্ষ হাতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতিগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়েছিল। আমাদের কপাল খারাপ–পৃথিবীতে এরকম দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে গেল তা না হলে বিজ্ঞান নিশ্চয়ই আরো এগোত।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, উঁহু। প্রকৃতি বাড়াবাড়ি সহ্য করো না। মানুষ বিজ্ঞান নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিল তাই প্রকৃতি এটা বন্ধ করে দিয়েছে।
রুহান একটু অবাক হয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখের দিকে তাকাল, সে কী সত্যিই এটা বিশ্বাস করে?
মহিলাটি কয়েকটা সুইচ অন করে বলল, আমাদের এই যন্ত্রটা আছে বলে সক্রেটিসদের মাথায় সিস্টেম লোড করতে পারছি। ওদের বিক্রি করে কিছু ইউনিট কামাই করছি। যাদের নেই তারা কী করবে?
মধ্যবয়স্ক মানুষটা বলল, তারা আঙুল চুষবে। তারপর হা হা করে হাসতে লাগল যেন খুব বড় একটা রসিকতা করে ফেলেছে।
মহিলাটি মাথা তুলে চারদিকে তাকিয়ে বলল, সবাই রেডি? আমি তাহলে কাজ শুরু করি?
রুহান জিজ্ঞেস করল, এখন কী করবে?
মহিলাটি প্যানেলের একটা স্বচ্ছ খুপরিতে উজ্জ্বল একটা ক্রিস্টাল দেখিয়ে বলল, এই যে এই ক্রিস্টালটাতে পুরো সিস্টেম আছে। আমি ক্রানার ইলেকট্রডের ভিতর দিয়ে এটা মাথার ভেতরে পাঠাব।
তখন কী হবে?
মাথায় নতুন সিনান্স কানেকশন হবে-দরকার হলে তার পুরানো কানেকশন খুলে নেবে।
তাহলে কী হয়?
বলতে পার এই মেয়েটা একটা নতুন মানুষ হয়ে যাবে–আসলে ঠিক মানুষ না। একটা নতুন যন্ত্র।
রুহান বুকের ভেতর নিঃশ্বাস আটকে রেখে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। কী অবলীলায় কী ভয়ঙ্কর একটা কথা বলে দিল।
মহিলাটি একটা সুইচ টিপে দিতেই ঘরের মাঝখানে টেবিলে বেঁধে রাখা ক্ৰানার দেহটা ধনুকের মতো বেঁকে যায়, সে রক্ত শীতল করা কণ্ঠস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে।
রুহান ক্রানার কাছে ছুটে গিয়ে বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তার শরীর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, চোখ দুটো মনে হচ্ছে কোঠর থেকে ঠেলে বের হয়ে আসবে।
রুহান আর্তস্বরে চিৎকার করে বলল, বন্ধ করো। বন্ধ করো এক্ষুনি!
ছোট করে ছাটা চুলের মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, বন্ধ করব? কী বন্ধ করব?
যেটা করছ সেটা। দেখছ না মেয়েটা যন্ত্রণায় কী করছে?
মহিলাটি মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে একবার তাকাল তারপর খানিকটা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, যন্ত্রণা ছাড়া মানুষ সিস্টেম লোড করবে কেমন করে? তোমাকে বলেছি না সিনান্স কানেকশান উপড়ে ফেলা হচ্ছে
কতক্ষণ থাকবে এরকম?
এই তো কিছুক্ষণ। ধৈর্য ধরো দেখবে ঠিক হয়ে যাবে।
রুহান আবার ক্রানার কাছে ফিরে গেল, কিহি তার দুই হাত শক্ত করে ধরে তার সাথে নিচু গলায় কথা বলছে, ক্রানা, সোনামণি আমার। একটু ধৈর্য ধরো, একটুখানি সহ্য করো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই যে দেখ আমি তোমার পাশে আছি, তোমার দিকে তাকিয়ে আছি, তোমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছি। এই দেখ আমি ঈশ্বরের কাছে তোমার জন্যে প্রার্থনা করছি–যেন তোমার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। ক্রানা সোনামণি আমার
রুহান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল এবং দেখতে পেল খুব ধীরে ধীরে ক্রানার শরীর দুমড়ে মুচড়ে উঠতে উঠতে এক সময় শান্ত হয়ে আসে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। সে মুখ হা করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে চোখ খুলে তাকাল। কিহি ক্ৰানার মুখের কাছাকাছি নিজের মুখটি নিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, এখন তোমার কেমন লাগছে ক্ৰানা।
ক্রানা শান্ত দৃষ্টিতে কিহির দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, আমার ভালো খারাপ কিছুই লাগছে না। সত্যি কথা বলতে কী আমার কোনোরকম অস্তিত্ব আছে বলেই মনে হচ্ছে না।
রুহান একটু অবাক হয়ে ক্ৰানার দিকে তাকাল, মেয়েটি খানিকক্ষণ আগেই পুরোপুরি অপ্রকৃতস্থ ছিল অথচ এখন একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলছে। কিহি কানার হাত স্পর্শ করে বলল, তুমি আমাকে চিনতে পারছ ক্ৰানা।
হ্যাঁ। অবশ্যই চিনতে পারছি। তুমি হচ্ছ কিহি। আমাদের সবার প্রিয় কিহি। তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি কে? তাকে দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে।
এ হচ্ছে রুহান।
ক্ৰানা ফিসফিস করে বলল, রুহান রুহান!
ঘরের কোনায় যন্ত্রপাতির প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট করে ছাটা চুলের মেয়েটি গলা উঁচিয়ে ডাকল, বুড়ো।
কিহি মনে হয় এই অবহেলার ডাকটিতে অভ্যস্ত, বেশ সহজভাবেই বলল, বলো।
তুমি কিছুক্ষণ মেয়েটার সাথে কথা বলতে পারবে? যেন সে সজাগ থাকে?
পারব।
চমৎকার! আমরা তার অবচেতন মনে কাজ করছি।
ঠিক আছে। বলে কিহি আবার ক্রানার উপর ঝুঁকে পড়ল। বলল, তোমার সব কথা মনে আছে কানা?
ক্ৰানা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। মনে আছে।
তুমি এখন আমাকে চিনতে পারছ ক্ৰানা?
হ্যাঁ। চিনতে পারছি। তুমি কিহি। আমাদের সবার খুব প্রিয় একজন মানুষ তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুহান।
তুমি কী আমার সব কথা বিশ্বাস করবে ক্ৰানা?
করব। নিশ্চয়ই করব।
তাহলে শোন। আমাদের মনে যে দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ-বেদনা হয় সেগুলো হচ্ছে মস্তিষ্কের ভেতরের বিশেষ এক ধরনের পরিস্থিতি।
ক্ৰানা নামের মেয়েটার মুখে খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সে বলে, আমি জানি। আমার মস্তিষ্কে এখন এরা কিছু একটা করছে এখন আমি সবকিছু বুঝতে পারি।
কিহি গলা নামিয়ে বলল, হ্যাঁ। এরা তোমার মস্তিষ্কে এক ধরনের স্টিমুলেশন দিচ্ছে। যখন স্টিমুলেশন বন্ধ করে দেবে তখন তুমি আবার আগের মতো হয়ে যাবে। স্টিমুলেশন থাকতে থাকতে আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই যেটা তুমি সবসময় মনে রাখবে।
কী কথা কিহি? আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমরা তোমার সব কথা মনে রাখব।
কিহি কানার হাত ধরে নরম গলায় বলল, দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ-বেদনাযন্ত্রণা-সুখ সবকিছুই যদি মস্তিষ্কের বিশেষ একটা অবস্থা হয়ে থাকে তাহলে কেন আমরা সেটা নিয়ন্ত্রণ করব না? কেন আমরা আমাদের মস্তিষ্কের পরিস্থিতিকে সবসময় আনন্দ কিংবা সুখের পরিস্থিতি করে রাখব না? তাহলে যখন দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণা আসবে সেটাও আমাদের কষ্ট দিতে পারবে না!
ক্ৰানা ফিসফিস করে বলল, সেটা আমরা কেমন করে করব?
কিহি ক্ৰানার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি মনে করে নাও পৃথিবীতে কোনো অশুভ কিছু নেই। মনে করো সবাই ভালো। মনে মনে কল্পনা করো পৃথিবীটা খুব সুন্দর একটা জায়গা। এখানে শুধু আনন্দ আর সুখ। ক্রানা তুমি মনে মনে কল্পনা করো যে তুমি খুব খু-উব সুখী একজন মানুষ। তারপর তুমি মনের ভেতরে সেই সুখটা ধরে রাখ। পারবে না?
ক্ৰানা ধীরে ধীরে তার চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ সেভাবে থাকে। তার মুখে এক ধরনের অপার্থিব হাসি ফুটে ওঠে, দেখে মনে হতে থাকে তার ভেতরে এক ধরনের অলৌকিক শান্তি এসে ভর করেছে। চোখ দুটো বন্ধ করে সে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ কিহি। আমি পারছি। আমার ভেতরে এক ধরনের গভীর শান্তি এসেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিতে পারব। কারো বিরুদ্ধে আমার আর কোনো ক্ষোভ নেই কিহি। আমার ভেতরে আর কোনো আক্রোশ নেই।
ক্রানার হাতে অল্প চাপ দিয়ে কিহি বলল, চমৎকার! এটা তোমার ভেতর ধরে রাখতে পারবে না?
ক্রানা বলল, আমি জানি না। এখন তো আমার মস্তিষ্কের ভেতর স্টিমুলেশন দিচ্ছে তাই কাজটা খুব সহজ। যখন স্টিমুলেশন থাকবে না তখন কী হবে আমি জানি না।
নিজের উপর বিশ্বাস রাখ ক্ৰানা, তুমি পারবে। তোমার কাজটা আরো সহজ করে দিচ্ছি। কিহি তার ডান হাতটা জানার চোখের সামনে ধরে বলল, এই দেখ আমার হাতে একটা ক্রস আঁকা আছে। যখন তুমি মনে মনে সুখ আর আনন্দ আর গভীর এক ধরনের শান্তি অনুভব করছ তখন তুমি এই ক্রসটির দিকে তাকিয়ে থাক। তোমার মস্তিষ্কে তাহলে এর স্মৃতি রয়ে যাবে। ভবিষ্যতে। যখনই তুমি এই ধরনের একটি ক্রস চিহ্ন দেখবে সাথে সাথে তোমার এই গভীর আনন্দ, সুখ আর শান্তির কথা মনে হবে।
কিন্তু আমি কোথায় দেখব এই ক্রস?
দেখবে। অনেক জায়গায় দেখবে। দুটো গাছের ডাল একটার উপর দিয়ে আরেকটা যাবার সময় ক্রস চিহ্ন তৈরি করে। মানুষ কিছু একটা মনে রাখার জন্যে ক্রস চিহ্ন আঁকে। তোমার দুই হাত যখন তোমার কোলের উপর রাখ একটা হাত অন্য হাতের উপর ক্রস তৈরি করে। মানুষ পায়ের উপর পা রেখে বসে। সেটাও ক্রস। তোমার চারপাশে ক্রস, ক্ৰানা। কাজেই তুমি ভুলবে না। কিছুতেই ভুলবে না।
ঠিক আছে।
তুমি তাহলে আমার হাতের চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাক। বুকের ভেতর গভীর আনন্দ, সুখ আর শান্তি অনুভব করতে করতে তাকিয়ে থাক। প্রিয় ক্রানা আমার, সোনামণি, তোমার জন্যে আমাদের সবার গভীর ভালোবাসা। গভীর গভীর ভালোবাসা। .
রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে কিহি এবং ক্রানার দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে মনে হতে থাকে সে বুঝি কোনো একটি অলৌকিক জাদুমন্ত্রের প্রক্রিয়া দেখছে। কী গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে কিহি তার প্রত্যেকটা কথা উচ্চারণ করছে। আর কী সহজেই ক্ৰানা তার প্রত্যেকটা শব্দ বিশ্বাস করছে। ক্রানার মুখে গভীর এক ধরনের প্রশান্তির চিহ্ন, দেখে মনে হয় পৃথিবীর কোনো নীচতা, হীনতা কোন ষড়যন্ত্র, কোনো অন্যায়, কোনো অবিচার তাকে বুঝি আর কোনোদিন স্পর্শ করতে পারবে না।
খুব ধীরে ধীরে একসময় ক্ৰানার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। গভীর এক ধরনের ঘুমে সে অচেতন হয়ে পড়ে।
ঘরের এক কোনায় প্যানেলের সামনে বসে থাকা ছোট করে ছাটা চুলের মহিলাটি মুখে এক ধরনের সন্তুষ্টির শব্দ করে বলল, চমৎকার! আরো একটা সক্রেটিস রেডি।
মধ্যবয়স্ক মানুষটা বলল, কোনো ঝামেলা ছাড়া শেষ হলো।
মহিলাটি বলল, হ্যাঁ, এর জন্যে আমাদের বুড়োকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। সে কত কী আজগুবি কথা বলে আর আমাদের বেকুব সক্রেটিসরা তার সব কথা বিশ্বাস করে বসে থাকে।
কিহি বলল, এগুলো আজগুবি কথা না। আমি যেটা বলি সেটা বিশ্বাস করেই বলি। এটা এক ধরনের সম্মোহন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। মহিলাটি হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দিয়ে বলল, আমাদের সক্রেটিসরা যদি শান্তিতে থাকে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। স্টিমুলেশন দেয়ার সময় ঠিক ঠিক তথ্যগুলো দিতে পারলেই হলো।
পাহাড়ের মতো বড় বড় মানুষগুলো এবার উঠে আসে। ক্রানার অবচেতন দেহটা একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে তারা ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, কিহি ঘুমন্ত ক্রানার মুখমণ্ডল আলতোভাবে স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলল, বিদায় ক্ৰানা। সোনামণি আমার।
ক্রানাকে নিয়ে বের হয়ে যাবার পর বৃদ্ধ কিহিকে কেমন যেন অসহায় দেখায়। দেখে মনে হয় কেউ বুঝি তার ভেতর থেকে কিছু একটা উপড়ে নিয়ে চলে গেছে।
রুহান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। তার বুকের ভেতর বিষণ্ণতাটুকু আরো গভীরভাবে চেপে বসেছে।
০৬. এই অস্ত্রটার নাম মেগাট্রন
এই অস্ত্রটার নাম মেগাট্রন। কমবয়সী মানুষটা ভারী অস্ত্রটা হাত বদল করে বলল, কে এর নাম মেগাট্রন রেখেছে জানি না, কিন্তু খুব স্বার্থক নামকরণ। এটি আসলেই একটা মেগা অস্ত্র। প্রতি সেকেন্ডে দশটা গুলি করতে পারে, লেজার লক অটোমেটিক। অত্যন্ত চমৎকার অস্ত্র–শুধু একটা সমস্যা। অস্ত্রটা ভারী। সব মানুষ সহজে এটা নাড়াচাড়া করতে পারে না।
রুহান এক দৃষ্টে কমবয়সী মানুষটার দিকে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো শুনছে, কিন্তু ঠিক মনোযোগ দিতে পারছে না। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ তাকে অস্ত্রের উপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
অস্ত্র বিশেষজ্ঞ মানুষটি বিশাল মেগাট্রনটি টেবিলের উপর রেখে তুলনামূলকভাবে ছোট একটা অস্ত্র হাতে নিয়ে বলল, এটার নাম ক্রিকি। ক্রিকি প্রায় মেগাট্রনের মতোই তবে এর গুলির ভর একটু কম। অস্ত্রটা ক্রোমিয়াম এলয় দিয়ে তৈরি, তাই এর ওজন হালকা। অপরাধজগতে খুব জনপ্রিয়। গত খেলায় খেলোয়াড়দের কেউ কেউ এটা ব্যবহার করেছে। মানুষটা অস্ত্রটা টেবিলে রেখে এবারে তৃতীয় একটা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। কুচকুচে কালো এবং হালকা, গুলির লম্বা ম্যাগাজিন বাঁকা হয়ে বের হয়েছে। অস্ত্র বিশেষজ্ঞ মানুষটা মুখে সন্তুষ্টির একটা শব্দ করে বলল, তবে এটা হচ্ছে খেলোয়াড়দের সবচেয়ে প্রিয় অস্ত্র। ব্ল্যাক মার্কেটে এর দাম এখন তেতাল্লিশ হাজার ইউনিট। এত হালকা যে হাতে নিলে মনে হয় বুঝি খেলনা, কিন্তু এটা খেলনা নয়, এটা একেবারে খাঁটি অস্ত্র। প্রতি সেকেন্ডে গুলি করে পাঁচটা—তবে সেই পাঁচটার ট্রাজেক্টরী নিখুঁত। খেলোয়াড়রা তো যুদ্ধ করে না যে তাদের প্রতি সেকেন্ডে দশটা গুলি দরকার—খেলোয়াড়রা হিসেব করে গুলি করে। এর আগের টুর্নামেন্টের শেষ খেলায় মাত্র একটা গুলি খরচ হয়েছিল। বিশ্বাস হয়?
রুহান এক ধরনের ক্লান্তি নিয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবীতে এত ধরনের অস্ত্র আছে কে জানত। শুধুমাত্র মানুষকে হত্যা করার জন্যে মানুষেরাই এই অস্ত্রগুলো আবিষ্কার করেছে রুহানের সেটা বিশ্বাস হতে চায় না।
কম বয়সী অস্ত্র বিশেষজ্ঞ রুহানের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোনটা নিতে চাও?
রুহান বলল, আমি কোনোটাই নিতে চাই না।
রুহান খুব একটা মজার কথা বলেছে এরকম ভান করে কম বয়সী অস্ত্র বিশেষজ্ঞ হা হা করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, একজন খেলোয়াড় খালি হাতে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে দৃশ্যটা কল্পনা করতেও কষ্ট।
খেলোয়াড়ের হাতে অস্ত্র থাকতেই হবে?
হ্যাঁ। খেলাটি হচ্ছে তোমার প্রতিপক্ষকে হত্যা করা। তুমি যদি হত্যাই করতে না পার তাহলে কে তোমার খেলা দেখবে?
রুহান বিষণ্ণ দৃষ্টিতে অস্ত্রগুলোর দিকে তাকায়। একটা একটা করে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, নেড়েচেড়ে দেখে। অস্ত্র বিশেষজ্ঞ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে তার অঙ্গভঙ্গি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে।
শেষ পর্যন্ত রুহানকে তার শরীরের কাঠামোর সাথে মিলে যায় এরকম কয়েকটা অস্ত্র বেছে দেয়া হলো। একজন খেলোয়াড় যতগুলি খুশি অস্ত্র নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যেহেতু পুরো খেলাটিই হচ্ছে এক ধরনের ক্ষীপ্রতার খেলা তাই কেউ বেশি অস্ত্র নিয়ে যায় না, দুটি কিংবা খুব বেশি হলে তিনটি ভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিয়ে যায়। অস্ত্রগুলো কোমর থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয় কিংবা উরুতে
বেঁধে নেয়া হয়। কেউ কেউ একটা পিঠে ঝুলিয়ে রাখতে পছন্দ করে। গুলির বাড়তি ম্যাগাজিনগুলো বেল্টের মতো করে বুকে কিংবা পায়ের সাথে বেঁধে নেয়া হয়। প্রথম দিন রুহানকে তার অস্ত্রগুলোর সাথে পরিচিত করানো হলো। দূরে টার্গেট তাকে দিয়ে লক্ষ্যভেদ করানো হলো। যে মানুষ জীবনে কখনো অস্ত্র হাতে স্পর্শ করে নি সেই হিসেবে তার নিশানা অসাধারণ। রুহানের ভেতরে এক ধরনের সহজাত ক্ষীপ্রতা আছে যেটা সচরাচর মানুষের ভেতর চোখে পড়ে না। রুহান নিজেও সেটা জানত না।
সারাদিন প্রশিক্ষণ নিয়ে রুহান সন্ধ্যেবেলা পরিশ্রান্ত ঘর্মাক্ত আর ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। কিছুক্ষণ নিজের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে তারপর বাথরুমে টগবগে গরম পানিতে রগড়ে রগড়ে গোছল করে বের হয়ে আসে। টেবিলে তার খাবার ঢাকা দেয়া ছিল, রুহান ঢাকনা খুলে খেতে বসে। ফলের রস, যবের রুটি, ভেড়ার মাংসের স্টু, গরম স্যুপ আর কাচা সবজি। বহুদিন সে একরম খাবার খাওয়া দূরে থাকুক চোখেই দেখে নি। খেতে বসে তার হঠাৎ করে মায়ের কথা মনে পড়ল, তার ছোট দুটি বোনের কথা মনে পড়ল। খাবার টেবিলে শুকনো রুটি আর পাতলা পানির মতো স্যুপ খেতে গিয়ে ছোট বোন দুটি কী আপত্তিই না করত। ক্ষুধার্ত রুহানের হঠাৎ করে খিদেটা যেন উবে যায়। সে দীর্ঘসময় খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর খানিকটা রুটি আর এক বাটি স্যুপ খেয়ে উঠে যায়।
রুহান তার নিজের ঘর থেকে বের হয়ে হলঘরের দিকে এগিয়ে যায়, তার খুব সৌভাগ্য যে তাকে ছোট একটা ঘরের ভেতর তালাবদ্ধ করে রাখে নি। তাকে তার ঘর থেকে বের হতে দিয়েছে অন্যদের সাথে মেলামেশা করতে দিয়েছে। মাথায় ইলেকট্রড বসানো ছেলে-মেয়েগুলোর সাথে কথাবার্তা বলার খুব একটা সুযোগ নেই, কিন্তু বৃদ্ধ কিহি খুব চমৎকার একজন সঙ্গী। রুহান বড় হলঘরে গিয়ে কিহিকে খুঁজে বের করল। সে একটা নরম চেয়ারে গা ড়ুবিয়ে বসে। আছে, চোখের দৃষ্টি বহুদূরে। রুহানকে দেখে কিহি সোজা হয়ে বসে বলল, কী খবর রুহান। খেলোয়াড় হবার প্রথম দিনটি তোমার কেমন গেছে?
রুহান কিহির পাশে বসে বলল, আমি ঠিক যেরকম ভেবেছিলাম, সেরকম।
তুমি কী রকম ভেবেছিলে?
অর্থহীন শারীরিক ব্যাপার। সহজাত ব্যাপার। রুহান একটু থেমে কিহির কে তাকিয়ে বলল, তুমি বলতে পারবে কিহি, পৃথিবীটা এরকম কেন হয়ে গেল? পৃথিবীর মানুষ কী এর চাইতে ভালো একটা পৃথিবী পেতে পারে না?
অবশ্যই পারে। কিহি রুহানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এবং তুমি নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ পৃথিবীর মানুষ সেই পৃথিবী পাবে।
কখন পাবে? কীভাবে পাবে?
সেটা আমি জানি না। কিহি মাথা নেড়ে বলল, আমি ইতিহাস ঘেটে ..দখেছি মানুষের সভ্যতা মাঝে মাঝেই এরকম অন্ধ কানাগলিতে ঘুরপাক খায় 1•• শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে বের হয়ে আসে।
কীভাবে বের হয়ে আসে?
কিহি দুর্বলভাবে হেসে বলল, সেটাও আমি জানি না। মানুষের একেবারে ভেতরে মনে হয় মনুষ্যত্ব বলে একটা জিনিস থাকে। যত দুঃসময়ই হোক সেই মনুষত্ব বুকের ভিতরে ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকে। যখন সবকিছু অন্ধকারে ঢেকে যায় তখন সেই মনুষ্যত্বের ছোট আগুনটা হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে।
রুহান কিহির দিকে তাকিয়ে রইল। এই বৃদ্ধ মানুষটি কথা বলে খুব সুন্দর করে। তার কথা রুহানের খুব বিশ্বাস করার ইচ্ছে করে, কিন্তু সে যেটা বলছে সেটা কী আসলেই সত্যি?
রুহান কিহির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বলছ এক সময় আবার মানুষের সভ্যতা মাথা তুলে দাঁড়াবে?
হ্যাঁ। মাথা তুলে দাঁড়াবে।
রুহান নিজেকে দেখিয়ে বলল, এই যে, আমাকে দেখ।
কিহি হাসিমুখে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখছি।
তোমার কী মনে হয় আমি একজন রক্তপিপাসু খুনি?
না। মোটেও মনে হয় না রুহান। তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি একজন খুব হৃদয়বান তরুণ।
কিন্তু আমাকে কেমন করে মানুষ খুন করতে হয় তার ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। কত দ্রুত কতগুলো অস্ত্র দিয়ে আমি কতগুলো মানুষকে খুন করতে পারি সেটাই হবে আমার কাজ। আর আমি যদি সেটা না করি, তাহলে কী হবে জান?
কিহি বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল, জানি।
তাহলে আমাকে অন্যেরা মেরে ফেলবে। এখন তুমিই বল কিহি, আমি কী বেঁচে থাকব না মরে যাব?।
কিহি তার হাত দিয়ে রুহানের হাত স্পর্শ করে বলল, তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে রুহান। মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
একজন খুনির কী মানুষের মর্যাদা আছে?
কিহি মাথা নেড়ে বলল, না। নেই।
তাহলে?
কিহি বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল, আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তর জানি রুহান।
রুহান আর কিহি দুজন চুপচাপ বসে থাকে। সামনে অপ্রকৃতস্থ তরুণ তরুণীরা তাদের শিশুর মতো ভঙ্গিতে নিজেদের সাথে কথা বলছে, তর্ক করছে, কেউ কেউ ঝগড়া করছে। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে তাদের দেখতে দেখতে রুহান একসময় বলল, কিহি, তুমি বিশ্বাস করো একসময় মানুষ আবার তাদের সভ্যতা ফিরে পাবে।
হ্যাঁ। আমি বিশ্বাস করি।
সভ্যতার জন্যে দরকার জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা ও গবেষণা।
হ্যাঁ।
রুহান তার গলায় ঝোলানো ক্রিস্টাল রিডারটা দেখিয়ে বলল, তার জন্যে দরকার আমাদের ক্রিস্টাল রিডার। যেটা আমার জন্যে তথ্য বাঁচিয়ে রাখবে, তথ্য দেয়া-নেয়া করবে।
হ্যাঁ। কিহি আবার মাথা নাড়ল।
কিন্তু আমি শুনেছি গত পঞ্চাশ বছরে পৃথিবীতে একটা ক্রিস্টাল রিডার তৈরি হয়নি। তাহলে আমরা নতুন কিছু শিখব কেমন করে?
কিহির মুখে সূক্ষ্ম এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে রুহানের হাতটা নিজের কাছে টেনে এনে যেখানে কিছু বিদঘুটে চিহ্ন এঁকে দেয়া হয়েছে সেটা দেখিয়ে বলল, এটা কী তুমি জান?
না। এটা কী?
এখানে একটা সংখ্যা লেখা আছে।
রুহান অবাক হয়ে বলল, সংখ্যা লেখা আছে?
হ্যাঁ। আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে সংখ্যাটি হচ্ছে ছয় শূন্য তিন তিন নয় চার দুই।
রুহান অবাক হয়ে বলল, তুমি এটা কেমন করে বললে?
আমি এটা পড়েছি। যখন ক্রিস্টাল রিডার ছিল না তখন মানুষ লিখত এবং সেই লেখা পড়ত। প্রত্যেক কথা লেখা হতো বর্ণমালা দিয়ে। ক্রিস্টাল রিডার আসার পর ভাষার এই লিখিত রূপটা উঠে গেছে। এখন আমরা সরাসরি ক্রিস্টাল রিডারে বলি, ক্রিস্টাল রিডার থেকে শুনি। সেটাতে সবকিছু বাঁচিয়ে রাখি।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, আমি বর্ণমালার কথা শুনেছি। আমাদের গ্রামে একজন বুড়ো মানুষ ছিল, কুরু। সে আমাকে বলেছিল।
কিহি বলল, যদি সত্যি সত্যি ক্রিস্টাল রিডার পৃথিবী থেকে উঠে যায় তাহলে আমাদের এক ধাপ পিছিয়ে যেতে হবে। আমাদের আবার বর্ণমালা শিখতে হবে। আমাদের আবার পড়তে শিখতে হবে, লিখতে শিখতে হবে।
রুহান কিহির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি লিখতে পড়তে জানো?
হ্যাঁ। আমি একটু একটু শিখেছি। আমি বুড়ো মানুষ, আমার অনেক অবসর। আমি আমার অবসরে এ ধরনের অর্থহীন কাজ করি।
রুহান হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, তুমি আমাকে লিখতে পড়তে শেখাবে কিহি।
কেন শেখাব না! অবশ্যই শেখাব। বর্ণমালাগুলো তোমার ক্রিস্টাল রিডারে ঢুকিয়ে নাও, দেখবে দেখতে দেখতে শিখে যাবে।
আমি কোথায় বর্ণমালাগুলো পাব?
আমার কাছে আছে। আমি তোমাকে দেব।
ধন্যবাদ কিহি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
কিহি তার আরামদায়ক চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, পৃথিবীর পুরো জ্ঞানভাণ্ডারই এরকম বর্ণমালা দিয়ে লেখা আছে।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, আমিও এটা শুনেছি।
আরো প্রাচীন কালে সেগুলো রাখা হতো কাগজে লিখে, সেগুলোর নাম ছিল বই।
বই?
হ্যাঁ। এখনো পৃথিবীর অনেক জায়গায় বড় বড় লাইব্রেরীতে বই সাজানো আছে। কেউ আর সেগুলো পড়তে পারে না। কিন্তু তবু সাজিয়ে রাখা আছে। কিহি হঠাৎ ঘুরে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কখনো বই দেখেছ?
না।
আমার কাছে একটা বই আছে। তুমি দেখতে চাও?
হ্যাঁ। দেখতে চাই। রুহান উত্তেজিত হয়ে বলল, দেখাবে আমাকে?
কিহি হেসে বলল, কেন দেখাব না? অবশ্যই দেখাব। এসো আমার সাথে।
রুহান কিহির পিছনে পিছনে লম্বা করিডোর ধরে হেঁটে তার ছোট ঘরটিতে হাজির হলো। একটা শক্ত বিছানার পাশে একটা টেবিল, সেখানে কিছু দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র। সেখান থেকে চতুষ্কোণ একটা জিনিস হাতে তুলে নিয়ে কিহি রুহানের হাতে দিল। রুহান সেটা হাতে নিয়ে খুলে, ভেতরে সারি সারি সাদা পৃষ্ঠা, সেই পৃষ্ঠাগুলোতে বিচিত্র নক্সার মতো চিহ্ন সাজানো। এগুলো নিশ্চয়ই বর্ণমালা দিয়ে লেখা। রুহান কিছুক্ষণ বিস্ময় নিয়ে বইটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর সেটি কিহির হাতে দিয়ে বলল, তুমি এটা পড়তে পারবে?
কিহি হেসে বলল, হ্যাঁ। পারব।
আমাকে একটু পড়ে শোনাও না।
কিহি বইটি তার চোখের সামনে খুলে ধরে বলল, এটা একটা কবিতার বই। কোনো একজন প্রাচীন কবির লেখা কবিতা। এই যে দেখ, এখানে লেখা–
ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন খেতে মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম–সাপের খোলস নীড় শীত
এইসব উত্রায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ–কেমন নিবিড়।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কী সুন্দর কথাগুলো।
কিহি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। কথাগুলো খুব সুন্দর। যখন শুরু করেই দিয়েছি, তাহলে তোমাকে বর্ণমালার কয়েকটা অক্ষর দেখিয়ে দিই।
রুহান বলল, হ্যাঁ, দেখাও। সে বইয়ের একটা পৃষ্ঠা খুলে তার উপর ঝুঁকে পড়ল।
সারাটি দিন রুহানকে অস্ত্রের ব্যবহার আর শারীরিক দক্ষতার উপর ট্রেনিং দেয়া হয়। ক্লান্ত ঘর্মাক্ত হয়ে ফিরে এসে সে গোসল করে খেয়ে বর্ণমালাগুলো নিয়ে বসে। দেখতে দেখতে সে পড়তে শিখে গেল। তার এখনো বিশ্বাস হয় না পৃথিবীর সব মানুষ একসময় পড়তে পারত। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যে ক্রিস্টাল রিডারে অভ্যস্ত বলে তার কাছে বর্ণমালা ব্যবহার করে পড়ার এই পুরো প্রক্রিয়াটাকে মনে হচ্ছে আদিম একটা পদ্ধতি। কিন্তু সত্যি সত্যি যদি পৃথিবী থেকে একদিন ক্রিস্টাল রিডার উঠে যায় তখন তো জ্ঞান-বিজ্ঞানকে ধরে রাখার জন্যে এই বর্ণমালার কাছেই ফিরে আসতে হবে। প্রথম প্রথম পড়তে এবং পড়ে কিছু একটা বুঝতে তার যেরকম কষ্ট হতো এখন আর সেটা হয় না। কিহির কাছ থেকে যে কবিতার বইটি এনেছে সেটা সে পড়তে পারে, পড়ে বুঝতে পারে শুধু যে বুঝতে পারে তা নয়, অনুভবও করতে পারে।
দেখতে দেখতে রুহানের জীবনটি মোটামুটি একটা ছকের ভেতর চলে। এলো। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠার পরই তাকে বেশ কিছুক্ষণ ছোটাছুটি করতে হয়। তারপর তাকে কিছু একটা খেতে হয়–স্বাস্থ্যকর এবং বলকারক খাবার। তারপর তাকে কিছুক্ষণ খেলোয়াড়দের নানা ধরনের খেলার ভিডিও দেখতে হয়, সেটা তার জন্যে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। কোন খেলোয়াড়ের কী বিশেষত্ব সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে বোঝানো হয়। কে কোন খেলায় কেন জিতেছে সেটা ব্যাখ্যা করা হয়। দেখতে দেখতে রুহান এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে। তার মাঝে মাঝে মনে হয় সে যদি একজন খেলোয়াড় না হয়ে একজন সক্রেটিস হয়ে যেত তাহলেই কী ভালো হতো? মানুষকে কত সহজে কত দ্রুত খুন করা যায় এই বিদ্যাটা তাহলে অন্তত তাকে নিশ্চয়ই হয়তো শিখতে হতো না।
খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর রুহানকে অস্ত্র হাতে ট্রেনিং শুরু করতে হয়। শরীরের নানা জায়গায় অস্ত্রগুলো বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। সেগুলো তাকে চোখের পলকে টেনে বের করে গুলি করতে হয়। নানা ধরনের টার্গেট থাকে সেখানে লক্ষ্যভেদ করতে হয়। রুহান নিজেই বুঝতে পারে, সে সাধারণ একজন মানুষ থেকে দেখতে দেখতে বিচিত্র বোধশক্তিহীন একজন পেশাদার হত্যাকারীতে পাল্টে যাচ্ছে। মানুষকে কত দ্রুত কোথায় আঘাত করতে হবে সেটি বুঝি তার থেকে ভালো করে আর কেউ জানে না। সে কী এটাই চেয়েছিল?
রুহান বুঝতে পারছিল পাহাড়ের কাছাকাছি এই ট্রেনিং সেন্টার থেকে তার বিদায় নেবার সময় চলে আসছে। একজন মানুষকে যতটুকু শেখানো সম্ভব মোটামুটি সবই তাকে শেখানো হয়েছে। এখন তাকে কোনো একটি সত্যিকার খেলায় নামিয়ে দিতে হবে। যেখানে সে মুখোমুখি দাঁড়াবে একজন সত্যিকার মানুষের সামনে, যে মানুষটি হবে ঠিক তার মতো একজন খেলোয়াড়। ঠিক তার মতোই ক্ষীপ্র, তার মতোই মানুষকে হত্যা করার জন্যে প্রস্তুত।
তাই একদিন ভোরবেলা যখন ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করল তার ঘরের ভেতর চারজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারল সে যে সময়ের জন্যে অপেক্ষা করছে সেই সময়টুকু চলে এসেছে।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলল, রুহান, তোমার এখন আমাদের সাথে যেতে হবে।
কোথায় শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়ে রুহান থেমে গেল। জিজ্ঞেস করে কী হবে? রুহান শান্ত গলায় বলল, এখানে আমার সাথে অনেকের পরিচয় হয়েছে। আমি কী তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি?
না। মানুষটি শীতল গলায় বলল, তোমাকে আমরা খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করেছি। বিদায় নেয়ার মতো ছেলেমানুষী মানবিক বিষয়গুলো তোমার ভেতরে থাকার কথা নয়। তোমাকে বুঝতে হবে, তুমি হবে বোধশক্তি ভালোবাসাহীন একটা ক্ষীপ্র যন্ত্র।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেবার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
মানুষটি হাসিমুখে মাথা নাড়ল, রুহানের বিদ্রুপটুকু ধরতে পারল না।
এবারে একজন একটা কালো কাপড় নিয়ে এলো। বলল, তোমার চোখ দুটো বেঁধে নিতে হবে রুহান।
রুহান একবার ভাবল সে জিজ্ঞেস করবে, কেন আমার চোখ বেঁধে নিতে হবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। কী হবে জিজ্ঞেস করে?
চোখ বাঁধা অবস্থায় রুহানকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন সে কিছু দেখতে না পেয়েও বুঝতে পারছিল হল ঘরে অপ্রকৃতস্থ কিছু তরুণ-তরুণী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না কিন্তু তারপরেও সে অনুভব করল তারা বুঝি ফিসফিস করে বলছে, বিদায়। বিদায়। রুহান রুহান।
০৭. মেয়েটি রুহানের থুতনি ধরে
মেয়েটি রুহানের থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে বলল, ইশ! তোমার চেহারাটা কি মিষ্টি! দেখে মনেই হয় না যে তুমি এত বড় খুনি।
রুহান কিছু বলল না। সে কী আসলেই খুব বড় খুনি? মেয়েটা তার মুখটা ডান থেকে বামে নাড়িয়ে বলল, এরকম মিষ্টি চেহারার মানুষ হয়ে তুমি মানুষ খুন করার খেলোয়াড় হলে কেমন করে?
রুহান এবারেও কিছু বলল না। মেয়েটা হাতে খানিকটা কালো রং নিয়ে রুহানের চিবুকের নিচে লাগিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। রুহান বলল, তুমি কী করছ? আমার মুখে রং লাগাচ্ছ কেন?
তোমার মুখে একটু নিষ্ঠুর ভাব আনার চেষ্টা করছি। চোয়ালের হাড় উঁচু থাকলে মানুষকে নিষ্ঠুর দেখায়। চোখটাও গভীরে ঢোকাতে হবে। চুলগুলো আরো ছোট করে ছাটতে হবে।
কেন? আমাকে এরকম নিষ্ঠুর দেখাতে হবে কেন? আমাকে যে কাজে ব্যবহার করছ সেটা কী যথেষ্ট নিষ্ঠুর না?
সেজন্যেই তো এটা জরুরি। একটা নিষ্ঠুর কাজে যাচ্ছে একজন মানুষ, তার চেহারাটা যদি ছোট শিশুর মতো কোমল হয় তাহলে কেমন করে হবে?
মেয়েটা তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখের নিচে খানিকটা রং লাগিয়ে মাথা বাঁকা করে তাকে দেখল। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল, নাহ্। তোমার চেহারায় নিষ্ঠুরতা ঠিক আসছে না।
রুহান বলল, ছেড়ে দাও। আমি হয়তো আর ঘণ্টাখানেক বেঁচে আছি। এখন কী এগুলো ভালো লাগে?
মেয়েটা হাত দিয়ে পাশের টেবিলে ঠোকা দিয়ে বলল, কাঠে ঠোকা। কাঠে ঠোকা। অপয়া কথা বল না। ঘণ্টাখানেক বলছ কেন? তুমি অনেকদিন বেঁচে থাকবে। সব খেলোয়াড়কে খুন করে তুমি হবে খেলোয়াড়দের খেলোয়াড়। হাজার ইউনিট দিয়ে মানুষ তখন তোমার খেলা দেখতে আসবে।
রুহান কোনো কথা বলল না। তার ভেতরে সে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। পাথরের দেয়ালে ঘেরা একটা মাঠের মধ্যে কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে, সেখানে থাকবে ঠিক তার মতো একজন মানুষ হত্যা করতে যার এতটুকু দ্বিধা নেই, শিকারিরা যেভাবে পাখিকে গুলি করে ঠিক সেভাবে গুলি করবে সে। চারপাশে থাকবে হাজার হাজার মানুষ। তারা চিৎকার করবে আনন্দে। মানুষকে খুন করার দৃশ্য কী আসলেই আনন্দের হতে পারে?
মেয়েটা বলল, তুমি কী ভাবছ?
কিছু না।
মানুষ কিছু না ভাবতে পারে না। ভাবনাতে কিছু না কিছু থাকতে হয়। তোমার বলা উচিত ছিল আমি কী ভাবছি, সেটা বলতে ইচ্ছে করছে না।
রুহান বলল, আমি কী ভাবছি বলতে ইচ্ছে করছে না।
ঠিক আছে, বলতে হবে না। মেয়েটা রুহানের মুখে কয়েক জায়গায় একটু রং মাখিয়ে আবার তাকে ভালো করে লক্ষ্য করে, তারপর হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। কোনোভাবেই রুহানকে নিষ্ঠুর রক্তলোভী একটা মানুষে পাল্টে দেয়া যাচ্ছে না।
রুহান জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী মেয়ে?
আমার নাম জেনে তুমি কী করবে?
কিছু করব না। এমনি জানতে চাইছি।
আমার নাম ত্রিনা।
ত্রিনা? কী আশ্চর্য!
কেন? আশ্চর্য কেন?
আমার একটি ছোট বোন আছে, তার নাম ত্রিনা। রুহান এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তোমার কী মনে হয় ত্রিনা, আমি কী কখনো আবার আমার ছোট বোনকে দেখব?
সত্যি কথা বলব?
বলো।
ত্রিনা নামের মেয়েটা বলল, একজন খেলোয়াড়ের ভাই বোন মা এসব থাকতে হয় না। যার আপনজন থাকে সে কখনো খেলোয়াড় হতে পারে না।
রুহান বলল, ও।
ত্রিনা বলল, হ্যাঁ। এখন তুমি কথা বল না, তুমি কথা বললে আমি তোমার মুখে ঠিক করে রং লাগাতে পারি না।
রুহান বলল, ঠিক আছে ত্রিনা। আমি এখন কথা বলব না, ত্রিনা।
রুহান অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, প্রতিবার ত্রিনা কথাটা উচ্চারণ করতেই তার ভেতরে কিছু একটা যেন কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে সত্যিই বুঝি সে তার বোনের সাথে কথা বলছে।
ত্রিনা চলে যাবার পর নীল কাপড় পরা চারজন মানুষ তার অস্ত্রগুলো নিয়ে। এলো। তারা সময় নিয়ে অস্ত্রগুলো তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বেল্ট দিয়ে বেঁধে দিতে থাকে। গুলির ম্যাগাজিন ঝুলিয়ে দিতে থাকে। রুহান বলল, আমাকে যত গুলি দিচ্ছ মনে হচ্ছে একজন নয়, একশজনের সাথে যুদ্ধ করব।
মানুষ চারজনের কেউ তার কথার উত্তর দিল না। একটু পরেই যে ঘটনাটি ঘটবে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা–সেটা নিয়ে কেউ হালকা কিছু বলতে চায় না। বলার সাহস পায় না। রুহানকে অস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে দেবার পর তারা তাকে সামনে হাঁটিয়ে নিতে থাকে। তখন রুহান প্রথমবার অসংখ্য মানুষের কলরব শুনতে পায়। তার সাথে সাথে লাউড স্পীকারে একজন মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। একজন মানুষ চিৎকার করে কিছু একটা বলছে–গলার স্বরে উত্তেজনা। কী বলছে স্পষ্ট করে বুঝতে পারছে না শুধুমাত্র কণ্ঠস্বরে প্রায় উন্মত্ততার কাছাকাছি উত্তেজনাটুকু ধরা পড়ছে।
রুহান পাশের মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, কী বলছে ওখানে?
তোমার কথা।
আমার কথা?
হ্যাঁ।
আমার কী কথা?
তুমি কী ভয়ঙ্করভাবে আজকে তোমার প্রতিপক্ষকে হত্যা করবে, এইসব।
রুহান একটু অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাল। সত্যিই কী তাই বলছে? সত্যিই কী এই ধরনের কথা বলা যায়? বলা সম্ভব?
হঠাৎ হাজার হাজার মানুষের চিৎকার শোনা যায়। রুহান মাথা ঘুরিয়ে পাশের মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, সবাই চিৎকার করছে কেন?
তোমার প্রতিপক্ষ এইমাত্র মাঠে এসেছে। সবাই তাকে অভিনন্দন। জানাচ্ছে। তুমি যখন যাবে, তখন তোমাকেও এভাবে অভিনন্দন জানাবে।
আমি কখন যাব?
এই তো এক্ষুণি যাবে। যখন তোমাকে ডাকবে।
হঠাৎ করে রুহান নিজের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে। কিছুক্ষণের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে সে তার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারছে না। এটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শেষ হয়ে যাক–সে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারবে না। রুহানের নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে আসে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাস জমে ওঠে। সমস্ত শরীর টান টান হয়ে থাকে উত্তেজনায়।
ঠিক এরকম সময়ে পাশে দাঁড়ানো মানুষটি বলল, চল। তোমাকে ডাকছে।
রুহান কোনো কথা না বলে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। সামনে একটা বড় স্টেনলেস স্টীলের গেট। কাছাকাছি আসতেই সেটা নিঃশব্দে খুলে গেল, সাথে সাথে সে বাইরে অসংখ্য মানুষের গুঞ্জন শুনতে পেল। লাউড স্পীকারে মানুষটির কথা হঠাৎ করে স্পষ্ট হয়ে যায়। গমগমে উত্তেজিত গলায় একজন বলছে, তোমরা যারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিষ্ঠুর একটা হত্যাকারীকে দেখার জন্যে ধৈর্য ধরে বসে আছ, সে আসছে। সে তোমাদের সামনে আসছে। এই ভয়ঙ্কর রক্তপিপাসু হিংস্র মানুষটি হচ্ছে রুহান রুহান!
রুহান খোলা গেট দিয়ে হেঁটে বাইরে মাঠে এসে দাঁড়ায়, চারপাশে পাথরের দেয়াল, তার উপরে বসার জায়গা সেখানে হাজার হাজার মানুষ বসে আছে। তাকে দেখে তারা আনন্দে চিৎকার করতে থাকে। রুহানের এখনো বিশ্বাস হয় না, এই হাজার হাজার মানুষ একটা হত্যাকাণ্ড দেখতে এসেছে? কে কাকে হত্যা করতে পারে সেই ভয়ঙ্কর খেলার দর্শক এরা? এরা কী মানুষ? মানুষ কী এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড দেখে আনন্দ পেতে পারে? পাওয়া সম্ভব?
রুহান হাজার হাজার মানুষের চিৎকার আর আনন্দধ্বনি শুনতে শুনতে চারদিকে তাকাল। তখন সে মাঠের অন্য পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে পেল। মাঠটি অনেক বড়, মানুষটি অনেক দূরে পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেহারাটি ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। না দেখেও সে বুঝতে পারে মানুষটির মুখমণ্ডল নিশ্চয়ই পাথরের মতো শক্ত, চোখের দৃষ্টি কুর। রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটি তাকে হত্যা করবে নাকি সে এই মানুষটিকে হত্যা করবে?
হঠাৎ করে আবার সে লাউড স্পীকারে একজন মানুষের গমগমে গলার স্বরে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়। মানুষটি উন্মত্তের মতো চিৎকার করে বলে, তোমরা সবাই যে খেলাটি দেখার জন্যে শত শত কিলোমিটার দূর থেকে এসেছ, এক্ষুণি সেই খেলাটি দেখবে। এই খেলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ খেলা। এই খেলা হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ মানুষকে হত্যা করার খেলা!
বিশাল মাঠের চারপাশে বসে থাকা অসংখ্য মানুষ এক ধরনের আনন্দধ্বনি করে ওঠে।
মানুষটির উত্তেজিত কণ্ঠস্বর আবার গমগম করে ওঠে, এই বিশাল আনন্দ মেলায় সবাইকে স্বাগতম। আজকের এই খেলা যিনি আয়োজন করেছেন, এই অঞ্চলের সেই অলিখিত সম্রাট, যুদ্ধবাজ নেতা সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনীর অধিনায়ক বীর সাহসী যোদ্ধা ক্ৰিভনকে সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দন।
রুহান দেখতে পেল একেবারে সামনের সারিতে বসে থাকা জমকালো পোশাকে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ উঠে দাঁড়াল, উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে তাকে অভিনন্দন জানাল। ক্ৰিভন হাত নেড়ে সবার অভিবাদনের প্রত্যুত্তর দেয় তারপর আবার নিজের জায়গায় বসে যায়।
লাউড স্পীকারে গমগমে গলায় মানুষটি বলে, তোমরা সবাই দেখেছ, মাঠের উত্তর পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুহান রুহান। ভয়ঙ্কর হিংস্র রুহান রুহান। মাঠের দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিদি-নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু রিদি।
আমার প্রিয় দর্শকেরা। তোমরা কী এখন এই দুই হিংস্র মানুষ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উত্তেজনাময় খেলার খেলোয়াড়দের খেলা দেখতে চাও?
হাজার হাজার মানুষ উন্মত্ত গলায় চিৎকার করে ওঠে দেখতে চাই! দেখতে চাই!!
লাউড স্পীকারে আবার মানুষটির গলা শোনা গেল, তাহলে দেখ! রুহান রুহান এবং রিদি হাজার হাজার মানুষ তোমাদের খেলা দেখতে এসেছে। দেখাও তোমাদের খেলা দেখাও। হত্যা করো একজন আরেজনকে। হত্যা করো। হত্যা—হত্যা–
লাউড স্পীকারে ভয়ঙ্কর একটা বাজনা বেজে হঠাৎ করে সেটি থেমে যায়। রুহানের মনে হয় কোথাও কোনো শব্দ নেই। চারপাশে পাথরের দেয়াল, দেয়ালের উপর সারি সারি বসে থাকা মানুষ সবকিছু কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে যায়। মনে হয় কোথাও কেউ নেই। শুধু বহুঁ দূরে দুই পা অল্প একটু ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ। যে কোনো মুহূর্তে মানুষটি একটা অস্ত্র তুলে নিয়ে তাকে গুলি করবে।
মানুষটি অনেক দূরে, তার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। রুহানের কী হলো কে জানে, হঠাৎ করে এই মানুষটার সত্যিকার চেহারা দেখার একটা অদম্য ইচ্ছে তার বুকের ভেতর জেগে উঠল। যে মানুষটাকে সে হত্যা করবে কিংবা যে মানুষটা তাকে হত্যা করবে, তাকে সে ভালো করে একবার দেখবে না, চোখে চোখে তাকাবে না, সেটা তো হতে পারে না। রুহান তাই এক পা অগ্রসর হলো।
বহুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিও ঠিক এক পা অগ্রসর হলো। কী আশ্চর্য! সে যেরকম মানুষটিকে কাছে থেকে দেখতে যাচ্ছে ঠিক সেরকম এই মানুষটিও তাকে কাছে থেকে দেখতে চাচ্ছে? তার যেরকম কৌতূহল রিদি নামের মানুষটারও কী ঠিক সেই একই রকম কৌতূহল? রুহান তখন আরো এক পা অগ্রসর হয়–রিদি নামের মানুষটাও এক পা অগ্রসর হয়। রুহান হাত দিয়ে মাথা থেকে টুপিটা খুলে নেয়। ডান হাতে টুপিটা ধরে রাখায় আপাতত সেই হাতটি অচল হয়ে গেল। রিদিকে সে এটা জানিয়ে দিতে চায়। সে এই মুহূর্তে ডান হাতে অস্ত্র তুলে নেবে না, ইচ্ছে করলেও পারবে না। রিদিও তার মাথা থেকে টুপিটা খুলে হাতে নেয়। এই মানুষটাও রুহানকে জানাল, সে এই মুহূর্তে তাকে গুলি করবে না। আগে কাছে এসো তোমাকে একবার ভালো করে দেখি।
দুজন দুজনের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। পাথরের দেয়ালের উপরে বসে থাকা সারি সারি মানুষের ভেতরে একটা বিস্ময়ধ্বনি শোনা যায়, কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, দুজন খেলোয়াড় একজন আরেকজনের কাছে এত সহজে এগিয়ে যেতে পারে। নতুন এক ধরনের উত্তেজনার জন্যে সবাই সোজা হয়ে বসে, তাদের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়।
রুহান আর রিদি হেঁটে হেঁটে একজন আরেকজনের খুব কাছাকাছি এসে থামল। এত কাছে যে ইচ্ছে করলে একজন আরেকজনকে স্পর্শ করতে পারে। কিন্তু তারা একজন আরেকজনকে স্পর্শ করল না, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
রিদির মুখে ছোপ ছোপ কালো রং, চেহারায় ভয়ঙ্কর একটি ছাপ দেয়ার চেষ্টা করেছে। রুহান অবাক হয়ে দেখল ছোপ ছোপ কালো রঙের আড়ালে রিদির চেহারায় এক আশ্চর্য সারল্য। চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ, বিষণ্ণ এবং বেদনাতুর। তরুণটি তার দিকে বিস্ময়ে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মনে হয় সে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
রুহান রিদির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল, আমি পারব।
কী পারবে না?
আমি তোমাকে হত্যা করতে পারব না।
রিদির মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে হাসিটাকে ধরে রেখে বলল, চারদিকে তাকিয়ে দেখ, কত মানুষ। তারা সব দেখতে এসেছে তুমি আমাকে কেমন করে হত্যা করবে আর আমি তোমাকে কেমন করে হত্যা করব।
আসুক।
তারা অপেক্ষা করছে।
করুক। তুমি চাইলে আমাকে হত্যা করতে পার। রুহান মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু আমি তোমাকে হত্যা করব না।
তুমি তাহলে কী করবে?
রুহান বলল, আমি জানি না।
তুমি কিছু না করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তোমাকে কিছু একটা করতে হবে।
করতেই হবে?
হ্যাঁ। করতেই হবে।
রুহান মাথার টুপিটা পরে বলল, ঠিক আছে, তাহলে কিছু একটা করি।
এর পর সে যে কাজটা করল তার জন্যে রিদি প্রায় হাজার দশেক শ্বাসরুদ্ধ দর্শক এমন কী সে নিজেও প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ করে সে ঘুরে দাঁড়ায়, তারপর পাথরের দেয়ালের দিকে ছুটে যায়। এবড়ো থেবড়ো দেয়াল ধরে সে ক্ষীপ্র সরীসৃপের মতো উপরে উঠে কিছু বোঝার আগে জমকালো পোশাক পরা ক্ৰিভনের মাথার উপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা ধরে।
শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বসে থাকা হাজার দশেক দর্শক বিস্ময়ের এক ধরনের আর্ত শব্দ করে হঠাৎ করে একেবারে নিশ্ৰুপ হয়ে যায়, মনে হয় একটা সূচ ফেললেও বুঝি তার শব্দ শোনা যাবে।
রুহান ফিসফিস করে বলল, ক্ৰিভন! তোমার সেনাবাহিনীকে বলে দাও তারা যদি একটুও বোকামী করে তাহলে তোমার মস্তিষ্কে কমপক্ষে এক ডজন। বুলেট ঢুকে যাবে।
ক্রিভন কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি কী চাও?
আমি ভালো করে জানি না। রুহান অস্ত্রটা ক্ৰিভনের মাথায় আলতোভাবে স্পর্শ করে বলল, আগে তোমার সেনাবাহিনীর কাছে নির্দেশ পাঠাও, তারা যেন হাতের অস্ত্র নিচে নামিয়ে রাখে। এই মুহূর্তে
ক্ৰিভনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, সে তার পাশে বসে থাকা সামরিক পোশাক পরা একজনকে বলল, জেনারেল, তুমি এক্ষুনি নির্দেশ দাও। এই মুহূর্তে। কেউ যেন কোনো পাগলামী না করে।
চমৎকার! রুহান এবার ক্ৰিভনের বুকের কাপড় টেনে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয় তারপর তাকে ঠেলে সামনের দিকে নিয়ে যায়। মাথার পিছনে অস্ত্রটা ধরে রেখে বলল, এবারে আমার সাথে চলো।
ক্ৰিভন ভয় পাওয়া গলায় বলল, কোথায়?
রুহান বলল, আমি ভালো করে জানি না। তারপর তাকে ধাক্কা দিয়ে পাথরের দেয়াল থেকে নিচে ফেলে দেয়। দেয়ালটি খুব বেশি উঁচু নয় কিন্তু ক্ৰিভন প্রস্তুত ছিল না বলে নিচে লুটোপুটি খেয়ে পড়ল, রুহান লাফিয়ে নাম ঠিক তার পাশে। রুহানের পোশাক ধরে তাকে টেনে তুলে বলল, ব্যথা পেয়েছ?
ক্ৰিভন মুখে যন্ত্রণার চিহ্নটা সরাতে সরাতে বলল, না। পাইনি।
চমৎকার! রুহান তাকে নিজের খুব কাছাকাছি টেনে এনে বলল, ক্ৰিভন, তুমি আমার কাছাকাছি থাক। তোমার গার্ডগুলোর যদি মাথা মোটা হয় আর তোমাকে বাঁচানোর জন্যে দূর থেকে গুলি করার চেষ্টা করে তাহলে সেট। যেন শুধু আমাদের গায়ে না লাগে, তোমার ঘিলুও যেন খানিকটা বের হয়ে আসে। বুঝেছ?
ক্ৰিভন ফ্যাকাসে মুখে বলল, কেউ গুলি করবে না।
না করলেই ভালো।
রুহান ক্ৰিভনকে টেনে মাঠের মাঝামাঝি নিয়ে যায় যেখানে রিদি দুই হাতে দুটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রিদির মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল। বলল, রুহান! তুমি এটা কী করেছ?
এই পুরো এলাকার অলিখিত যুদ্ধবাজ সম্রাটকে ধরে এনেছি। কেন?
তুমি বলেছ হাজার হাজার দর্শক অনেকগুলো ইউনিট খরচ করে আমাদের খেলা দেখতে এসেছে। কিছু একটা যদি না করি তাহলে তাদের খুব আশাভঙ্গ হবে।
রিদি কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ভালো মানুষের মতো হেসে ফেলল, তারপর কাছে এসে রুহানের পিঠে থাবা দিয়ে বলল, আমি আমার জীবনে তোমার চাইতে বিচিত্র মানুষ দেখি নি!
রুহান বলল, সেটা নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে। কিন্তু ক্ৰিভনকে নিয়ে কী করি?
রিদি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে গাল ঘষে বলল, দর্শকদের একটা সহজ উপায় হচ্ছে এই মাঠের মাঝখানে একে গুলি করে মেরে ফেলা। দর্শকদের তাহলে একেবারেই আশা ভঙ্গ হবে না। তারপর আমরা ঘোষণা করে দিই আমরা এখন এই সাম্রাজ্যের হর্তাকর্তা বিধাতা!
ক্রিভনের মুখ হঠাৎ একেবারে রক্তশূন্য হয়ে যায়। সে ভাঙ্গা গলায় বলল, ঈশ্বরের দোহাই লাগে তোমাদের, তোমরা যা চাও তাই দেব আমি–আমাকে মেরো না।
যা চাই তাই দেবে?
হ্যাঁ। ঈশ্বরের কসম খেয়ে বলছি–
বেশ। রিদি অস্ত্রটা তার গলায় স্পর্শ করে বলল, এই মুহূর্তে আমাদের হওনকে এখান থেকে বের হয়ে একটা বুলেটপ্রুফ গাড়িতে করে নিয়ে যাও।
নিয়ে যাব। অবশ্যই নিয়ে যাব। একশবার নিয়ে যাব।
কোথায় নিয়ে যাবে?
ক্রিভন ভাঙ্গা গলায় বলল, তোমরা যেখানে বলবে। তোমরা যেখানে যেতে চাও–
যাবার কোনো জায়গা আছে নাকি আবার। পুরো দুনিয়াটাই তো তোমরা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে রেখেছ!
জঙ্গলে?
মাথা খারাপ, জঙ্গলে গিয়ে আমি শেয়াল কুকুরের মতো লুকিয়ে থাকব?
তাহলে কোথায় যাবে?
লাল পাহাড়ে গেলে কেমন হয়?
লাল পাহাড়ে? ক্ৰিভনের মুখটা বিবর্ণ হয়ে যায়। লা-লাল পাহাড়ে?
হ্যাঁ। রিদি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা দিয়ে গলায় খোঁচা দিয়ে বলল, কোনো সমস্যা আছে?
না, নেই।
চমৎকার! রিদি ক্ৰিভনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, চল যাই।
ক্রিভন অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দুই পা হেঁটে সামনে যায়। রিদি পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে একবার দর্শকদের মুখের দিকে তাকাল। তারপর রুহানের দিকে চোখ মটকে বলল, দর্শকদের আরেকটু আনন্দ দেয়া যাক কী বলো?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে। সেও তার অস্ত্রটা বের করে নেয়। তারপর কেউ কিছু বোঝার আগে দর্শকের মাথার উপর দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে সবাই মাথা নিচু করে যে যেখানে আছে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করে, হুঁটোপুটি করে ছুটে পালাতে শুরু করে। রিদি হা হা করে হেসে বলল, হায়রে আমাদের মুরগি ছানার দল! ইউনিট খরচ করে মানুষ মারা দেখতে এসেছে অথচ সাহসের নমুনা দেখ!
রুহান বলল, অনেক হয়েছে, এখন চল।
রিদি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, দেখা যাক আসলেই আমরা পালাতে পারি কি না!
ক্রিনের পোশাকের পিছনে ধরে তারা তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে। সমস্ত এলাকাটা তখন মানুষের হৈ চৈ চিৎকারে একটা নারকীয় পরিবেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে কোনো জায়গা থেকে কেউ গুলি করে তাদের শেষ করে দিতে পারে কিন্তু সেটা নিয়ে এখন চিন্তা করার সময় নেই।
রুহান আর রিদি পাশাপাশি ছুটতে থাকে। কিছুক্ষণ আগেও তাদে একজনের আরেকজনকে হত্যা করার কথা ছিল।
০৮. পাহাড়ের উপর থেকে
পাহাড়ের উপর থেকে নিচের উপত্যকাটির দিকে তাকিয়ে রিদি বলল, এই হচ্ছে সেই লাল পাহাড়।
রুহান বলল, এটা লালও না পাহাড়ও না তাহলে এর নাম লাল পাহাড় কেন?
রিদি হেসে বলল, আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি এর নাম দিই নি।
তুমি এখানে আসতে চেয়েছ–এটা সম্পর্কে নিশ্চয়ই তুমি জান।
এমন কিছু জানি না, শুধু শুনেছি এই লাল পাহাড়টা কারো এলাকা না। সবার ভেতরে একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে যে এটা কেউ দখল করে নেবে না।
কেন?
রিদি ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, সবারই ব্যাবসাপাতি করতে হয়। অস্ত্র কিনতে হয়। সৈনিক বিক্রি করতে হয়। যন্ত্রপাতি ঠিক করতে হয়। তাই লাল পাহাড়টা এই সব করার জন্যে রেখে দিয়েছে।
রুহান আঁকাবাঁকা রাস্তাটির দিকে তাকিয়ে রইল, সেটা পাহাড় ঘিরে নিচে উপত্যকায় নেমে গেছে। তাদেরকে এই পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে নেমে যেতে হবে। এরকম বেশ কয়েকটি রাস্তা চারদিক থেকে এসেছে। ওরা ইচ্ছে করলে ক্ৰিভনকে নিয়ে একেবারে উপত্যকায় নেমে যেতে পারত কিন্তু তা না করে এখানে নেমে পড়েছে। ক্রিভনের গলায় একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চেপে ধরে রেখে বিশাল একটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি করে শহরের ভেতর ঢুকলে শহরের সব মানুষ নিশ্চয়ই বিস্ফারিত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারা কারো চোখে আলাদা করে পড়তে চায় না, যে ঘটনা ঘটিয়ে এসেছে সেটা নিশ্চয়ই কয়েকদিনে জানা-জানি হয়ে যাবে কিন্তু তারাই যে সেই ঘটনার নায়ক সেটা তারা কাউকে জানতে দিতে চায় না। তাই দুজনে মাঝপথে নেমে গেছে, বাকীটা হেঁটে যাবে।
রিদি বলল, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চল হাঁটি। পাহাড় ঘিরে পথটা গেছে, অনেকদূর হেঁটে যেতে হবে।
উঁহু। রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমাদের এখন রওনা দেয়া ঠিক হবে না।
কেন?
অনেকটা পথ। কমপক্ষে তিন চার ঘণ্টা তো লাগবেই। এখন এই রাস্তা আমাদের এতক্ষণ থাকা ঠিক না।
কেন? রাস্তায় থাকলে কী হবে?
ক্ৰিভনকে আমরা যেভাবে ধরে এনেছি সেটা একটা যুদ্ধবাজ নেতার জন্যে খুব বড় অপমান। বিশেষ করে এত হাজার হাজার মানুষের সামনে-
হ্যাঁ। সেটা ভুল বল নি।
রুহান বলল, সেই অপমান থেকে রক্ষা পাবার তার এখন একটাই পথ।
রিদি মাথা নেড়ে বলল, আমাদের ধরে নিয়ে দশ হাজার মানুষের সামনে একটা ভয়ঙ্কর শাস্তি দেয়া?
হ্যাঁ। আমরা ক্ৰিভনকে এখানে ছেড়ে দিয়েছি। ক্ৰিভন জানে আমরা এখন এই পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাব। ঘণ্টা তিনেক লাগবে পৌঁছাতে। সে নিশ্চয়ই এই সময়ে তার দলবল নিয়ে আমাদের ধরতে ফিরে আসবে। কাজেই আমাদের এখন এই রাস্তায় থাকা ঠিক হবে না।
রিদি কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ঠিকই বলেছ।
রুহান বলল, রাস্তা দিয়ে না হেঁটে আমরা এই পাহাড়ের ঢালু দিয়ে হেঁটে যাই। আমার মনে হয় আমরা তাহলে অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব।
রিদি আবার মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার বুদ্ধি।
যদি দরকার হয় আমরা তাহলে ভালো একটা জায়গায় অপেক্ষা করতে পারি। যদি ক্ৰিভনের দলের সাথে যুদ্ধ করতেই হয় আমরা সেটা করব একটা সুবিধাজনক জায়গা থেকে।
রিদি বলল, রুহান, তোমার মাথা খুব পরিষ্কার। তোমার মাথায় ইলেকট্রড বসিয়ে যে সক্রেটিস বানায় নি সেটাই আশ্চর্য।
চেষ্টা করেছিল। রুহান বলল, আমি ধোকা দিয়ে বের হয়ে এসেছি। রিদি চোখ বড় বড় করে বলল, আশ্চর্য!
আশ্চর্যের কিছু নেই। এখন চল ঢালু বেয়ে হাঁটতে শুরু করি। অন্ধকার হবার আগে পৌঁছে গেলে খারাপ হয় না।
চল।
দুজন তখন পাহাড়ী ছাগলের মতো পাথরের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে শুরু করে। এই পথ দিয়ে মানুষ হাঁটে না, তাই চারদিক গাছপালা ঝোপঝাড়ে ঢেকে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা গভীর জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল। পাহাড়ী পথে ক্রিভনের লোকজন চলে এলেও তারা কোনোদিন তাদের খুঁজে পাবে না।
একটা পাহাড়ী ঝর্ণার কাছে বসে তারা যখন ঘষে ঘষে তাদের মুখের রং ওঠানোর চেষ্টা করছিল তখন তারা অনেকগুলো সাজোয়া গাড়ির শব্দ শুনতে পেল। গাড়িগুলো কর্কশ শব্দ করতে করতে রাস্তায় ছোটাছুটি করছে। অনেক মানুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর এবং কিছু বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির শব্দও তারা শুনতে পেল। নিশ্চয়ই ক্রিভনের বাহিনী এসে তাদের খোঁজ করছে, তারা যেখানে আছে সেখানে কখনোই তারা খুঁজে পাবে না। ঘণ্টাখানেক পর রুহান আর রিদি আবার সাজোয়া গাড়িগুলোর কর্কশ শব্দ শুনতে পেল, তাদের খুঁজে না পেয়ে সেগুলো ফিরে যেতে শুরু করেছে।
রিদি রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সন্দেহটা একেবারে একশ দশ ভাগ সত্যি ছিল।
রুহান বলল, তার অর্থ কী জান?
কী?
আমি এখন অপরাধীদের মতো চিন্তা করি।
রিদি শব্দ করে হেসে বলল, অপরাধীর মতো চিন্তা করা অপরাধ না, অপরাধীর মতো কাজ করা হচ্ছে অপরাধ।
রুহান বলল, কিন্তু তুমি আসল বিষয়টা ভুলে যাচ্ছ। অপরাধীর মতো চিন্তা করা অপরাধ না হতে পারে কিন্তু এটা খুব কষ্ট। আমি আগে এরকম ছিলাম না।
রিদি রুহানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কী একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ?
কী?
আমরা দুজন একজন আরেকজন সম্পর্কে কিছুই জানি না।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমাদের একজন আরেকজনকে খুন করার কথা ছিল। অথচ এখন একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারব না। বেঁচে থাকার জন্যে তোমার আমাকে আর আমার তোমাকে দরকার।
রিদি এক দৃষ্টে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রুহান জিজ্ঞেস করল, কী লো? তুমি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
তোমাকে দেখছি।
আমাকে কী দেখছ?
যে মানুষটার সাথে আমার থাকতে হবে তার চেহারাটা কেমন সেটা এখনো ভালো করে দেখতে পারি নি। তোমার চেহারাটা দেখার চেষ্টা করছিলাম, তুমি কী জান—
জানি।
রিদি অবাক হয়ে বলল, কী জান?
তুমি নিশ্চয়ই বলতে চাইছ ঝর্ণার পানি দিয়ে আমি আমার মুখের রং ধুতে পারি নি। উল্টো সেই রং ছড়িয়ে পড়ে এখন আমাকে একটা ভূতের মতো দেখাচ্ছে।
রিদি শব্দ করে হেসে বলল, হ্যাঁ, আমি সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম। তবে তুমি যখন নিজেই এটা আবিষ্কার করেছ তার একটাই অর্থ। আমিও আমার মুখের রং ধুতে পারি নি। আমাকেও নিশ্চয়ই ভূতের মতোই লাগছে!
ঠিকই অনুমান করেছ। চেষ্টা করে লাভ নেই। চল আগে লোকালয়ে যাই। তখন একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
লোকালয়ের মানুষেরা আমাদের দেখে ভয় পেয়ে যাবে।
তোমার তাতে কোনো আপত্তি আছে?
না। কোনো আপত্তি নেই। রিদি উঠে দাঁড়াল। বলল, চল যাই। তুমি বিশ্বাস করবে কী না জানি না, আমার খিদে পেতে শুরু করেছে।
রুহান বলল, অবশ্যই বিশ্বাস করব। আমারও ভয়ঙ্কর খিদে পেয়েছে। লাল পাহাড়ে গিয়ে ভালো কিছু খেতে পাব তো?
পাব। নিশ্চয়ই পাব।
দুজন আবার ঝোপঝাড় ভেঙ্গে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে থাকে।
রুহান এবং রিদি ভেবেছিল লাল পাহাড়ে পৌঁছানোর পর তাদের বিচিত্র পোশাক, রং মাখা মুখ এবং শরীরে ঝুলিয়ে রাখা নানা ধরনের অস্ত্র দেখে নিশ্চয়ই তাদের ঘিরে একটা ভিড় জমে যাবে, কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা কারণটা বুঝে গেল। পুরো লাল পাহাড় এলাকাটাই আসলে বিচিত্র মানুষের এলাকা। অনেক মানুষই মুখে বিচিত্র রং লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অনেকের পোশাক বিচিত্র, অনেকেই নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরো এলাকাটা একটা বড় মেলার মতো, নানা ধরনের আনন্দোৎসবের ব্যবস্থা রয়েছে। নানা ধরনের দোকানপাট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নানা ধরনের মানুষের ভিড়ে পুরো এলাকাটা গমগম করছে। এখানে নানা বয়সের নারী আর পুরুষ রয়েছে কিন্তু কোনো শিশু কিশোর নেই। দেখেই বোঝা যায় এই এলাকাটি ক্ষণস্থায়ী, মানুষ এখানে আসবে কিছু সময় কাটিয়ে চলে যাবে। কেউ এখানে পাকাপাকিভাবে থাকবে না।
রিদি মানুষের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, রুহান জায়গাটা আমার পছন্দ হয়েছে।
রুহান হেসে বলল, আমরা যেরকম জায়গা থেকে এসেছি তারপর সরাসরি নরক না হলেই জায়গাটা আমাদের পছন্দ হবার কথা।
রিদি বলল, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ? এখানকার মানুষের চোখে মুখে সেই ভয় আর আতঙ্ক নেই।
হ্যাঁ। অনেকের মুখে হাসি। রুহান নিজেও হাসার চেষ্টা করে বলল, হাসতে কেমন লাগে ভুলেই গেছি।
রিদি বলল, পেটে কিছু পড়লে তুমিও হাসতে পারবে।
খুঁজে খুঁজে দুজনে একটা ভালো খাওয়ার জায়গা বের করল। পাথরের একটা বাসার সামনে চেয়ার টেবিল সাজানো। কাছেই পাথরের চুলোতে গনগনে আগুনে সত্যিকারের মাংস মশলা মাখিয়ে ঝলসানো হচ্ছে। অনেক মানুষের ভিড় তার মধ্যে দুজনে ঠেলেঠুলে একটা টেবিল দখল করে নিল। কমবয়সী একটা মেয়ে তাদের টেবিলে উত্তেজক পানীয়ের একটা জগ দিয়ে গেল। পাথরের গ্লাসে ঢেলে এক চুমুক খাওয়ার পরেই তাদের মন ভালো হয়ে যায়। তারা বসে বসে পা দুলিয়ে চারপাশের মানুষগুলোকে দেখতে থাকে।
তোমাদের সাথে বসতে পারি? গলার স্বর শুনে দুজনে তাকিয়ে দেখে মাঝবয়সী একজন মানুষ, উষ্কখুষ্ক চুল, চোখ দুটো জ্বলজ্বলে এবং অস্থির।
রুহান পা দোলানো বন্ধ করে বলল, হ্যাঁ, পার।
রিদি বলল, ইচ্ছে করলে আমাদের পানীয়ও এক ঢোক খেতে পার।
মানুষটি তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই এই এলাকার মানুষ নও।
কেন?
এই এলাকার মানুষেরা পরিচয় হবার আগেই কাউকে তার পানীয়তে ভাগ বসাতে দেয় না।
রিদি আর রুহান দুজনেই শব্দ করে হাসল। রুহান বলল, অন্যদিন তোমাকে এত সহজে আমাদের পানীয়তে ভাগ বসাতে দেব না। আজ দিচ্ছি। আজ আমাদের মনটা খুব ভালো।
মানুষটা জিজ্ঞেস করল, কেন? তোমাদের মন ভালো কেন?
রুহান সরাসরি উত্তর দিল না, বলল, অনেকগুলো কারণ আছে, তোমাকে কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি? তা ছাড়া মন ভালো হতে কী আর কারণের দরকা। হয়? এই উত্তেজক পানীয় এক ঢোক খেলেই মন ভালো হয়ে যায়।
মানুষটি মাথা নেড়ে তার পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, সেটা ঠিকই বলেছ। একটা সময় ছিল যখন সবসময়ে মানুষের মন খারাপ থাকত–কখন কী হয় সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করত। এখন উল্টো। ধরেই নিয়েছে জীবনটা যে কোনো সময় শেষ হয়ে যাবে। তাই যে কয়দিন আছে সেই কয়দিন ফূর্তি করে নাও।
রিদি আর রুহান দুজন কোনো কথা না বলে অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল। মানুষটি বলল, তোমরা এখানে নতুন এসেছ?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
লাল পাহাড় ঘুরে দেখেছ?
না। এখনো দেখি নি। এখানে কী আছে দেখার মতো?
মানুষটি চোখ বড় বড় করে উৎসাহ নিয়ে বলল, এই এলাকার সবচেয়ে বড় বাজারটি এখানে। এমন কোনো জিনিস নেই যেটা এখানে পাওয়া যায় না। অস্ত্র পাতি গোলাবারুদ থেকে শুরু করে মানুষ মেয়েমানুষ সবকিছু এখানে পাওয়া যায়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মানুষটি একটু ঝুঁকে বলল, কিনবে তোমরা কিছু? সুন্দরী মেয়েদের একটা চালান আসছে শুনেছি।
রিদি মাথা নেড়ে বলল, না আমরা কিছু কিনব না।
মানুষটার একটু আশাভঙ্গ হলো বলে মনে হলো। বলল, তোমরা এত ক্ষমতাশালী মানুষ, তোমরা যদি কিছু ইউনিট খরচ না কর তাহলে বাজার চালু থাকবে কেমন করে?
রুহান সোজা হয়ে বসে বলল, ক্ষমতাশালী? আমরা? তোমার এরকম ধারণা হলো কেমন করে?
বাহ্! মানুষটা দুই হাত তুলে বলল, তোমরা কী রকম অস্ত্র নিয়ে ঘুরছ দেখেছ? এরকম একটা অস্ত্র কত ইউনিটে বিক্রি হয় জান?
রুহান কিংবা রিদি দুজনের কেউই সেটা জানে না, তবে তারা সেটা প্রকাশ করল না, সাবধানে মাথা নাড়ল।
মানুষটা বলল, সারা লাল পাহাড়ে কারো কাছে এই অস্ত্র নেই, আর তোমাদের একজনের কাছেই আছে তিনটা করে! ক্ষমতা না থাকলে এগুলো হয় না।
রুহান আর রিদি একজন আরেকজনের দিকে তাকাল তারা এই বিষয়টা আগে। এভাবে চিন্তা করে নি। মানুষটা বলল, তোমরা কী কিছু কিনবে? ফূর্তি-ফার্তা করবে?
উঁহু। রুহান মাথা নাড়ল।
মানুষটা মাথা আরেকটু এগিয়ে আনল, নিচু গলায় ষড়যন্ত্রীর মতো বলল, কোনো গোপন রোগের চিকিৎসা করাতে চাও? আমার পরিচিত ভালো ডাক্তার আছে।
রুহান মাথা নাড়াতে গিয়ে হেসে বলল, না, আমাদের কোনো গোপন রোগ নেই।
আজকাল খুব একটা জনপ্রিয় অপারেশন হচ্ছে। পুরুষ মহিলা হওয়ার অপারেশন। মাত্র সাতদিন ক্লিনিকে থাকতে হয়—
রিদি আর রুহান দুজনেই মাথা নাড়ল। রিদি বলল, রক্ষে কর। এতদিন থেকে পুরুষ মানুষ হয়ে আছি অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আমি মহিলা হতে পারব না।
মানুষটি তবু হাল ছাড়ল না, বলল, আমারও তাই ধারণা। এরকম হাট্টাকাট্টা জোয়ান পুরুষ মানুষ, খামোখা অপারেশন করে মেয়ে হতে যাবে কেন? তোমাদের বরং দরকার বাড়তি পৌরুষত্ব। খুব ভালো হরমোন আছে এখানে। ব্ল্যাক মার্কেটের এক নম্বর জিনিস। লাগবে?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, না লাগবে না।
তাহলে দুই নম্বর হৃৎপিণ্ড? ছোট্ট শিশুর ভালো হৃৎপিণ্ড আছে। বুকের ভতর বসিয়ে দেবে টেরও পাবে না। আসল হৃৎপিণ্ডের সাথে সাথে চলবে। এখন যত পরিশ্রম করতে পার তার ডবল পরিশ্রম করতে পারবে।
রুহান হেসে বলল, না, আমার মনে হচ্ছে একটা হৃৎপিণ্ডতেই আমার বেশ কাজ চলে যাচ্ছে।
মানুষটি এবারে রীতিমতো হতাশ হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে মনমরা হয়ে বসে পড়ল।
রিদি বলল, যদি একান্তই আমাদের সাহায্য করতে চাও তাহলে বলো রাত কাটানোর জন্যে ভালো একটা জায়গা কোথায় পাব? কোনো হাঙ্গামা হুঁল্লোড় চাই না, শুধু নিরিবিলি ঘুমাব।
রুহান বলল, ঘুমানোর আগে গরম পানিতে ভালো করে রগড়ে গোসল করব।
রিদি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সেটাও করতে হবে।
এলোমেলো চুলের মানুষটা এবারে সোজা হয়ে বসল। চোখ বড় বড় করে বলল, এখানে চাররকম থাকার জায়গা আছে। প্রথমটা হচ্ছে দামি, অনেক ইউনিট লাগে–
না না না। রুহান বাধা দিল, আমরা খুব কম ইউনিটে থাকতে চাই। সম্ভব হলে কোনো ইউনিট খরচ না করে।
মানুষটা অবাক হয়ে বলল, কোনো ইউনিট খরচ না করে?
হ্যাঁ। মনে করো কাজের বিনিময়ে খাদ্য। কিংবা কাজের বিনিময়ে নিদ্রা।
মানুষটা কিছুক্ষণ তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বল, সত্যি তোমাদের কোন ধরনের কাজ দরকার?
রিদি আর রুহান দুজনেই মাথা নাড়ল। মানুষটা জিজ্ঞেস করল, কা ধরনের কাজ?
রুহান বলল, সেটা ভালো করে জানি না।
তোমাদের কাছে এত রকম অস্ত্র –সেগুলো নিশ্চয়ই ব্যবহার করতে পার?
রুহান আর রিদি একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, রিদি হাসি গোপ করে বলল, একটু একটু পারি।
তাহলে তোমরা হয়তো কোনো ব্যবসায়ীর বডিগার্ড হিসেবে কাজ করতে পারবে। কিংবা কোনো দোকানে নিরাপত্তা কর্মী। কী বলো?
রিদি আর রুহান কোনো কথা না বলে একটু কাঁধ ঝাঁকাল।
তোমরা ইচ্ছে করলে নিজেদের একটা দল খুলতে পার। কিছু মানুষ নিয়ে তাদের ট্রেনিং দিয়ে—
রুহান বলল, ডাকাতের দল? রক্ষে করো!
ডাকাত? ডাকাত বলছ কেন।
অস্ত্র নিয়ে ট্রেনিং দিয়ে হামলা করাকে বলে ডাকাতি।
মানুষটা শব্দ করে হেসে বলল, তোমরা খুব মজার মানুষ। এটা ডাকাতি হবে কেন? এটা এখন সবাই করে।
রিদি কিংবা রুহান কোনো কথা না বলে পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিল। রুহান বলল, তার চাইতে ভালো থাকার জায়গা কোথায় আছে বলো।
তোমরা যদি সোজা হেঁটে যাও, একেবারে পাহাড়ের নিচে দেখবে ছোট ছোট ঘর আছে। রাতের জন্যে ভাড়া দেয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পাহাড়ের নিচে। বলে অবশ্যি রাতে ঝড়ো বাতাসের খুব শব্দ হয়।
হোক। রুহান বলল, ঝড় বাতাস আমার ভালোই লাগে।
মানুষটি এবারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুজনকে লক্ষ্য করে বলল, আচ্ছা। তোমরা বলবে তোমরা কারা? কী করো, কোথায় থাক?
রিদি বলল, এখনো জানি না। যখন জানব তখন বলব। নিশ্চয়ই বলব।
জান না মানে?
আমাদের দুজনের দেখা হয়েছে আজ দুপুরে। একজন আরেকজনকে ভালো করে চিনিই না। শুধু একজন আরেকজনের নামটা জানি।
মানুষটি কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে হা হা করে হেসে বলল, তোমরা খুব মজার মানুষ। তারপর চোখ টিপে বলল, বুঝতে পারছি সত্যি কথাটি বলতে চাইছ না। না বললে নাই–এখানে কেউ সত্যি কথা বলে না। শুধু আমি বলি। আমার নাম দ্রুচেন। এজেন্ট দ্রুচেন। সবাই চেনে আমাকে। কোনো দরকার হলে আমাকে খবর দিও। আমি নিয়ম মেনে চলি, তোমাদের কাজ জোগাড় করে দেব। দশ ভাগ কমিশন আমার।
ঠিক আছে।
তাহলে তোমরা ডিনার করো, আমি যাই। পানীয়ের জন্যে ধন্যবাদ।
রুহান হাসিমুখে বলল, লাল পাহাড়ের ভেতরের খবর দেবার জন্যে তোমাকেও ধন্যবাদ।
খাওয়া শেষ করে রিদি আর রুহান এলাকাটাতে খানিকক্ষণ ইতস্তত হাঁটে। বাজারের কাছাকাছি এলাকায় নাচ গান হচ্ছে। মানুষজন তাল-লয়হীন বিকট সঙ্গীতের সাথে নাচানাচি করছে। নেশা করে তাদের চোখ মুখ রক্তাভ, চালচলন কথাবার্তা সংযত। তারা সেখানে বেশি সময় না থেকে সরে এলো, আশেপাশে নানা ধরনের দোকানপাট। অস্ত্রের দোকান সবচেয়ে বেশি, সেখানে নানারকম স সাজানো আছে, মানুষজন সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখছে, কিনছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটা বড় নার্সিং হোম। সেখানে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেচা-কেনা tlk। গাড়ির বেশ বড় বড় দোকান। নানা ধরনের গাড়ি সাজানো রয়েছে। পোশকের অনেকগুলো দোকান। মনে হয় পোশাকের এক ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, বেশিরভাগই বিদঘুটে রঙের বিচিত্র সব পোশাক।
রিদি আর রুহান হাঁটতে হাঁটতে শহরের এক পাশে চলে এলো, সেখানে ছোট ছোট দোকান। রাস্তার পাশে স্থপ করে রেখে নানা ধরনের বিচিত্র পত্র বিক্রি হচ্ছে। ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্যে ফর্মালিনে ড়ুবিয়ে রাখা মানুষের আঙুল, চোখ, জিব। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে তৈরি করা কিছু বিচিত্র জন্তু। সীসার কৌটায় ভরে রাখা তেজক্রিয় মৌল। বিভিন্ন জাদুঘর থেকে চুরি করে আনা প্রাচীন মূর্তির অংশ। রুহান হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল কমবয়সী একজন মানুষ অনেকগুলো বই নিয়ে বসে আছে। সে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যায়। রিদি জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী?
কমবয়সী মানুষটি বলল, জানি না। তাহলে এগুলো বিক্রি করছ কেন?
কমবয়সী মানুষটি দাঁত বের করে হেসে বলল, আমি না জানলে ক্ষতি কী অন্য কেউ তো জানতে পারে।
রুহান বলল, আমি জানি। এগুলোকে বলে বই। আগে যখন মানুষের কাছে ক্রিস্টাল রিডার ছিল না তখন তারা এভাবে তথ্য বাঁচিয়ে রাখত।
রিদি অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! এখানে কীভাবে তথ্য বাঁচিয়ে রাখবে?
রুহান বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে থেমে গেল। কমবয়সী মানুষটা যদি বুঝতে পারে সে বই নামের বিষয়টা সম্পর্কে জানে এমনকী সে অল্প বিস্তর পড়তেও পারে তাহলে শুধু শুধু বইগুলোর দাম বাড়িয়ে দেবে। সে দুই-একটা বই কিনতে চায়। বইগুলো উল্টে পাল্টে সে কয়েকটা বই বেছে নেয়। দাম নিয়ে কিছুক্ষণ দরাদরি করে বইগুলো কেনে। রিদি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করবে এগুলো দিয়ে?
রুহান কিছু বলার আগেই কমবয়সী মানুষটা বলল, ঘরে সাজিয়ে রাখা যায়। আর নেশা করার কাজে লাগে। কাগজ ছিঁড়ে গোল করে পাকিয়ে ভিসুবিচিরাস নাক দিয়ে টানা যায়। হাশিস খাবার জন্যে আগুন জ্বালাতেও খুব সুবিধা। একটা একটা করে কাগজ ছিঁড়ে আগুন জ্বালাবে।
রিদি একটু চোখ বড় বড় করে মানুষটার দিকে তাকাল। মানুষটা মুখে। হাসি আরেকটু বিস্তৃত করে বলল, তা ছাড়া বাথরুম করার পর মুছে ফেলা। কাজেও লাগানো যায়–
রুহান রিদির হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিতে নিতে বলল, চল, বইয়ে। ব্যবহার সম্পর্কে আরো জটিল কিছু বের হওয়ার আগে কেটে পড়ি।
মানুষটি আবার দাঁত বের করে হেসে বলল, আমার কাছে আরো মজার মজার সব বই আছে।
রুহান যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, তুমি এগুলো কোথা থেকে আনো।
মানুষটি চোখ মটকে বলল, জানতে চাও?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
আমাকে কত ইউনিট দেবে বল?
এক ইউনিটও দেব না। কথা শুনতে ইউনিট দিতে হয় কে বলেছে?
মানুষটা চোখ মটকে বলল, কথার যদি দাম থাকে তাহলে দাম দেবে না?
রুহান মাথা নাড়ল। না, দাম দিয়ে কথা শুনতে হলে কথা শুনবই না।
এক হাজার ইউনিট। মানুষটা মুখ গম্ভীর করে বলল, আমাকে এক হাজার ইউনিট দিলে তোমাকে বলে দেব, এগুলো কোথায় পাওয়া যায়।
রুহান আবার মাথা নেড়ে বলল, কিছু প্রয়োজন নেই।
সে হেঁটে চলে যাচ্ছিল, লোকটা পিছন থেকে চিৎকার করে বলল, ঠিক আছে! পাঁচশ ইউনিট!
রুহান মাথা নেড়ে বলল, এক ইউনিটও না।
রিদি আর রুহান হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেল মানুষটা পিছন থেকে চিৎকার করে বলল, ঠিক আছে! একশ ইউনিট।
রুহান এবারে আর কথার উত্তর দিল না। মানুষজনের ভিড় ঠেলে হেঁটে একটু এগিয়ে যেতেই কে যেন রুহানের আস্তিন টেনে ধরে। রুহান মাথা ঘুরিয়ে দেখে ঢুলুঢুলু চোখের একজন মানুষ, রুহানের হাতের বইগুলো দেখিয়ে বলল, তুমি এইগুলো ইউনিট খরচ করে কিনেছ?
হ্যাঁ, কেন? কী হয়েছে?
পূর্ব দিকে জঙ্গলের কাছে একটা দালান ভেঙ্গে পড়ে আছে, সেখানে গুলো পড়ে থাকে–হাজার হাজার। পোকা মাকড়ে খায়। আর তুমি বেকুব, এগুলো ইউনিট খরচ করে কিনেছ! তোমাদের মতো বোকা মানুষ আছে বলে অন্যেরা খেয়ে পরে বেঁচে থাকে।
রুহান হাসি চেপে রেখে বলল, কথাটা তুমি ভুল বল নাই। তবে তুমি আমাকে যতটা বোকা ভেবেছ, আমি তত বোকা নই। এই বইগুলো কোথায় পাওয়া যায় সেই খবরের জন্যে আমি কিন্তু একটা ইউনিটও খরচ করি না!
ঢুলুঢুলু চোখের মানুষটা বলল, তোমরা এখানে নতুন এসেছ?
হ্যাঁ।
তোমাদের কিছু লাগবে? কিছু সুন্দরী মেয়ে বিক্রি হচ্ছে।
রুহান আর রিদি একসাথে মাথা নেড়ে বলল, না লাগবে না।
খুব ভালো ক্লিনিক আছে পরিচিত। জটিল অপারেশন করাতে পার। গোপন অসুখ থাকলে-–
রিদি মাথা নেড়ে বলল, না, কোনো গোপন অসুখ নেই আমাদের।
ঢুলুঢুলু চোখের মানুষটা আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল, রুহান আর রিদি তাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে দ্রুত সামনে হেঁটে যেতে শুরু করল।
০৯. দরজাটা ধাক্কা দিতেই
দরজাটা ধাক্কা দিতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল। ঘরের ভেতরে ভ্যাপ। এক ধরনের গন্ধ। আবছা অন্ধকারে দেখা যায় সারি সারি তাক, সেই তাকের উপর অসংখ্য বই। বইগুলো অযত্নে পড়ে আছে, ধূলায় ধূসর।
রুহান একটু এগিয়ে গিয়ে একটা বই টেনে নেয়। পৃষ্ঠা খুলে কী নে? আছে পড়ার চেষ্টা করে, মাছ যেমন করে পানি থেকে অক্সিজেন নেয় সেখানে। তার একটা ব্যাখ্যা লেখা রয়েছে। রিদি একটু অবাক হয়ে রুহানের দি তাকিয়েছিল, জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করছ?
বইয়ে কী লেখা আছে সেটা পড়ার চেষ্টা করছি।
রিদি বিস্ফারিত চোখে বলল, কী বললে? পড়ার চেষ্টা করছ?
হ্যাঁ।
তুমি পড়তে পার?
খুব ভাল পারি না। শিখছি।
রিদি ভুরু কুঁচকে বলল, এত কাজ থাকতে তুমি পড়া শিখছ কেন? এটা যেন অনেকটা অনেকটা–
রুহান মুখে হাসি টেনে বলল, অনেকটা কী?
অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে শেখার মতো। তুমি যখন দুই পায়ে হাঁটতে পারো তখন হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে শেখার চেষ্টা করবে কেন? ক্রিস্টাল রিডার দিয়ে সব রকম তথ্য বিনিময় করা যায় তখন কাগজে বর্ণমালা লিখে তথ্য বিনিময় করতে চাইছ কেন?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না। তবে—
তবে কী?
আমার কী মনে হয় জান?
কী?
রুহান বলল, আমার মনে হয় কিছুদিন পর আমাদের কাছে আর ক্রিস্টাল রিডার থাকবে না। পৃথিবীতে এত মারামারি কাটাকাটি হচ্ছে যে নতুন করে কেউ ক্রিস্টাল রিডার বানাতেও পারবে না। তখন কী হবে জান?
রিদি কেমন যেন বিচিত্র দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। খানিক্ষণ পর বলল, তুমি সত্যিই এটা মনে করো?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমি মনে করি। শুধু যে ক্রিস্টাল রিডার থাকবে নাম তা না। অস্ত্র থাকবে না। গাড়ি থাকবে না। কাপড় থাকবে না। খাবার থাকবে না!
কী বলছ তুমি?
আমি ঠিকই বলছি। রুহানের মুখটা অকারণেই গম্ভীর হয়ে যায়। সে থেমে থেমে বলল, আমাদের খুব দুর্ভাগ্য আমরা পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময়ে জন্মেছি। যখন সবকিছু ধ্বংস হচ্ছে। চারপাশে সবাই ডাকাত। জ্ঞান-বিজ্ঞান নেই লেখাপড়া নেই–
রিদি বাধা দিয়ে বলল, সে কী! তুমি দেখি বুড়ো মানুষদের মতো কথা বলতে শুরু করেছ।
রুহান হেসে বলল, ঠিকই বলেছ। আমি মনে হয় বুড়ো হয়ে গেছি। কিন্তু কথাগুলো তুমি খুব ভুল বলে নি।
রুহানের চোখ কেমন জানি চকচক করে ওঠে, সে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমি তো ইতিহাস খুব বেশি জানি না কিন্তু যেটুকু জানি সেখানে কী দেখেছি জান?
কী দেখেছ?
যখন মানুষের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায় তখন তারা আবার মাথা সোজা করে দাঁড়ায়। এখানেও নিশ্চয়ই দাঁড়াবে। যখন দাঁড়াবে তখন তো আবার জ্ঞান চর্চা করতে হবে। জানতে হবে, শিখতে হবে–তখন যদি ক্রিস্টাল রিডার না থাকে তখন তারা এই বই থেকে পড়বে।
রিদি কয়েক মুহূর্ত রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর হঠাৎ শব্দ করে হাসতে শুরু করল।
রুহান ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি বোকার মতো হাসছ কেন?
রিদি কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বলল, তুমি বোকার মতো কথা বললে দোষ নাই কিন্তু আমি বোকার মতো হাসলে দোষ?
আমি কখন বোকার মতো কথা বলেছি?
রুহান মুখ শক্ত করে বলল, আমি বলি নি এই ঘরের এই পোকা খাওয়া বইগুলো পড়বে।
তাহলে কী বলেছ?
বলেছি দরকার হলে এই রকম বই পড়বে। ক্রিস্টালে যেরকম তথ্য রাখা যায় সেরকম বইয়েও তথ্য রাখা যায়। ক্রিস্টাল রিডার যদি না থাকে তাহলে বইয়ের তথ্য দিয়ে কাজ চালানো যাবে। সবাইকে আবার বর্ণমালা শিখতে হবে–
রিদি আবার হাসতে শুরু করল। রুহান চোখ পাকিয়ে বলল, তুমি আবা। বোকার মতো হাসছ কেন?
তোমার কথা শুনে। আমি এবারে কোন কথাটা হাসির কথা বলেছি?
এই যে বলছ সবাইকে বর্ণমালা শিখতে হবে। তারপর বলবে সবাই গাছের বাকল পরে থাকতে হবে। গুহার ভেতরে কাঁচা মাংস আগুনে ঝলসে খেতে হবে–বিবর্তনে বানর থেকে যেরকম মানুষ হয়েছে, সেরকম আবার উল্টো বিবর্তনে আমরা সবাই মানুষ থেকে বানর হয়ে যাব। আমাদের সবার ছোট ছোট লেজ গজিয়ে যাবে!
এবারে রুহানও হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বলল, তোমার সাথে কথা বলার কোনো অর্থ নেই। তুমি কোনো কিছুকে গুরুত্ব দাও না।
রিদি রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো ভবিষ্যতে অনেকদূর তাকাতে পার তাই সবকিছুকে গুরুত্ব দিতে পার। আমার সমস্যাটা কী জান?
কী?
আমি একদিন একদিন করে বেঁচে থাকি। তাই কোনো কিছুকে গুরুত্ব দিতে পারি না।
রুহান কিছুক্ষণ রিদির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমারও কী মনে হয় জান?
কী?
তুমি খুব একটা অদ্ভুত মানুষ।
রিদি চোখ বড় বড় করে বলল, কী আশ্চর্য! আমার ঠিক তাই মনে হচ্ছিল।
ঠিক কী মনে হচ্ছিল?
যে তুমি খুব আজব একজন মানুষ।
ঠিক কী কারণ জানা নেই হঠাৎ করে দুজনেই অকারণে হেসে ওঠে। পুরনো বিধ্বস্ত একটা ঘরে আবছা অন্ধকারে ধূলি ধূসরিত বইয়ের স্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা দুইজনের হাসির শব্দটি অত্যন্ত বিচিত্র শোনায়।
দুপুরবেলা একটা ছোট খাবার দোকানে রিদি আর রুহান এক বাটি গরম স্যুপের শুকনো রুটি চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে, তখন রুহান প্রথমে বিষয়টা লক্ষ করল। তাদের টেবিল থেকে দুই টেবিল দূরে বসে থাকা একজন মানুষ তাদের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। রুহানের সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্রই মানুষটি চোখ সরিয়ে নিল। রুহান চোখের কোনা দিয়ে মানুষটাকে লক্ষ্য করে, খাওয়া শেষ না করেই মানুষটি উঠে গেল। সম্ভবত তাদের চিনে ফেলেছে—এত বড় একটা কাণ্ড করে এসেছে তাদের পরিচয়টা কেউ জানবে না সেটা তো হতে শারে না। আগে হোক পরে হোক এটা জানাজানি হবেই।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে রিদিকে বলল, রিদি আমাদের পরিচয় কিন্তু এখানে জানাজানি হয়ে যাবে।
রিদি বলল, এখনও হয়নি সেটাই আশ্চর্য।
একটা মানুষ খুব সন্দেহজনক ভাবে উঠে গেল।
আবার ফিরে না আসা পর্যন্ত খেতে থাক। হালকা অস্ত্রটা খুলে রাখা যাক। দরকার হলে ব্যবহার করা যাবে।
রুহান বলল, যদি আমাদের পরিচয় জেনে থাকে তাহলে কিছু করার আগে অনেকবার চিন্তা করবে।
তা ঠিক।
রুহান চোখের কোনা দিয়ে চারদিকে এক নজর দেখে বলল, আমি এভাবে থাকতে পারব না।
কীভাবে থাকতে পারবে না?
এই যে সবসময় সতর্ক হয়ে, চোখ কান খোলা রেখে একটা হাত ট্রিগারের পর রেখে।
রিদি হেসে বলল, এখন বেঁচে থাকার এটাই হচ্ছে নিয়ম।
আমি এভাবে বেঁচে থাকতে চাই না।
তাহলে তুমি কীভাবে বেঁচে থাকতে চাও?
আমি আমার গ্রামে ফিরে যেতে চাই। সেখানে থাকতে চাই।
তোমার গ্রামে কে আছে রুহান?
আমার মা। আমার ছোট দুটি বোন। নুবা আর ত্রিনা।
রিদি কিছু না বলে কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রুহান জিজ্ঞেস। করল, তোমার কে আছে রিদি?
আমার কেউ নেই।
কেউ নেই?
না।
কেন নেই সেটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে রুহান থেমে গেল। সে নিজে থে যদি বলতে না চায় তাহলে হয়তো জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। রুহান বল, তাহলে তুমিও চল আমার সাথে। আমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর, তোমার ভালো লাগবে।
রিদি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রুহা। বলল, সারা পৃথিবীর সবাই বলছে যার জোর বেশি সে যেটা বলবে সেটাই হচ্ছে নিয়ম। মানুষ আর পশুর মধ্যে এখন কোনো পার্থক্য নেই। আমরা বলল সেটা ভুল। আমাদের গ্রাম দিয়ে সেটা শুরু করব। ছোট একটা স্কুল বানাব। ছেলে-মেয়েরা সেখানে পড়বে। ক্রিস্টাল রিডার না থাকলে আমরা বর্ণমা! শেখাব, বই বানাব, বই পড়াব। আবার জ্ঞান চর্চা শুরু করব। একজন মানুষ আরেকজনকে ভালোবাসবে-
রুহান হঠাৎ থেমে গেল। রিদি জিজ্ঞেস করল, কী হলো? শুনতে তো ভালোই লাগছিল, থামলে কেন?
ঐ লোকটা ফিরে এসেছে সাথে আরো দুইজন। একজন পুরুষ অন্য মহিলা।
রিদির শরীরটা একটু শক্ত হয়ে যায়। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, কী করতে ওরা?
কিছু করছে না, দেখছে। আমাদের দেখছে।
রুহান আর রিদি নিঃশব্দে বসে থাকে। মানুষগুলো কিছুক্ষণ তাদের দেখে আবার বের হয়ে গেল। রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ভালো লাগে না। আমার একেবারেই ভালো লাগে না। এভাবে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই।
রিদি কিছু না বলে নিঃশব্দে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল।
সন্ধ্যেবেলা দুজন আবার বের হয়েছে। গান বাজনার বিকট সুর থেকে সরে গিয়ে তারা মূল বাজারটার দিকে এগিয়ে যায় উজ্জ্বল আলোতে বিচিত্র পোশাক পরা মানুষজন হাঁটাহাঁটি করছে, জিনিসপত্র দরদাম করছে কিনছে। এখানে এলে ঠাৎ করে মনে হয় পৃথিবীতে বুঝি কোনো সমস্যা নেই।
হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটু ভিড় দেখে দুজনে এগিয়ে যায়, একটা খাঁচার ভেতরে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে। পাশে একটা ছোট মঞ্চ, সেখানে একজন কিশোর দাঁড়িয়ে আছে। কিশোরটি এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, দেখে মনে হয় তার চারপাশে কী ঘটছে সে বুঝতে পারছে না। কিশোরটির পাশে একজন মানুষ হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে কথা বলছে।
রুহান এবং রিদি শুনল, মানুষটি বলছে, এর নাম কিসি। কিসির বয়স বারো কিন্তু তোমরা দেখতে পাচ্ছ তার বাড়ন্ত শরীর। একদিন সে যে একজন হাট্টাকাট্টা জোয়ান হবে সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা আমাদের নিজস্ব ডাক্তার দিয়ে কিসিকে পরীক্ষা করিয়েছি। কিসি একেবারে সুস্থ। সবল এবং নিরোগ তার শরীরে কোনো রোগ-জীবাণু নেই। কিসির পরিরারের জিনিসপত্র আমাদের কাছে আছে, ডি.এন.এ প্রোফাইলও আছে, ইচ্ছা করলে তোমরা দেখতে পার।
মানুষটি দম নেবার জন্যে একটু থামল, তখন রুহান আর রিদি বুঝতে পরল এখানে মানুষ বেচা-কেনা হচ্ছে। তারা আগে কখনো এটি দেখে নি, দুজনেই এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে যায়। মানুষটি মাইক্রোফোনটা গুখের কাছে নিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করে, এই ছেলেটাকে আমরা এনেছি দক্ষিণের অঞ্চল থেকে। অনেক কষ্ট করে আনতে হয়েছে, তোমরা জান সারা পৃথিবীতে মারামারি কাটাকাটি চলছে। এর মধ্যে মানুষ ধরে আনা সোজা কথা না। যেভাবে চলছে তাতে মনে হচ্ছে কিছুদিন পর সাধারণ মানুষ আর মানুষের বাজারে হাত দিতে পারবে না, দাম কমপক্ষে তিন-চার গুণ বেড়ে যাবে। এখনই সময় আমি অনেক কম দামে ছেড়ে দিচ্ছি, এই বাড়ন্ত কিশোরটি মাত্র দুই ইজার ইউনিট!
পাশে থেকে একজন বলল, দুই হাজার ইউনিট কী মাত্র হলো নাকি? এই দমে একটা গাড়ি কেনা যায়।
মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা বলল, গাড়ি আর মানুষ কী এক জিনিস? আস্ত একটা মানুষ পেয়ে যাচ্ছ। যদি এর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খোলা বাজারে বিক্রি করো তাহলে কত দাম পাবে জান? আজকাল ভালো একটা হৃৎপিণ্ডই পাঁচশো ইউনিটের কমে পাওয়া যায় না। হৃৎপিণ্ড ছাড়া আছে কিডনি, লিভার, লাংস। চোখের কর্ণিয়া, ব্রেন আর রক্ত। একেবারে ফ্রেশ রক্ত। তুমি যদি মানুষটাকে সারা জীবন পালতে না চাও কেটেকুটে বিক্রি করে দিতে পারো। তাতে লাভ হবে আরো বেশি। কিনবে কেউ?
বুড়ো মতো একজন মানুষ বলল, ধুর! পোলাপান দিয়ে কী করব? মেয়েমানুষ থাকলে দেখাও।
মেয়েমানুষ? মেয়েমানুষ থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে। আমাদে৷ কোম্পানির আসল বিজনেস হচ্ছে মেয়েমানুষের বিজনেস। আমাদের নেটওয়াএকেবারে গভীর গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। সারা দেশ খুঁজে আমরা সুন্দর মেয়েমানুষ ধরে আনি।
মানুষটি খাঁচা খুলে কিসি নামের কিশোরটাকে ভিতরে ঠেলে দিয়ে এ মেয়েকে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। মেয়েটার ভাবলেশহীন মুখ। চোখে মুখে এক ধরনের বিচিত্র কাঠিন্য। মাথায় এলোমেলো চুল, শরীরে কাপড় অবিন্যস্ত। মানুষটা মেয়েটির চারপাশে ঘুরে মুখে একধরনের পরিতৃপ্তি শব্দ করে বলল, এই মেয়েটার নাম ক্রিটিনা। মেয়েটার শরীরটা একবার ভালো করে দেখ! দেখলেই জিবে পানি চলে আসে।
মানুষটার কথা শুনে উপস্থিত অনেকেই শব্দ করে হেসে উঠল। উৎসাহ পেয়ে মানুষটা বলল, একেবারে গহীন একটা গ্রাম থেকে ধরে এনেছি, যেভ। এনেছি ঠিক সেইভাবে তোমাদের সামনে হাজির করেছি। তোমরা কল্পনা করা। নাও যখন এই মেয়েকে সাজিয়ে গুছিয়ে আনবে তখন তাকে দেখতে কেমন লাগবে। মনে হবে একেবারে আগুনের খাপরা।
মানুষটি একটু দম নিয়ে বলল, এই আগুনের খাপরার বয়স উনিশ। পরিরারের কাগজপত্র, ডি.এন.এ প্রোফাইল সবকিছু তৈরি আছে। ইচ্ছে করলে দেখতে পার। ডাক্তারী পরীক্ষা হয়েছে, একেবারে সুস্থ সবল নিরোগ। অনে কষ্ট করে অনেক দূর থেকে এনেছি তাই দাম একটু বেশি কিন্তু এই জিনিস কম দামে পাবে না।
বুড়ো মানুষটা মুখের লোল টেনে বলল, কত দাম?
পাঁচ হাজার ইউনিট।
পাঁচ হাজার? বুড়ো মানুষটা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, পাঁচ হাজার ইউনিট কী ছেলেখেলা নাকি?
মাইক্রোফোন হাতে মানুষটা বলল, আমি কী বলেছি এটা ছেলেখেলা? ভালো জিনিস চাইলে তার দাম দিতে হয়। বুঝেছ?
বুড়ো মানুষটা বলল, আমাকে আগে ভালো করে দেখতে দাও।
দেখ দেখ, যত খুশি দেখ। এর মধ্যে কোনো ভেজাল নেই।
বুড়ো মানুষটি মঞ্চে উঠে মেয়েটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তারপর সন্তুষ্টির মতো একটা শব্দ করে পকেট থেকে ইউনিটের বান্ডিল বের করে গুনে গুনে দিতে থাকে।
রুহান মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ মুখে কী গভীর একটা বিষাদের ছাপ। চোখ থেকে নেমে আসা পানি গালের উপর শুকিয়ে রয়েছে। বড় বড় চোখে এক ধরনের অবর্ণনীয় অবিশ্বাস নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে এক গভীর হতাশা।
বুড়ো মানুষটা তার ইউনিটগুলো মাইক্রোফোন হাতের মানুষটাকে ধরিয়ে দিয়ে মেয়েটার হাত ধরে টেনে আনতে শুরু করে। কী করছে বুঝতে না পেরেই রুহান হঠাৎ গলা উঁচিয়ে বলল, এই যে বুড়ো, তুমি দাঁড়াও।
বুড়ো মানুষটি দাঁড়িয়ে গেল, তার মুখে ক্রোধের একটা ছায়া পড়ে। সে কঠিন চোখে ভিড়ের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কে তার সাথে এই অশোভন গলায় কথা বলছে। মানুষটা রুহান সেটা আবিষ্কার করে বুড়ো মানুষটা কেমন যেন থিতিয়ে যায়–তার সারা শরীর ঝুলে থাকা অস্ত্রগুলোই যে এর কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে শুকনো গলায় বলল, হয়েছে?
তুমি মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।
ছেড়ে দেব? কষ্ট করেও বুড়ো তার গলায় ঝাঁঝটুকু লুকাতে পারে না, কেন ছেড়ে দেব?
রিদি হতাশ একটা ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, রুহান এখন কী করবে সে জানে না। যেটাই করুক তাকে তার সাথে থাকতে হবে। মনে হচ্ছে এটা তার ভবিতব্য–রুহান কিছু একটা করে বসবে আর তাকে সেটা সামাল দিতে হবে। রিদি সতর্ক ভঙ্গিতে পিছন থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা তুলে নেয় এবং সেটা উপস্থিত কারো দৃষ্টি এড়াল না।
রুহান হেঁটে হেঁটে ছোট মঞ্চটার উপরে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, মানুষ বেচাকেনা করা যায় না।
বুড়ো মানুষটার চোখে মুখে জ্বালা ধরানো এক ধরনের বিতৃষ্ণার ছাপ পড়ল। সে মাথা ঘুরিয়ে মাইক্রোফোন হাতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, কী বলছে এই মানুষ?
মাইক্রোফোন হাতের মানুষটা একটু এগিয়ে এসে বলল, তুমি এই মেয়েটাকে নিতে চাইছিলে? এটা তো বিক্রি হয়ে গেছে। তুমি চিন্তা করো না আমার কাছে আরও আছে। এই দেখ আমার সাপ্লাই-
রুহান মাথা নেড়ে বলল, উঁহু। আমি মোটেও সেটা বলি নাই। আমিক বলেছি মানুষ বেচা-কেনা বন্ধ।
বন্ধ?
হ্যাঁ। বন্ধ।
কবে থেকে?
অনেকদিন থেকে। মানুষ আগে যখন অসভ্য আর জংলী ছিল তখন একজন মানুষ আরেকজনকে বিক্রি করত। এখন মানুষ সভ্য হয়েছে এখন তারা মানুষ বিক্রি করে না।
মাইক্রোফোন হাতের মানুষটিকে এবারে পুরোপুরি বিভ্রান্ত দেখায়। সে আমতা আমতা করে বলল, দেখ। তুমি নিশ্চয়ই এখানে নতুন এসেছে! এখন বাজারে নিয়মিত মানুষ, মেয়েমানুষ, বাচ্চা-কাচ্চা বিক্রি হয়। বিশাল ব্যবসা। আমি অনেকদিন থেকে করছি–
রুহান তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, ভুল করছিলে। আর করবে না। সে খাঁচার ভেতরে আটকে থাকা মানুষগুলো দেখিয়ে বলল, এদে সবাইকে ছেড়ে দাও।
মাইক্রোফোন হাতের মানুষটির চোখে মুখে এবারে একটা ক্রোধের চিহ্ন ফুটে ওঠে, সে কঠিন চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কে আমি জানি না। তুমি কী জন্যে এটা করছ সেটাও আমি জানি না। আমি বলছি, তুমি এখান থেকে যাও। আমার এই ব্যবসা আমি এমনি এমনি করি না। আমার গার্ডদের ডাকলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
তাহলে তুমি বলছ মানুষ বেচা-কেনা করা যায়?
অবশ্যই করা যায়। এই লাল পাহাড় হচ্ছে মুক্তাঞ্চল। যে কোনো জায়গা থেকে যে কোনো জিনিস এনে এখানে বিক্রি করা যায়। এটা হচ্ছে মুক্তাঞ্চলের অলিখিত আইন।
ভারি মজা তো।
মাইক্রোফোন হাতের মানুষটি বলল, মজা?
হ্যাঁ। তার মানে আমিও ইচ্ছে করলে মানুষকে বিক্রি করতে পারব?
অবশ্যই পারবে।
ঠিক আছে, আমি তাহলে চেষ্টা করে দেখি। বলে সে খপ করে মানুষটির কলার ধরে কাছে টেনে এনে তার হাত থেকে মাইক্রোফোনটা কেড়ে নেয়। এক হাতে মানুষটাকে ধরে রেখে অন্য হাতে মাইক্রোফোনটা মুখের সামনে ধরে সে বলল, তোমাদের কাছে বুড়া হাবড়া অপদার্থ একটা মানুষ বিক্রি করতে চাই। কথা বেশি বলে এ ছাড়া এর আর কোনো সমস্যা নেই। কে কিনতে চাও?
উপস্থিত মানুষদের ভেতর থেকে একজন কৌতুকপ্রিয় মহিলা জিজ্ঞেস করল, কত দাম?
খুব সস্তায় ছেড়ে দিচ্ছি। দাম মাত্র এক ইউনিট।
উপস্থিত মানুষগুলোর ভেতরে একটা হাসির রোল উঠল। মহিলাটি বলল, এত সস্তা হলে এক ডজন কিনতে চাই।
আমার কাছে এক ডজন নেই, একটাই আছে। এরকম অপদার্থ মানুষ ডজন ডজন তৈরি হয় না।
দাও তাহলে- মহিলাটি সত্যি সত্যি তার ব্যাগ খুলে ইউনিট বের করতে শুরু করে।
রুহান কলার ধরে রাখা মানুষটাকে বলল, দিই তোমাকে বিক্রি করে?
কী করছ তুমি বুঝতে পারছ না? মানুষটি ক্রুদ্ধ গলায় বলল, সবকিছু নিয়ে তামাশা করা যায় না।
আমি মোটেও তামাশা করছি না। রুহান ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি যদি জোর করে ধরে এনে মানুষ বিক্রি করতে পার তাহলে আমি কেন জোর করে ধরে তোমাকে বিক্রি করতে পারব না?
মানুষটি চট করে এই যুক্তিটার উত্তরে কিছু বলতে পারল না। খানিক্ষণ আমতা আমতা করে বলল, তুমি এরকম পাগলামী করতে পার না—
রুহান তখন মানুষটিকে ছেড়ে দেয়। বলে, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি এরকম পাগলামী করতে পারি না। মানুষ হয়ে মানুষকে বিক্রি করে দেয়া পাগলামী। এটা কেউ করতে পারে না। আমি যেমন তোমাকে করব না–তুমিও এদের করবে না। বুঝেছ?
মানুষটি কিছু অশ্লীল কথা উচ্চারণ করে উন্মত্তের মতো চিৎকার করে বলল, গার্ড!
রিদি এবারে তার অস্ত্রটা মাথার উপরে তুলে চিৎকার করে বলল, খবরদার, কেউ নড়বে না।
তার চিৎকারে যে যেখানে ছিল সেখানেই থেমে গেল।
রিদি বলল, গার্ডরা, তোমরা ইচ্ছে করলে আমাকে গুলি করার চেষ্টা করতে পার। কিন্তু আমি আগেই বলে দিচ্ছি তোমরা অস্ত্রটা তোলার আগেই তোমাদের আমি শেষ করে দিতে পারব। বুঝেছ?
কেউ কোনো কথা বলল না। মানুষগুলো নিজেদের ভেতরে চাপা গলা কথা বলতে থাকে এবং হঠাৎ কমবয়সী একটা মেয়ে এগিয়ে এসে উত্তোও গলায় বলল, তোমরা কী খেলোয়াড়? তোমরাই কী ক্ৰিভনকে ধরে নিয়েছিলে?
রিদি আর রুহান একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তাদের পরিচয় আর গোপন রাখার প্রয়োজন নেই। রিদি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
বিস্ময়ের একটা সম্মিলিত শব্দ শোনা গেল, এবারে অনেকেই তাদের কাজে আসার চেষ্টা করে, ভালো করে এক নজর দেখার চেষ্টা করে। কমবয়সী কয়েকটা মেয়ে আনন্দে এক ধরনের চিৎকার করতে থাকে। চারদিকে মানুষে হুঁটোপুটি শুরু হয়ে যায়।
রুহান মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তোমরা সবাই শান্ত হও। আমি তোমাদের সবাইকে সাক্ষী রেখে বলছি আজ থেকে লাল পাহাড়ে মানুষ বেচাকেনা বন্ধ। আর কেউ এখানে দূরের গ্রাম থেকে মানুষ ধরে এনে বিক্রি করতে পারবে না।
উপস্থিত মানুষগুলো উল্লাসের মতো এক ধরনের শব্দ করল। তারা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে সেরকম মনে হলো না, কোনো একটা বিষয় নিয়ে হৈ চৈ হচ্ছে সেটা নিয়েই আনন্দ!
কাছাকাছি ক্রিটিনা দাঁড়িয়ে ছিল, রুহান বলল, ক্রিটিনা তোমাকে কেউ বিক্রি করতে পারবে না। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
ক্রিটিনা কোনো কথা না বলে স্থির চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। রুহান বলল, তুমি মুক্ত। তুমি যেখানে খুশি যেতে পার।
ক্রিটিনা ফিসফিস করে বলল, আমি তোমাকে ঘৃণা করি। অসম্ভব ঘৃণা করি।
রুহান চমকে ওঠে বলল, ঘৃণা করো? আমাকে?
হ্যাঁ। তুমি ভেবেছ আমি তোমাদের মতো মানুষদের চিনি না? খুব ভালো করে চিনি। গলায় একটা অস্ত্র ঝুলিয়ে তোমরা মনে করো সারা পৃথিবীটা তোমাদের। যা ইচ্ছা তাই করতে পার।
রুহান কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, বিশ্বাস করো, আমি সেরকম কিছু ভাবছি না।
আমি জানি তুমি ঐ মানুষটার কাছ থেকে কেন আমাদের ছিনিয়ে নিয়েছ।
কেন?
তুমি এখন আমাদের অন্য কোথাও বিক্রি করবে।
না, ক্রিটিনা বিশ্বাস করো, তোমাদের আমি অন্য কোথাও বিক্রি করব না। তোমরা যেখানে খুশি যেতে পার। তোমরা স্বাধীন–
ক্রিটিনা হঠাৎ আনন্দহীন শুকনো হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল। হাসতে হাসতে বলল, আমরা স্বাধীন?
হ্যাঁ।
আমরা স্বাধীন হয়ে এখন কোথায় যাব? বাইরে তোমার মতো হাজার হাজার মানুষ বসে আছে আমাদের ধরে নিতে! আমরা কোথায় যাব? কী করব?
তোমাদের গ্রামে যাবে!
আমাদের গ্রাম কত দূর তুমি জান? এরা সেই গ্রামে কী করেছে তুমি জান? কত বাড়ি পুড়িয়েছে, কত মানুষ মেরেছে তুমি জান?
আমি দুঃখিত ক্রিটিনা–
ক্রিটিনা হঠাৎ চিৎকার করে বলল, খবরদার, যেটা বিশ্বাস করো না সেটা মুখে উচ্চারণ করো না।
রুহান থতমত খেয়ে বলল, আমি কী বিশ্বাস করি না?
দুঃখিত হবার কথা বলো না। কারণ তোমরা দুঃখিত না। তোমরা আমাদের লুট করে নিয়ে এখন কোথাও বিক্রি করবে। আমি জানি–
বিশ্বাস করো ক্রিটিনা—
ক্রিটিনার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলে উঠল। সে হিংস্র গলায় বলল, খবরদার, তুমি বিশ্বাস করার কথা মুখে আনবে না। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। কাউকে না।
১০. রিদি রুহানের দিকে এগিয়ে এসে
রিদি রুহানের দিকে এগিয়ে এসে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব বিপদের মধ্যে পড়েছ।
রুহান একটু কষ্ট করে হেসে বলল, তোমার কী ধারণা?
আমার ধারণা তুমি এবং আমি দুজনেই খুব বিপদের মধ্যে পড়েছি। একজন মানুষের পুরো ব্যবসা তুমি লুট করে নিয়েছ সে কী এটা সহজভা। মেনে নেবে? নেবে না!।
আমি কিছু লুট করি নি। আমি এই মানুষগুলোকে মুক্ত করে দেবার চেষ্টা। করছিলাম।
রিদি শব্দ করে হেসে বলল, তুমি যাদেরকে মুক্ত করেছ তারাও তোমাকে বিশ্বাস করে নি, আর তুমি আশা করছ অন্যেরা বিশ্বাস করবে?
রুহান মাথা চুলকে বলল, কী করা যায় বুঝতে পারছি না।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সরে যেতে হবে। সবাইকে নিয়ে।
কিন্তু সেটা কীভাবে করব?
ঠিক এরকম সময় তারা দেখতে পেল একজন মানুষ ভিড় ঠেলে তাদের দিকে আসছে। কাছাকাছি এলে তারা মানুষটিকে চিনতে পারল, এজেন্ট দ্রুচেন।
এজেন্ট দ্রুচেন কাছে এসে দুজনের হাত ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, অভিনন্দন। তোমাদের অনেক অনেক অভিনন্দন।
রুহান ভুরু কুঁচকে বলল, কেন? কীসের অভিনন্দন?
তোমরা দুজন মিলে এত বড় একটা সাপ্লাই লুট করে নিলে এটা কী সোজা কথা? কার কাছে বিক্রি করবে ঠিক করেছ কিছু? আমার পরিচিত কিছু খরিদ্দার আছে, খুব ভালো ব্যবসা করে। এখান থেকে পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটার দূরে থাকে, আমি তোমাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারি। শতকরা দশ ভাগ কমিশন আমার, আমি আগে থেকে বলে রাখছি।
রুহান কিছু না বলে নিঃশব্দে এজেন্ট দ্রুচানের দিকে তাকিয়ে রইল। দ্রুচান বলল, কী হলো তুমি কথা বলছ না কেন?
রুহান তবু কোনো কথা বলল না। এজেন্ট দ্রুচান বলল, এর থেকে কম কমিশনে আমি কাজ করতে পারব না। অসম্ভব!
রুহান এবারেও কোনো কথা বলল না। দ্রুচান বলল, তোমাদের কী হয়েছে? তোমরা কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন? কত কমিশন দিতে পারবে?
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা কোনো কমিশন দিতে পারব না এজেন্ট দ্রুচান। তার কারণ আমরা এই মানুষগুলোকে বিক্রি করার জন্যে লুট করি নি! তাদের যেখান থেকে ধরে আনা হয়েছে আমরা সেখানে গিয়ে তাদের রেখে আসব।
এজেন্ট দ্রুচান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী পাগল?
আমি বলেছি এই মানুষগুলোকে যেখান থেকে ধরে আনা হয়েছে আমরা তাদের সেখানে রেখে আসব।
এজেন্ট দ্রুচান একবার রিদির মুখের দিকে তাকাল তারপর মাথা ঘুরিয়ে আবার রুহানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা আমার সাথে ঠাট্টা করছ?
না, আমরা ঠাট্টা করছি না। আমরা সত্যি কথা বলছি।
এজেন্ট দ্রুচান তখনো বিষয়টা বুঝতে পেরেছে বলে মনে হলো না, মাথা চুলকিয়ে বলল, কিন্তু কেন?
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তার কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে মানুষ কখনো পণ্য হতে পারে না, একজন মানুষকে কখনো পণ্য হিসেবে বেচাকেনা করা যায় না।
এজেন্ট দ্রুচান বাধা দিয়ে বলল, কে বলেছে করা যায় না। সবাই করছে।
তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা মনে করি একজন মানুষ কখনো অন্য মানুষকে বেচা-কেনা করতে পারে না।
এজেন্ট দ্রুচান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আসলেই সেটা যদি তোমাদের পরিকল্পনা হয়ে থাকে তাহলে তোমরা খুব বিপদের মধ্যে আছ!
তোমাদের নিরাপত্তা দেবার কেউ নেই–এই লোক ক্ৰিভনের খুব কাছের মানুষ। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকজন আসবে তোমাদের ধরতে।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমারও তাই ধারণা।
তোমাদের এক্ষুনি সরে পড়তে হবে। এই মুহূর্তে।
ঠিকই বলেছ।
কীভাবে পালাবে এখান থেকে?
আমরা ভাবছিলাম তুমি আমাদের নিয়ে যাবে।
আমি? এজেন্ট দ্রুচান অবাক হয়ে বলল, আমি কেন নিয়ে যা যেখানে এক ইউনিট কমিশন নেই সেখানে আমি কেন তোমাদের নিয়ে যাব?
রুহান এজেন্ট দ্রুচানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নিয়ে যা। কারণ সেটা হবে এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে সাহায্য করার একটা সুযোগ। তুমি তাদের সাহায্য করবে।
এজেন্ট দ্রুচান অবাক হয়ে রুহানের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে যায়, চোখ মুছে নিজেকে। সামলে নিয়ে বলল, তুমি খুব মজার মানুষ। আমি বিশ্বাস করতে পারি না। কেউ একজন তোমার মতো করে কথা বলতে পারে।
রুহান বলল, আমি এমন কিছু বিচিত্র কথা বলি নি। পৃথিবীটা গড়ে উঠে মানুষের জন্যে মানুষের ভালোবাসার কারণে। তুমি যদি এই মানুষগুলো সাহায্য করো তাহলে সেই ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারবে। মানুষের জন্যে। ভালোবাসার মতো সুন্দর জিনিস পৃথিবীতে আর কিছু নেই! বিশ্বাস করো।
এজেন্ট দ্রুচান এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে তুমি আমাকে এসব বলছ।
রুহান বলল, তুমি বিশ্বাস করবে কী না, সেটা তোমার ব্যাপার। কি আমি যেটা বলছি সেটা সত্যি বলছি।
এজেন্ট দ্রুচান মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আমি গেলাম। তোমরা কী করবে তোমরাই জান। আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি যে তোমরা যদি এখনই এখান থেকে সরে না পড়ে তোমাদের কপালে দুঃখ আছে। অনেক বড় দুঃখ।
এজেন্ট দ্রুচান চলে যাবার পর রিদি রুহানের সামনে দাঁড়িয়ে বল, তাহলে কী করবে ঠিক করেছ?
আপাতত সরে পড়ি।
কোথায় সরে পড়বে?
পাহাড়ের দিকে যাই। জঙ্গলে ঢুকে পড়ি–সেখানে চট করে কেউ খুঁওে পাবে না।
রিদি মাথা নাড়ল, খুব ভালো একটা পরিকল্পনা হলো বলে মনে হচ্ছে না কিন্তু আর তো কিছু করার নেই। রিদি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, চল তাহলে রওনা দিই।
ঘণ্টাখানেক পরে পাহাড়ী পথে রুহান আর রিদি জনা ত্রিশেক নানা বয়সের তরুণ-তরুণী নিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। আবছা অন্ধকার, আকাশে একটা ভাঙ্গা দ, তার মৃদু আলোতে সবাই নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে। ছোট একটা উপত্যকা পার হলে তারা একটা পাহাড়ী রাস্তায় উঠতে পারবে। এই রাস্তা ধরে দক্ষিণে কয়েকশ কিলোমিটার যেতে হবে। কেমন করে যাবে তারা এখনো জানে না।
উপত্যকাটা পার হয়ে তারা পাহাড়ী রাস্তায় এসে ওঠে। কম বয়সী ছেলেমেয়েগুলো পথের পাশে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। আবছা অন্ধকারে তাদের চেহারা দেখা যায় না, শুধু ভাগ্যের উপর অসহায়ভাবে সবকিছু অসমর্পণ করে দেয়ার ভঙ্গিটুকু বোঝা যায়।
রুহান নিচু গলায় বলল, তোমরা বিশ্রাম নেবার জন্যে খুব বেশি সময় পাবে না। আমাদের এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে হবে।
অন্ধকারে বসে থাকা একজন তরুণ জিজ্ঞেস করল, কেন?
তোমাদের যাদের কাছ থেকে ছুটিয়ে এনেছি তারা তোমাদের আবার ধরে–তে আসতে পারে।
অন্ধকারে বসে থাকা তরুণটি বলল, তাতে কী আসে যায়? আমরা তোমাদের হাতে থাকি আর অন্যের হাতে থাকি তাতে কী আসে যায়?
রুহান কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন অনেক দূরে একটা লরির হেডলাইট দেখতে পেল।
রিদি নিচু গলায় বলল, সবাই পিছনে সরে যাও। বনের ভেতরে গিয়ে লুকিয়ে যাও।
আবছা অন্ধকারে বসে থাকা তরুণটি বলল, কেন? কেন আমাদের পিছনে সরে যেতে হবে?
কারা আসছে আমরা জানি না। তারা কী চায় সেটাও জানি না। যদি গোলাগুলি শুরু হয় তোমাদের নিরাপদে থাকা দরকার। মাথা নিচু করে মাটিতে শুয়ে থাক। যাও।
আবছা অন্ধকারে বসে থাকা তরুণ-তরুণীগুলো উঠে দাঁড়িয়ে হুঁটোপুটি করে বনের ভেতরে ছুটে যেতে থাকে। রিদি আর রুহান দুটি বড় গাছের মড়ালে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা লরিটির ইঞ্জিনের চাপা গুঞ্জন শুনতে পেল। দেখতে দেখতে সেটা তাদের কাছাকাছি চলে আসে। রিদি আর রুহান অবাক হয়ে দেখল তাদের কাছাকাছি এসে লরিটি থেমে যায়। তারা ভাবছিল লরির পিছন থেকে অস্ত্র হাতে অনেকগুলো মানুষ নামবে কিন্তু সেরকম কিছু হলো। তারা অবাক হয়ে দেখল শুধু ড্রাইভিং সীট থেকে একজন মানুষ নেমে এলে। আবছা অন্ধকারে তাকে স্পষ্ট দেখা যায় না, চোখে লাগানো ইফ্রারেড গগলসটা শুধু চোখে পড়ে। মানুষটি এদিকে সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ উচ্চস্বরে ডাক, রুহান, রিদি–
রুহান আর রিদি মানুষটির গলার স্বর চিনতে পারে, এজেন্ট দ্রুচান। গাছে। আড়াল থেকে দুজনে বের হয়ে এলো, রুহান বলল, কী ব্যাপার দ্রুচান? তুমি এখানে?
এজেন্ট দ্রুচান বলল, তোমার মানুষজন কোথায়? দেরি করো না, তাড়াতাড়ি ওঠো লরিতে। তোমাদের খোঁজে বিশাল বাহিনী রওনা দিচ্ছে।
রুহান এজেন্ট দ্রুচানের কাছে গিয়ে নরম গলায় বলল, আমি জানতাম তুমি আসবে।
এজেন্ট দ্রুচান বিরক্ত গলায় বলল, বাজে কথা বলো না। আমি নিজে জানতাম না আর তুমি কেমন করে জানতে?
তুমি না জানতে পার, কিন্তু আমি জানতাম। এই পৃথিবীটা টিকে যাণে কেন তুমি জান এজেন্ট দ্রুচান?
আমার এত বড় বড় জিনিস জানার কোনো সখ নেই রুহান। আমি শুধু জানি যদি এক্ষুনি এই লরিতে সবাই না ওঠো তাহলে কিন্তু কেউ পৌঁছাতে পারবে না।
রুহান এজেন্ট দ্রুচানের কথাটা না শোনার ভান করে বলল, এই পৃথিবীট। টিকে যাবে কারণ মানুষের ভেতরে এখনো মনুষ্যত্বটুকু বেঁচে আছে।
এজেন্ট দ্রুচান বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি যে কী বাজে বকতে পারো রুহা। সেটা অবিশ্বাস্য।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় পাহাড়ী পথ দিয়ে লরিটি ছুটে যাচ্ছে। সামনের ড্রাইভিং সিটে এজেন্ট দ্রুচানের পাশে বসেছে রিদি। পিছনে অন্য সবার সাথে বসেছে রুহান। রুহান পিছনের খোলা অংশ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। লরির ভেতরে চুপচাপ বসে আছে অন্য সবাই।
বসে থাকতে থাকতে রুহানের চোখে হঠাৎ একটু ঘুমের মতো এসেছিল। হঠাৎ করে তার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল, তার কোলের উপর রাখা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা কেউ একজন হ্যাচকা টান দিয়ে সরিয়ে নিয়েছে। রুহান মাথা ঘুরিয়ে দেখে মানুষটি ক্রিটিনা। সে অস্ত্রটা তার দিকে তাক করে ধরে রেখেছে, আবছা অন্ধকারেও বোঝা যায় তার চোখ ধকধক করে জ্বলছে। রুহান কোনো কথা না বলে স্থির চোখে ক্রিটিনার দিকে তাকিয়ে রইল।
ক্রিটিনা হিংস্র গলায় বলল, লরি থামাও।
কেন?
আমরা নেমে যাব।
কোথায় নেমে যাবে?
সেটা তোমার জানার প্রয়োজন নেই।
রুহান বলল, ক্রিটিনা, আমরা তোমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছি।
তোমাদের সাহায্যের কথা আমি খুব ভালো করে জানি! তোমরা হচ্ছ খুনে ৬াকাত ঠগ আর প্রতারক–
আমার কথা শোনো—
ক্রিটিনা চিৎকার করে বলল, আমি কোনো কথা শুনব না। লরি থামাও।
যদি না থামাই? তোমাকে আমি খুন করে ফেলব।
রুহান হাসার চেষ্টা করল, যদিও আবছা অন্ধকারে সেটা কেউ দেখতে পেল না। সে নরম গলায় বলল, খুন করে ফেলবে?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে। করো খুন।
ক্রিটিনা হিংস্র গলায় বলল, আমাকে রাগানোর চেষ্টা কর না–
রুহান বলল, আমি তোমাকে মোটেও রাগানোর চেষ্টা করছি না, ক্রিটিনা আমি তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। তুমি বুঝতে চাইছ না। আমি তোমাকে বলেছি, তোমাদের আমরা তোমাদের গ্রামে নিয়ে যেতে যাচ্ছি–
মিথ্যে কথা বলবে না। ক্রিটিনা চিৎকার করে বলল, আমার সাথে মিথ্যে কথা বলবে না।
ঠিক আছে, আমি আর কথাই বলব না।
খুন করে ফেলব তোমাদের সবাইকে।
কীভাবে খুন করবে?
গুলি করে খুন করব।
তুমি কী আগে কখনো এরকম অস্ত্র ব্যবহার করেছ? তুমি কী জান কেমন করে গুলি করতে হয়?
ক্রিটিনাকে এক মুহূর্ত একটু ইতস্তত করতে দেখা যায়। ইতস্তত করে বলে, সব অস্ত্রই এক। আমি জানি ট্রিগার টানলেই গুলি হয়।
না। রুহান মাথা নাড়ল, নিরাপত্তার কিছু ব্যাপার থাকে। ট্রি। টানলেই গুলি হয় না। আমার কথা বিশ্বাস না করলে তুমি ট্রিগার টেনে দেখতে পার।
ক্রিটিনা ইতস্তত করে অস্ত্রটা বাইরে তাক করে ট্রিগার টানল, ঘট করে একটা শব্দ হলো কিন্তু কোনো গুলি হলো না। রুহান বলল, এখন আমার বা বিশ্বাস হলো? তুমি অস্ত্রটা আমার কাছে নিয়ে এসো, আমি তোমাকে দেখি দেই কেমন করে সেফটি লিভারটা টানতে হয়।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।
ঠিক আছে, তাহলে অস্ত্রটা আমাকে দিতে হবে না। তুমি নিজেই কর। ডানপাশে উপরের লিভারটা টেনে নিজের দিকে আন।
ক্রিটিনা অনিশ্চিতের মতোন লিভারটি নিজের দিকে টেনে আনে। রুহান পরিতৃপ্তির মতো শব্দ করে বলল, চমৎকার! এখন তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে গুলি করে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারবে। বিশ্বাস না করলে পরীক্ষা করে দেখ!
ক্রিটিনা অস্ত্রটা বাইরে তাক করে ট্রিগার টানতেই ভয়ঙ্কর শব্দ করে অস্ত্রটি গর্জন করে ওঠে। লরির ভেতরে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলো ভয় পেয়ে চিৎকার করে পিছনে সরে যায়। সামনে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা রিদি এবং দ্রুচান গুলির শব্দ শুনে কারণটা বোঝার জন্যে রাস্তার পাশে লরি থামিয়ে নেমে আসে। রিদি চাপা গলায় বলে, কী হয়েছে রুহান?
বিশেষ কিছু না। রুহান হালকা গলায় বলল, কেমন করে অস্ত্র চালান হয় তার একটা ছোট ট্রেনিং হচ্ছে।
রিদি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, তোমার মাথা খারাপ রুহাব। এটা কী ট্রেনিং দেবার সময়?
রুহান শব্দ করে হেসে বলল, ট্রেনিংয়ের সময় অসময় বলে কিছু নেই রিদি। তোমরা সেটা নিয়ে চিন্তা কর না। যাও লরি চালাতে থাক।
কিছুক্ষণের মধ্যে আবার লরি চলতে শুরু করে। লরির পেছনে বসে থেকে কিছুই হয়নি এরকম একটা ভঙ্গি করে রুহান শিস দিয়ে একটা সুর তোলার চেষ্টা করতে থাকে। ক্রিটিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি কী লিভার আবার সামনে ঠেলে দেব?
তুমি যদি অস্ত্রটা এই মুহূর্তে ব্যবহার করতে না চাও তাহলে সেটাই নিরাপদ।
ক্রিটিনা লিভারটি ঠেলে দিয়ে অস্ত্রটা রুহানের দিকে এগিয়ে দেয়। বলে, নাও।
কী নেব?
এই অস্ত্রটা।
রুহান বলল, তোমার কাছে রাখ।
আমার কাছে রাখব?
হ্যাঁ।
কেন?
দুটি কারণে। এক, আমি চাই তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর, যে সত্যিই আমরা তোমাদেরকে তোমাদের এলাকায় ফিরিয়ে দিতে চাই। দুই, আমার কাছে আরো একাধিক অস্ত্র আছে, তুমি যেহেতু অস্ত্র চালাতে শিখেই গেছ, এটা তোমার কাছে থাকলে আমাদের নিরাপত্তা বেশি হয়। যদি দরকার হয় তাহলে তুমিও এটা ব্যবহার করতে পারবে।
ক্রিটিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি দুঃখিত, রুহান আমি যে তোমার কোনো কথা বিশ্বাস করি নি।
এখন করেছ?
তোমাকে বিশ্বাস করেছি, তোমার কথা এখনো বিশ্বাস করি নি।
রুহান শব্দ করে হেসে বলল, আমাকে যদি বিশ্বাস কর তাহলে আগে হোক পরে হোক একদিন আমার কথাকেও বিশ্বাস করবে।
ক্রিটিনা অস্ত্রটা কোলের উপর রেখে রুহানের পাশে বসল। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা কেন আমাদের উদ্ধার করছ?
রুহান বলল, আমি জানি না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, উত্তরটা পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ। পছন্দ হয়েছে।
কেন?
পৃথিবী থেকে ভালো উঠে গেছে। এটা আবার ফিরে আসবে। এভাবেই আসবে। কেউ জানবে না কেন আসছে। আসবে গোপনে।
রুহান ক্রিটিনার দিকে তাকাল, আবছা অন্ধকারে তার চেহারাটা ভালো। করে দেখা যায় না। চেহারায় এক ধরনের বিষাদের ছাপ।
খুব ভোরবেলা লরিটি থামল। পিছনের দরজা খুলে প্রথমে রুহান তার পিছু ক্রিটিনা নেমে এলো, তারপর অন্য সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে। কয়েক ঘণ্টা আগেও সবার ভেতরে একটা চাপা আশঙ্কা কাজ করছিল। যখন বুঝতে পেরেছে যে আসলেই সবাইকে তাদের নিজের এলাকাতে নিয়ে যাও হচ্ছে তখন হঠাৎ করে সবার ভেতরে এক ধরনের নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার ফুরফুরে আনন্দ এসে ভর করেছে। লরি থেকে নেমে সবাই হৈ চৈ চেচামেচি করতে থাকে–যারা একটু ছোট তারা ছোটাছুটি শুরু করে দেয়।
এজেন্ট দ্রুচান লরির নিচে থেকে একটা বাক্স টেনে নামিয়ে আনে, সেটা খুলতেই ভেতর থেকে শুকনো খাবার আর পানীয় বের হয়ে আসে। সবার মধ্যে সেটা ভাগ করে দিতে দিতে বলল, তাড়াতাড়ি সবাই খেয়ে নাও, আমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রওনা দেব।
কমবয়সী একটা মেয়ে বলল, কেন আমাদের এক ঘণ্টার মধ্যে রওনা দিতে হবে? আমরা কী জায়গাটা একটু ঘুরে দেখতে পারি না?
এখানে দেখার মতো কিছু নেই।
মেয়েটি বলল, কে বলেছে নেই? ঐ যে দূরে একটা কাচের ঘর দেখা যাচ্ছে।
এজেন্ট দ্রুচান বলল, এটা একটা পুরানো মান-মন্দির। ভেঙ্গে চুরে আছে, দেখার মতো কিছু নেই।
কে থাকে ওখানে?
কেউ থাকে না। সাপ খোপ থাকলে থাকতেও পারে।
মেয়েটি আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, আমার সাপখোপ দেখতে খুন। ভালো লাগে। আমি কী দেখতে যেতে পারি?
রুহান বলল, ঠিক আছে যাও। সাপ-খোপ বাঘ সিংহ যেটা ইচেছ দেখতে যেতে পার তবে এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসতে হবে। তোমরা জান তোমাদে: ধরার জন্যে পিছু পিছু অনেক মানুষ আসছে।
একটা ছেলে কঠিন মুখে বলল, আসুক না ধরতে! ওদের বারটা বাজি? ছেড়ে দেয়া হবে না?
রুহান জানতে চাইল। বলল, কে বারটা বাজাবে?
ছেলেটি এক গাল হেসে বলল, কেন? তুমি? তুমি আর রিদি। তোমরা পৃথিবীর সেরা খেলোয়াড়, তোমাদের কাছে কে আসবে?
আশেপাশে যারা ছিল সবাই আনন্দের মতো একটা শব্দ করল।
সবাই চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবার পর এজেন্ট দ্রুচান তার লরিটার কাছে 1য়ে বনেট খুলে ইঞ্জিনের দিকে উঁকি দেয়। কিছু একটা দেখে সে হঠাৎ শিস দেয়ার মতো শব্দ করে। রুহান জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
এজেন্ট দ্রুচান বলল, সমস্যা।
কী সমস্যা।
ইঞ্জিনের কুলেন্ট পাইপে লিক। সব কুলেন্ট পড়ে যাচ্ছে।
কীভাবে হলো?
পুরানো ইঞ্জিন সেটা হচ্ছে সমস্যা। ভালো কুলেন্ট পাওয়া যায় না, জোড়াতালি দিয়ে তৈরি হয় সেটা আরেকটা সমস্যা।
রুহান জিজ্ঞেস করল, তাহলে এখন কী করবে?
কুলেন্টের পাইপগুলো পাল্টাতে হবে।
কী দিয়ে পাল্টাবে?
আমার কাছে বাড়তি পাইপ আছে, কিন্তু ওয়েল্ডিং করতে হবে। একটু সময় নেবে।
রিদি পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল, এজেন্ট দ্রুচান, আমি তোমাকে সাহায্য করি?
এজেন্ট দ্রুচান বলল, তার চাইতে বেশি দরকার একটু রাস্তার দিকে লক্ষ্য এখা, হঠাৎ করে যদি আমাদের ধরতে চলে আসে তখন মহা বিপদ হবে।
রুহান বলল, ঠিক আছে আমি সেটা দেখছি।
রিদি জানতে চাইল, কীভাবে দেখবে?
রুহান পিছনে তাকিয়ে বলল, আমি ঐ মানমন্দিরটার উপরে গিয়ে দাঁড়াই, তাহলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাব।
রিদি মাথা নেড়ে বলল, যাও।
এজেন্ট দ্রুচান তার গলায় ঝোলানো বাইনোকুলারটি রুহানের হাতে দিয়ে বলল, এটা নিয়ে যাও।
ক্রিটিনা কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, রুহান, আমি কী তোমার সাথে যেতে পারি?
অবশ্যই যেতে পার ক্রিটিনা। মান-মন্দিরের উপরে একা একা দাঁড়িয়ে না থেকে দুজনে মিলে দাঁড়ালে সময়টা ভালো কাটবে। চল।
এক সময়ে এই এলাকায় জনবসতি ছিল এখন নেই। যে ছোট নুড়ি পাথরের রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে মানমন্দির পর্যন্ত উঠে গেছে সেটা নানারকম ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে তারা মানমন্দিরের কাছে এসে দাঁড়ায়। ভাঙ্গা মানমন্দিরের ভেতর থেকে তারা ছেলে-মেয়েদের চেচামেচি শুনতে পায়। তাদের কলরব শুনলে মনে হয় তারা বুঝি কোনো একটা আনন্দোৎসবে এসেছে।
মানমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিটিনা কপালের ঘাম মুছে বলল, কে গরম দেখেছ?
হ্যাঁ। বেশ গরম। রুহান একটু অবাক হলো, তারা সরাসরি রোদে দাঁড়িয়ে নেই, তাছাড়া সূর্যের আলো এখনো এত প্রখর হয়নি, কিন্তু এখানে তবু বেশ গরম। রুহান কারণটা ঠিক বুঝতে পারে না। মানমন্দিরটা কাচ দিয়ে তৈরি। বিভিন্ন জায়গায় কাচ ভেঙ্গে আছে, ফেটে আছে। লতাগুল্ম দিত। মানমন্দিরটা স্থানে স্থানে ঢেকে আছে তবুও বোঝা যায় এটি এক সময় চমৎকার একটা বিল্ডিং ছিল। রুহান উপরে উঠার সিড়ি খুঁজে বের করার জন্যে মানমন্দিরের ভেতরে ঢুকে আবিষ্কার করে ভেতরে বেশ ঠাণ্ডা। রুহান ক্রিটিনার দিকে তাকিয়ে বলল, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ ক্রিটিনা?
কী?
এটা একটা কাচের ঘর, ভেতরে ঠাণ্ডা কিন্তু বাইরে গরম।
তার মানে কী?
মানমন্দিরের কাচ সূর্যের আলোর তাপের অংশটিকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না, এটা বাইরে প্রতিফলিত হচ্ছে, সেজন্য বাইরে গরম। শুধু দৃশ্যমান আলোটা ঢুকতে দিচ্ছে ভিতরে, সেজন্যে ভেতরে অনেক আলো কিন্তু গরম নেই, ঠাণ্ডা।
ভারি মজা তো।
হ্যাঁ। এলাকটা নিশ্চয়ই উষ্ণ। মানমন্দিরকে ঠাণ্ডা রাখার জন্যে এরকম কাচ লাগানো হয়েছে।
ঠিকই বলেছ।
রুহান আর ক্রিটিনা কথা বলতে বলতে মানমন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যেতে থাকে। অনেক উঁচু মানমন্দির, ছাদে পৌঁছানোর পর তারা আবিষ্কার করল এখানে দাঁড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। যে রাস্তা ধরে তারা এসে সেই রাস্তাটি পাহাড়কে ঘিরে ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে তারা প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। রুহান চারদিকে তাকিয়ে দেখে–যতদূর দেখা যায়, ফাঁকা ধূ ধূ পাহাড়, জনমানবের চিহ্ন নেই। পুরো দৃশ্যটাতে এক ধরনের মন খারাপ করা বিষয় রয়েছে, ঠিক কী কারণে মন খারাপ হয় সেটা বুঝতে না পেরে রুহান এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে।
মানমন্দিরের ছাদে দাঁড়িয়ে তারা দেখতে পায় ছেলেমেয়েগুলো বাইরে ছুটোছুটি করছে। এখন তাদের দেখে বোঝাই যায় না যে সবাইকে মায়ের বুক থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পণ্য হিসেবে বিক্রি করার জন্যে। মনে হচ্ছে তারা বুঝি কোথাও পিকনিক করতে এসেছে।
মানমন্দিরের ছাদে দুজন ইতস্তত হাঁটে। চারপাশে বন জঙ্গল। এখানে জনবসতি কখনোই ছিল না, এক সময় হয়তো মানমন্দিরটা চালু ছিল তখন কিছু মানুষজন থাকত, আসত-যেত। এখন কেউ নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এখন মানুষের কোনো আগ্রহ নেই, উৎসাহ নেই।
রুহান–ক্রিটিনার গলার স্বর শুনে রুহান ঘুরে তাকাল। ক্রিটিনা বলল, তোমাকে আমার একটা কথা বলা হয়নি।
কী কথা?
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
রুহান হেসে বলল, কী জন্যে ধন্যবাদ?
আমাদের উদ্ধার করে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছ, সেজন্যে নয়। সেজন্যে কৃতজ্ঞতা। কিন্তু ধন্যবাদ অন্য কারণে–
কী কারণে?
এই যে আমি তোমাকে বলছি তোমাকে অনেক ধন্যবাদ—এই কথাটি বলার সুযোগ করে দেবার জন্যে। এরকম কথা বলাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে পৃথিবীটা হচ্ছে স্বার্থপর নিষ্ঠুর একটা জায়গা। এখানে সবাইকে হতে হবে হিংস্র আর স্বার্থপর। যার যেটা প্রয়োজন সেটা কেড়ে নিতে হবে। এখানে ভালোবাসা আর মমতার কোনো স্থান নেই।
ক্রিটিনা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমিও একজন হিংস্র মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে সেটা ভুল। তুমি আবার আমার ভিতরে মানুষের উপরে বিশ্বাস ফিরিয়ে নিয়ে এসেছ। এই বিশ্বাসের কারণে আমি হয়তো খুব বিপদে পড়ব। হয়তো আমার দুঃখ হবে, কষ্ট হবে, যন্ত্রণা হবে, কিন্তু তবু আমি এই বিশ্বাসটা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।
কথা বলতে বলতে ক্রিটিনা দূরে তাকাল এবং হঠাৎ করে তার চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে যায়। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, রুহান!
কী হয়েছে?
ঐ দেখ–
রুহান ক্রিটিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে দূরে তাকায়, বহুদূরে পাহাড় ঘিরে রাস্তাটি উঠে এসেছে। সেই রাস্তায় অনেকগুলো গাড়ি একটা কনভর। গাড়িগুলো এইদিকে আসছে। ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে এগুলো এখানে পৌঁছে যাবে।
কেউ বলে দেয়নি কিন্তু তারা জানে এই কনভয়গুলো আসছে তাদের ধরে নেয়ার জন্যে।
১১. এজেন্ট দ্রুচান
এজেন্ট দ্রুচান বলল, না, আমি এক ঘণ্টার ভেতর রওনা দিতে পারব না। এখনো সবগুলো কুলেন্ট টিউব ওয়েল্ড করে লাগানো হয়নি। সময় লাগবে।
রিদি গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, তাহলে আমাদের করার বিশেষ কিছু নেই। কনভয়টাকে মাঝখানে থামাতে হবে।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অস্ত্র নিয়ে আমরা মাত্র দুইজন। ক্রিটিনাকে ধরলে তিনজন। তাদের গাড়িই আছে চারটা। কিছু একটা করা যাবে বলে মনে হয় না।
রাস্তার ভালো একটা জায়গা দেখে এমবুশ করতে হবে। রিদি বলল, প্রথম গাড়িটা থামাতে পারলে অন্যগুলোও থেমে যাবে।
রুহান কোনো কথা না বলে অন্যমনস্কভাবে মাথা ঘুরিয়ে দূরের মানমন্দিরটার দিকে তাকাল। রিদি বলল, তাহলে দেরি করে কাজ নেই, চলো
এখনই বের হয়ে পড়ি।
রুহান বলল, আমি অন্য একটি কথা ভাবছিলাম।
কী কথা?
ঐ যে মানমন্দিরটা দেখছ, তার কাচগুলো তাপ প্রতিরোধক। সূর্যের আলোর ভেতর যেটুকু দৃশ্যমান সেটা ঢুকতে দেয় কিন্তু তাপের অংশটুকু প্রতিফলিত করে দেয়। আমরা এই কাচগুলো ব্যবহার করে একটা কাজ করতে পারি।
কী কাজ?
আমাদের মধ্যে প্রায় তিরিশজন ছেলে-মেয়ে আছে। সবার কাছে যদি একটা কাচ দিই তারা সেটা হাতে নিয়ে সূর্যের আলোটা প্রতিফলিত করে ঐ গাড়িগুলোর উপরে ফেলে তাহলে গাড়িগুলোতে আগুন ধরে যাবে। আমরা অনেক দূর থেকে গাড়িগুলো জ্বালিয়ে দিতে পারব।
রিদি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে বলল, সত্যি?
কয়েক হাজার বছর আগে আর্কিমিডিস নামে একজন বিজ্ঞানী এভাবে শত্রুদের জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
তুমিও সেটা করবে?
হ্যাঁ। একটু প্র্যাকটিস করতে হবে, কিন্তু আমার মনে হয় আমরা পারব। সবচেয়ে বড় কথা কাজটা করা যাবে গোপনে, তারা বুঝতেই পারবে না কী হচ্ছে।
রিদি বলল, ঠিক আছে, তাহলে দেরি করে লাভ নেই। কাজ শুরু করে দেয়া যাক।
মানমন্দিরের কাচগুলো খুলে নেয়ার কাজটুকু সহজ হলো না, কিন্তু কাচগুলো অক্ষত রেখে খোলারও প্রয়োজন ছিল না তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় বড় গোটা চল্লিশেক কাচ খুলে ফেলা হলো। সূর্যটা এতক্ষণে বেশ উপরে উঠে তার প্রখর আলোতে এখন যথেষ্ট উত্তাপ। বড় কাচগুলো দিয়ে তার প্রায় সবখানি প্রতিফলিত করা যায়।
এর মধ্যে ক্রিটিনা সবাইকে ডেকে এনেছে। তাদেরকে একটা জরুরি কাজ করতে হবে বলে সে সবাইকে একটা লম্বা সারিতে দাঁড়া করাল। সবাই উশখুশ। করছিল, রুহান হাত তুলে তাদের শান্ত করে বলল, আজ তোমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে।
একজন জানতে চাইল, কী কাজ?
তোমরা সবাই নিশ্চয়ই অনুমান করেছ তোমাদের আবার ধরে নেবার জন্যে কিছু মানুষজন আসার কথা। বাজে মানুষ। খারাপ মানুষ। জঘন্য মানুষ।
সবাই মাথা নাড়ল। রুহান বলল, তারা আসছে।
সাথে সাথে সবার ভেতরে একটা আতঙ্কের ছাপ পড়ল। রুহান হাত ও বলল, তোমাদের ভয় পাবার কিছু নেই। সেই জঘন্য মানুষগুলোকে আমরা কাছে আসতে দেব না। দূর থেকে আমরা তাদের ধ্বংস করে দেব।
কীভাবে ধ্বংস করবে?
এই কাচগুলো দিয়ে। তোমরা সবাই নিশ্চয়ই কখনো না কখনো আয়না দিয়ে সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করেছ, দূরে কোথাও পাঠিয়েছ। তাই না?
সবাই মাথা নাড়ল। রুহান বলল, এখানেও তাই করবে, এই বড় কাচগুলো আয়নার মতো তবে–আলো নয় তাপকে প্রতিফলিত করে।
রুহান সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে গলা উঁচু করে বলল, আম সবাই যদি আলাদা আলাদাভাবে আয়নাগুলোকে দিয়ে এক জায়গায় সব তাপ কেন্দ্রীভূত করতে পারি, প্রচণ্ড তাপে সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠবে। তোমরা যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর এখনই সেটা পরীক্ষা করে দেখতে পার। আমি তোমাদের সবাইকে একটা করে কাচ দেব, তোমরা সূর্যের আলোকে এই কাচ দিয়ে প্রতিফলিত করে এক জায়গায় ফেলবে। পারবে না?
সবাই চিৎকার করে বলল, পারব।
চমৎকার! রুহান তখন পাশে সাজিয়ে রাখা কাচগুলো একজন একজনকে দিতে শুরু করে। চেষ্টা করা হয়েছে যথাসম্ভব বড় টুকরো দিতে, ভারী কাচগুলো নিচে রেখে সবাই দুই পাশে ধরে দাঁড়ায়। রুহান একপাশে সরে গিয়ে বলল, সাবধান, কারো যেন হাত না কাটে। ভাঙ্গা কাচ খুব ধারালো হয়।
সবাই মাথা নেড়ে জানাল তারা সবাধান থাকবে।
রুহান তখন বেশ খানিকটা দূরে একটা শুকনো গাছের গুড়ি দেখিয়ে বলল, সবাই চেষ্টা কর সূর্যের আলোটাকে এখানে প্রতিফলিত করতে। যখন প্রতিফলিত হবে তখন স্থিরভাবে ধরে রাখবে। ঠিক আছে?
সবাই মাথা নাড়ল।
চমৎকার! রুহান সামনে থেকে সরে গেল। বলল, শুরু কর।
ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে করতে হবে বুঝতে একটু সময় লাগল, সবাই তাদের কাচটা ঠিক করে ধরার চেষ্টা করতে থাকে। আলোটাকে গাছের গুড়িতে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করতে থাকে। যখন সবাই সূর্যের আলোকে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীভূত করতে পারল তখন গাছের গুড়িটা থেকে প্রথমে ধোঁয়া বের হতে থাকে তারপর হঠাৎ ধক করে আগুন ধরে ওঠে। সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে সাথে সাথে।
রুহান হাততালি দিয়ে বলল, চমৎকার! এসো, এবারে আরো দূরে কোথাও চেষ্টা করি।
দেখতে দেখতে সবাই ব্যাপারটা ধরে ফেলল, কোনো একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দিলে সবাই মিলে সেখানে আগুন ধরিয়ে দিতে পারছে। বেশ সহজেই।
রিদি প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করে নি যে এটা সম্ভব যখন দেখল সত্যি সত্যি সবাই মিলে অনেক দূরে একটা জায়গায় আগুন লাগিয়ে দিতে পারছে সে হতবাক হয়ে গেল। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এটি কেমন করে সম্ভব? কী। আশ্চর্য!
রুহান অবশ্যি কথাবার্তায় আর সময় নষ্ট করল না। রাস্তাটার পাশে পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় এই জনা ত্রিশেক ছেলেমেয়েদের সবার কাছে বড় একটা কাচের টুকরো দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। সবাই ঝোপঝাড়ের আড়ালে নিজেদের আড়াল করে রাখল, হঠাৎ করে তাকালেও যেন কাউকে দেখা না যায়।
গাড়িগুলোতে আগুন ধরানোর জন্যে সেগুলো থামানো দরকার। তাই রুহান আর রিদি মিলে পাহাড় থেকে বেশ কিছু বড় বড় পাথর গড়িয়ে রাস্তার উপর নামিয়ে নিয়ে এলো। দেখে মনে হয় পাহাড়ের উপর থেকে এমনি বুঝি গড়িয়ে নেমেছে। এ জায়গায় এসে পাথরগুলো সরানোর জন্যে গাড়ি থামিয়ে সবাইকে গাড়ি থেকে নামতেই হবে।
সবরকম প্রস্তুতি নিয়েও রুহান সন্তুষ্ট হলো না। রাস্তার পাশে বড় পাথরের আড়ালে অস্ত্র নিয়ে তারা নিজেরা লুকিয়ে রইল। যদি কোনোভাবে দলটা থামানো না যায় তখন গোলাগুলি করে থামাতে হবে! রাস্তার এক পাশে থাকল রুহান আর ক্রিটিনা, অন্য পাশে রইল রিদি। এবারে শুধু অপেক্ষা করা।
অপেক্ষা করতে করতে যখন সবাই অধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছেচে ঠিক তখন তারা পাহাড়ী রাস্তায় গাড়িগুলোর ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেল। পাহাড় রাস্তার ঠিক কোথায় আছে তার উপর নির্ভর করে শব্দটা হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছিল আবার হঠাৎ করে কমে আসছিল। এক সময় শব্দটা একটা নিয়মিত শব্দে পরিণত হলো এবং ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর দূরে গাড়িগুলোকে দেখা যেতে লাগল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সেগুলো রাস্তায় পড়ে থাকা পাথরগুলোর সামনে এসে দাঁড়াল।
গাড়ির দরজা খুলে খুব সাবধানে একজন অস্ত্র হাতে নেমে আসে, সে সতর্ক চোখে চারদিকে দেখে অন্যদের নামতে ইঙ্গিত করল। অস্ত্র হাতে তখন বেশ অনেকগুলো মানুষ নেমে গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে সতর্কভাবে এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। নেতাগোছের একজন বলল, কী মনে হয়? এটা কী কোন ট্রাপ?
অন্য একজন উত্তর করল, বুঝতে পারছি না। কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ করে রাস্তার মাঝে পাথর পড়ে আছে? আমার মনে হয় কেউ এনে রেখেছে।
সাবধান! দুইজনই কিন্তু খেলোয়াড়। মনে নাই এরা ক্ৰিভনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল!
সেটা অন্য ব্যাপার। এখন তার সাথে ত্রিশ পঁয়ত্রিশজন ছেলে-মেয়ে! আর যাই করুক এখন এরা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করবে না।
নেতাগোছের মানুষটি বলল, দেরি করে লাভ নেই। রাস্তা থে পাথরগুলো সরাও। অন্যেরা কভার দাও।
হঠাৎ একজন বলল, কী ব্যাপার এখানে এত গরম কেন?
হ্যাঁ! কী ব্যাপার? মানুষগুলো অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকায়। উত্তাপটুকু দেখতে দেখতে সহ্যের বাইরে চলে যায় তখন তারা যন্ত্রণায় ছটফট করে এদিকে সেদিকে ছুটতে শুরু করে।
রুহান, ক্রিটিনা আর রিদি নিঃশব্দে বসে থাকে। ছেলেমেয়েগুলো একজন একজন করে করে তাদের কাচ দিয়ে সূর্যের আলোর তাপ কেন্দ্রীভুত করতে শুরু করছে আর দেখতে দেখতে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তারা গাড়ির ইঞ্জিন থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখল এবং হঠাৎ করে একটা বিস্ফোরণ করে গাড়ির ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ল এবং মানুষগুলো চিৎকার করে ছুটে সরে যেতে থাকে। কীভাবে কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে কয়েকজন ইতস্তত গুলি করল কিন্তু তার কোনো প্রত্যুত্তর এলো না বলে নিজেরাই আবার অস্ত্র নামিয়ে নিল।
রুহান, ক্রিটিনা আর রিদি তাদের অস্ত্র তাক করে নিঃশপে বসে থাকে। শাইকে বলা আছে প্রথম গাড়িটা জ্বালিয়ে দিতে পারলে দ্বিতীয়টা এবং সেটা করতে পারলে তার পরেরটা জ্বালিয়ে দিতে হবে। ছেলেমেয়েগুলো সত্যি সত্যি দ্বিতীয়টাতেও আগুন ধরিয়ে দিল, তখন হঠাৎ করে পিছনের দুটো গাড়ি পিছনে সরে যেতে থাকে। অন্য মানুষগুলোকে গাড়িতে তুলে নিয়ে হঠাৎ করে গাড়িগুলো যে পথে এসেছিল সেই পথে ফিরে যেতে থাকে। পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সবাই যে যার জায়গায় লুকিয়ে রইল। গাড়িগুলোর ইঞ্জিনের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর প্রথমে রিদি এবং তার দেখাদেখি রুহান আর ক্রিটিনা পাথরের আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। তাদের দেখাদেখি অন্যেরাও তখন পাহাড় থেকে ছুটে নিচে নেমে আসতে থাকে। রাস্তার উপর দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা গাড়ি দুটো ঘিরে সবাই লাফালাফি করে আনন্দে চিৎকার করতে থাকে। সাধারণ একটা কাচের টুকরো দিয়ে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা এভাবে গাড়িগুলো জ্বলিয়ে সবাইকে তাড়িয়ে দিয়েছে এই বিষয়টা এখনো তারা বিশ্বাস করতে পারছে না।
ঘণ্টাদুয়েক পরে যখন আবার সবাই রওনা দিয়েছে তখন কারো ভেতরেই চাপা ভয় আর আতঙ্কটুকু নেই, নিজেদের ভেতরে তখন বিচিত্র এক ধরনের আত্মবিশ্বাস। লরির ভেতরে তারা হাততালি দিয়ে গান গাইতে থাকে। দেখতে দেখতে পাহাড়ী এলাকা পার হয়ে তারা একটা উপত্যকায় নেমে আসে, সেখান থেকে একটা নদীর তীর ধরে এগোতে থাকে। রাস্তা ভালো নয়, যেতে হচ্ছে খুব ধীরে ধীরে, যখন অন্ধকার হয়ে গেল তখন তারা রাত কাটানোর জন্যে এক জায়গায় থেমে গেল। নদীর পানিতে হাত মুখ ধুয়ে তারা কিছু শুকনো খাবার খেয়ে বিশ্রাম নেয়। এজেন্ট দ্রুচান তার লরির নিচে শুয়ে শুয়ে সেটা মেরামত করতে থাকে। রাত বিরেতে কী হয় কেউ জানে না, তাই রুহান, রিদি আর ক্রিটিনা পালা করে পাহারা দেবে বলে ঠিক করল। ভোর রাতের দিকে তার পালা শেষ করে শুতে গিয়েছে, চোখে একটু ঘুম নেমে এসেছিল হঠাৎ করে ক্রিটিনা তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, রুহান!
রুহান মুহূর্তে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে, কী হয়েছে?
একটা গাড়ি।
গাড়ি?
হ্যাঁ।
কোথায়? ক্রিটিনা অন্ধকারে হাত দিয়ে দেখায়, ঐ যে, আসছে?
রুহান আবছা অন্ধকারে গাড়িটাকে দেখতে পেল। হেড লাইট নিভিয়ে চুপি চুপি আসছে। মুহূর্তের মধ্যে ওরা প্রস্তুত হয়ে যায়। লরিটির পাশে আড়াল নিয়ে ওরা ওদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ট্রিগারে আঙ্গুল দিয়ে বসে থাকে।
গাড়িটি রাস্তার পাশে দাঁড়া করিয়ে রাখা লরিটির কাছাকাছি এসে থেমে গেল। দরজা খুলে জনা দশেক মানুষ নেমে আসে, আবছা অন্ধকারেও দেখা যায় মানুষগুলো সশস্ত্র। কাছাকাছি আসার পর রিদি হঠাৎ উচ্চস্বরে বলল, থাম।
মানুষগুলো থেমে গেল। রুহান বলল, তোমরা আমাদের অস্ত্রের আওতার ভেতর আছ, কোনোরকম বোকামী করতে চাইলেই কিন্তু মারা পড়বে।
অন্ধকারে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ভেতর থেকে একজন বলল, ভয় নেই। আমরা তোমাদের আক্রমণ করতে আসিনি।
তাহলে কী জন্যে এসেছ?
তোমাদের দলে যোগ দিতে এসেছি।
আমাদের দলে যোগ দিতে এসেছ?
হ্যাঁ।
রিদি আর রুহান প্রায় একই সাথে বিস্ময়ের এক ধরনের শব্দ করল। রুহান বলল, তোমরা কারা?
আমরা দক্ষিণের গ্রুজনীর দলের মানুষ।
রিদি তার হাতের আলো জ্বালায়, সেই আলোতে সামনে দাঁড়িয়ে। মানুষগুলোকে বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। মানুষগুলোর বয়স খুব বেশি নয়, দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি ছাড়া সেখানে চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা পাকা বাদামী চুলের একজন বলল, তোমরা দুজন নিশ্চয়ই রিদি আর রুহান?
রিদি আর রুহান মাথা নাড়ল, মানুষটি বলল, আমরা তোমাদের অনেক গল্প শুনেছি, তোমাদের দেখে খুব খুশি হলাম।
রিদি বলল, ঠিক কী গল্প শুনেছ জানি না! তবে আমরাও তোমাদের দেখে খুব খুশি হয়েছি।
রুহান বলল, এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই। তোমরা এসে বস। হাতের অস্ত্রগুলো ঐ গাছের উপর হেলান দিয়ে রাখতে পার।
বাদামী চুলের মানুষটি অস্ত্রটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, পুরো এলাকায় তোমাদের কথা সবাই জানে। আমার কী মনে হয় জান? আরো অনেকেই এখন তোমাদের সাথে যোগ দিতে আসবে।।
রিদি আর রুহান একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। বাদামী চুলের মানুষটি বলল, আমার মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি তোমরা শক্তিশালী একটা দল তৈরি করে ফেলতে পারবে। পার্বত্য এলাকার ওপাশে বিশাল একটা এলাকায় এখনো কেউ যায় নি। আমরা সবাই মিলে সে এলাকাটা আক্রমণ করতে পারি।
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা একজন মানুষ তার গাল ঘষতে ঘষতে বলল, ঐ এলাকার মানুষগুলো খুব শক্ত সমর্থ। ধরে আনতে পারলে অনেক ইউনিটে বিক্রি করতে পারবে।
রিদি আর রুহান একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, রুহান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তাকে বাধা দিয়ে বাদামী চুলের মানুষটি বলল, প্রথমে ভালো কিছু অস্ত্র দরকার। গ্রুজনির অস্ত্র কিছু লুট করে আনা যায়–
রুহান এবার হাত তুলে বাধা দিয়ে বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও, তোমরা আরো কিছু বলার আগে আমাদের কথা একটু শুনো।
রুহানের গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, মানুষটি থেমে গিয়ে থতমত খেয়ে রুহানের দিকে তাকাল। রুহান শান্ত গলায় বলল, তোমরা খুব একটা বড় ভুল করেছ।
কী ভুল করেছি?
তোমরা যেরকম ভাবছ ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, ব্যাপারটি মোটেও কী রকম নয়?
আমরা একটা দল তৈরি করছি না। দল তৈরি করে আশেপাশের এলাকায় ডাকাতি করতে যাচ্ছি না। মানুষ ধরে ধরে তাদের বিক্রি করতে যাচ্ছি না।
বাদামী চুলের মানুষটি অসহিষ্ণু গলায় বলল, তুমি কী বলছ? আমরা খুব ভালো করে জানি তুমি ত্রিশজন ছেলে-মেয়েকে লুট করে নিয়ে এসেছ। এজেন্ট দ্রুচান দশ পার্সেন্ট কমিশনে তাদেরকে পৌঁছে দিচ্ছে–
না, না, না। রুহান মাথা নাড়ল, আমরা তাদেরকে মুক্ত করে এনে। মুক্ত করে তাদেরকে তাদের এলাকায় ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছি।
এজেন্ট দ্রুচান-
এজেন্ট দ্রুচান আমাদের সাহায্য করছে। সে একটি ইউনিটও নিচ্ছে না।
বাদামী চুলের মানুষটি বিস্ফারিত চোখে বলল, এজেন্ট দ্রুচান কোন ইউনিট নিচ্ছে না?
না।
কেন?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না তোমাকে এটা কেমন কে বোঝাব।
চেষ্টা কর!
আমরা মনে করি, মানুষ হয়ে মানুষকে বেচা-কেনা করা যায় না। সা! পৃথিবী এখন যেরকম স্বার্থপর হয়ে গেছে, লোভী হয়ে গেছে, হিংস্র হয়ে গেu. এটা ঠিক না। আমাদে একজনের অন্যজনকে সাহায্য করতে হবে, ভালোবাসতে হবে। আমাদের নিঃস্বার্থ হতে হবে। এজেন্ট দ্রুচান আমাদের কথা বিশ্বাস করে আমাদের সাহায্য করছে।
মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তারা এখনও রুহানের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি তোমরা আমার কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছ না, কিন্তু আমি যেটা বলছি সেটা সত্যি। পৃথিবীটা ঠিক দিকে যাচ্ছে না, আমি আর রিদি মিলে পৃথিবীটা ঠিক করতে পারব না। কিন্তু যেটা ঠিক সেটা করার চেষ্টা করতে পারব। আমাদের কথা শুনে অন্যেরা হয়তো সেটা বিশ্বাস করবে। কোথাও কেউ হতে। সত্যিকারভাবে চেষ্টা করবে।
বাদামী চুলের মানুষটির মুখে বিদ্রুপের এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল। হেঁটে গাছে হেলান দিয়ে রাখা অস্ত্রটি তুলে নিয়ে বলল, আমরা ভেবেছিলাম তোমরা দুঃসাহসী মানুষ। এখন দেখছি সেটা পুরোপুরি ভুল ধারণা। তোম্রা ভীতু আর কাপুরুষ। শুধু যে ভীতু আর কাপুরুষ তাই নয় তোমাদের কোনো বাস্তব জ্ঞান পর্যন্ত নেই।
রিদি ক্রুদ্ধ হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, রুহান তাকে থামাল। বলল, আমি দুঃখিত, তোমরা ভুল একটা ধারণা করে এত কষ্ট করে এখানে এসেছ!
হ্যাঁ। সেটা সত্যি, তোমাদের খুঁজে বের করে এখানে আসতে আমাদের খুব কষ্ট হয়েছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট!
আমরা খুব দুঃখিত।
মানুষগুলো কোনো কথা বলল না। রুহান বলল, তোমরা তাহলে ফিরে যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
তোমাদের ফেরত যাত্রা শুভ হোক।
মানুষগুলো এবারেও কোনো কথা না বলে কঠোর মুখে তাদের গাড়িতে ফিরে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইঞ্জিন গর্জন করে ওঠে এবং গাড়িটি যে দিক দিয়ে এসেছিল সেই দিকে ফিরে যেতে শুরু করে।
কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ফিরে আসবে। গলার স্বর শুনে রুহান আর রিদি মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, এজেন্ট দ্রুচান ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে আছে। রুহান জিজ্ঞেস করল, কে ফিরে আসবে?
এই মানুষগুলো?
কেন?
তোমাদের সাথে যোগ দিতে।
রুহান অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে জান?
এজেন্ট দ্রুচান অবাক হয়ে বলল, আমি জানি। কেমন করে জানি সেটা জানি না। কিন্তু আমি জানি। আমিও এসেছিলাম মনে নেই?
ক্রিটিনা নরম গলায় বলল, আমি কারণটা জানি।
কী কারণ?
কারণটা খুব সহজ। মানুষ আসলে ভালো। তারা ভালো থাকতে চায়। যখন ভালো থাকার সুযোগ পায় তারা ভালো হয়ে যায়। ভালো থাকার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে।
কী ব্যাপার?
এটাকে মনে হয় বলে শান্তি। পৃথিবীর সবাই শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে। অথচ শান্তি খুঁজে পাওয়া কী সহজ। অন্যের জন্যে কিছু একটা করাই হচ্ছে শান্তি। মানুষ কেন যে এটা বোঝে না কে জানে?
রুহান আর রিদি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ক্রিটিনার দিকে তাকিয়ে রইল।
গাড়িটি সত্যি সত্যি ফিরে এলো ঘণ্টা দুয়েক পরে। গাড়িতে অবশ্যি সবাই ছিল না, দশজনের ভেতর তিনজন ফিরে আসতে রাজি হয় নি, তাদের ধারণা ব্যাপারটা একটা হাস্যকর নির্বুদ্ধিতা। তারা নিজের এলাকায় ফিরে গেছ বাদামী চুলের মানুষটা সেই তিনজনের একজন।
অন্যেরা জানাল তারা হঠাৎ করে বুঝতে পেরেছে যে তারা আসবে। অসুখী। তারা একটু সুখ চায়। সুখ আর শান্তি। ভালো হয়ে থাকার শান্তি।
১২. লরির খোলা দরজার কাছে
লরির খোলা দরজার কাছে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রুহান তার লাল পাহাড় থেকে কিনে আনা বইটি পড়ছে তখন ক্রিটিনা জিজ্ঞেস করল, তোমার হাতে টা কী?
এটার নাম বই। আগে যখন সব মানুষের কাছে ক্রিস্টাল রিডার ছিল না তখন তারা এই রকম বই পড়ত।
কী আশ্চর্য! ক্রিটিনা রুহানের পাশে ঝুঁকে পড়ে বলল, দেখি তোমার বইটি।
ক্রিটিনা রুহানের এত কাছে ঝুঁকে এসেছে সে মেয়েটির মাথার চুলের হালকা এক ধরনের সুবাস পেল। বিবর্তনে মানুষের যে ইন্দ্রিয়গুলোর বিকাশ ফটেছে ঘ্রাণ তার একটি নয়, যদি হতো সে নিশ্চয়ই এই মেয়েটির শরীরের ঘ্রাণ তীব্রভাবে অনুভব করতে পারত।
ক্রিটিনা বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে বলল, কী আশ্চর্য! এখানে দেখছি নানা ধরনের চিহ্ন!
হ্যাঁ। এগুলোকে বলে বর্ণমালা। বর্ণমালা সাজিয়ে সবকিছু লেখা হয়।
সত্যি?
হ্যাঁ।
তুমি বর্ণমালা পড়তে পার?
হ্যাঁ। আমি শিখেছি।
ক্রিটিনা অবাক হয়ে বলল, তুমি আমাকে পড়ে শোনাও দেখি এখানে কী লেখা আছে।
রুহান পড়ল, মানুষের চোখ অত্যন্ত সংবেদনশীল। মাত্র সাতটি ফোটন হলেই চোখের রেটিনা সেটাকে দেখতে পায়। বিবর্তনের কারণে যদি চোখ আর মাত্র দশ গুণ বেশি সংবেদনশীল হয়ে যেত তাহলে খালি চোখেই আমরা কোয়ান্টাম প্রক্রিয়া দেখতে পেতাম–
ক্রিটিনা চোখ বড় বড় করে বলল, বাবা গো! কী কটমটে কথা!
রুহান হেসে বলল, এটা মোটেও কটমটে কথা না। এটা খুব সাধারণ কথা। আসলে আমরা তো ক্রিস্টাল রিডারে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তাই বই থেকে পড়লে কিছু বুঝতে পারি না।
ক্রিটিনা ভুরু কুঁচকে বলল, এখন তো পৃথিবীতে আর ক্রিস্টাল রিডার তৈরি হয় না, তাই না?
না।
তার মানে আমাদের আবার এরকম বই পড়া শিখতে হবে?
রুহান সোজা হয়ে বসে বলল, হ্যাঁ। আসলে আমি ঠিক এই কথাটা সবাইকে বোঝাতে চাই কিন্তু কেউ সেটা বুঝতে চায় না। যতদিন পৃথিবীটা আবার ঠিক না হয় সবার কাছে ক্রিস্টাল রিডার না থাকে ততদিন কী ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করবে না? একশবার করবে!
এই রকম বই দিয়ে?
হ্যাঁ। রুহান ক্রিটিনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতে চাইছ না। কিন্তু বিশ্বাস কর–
ক্রিটিনা হেসে বলল, কে বলেছে আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি না? আমি অবশ্যই তোমার কথা বিশ্বাস করেছি।
রুহান মাথা নেড়ে বলল, না, তুমি আসলে আমার কথা বিশ্বাস কর নি। তুমি আমাকে খুশি করার জন্যে এই কথাটা বলছ।
ঠিক আছে। ক্রিটিনা মুখ টিপে হাসল। হেসে বলল, এখন তা হলে তোমাকে আরেকটা কথা বলি, এই কথাটা শুনলে তুমি বুঝবে যে আসলেই আমি তোমার কথা বিশ্বাস করেছি।
কী কথা বলবে?
তুমি কী আমাকে পড়তে শেখাবে?
রুহানের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, তুমি সত্যি আমার কাছে শিখতে চাও?
হ্যাঁ। শিখতে চাই।
কেন?
ক্রিটিনা শব্দ করে হাসল। হেসে বলল, না! তোমাকে খুশি করার ও! আমি ঠিক করেছি আমাদের গ্রামের স্কুলটা আমি আবার চালু করব। স্কুলে। বাচ্চাদের আমি পড়তে শেখাব। তারা যেন কিছু একটা জানার সুযোগ পায়, শেখার সুযোগ পায়!
চমৎকার! রুহান নিজের অজান্তেই ক্রিটিনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি ঠিক এরকম একটা কিছু চাচ্ছিলাম!
ক্রিটিনা বলল, তাহলে তুমি আমাকে কখন শেখাবে?
এখনই শেখাব।
এখন? এই লরির মধ্যে? যখন আমরা ঝাঁকুনি খেতে খেতে যাচ্ছি?
হ্যাঁ। ভালো কাজে দেরি করতে হয় না।
সত্যি সত্যি রুহান ক্রিটিনাকে বর্ণমালা শেখাতে শুরু করে দিল।
দুজনে মিলে যখন বর্ণমালার মাঝামাঝি গিয়েছে তখন হঠাৎ লরিটি থেমে গেল। রুহান মাথা বের করে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
সামনে থেকে এজেন্ট দ্রুচান বলল, রাস্তার মাঝখানে দুইটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অনেক মানুষ অনেক অস্ত্র।
রুহানের পেটের মধ্যে কেমন যেন পাক খেয়ে ওঠে, চাপা গলায় বলল, সর্বনাশ!
তাড়াতাড়ি অস্ত্রটা নিয়ে সে লাফিয়ে নেমে আসে। এজেন্ট দ্রুচান চোখে বাইনোকুলার দিয়ে সামনের গাড়িগুলোকে দেখছে। তার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। রুহান জানতে চাইল, কী অবস্থা?
বুঝতে পারছি না।
সবাই কী পজিশান নিয়েছে?
নাহ্। হাঁটাহাটি করছে। দেখে মনে হয় না কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে। সবাই গল্পগুজব করছে।
তাহলে কী আমরা যাব?
এজেন্ট দ্রুচান বাইনোকুলার থেকে চোখ নামিয়ে বলল, একসাথে সবার যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি যাই দেখে আসি কী ব্যাপার।
এজেন্ট দ্রুচান খুব দুশ্চিন্তিত মুখে গেল কিন্তু সে যখন ফিরে এলো তখন তার মুখ ভরা হাসি। হাত নেড়ে চোখ বড় বড় করে বলল, তোমরা বিশ্বাস করবে না কী হচ্ছে?
কী হচ্ছে?
দুই গাড়ি বোঝাই লোকজন, আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।
রুহান চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি ওদের বলেছ যে আমরা ডাকাতের দল তৈরি করছি না। লুটপাট করতে যাচ্ছি না?
আমার বলতে হয়নি! ওরা জানে। ওরা সেটা জেনেই এসেছে। ওরা ডাকাতের দলে যেতে চায় না।
রিদি অবাক হয়ে বলল, সত্যি?
সত্যি! তোমরা বিশ্বাস করবে না কী ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র নিয়ে চলে এসেছে। যদি আমরা সত্যি সত্যি ডাকাতের দল করতাম, আমাদের সাথে কেউ পারত না!
রুহান চোখ পাকিয়ে বলল, এজেন্ট দ্রুচান, তোমার যতই ডাকাতের দল করার ইচ্ছে হোক না কেন আমরা কিন্তু সেটা করছি না!
এজেন্ট দ্রুচান একটা কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাসের ভঙ্গি করে বলল, আমি জানি রুহান! আমি সেটা খুব ভালো করে জানি।
ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে হলো কেউই বুঝতে পারল না, কিন্তু সবাই যখন ক্রিটিনাদের গ্রামে পৌঁছাল তখন তাদের সাথে আঠারোটা লরি এবং প্রায় তিনশত মানুষ। বেশিরভাগ সশস্ত্র—সবাই এসেছে রুহান আর রিদির সাথে কাজ করার জন্যে। ক্রিটিনার গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেল। কিন্তু তারা দেখল গ্রামের কেউ ঘুমায় নি, সবাই গভীর আগ্রহ নিয়ে তাদের জন্যে। অপেক্ষা করছে। ক্রিটিনাকে দেখে তার মা ছুটে এলো, বুকে জড়িয়ে বলল, মা তুই ফিরে এসেছিস?
ক্রিটিনা চোখ মুছে বলল, হ্যাঁ মা ফিরে এসেছি।
আমি ভেবেছিলাম তোকে আর কোনোদিন দেখব না।
ক্রিটিনা বলল, আমিও তাই ভেবেছিলাম মা, কিন্তু এই যে দুইজন রুহান আর রিদি তারা সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। তারা আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে।
ক্রিটিনার মা অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, জানি। আমি সব জানি। এখন সবাই জানে। এই এলাকার সব মানুষের মুখে মুখে এখন একটা মাত্র কথা।
কী কথা মা?
ঈশ্বর দুজন দেবদূতকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে, তারা এখন সারা পৃথিবীর সব মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর করে দেবে।
ক্রিটিনা খিলখিল করে হেসে বলল, না মা, ওরা দেবদূত না। ওরা মানুষ। একটু বোকা সোকা কিন্তু একেবারে একশ ভাগ মানুষ। তারা যে কাজটা করছে সেই কাজটা দেবদূতরা পারত না, শুধু মানুষেরাই এই কাজ পারে।
আমাকে ঐ মানুষগুলোর কাছে নিয়ে যাবি? আমি ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে তাদের মঙ্গলের জন্যে প্রার্থনা করব?
এসো মা আমার সাথে।
ক্রিটিনা তার মাকে নিয়ে রুহান আর রিদিকে খুঁজে বের করে আবিষ্কার করল হারানো সন্তানদের মায়েরা রুহান আর রিদিকে ঘিরে রেখেছে। কেউ কেউ আকুল হয়ে কাঁদছে, কেউ কেউ তাদের হাত ধরে সেখানে চুমু খাবার চেষ্টা করছে।
রুহান কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু অনেক মানুষের ভিড়ে সে কিছু বলতে পারছে না। ক্রিটিনা তখন রুহান আর রিদিকে উদ্ধার করার জন্যে এগিয়ে যায়, সবাইকে ঠেলে সরিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, তোমরা সবাই সরে যাও। এই দুজন মানুষ অনেক দূর থেকে অনেক কষ্ট করে আমাদের সবাইকে উদ্ধার করে এনেছে। মানুষগুলো ক্লান্ত, তাদের একটু বিশ্রাম নিতে দাও।
মায়েরা চিৎকার করে বলল, আমরা আমাদের বাড়িতে তাদের জন্যে বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছি। আমাদের বাড়িতে খাবারের ব্যবস্থা করেছি। আমরা তাদের আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চাই!
ক্রিটিনা বলল, দুজন মানুষ ত্রিশজনের বাড়িতে যেতে পারবে না! তাদের। সাথে আরো তিনশ মানুষ আছে। তাদের সবার একটা ব্যবস্থা করতে হবেতোমরা আপাতত তাদের মুক্তি দাও।
কমবয়সী একজন মা বলল, আমরা তাদের কোনো একটা কথা শুনতে চাই।
ক্রিটিনা রুহানের হাত স্পর্শ করে বলল, রুহান তুমি কিছু একটা বল।
কী বলব?
ক্রিটিনা কাঁধ বাঁকিয়ে বলল, আমি জানি না। যা ইচ্ছে হয় বল!
রুহান একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে গলা উঁচু করে বলল, আপনাদের কাছে আপনাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনতে পেরে আমাদের খুব ভালো লাগছে।
অনেক মানুষের ভিড়, সবার কথাবার্তায় জায়গাটা সরগরম হয়ে ছিল, রুহান কথা বলতে শুরু করতেই সবাই চুপ করে গেল, চারপাশে হঠাৎ করে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। রুহান সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, কাজটা ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সত্যি কথা বলতে কী যখন আমরা সেটা শুরু করেছিলাম তখন ঠিক কীভাবে আমরা করব সেটা জানতাম না। তারপর আমরা সেটা শুরু করেছিলাম।
রুহান একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা অসম্ভব আনন্দিত, আমরা সেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটা শুরু করেছিলাম। সে কারণে আজ আপনাদের আপনাদের সন্তানদের ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু এই কাজটি করার কাতা। আরেকটি খুব বড় কাজ হয়েছে! মানুষ আবার নতুন করে বিশ্বাস করতে। করেছে যে একজনকে শুধু অন্যায় আর অপরাধ করে বেঁচে থাকতে হবে। মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে ঘৃণা করে, তাদের উপর অত্যাচার করে দিন কাটাতে হবে না। মানুষ মানুষকে ভালোবাসতে পারবে, তাদের সম্মান করতে পার। এবং তার পরেও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারবে।
রুহান এক মুহূর্তের জন্যে থামতেই সবাই এক ধরনের আনন্দধ্বনি কর। তার ঠিক কোন কথাটাতে সবাই এত আনন্দ পেয়েছে রুহান তা ধরতে পারল না। কম বয়সী একটি মা চিৎকার করে বলল, এখন আমরা অন্যজনের মুখে কিছু শুনতে চাই!
রিদি হাত নেড়ে বলল, আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না! রুহান যেটা বলেছে সেটাই আমার কথা।
এবারে অনেকে চিৎকার করে বলল, না, না, আমরা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
রিদি একটু ইতস্তত করে বলল, রুহানের সব কথা ঠিক। তবে আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, যারা পৃথিবীটাকে একটা নরকে পরিণত করেছে তারা কিন্তু এত সহজে এটা মেনে নেবে না। তারা পাল্টা আঘাত হানা। চেষ্টা করবে, প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে। আমাদের সে জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা যেটা শুরু করেছি সেটা এখনো শেষ হয়নি–সবাই মিলে সেটা শেষ করতে হবে!
এবারেও অনেকেই আনন্দের একটা শব্দ করল, যদিও রিদি যে কথাগুলো বলেছে সেটা মোটেও আনন্দের কথা নয়, সেটা ছিল খুব ভয়ের কথা, খুব আশঙ্কার কথা।
প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাবার পর যখন গভীর রাতে সবাই ঘুমাতে গিয়ে তখন রিদি আর রুহান অনেকক্ষণ পর নিরিবিলি কথা বলার সুযোগ পেল। রিদি চোখ মটকে বলল, কেমন বুঝতে পারছ রুহান!
রুহান জিজ্ঞেস করল, তুমি কীসের কথা বলছ?
সব মিলিয়েই বলছি। তুমি যখন লাল পাহাড়ের বাজারে ক্রিটিনা আর অন্য ছেলে-মেয়েদের বাঁচানোর জন্যে তোমাদের অস্ত্রটা বের করেছিলে তখন কী তুমি কল্পনা করেছিলে এরকম একটা কিছু ঘটবে?
না। ভাবি নি।
তুমি কী ভেবেছিলে?
রুহান বলল, আমি কিছুই ভাবি নি। মানুষ হয়ে মানুষকে বেচা-কেনা করা যায় না, যেভাবেই হোক সেটা থামাতে হবে, এটা ছাড়া আর কিছুই ভাবি নি।
এখন তুমি বুঝতে পারছ কী ঘটছে? কী ঘটছে?
এখন আমাদের সাথে প্রায় তিনশ সশস্ত্র মানুষ। তারা যে শুধু সশস্ত্র তাই না, আমার ধারণা তাদের সবাই বেশ ভালো সৈনিক। আমি নিশ্চিত, যতই দিন যাবে এরকম মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে। দেখতে দেখতে আমাদের সাথে হাজার হাজার মানুষ চলে আসবে। আমরা তখন বিশাল একটা শক্তি হয়ে যাব। বুঝতে পারছ?
রুহান বলল, হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।
রিদি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না, তুমি বুঝতে পার নি।
আমি কী বুঝতে পারি নি!
আমরা যেটা অনুমান করছি সেটা কী ক্ৰিভন অনুমান করছে না?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, মনে হয় করছে।
তা হলে?
তুমি বলছ, ক্রিভন সেটা কোনোদিনই করতে দেবে না?
রিদি মাথা নাড়ল, আমার তাই ধারণা। আমরা এখন পর্যন্ত যে সব কাজ করেছি তার প্রত্যেকটা ক্ৰিভনের মান-সম্মান, ব্যাবসা, বাণিজ্য, ক্ষমতার রাজত্ব সবকিছুর উপর একটা করে বিশাল আঘাত। ক্ৰিভনের এখন তার লোকজনের সামনে মুখ দেখানোর কোনো উপায় নেই। ক্ৰিভনকে যেভাবে হোক তার সম্মানকে উদ্ধার করতে হবে। সেটা কীভাবে করা সম্ভব, বলো দেখি?।
রুহান কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।
রিদি বলল, বলো।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাদের দুইজনকে ধরে নিয়ে।
হ্যাঁ। শুধু ধরে নিয়ে নয়, দুইজনকে খুব কঠিন একটা শাস্তি দিয়ে–এমন কঠিন একটা শাস্তি যে পৃথিবীর যে কোনো মানুষ যখন সেটা শুনবে তখন আতঙ্কে শিউরে উঠবে। রিদি এক মুহূর্ত থেমে বলল, সেটা কী হতে পা তুমি জান?
রুহান কিছুক্ষণ পর বলল, জানি।
সেটা কী?
আমি সেটা নিয়ে কথা বলতে চাই না।
ঠিক আছে। আমিও চাই না। শুধু আমি নিশ্চিত করতে চাই যে তুমিও বর্তমান পরিস্থিতিটা ঠিকভাবে বুঝতে পারছ।
আমি বুঝতে পারছি রিদি। জেনে হোক না জেনে হোক আমরা অসম্ভব বিপদের একটা কাজে হাত দিয়েছি। অনেকটা সিংহের লেজ ধরে ফেলার মতো, এখন সেটা ধরে রাখতেই হবে, ছেড়ে দিলে সিংহটা আমাদের খেয়ে ফেলবে।
রিদি শব্দ করে হেসে বলল, মাঝে মাঝে তুমি খুব বিচিত্র কথা বল রুহান। খুব বিচিত্র এবং মজার। যাই হোক, চল শুয়ে পড়া যাক।
তুমি যাও, আমার একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
সেটাও খুব বিচিত্র, তুমি জানতে চেয়ো না।
রিদি বলল, সেই কাজটা কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না?
না।
আমি জানি, আমাদের খুব বিপদের ঝুঁকি আছে কিন্তু সেটা আজ রাতেই ঘটে যাবে বলে আমি মনে করি না। আমাদের এখানে এখন তিনশত সশস্ত্র মানুষ, তারা ছোট গ্রামটার চারপাশে পালা করে পাহারা দিচ্ছে। নাইট গগলস চোখে দিয়ে লোকজন দেখছে, গোপনে কেউ আক্রমণ করতে পারবে না।
সেটা নিয়েই ভাবছি রিদি। মনে হচ্ছে সেটাই দুশ্চিন্তার কথা।
রিদি শক্ত বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে বিড়বিড় করে বলল, যেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কথা তুমি সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। কিন্তু যেটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে তুমি চুল পাকিয়ে ফেল। আমার ধারণা তোমার। এখন সময় হয়েছে- কথাটা শেষ করার আগেই রিদি গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।
রুহান শুতে গেল একটু পরেই। শোবার আগে সে কয়েকটা কাঠি পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করে সেই কয়লা দিয়ে দেয়ালে একটা নির্দেশ লিখে গেল। ছোট একটা নির্দেশ, এটা লিখতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়, কিন্তু রুহান তার জীবনে বর্ণমালা ব্যবহার করে কিছু লেখেনি তাই তার বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল! রুহান খুব ভালো করে জানে বর্ণমালা ব্যবহার করে এই লেখা খুব বেশি মানুষ পড়তে পারবে না, তবুও তার মনে হলো এটা লিখে রাখা দরকার। খুব দরকার।
সে যে কত ক্লান্ত হয়েছিল সেটা সে নিজেই জানত না। রিদির মতোই বিছানায় শোয়া মাত্রই রুহান গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।
গভীর রাতে রিদি আর রুহান তাদের দরজায় শব্দ শুনে চমকে জেগে উঠে। ভয়। পাওয়া গলায় রুহান জিজ্ঞেস করল, কে?
আমি গার্ড।
কী হয়েছে গার্ড?
একটা মেয়ে তোমাদের সাথে দেখা করতে এসেছে।
মেয়ে? রিদি আর রুহান অবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। এতো রাতে কোন মেয়ে তার সাথে দেখা করতে আসবে?
দরজা খুলতেই হুঁড়মুড় করে একটা মেয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকল। একটা চাদর দিয়ে তার পুরো শরীর ঢাকা, শীতে একটু একটু কাঁপছে। মেয়েটি অপ্রকৃতস্থের মতো তাদের দুজনের দিকে তাকায়। বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে যন্ত্রের মতো বলতে থাকে, রিদি? রুহান? রিদি? রুহান? রিদি? রুহান?
রুহান নিঃশ্বাস বন্ধ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটিকে সে চেনে। একজন সক্রেটিস। মেয়েটির নাম ক্ৰানা। এই মেয়েটির মাথায়। ইলেট্রড দিয়ে যখন সিস্টেম লোড করা হয়েছিল তখন সেখানে সে হাজির ছিল। রুহান মেয়েটিকে চিনতে পেরেছে কিন্তু মেয়েটি তাকে চিনতে পারে নি। চেনার কথা নয়–এরা সক্রেটিস, মাথায় স্টিমুলেশন দেবার আগে এরা কাউকে চেনে না।
রুহান তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটার হাতের দিকে তাকাল, একটা লাল লিভার শক্ত করে ধরে রেখেছে। লিভারটা সে চেনে, বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্যে এই ধরনের লিভার ব্যবহার করা হয়।
ক্ৰানা একবার রিদি আর একবার রুহানের দিকে তাকিয়ে অনেকটা আপন মনে জিজ্ঞেস করে, রিদি? রুহান? রিদি?
রুহান বলল, হ্যাঁ। আমরা রিদি আর রুহান।
ক্রানা নামের মেয়েটা কিছুক্ষণ তাদের মুখের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে খুব ধীরে ধীরে তার শরীরের উপর থেকে চাদরটা সরাল, তারপর বলল, ক্রিভন আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছে। ক্ৰিভন? তোমরা চেনো ক্ৰিভনকে?
রুহান আর রিদি বিস্ফোরিত চোখে কানার শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার শরীরে বড় বড় দুটি টিউব বাঁধা। টিউবগুলো দুজনেই চেনে। এগুলো হাইব্রিড বিস্ফোরক। দুটো প্রয়োজন নেই একটা টিউব বিস্ফোরিত হলেই এই পুরো গ্রাম ভস্মীভূত হয়ে যাবে, কিন্তু ক্ৰিভন দুটি হাইব্রিড বিস্ফোরক শো দিয়েছে কারণ গ্রামটাকে ভস্মীভূত করা তার উদ্দেশ্য নয়। তার উদ্দেশ্য ভয় দেখানো।
ক্রানা ডান হাতে শক্ত করে লিভারটা চেপে ধরে রেখে বিড়বিড় করে বলাকা, ক্ৰিভন খুব মজার মানুষ। এক কথা অনেকবার বলে। অনেকবা। অনেকবার। আমাকে বলেছে রিদি আর রুহানকে খুঁজে বের করে নিয়ে যেতে। অনেকবার বলেছে। আর কী বলেছে জান? বলেছে রিদি আর রুহান যদি এক। কথা উচ্চারণ করে তাহলে এই লিভারটা ছেড়ে দিতে! কী আশ্চর্য একটা কথা!
রুহানের মনে হলো তার মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত ব যেতে শুরু করেছে। মনে হলো সে বুঝি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাবে। ক্ৰানা এদিক সেদিক তাকিয়ে আবার আপন মনে বলে, রিপি রুহান তোমরা কী কথা বলবে? একটা কথা। মাত্র একটা কথা! তাহলে আমি লিভারটা ছেড়ে দিতাম–দেখতাম কী হয়! কী হবে বলে তোমার মনে হয়? তোমরা কী জান? রিদি? রুহান? তোমরা জান? জান কী হয়?
ক্রানার সামনে দাঁড়িয়ে রিদি আর রুহান কুলকুল করে ঘামতে থাকে। হেরে গেছে! তারা জানে তারা হেরে গেছে। ক্ৰিভনের মতো একজন অসুস্থ মানুষ কী। সহজে তাদের হারিয়ে দিল!
১৩. ক্রিটিনাদের গ্রাম
উঁচু জায়গাটা থেকে ক্রিটিনাদের গ্রামটা স্পষ্ট দেখা যায়। দিনেরবেলা হলে আরও স্পষ্ট দেখা যেত। এখন রাত, আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, চাদের আলোতে সবকিছুই একটু অন্যরকম দেখায়। আবছা এবং রহস্যময়। গ্রামে ছোট ছোট বাসা, বাসার সামনে একটু খোলা জায়গা, খোলা জায়গা ঘিরে গাছ-গাছালি বাগান। এখন অনেক রাত বলে বাসাগুলো অন্ধকার থাকার কথা কিন্তু অনেক বাসাতেই আলো জ্বলছে। রিদি, রুহান আর প্রায় তিনশ সশস্ত্র মানুষকে আশ্রয় দেবার জন্যে গ্রামের মানুষেরা কাজকর্ম করছিল। রিদি রুহানকে ধরে নিয়ে আসার পর এখন গ্রামের মানুষদের ভেতর ভয়, আশঙ্কা আর উত্তেজনা। এই জায়গাটা থেকে সেই উত্তেজনাটুকু দেখা যায়। মানুষজন ভীত বিহ্বল হয়ে ছোটাছুটি করছে। কাছে থাকলে হয়তো তাদের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দও শোনা যেত।
রিদি আর রুহানকে দুটি ধাতব চেয়ারে বেঁধে বসানো হয়েছে, তৃতীয় চেয়ারটিতে বসেছে ক্ৰানা। ক্রানাকে বেঁধে না রাখলেও হতো কিন্তু তবু তাকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে যেন হঠাৎ করে উঠে না পড়ে। সে বিড়বিড় করে একটানা নিজের সাথে কথা বলে যাচ্ছে। হঠাৎ করে শুনলে মনে হয় অর্থহীন কিন্তু মন দিয়ে শুনলে একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে যা ঘটছে তার পুরো ব্যাপারটা নিয়ে জানার ভেতরে একটা বিস্ময়, কী ঘটছে কেন ঘটছে। সেটা নিয়ে তার ভেতরে অসহায় এক ধরনের প্রশ্ন।
ক্ৰিভনের জন্যেও একটা চেয়ার রাখা হয়েছে। তার চেয়ারটি নরম এবং আরামদায়ক। চেয়ারটিতে সে বসে নি, সেখানে তার একটা পা তুলে সে ক্রিটিনাদের গ্রামের দিকে তাকিয়ে আছে। জোছনার আলোতে গ্রামটিকে মনে হচ্ছে রহস্যময় এবং অলৌকিক। ক্ৰিভন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, রিদি এবং রুহান, তোমরা দুজন মানুষ আমার অনেক ক্ষতি করেছ। শুধু আমার না, আরো অনেকের।
রিদি কিংবা রুহান কেউ কোনো কথা বলল না। ক্ৰিভন বলল, তোমরা কেন এসব করছ আমি জানি না। আমি চিন্তা করে তার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। অনেক চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছি, সেটা কী জান? সেটা হচ্ছে নির্বুদ্ধিতা। চরম নির্বুদ্ধিতা। এই পৃথিবীটা নির্বোধ মানুষের জন্যে না–এই পৃথিবীটা হচ্ছে বুদ্ধিমান মানুষের জন্যে। তোমাদের এই পৃথিবীতে থাকার কোনো অধিকার নেই।
ক্রিভন চেয়ার থেকে পা নামিয়ে দুই পা হেঁটে সামনে গিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু নির্বুদ্ধিতা হোক আর যাই হোক, তোমরা আমার অনেক বড় ক্ষতি করেছ। সেই ক্ষতিটা আমাকে পুষিয়ে নিতে হবে। যেভাবে হোক।
সেটা করার জন্যে আমাকে কী করতে হবে জান? প্রথমে সবার কাছে প্রমাণ করতে হবে যে যারা তোমাদের সাথে থাকে তারা হচ্ছে নির্বোধ! তারা এত নির্বোধ যে তারা পোকা মাকড়ের মতো মারা পড়ে। ঘটনাটা ঘটানোর জন্যে আমি নিজে এই গণ্ডগ্রামে চলে এসেছি। এখানে বসে থেকে সামনের যে গ্রামটা আছে সেটাকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেব। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই গ্রামে একটা মানুষ দূরে থাকুক একটা টিকটিকিও বেঁচে থাকবে না! কী আনন্দ, তাই না?
ক্রিভন কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ গ্রামটার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর মাথা ঘুরিয়ে রিদি আর রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু শুধু গ্রামবাসীদের পোকামাকড় ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাসের মতো মারলে তো হবে না তোমাদের দুইজনকেও একটা শাস্তি দিতে হবে। সেটি হতে হবে এমন যন্ত্রণার একটি শাস্তি যেটা তোমাদের শরীরের প্রত্যেকটা কোষ, তোমাদের মস্তিষ্কের প্রত্যেক নিউরন সেল, তার প্রত্যেকটা সিনান্স কানেকশান যেন মনে রাখে। যন্ত্রণাটা শুধু তোমাদের দিলে তো হবে না সেটা সবাইকে দেখাতেও হবে। বিশাল একটা স্টেডিয়ামের মাঝখানে তোমাদের শাস্তিটা দেব, কয়েক লাখ মানুষ স্টেডিয়ামে টিকেট কেটে সেটা দেখতে আসবে–এটা হচ্ছে আমার পরিকল্পনা। এই এলাকার পুরো মানুষ জানবে ক্রিভনের সাথে কেউ যদি লাগতে আসে তা কোনো মুক্তি নেই। ক্ৰিভনের চোখ দুটি জ্বলে ওঠে, সে হিসহিস করে বল, দরকার হলে তাদের আমি নরক থেকে ধরে আনব, ধরে এনে শাস্তি দেব।
ক্ৰিভন নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তোমাদের শুধু শারীরিক যন্ত্রণার একটা শাস্তি দেব না, তোমাদের মানসিক একটা যন্ত্রণারও ব্যবস্থা করা দরকার। সে জন্যে তোমাদের এখানে এনেছি, চেয়ারে বসতে দিয়েছি, বেঁধে রেখেছি। বেঁধে না রাখলেও হতো–পালিয়ে তোমরা কোথায় যাবে? কেন এত যত্ন করে তোমাদের এখানে বসিয়েছি জান? তোমরা যেন পুরো ব্যাপারটা দেখতে পার! আমরা এক্ষুনি যে হত্যাকাণ্ড শুরু করব সেটা তোমরা নিজের চোখে দেখবে! তোমাদের নির্বুদ্ধিতার জন্যে এই মানুষগুলো একজন একজন করে মারা যাবে! তোমরা সেটা দেখবে। শরীরে আগুন নিয়ে ছোট ছোট শিশুরা চিৎকার করে ছোটাছুটি করবে তোমরা সেটা দেখবে! দেখে ভাববে এর জন্যে আমরা দায়ী! আমাদের নির্বুদ্ধিতা দায়ী। ক্ৰিভন ঘুরে তাকিয়ে বলল, বুঝেছ?
রিদি কিংবা রুহান কোনো কথা বলল না। তারা পুরো ব্যাপারটা ঠিক করে চিন্তাও করতে পারছিল না, মনে হচ্ছিল পুরো বিষয়টা বুঝি একটা দুঃস্বপ্ন, ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন।
ক্ৰিভন এসে তার নরম চেয়ারটিতে বসে পিছনে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো একজন মানুষকে বলল, স্টিমুলেশন দেবার কাজ শুরু করো।
কয়েকজন ছোটাছুটি করে একটা ছোট যন্ত্র নিয়ে আসে। ক্রানার চেয়ারের পিছনে যন্ত্রটা রেখে তারা ক্রানাকে চেপে ধরল। ক্ৰানা চিৎকার করে প্রতিবাদ করে, ভয়ে আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে। তার মাঝে একজন একটা ক্যাবল টেনে এনে একটা ধাতব কানেক্টর তার মাথার মাঝে ঢুকিয়ে দেয়। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে ক্ৰানা অচেতন হয়ে যায়। ক্রিভন সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথা নেড়ে বলল, সক্রেটিস খুব কাজের জিনিস, তবে ব্যবহার করা এত সোজা নয়!
কাউকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলা হয় নি তাই কেউ এই প্রশ্নের উত্তর দিল। ক্রিভন কিছুক্ষণ ক্ৰানার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জ্ঞান ফিরিয়ে আন তাড়াতাড়ি, আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।
কয়েকজন ক্রানাকে ঘিরে দাঁড়ায়, তার মুখে পানির ঝাঁপটা দেয়, শরীরে ধাক্কা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্রানা চোখ খুলে তাকায়। ফিসফিস করে বলে, আমি কোথায়?
ক্রিভন এগিয়ে গিয়ে বলল, তুমি ঠিক জায়গাতেই আছ। এখন সুস্থ বোধ করছ তো?
ক্ৰানা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি কথা বলতে কী আমার কোনো বোধ নেই। আমাকে কী জন্যে ডেকেছ বল।
একটু আগেই জানা কথা বলছিল পুরোপুরি অপ্রকৃতস্থ একজন মানুষের মতো মস্তিষ্কে স্টিমুলেশন দেবার সাথে সাথে সে কথা বলছে পুরোপুরি স্বাভাবিক মানুষের মতো!
ক্রিভন ক্রানার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, প্রথমে তোমাকে একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার। রিদি আর রুহান নামের দুই নির্বোধকে ধরে আনার জন্যে যে পরিকল্পনাটা তুমি করে দিয়েছিলে, সেটা চমৎকারভাবে কাজ করেছে।
শুনে খুব সুখি হলাম।
বুকের মাঝে হাইব্রিড বিস্ফোরক বেঁধে কাকে পাঠিয়েছিলাম তুমি কী জান?
না, আমি জানি না। আমামর জানার কথা নয়।
আমরা তোমাকে পাঠিয়েছিলাম।
ক্ৰানা ফিসফিস করে বলল, আমি বলে কেউ নেই। আমি ক্ৰানা নামে এই মেয়েটির মস্তিষ্কের একটা অবস্থা। আমার নিজের কোনো অস্তিত্ব নেই। তোমরা ক্ৰানাকে পাঠিয়েছিলে, আমাকে নয়।
একই কথা।
ক্রানা জোর দিয়ে বলল, না এক কথা নয়।
যাই হোক আমি সেটা নিয়ে এখন তোমার সাথে তর্ক করতে চাই না। আমার এখন তোমার সাহায্যের প্রয়োজন।
ক্ৰানা বলল, বলো, আমাকে কী করতে হবে।
সামনের এই গ্রামটি দেখছ? হ্যাঁ, দেখছি।
আমি এই গ্রামের প্রত্যেকটা জীবিত প্রাণীকে হত্যা করতে চাই।
ক্রানার কণ্ঠস্বর এক মুহূর্তের জন্যে থমকে যায়, এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, কেন?
আমি এই গ্রামের মানুষকে একটা শাস্তি দিতে চাই। সেই শাস্তির খবরটি সব জায়গায় ছড়িয়ে দিয়ে আমার ক্ষমতাটি সম্পর্কে সবাইকে ধারণা দিতে চাই।
ক্রানা বলল, প্রাণী হত্যা করার জন্যে সবচেয়ে কার্যকরী বিষ নিশুনিয়া এখান থেকে দুটি নিশুনিয়া বোমা একটা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে গ্রামের মাঝামাঝি ছুড়ে দাও, ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে সবাই মারা যাবে। যন্ত্রণাহীন চমৎকার একটি মৃত্যু!
না, না, না— ক্ৰিভন মাথা নেড়ে বলল, আমি যন্ত্রণাহীন মৃত্যু চাই না। আমি ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করতে চাই। যন্ত্রণার প্রত্যেকটা মুহূর্ত ভিডিওতে ধরে রাখতে চাই। সেটা প্রচার করতে চাই।
তাহলে তোমার জন্যে সবচেয়ে উপযোগী বোমা হবে ক্রাটুশকা বোমা। প্রতি এক বর্গ কিলোমিটারের জন্যে এবটা বোমাই যথেষ্ঠ। এই বোমা থেকে যে গ্যাস বের হয় সেটা বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে প্রত্যেকটা প্রাণীর শরীরের প্রতি সেন্টিমিটার পুড়িয়ে দেবে। দেখতে দেখতে ফোঁসকা পড়ে দগদগে ঘা হয়ে যাবে। চোখের কর্ণিয়া পুড়ে অন্ধ হয়ে যাবে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায়। চিৎকার করতে থাকবে। নিঃশ্বাসের সাথে ফুসফুসে এই গ্যাস যাবার পর ফুসফুস ঝাঝরা হয়ে যাবে, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ফুসফুসের টুকরোগুলো বের হয়ে আসবে। বলা যেতে পারে তিন থেকে চার ঘণ্টার ভেতরে প্রত্যেকটা প্রাণী নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে। কম সময়ের ভেতরে সবাইকে হত্যা করার জন্যে এটাই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। যদি আরও বেশি সময় নিয়ে কাজটা করতে চাও।
ক্রিভন বাধা দিয়ে বলল, না, আমার হাতে বেশি সময় নেই। আমি সময় নিয়ে করতে পারব না।
ক্ৰানা অত্যন্ত শান্ত গলায় বলল, তাহলে তোমার জন্যে কাটুশকা বোমাটিই ভালো। এর দুটি গ্রেড আছে তুমি দ্বিতীয় গ্রেডটি গ্রহণ কর। তোমার সংরক্ষণে সেটা আছে। এর ওজন তেইশ কেজি। এটা নিক্ষেপ করার জন্যে তোমার একটা ক্ষেপণাস্ত্র দরকার। জেনারেশন থ্রী, মাকাও মডেলটি ভালো। নিক্ষেপ করার সময় মাটির সাথে তিরিশ ডিগ্রী কোণ করতে হবে।
চমৎকার! ক্ৰিভন মাথা ঘুরিয়ে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে লক্ষ্য করে বলল, তোমরা ব্যবস্থা কর।
মানুষগুলো সাথে সাথে জেনারেশনে থ্রী মাকাও মডেল আর দ্বিতীয় গ্রেডের ক্রাটুশকা বোমা আনতে চলে গেল। ক্ৰানা চোখের কোণা দিয়ে তাদেরকে চলে যেতে দেখল, তারপর চেয়ারে মাথা হেলান দিয়ে বলল, অসম্ভব যন্ত্রণা দিয়ে কীভাবে পুরো গ্রামের সবাইকে হত্যা করতে হবে আমি সেটা বলে দিয়েছি। আমি কী এখন বিদায় নিতে পারি? তোমরা নিশ্চয়ই জান আমার মস্তিষ্ককে এখন বাড়তি ক্ষমতায় কাজ করতে হচ্ছে, সেটি কষ্ট। অনেক কষ্ট।
ক্ৰিভন শব্দ করে হেসে বলল, তোমাকে আমাদের অনেক ইউনিট দিয়ে কিনতে হয়েছে। সে জন্যে একটু কষ্ট তোমাকে করতেই হবে। পুরো ঘটনাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার সাহায্য দরকার। তার কারণ—
কী কারণ?
আমার পুরো সেনা বাহিনী আসছে। সবাইকে হত্যা করার পর আমার পুরো সেনাবাহিনীকে এখানে পাঠাব, অনেক অস্ত্র আছে সেগুলো উদ্ধার করতে হবে। তা ছাড়া
তা ছাড়া কী?
রিদি আর রুহানকে ধরে আনা হয়েছে। তাদেরকে শাস্তি দেয়ার একটি ব্যাপার আছে। সেটা নিয়েও তোমার সাথে কথা বলতে হবে।
ঠিক আছে। কিন্তু তাড়াতাড়ি কর। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। অসম্ভব কষ্ট। আমার মস্তিষ্কে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে একজন মানুষের মস্তিষ্ক কখনো সেভাবে ব্যবহার করা হয় না। কখনো সেভাবে ব্যবহার করার কথা না।
ক্ৰিভন আবার হেসে বলল, তোমাকে আমি অনেকগুলো ইউনিট দিয়ে কিনেছি। তুমি একটু কষ্ট সহ্য কর।
রিদি আর রুহান নিঃশব্দে বসে আছে। কাছাকাছি কোনো একটা কনটেনার থেকে জেনারেশান থ্রী মাকাও মডেল, দ্বিতীয় গ্রেডের ক্রাটুশকা বোমা এবং আরও কিছু যন্ত্রপাতি আনা হতে থাকল। মানুষজন ব্যস্ত হয়ে সেগুলো সাজিয়ে রাখতে থাকে। রিদি আর রুহান নিঃশব্দে বসে দূরে ক্রিটিনার গ্রামটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
রুহান অনেকক্ষণ থেকেই গ্রামটির দিকে কী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেখানে একটা কিছু ঘটার জন্যে সে অপেক্ষা করছে। ঘুমানোর আগে কয়লা দিয়ে সে তার ঘরের দেয়ালে একটা নির্দেশ লিখে রেখেছিল, ক্রিটিনা কী সেই নির্দেশটা পড়তে পেরেছিল? পড়ার পর সেটাকে কী সে গুরুত্ব দিয়েছিল?
উত্তর থেকে একটা শীতল বাতাস বয়ে আসে। রুহান নিজের ভেতরে একটা কাঁপুনী অনুভব করে এবং ঠিক তখন তার মনে হলো গ্রামের ভেতর এক সাথে অনেকগুলো আলো জ্বলে উঠল। ভালো করে তাকালে বোঝা যায় সেগুলো। মশালের আগুন। রুহান নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে আর দেখতে পায় আলোগুলো গ্রামের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে। সারা গ্রামের ভেতর নতুন নতুন মশাল জ্বলে ওঠে আর সেগুলো গ্রামের একমাথা থেকে অন্য মাথায় সরে যেতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে সেগুলো সারিবদ্ধ হয়ে যায় এবং পুরো গ্রামটি জুড়ে মশালের আলো দিয়ে বিশাল একটা ক্রস আঁকা হয়ে যায়।
রুহানের সাথে সাথে অন্য সবাই গ্রামের দিকে তাকাল। ক্রিভন একটু অবাক হয়ে বলল, কী করছে গ্রামের মানুষেরা?
কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না, শুধু ক্ৰানা হঠাৎ করে সোজা হয়ে বসে চোখ বড় বড় করে ক্রসটির দিকে তাকিয়ে রইল। রুহান আড়চোখে তাকিয়ে দেখল হঠাৎ করে ক্রানার সারা মুখে আনন্দের একটা আভা ছড়িয়ে পড়ছে।
ক্রিভন এগিয়ে এসে বলল, তুমি কী বলতে পারবে এটা কী?
হ্যাঁ। ক্ৰানা মাথা নাড়ল, বলতে পারব।
এটা কী?
এটা একটা ক্রস।
ক্রিভন অধৈর্য হয়ে বলল, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু কেন ক্রস?
গ্রামের মানুষ একটা তথ্য পাঠানোর চেষ্টা করছে। খুব জরুরি একটা তথ্য।
সেটা কী তথ্য? কাকে পাঠাচ্ছে।
ক্রানা মাথা নেড়ে বলল, আমি বোঝার চেষ্টা করছি। বোঝা মাত্রই তোমাকে জানাব। আমার মনে হয় কিছুক্ষণের মাঝেই এটা আমি বুঝে যাব।
ঠিক আছে আমরা ততক্ষণে বাকি কাজ সেরে ফেলি। মানুষগুলো কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত করে কাটুশকা বোমাটি ভেতরে প্রবেশ করায়। তারপর পিছনে সরে দাঁড়ায়। ক্ৰিভন জিজ্ঞেস করে, সবাই প্রস্তুত।
মানুষগুলো মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। প্রস্তুত।
ক্রিভন সুইচ টেপার জন্যে একটু এগিয়ে যেতেই ক্রানা বলল, একটু দাঁড়াও।
কেন?
তুমি কী বলেছ তোমার সেনাবাহিনী এই এলাকায় আসছে?
হ্যাঁ।
তাদের কী আসতেই হবে?
হ্যাঁ।
তাহলে আগে তাদের একটা খবর পাঠাও।
ক্ৰিভন বলল, কী খবর পাঠাব?
তাদের অস্ত্রের সিকিউরিটি মডিউলে একটা সংখ্যা প্রবেশ করাতে হবে। তাতে বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতির জন্যে এলার্মটি কার্যকর হবে। তাদের নিরাপত্তার জন্যে এটা খুব জরুরি।
ক্ৰিভন অবাক হয়ে বলল, আমি কখনো শুনি নি, অস্ত্রের ভেতরে বিষাক্ত গ্যাসের এলার্ম আছে।
ক্রানা হাসির মতো একটা শব্দ করে বলল, তোমরা যদি সবকিছু জানতে তাহলে নিশ্চয়ই অনেক ইউনিট খরচ করে আমাকে কিনে আনতে না।
ক্রিভন মাথা নাড়ল। সেটা সত্যি। ঠিক আছে তুমি কোডটি বল, আমি আমার সেনাবাহিনীর কাছে কোডটা পাঠিয়ে দিই।
ক্ৰানা একটা জটিল কোড উচ্চারণ করে অস্ত্রধারী একজন মানুষ ক্রিস্টাল রিডারে সেটা তুলে নিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে পাঠানোর জন্যে চলে যায়।
ক্রিভন বলল, আমরা কী আমাদের অস্ত্রেও কোডটা ঢোকাব?
ক্ৰানা বলল, ঢোকাতে পার। তোমাদেরও একটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে।
অস্ত্রের ভেতর কোডটা ঢুকিয়ে ক্রিভন আবার তার ক্ষেপণাস্ত্রের কাছে ফিরে এলো, ক্ষেপণাস্ত্রের সুইচ স্পর্শ করার ঠিক আগের মুহূর্তে ক্ৰানা বলল, দাঁড়াও।
কী হলো।
বাতাসের দিক পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। বিষাক্ত গ্যাস এদিকে আসতে পারে, তোমাদের একটু নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার।
সেটি কীভাবে করব?
সবাই একটা প্রতিষেধক ক্যাপসুল তোমাদের জিভের নিচে রেখে দাও।
প্ৰতিষেধক ক্যাপসুল কোনটি?
তোমাদের চিকিৎসক নিশ্চয়ই জানে। তাকে জিজ্ঞেস কর।
ক্ৰিভন একটু অধৈর্য হয়ে বলল, আমরা সাথে কোনো চিকিৎসক আনি নি। তুমি কী জান না?
জানি। অবশ্যই জানি। কিন্তু আমি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ নই। আমি যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ। ক্ৰানা শান্ত গলায় বলল, আমি চিকিৎসা সংক্রান্ত উপদেশ দিতে চাই না। কারণ তুমি আমাকে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ হিসেবে কিনে আননি। যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কিনেছ।
ক্রিভন অধৈর্য হয়ে হাত ছুড়ে বলল, তুমি সময় নষ্ট করো না। বলে দাও কোনটি প্রতিষেধক ক্যাপসুল।
ক্ৰানা প্রতিষেধক ক্যাপসুলের নামটি বলে দিতেই একজন সেগুলো আনতে ছুটে চলে গেল। ক্রানা বলল, যতক্ষণ সেগুলো আনা না হচ্ছে তোমরা ততক্ষণ অন্য একটা কাজ করতে পার।
কী কাজ?
বাতাসের দিক পরিবর্তন করছে, আমি বুঝতে পারছি, উত্তর দিক থেকে শুষ্ক বাতাস আসছে। শুকনো বাতাস ক্রাটুশকা অক্সিডাইজড হতে দেরি হয়।
তার মানে কী?
তার মানে কাটুশকা বোমার কার্যকারিতা শতকরা ত্রিশ ভাগ পর্যন্ত কম হয়ে যেত পারে।
কিভন একটু বিরক্ত হয়ে বলল, শেষ মুহূর্তে এটা বলছ কেন?
ক্ৰানা শান্ত গলায় বলল, আমি এটা শেষ মুহূর্তে বলছি কারণ আমি এটা শেষ মুহূর্তে জানতে পেরেছি। কিন্তু সেটি নিয়ে তোমার ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
ক্ৰিভন, আমি শতকরা ত্রিশ ভাগ অকার্যকর একটি বোমা কেন পাঠাব?
ক্রানা বলল, এগুলো রাসায়নিক বোমা। কেউ শতকরা একশ ভাগ কার্যকারিতা গ্যারান্টি দেয় না। তবে যেহেতু সমস্যাটি সহজ এর সমাধানটিও সহজ।
সমাধানটি কী?
ক্ৰানা বলল, যেহেতু বাতাস শুষ্ক, জলীয় বাষ্প নেই, কাটুশকা বোমার উপাদানে একটু পানি দাও। এগুলো রাসায়নিক বোমা, শেষ মুহূর্তে এখানে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থ দেয়া যায়।
ক্ৰিভন বলল, তুমি সেটা আগে বলছ না কেন?
আমি ঠিক সময়েই বলেছি, তুমি অধৈর্য হয়ে আছ বলে তোমার কাছে মনে। হচ্ছে আমি দেরি করে বলেছি। কাটুশকা বোমাটি বের করে আনো, ডানদিকৈর স্কুটা ঢিলে করে সেখানে পাঁচশ সিসি পানি ঢেলে দাও।
ক্ৰিভন অন্য কাউকে দায়িত্বটি না দিয়ে নিজেই কাটুশকা শেলটি বের করে আনে। ডানদিকের স্কুটা খুলে সেখানে একটু পানি ঢেলে দিয়ে আবার স্কুটা লাগিয়ে দেয়। শেলটা ক্ষেপণাস্ত্রে ঢুকিয়ে কানার দিকে তাকাল, আর কিছু?
না।
আমি সুইচ টিপতে পারি?
প্রতিষেধক ক্যাপসুলটা আসুক।
কাজেই ক্ৰিভনকে আরো কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হলো। সবাই প্রতিষেধক ক্যাপসুলটা জিভের নিচে দিয়ে ক্রিভন ক্ষেপণাস্ত্রটির কাছে এগিয়ে। যায়। ডানদিকে একটা লিভারকে টেনে ধরে সে সুইচটা চেপে ধরে। সাথে সাথে ভেতরে একটা যান্ত্রিক শব্দ হয়ে এলার্ম বেজে ওঠে। ক্রিভন পিছনে সরে আসে এবং হঠাৎ করে ঝাঁকুনি দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রটি কেঁপে ওঠে এবং একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে কাটুশকার শেলটি উড়ে গেল।
ক্ৰিভনের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে। সে রিদি আর রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, নির্বুদ্ধিতার পরিণাম কী হতে পারে, তুমি নিজের চোখে দেখ।
রুহান ফিসফিস করে বলল, পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগেও অনেকবার অনেক নৃশংসতা হয়েছে। কিন্তু কোনো নৃশংস মানুষ কিন্তু কখনো বেঁচে থাকে নি। তুমিও বেঁচে থাকবে না ক্ৰিভন।
ক্রিভন শব্দ করে হেসে বলল, তুমি নিজের চোখে দেখ কে বেঁচে আছে, আর কে বেঁচে নেই!
দূর গ্রাম থেকে একটা কোলাহলের মত শব্দ ভেসে আসে, ক্রিভন সেদিকে উৎসুকভাবে তাকিয়ে ক্রানাকে জিজ্ঞেস করল, শেলটি কী ফেটেছে।
ক্রানা মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই ফেটেছে।
বিষক্রিয়া শুরু হয়েছে?
ক্রানা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ক্ৰিভন, তুমি একটু আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আলোর মশাল দিয়ে গ্রামে একটা ক্রস তৈরি করার অর্থ কী?
হ্যাঁ। সেটা কী তুমি বুঝতে পেরেছ?
পেরেছি।
ক্রিভন ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল, সেটা কী?
মানুষ যখন কাউকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে, তখন হাত দুটো অনেক সময় একটার উপর আরেকটা চলে আসে, নিজের অজান্তে দুটি হাত দিয়ে তৈরি হয় একটা ক্রস।
ক্ৰিভন বলল, তুমি কি বলছ বুঝতে পারছি না।
আমি বলছি, এই ক্রসের অর্থ ভালোবাসা।
ভালোবাসা?
হ্যাঁ, ভালোবাসা।
ক্ৰিভন কুদ্ধ গলায় বলল, কার জন্যে ভালোবাসা? কীসের ভালোবাসা?
মানুষের জন্যে মানুষের ভালোবাসা।
কিন্তু সেটা বলার অর্থ কী?
তারা আমাকে মনে করিয়ে দিল, মানুষের জন্যে থাকতে হয়। ভালোবাসা।
ক্রিভন কাঠ কাঠ গলায় হেসে উঠে বলল, এটা চমৎকার একটা রসিকতা হলো, তারা বলছে ভালোবাসা আর তুমি ক্রাটুশকার শেল দিয়ে সেই ভালোবাসার জবাব দিলে! তোমার ভালোবাসায় সবার চামড়ায় ফোঁসকা পড়ে দগদগে ঘা হবে, ফুসফুস টুকরো টুকরো হয়ে বের হয়ে আসবে নিঃশ্বাসের সাথে!
ক্ৰানা মাথা নেড়ে বলল, না, ক্ৰিভন! তুমি বুঝতে পারছ না। কেউ যখন ভালোবাসার কথা বলে তখন তাকে হত্যা করা যায় না।
ক্রিভন চমকে উঠে বলল, তুমি কী বললে?
আমি বলেছি, মানুষ যখন মানুষের কাছে ভালোবাসার কথা বলে তখন তাকে হত্যা করা যায় না!
কিন্তু কিন্তু–
ক্ৰানা হেসে বলল, মনে নেই তুমি কাটুশকার শেলে স্কু খুলে পানি ঢুকিয়েছ?
হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?
পুরো রাসায়নিক উপাদানগুলো তখন নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছি ক্রিভন।
ক্ৰিভন চিৎকার করে বলল, তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলতে পার না। এটা অসম্ভব। তুমি মানুষ নও তুমি মস্তিষ্কের একটা বিচ্যুতি–
তুমি ঠিকই বলেছ। আমার মিথ্যা বলার কথা নয়, শুধু একটি ব্যতিক্রম আছে। যদি কোথাও আমি একটি ক্রস দেখতে পাই, আমার সমস্ত যুক্তি তর্ক ওলটপালট হয়ে যায়! আমার ভেতরে ভালোবাসার বান ডেকে যায়-–
না! ক্ৰিভন চিৎকার করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, অবাক হয়ে একবার ক্রানার দিকে আরেকবার রিদি আর রুহানের দিকে তাকায়। ক্রানা হাসি মুখে বলল, তুমি ছোটাছুটি করো না, তোমার জিভের নিচে যে ক্যাপসুলটা দিয়েছ সেটা কোনো প্রতিষেধক নয়, সেটা ঘুমের ওষুধ! তুমি ঘুমিয়ে পড়ছ ক্ৰিভন। শুধু তুমি নও, তোমরা সবাই।
না। ক্ৰিভন গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলল, এটা হতে পারে না।
পারে। আমি যদি একটা মিথ্যা বলতে পারি তাহলে দশটা মিথ্যা বলতে পারি। আমি অবশ্যি দশটা মিথ্যা বলি নি। মাত্র তিনটা মিথ্যা বলেছি! তিন নম্বর মিথ্যাটা কী জান?
ক্রিভন কোনো কথা না বলে স্থির চোখে কানার দিকে তাকাল। ক্রানা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, তোমাদের অস্ত্রগুলোর ভেতরে একটা কোড ঢুকিয়েছ মনে আছে? কোডগুলো অস্ত্রটাকে অকেজো করে দেয়। তোমার পুরো সেনাবাহিনীর কারো কাছে এখন কোনো অস্ত্র নেই! একটিও নেই!
ক্রিভন হাঁটু গেড়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে কোমর থেকে হঠাৎ একটা ছোট রিভলবার বের করে হিংস্র গলায় বলল, আছে! একটা অস্ত্র এখনো আছে। এই অস্ত্রের কোনো কোড নেই। সেটা দিয়েই আমি তোমাদের শেষ করব।
ক্ৰিভন অস্ত্রটা প্রথমে রুহানের দিকে তাক করল। ট্রিগার টানার সাথে সাথে প্রচণ্ড একটা শব্দে কানে তালা লাগা গেল, শেষ মুহূর্তে রিদি তারই চেয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নিজের শরীর দিয়ে রক্ষা করেছে রুহানকে।
রুহান বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। ক্রিভনের দেহের উপর রিদি উপুড় হয়ে পড়ে আছে। জোছনার নরম আলোতে দৃশ্যটিকে মনে হয় অতিপ্রাকৃতিক। যে ক্ষীণ কালচে তরলটি গড়িয়ে আসছে, সেটি রক্তের ধারা। জোছনার আলোতে সেটিকে লাল দেখাচ্ছে না, সেটাকে দেখাচ্ছে কালো!
রুহান তবুও জানে এটা রক্ত। রিদির রক্ত।
১৪. রুহানের পাশে পাশে হাঁটছে ক্রিটিনা
রুহানের পাশে পাশে হাঁটছে ক্রিটিনা। নদীর তীরে একটা বড় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রুহান বলল, তুমি এখন যাও।
ক্রিটিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না রুহান।।
রুহান শব্দ করে হেসে বলল, পৃথিবীটা এর মধ্যে অন্যরকম হয়ে গেছে ক্রিটিনা। মানুষের এখন অন্য মানুষকে দেখে ভয় পেতে হয় না। তারা একা বের হতে পারে, তাদের অস্ত্র নিয়ে বের হতে হয় না।
সব তোমার জন্যে।
না। আমার জন্যে নয়–আমাদের জন্যে। রুহান গলার স্বর পাল্টে বলল, তোমার কী মনে হয় ক্রিটিনা রিদি ভালো হয়ে উঠবে না?
উঠবে। একটু সময় লাগবে, কিন্তু ভালো হয়ে যাবে।
আর ক্রানা?
ক্রানা খুব হাসিখুশি আছে। একেবারে শিশুর মতোন। কিহি চলে আসার পর কী খুশি হয়েছে তুমি দেখেছ?
দেখেছি। ক্রানার মতো সবাই কিহিকে খুব ভালোবাসে। রুহান বলল, তুমি জান কিহি আমাকে পড়তে শিখিয়েছিল।
ক্রিটিনা বলল, আর তুমি শিখিয়েছ আমাকে।
আমি যদি না শেখাতাম তাহলে কী সর্বনাশ হতো চিন্তা করেছ?
ক্রিটিনা হেসে বলল, খুব ভালো করে শেখাও নি। দেয়ালে তোমার লেখাটা পড়তে আমার অনেকক্ষণ লেগেছিল।
তাতে কিছু আসে যায় না। সেটা পড়েছ, পড়ে যেটা করার কথা সেটা করেছ সেটাই বড় কথা! এখন সবাইকে পড়তে শিখিয়ে দাও, কিহি তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। ক্রিস্টাল রিডারের উপর আর ভরসা করে থাকার দরকার নেই।
রুহান হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, ক্রিটিনা, তুমি এখন যাও।
ক্রিটিনা মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে ছাড়তে মন চাইছে না রুহান।
রুহান ক্রিটিনার মুখের দিকে তাকাল, তার চোখের কোণায় পানি চিক চিক করছে। রুহান ক্রিটিনার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, আমারও তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না ক্রিটিনা। কিন্তু আমাকে যেতে হবে। কতদিন আমার মাকে দেখিনি। আমার ছোট দুটি বোন আছে, নুবা আর ত্রিনা তাদেরকেও দেখিনি। তারা কোথায় আছে, কেমন আছে আমি জানি না–
তুমি তাহলে কথা দাও আবার তুমি ফিরে আসবে।
আমি আবার আসব ক্রিটিনা।
আমার কাছে আসবে?
তোমার কাছে আসব।
আমি প্রতিদিন বিকেলে এখানে এসে এই পথের দিকে তাকিয়ে থাকব।
রুহান হেসে বলল, পাগলী মেয়ে! প্রতিদিন কেন অপেক্ষা করবে।
আমি করব। বলে ক্রিটিনা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।
রুহান যখন তার বাসায় পৌঁচেছে তখন গভীর রাত। দরজায় শব্দ শুনে মা জিজ্ঞেস করলেন, কে এসেছে?
আমি মা। আমি রুহান।
মা দরজা খুলে অবাক হয়ে রুহানের দিকে তাকালেন। ফিসফিস কতে বললেন, তুই এসেছিস?
হ্যাঁ মা। আমি এসেছি। মা বললেন, আয় বাবা একটু কাছে আয়।
রুহান এগিয়ে গেল, মা দুই হাতে তাকে শক্ত করে চেপে ধরে ফিসফিস করে বললেন, আমি সৃষ্টিকর্তার হাতে তোকে সপে দিয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তা আবার তোকে আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে।
মা ছেড়ে দেবার পর রুহান জিজ্ঞেস করল, নুবা ত্রিনা কেমন আছে মা?
ভালো আছে।
কোথায় তারা?
ঘুমাচ্ছিল। এখন নিশ্চয়ই উঠেছে।
ঘুম ভাঙ্গা চোখে ততক্ষণে নুবা আর ত্রিনা উঠে এসেছে। অবাক হয়ে তার। তাদের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
রুহান হাত বাড়িয়ে বলল, কাছে আস।
দুজনে দ্বিধান্বিত ভাবে এগিয়ে এসে তাদের ভাইকে স্পর্শ করে। নুবা ফিসফিস করে বলে, তুমি আর চলে যাবে না তো?
রুহান হেসে বলল, ধুর বোকা। আমি কী চলে গিয়েছিলাম? আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল!
তোমাকে আবার কেউ ধরে নিয়ে যাবে না তো?
না। নেবে না।
ত্রিনা নুবার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, মনে নাই নুবা, সবাই বলেছে পৃথিবী আবার আগের মতো হবে। ভালো আর সুন্দর?
হ্যাঁ। ত্রিনা দুই চোখ বড় বড় করে বলল, দুইজন মানুষ এসেছে স্বর্গ থেকে, তারা সারা পৃথিবীটাকে সুন্দর করে দিচ্ছে!
নুবা চোখ বড় বড় করে রুহানের দিকে তাকাল, সেই মানুষ দুইজন নাকি অপূর্ব সুন্দর! তাদের চেহারা নাকী দেবদূতের মতোন। তাদের হাতের অস্ত্র দিয়ে তারা চোখ বন্ধ করে পৃথিবীর সব দুষ্টু মানুষকে শেষ করে দিতে পারে।
ত্রিনা বলল, তাদের মাথায় অনেক বুদ্ধি। তাদের বুকে নাকী সিংহের মতো সাহস।
নুবা বলল, পৃথিবীর সব মানুষ নাকী তাদের ভালোবাসে।
ত্রিনা বলল, আমরাও তাদেরকে ভালোবাসি। আমি আর নুবা প্রতি রাতে তাদের জন্যে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি।
নুবা ছেলেমানুষের মতো বলল, আর তুমি জান। সেই দুজনের একজনের নাম রুহান রুহান! ঠিক তোমার মতোন। কী আশ্চর্য, তাই না?
রুহান ছোট দুটি বোনকে কাছে টেনে এনে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ খুব আশ্চর্য।
মা একদৃষ্টে তার সন্তানের দিকে তাকিয়েছিলেন হঠাৎ কাঁপা গলায় বললেন, রুহান।
কী মা?
তুই–তুই সেই রুহান। তাই না?
রুহান এক মুহূর্তের জন্যে চিন্তা করল, তারপর বলল, হ্যাঁ মা। আমি সেই রুহান রুহান।
—XOXO—