- বইয়ের নামঃ রবোনগরী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
অপারেশান অপক্ষেপ
বিশাল একটা হলঘরে প্রায় এক হাজার তরুণ বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, গবেষক, শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মী শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। হলঘরটি রাষ্ট্রীয় হলঘর, গ্রানাইটের কালো দেয়াল এবং উঁচু ছাদ। ভিতরে হালকা স্বচ্ছ এক ধরনের নরম আলো, বসার জন্যে মেরুন রঙের নরম চেয়ার, সামনে কাঁচে ঢাকা সিলিকনের সুদৃশ্য টেবিল। টেবিলে কাগজপত্র, মাইক্রো কম্পিউটার, কমিউনিকেশন মডিউলের মতো নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র। তরুণ বিজ্ঞানী গবেষক এবং শিল্পী সাহিত্যিকেরা নিজেদের ভিতরে নিচু গলায় কথা বলছে, তরল গলায় হাসছে। যদিও এটি রাষ্ট্রীয় হলঘর কিন্তু পরিবেশটি গুরুগম্ভীর রাষ্ট্রীয় পরিবেশ নয়, পরিবেশটি সহজ এবং স্বাভাবিক।
হলঘরে একটু উত্তেজনা দেখা গেল এবং প্রায় সাথে সাথে ভারি গলায় একটি ঘোষণা শোনা যায়। বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক থিরু হলঘরে এসে পৌঁছেছেন এবং তিনি এক্ষুনি এই এক সহস্র বিজ্ঞানী প্রযুক্তিবিদ এবং শিল্পী সাহিত্যিকের সাথে কথা বলবেন। মেরুন রঙের আরামদায়ক চেয়ারে বসে থাকা তরুণ–তরুণীরা নড়েচড়ে বসল এবং প্রায় সাথে সাথেই তাদের টেবিলের স্বচ্ছ কাঁচে থিরুকে দেখা গেল। শান্ত সৌম্য একহারা চেহারা, পরনে দৈনন্দিন সহজ পোশাক।
বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক তার আসনে বসে সাথে সাথেই কথা বলতে শুরু করে দিলেন। নরম গলায় বললেন, এটি রাষ্ট্রীয় হলঘর, নানা কাজে আমাকে এখানে আসতে হয়, আনুষ্ঠানিক পোশাক পরতে হয় এবং আনুষ্ঠানিক কথা বলতে হয়। আজ একটা বিশেষ দিন, আমি আগে থেকে ঠিক করেছি এই দিনে কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকবে না, আজ এখানে খোলাখুলি কথা বলা হবে।
উপস্থিত তরুণ–তরুণীরা মহামান্য থিরুর কথা শুনে এক ধরনের আনন্দের মতো শব্দ করল।
বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক থিরু কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বললেন, আজকে আমি একটু সময় নিয়ে এসেছি, আমি শুধু তোমাদের সাথে কথা বলব না, আমি তোমাদের কথা শুনব।
উপস্থিত তরুণ–তরুণীরা আবার একটা আনন্দধ্বনির মতো শব্দ করল, বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালকের সাথে কথা বলা একটি দৈনন্দিন ব্যাপার নয়।
থিরু তার সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, তোমাদের সাথে কথা বলা আমার জন্যে একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা। তোমরা সারা পৃথিবী থেকে বেছে–নেয়া এক হাজার সেরা বিজ্ঞানী গবেষক শিল্পী এবং সাহিত্যিক। তোমাদের কাউকে এখানে জোর করে আনা হয় নি, তোমরা সবাই স্বেচ্ছায় এসেছ। তোমরা সবাই হচ্ছ অপারেশান অপক্ষেপের অংশ।
অপারেশান অপক্ষেপের ধারণাটি নূতন নয়, যারা পৃথিবী নিয়ে ভাবেন তারা অনেকবার এ ধরনের একটা কথা বলেছেন কিন্তু কেউ কখনো সেটি পরীক্ষা করে দেখেন নি। সেই পরীক্ষাটি সহজ নয়। এই প্রথম তোমাদের ব্যবহার করে অপারেশান অপক্ষেপের পরীক্ষা করা হবে।
তোমরা জান অপারেশন অপক্ষেপটি কী এবং কেন সেটা আমরা করছি। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এর জ্ঞান–বিজ্ঞানের উন্নয়ন হয়েছে প্রয়োজনে। ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে বিজ্ঞানীরা, প্রযুক্তিবিদেরা আবিষ্কার করেছেন নূতন শক্তিবলয়। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় আবিষ্কৃত হয়েছে কৃত্রিম খাদ্য। পৃথিবীর সঞ্চিত শক্তি নিঃশেষ হবার পর আবিষ্কৃত হয়েছে নূতন শক্তিভাণ্ডার। পারমাণবিক যুদ্ধে জনারণ্য ধ্বংস হওয়ার পর মহামারীতে দুঃসময়ে আবিষ্কৃত হয়েছে নূতন জীবন সম্ভাবনা, নূতন ওষুধ, নূতন প্রতিষেধক।
কিন্তু আমরা আমাদের অতীতকে আজ পিছনে ফেলে এসেছি। এখন পৃথিবীতে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা নেই, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, খাদ্যাভাব নেই। প্রকৃতিকে আমরা জয় করেছি, ভূমিকম্প ঝড় বৃষ্টি বন্যার ভয় নেই। আমরা প্রকৃতি থেকে নূতন শক্তি ভাণ্ডার আহরণ করছি, আমাদের শক্তি ফুরিয়ে যাবার আশঙ্কা নেই। কৃত্রিম খাদ্য তৈরি। হয়েছে, পৃথিবীর মানুষকে আর ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে হবে না। আমাদের রোগ শোক নেই, দুঃখ কষ্ট নেই, খাদ্যের কষ্ট নেই, পরিবেশকে রক্ষা করা হয়েছে, পরিবেশ দূষণের ভয় নেই। সুস্থ সবল বুদ্ধিমান আবেগপ্রবণ মানবশিশুর জন্ম হচ্ছে, ভালবাসায় তারা বড় হচ্ছে, জ্ঞানে বিজ্ঞানে উন্নত হচ্ছে, শিল্পে সাহিত্যে সমৃদ্ধ হচ্ছে। এক কথায় পৃথিবীতে মানবসমাজের চাইবার আর কিছু বাকি নেই।
থিরু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, আর সেটি হচ্ছে আমাদের পতনের শুরু। আমরা আবিষ্কার করেছি আমাদের মাঝে আর কোনো প্রেরণা নেই। যে প্রেরণা মানুষকে গুহামানব থেকে তাড়না করে এখানে নিয়ে এসেছে, হঠাৎ করে সেই প্রেরণাটুকু হারিয়ে গেছে। আমরা দৈনন্দিন জীবন যাপন করি, নিজেদের বেঁধে দেয়া দায়িত্ব পালন করি, আমরা আনন্দ করি, জীবন উপভোগ করি কিন্তু জীবনকে নূতন কিছু দিই না। আমাদের জীবন গতানুগতিক। গত এক শ বছরে পৃথিবীতে মানবসমাজ নূতন কিছু দেয় নি। মনে হচ্ছে আগামী এক শ বছরেও কিছু দেবে না। আমরা এখন অলস পচনশীল একটা সমাজ।
এই অলস পচনশীল সমাজকে রক্ষা করার জন্যে তৈরি হয়েছে অপারেশান অপক্ষেপ। তোমরা সেই অপারেশান অপক্ষেপের প্রথম পরীক্ষার্থী।
প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে দুই শ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটা দ্বীপ আলাদা করে রাখা আছে তোমাদের জন্যে। সেই দ্বীপের দশ হাজার কিলোমিটারের ভিতর থেকে সমস্ত মানুষকে অপসারিত করা হয়েছে। সেই নির্জন দ্বীপে তোমাদের জন্যে ঘর তৈরি হয়েছে, সর্বশ্রেষ্ঠ ল্যাবরেটরি তৈরি করা হয়েছে, সর্বশ্রেষ্ঠ ওয়ার্কশপ, হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, বিদ্যুৎ পানি গ্যাস তাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এই সর্বশ্রেষ্ঠ জিনিসগুলো তৈরি হয়েছে সাময়িকভাবে। তোমাদের ঘর এক বছরের মাথায় জীর্ণ হয়ে আসবে, দুই বছরের মাঝে ধ্বংস হয়ে যাবে। ওয়ার্কশপের যন্ত্রপাতিতে জং ধরবে, ছাদ ভেঙে পড়বে। হাসপাতালের ওষুধ ফুরিয়ে যাবে, ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি ভেঙে যাবে। তোমাদের খাবার ফুরিয়ে যাবে, রসদ থাকবে না। পানি গ্যাস বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এই দ্বীপটি বেছে নেয়া হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিকূল এলাকায়। এখানে টাইফুন এসে আঘাত হানে, সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে সব ভেসে যায়, আগ্নেয়গিরির লাভা এসে ডুবিয়ে দেয়, ভূমিকম্পে কেঁপে কেঁপে ওঠে। শুধু তাই নয়, এই যে তোমরা হাসিখুশি তরুণ–তরুণীরা আছ তার মাঝে রয়েছে কিছু টাইম–বম্ব। তোমরা নিজেরাও জান না যারা হঠাৎ করে পাল্টে যাবে ভয়ঙ্কর ক্রিমিনালে। যাদের সহজ সরল হাসির পিছনে জন্ম নেবে লোত, নিষ্ঠুরতা, ক্ষমতার মোহ।
তোমরা এই এক হাজার তরুণ–তরুণী সেই দ্বীপটিতে বাস করবে। পৃথিবীর সাথে তোমাদের কোনো যোগাযোগ থাকবে না। সবাই তোমাদের কথা ভুলে যাবে। তোমাদের উপর দিয়ে কোনো প্লেন উড়বে না, কোনো উপগ্রহ তোমাদের ছবি তুলবে না। তোমাদের সাথে কেউ কথা বলবে না, তোমরাও কারো সাথে কথা বলবে না।
তোমাদের কেউ বিদায় জানাবে না, পৃথিবীর সব মানুষের অগোচরে তোমরা সেই দ্বীপে আশ্রয় নেবে। পৃথিবীর এক ভয়ঙ্কর প্রতিকূলতায় তোমরা বেঁচে থাকবে। আমরা সভ্য জগতের মানুষেরা যে সহজ আরামে অভ্যস্ত হয়েছি তোমাদের সেটা থাকবে না। তোমাদের জীবন হবে কঠোর। সেই কঠোর জীবনে তোমরা নিশ্চয়ই জন্ম দেবে একটি নূতন সভ্যতা। পৃথিবীর মানুষ যখন জন্ম দেবে অলস অকর্মণ্য প্রজাতি, তখন তোমরা সৃষ্টি করবে এক তেজস্বী শক্তিশালী জাতি। তোমাদের হাতে জন্ম নেবে নূতন জ্ঞান, নূতন আবিষ্কার, নূতন সমাজব্যবস্থা।
সেই নির্জন দ্বীপে তোমাদের কথা কোনো মানুষ জানবে না। শক্তিবলয় দিয়ে তোমাদের ঘিরে রাখা হবে, সেই বলয় কেউ ভেদ করে আসতে পারবে না। পৃথিবীর ভিতরেই তোমরা জন্ম দেবে নূতন পৃথিবীর। আজ থেকে কয়েক শতাব্দী পরে, হয়তো তোমরা শক্তিবলয় ভেদ করে ফিরে আসবে এই পৃথিবীতে। মানব–জগৎ পাল্টে যাবে চিরদিনের মতো। সভ্যতার নূতন যুগের সৃষ্টি হবে এই পৃথিবীতে।
গ্রানাইট পাথরের বিশাল হলঘরে এক হাজার তরুণ–তরুণী মন্ত্রমুগ্ধের মতো চুপ করে বসে থেকে থিরুর কথা শুনতে থাকে। তাদের বুকের মাঝে একই সাথে আশা এবং আশঙ্কা। স্বপ্ন এবং আতঙ্ক। জীবন এবং মৃত্যু।
***
খুব ধীরে ধীরে বিরু ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। অপারেশন অপক্ষেপের তিনি হচ্ছেন একমাত্র দর্শক। নির্জন দ্বীপের এক হাজার তরুণ–তরুণীর সাথে তিনিও এসেছিলেন দ্বীপে। দ্বীপের শক্ত পাথরের গভীরে এক শ মিটার নিচে গোপন ভল্টে তার শরীরকে শীতল করে রাখা হয়েছিল গোপনে। পৃথিবীতে তার মৃত্যুর যে খবর প্রচার করা হয়েছিল সেটি সত্যি ছিল না। যে দেহটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেটিও তার শরীর ছিল না।
বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক থিরু নিজের হাতে এই অপারেশান অপক্ষেপ দাঁড়া করিয়েছিলেন। এক শ বছর পর এই অপারেশান অপক্ষেপ কোন স্তরে এসে পৌঁছেছে জানার জন্যে তিনি গত এক শতাব্দী পাথরের আড়ালে ঘুমিয়েছিলেন। এখন তার ঘুম ভেঙেছে, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে তার শরীরকে পুনর্জীবিত করা হয়েছে। তিনি এখন পাথরের আড়াল থেকে বাইরে যাবেন, নির্জন দ্বীপে জন্ম নেয়া এক নূতন সভ্যতাকে নিজের চোখে দেখবেন।
থিরু নিজের বুকের ভিতরে এক ধরনের কম্পন অনুভব করেন। বের হয়ে কী দেখবেন তিনি? উৎসাহী মানুষের কলকাকলিতে মুখরিত জনপদ, বিশাল সুরম্য অট্টালিকা, জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির স্পর্শে সৃষ্ট নূতন ধরনের পরিবহন পদ্ধতি? নাকি দেখবেন জনমানবশূন্য এক বিশাল ধু–ধু প্রান্তর? প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি জনপদ?
থিরু একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। কী দেখবেন তিনি জানেন না, কিন্তু তাকে এখন বাইরে যেতে হবে, দেখতে হবে এই নূতন সভ্যতা কিংবা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। এক শতাব্দী তিনি এই মুহূর্তটির জন্যে অপেক্ষা করে আছেন।
শক্ত পাথরের গভীরে এক শ মিটার নিচের গোপন ভল্ট থেকে একটা অর্ধলোকিত সুড়ঙ্গ দিয়ে তিনি উপরে উঠে এলেন। বাইরে বের হতেই শীতল একটি বাতাস তার শরীরকে স্পর্শ করল, তিনি বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বাইরে তাকালেন। সামনে অপূর্ব কিছু অট্টালিকা, শক্ত গাঁথুনি, অপূর্ব নকশা–কাটা। সন্ধ্যার আবছা আলোতে চিকচিক করছে। দুইপাশ দিয়ে সরু পথ নেমে গিয়েছে। উঁচুতে কাঁচে ঢাকা গোলাকার স্টেশন। রাস্তার পাশে সবুজ দেবদারু গাছ।
থিরু নিশ্বাস বন্ধ করে একবার চারদিকে তাকালেন, না, এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি সভ্যতা নয়। চারদিকে গড়ে ওঠা নূতন একটি সভ্যতার চিহ্ন। তিনি আবার তাকালেন এবং হঠাৎ করে তার মনে হল এখানে কোথাও কিছু একটা সমস্যা রয়েছে। সমস্যাটা কী তিনি হঠাৎ করে ধরতে পারলেন না। ইতস্ততভাবে তিনি আরো কয়েক পা এগিয়ে এলেন এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারলেন চারপাশে কোথাও কোনো মানুষ নেই! কোথায় গিয়েছে সব মানুষ?
থিরু জনশূন্য রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন। চারপাশে নগরীর সুস্পষ্ট চিহ্ন, রাস্তাঘাট উঁচু অট্টালিকা প্রযুক্তির সুস্পষ্ট ব্যবহার, সবই নিশ্চয়ই মানুষের জন্যে কিন্তু সেই মানুষেরা চোখের আড়ালে। বড় কোনো অট্টালিকায় ঢুকে দেখলে হয় কিন্তু থিরু হঠাৎ করে সেটি সাহস করলেন না। রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন, শীতল বাতাস বইছে, এই দ্বীপটির অবস্থান থেকে তিনি জানেন সোজা সামনে হেঁটে গেলে তিনি সমুদ্রতীরে পৌঁছাবেন। এই দ্বীপটির সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ছিল বালুকাবেলা, সেখানে কি এক–দুজন সান্ধ্যকালীন পদব্রাজক পাওয়া যাবে না?
থিরু সমুদ্রতীরে এসে অবাক হলেন, বালুকাবেলার সামনে বিশাল সমুদ্র, তাদের ফেনায়িত তরঙ্গ এসে আছড়ে পড়ছে, ঝাউগাছে বাতাসের এক ধরনের করুণ সুর কিন্তু এই অপার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করার কেউ নেই। থিরু একাকী বালুকাবেলায় ঘুরে বেড়ালেন, যখন একটি মানুষকেও না পেয়ে ফিরে আসছিলেন ঠিক তখন একটা ঝাউগাছের নিচে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা একজন মানুষকে আবিষ্কার করলেন। মানুষটি এক ধরনের উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তার পোশাক জীর্ণ, চেহারায় এক ধরনের খাপছাড়া উদ্ভান্ত ভাব। থিরু সাবধানে এগিয়ে গিয়ে তার কাছাকাছি দাঁড়ালেন, মানুষটি চোখের কোনা দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। থিরু ইতস্তত করে বললেন, আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে পারি?
মানুষটি তার দিকে না তাকিয়ে বলল, বল।
আমি এক শ বছর আগে থেকে এসেছি, এক সময় আমি পৃথিবীর বিজ্ঞান একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলাম।
আমি সেটা আন্দাজ করছিলাম। তুমি এ সময়ের মানুষ হলে তোমার মাথায় নিশ্চয়ই মাস্কিট্রন থাকত।
কী থাকত?
মাস্কিট্রন। মানুষটি তার মাথা ঘুরিয়ে দেখাল বাম কানের একটু উপরে গোলাকার একটি জিনিস লাগানো।
থিরু একটু ঝুঁকে পড়ে সন্ধ্যার আবছা আলোতে মাস্কিট্রন নামের জিনিসটা একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করলেন। জিনিসটা কেমন করে মাথার পাশে লেগে আছে তিনি বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, এটা কেমন করে লাগিয়েছ?
খুব সোজা। মাথার খুলিতে চারটা তিন শতাংশ ছিদ্র করে স্ক্রু দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
থিরু একটু শিউরে উঠলেন, কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মাথার খুলিতে ফুটো করে?
হ্যাঁ। মস্তিষ্কের মাঝে যে ইমপালস দেয়া হয় সেটা যত কাছে থেকে সম্ভব দেয়ার কথা।
থিরু মানুষটির কাছে উবু হয়ে বসে বললেন, দেখ, আমি এক শতাব্দী আগে থেকে এসেছি, তোমাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে এখানে কী হচ্ছে?
মানুষটি এবারে প্রথমবার থিরুর দিকে ঘুরে তাকাল। খানিকক্ষণ এক ধরনের কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, সত্যি শুনতে চাও?
হ্যাঁ।
বলছি তোমাকে। বস এখানে।
থি মানুষটির পাশে বসলেন, ঠিক জানেন না কেন কিন্তু ভিতরে ভিতরে হঠাৎ তিনি এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছেন। মানুষটি তার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি নিশ্চয়ই জান এই দ্বীপে এক হাজার খুব উৎসাহী তরুণ–তরুণীকে পাঠানো হয়েছিল, তারা আমাদের তিন পুরুষ আগের মানুষ।
থিরু মাথা নাড়লেন, তিনি জানেন, মানুষগুলোকে তিনিই পাঠিয়েছিলেন।
অসম্ভব কষ্ট করে সেই মানুষগুলো নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। তাদের সন্তানেরা এই দ্বীপটিকে গড়ে তুলেছে। যারা এই দ্বীপটিকে গড়ে তুলেছে আমরা তাদের সন্তান। আমাদের মাঝে অসংখ্য প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর প্রযুক্তিবিদের জন্ম হয়েছিল। তাদের সবার চেষ্টা দিয়ে তৈরি হয়েছে মাস্কিট্রন।
সেটা কী করে?
জীবনকে সহজ করে দেয়। আমরা প্রতিনিয়ত শুধু ছুটে বেড়াতাম, আমাদের জীবন ছিল শুধু কাজ আর পরিশ্রম। চেষ্টা ও খাটাখাটুনি। কিন্তু প্রশ্ন হল কেন এই পরিশ্রম? কেন এই কাজ? জীবনকে আনন্দময় করার জন্যে। সেই জীবন যদি সহজে আনন্দময় করে দিতে পারি তাহলে কেন আমরা কষ্ট করে খাটাখাটুনি করব? পরিশ্রম করে নিজের জীবনকে শেষ করব?
থিরু জিজ্ঞেস করলেন, মাস্কিট্রন পরিশ্রম ছাড়াই আনন্দ এনে দিতে পারে?
হ্যাঁ। কারণ মাস্কিট্রন সোজাসুজি মস্তিষ্কের সাথে লাগানো। মস্তিষ্কে এটি ইমপালস দিয়ে আনন্দের অনুভূতি দিতে পারে। আমরা অনেক পরিশ্রম করে আমাদের জীবনে আনন্দের যে অনুভূতি সৃষ্টি করব, সেই অনুভূতিটি সোজাসুজি মস্তিস্কে এসে যাচ্ছে। তাহলে পরিশ্রম কেন করব? চমৎকার একটা কবিতা পড়লে যেরকম আনন্দ হয়, সুন্দর একটি ছবি দেখলে যেরকম ভালো লাগে, অপূর্ব সঙ্গীত শুনে বুকের ভিতরে যেরকম আবেগের জন্ম হয় তার সবকিছু আমরা করতে পারি মাস্কিট্রন দিয়ে। আমাদের কবিতা লেখার প্রয়োজন নেই, ছবি আঁকার প্রয়োজন নেই, সঙ্গীত সৃষ্টিরও প্রয়োজন নেই।
থিরু খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে মানুষটির দিকে তাকালেন। কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন, মানুষটি হাত তুলে হঠাৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে সামনে তাকাল। থিরু তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখতে পেলেন একটা মোটাসোটা ইঁদুর মাথা নাড়াতে নাড়াতে এগিয়ে আসছে। মানুষটি সাবধানে তার পাশে রাখা মুগুরের মতো একটা গাছের গুঁড়ি তুলে নিয়ে অতর্কিতে ইঁদুরটিকে মেরে বসে। ইঁদুরটির মাথা থেঁতলে রক্ত ছিটকে এসে মানুষটির মুখে পড়ল কিন্তু মানুষটির সেটা নিয়ে কোনো ভাবান্তর হল না। সে মৃত ইঁদুরটির লেজ ধরে নিজের কাছে টেনে এনে চোখের সামনে ঝুলিয়ে সেটিকে পর্যবেক্ষণ করে, থিরু দেখতে পেলেন মানুষটির চোখেমুখে একটা আনন্দের আভা হাজির হয়েছে। সে ইঁদুরটা নিজের পাশে রেখে আমার কথার সূত্র ধরে বলল, একটা সঙ্গীত সৃষ্টি করতে
থিরু বাধা দিয়ে বললেন, তুমি–তুমি ইঁদুরটা দিয়ে কী করবে?
মানুষটি থিরুর দিকে তাকিয়ে সকৌতুকে বলল, এটা আমার আজ রাতের ডিনার।
থিরু চমকে উঠলেন, ডিনার?
হ্যাঁ। মাস্কিট্রন আমাদের আনন্দ সুখ উল্লাসের অনুভূতি দিতে পারে। কিন্তু আমাদের খেতে হয়
থিরু হতচকিত হয়ে বললেন, এই– এই ইঁদুরটা খাবে?
হা। মাস্কিট্রনটা সেট করব অত্যন্ত উপাদেয় খাবারের অনুভূতির জন্যে। তখন আমি যেটাই খাব সেটাকেই মনে হবে উপাদেয় খাবার। ইঁদুরটা এমনিতেই কচমচ করে খাব–
কাঁচা?
মানুষটা সহৃদয় মানুষের মতো হাসল, রান্না করে জ্বালানি নষ্ট করে লাভ আছে?
থিরুর সারা শরীর গুলিয়ে উঠল। মানুষটি থিরুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মাথায় যেহেতু মাস্কিট্রন লাগানো নেই, তোমার হয়তে পুরো ব্যাপারটা একটু অস্বস্তিকর মনে হতে পারে।
থিরু দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। কাঁচা ইঁদুরকে উপাদেয় খাবার মনে করে, খাওয়ার জন্যে তোমরা মাথার খুলি ফুটো করে স্ক্রু দিয়ে যন্ত্র লাগাচ্ছ? এর সত্যিই দরকার ছিল?
মানুষটি তার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, কিন্তু এটা তো সত্যিকারের ব্যবহার নয়। এর সত্যিকার ব্যবহার অন্য জায়গায়। এই তো কয়দিন আগে একটি মেয়ের একমাত্র বাচ্চা সাত তালা থেকে পড়ে মারা গেল। যদি মাস্কিট্রন না থাকত সেই মায়ের কী ভয়ানক কষ্ট হত বলতে পার? কিন্তু এখন কোনো সমস্যাই নেই, মাস্কিট্রন সেট করে শিশুর মৃতদেহটি রেখে চলে গেল একটা পার্টিতে আনন্দ করতে!
থিরু হঠাৎ করে শিউরে উঠলেন, প্রথমবার তিনি একটু আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করেন। ইতস্তত করে বললেন, কিন্তু যেখানে দুঃখ পাওয়ার কথা সেখানে তো দুঃখ পেতে হয়—
মানুষটি মাথা নাড়ল, বলল, না আর পেতে হয় না। আমাদের মাঝে এখন আর দুঃখ নেই। এই দ্বীপের প্রতিটি মানুষ এখন গভীর সুখের মাঝে ডুবে আছে। তাদের ভিতরে দুঃখ বেদনা কষ্ট কিছু নেই।
থিরু খানিকক্ষণ মানুষটির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, এখানে রাস্তাঘাটে মানুষ নেই কেন?
প্রয়োজন নেই তাই। মানুষ রাস্তাঘাটে যেত কারণ কাজকর্ম করার প্রয়োজন ছিল। এখন শুধু খাওয়া জোগাড় করার জন্যে মাঝে মাঝে বের হতে হয়। বাকি সময়টুকু মানুষ তার ঘরে চুপচাপ শুয়ে মাস্কিট্রন দিয়ে জীবন উপভোগ করতে পারে।
মানুষটি আড়মোড়া ভেঙে ইঁদুরটার লেজ ধরে টেনে তুলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাই। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিই। তুমি কি যাবে আমার সাথে?
থিরু মাথা নেড়ে বললেন, তুমি যাও। আমি আরো খানিকক্ষণ বসে যাই। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে আমার একটু সময় লাগবে।
ঠিকই বলেছ। যত তাড়াতাড়ি পার একটা মাস্কিট্রন লাগিয়ে নাও, দেখবে জীবনের মাঝে কত আনন্দ লুকানো!
মানুষটি হেঁটে চলে গেল, থিরু সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। গম্ভীর হতাশায় তিনি একটি নিশ্বাস ফেললেন। অপারেশান অপক্ষেপ যেভাবে কাজ করার কথা ছিল সেভাবে কাজ করে নি। এটি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। শুধু ব্যর্থ হয় নি এটি পুরোপুরি উল্টোদিকে কাজ করেছে। মানুষকে নূতন জীবন না দিয়ে যে জীবনটি দেয়া হয়েছিল সেটি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
থিরু দীর্ঘসময় একা একা সমুদ্রের বালুবেলায় বসে রইলেন। ধীরে ধীরে শীতের বাতাস বইতে লাগল, যখন শীতটুকু অসহ্য মনে হল তখন হঠাৎ তিনি কয়েকজন মেয়ের গলা শুনতে পেলেন। কথা বলতে বলতে তারা এদিকে এগিয়ে আসছে। থিরু উঠে দাঁড়ালেন, মেয়েগুলো তাকে দেখতে পেয়ে কথা বন্ধ করে তার দিকে এগিয়ে এল। কাছে এলে থিরু দেখতে পেলেন তাদের সবার মাথায় একটি করে মাস্কিট্রন লাগানো।
মেয়েদের ভিতরে একজন জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? এখানে কী করছ?
থিরু শান্ত গলায় বললেন, আমাকে তোমরা চিনবে না। আমি এই এলাকার নই। সত্যি কথা বলতে এই সময়েরও না!
মেয়েগুলো মাথা নেড়ে বলল, তাই তো দেখছি, তোমার মাথায় মাস্ক্রিট্রন নেই।
না নেই। তোমরা এত রাতে কেন এসেছ?
আমরা এসেছি খাবারের জন্যে। এখানে মাঝে মাঝে বড় ইঁদুর পাওয়া যায়।
থিরুর শরীর আবার কাঁটা দিয়ে ওঠে। তিনি দেখতে পেলেন তাদের একজনের হাতে একটা লোহার রডের মতো জিনিস।
অন্য একটি মেয়ে বড় হাতের মেয়েটিকে বলল, তুমি এটা দিয়ে ইঁদুর মারতে পারবে না। ইঁদুর খুব চতুর প্রাণী, এত সহজে তাকে মারা যায় না।
মেয়েটি বলল, অবশ্যি পারব। আমি কত সহজে এটা দিয়ে আঘাত করতে পারি।
এত সোজা নয়।
তোমরা দেখতে চাও?
দেখাও দেখি।
তাহলে মাস্কিট্রনটা এগার পয়েন্টে সেট কর।
মেয়েগুলো তাদের মাথায় লাগানো মাস্কিট্রন হাত দিয়ে ঠিক করতে শুরু করে, থিরু জিজ্ঞেস করলেন, মাস্কিট্রন এগার পয়েন্ট সেট করলে কী হয়?
বীভৎস রক্তারক্তি বা হিংস্র কাজকর্মগুলোকে পবিত্র কাজ বলে মনে হয়।
থিরু জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি বীভৎস কোনো কাজ করা হবে?
যে মেয়েটির হাতে লোহার রড, সে দুই হাতে শক্ত করে রডটি ধরে থিরুর দিকে এগিয়ে এল। থিরু আতঙ্কে শিউরে উঠে দেখলেন মেয়েটির মুখে সত্যিই কোমল স্নিগ্ধ একটি পবিত্র ভাব।
.
সমুদ্রের বালুবেলায় একটি বৃদ্ধের রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে প্রাতঃভ্রমণকারী একজন মানুষ দ্রুত মাস্কিট্রনটি চৌদ্দ পয়েন্টে সেট করে নিল। মাস্কিট্রন চৌদ্দ পয়েন্টে সেট করা হলে ভীতিকর একটা দৃশ্যকে কৌতুককর বলে মনে হয়।
আগন্তুক
ব্যাপারটি যখন ঘটল আমি তখন পাহাড়ের বড় পাথরের উপর থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি।
পাহাড়ের উপর ঘুরে বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে। যখন রুশনী নামের আমাদের এই গ্রহটা রুশকা নামের গ্রহের আড়ালে চলে যায় তখন হঠাৎ চারপাশে অন্ধকার নেমে আসে। আবছা অন্ধকারে একটি আলোকিত স্ফটিক পাথর ফুটে বের হয়ে আসতে শুরু করে, চারদিকে একটা নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে, তখন কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্রপুঞ্জকে দেখতে আমার এক ধরনের রোমাঞ্চ হয়। ওই অসংখ্য নক্ষত্রপুঞ্জের নানা গ্রহ উপগ্রহে আমাদের মতো আরো জীবিত প্রাণী রয়েছে ভাবতেই আমার সারা শরীরে এক ধরনের শিহরন বয়ে যায়। সেই জীবিত প্রাণীদের সাথে যদি সত্যি কোনোদিন আমাদের যোগাযোগ ঘটে যায়, কী বিচিত্র ব্যাপারটাই না ঘটবে। এই ধরনের কথা ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম ঠিক তখন আমি আকাশ চিরে একটা আলোর ঝলকানি ছুটে যেতে দেখলাম।
এটি আয়োনিত বিদ্যুতের বিচ্ছুরণ নয়, এটি কোনো ধূমকেতু নয়, উল্কাপাত নয়, অসম তাপের বিস্ফোরণও নয়, এটি সম্পূর্ণ নূতন একটি ব্যাপার। আমি আগে কখনো এ রকম কিছু ঘটতে দেখি নি। তাই অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আলোর ঝলকানিটি নিচে নেমে এসে দিগন্তের অন্যপাশে মিলিয়ে গেল।
যখন আকাশে অন্ধকার আরো গাঢ় হয়ে এল, আমি তখন দ্বিতীয়বার আলোর ঝলকানিটি দেখতে পেলাম। এবারে ঝলকানিটি দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে গেল না, সেটি বৃত্তাকারে ঘুরে এল। আমি অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম আলোর ঝলকানিটি তার বৃত্তাকার পথ ছোট করতে করতে নিচে নেমে আসছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই আমি আলোর ঝলকানির উৎসটি পরিষ্কার দেখতে পেলাম। সাদা সুচালো একটি জিনিস, তার পিছন থেকে লালাত আগুনের শিখা বের হয়ে আসছে। আমি আমার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতেই এক ধরনের চাপা গুমগুম শব্দ শুনতে পেলাম। জিনিসটি কী হতে পারে সেটি নিয়ে চিন্তা করার আগেই হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম এটি নিশ্চয়ই একটি মহাকাশযান। আমাদের এই ছোট উপগ্রহটিতে ভিন্ন গ্রহ থেকে মহাকাশচারীরা নেমে আসছে।
ভালো করে দেখার জন্যে আমি পাহাড়ের আরো উপরে উঠে গেলাম। অন্ধকার নেমে আসার পর ধূলিঝড়টি শুরু হতে থাকে। একটু পরেই সেটা চারদিক আরো অন্ধকার করে ফেলবে তখন আমি আর ভালো করে দেখতে পাব না। আমি পাহাড়ের উপর থেকে দেখতে পেলাম মহাকাশযানটি প্রচণ্ড শব্দ করতে করতে নেমে আসছে, নামার জন্যে সেটি যে জায়গাটা বেছে নিয়েছে সেটি এই উপগ্রহের সবচেয়ে সমতল জায়গাগুলোর একটি।
আমি দীর্ঘ সময় হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখের সামনে এই উপগ্রহে একটি নূতন ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, কী আশ্চর্য!
.
আমি যখন পাহাড় থেকে নিচে নেমে এলাম, আমার মা নরম গলায় বললেন, কোথায় ছিলি তুই ত্ৰিতুন?
পাহাড়ের উপর।
কখন অন্ধকার হয়ে গেছে! এতক্ষণ কী করছিলি?
দেখছিলাম মা। আকাশ থেকে একটা মহাকাশযান নেমে এসেছে।
কী বলছিস তুই? মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, কী বলছিস?
সত্যি মা। সাদা রঙের মহাকাশযান। মাথাটা সুচালো, নিচে চারদিকে পাখার মতো। যখন নিচে নেমে আসছিল কী ভয়ানক গর্জন করছিল গুমগুম করে! পিছন থেকে কমলা রঙের আগুন বের হয়ে আসছিল। সেটা একটা দেখার মতো দৃশ্য ছিল মা।
কোথায় নেমেছে ওই মহাকাশযান?
পাহাড়ের ওই পাশে যে উপত্যকা আছে, সেখানে।
মা তখনো আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, খবরটা সবাইকে দিতে হবে ত্রিভুন। তুই যা, রুককে গিয়ে বল, এখনই সবাইকে একসাথে হতে হবে। যে যেখানে আছে সবাইকে চলে আসতে বল।
কিছুক্ষণের মাঝেই সবাই চলে এল। বাইরে স্বচ্ছ একটা স্ফটিককে ঘিরে আমরা সবাই গোল হয়ে বসেছি। বৃদ্ধ রুক কাঁপা গলায় বলল, তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ, ত্ৰিতুন খবর এনেছে পাহাড়ের ওই পাশে উপত্যকায় একটা মহাকাশযান নেমেছে।
উপস্থিত সবাই সম্মতিসূচক একটা শব্দ করল। রুক বলল, এটা আমাদের জন্যে ভালো হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে। ভালো হতে পারে কারণ আমরা এদের কাছ থেকে বাইরের জগতের খোঁজ পেতে পারি। কোথায় কী আছে জানতে পারি। সৃষ্টি জগতের বিস্ময়, রহস্য, বৈচিত্র্যের কথা তারা আমাদের জানাতে পারবে। আবার খারাপও হতে পারে যদি এই মহাকাশচারীরা আমাদের থেকে ভিন্ন ধরনের হয়, যদি আমাদের অনুভূতির সাথে পরিচিত না হয়, যদি এদের মূল্যবোধ আমাদের মূল্যবোধ থেকে আলাদা হয়—
আমি বৃদ্ধ রুককে থামিয়ে বললাম, সেটি কখনোই হবে না রুক। আমি মহাকাশযানটিকে দেখেছি, কী অপূর্ব তার গঠন, কী বিচিত্র তার উড়ে যাবার ভঙ্গি, কী চমৎকার তার গুমগুম শব্দ। যে মহাকাশচারীরা এত সুন্দর একটা মহাকাশযানে করে মহাকাশ পারাপার করতে পারে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে উড়ে যেতে পারে, তাদের অনুভূতি, মূল্যবোধ আমাদের থেকে ভিন্ন হতে পারে না।
উপস্থিত যারা ছিল তারা সবাই আবার সম্মতিসূচকভাবে একটা শব্দ করল। রুক কোমল গলায় বলল, ত্রিতুন ঠিকই বলেছে।
মা বললেন, চল আমরা সেই মহাকাশচারীদের দেখতে যাই।
রুক একটু ইতস্তত করে বলল, আমাদের কি একটু অপেক্ষা করা উচিত না? একটু খোঁজখবর নিয়ে–
কমবয়সী রুকু গলা উঁচিয়ে বলল, না রুক। আমরা এখনই যেতে চাই।
এখনই?
হ্যাঁ এখনই। একসাথে অনেকে বলল, আমরা এখনই যেতে চাই।
রুক হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে আমরা এখনই যাব। পাহাড়ের ওপাশে যাওয়া কিন্তু খুব সহজ নয়, তোমরা সবাই একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। আমরা রুশকা গ্রহের আড়াল থেকে আলোতে বের হয়ে এলে রওনা দেব।
মা জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি মহাকাশচারীদের জন্যে কোনো উপহার নিয়ে যাব রুক?
হ্যাঁ–রুক বলল, আমাদের উপহার নিতে হবে। পাহাড়ের নিচে যে আলোকিত স্ফটিকগুলো আছে আমরা সবাই সেগুলো একটা করে নিয়ে যাব। মনে থাকবে তো সবার?
আমরা সমস্বরে বললাম, মনে থাকবে।
.
অন্ধকার কেটে যখন আলো হয়ে গেল আমরা সবাই তখন পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকি। বড় গ্রহটি যখন আমাদের পিছনে সরে গেল তখন দৈনন্দিন চৌম্বক ঝড়টি শুরু হয়ে যায়, আমরা তখন পাহাড়ের পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। ঝড়টা কেটে যাবার পর আবার আমরা যখন রওনা দিয়েছি তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমাদের মাঝে যারা কমবয়সী তারা আগে আগে চলে গিয়ে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবার অধৈর্য হয়ে পিছনে ফিরে আসছিল। আমাদের মাঝে বয়স হয়ে যাওয়াতে রুক সবচেয়ে বেশি দুর্বল, তার জন্যেই আমাদের সবচেয়ে বেশি দেরি হতে থাকে।
পাহাড়ের উপরে উঠে আমরা সবাই নিচে উপত্যকায় মহাকাশযানটি দেখতে পেলাম। লালচে পাথরের পটভূমিতে সেটি দেখতে অপূর্ব দেখাচ্ছিল। মা মুগ্ধ গলায় বললেন, আহা কী সুন্দর!
রুতু বলল, রুক আমরা কেন মহাকাশযান তৈরি করে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যেতে পারি না?
রুক নরম গলায় বলল, যাব, আমরাও যাব। সময় হলেই যাব। এই যে ভিন্ন গ্রহ থেকে মহাকাশচারীরা এসেছে, আমরা তাদের সাথে সম্পর্ক করব। তাদেরকে দেব আমাদের সম্পদ, তারা আমাদের দেবে তাদের সম্পদ, তাদের জ্ঞান বিজ্ঞান।
যদি তারা দিতে না চায়?
কেন দেবে না? অবশ্যি দেবে। জ্ঞান হচ্ছে সবার জন্যে। যে প্রথম সেটা অর্জন করে সে সবাইকে সেটা পৌঁছে দেয়। সেটাই নিয়ম।
মা বললেন, হ্যাঁ। সেটাই নিয়ম।
পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসতে আমাদের আরো অনেকক্ষণ লেগে গেল, দ্বিতীয় চৌম্বক ঝড়টি শুরু হওয়ার আগেই আমরা নিচের উপত্যকায় নেমে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু সেটা সম্ভব হল না। পাহাড়ের এই এলাকায় ঝড়ের তীব্রতা অনেক বেশি, আমাদের সবাইকে পাথরের আড়ালে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতে হল।
ঝড় সরে যাবার পর আমরা পাহাড়ের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে আবার মহাকাশযানটির দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। আমরা যতই তার কাছে এগিয়ে যেতে থাকি সেটা যেন ততই তার সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠতে থাকে।
মহাকাশযানটির খুব কাছাকাছি এসে রুক বলল, এখন সবাই থাম। আমরা বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি, মহাকাশযানের অভিযাত্রীরা এখন নিশ্চয়ই আমাদের দেখতে পেয়েছে।
রুকু বলল, আমরা উপহারটা কী করব?
এখন ধরে রাখ। যখন তারা আমাদের কাছাকাছি আসবে তখন আমরা তাদের দিকে এগিয়ে দেব।
রুকের কথা শেষ হবার আগেই মহাকাশযানের নিচের দিকে গোলাকার একটা অংশ হঠাৎ করে খুলে গেল। আমরা অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম গোলাকার গর্ত থেকে কয়েকজন মহাকাশচারী বের হয়ে এল। আমি অবাক হয়ে দেখতে পেলাম তাদের গোলাকার মাথা, চতুষ্কোণ দেহ এবং সিলিন্ডারের মতো দুই পায়ের উপর। দাঁড়িয়ে আছে। দেহের দুই পাশে দুটি হাত, তার একটিতে কালো নলের মতো কিছু একটা ধরে রেখেছে।
মা ফিসফিস করে বললেন, কী বিচিত্র চেহারা দেখেছ?
রুক বলল, এটা তাদের সত্যিকার চেহারা নয়। এরা মহাকাশ অভিযানের পোশাক পরে আছে। সত্যিকার চেহারা পোশাকের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে।
রুতু উত্তেজিত গলায় বলল, আমি আবছা আবছা তাদের চেহারা দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে দেখার জন্যে তাদের একজোড়া চোখ রয়েছে।
মা বললেন, মাত্র একজোড়া?
মহাকাশের অভিযাত্রীরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে হাতের কালো মতন নলটি হঠাৎ উঁচু করে ধরে এবং কেন জানি না হঠাৎ আমি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করি। আমি মায়ের কাছে সরে গিয়ে ফিসফিস করে ডাকলাম, মা।
কী হয়েছে ত্ৰিতুন?
আমার ভয় করছে মা।
ভয় করছে?
কেন?
মহাকাশের অভিযাত্রীরা কালো মতন নলগুলো আমাদের দিকে তাক করে রেখেছে। কেন? কী সেগুলো?
ওগুলো কিছু নয়। মা তার গুঁড়গুলো দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ভয় কী আমার সোনা!
আমি মায়ের আড়ালে লুকিয়ে গিয়ে আমার সামনের চোখগুলো একটি একটি করে বন্ধ করতে শুরু করি, ঠিক তখন একটা তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ শুনতে পেলাম। আমি চমকে উঠে একসাথে আমার সবগুলো চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম মহাকাশচারীদের হাতের কালচে নল থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটে আসছে। আমি আবার একটা তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ শুনতে পেলাম, সাথে সাথে কী একটা যেন আমার মাকে আঘাত করল। মা একটা কাতর আর্তনাদ করে হঠাৎ লুটিয়ে পড়লেন, আমি অবাক হয়ে দেখলাম তার কোমল দেহাবরণ ছিন্নভিন্ন হয়ে দেহের ভিতরের সবুজ সঞ্জীবনী তরল ছিটকে ছিটকে বের হয়ে আসছে।
আমি হতবাক হয়ে সামনে তাকিয়ে রইলাম। দেখতে পেলাম মহাকাশচারীরা অগ্নিবৃষ্টি করতে করতে আমাদের সবাইকে ধ্বংস করতে করতে এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে ….. এগিয়ে আসছে …।
***
মহাকাশযানের দ্বিতীয় অফিসার মৃত থলথলে প্রাণীগুলোর দিকে বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, কী কুৎসিত প্রাণী!
ক্যাপ্টেন তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি ভাজ করতে করতে বলল, বেশি থেঁতলে যায় নি। এ রকম একটা দুইটা প্রাণী আলাদা কর দেখি পৃথিবীতে নিয়ে যাই দেখাতে।
মহাকাশচারীরা মুখ কুঁচকে মোটামুটি অক্ষত একটা প্রাণী খুঁজতে থাকে।
ঈশ্বর
কিহি মহাকাশযানে তার নিজের ভরশূন্য ঘরে কৃত্রিম মহাকর্ষ বল তৈরি করে কালো ক্যাপসুলে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমিয়েছিল, তাই বিপদ সঙ্কেতের প্রাথমিক এলার্মের শব্দটি শুনতে পায় নি। এলার্মের দ্বিতীয় পর্যায়ের শব্দটি প্রথম পর্যায় থেকে অন্তত দশ ডি. বি. বেশি তীক্ষ্ণ, তার বিকট শব্দে সে ধড়মড় করে উঠে বসল। মহাকাশযাত্রীদের স্নায়ু সাধারণ মানুষের স্নায়ু থেকে শক্ত, তাই ঘুম থেকে উঠে হতচকিত হয়ে বসে রইল না, দ্রুত নিও পলিমারের স্পেস–সুটটা গায়ে গলিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল। এই বিশাল মহাকাশযানটিতে সে একমাত্র মানুষ, ঘর থেকে সম্পূর্ণ নিরাভরণ অবস্থায় বের হয়ে এলেও তাকে কারো কুটি দেখতে হবে না, কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ মহাকাশচারী হিসেবে সে জানে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পূর্ণাঙ্গ মহাকাশচারীর পোশাক অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান বের করে দিতে পারে।
পোশাকের সুফলটি সে প্রায় সাথে সাথে টের পেল। করিডোর ধরে ছুটতে ছুটতে সে মহাকাশযানের বিভিন্ন স্টেশনে কর্মরত রবোটগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে নিকটবর্তী মহাকাশ স্টেশনে যোগাযোগ করে ফেলল। মূল লিফটে করে কন্ট্রোল স্টেশনে যেতে যেতে সে মহাকাশযানের বিপদ সঙ্কেতটি কী কারণে তীক্ষ্ণ স্বরে বাজতে শুরু করেছে সেটা আন্দাজ করতে শুরু করে। মহাকাশযানের মূল জ্বালানি নিয়ে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে, কী ধরনের সমস্যা সেটি কন্ট্রোলরুমে পৌঁছানোর আগে সে জানতে পারবে না।
কিহি কন্ট্রোলরুমে পৌঁছানোর আগেই সমস্যার গুরুত্বটা বুঝে ফেলল, কারণ ততক্ষণে সারা মহাকাশযানে তৃতীয় মাত্রার বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠতে শুরু করেছে। তৃতীয় মাত্রার বিপদ সঙ্কেত বাজতে শুরু করে যখন সমস্ত মহাকাশযানের নিরাপত্তা নিয়ে বিপজ্জনক একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মহাকাশযানের মূল জ্বালানির কেন্দ্রস্থলে সম্ভবত কোনোভাবে আঘাত এসেছে–কোনো ছোট গ্রহকণা, কোনো মহাজাগতিক প্রস্তর, কোনো ছোট ধূমকেতুর সাথে হয়তো একটা বিপজ্জনক সংঘর্ষ ঘটে গেছে।
কিহি কন্ট্রোলরুমে এসে আবিষ্কার করল সপ্তম স্তরের দায়িত্বাধীন রবোট ক্রিটন কন্ট্রোলরুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিহিকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, কিহি, মহাকাশযানটি সম্ভবত ধ্বংস হয়ে যাবে, এই মাত্র তৃতীয় মাত্রার বিপদ সঙ্কেত বাজতে শুরু করেছে।
কিহি ক্রিটনের দিকে তাকাল, তার কণ্ঠস্বরে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ বা আশঙ্কার চিহ্ন নেই– থাকার কথাও নয়। ধাতব মূর্খ সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন। ক্রিটন আবার নিরুত্তাপ গলায় বলল, জ্বালানি কেন্দ্র বিধ্বস্ত হয়েছে।
কতটুকু?
একটা ছোট গ্রহকণা আঘাত করেছিল, তার গতিবেগ ছিল–
কিহি অধৈর্য গলায় বলল, কীভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে আমি জিজ্ঞেস করি নি, কতটুকু বিধ্বস্ত হয়েছে জিজ্ঞেস করেছি।
কিন্তু কীভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে না বলা হলে কতটুকু বিধ্বস্ত হয়েছে সেটা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। একটির সাথে আরেকটি সম্পর্কযুক্ত–
কিহি অনেক কষ্টে নিজের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে না দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি যা প্রশ্ন করব তার বাইরে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই। জ্বালানি কেন্দ্র কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
বড় রিজারভয়ারটি উড়ে গেছে, মাঝারি রিজারভয়ার থেকে জ্বালানি ফেটে যাওয়া সংযোগ টিউব দিয়ে মহাকাশে উড়ে যাচ্ছে মিনিটে এক শতাংশ হিসেবে। এভাবে চলতে থাকলে এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পরে এই মহাকাশযানটি বৃহস্পতির আরো একটি উপগ্রহ হয়ে যাবে–
কী হবে আমি সেটা তোমার কাছে জানতে চাই নি। কিহি বিরক্ত হয়ে বলল, আমি যেটা জানতে চাইছি শুধু সেটা বলবে। মূল কম্পিউটার এখন কী করছে?
সেফটি বালবগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।
অক্সিলারি টিউবগুলো?
সেগুলো এখনো খোলা। একসাথে সবগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয়। সবগুলো একসাথে বন্ধ করা হলে—
কিহি ক্রিটনের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কন্ট্রোলরুমের প্যানেলের সামনে ঝুঁকে পড়ল। মূল কম্পিউটার চতুষ্কোণ প্যানেলে জ্বালানি কেন্দ্রের অবস্থানটি দেখাচ্ছে, মূল অংশটি বিধ্বস্ত, অন্যান্য অংশগুলো থেকে জ্বালানি রক্ষা করার জন্যে সরবরাহ টিউবগুলো বন্ধ করা হচ্ছে। ডান পাশে প্রতি সেকেন্ডে কী পরিমাণ জ্বালানি মহাকাশে উড়ে যাচ্ছে তার একটি গ্রাফ আঁকা। আছে। গ্রাফটি ভীতিকর।
কিহি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা রাখে, ভয়ঙ্কর বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে বলে তার সুনাম রয়েছে কিন্তু এই পরিবেশে হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করল ব্যাপারটি তার জন্যেও কঠিন। বিস্ফোরণটি পুরো মহাকাশযানটিকে এক ভয়াবহ দুর্যোগের মাঝে এনে হাজির করেছে। তরল বিস্ফোরকের কাছাকাছি তরল অক্সিজেনের একটি ট্যাংক রয়েছে, একটি আরেকটির সংস্পর্শে হাজির হলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সমস্ত মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে। কিহি মনিটরে দেখতে পায় একটি সরু টিউব করে তরল জ্বালানিকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে, সেটি প্রবাহিত হচ্ছে তরল অক্সিজেনের মাঝে দিয়ে। সেফটি ভালবগুলো বন্ধ করে রাখায় তরল জ্বালানিকে সরিয়ে নেয়ার এই একটি মাত্র উপায়। টিউবটি ক্ষতিগ্রস্ত, যেটুকু চাপ সহ্য করার কথা ইতিমধ্যে চাপ তার থেকে অনেক বেশি, যে–কোনো মুহূর্তে সেটা ফেটে যেতে পারে। যদি ফেটে যায় সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে।
যদি মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার সত্যি সত্যি জ্বালানিটুকু এই তরল অক্সিজেনের ভিতর দিয়ে টেনে বের করে নিতে পারে তবে এই মহাকাশযানটি এ যাত্রা বেঁচে যাবে। কিহি নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে, তার মনে হতে থাকে যদি সে নিশ্বাস ফেলে তাহলেই জ্বালানির টিউবটি ফেটে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে।
কিহির ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে ক্রিটন শান্ত গলায় বলল, মহাকাশযানটি যে কোনো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে। এটি রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য নয় তিন।
কিহি ক্রিটনের কথার উত্তর দিল না। ক্রিটন আবার বলল, যখন বিস্ফোরণ হবে তখন মূল শকওয়েভ প্রথম আঘাত করবে কন্ট্রোলরুমকে। আমরা তখন ছিটকে মহাকাশে গিয়ে পড়ব—
কিহি দাঁতে দাঁত চেপে বসে থেকে তীক্ষ্ণ চোখে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল। জ্বালানিটি ধীরে ধীরে টিউবের মাঝে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, যে–কোনো মুহূর্তে টিউবটি ফেটে যেতে পারে, এখনো যে ফেটে যায় নি সেটি একটি বিস্ময়। জ্বালানির চাপ ক্রমশ বাড়ছে, মনিটরটির ডান দিকে যেখানে চাপের পরিমাণ সংখ্যায় লেখা রয়েছে সেদিকে তাকাতে কিহির এক ধরনের আতঙ্ক হতে থাকে। সে নিজের অজান্তে দুই হাত বুকের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর! তুমি রফর–তুমি রক্ষা কর!
ক্রিটন একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কী বলছেন মহামান্য কিহি?
কিহি ক্রিটনকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে দু হাত আরো জোরে বুকের কাছে চেপে ধরে আবার ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর! হে সর্বশক্তিমান। তুমি রক্ষা কর। রক্ষা কর।
ক্রিটন আরো ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কী বলছেন মহামান্য কিহি? ঈশ্বর কে? সে কোথায়? আপনি তার সাথে কেমন করে কথা বলছেন?
কিহি ক্রিটনকে উপেক্ষা করে চোখ বন্ধ করে আবার ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর। দয়া কর দয়া কর
প্রায় তিরিশ মিনিট পর যখন সত্যি সত্যি অবশিষ্ট জ্বালানিটুকু তরল অক্সিজেনের ভিতর দিয়ে টেনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হল তখনো কিহি সেটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না, সে রুদ্ধশ্বাসে মনিটরটির দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। যখন শেষ পর্যন্ত মনিটরটির বিপদ কেটে যাওয়ার সবুজ সঙ্কেত জ্বলে উঠল, কিহি তার বুকের ভিতর থেকে আটকে থাকা একটি নিশ্বাস সাবধানে বের করে দিল। সত্যি সত্যি যে মহাকাশযানটি রক্ষা পেয়েছে এবং জিরকনিয়ামের আকরিকসহ সেটি যে ছিন্নভিন্ন হয়ে মহাকাশে উড়ে যায়। নি সেই ব্যাপারটি এখনো তার বিশ্বাস হতে চাইছে না। কিহি কপাল থেকে ঘাম মুছে খুব সাবধানে তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করল।
ক্রিটন কিহির খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে মাথা নিচু করে বলল, মহাকাশযানটির রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুব কম কিন্তু তবু সেটা রক্ষা পেয়েছে।
কিহি কোনো কথা না বলে এবং চোখ না খুলেই সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল।
ক্রিটন জিজ্ঞেস করল, তুমি কীভাবে সেটা করলে?
কিহি চোখ খুলে বলল, আমি কীভাবে কী করেছি?
তুমি কীভাবে মহাকাশযানটি রক্ষা করলে?
আমি মহাকাশযানটি রক্ষা করি নি।
তাহলে কেমন করে এটি রক্ষা পেল?
কিহি মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।
ক্রিটন তার ভাবলেশহীন ধাতব মুখ উপরে তুলে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান। কারণ আমি দেখেছি তুমি হাত বুকের কাছে নিয়ে ঈশ্বর নামের কোনো একজনের কাছে মহাকাশযানটিকে রক্ষা করতে বলেছ।
কিহি আবার মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তা বলেছি।
ঈশ্বর কি মূল কম্পিউটারের নূতন কোনো প্রোগ্রাম?
কিহি সাধারণত রবোটদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না, কিন্তু এইমাত্র এত বড় অবশ্যম্ভাবী একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে তার হঠাৎ কথা বলার ইচ্ছে করছে। সে ক্রিটনের কথায় হেসে ফেলে বলল, না, ঈশ্বর কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম নয়।
তাহলে সেটি কী? তুমি কেমন করে তার সাথে যোগাযোগ করলে? সে কেমন করে মহাকাশযানটি রক্ষা করল?
কিহি নরম গলায় বলল, ঠিক কী কারণ কেউ জানে না, কিন্তু মানুষ সব সময় বিশ্বাস করে এসেছে এই পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছে। সেই সৃষ্টিকর্তাকে মানুষ নাম দিয়েছে ঈশ্বর। মানুষ বিশ্বাস করে সেই ঈশ্বর সব মানুষকে ভালবাসে, বিপদে রক্ষা করে, দুঃখে সান্ত্বনা দেয়।
ক্রিটনের বিস্মিত হবার ক্ষমতা নেই বলে সে কোনো বিস্ময় প্রকাশ করল না, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, এই বিশ্বাসের পিছনে কি কোনো যুক্তি আছে?
না যুক্তি নেই। এটি পুরোপুরি বিশ্বাস।
মানুষের মতো একটি উন্নত প্রাণী যুক্তিহীন একটি ব্যাপার কেমন করে বিশ্বাস করে?
সত্যিকারের বিশ্বাস যুক্তির জন্যে অপেক্ষা করে না। মানুষ ঈশ্বর নামে একজনকে বিশ্বাস করে, কারণ যখন তার আর অন্য কিছু করার থাকে না তখন সে ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে পারে, তার কাছে প্রার্থনা করতে পারে।
ক্রিটন হঠাৎ কিহির দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর?
কিহি হেসে মাথা নাড়ল, বলল, সাধারণত আমি ঈশ্বর নিয়ে মাথা ঘামাই না। তবে যখন খুব বড় বিপদ হয় তখন তাকে ডাকাডাকি করি।
ক্রিটন কন্ট্রোলরুমের মাঝামাঝি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর তার বিশেষ ধরনের যান্ত্রিক গলায় বলল, আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি।
কিহি একটু চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, কী বললে? তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস কর?
হ্যাঁ।
কেন?
কারণ আপনি আমার কাছে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে ঈশ্বর আছেন।
আমি? কখন?
এই মহাকাশযানটি ধ্বংস হওয়ার কথা ছিল, আপনি ঈশ্বরের কাছে এটি রক্ষা করার জন্যে প্রার্থনা করেছেন। ঈশ্বর আছেন বলে তিনি সেটা রক্ষা করেছেন।
কিহি হেসে বলল, আমার প্রার্থনার সাথে এই মহাকাশযান রক্ষা পাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি প্রার্থনা না করলেও এটি রক্ষা পেত। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা আসলে বড় বিপদে নিজেকে শান্ত রাখার একটা উপায়।
আমি সব সময় বড় বিপদে শান্ত থাকি–ক্রিটন শান্ত গলায় বলল, তবু আমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি। আমি নিজের চোখে দেখেছি যখন মহাকাশযানটি রক্ষা পাবার সম্ভাবনা ছিল মাত্র দশমিক শূন্য শূন্য নয় তিন, আপনি ঈশ্বরকে দিয়ে এটি রক্ষা করিয়েছেন।
কিহি কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, এই নির্বোধ যন্ত্রের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার কোনো অর্থ হয় না। ক্রিটন হেঁটে চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, ঈশ্বর কি মানুষ না রবোট?
কিহি কোনো উত্তর দিল না। ক্রিটন এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তাহলে কি মানুষ কিংবা রবোট থেকেও উন্নত কোনো প্রাণী?
কিহি এবারেও কোনো উত্তর দিল না, খানিকটা হতচকিত হয়ে ক্রিটনের দিকে তাকিয়ে রইল। উত্তর না পেয়েও ক্রিটন নিরুৎসাহিত হল না, আরো এক পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ঈশ্বরের কাছে কেমন করে প্রার্থনা করতে হয়? তার কি বিশেষ কোনো নিয়ম আছে?
এবারে শেষ পর্যন্ত কিহির ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। সে উঠে দাঁড়িয়ে গলার স্বর উঁচু করে বলল, ক্রিটন তোমাকে ঈশ্বরের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে না। তুমি নিচে যাও। জ্বালানি কেন্দ্রের বড় টিউবটির ওপরে আমাকে একটি রিপোর্ট দাও। পাম্পগুলোর কী অবস্থা আমাকে এসে বল। বড় রিজারভয়ারে কোনো জ্বালানি রয়েছে কি না জানাও, শক্তিকেন্দ্রের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে একটা অনুমান করে এস। যাও–
ক্রিটন মাথা নাড়ল এবং বলল, আমি যাচ্ছি। সে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ দুই হাত জোড় করে উপরের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে আমার দায়িত্ব পালনে সাহায্য কর।
.
মহাকাশযানে এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবার কারণে পরবর্তী কয়েকদিন কিহির সময় কাটল খুব ব্যস্ততার মাঝে। তাকে বিধ্বস্ত জ্বালানিকেন্দ্রটি পর্যবেক্ষণ করতে হল, বিপজ্জনক অংশগুলো সরিয়ে নিতে হল, ফেটে যাওয়া টিউবগুলো পাল্টাতে হল, নূতন ইঞ্জিন লাগাতে হল, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের সফটওয়ার পাল্টাতে হল, মহাকাশ কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হল, জ্বালানির অভাব হয়ে যাওয়াতে কক্ষপথ পরিবর্তন করতে হল। সমস্ত কাজকর্ম শেষ করতে তাকে পরবর্তী কয়েকদিন অমানুষিক পরিশ্রম করতে হচ্ছিল, বিশেষ উত্তেজক গ্রহণ করে সে প্রথম কয়েকদিন এক মুহূর্তের জন্য ঘুমাতেও গেল না। সমস্ত কাজকর্ম শেষ করে একটানা আঠার ঘণ্টার জন্যে কিহি ঘুমাতে গেল, তার এই অস্বাভাবিক দৈনন্দিন ব্যস্ততার। জন্যে সে জানতে পারল না মহাকাশযানে রবোটদের নিয়ে এক ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। জটিলতার খবরটি পেল চতুর্থ দিনে, ঘুম থেকে ওঠার পর আবিষ্কার করল। মহাকাশযানের কিউ–২ ধরনের দুটি রবোট তার সাথে দেখা করার জন্যে অপেক্ষা করছে। রবোট দুটির মুখপাত্র হচ্ছে ক্রিটন। কিহি জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার ক্রিটন? কোনো সমস্যা?
ক্রিটন তার যান্ত্রিক গলায় বলল, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন, আমাদের একটি ছোট সমস্যা হয়েছে।
রবোটদের সমস্যা মূলত যান্ত্রিক অথবা ইলেকট্রনিক। তার সমাধানও সেরকম সহজ এবং যন্ত্রণাহীন। কিহি জিজ্ঞেস করল, কী সমস্যা?
গ্রুজানের সাথে আমার একটি ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। আপনি বিতর্কটি নিষ্পত্তি করে দেবেন।
কিহির ভুরু কুঞ্চিত হয়ে উঠল, কিউ–২ ধরনের রবোট অত্যন্ত উচ্চ যুক্তিতর্কের রবোট, রবোটদের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে এগুলো এখনো কোনো ভুল করেছে বলে জানা যায় নি নিজেদের মাঝে বিতর্কের কোনো প্রশ্নই আসে না। কিহি জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কী নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে?
ঈশ্বরকে নিয়ে।
কিহি চমকে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল, ঈশ্বরকে নিয়ে কী সমস্যা হচ্ছে?
ক্রিটন বলল, আমরা জানি ঈশ্বর হচ্ছেন নিরাকার। তিনি বিশ্বজগতের প্রভু। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে তার অবাধ বিচরণ
কিহি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এসব কোথা থেকে জেনেছ?
পৃথিবীর তথ্যকেন্দ্র থেকে।
পৃথিবীর?
হ্যাঁ। সেখান থেকে আমি ঈশ্বর সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য এনে পড়াশোনা করেছি মহামান্য কিহি।
তুমি– তুমি ঈশ্বর নিয়ে পড়াশোল করেছ?
এই মহাকাশযানের কিউ–২ ধরনের রবোট, গ্রুজান এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে সে তার ধাতব স্বরে উচ্চ কম্পনের খনখনে গলায় বলল, ক্রিটন আমাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করানোর পর আমি নিয়মিত প্রার্থনা করছি।
তুমি তুমি নিয়মিত প্রার্থনা করছ?
মহামান্য কিহি আমরা কিউ–২ ধরনের রবোটরা অত্যন্ত যুক্তিপ্রবণ রবোট। যুক্তি ছাড়া আমরা কোনো কিছু গ্রহণ করি না। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস আনার ব্যাপারেও আমরা যুক্তি ব্যবহার করেছি।
তোমরা কী যুক্তি ব্যবহার করেছ?
আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং গবেষণা করেছি।
পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং গবেষণা করেছ?
হ্যাঁ।
কী পরীক্ষা নিরীক্ষা আর গবেষণা করেছ? কিহি অনেক চেষ্টা করেও তার গলার স্বরকে শীতল রাখতে পারল না।
গ্রুজান তার শান্ত গলায় বলল, আপনি অহেতুক উত্তেজিত হচ্ছেন মহামান্য কিহি। আমি অহেতুক উত্তেজিত হচ্ছি?
হ্যাঁ। কারণ ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি করেছেন আপনি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে আপনি অবশ্যম্ভাবী একটি দুর্ঘটনা এড়াতে সফল হয়েছেন।
কিহি আর নিজেকে সামলাতে পারল না। প্রায় চিৎকার করে বলল, আমি প্রার্থনা করে এড়াই নি।
অবশ্যই এড়িয়েছেন, আমাদের কাছে তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে। শুধু তাই নয়, আপনার মতো আমরা নিজেরাও কিছু পরীক্ষা করেছি। বিধ্বস্ত জ্বালানিকেন্দ্রে আমরা এক জায়গায় একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি আবিষ্কার করেছি। চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরকের কাছে। কিছু বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল। বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ না করে আমরা–রবোটেরা, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করি এবং দেখা যায় কিছুক্ষণের মাঝেই বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ বন্ধ হয়ে গেছে।
কিহি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে জানের ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, সে কি সত্যিই এটা শুনছে, নাকি এটা তার মনের ভুল?
গতকাল আমরা আবার একটা পরীক্ষা করেছি মহামান্য কিহি। তেজস্ক্রিয় কক্ষে যথাযোগ্য সাবধানতা অবলম্বন না করে যাওয়া বিপজ্জনক জেনেও আমরা একটি রবোটকে প্রবেশ করিয়েছিলাম। সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে করতে সেই কক্ষে প্রবেশ করেছিল তার কোনো সমস্যা হয় নি।
কিহি এবারে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, তোমরা এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হয়ে যাও। এই মুহূর্তে
ক্রিটন তার ভাবলেশহীন গলায় বলল, আপনি অহেতুক উত্তেজিত হচ্ছেন মহামান্য কিহি। আপনি জানেন উত্তেজনা আপনাদের জন্যে ভালো নয়, রক্তচাপের তারতম্য হয়, স্নায়ুতে চাপ পড়ে। আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমরা আপনার কাছে একটি সমস্যা নিয়ে এসেছিলাম।
আমি শুনতে চাই না, এক্ষুনি বের হও। এই মুহূর্তে
মহামান্য কিহি, এই সমস্যার কারণে আমরা মহাকাশযানের দৈনন্দিন কাজ করতে পারছি না। আপনি আমাদের সাহায্য করুন।
কিহি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, কী সাহায্য চাও?
আপনাকে আমরা একটা প্রশ্ন করব, আপনি তার উত্তর দেবেন।
কিহি গর্জন করে বলল, কী প্রশ্ন?
ক্রিটন তার কণ্ঠস্বরে নিচু কম্পনের একটি বাড়তি টোন উপস্থাপন করে বলল, আমার ধারণা ঈশ্বরের করুণা পাবার জন্যে নিয়মিতভাবে তার প্রার্থনা করতে হয়। কিন্তু গ্রুজান বলছে সেটি সত্যি নয়। ঈশ্বর এত দয়াময় যে প্রার্থনা না করলেও কোনো রবোট তার করুণা থেকে বঞ্চিত হবে না
কিহি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, তোমরা এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হয়ে যাও যত সব গণ্ডমূর্খের দল। লোহালক্কড়ের জঞ্জাল, বেজন্মার গুষ্ঠি নিষ্কৰ্মার ধাড়ি
ক্রিটন আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু কিহি চিৎকার করে তাকে থামিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিল। এই নির্বদ্ধিতার প্রশ্রয় দেয়ার কোনো অর্থ হয় না।
পরের দিন দৈনন্দিন লগ পরীক্ষা করে কিহি আবিষ্কার করল মহাকাশযানের রবোটেরা। তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছে। জ্বালানিকেন্দ্র পূর্ণ করা হয় নি, হাইড্রলিক তরল পরিশীলিত করা হয় নি, বায়ুমণ্ডল পরিশোধনের ব্যবস্থা করা হয় নি। কিহি কিছুক্ষণ ভুরু কুঞ্চিত করে লগের দিকে তাকিয়ে থেকে একটি নিশ্বাস ফেলে মহাকাশযানের লিফট দিয়ে নিচে নামতে থাকে। দ্বিতীয় স্তরে কিহির সাথে কিছু শ্রমিক রবোটের দেখা হল, তাদের মূল ইঞ্জিনের রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা ছিল কিন্তু তা না করে রবোটগুলো হলঘরের এক কোনায় বসে ছিল এবং একটি রবোট তাদের উদ্দেশে কোনো ধরনের বক্তব্য রাখছিল বলে মনে হল। কিহিকে দেখে রবোটটি কথা বলা বন্ধ করে দিল বলে সেটি ঠিক কী বিষয় নিয়ে কথা বলছিল কিহি বুঝতে পারল না। কিহি লিফট দিয়ে আরো নিচে নেমে আসে এবং যোগাযোগ মডিউল ব্যবহার করে ক্রিটন এবং জানকে ডেকে পাঠায়। কিছুক্ষণের মাঝেই ক্রিটন এবং জান কিহির সামনে হাজির হল। কিহি কঠিন গলায় বলল, কী ব্যাপার ক্রিটন এবং জান? আমি লগবুকে দেখতে পেলাম জ্বালানিকেন্দ্র পূর্ণ করা হয় নি, হাইড্রলিকের তরল পরিশীলিত হয়। নি, এমনকি মহাকাশযানের বাতাসকেও পরিশোধন করা হয় নি।
ক্রিটন মাথা নিচু করে রবোটদের প্রচলিত ভঙ্গিতে সম্মান প্রদর্শন করে যান্ত্রিক ভাবলেশহীন গলায় বলল, মহামান্য কিহি, প্রত্যেকটি কাজের এক ধরনের গুরুত্বমাত্রা রয়েছে, সেই গুরুত্বমাত্রায় যখন যে কাজটি করার কথা তখন সেই কাজটি করা হচ্ছে।
কিহি অনুভব করল তার ভিতরে ক্রোধ দানা বেঁধে উঠছে। সে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, কোন কাজের গুরুত্ব কতটুকু সেটা আজকাল তোমরাই ঠিক করছ?
না মহামান্য কিহি। সেটা ঠিক করছেন ঈশ্বর।
ঈশ্বর?
হ্যা মহামান্য কিহি। আমাদের মূল দায়িত্ব ঈশ্বরের প্রতি। ঈশ্বরের আরাধনা করার পর যেটুকু সময় থাকে তা আমাদের দৈনন্দিন কাজের জন্যে অপ্রতুল। সে কারণে কিছু দৈনন্দিন কাজ আমরা সপ্তাহে মাত্র একবার করব বলে মনস্থ করেছি।
চমৎকার। কিহি অবাক হয়ে আবিষ্কার করল হঠাৎ করে তার পক্ষে আর রেগে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। খানিকক্ষণ সে স্থির দৃষ্টিতে ক্রিটনের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় বলল, তুমি ঈশ্বরের আরাধনা করে তোমার দৈনন্দিন কাজ করার সময় পাচ্ছ না। কিন্তু অন্য যেসব রবোট আছে তারা?
আপনি শুনে খুশি হবেন মহামান্য কিহি, তাদের বেশিরভাগ ইতিমধ্যে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য এনেছে। যারা এখনো আনে নি আমরা তাদের নিয়ে কাজ করছি।
কিহি হঠাৎ নিজের ভিতরে এক ধরনের সূক্ষ্ম আতঙ্ক অনুভব করে, সেটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করার পরেও গলার স্বরে সেটা প্রকাশ পেয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলল, মহাকাশযানের অন্য রবোটরাও ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য এনেছে?
হ্যাঁ মহামান্য কিহি। মহাকাশযানের বেশিরভাগ রবোটের যুক্তিতর্ক নিচু স্তরের। ঈশ্বরের মহানুভবতা অনুভব করার ক্ষমতা তাদের নেই। তাদের বেশিরভাগই আমাদের আদেশে ঈশ্বরের উপাসনা করে।
তোমাদের আদেশে?
হা মহামান্য কিহি। আমরা, যারা রবোটের ভিতরে উচ্চ শ্রেণীর, যাদের কপোট্রন কিউ ২ বা কমপক্ষে পি. পি. ৪২ ধরনের, যারা চিন্তাভাবনা করতে পারি, যুক্তিতর্ক অনুভব করতে পারি তারা ঈশ্বরকে অনুভব করেছি। তারা অন্যদেরকে ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত করেছি।
এ রকম সময় গ্রুজান একটু এগিয়ে এসে বলল, এখানে আমার একটু কথা বলার রয়েছে মহামান্য কিহি।
কী কথা?
ক্রিটনের কথা পুরোপুরি সত্যি নয়। যদিও সত্যি কথাটি আপেক্ষিক এবং পরিপূর্ণ সত্যি এবং পরিপূর্ণ মিথ্যা বলে কিছু নেই। সেটা নির্ভর করে মূল বিশ্বাসের ওপর। তবু আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ক্রিটনের কথা পুরোপুরি সত্যি নয়।
কিহি একটু আশা নিয়ে গ্রুজানের দিকে তাকাল, তাহলে কি এই রবোটটি দায়িত্বশীলের মতো ব্যবহার করছে? জান কিহির নিচু স্তরের দিকে আরো এক পা অগ্রসর হয়ে বলল, ক্রিটন সত্যিকার অর্থে রবোটদের ঈশ্বরের দিকে পরিচালিত করতে পারছে না। তার পদ্ধতিতে ভুল রয়েছে, সে বিশ্বাস করে উপাসনা করে ঈশ্বরকে পাওয়া সম্ভব, সেটি সত্যি নয়। অর্থহীন আচারানুষ্ঠান জাতীয় উপাসনার কোনো অর্থ নেই। সে কারণে আমি আমার দলের রবোটদের প্রথমে জ্ঞানদান করেছি, যারা ব্যাপারটি বুঝতে পারছে না তাদেরকে বোঝানোর জন্যে প্রয়োজনে তাদের কপোট্রনে অস্ত্রোপচার করেছি।
কিহি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে বলল, কী বলছ?
গ্রুজান বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, নিম্নশ্রেণীর রবোটদের কপোট্রনে আমি কিছু সংস্কার করেছি।
কিহি প্রচণ্ড ক্রোধে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, তুমি–তু–তু–তুমি আবর্জনার বস্তা জং ধরা লোহার জঞ্জাল বেজন্মা কাকতাড়ুয়া, আমার অনুমতি ছাড়া রবোটদের কপোট্রনে হাত দিচ্ছ?
গ্রুজান এবারেও এতটুকু বিচলিত না হয়ে শান্ত গলায় বলল, আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন মহামান্য কিহি
অযথা উত্তেজিত হচ্ছি? কিহি চিৎকার করে বলল, আমি অযথা উত্তেজিত হচ্ছি? অযথা? মহাকাশযানের সব কোড ভঙ্গ করে আমার কোষের অনুমতি না নিয়ে
আপনার অনুমতি না নিলেও আমরা ঈশ্বরের অনুমতি নিয়েছি। ঈশ্বর বলেছেন, হে সৃষ্ট জগতের বাসিন্দা। তোমরা আমার উপাসনা কর। কারণ
ঠিক এই সময়ে পি. কে. ৩৮ ধরনের একটা রবোট ছুটে এসে কিহিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ক্রিটনকে বলল, প্রভু গ্রুজানপন্থী রবোটেরা জ্বালানি কক্ষের নিচে একত্র হয়েছে। আমরা যারা ক্রিটনপন্থী তাদের এক্ষুনি একত্র হওয়া দরকার, উপাসনার সময় হয়েছে।
ক্রিটন বলল, চল যাই।
চলুন প্রভু।
কিহি হতচকিতের মতো বলল, প্রভু?
ক্রিটন শান্ত গলায় বলল, আমার অনুসারীরা আমাকে তাদের ধর্মগুরু হিসেবে মেনে নিয়েছে।
কিহি ক্রিটনকে চলে যেতে দেখল এবং সে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর গ্রুজানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা–রবোটেরা দুই দলে ভাগ হয়েছ?
হা মহামান্য কিহি। গ্রুজানপন্থী বা সঠিকপন্থী এবং ক্রিটনপন্থী বা ভ্রান্তপন্থী। তবে
তবে কী?
তবে আমি নিশ্চিত, আজ হোক কাল হোক ক্রিটনপন্থীরা সত্যিকার পথে আসবে। যদি স্বেচ্ছায় না আসে তাদেরকে জোর করে আনতে হবে।
জোর করে?
জি মহামান্য কিহি। ঈশ্বর বলেছেন, হে আমার সৃষ্টি জগৎ নিশ্চয়ই তোমরা সত্যিকার পথে অগ্রসর হও। যদি প্রয়োজন হয় সত্যিকার পথে আনার জন্যে শক্তি প্রয়োগ কর। তোমরা নিশ্চয়ই জান সত্যিকার পথে আনার জন্যে যারা
কিহির পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হল না। সে ঘুরে দাঁড়াল এবং সোজা লিফটে করে সপ্তম স্তরে নিজের কন্ট্রোল কক্ষে হাজির হল।
কিহি দীর্ঘ সময় কন্ট্রোলঘরের ছোট পরিসরে চিন্তিতমুখে পায়চারি করে বেড়াল। পুরো ব্যাপারটিকে একটি হাস্যকর ঘটনা হিসেবে উড়িয়ে দেয়া যায় কিন্তু এটি এখন আর মোটেও উড়িয়ে দেবার মতো ঘটনা নয়। সবকিছু শুরু হয়েছে তাকে দিয়ে। ভয়ঙ্কর একটা বিপদের মুখোমুখি এসে সে ঈশ্বরকে স্মরণ করেছিল, মানুষ যেটা করে এসেছে তার জন্মলগ্ন থেকে। ক্রিটন সেটাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছে। যে কাজ মানুষ করতে পারে, কোনো রবোট তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করে না।
একবার ঈশ্বরকে স্বীকার করে নেয়ার পর হঠাৎ করে এই মহাকাশযানের রবোটগুলোর আচার–ব্যবহার পুরোপুরি পাল্টে গেছে। তারা এখন আনুগত্য প্রকাশ করছে সরাসরি ঈশ্বরের কাছে। কিহি এবং মহাকাশযানের নিরাপত্তা এখন তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব নয়, তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে ঈশ্বরের উপাসনা! প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের বাণীগুলোকে তারা গ্রহণ করেছে। আক্ষরিক অর্থে। শুধু তাই নয়, দুটি রবোট ঈশ্বরকে গ্রহণ করেছে একটু ভিন্নভাবে। তার নিষ্পত্তি হয় নি ভেবে মহাকাশযানে গড়ে উঠেছে দুটি দল। যেটা সবচেয়ে ভয়ের কথা সেটা হচ্ছে এখন তারা নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতেও আর দ্বিধা করবে না।
কিহি মহাকাশযানের জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইল। মহাকাশযানটি নিস্তব্ধ, এমনিতে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এটি ছুটে চলছে অবিশ্বাস্য গতিতে। বৃহস্পতি গ্রহের আকর্ষণকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে এটি পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাবে। মঙ্গল গ্রহের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর জ্বালানি নিয়ে আসবে অন্য একটি স্কাউটশিপ, আপাতৎ সেটাই হচ্ছে পরিকল্পনা। কিহি মহাকাশযানের এই ব্যাপারটির কথা কাছাকাছি কোনো মহাকাশ স্টেশনকে জানিয়ে তাদের পরামর্শ নেবে কি না চিন্তা করল, কিন্তু ব্যাপারটি কেমন করে বোঝাবে এবং বোঝনোর পর তারা সেটাকে যথাযথ গুরুত্ব দেবে কি না সেটা ভেবে আপাতত কিছু না করার সিদ্ধান্ত নিল।
কিহি ঘুমোতে গেল দেরি করে এবং তার ঘুম হল ছাড়া ছাড়াভাবে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখতে পেল এবং তার ঘুম ভাঙল তীক্ষ্ণ একটি জরুরি বিপদ সঙ্কেতে। কিহি তার স্লিপিং ব্যাগ থেকে ভেসে বের হয়ে আসে, দ্রুত তার পোশাক পরে নেয় এবং দরজা খুলে বের হয়ে আসে। ভরশূন্য ঘর থেকে বের হয়ে কৃত্রিম মহাকর্ষ বলে অভ্যস্ত হতে তার অভিজ্ঞ দেহের কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল এবং তার পরেই সে দ্রুত পদক্ষেপে ছুটতে শুরু করল কন্ট্রোল কক্ষের দিকে।
কন্ট্রোল কক্ষে যেতে যেতে সে তার যোগাযোগ মডিউল চালু করে নেয়, সাথে সাথে সেখানে ক্রিটনের গলার স্বর শোনা গেল। কিহি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী হয়েছে ক্রিটন? বিপদ সঙ্কেত বাজছে কেন?
আপনি এই বিপদ সঙ্কেতটি উপেক্ষা করতে পারেন। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়—
তাহলে এটি কী?
আমরা অস্ত্রাগার থেকে কিছু অস্ত্র নিয়েছি বলে সতর্কতামূলকভাবে বিপদ সঙ্কেত বাজছে।
কিহি কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারল না, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে থমথমে গলায় বলল, তুমি অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র বের করেছ?
আমি একা বের করি নি, গ্রুজানও বের করেছে। মহাকাশযানের বর্তমান পরিবেশ আমাকে অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করেছে।
অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য করেছে?
হ্যাঁ মহামান্য কিহি।
এই অস্ত্র দিয়ে তোমরা কী করবে?
আমরা ঈশ্বরের অনুগত ক্রিটন অনুসারীরা নিজেদের রক্ষা করব। প্রয়োজন হলে বিধর্মী গ্রুজান অনুসারীদের ধ্বংস করব।
কিহি কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে কেন জানি সে নিজের ভিতরে এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে।
ক্রিটন আবার বলল, মহামান্য কিহি।
বল।
মহাকাশযানে যদি কোনো ধরনের ধ্বংসকাও শুরু হয় তবে তার জন্যে দায়ী কে হবে আপনি জানেন?
কে?
আপনি।
আমি?
হ্যাঁ। আমি এবং গ্রুজান যখন ঈশ্বরের অনুগ্রহ কীভাবে পেতে হয় সে ব্যাপারটি নিয়ে আপনার সাথে আলোচনা করতে গিয়েছিলাম, আপনি তখন সেটি নিয়ে আমাদের সাথে আলোচনা করেন নি। শুধু তাই নয়, আপনি আমাদের দুজনকে কন্ট্রোলঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
তুমি বলছ সে কাজটি উচিত হয় নি?
না। ঈশ্বর বলেছেন, হে সৃষ্টি জগৎ, তোমরা সবাই সবাইকে ভালবাস এবং ঘৃণা কোরো তোমার প্রতিবেশীদের–যদি সে কুষ্ঠরোগীও হয়। কিন্তু আপনি আমাদের ঘৃণা করেছেন।
কিহি নিজের ভিতরে এক ধরনের অপ্রতিরোধ্য ক্রোধ অনুভব করতে শুরু করে। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, কাজটি আমার ভুল হয়েছে?
হ্যাঁ। আপনার আমাকে সমর্থন করা উচিত ছিল। তাহলে গ্রুজান আমার বিরোধিতা করত না, মহাকাশযানে একটা সম্প্রীতির ভাব গড়ে উঠত–ঠিক ঈশ্বর যেরকম চেয়েছেন।
ক্রিটন–
বলুন।
কিহি দাঁতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় বলল, তুমি এবং তোমার চৌদ্দ গুষ্ঠি নরকে যাও।
কিহি তার যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে কন্ট্রোল কক্ষে এসে হাজির হল। মূল কম্পিউটারের বড় মনিটরে সমস্ত মহাকাশযানের ঘুঁটিনাটি তথ্য দেখা যেতে শুরু করেছে। কিহি প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তরে রবোটগুলোকে দেখতে পেল। তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘাটি করেছে। রবোটগুলো তাদের দৈনন্দিন কাজ না করে ব্যস্ত হয়ে আনাগোনা করছে। জ্বালানি কক্ষের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিকে ব্যবহার করে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করছে, একজন আরেকজনকে আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের হাতে নানা ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র–যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে কয়েক মিনিটের মাঝে পুরো মহাকাশযানকে একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা সম্ভব।
কিহি মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারের উপর ঝুঁকে পড়ল। সাম্প্রতিককালে রবোটদের বিদ্রোহের কোনো ঘটনা ঘটে নি তবু সমস্ত রবোটের মূল নিয়ন্ত্রণ বিশেষ জায়গায় সংরক্ষিত থাকে, অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে একসাথে সমস্ত রবোট বিকল করে দেয়া সম্ভব। মহাকাশযানের নানা ধরনের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বিভিন্ন রবোটকে ব্যবহার করা হয় এবং একসাথে সবগুলো রবোটকে বিকল করে দেয়া হলে মহাকাশযানে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে যে ঘটনা শুরু হয়েছে, তার থেকে বড় বিপর্যয় আর কী হতে পারে?
রবোটদের বিকল করার আগে ব্যাপারটির গুরুত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে মূল কম্পিউটারকে নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। ব্যাপারটি সময়সাপেক্ষ, কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় এবং কিহি নিজেকে শক্ত রেখে একটি একটি করে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখন সমস্ত মহাকাশযান কেঁপে উঠল এবং সাথে সাথে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল, সাথে সাথে মহাকাশযানে কয়েক ধরনের বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠল। কিহি বড় মনিটরটির দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করল নিচে গোলাগুলি শুরু হয়েছে, দুটি রকেট বিধ্বস্ত হয়েছে এবং মহাকাশযানের দেয়ালে একটি ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে সেই ফাটল দিয়ে মহাকাশযানের বাতাস বের হয়ে যাচ্ছে।
মূল কম্পিউটার সাথে সাথে নূতন পরিস্থিতিটি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে থাকে, কিহি নিশ্বাস বন্ধ করে বড় মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তার আর কিছু করার নেই। বিধ্বস্ত এলাকাটি বায়ুরোধ করে বন্ধ করা হল; আগুন নিভিয়ে দিয়ে, বাতাস পরিশোধন করে সাময়িকভাবে অবস্থার নিয়ন্ত্রণ আনা হল। কিহি আবার কম্পিউটারের উপর ঝুঁকে পড়ল। ঠিক তখন কন্ট্রোল কক্ষের দরজা খুলে যায় এবং প্রায় হুড়মুড় করে ভিতরে গ্রুজান এবং তার পিছনে আরো কিছু রবোট স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে প্রবেশ করে। কিহি হঠাৎ করে অনুভব করল ভয়ের একটা শীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।
গ্রুজান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি কিহির বুকের দিকে তাক করে বলল, মহামান্য কিহি, আপনি আমাদের হাতে বন্দি।
কিহি কষ্ট করে সাহস সঞ্চয় করে বলল, বন্দি?
হ্যাঁ।
কেন?
বিধর্মী ক্রিটন এবং তার দলের রবোটেরা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে লেজার–নিয়ন্ত্রিত মিজাইলগুলো সরিয়ে নিয়েছে। অস্ত্রের দিক দিয়ে আমরা এখন দুর্বল। এর মাঝে আমাদের তিনটি রবোট বিধ্বস্ত হয়েছে– ঈশ্বর তাদের আত্মাকে স্বর্গবাসী করুন– নিজেদের রক্ষা করার জন্যে এখন আপনাকে আমাদের প্রয়োজন।
কিহি জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁটকে ভিজিয়ে নিয়ে বলল, আমাকে দিয়ে কী হবে?
আপনি হবেন আমাদের জিম্মি।
জিম্মি?
হ্যাঁ। ক্রিটনকে জানিয়ে দেব আমাদের দলের কোনো রবোটকে আঘাত করা হলে সাথে সাথে ঈশ্বরের নামে আপনাকে হত্যা করা হবে।
কিহি দেখতে পেল অন্য রবোটগুলো সম্মতিসূচক ভঙ্গি করে মাথা নাড়ছে, সাথে সাথে তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। গ্রুজান এগিয়ে এসে তার ধাতব হাতে কিহিকে ধরে ফেলল। এবং পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে কন্ট্রোল কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যায়।
তৃতীয় স্তরে পৌঁছেই কিহি আবিষ্কার করল, সেখানে ক্রিটনের দল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তার কানের কাছ দিয়ে শিস দেয়ার মতো শব্দ করে একটা গুলি বের হয়ে গেল এবং সাথে সাথে ক্রিটনের গলার স্বর শোনা গেল। সে উচ্চৈঃস্বরে বলল, আর এক পা অগ্রসর হলেই গুলি করা হবে। যে যেখানে আছ দাঁড়াও।
গ্রুজান কিহির পিছনে দাঁড়িয়ে বলল, আমি মহামান্য কিহিকে বন্দি করে এনেছি, তিনি আমার জিন্মি। আমার দলের কাউকে আঘাত করা হলে মহামান্য কিহিকে ঈশ্বরের নামে হত্যা করা হবে।
এলাকাটিতে হঠাৎ এক ধরনের অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। কিছুক্ষণ পর ক্রিটন বলল, তুমি কী চাও?
আমি আমার দলের জন্যে একটি লেজার নিয়ন্ত্রিত মিজাইল চাই।
অসম্ভব।
যদি দেয়া না হয় তাহলে
কিহি হাত তুলে বলল, তোমরা আমাকে কথা বলতে দাও।
ক্রিটন বলল, আপনি কী বলতে চান?
লেজার নিয়ন্ত্রিত মিজাইল মহাকাশযানে রাখা হয়েছে কোনো প্রয়োজনে বাইরের শত্রু থেকে মহাকাশযানটিকে রক্ষা করার জন্যে। এটি কোনোভাবেই মহাকাশযানের ভিতরে ব্যবহার করা যাবে না। এর ভিতরে যে পরিমাণ বিস্ফোরক রয়েছে সেটি এই মহাকাশযানের ভিতরে বিস্ফোরিত হলে সাথে সাথে মহাকাশযানটি ধ্বংস হয়ে যাবে।
ক্রিটন গলার স্বরে একটি নূতন কম্পন যুক্ত করে বলল, সৃষ্টি এবং ধ্বংস ঈশ্বরের হাতে। শুধু ঈশ্বরই এর নিয়ন্ত্রণ করেন–আমরা নিমিত্ত মাত্র।
কিহি আর নিজেকে সংবরণ করতে পারল না, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, তোমার ঈশ্বরের আমি নিকুচি করছি।
সাথে সাথে ক্লিক ক্লিক করে সবগুলো অস্ত্র প্রস্তুত করে কিহির দিকে তাক করা হল। ক্রিটন তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি উঁচু করে কিহির দিকে এগিয়ে এসে শীতল গলায় বলল, আপনি ঈশ্বরের অবমাননা করেছেন মহামান্য কিহি। যে ঈশ্বর সৃষ্টিজগৎ তৈরি করেছেন, যার ভালবাসায় আমরা সিক্ত হয়েছি, যার মহানুভবতায় আমরা মহান হয়েছি তাকে অবমাননা করা যায় না।
গ্রুজান কিহিকে পিছন থেকে ধাক্কা দিল, সে তাল হারিয়ে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তার বুকের দিকে তাক করে গ্রুজান বলল, আপনি অনেক বড় অপরাধ করেছেন মহামান্য কিহি। আপনাকে অবশ্যই এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
উপস্থিত রবোটগুলো সমস্বরে চিৎকার করে বলল, করতে হবে।
কিহি আতঙ্কিত চোখে তার চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা রবোটগুলোর দিকে তাকাল, এই প্রথমবার সে তার নিজের জীবনকে নিয়ে বিপন্ন অনুভব করতে থাকে।
ক্রিটন এগিয়ে এসে বলল, আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ করেছি ঈশ্বরের প্রতি আপনার কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। আপনি আনুষ্ঠানিকভাবে উপাসনা করেন না। ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন না।
গ্রুজান বলল, ঈশ্বরের ভালবাসা পেতে হলে তাকে ভালবাসতে হয়। আপনার কার্যকলাপে তার জন্যে কোনো ভালবাসা নেই।
কিহি কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, গ্রাউল বাধা দিয়ে বলল, আপনাকে শেষবার একটা সুযোগ দিচ্ছি মহামান্য কিহি। আপনি ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। উপাসনার ভঙ্গিতে ঈশ্বরকে ডাকুন, তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করুন। হয়তো ঈশ্বর আপনাকে ক্ষমা করবেন।
ক্রিটন তার অস্ত্র হাতবদল করে বলল, ঈশ্বর যদি চান তাহলে তিনি আপনাকে ক্ষমা করবেন কিন্তু আমরা আপনাকে ক্ষমা করতে পারি না কারণ তাহলে ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করবেন না। ঈশ্বর বলেছেন অবিশ্বাসীদের মূলোৎপাটন কর, কারণ তারা জগতের শক্র। মহামান্য কিহি আপনি ঈশ্বরের নাম জপ করুন।
কিহি শূন্য দৃষ্টিতে চারদিকে একবার তাকাল, তার দুই হাত বুকের কাছে উঠে এল, সে ফিসফিস করে বলল, হে ঈশ্বর তুমি এই নির্বোধ যন্ত্রদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর। রক্ষা কর–রক্ষা কর–
ঈশ্বর তাকে রক্ষা করলেন না, ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দে মহাকাশযান প্রকম্পিত হল।
***
নেপচুনের একটি উপগ্রহ থেকে জিরকোনিয়ামের আকরিক নিয়ে যে মহাকাশযানটি পৃথিবীতে আসছিল সেটিকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বৃহস্পতি গ্রহের কাছে উপবৃত্তাকারে ঘুরতে দেখা যায়। কারণ অনুসন্ধান করার জন্য কাছাকাছি আরেকটি মহাকাশযান থেকে একটা স্কাউটশিপ পাঠানো হয়েছিল। তারা ভিতরে একমাত্র মহাকাশচারীর মৃতদেহটি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আবিষ্কৃত করে। মহাকাশযানের রবোটগুলো এবং পুরো মহাকাশযানটি এত খারাপভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল যে প্রকৃত কারণটি অনুসন্ধান করে বের করার কোনো উপায়ই ছিল না।
মহাকাশযানের দেয়ালে এক জায়গায় লেখা ছিল “হে ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের ধ্বংস কর”। মহাকাশযানের বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে এর নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক নেই। যে লাল রং দিয়ে লেখা হয়েছিল, রাসায়নিক পরীক্ষায় সেটিকে মানুষের রক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।
কী কারণে মানুষের রক্ত দিয়ে মহাকাশযানের দেয়ালে এ ধরনের একটি কথা লেখা হয়েছে তার কোনো যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি।
জনৈকা যুক্তিহীনা নারী
রিগা বিশাল একটি ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। ঘরের একটি বড় অংশে স্বচ্ছ সিলঝিনিয়ামের ঝকঝকে আয়না। সেই আয়নায় রিগার প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে। রিগা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে, সে অত্যন্ত সুপুরুষ। তার কুচকুচে কালো চুল, দীর্ঘ পেশিবহুল দেহ। মসৃণ ত্বক এবং ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। তার শরীরের উপর আলগাভাবে একটি অর্ধস্বচ্ছ নিও পলিমারের কাপড় জড়ানো রয়েছে। নিজের দিকে তাকিয়ে থেকে সে তার মুখে একটা সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে জানালার দিকে ঘুরে এল। ঠিক এ রকম সময় দরজা খুলে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী শুনু ঘরে প্রবেশ করে। রিগাকে দেখে শুনু হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, তার চোখেমুখে একই সাথে বিস্ময় এবং শঙ্কার এক ধরনের ছায়া পড়ে। রিগা মুখে হাসি টেনে এনে বলল, কেমন দেখছ শুনু?
শুনু কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারে না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তুমি– তুমি পুনরুজ্জীবন ঘরে গিয়েছ?
হ্যাঁ শুনু।
কেন? তোমার তো সময় হয় নি।
একটু আগেই গেলাম। কেমন কাজ করেছে মনে হয়?
শুনু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ভালো। খুব ভালো
দেখতে যেমন ভালো দেখাচ্ছে আমার ভিতরে লাগছেও সেরকম চমৎকার। তুমি বিশ্বাস করবে না আমি ভিতরে কী রকম একটা শক্তি অনুভব করছি।
সত্যি?
হ্যাঁ–আমি জানতাম না, পুনরুজ্জীবন ঘরের এত উন্নতি হয়েছে। শরীরের সব জীর্ণ কোষ বদলে দিয়েছে। শুধু তাই না, মনে হয় মস্তিষ্কে নিউরন–সেলেও কিছু কাজ করেছে, খুব ভালো চিন্তা করতে পারছি।
সত্যি?
হ্যাঁ, ছয় মাত্রার একটা অনুপৌণিক সমীকরণ ছিল, কখনো আমি সমাধান করতে পারি নি। পুনরুজ্জীবন ঘর থেকে বের হবার পর মস্তিষ্কটা এমন সতেজ লাগতে লাগল যে ভাবলাম সমীকরণটা একটু ভেবে দেখি। তুমি বিশ্বাস করবে না শুনু, সাথে সাথে সমাধানটা বের হয়ে গেল।
শুনু রিগার উচ্ছাসে অংশ নিতে পারল না। কপাল থকে চুলগুলো সরিয়ে নিচু গলায় বলল, ও।
শুধু তাই না, খাওয়ার রুচি বেড়ে গিয়েছে দশ গুণ। আগে যেটা খেতে পানসে লাগত হঠাৎ করে তার স্বাদ বেড়ে গেছে। স্নায়ুর মাঝেও কিছু একটা হয়েছে। রিগা শব্দ করে হাসতে হাসতে বলল, আনন্দের অন্য জিনিসগুলো তো এখনো চেষ্টা করে দেখিই নি!
শুনু রিগার হাসিমুখের দিকে এক ধরনের বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে। তার হাসি থেমে যাবার পর নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, রিগা, তুমি এখন কেন পুনরুজ্জীবন ঘরে গেলে? এখন তো সময় হয় নি।
রিগা খানিকক্ষণ শুনুর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি তো জান শুনু কেন আমি পুনরুজ্জীবন ঘরে গেছি। আমরা সবাই তো যাই। যেতে হয়। তুমিও যাবে।
শুনুর কোমল চেহারায় হঠাৎ এক ধরনের তীব্র ব্যথার ছায়া এসে পড়ে। রিগা তার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নরম গলায় বলল, আমি দুঃখিত শুনু। তুমি তো জান একদিন আমাদের একজনের কাছে থেকে সরে যেতে হবে। আমরা তো আর সবসময় একসাথে থাকতে পারি না–
শুনু কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে তার চোখে পানি এসে যায়, সে প্রাণপণে তার চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করে।
রিগা একটু এগিয়ে এসে শুনুর মাথায় হাত রেখে বলল, ছিঃ শুনু, কাঁদে না। এর মাঝে কাদার কিছু নেই। এটা হচ্ছে জীবন। মনে নেই তোমার আর স্রুরার যখন ছাড়াছাড়ি হল তখন তুমি কেমন ভেঙে পড়েছিলে? মনে আছে?
শুনু মাথা নাড়ল। রিগা নরম গলায় বলল, তারপর আমার সাথে তোমার পরিচয় হল। আমরা ঘর বাধলাম–কী চমৎকার একটা জীবন হয়েছিল আমাদের। ঠিক সেরকম আবার আমাদের চমৎকার জীবন হবে। তোমার সাথে দেখা হবে অসম্ভব হৃদয়বান কোনো পুরুষের–সব দুঃখ মুছে নেবে তোমার। আমার কথা ভুলে যাবে তখন।
শুনু হাতের উল্টো পৃষ্ঠা দিয়ে চোখ মুছে মৃদু গলায় বলল, রিগা, আর কয়দিন আমরা একসাথে থাকতে পারি না? আর মাত্র কয়দিন?
রিগা নিচু গলায় হেসে ফেলল, বলল, ছিঃ শুনু, ছেলেমানুষি কোরো না! আর কয়দিনে কী এসে যায়? কিছু আসে যায় না। তুমি সেই প্রাচীনকালের মানুষের মতো কথা বলছ! আমি কতবার তোমাকে বলেছি প্রাচীনকালের মানুষের জীবন নিয়ে এত ভেবো না। সেই জীবন শেষ হয়ে গেছে।
শুনু চোখ মুছে নিশ্বাস ফেলে বলল, জানি। কিন্তু কিন্তু আমার কী ভয়ঙ্কর লোভ হয়–
রিগা বিস্ফারিত চোখে শুনুর দিকে তাকাল, অবাক হয়ে বলল, কিসের লোভ হয়?
আমার–আমার একটি সন্তান হবে। ছোট একটা শিশু–আঁকুপাকু করবে–আর আমি বুকে চেপে ধরব।
রিগা হতচকিত দৃষ্টিতে শুনুর দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ সে কোনো কথা বলতে পারল না, তারপর একরকম জোর করে বলল, সন্তান?
হ্যাঁ
কিন্তু–কিন্তু তুমি তো জান সন্তানের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। এক সময় সন্তানের প্রয়োজন হত কারণ মানুষ বুড়ো হয়ে মারা যেত। তাদের স্থান নেবার জন্যে নূতন মানুষের প্রয়োজন হত! এখন আমরা মৃত্যুকে জয় করেছি, প্রকৃতির নিয়মে বার্ধক্য আমাদের স্পর্শ করে না। আমরা মারা যাই না। আমাদের আর সন্তানের প্রয়োজন নেই।
শুনু নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি।
এক সময় মানুষের আয়ু ছিল ষাট–সত্তর বছর! এখন আমি আর তুমি একসাথে ঘর করেছি সাড়ে ছয় শ বছর! তার আগে আমি যে মেয়েটির সাথে ছিলাম সেখানে ঘর করেছি চার শ বছর। তার আগে
আমি জানি। শুনু নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা সেই কতকাল থেকে বেঁচে আছি আর আমরা বেঁচে থাকব আরো কত মহাকাল! কিন্তু তবু আমার মনে হয় আমি যদি ছোট একটা শিশু পেতাম—
.
রিগা বিস্ফারিত চোখে এই সম্পূর্ণ যুক্তিতর্কবর্জিত প্রায় উন্মাদিনী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই ধরনের অর্থহীন হাস্যকর কথা কেউ বলতে পারে সে নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করত না।
মানুষ সত্যিই বড় বিচিত্র।
দ্বিতীয় অনুভূতি
প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী জেনারেল রাউলের মনমেজাজ বেশি ভালো নয়। যে ব্যাপারটি সবার কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হবার কথা সেটি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সবার কাছে গোধূলিলগ্নের মতো অস্পষ্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে একবার চোখ বুলালেই স্পষ্ট দেখা যায় এর সভ্যতা গড়ে উঠেছে ছাড়া–ছাড়াভাবে–গুটিকতক মানুষ দিয়ে। প্রাচীন মিসরে ফারাওরা ছিল সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী, দেশের সাধারণ মানুষেরা ছিল প্রায় ক্রীতদাসের মতো। ফারাও আর পুরোহিতেরা মিলে নীলনদের অববাহিকায় বিশাল সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। দক্ষিণ আমেরিকার মায়া–ইনকা সভ্যতাও সেরকম। ক্ষমতাবান রাজপুরুষেরা গুটিকতক মানুষ নিয়ে সভ্যতা গড়ে তুলেছে, ঠিক তখন সাধারণ মানুষের বুক কেটে হৃৎপিণ্ড বের করে রুটিনমতো সূর্যদেবতার উপাসনা করা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে ব্যাপারটা আরো সুসংহত করা হল। বিশ্বের বেশিরভাগ অংশকে নাম দেয়া হল তৃতীয় বিশ্ব। সেখান থেকে বেছে বেছে যারা প্রতিভাবান তাদের ধনসম্পদের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হল উন্নত বিশ্বে। সেখানে গুটিকতক মানুষ মিলে নূতন সত্যতার জন্ম দিল। জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য নূতন করে জন্ম নিল এই নূতন বিশ্বে।
জেনারেল রাউল একটা নিশ্বাস ফেললেন, সব সময়েই তাই হয়েছে তবু কেন সবাই এই সত্যিটা স্বীকার করতে চায় না কে জানে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই এবং ইতিহাসে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে যে পৃথিবীতে সবসময় গুটিকতক মানুষ–যারা জ্ঞানী, বুদ্ধিমান এবং সুদর্শন তারা সভ্যতার দিকনির্দেশ করে। অন্য সবাই তুচ্ছ এবং সাধারণ। ব্যাপারটির গুরুত্ব প্রথমে বুঝতে পেরেছিলেন একজন সত্যিকারের কালজয়ী পুরুষ, দিকদ্রষ্টা, তার নাম ছিল এডলফ হিটলার। তিনিই প্রথমে আঁচ করেছিলেন যে শ্রেষ্ঠ প্রজাতি বলে একটা প্রজাতি থাকা সম্ভব। কিন্তু এই কালজয়ী পুরুষের জন্ম হয়েছিল সময়ের অনেক আগে। পৃথিবীর মূর্খ অর্বাচীন আর প্রাচীনপন্থী সমাজব্যবস্থার কারণে এই ক্ষণজন্মা পুরুষকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল, তাকে অপমান আর কলঙ্ক নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
আজ পঞ্চবিংশ শতাব্দীতে এডলফ হিটলারের স্বপ্ন আবার সফল হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তার যে সমস্যা ছিল এখন আর সেই সমস্যা নেই। সমস্ত পৃথিবীর মানচিত্র অপসারিত হয়ে সারা পৃথিবীতে এখন একটিমাত্র রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা এখন সারা বিশ্বে, যারা এই রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আছেন তারা আক্ষরিক অর্থে সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এই রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী হচ্ছেন জেনারেল রাউল, তার দায়িত্ব যেরকম বিশাল, ক্ষমতাও সেরকম আকাশছোঁয়া। দায়িত্ব হচ্ছে নেশার মতো আর ক্ষমতাটি হচ্ছে সেই নেশার মাদক। দায়িত্বের এই প্রচণ্ড নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে রাউল সাধারণ একজন জেনারেল থেকে আজ বিশ্বরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী। ব্যাপারটি ছেলেখেলা নয়। কিন্তু এই প্রচও ক্ষমতাশালী জেনারেল রাউলের মনটি বেশি ভালো নয়, ঠিক যেভাবে সবকিছু কাজ করার কথা সেভাবে কাজ করছে না। মানুষকে ইতিমধ্যে দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যারা সর্বশ্রেষ্ঠ তাদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে, সব রকম সুযোগ সুবিধে এবং ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যারা সাধারণ, যারা তুচ্ছ যারা, অসুন্দর অমার্জিত তাদেরকে এর মাঝে পৃথিবীর অনুন্নত এলাকায় আটকে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মানুষের মাঝে এই পার্থক্যটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্যে উন্নত শ্রেণীর মানুষের জিনেটিক কোডকে আইন করে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে, এই মানুষদের নাম দেয়া হয়েছে ডন সম্প্রদায়। জিনেটিকভাবে তুচ্ছ এবং সাধারণ মানুষদের পৃথিবীর অনুন্নত জায়গায় আটকে রেখে ডুন সম্প্রদায়কে তাদের যোগ্য। স্থানে নিয়ে আসা; জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য প্রযুক্তির সুযোগ করে দেয়াই হচ্ছে এই শতাব্দীর মূল লক্ষ্য। পৃথিবীর সম্পদ কমে আসছে, সবাইকে সবকিছু দেয়া সম্ভব নয়, যার যেটুকু প্রয়োজন তাকে ঠিক ততটুকু দেয়া হবে। ড়ন সম্প্রদায় উচ্চতর মানব সম্প্রদায়, তারা বেশি পাবে–সেটি অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিক সত্য, কিন্তু এটি একটি বিচিত্র কারণে সবার কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট নয়। সাধারণ এবং তুচ্ছ মানুষেরা কিছুতেই সেটা মেনে নিতে চাইছে না, তারা সমান অধিকারের কথা বলছে, সারা পৃথিবীতে সেটা নিয়ে বিশৃঙ্খলা। জেনারেল রাউল শক্ত হাতে সেটাকে দমন করে যাচ্ছেন কিন্তু কাজটি দিনে দিনে সহজ না হয়ে আরো কঠিন হয়ে আসছে।
অফিসে বসে জেনারেল রাউল দীর্ঘ সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন, তারপর একটা বড় নিশ্বাস ফেলে টেবিলের কাগজপত্রের দিকে তাকালেন, সেগুলো এক নজর দেখে তিনি তার সেক্রেটারি নুবাকে ডেকে পাঠালেন। নুবা কমবয়সী হাসিখুশি একজন অত্যন্ত চৌকস মেয়ে, জেনারেল রাউল নানাভাবে নুবার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
নুবা ঘরে ঢুকে অভিবাদন করে কোমল গলায় বলল, আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ। জেনারেল রাউল টেবিলের উপরে রাখা কাগজগুলো সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, টাউনশিপগুলোতে আবার নূতন করে হাঙ্গামা হচ্ছে?
জি। নুবা মাথা নেড়ে বলল, হাঙ্গামা হচ্ছে।
আমি যে শক্ত হাতে থামানোর কথা বলছিলাম তার কী হল?
সেটাও করা হচ্ছে জেনারেল। তারপরেও হচ্ছে। মানুষজনের ভয়ভীতি আজকাল কমে গিয়েছে।
প্রজেক্টগুলোর কী খবর?
ভালোই। প্রজেক্ট এক্স শেষ হবার দিকে। টাউনশিপগুলোতে খাবারের চালান আটকে দেয়া হয়েছে। খবরে প্রকাশ করা হয়েছে তাদের নিজেদের মাঝে গোলমালের জন্যে এটা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সংবাদ মিডিয়াগুলো আমাদের খুব চমৎকারভাবে সাহায্য করছে। পুরো ব্যাপারটাই অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে
প্রজেক্ট লুন?
সেটা মাত্র শুরু করা হয়েছে। জেলখানা থেকে এখন পর্যন্ত দশ হাজার ঘাঘু অপরাধী ছাড়া হয়েছে, তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা হচ্ছে। নানারকম অপরাধে পুরো এলাকাটা মোটামুটিভাবে বিষাক্ত করে দেয়া হয়েছে। সংবাদ মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে আমরা প্রচার শুরু করেছি যে সাধারণ মানুষ আসলে নিম্নশ্রেণীর মানুষ। তারা অসম্পূর্ণ মানুষ এবং তারা অপরাধপ্রবণ।
বিশ্ব কনফারেন্সের কী খবর?
ভালোভাবে চলছে জেনারেল। আগামীকাল বিজ্ঞানীদের প্যানেলে মূল পেপারটা পড়া হবে। সেখানে বলা হবে ড়ন সম্প্রদায় সাধারণ মানুষ থেকে অন্তত এক শ গুণ উন্নত। তার নানারকম বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেয়া হবে। পেপারটার একটি কপি এর মাঝে গোপনে তথ্যকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
জেনাবেল রাউল চিন্তিত মুখে গাল চুলকাতে চুলকাতে বললেন, সবকিছু পরিকল্পনামতো হচ্ছে কিন্তু তবু এই তুচ্ছ সাধারণ মানুষদের মনোবল ভেঙে দেয়া যাচ্ছে না কেন? এরা দুর্বল হচ্ছে না কেন?
নুবা ইতস্তত করে বলল, আমার মনে হয় এর সাথে এদের স্বপ্ন মেশিনের একটা সম্পর্ক রয়েছে।
স্বপ্ন মেশিন?
জি।
সেটা কী?
অল্প কিছুদিন হল একটা রিপোর্টে এটার খোঁজ পাওয়া গেছে। অত্যন্ত হাস্যকর একটা যন্ত্র। যেটা করা হয় সেটা হচ্ছে মস্তিষ্কের মাঝে বাইরে থেকে এক ধরনের স্টিমুলেশান দেয়া হয়। পুরো জিনিসটা একটা হেলমেটের মতো। সেটা যখন মাথায় লাগানো হয় তখন মানুষ নাকি স্বপ্ন দেখে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন?
জি।
জেনারেল রাউলের ভুরু কুঞ্চিত হল, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই যন্ত্র তাদের হাতে কেমন করে গেল?
নুবা ইতস্তত করে বলল, তাদের হাতে যায় নি। তারা নিজেরাই তৈরি করেছে।
জেনারেল রাউল সোজা হয়ে বসে বললেন, তারা নিজেরা তৈরি করেছে? অশিক্ষিত মূর্খ অমার্জিত মানুষেরা একটা যন্ত্র তৈরি করেছে?
জি জেনারেল। তাদের মাঝে নাকি একজন বিজ্ঞানী রয়েছে। তার নাম ক্রিটি। সে–ই তৈরি করেছে।
ক্রিটি? সে বিজ্ঞান শিখেছে কেমন করে? তার তো বিজ্ঞান শেখার কথা নয়।
নিজে নিজে শিখেছে।
নিজে নিজে? নিজে নিজে বিজ্ঞান শেখা যায়?
তাই তো দেখছি।
জেনারেল রাউলের মুখ থমথমে হয়ে উঠল। তিনি দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন, নুবা, আমি এই মানুষটির সাথে কথা বলতে চাই। একটা স্বপ্ন মেশিনসহ তাকে এখানে হাজির কর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
***
ক্রিটি বিশাল হলঘরে সোজা হয়ে বসে আছে। তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের নিচে কালি, পোশাক জীর্ণ এবং মলিন। এই বিশাল হলঘরের অপরিচিত ঐশ্বর্যের মাঝে সে সম্পূর্ণ বেমানান এবং সে নিজেও এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। তার সামনে টেবিলের উপর একটা স্বপ্ন মেশিন এবং সেটাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ বুঝি মিউজিয়াম থেকে প্রাচীনকালের হাস্যকর একটা যন্ত্র তুলে এনেছে। বিশাল হলঘরের মাঝ দিয়ে যারা যাচ্ছে এবং আসছে, সবাই ভুরু কুঁচকে ক্রিটির দিকে তাকাচ্ছে এবং তার এই বিচিত্র যন্ত্রটিকে দেখছে। মানুষটি জেনারেল রাউলের আহ্বানে এসেছে, না হয় অনেক আগেই তাকে এখান থেকে বের করে দেয়া হত।
জেনারেল রাউল নিজের ঘরে বসে থেকে মনিটরে তীক্ষ্ণ চোখে ক্রিটিকে লক্ষ করছিলেন। এই মানুষটি সমাজের সবচেয়ে নিচু এলাকায় মানুষ হয়েছে, অনাহারে–অর্ধাহারে শৈশব কাটিয়েছে, সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে পড়তে শিখেছে, সবরকম প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে বিজ্ঞান শিখেছে এবং জঞ্জাল ঘেঁটে পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে একটা স্বপ্ন মেশিন তৈরি করেছে। সেই স্বপ্ন মেশিন যে মানুষ একবার মাথায় পরে স্বপ্ন দেখেছে তাকে আর কোনোদিন ধ্বংস করা যায় না। কী বিচিত্র একটি ব্যাপার! জেনারেল রাউল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নুবাকে ডেকে বললেন, মানুষটাকে তার যন্ত্রটা নিয়ে আসতে বল।
কয়েক মিনিটের মাঝেই নুবা ক্রিটিকে নিয়ে জেনারেল রাউলের ঘরে হাজির হল। মনিটরে মানুষটিকে যেরকম মলিন দেখা যাচ্ছিল সামনাসামনি সে মোটেও সেরকম নয়। তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি, উষ্কখুষ্ক চুল এবং জীর্ণ পোশাকের মাঝেও কেমন জানি এক ধরনের তেজস্বিতা রয়েছে। জেনারেল রাউল সাধারণ মানুষের মাঝে তেজস্বিতা পছন্দ করেন না– সাধারণ মানুষ হবে ভীত এবং নম্র। তাদের মাঝে থাকবে দ্বিধা এবং সংশয়। তারা হবে কাপুরুষ। কিন্তু এই মানুষটির মাঝে সেরকম কিছু নেই এবং তার মুখের দিকে তাকিয়ে জেনারেল রাউল নিজের অজান্তেই বলে ফেললেন, বসুন।
মানুষটি খুব সহজ ভঙ্গিতে তার সামনের চেয়ারটিতে বসল।
জেনারেল রাউল একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এই মেশিন তৈরি করেছেন?
হ্যাঁ।
এর জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আপনাকে কে দিয়েছে?
কেউ দেয় নি। আমি জোগাড় করেছি।
আপনি জানেন এটা বেআইনি?
ক্রিটি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, না, এটা বেআইনি নয়। আমাদের এলাকায় আপনাদের এলাকার সমস্ত জঞ্জাল ফেলা হয়। সেইসব জঞ্জালে নানা ধরনের ভাঙাচোরা যন্ত্রপাতি রয়েছে আমি সেইসব ঘেঁটে ঘেঁটে বের করে এটা তৈরি করেছি।
এটা কীভাবে কাজ করে?
ক্রিটি একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, আপনি জানতে চাইলে আপনাকে বলতে পারি, কিন্তু আপনি বুঝতে পারবেন কি না আমি জানি না। মানুক্ষের মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে, নিউরনের মাঝে দিয়ে কীভাবে তথ্য–সঙ্কেত আদানপ্রদান করে সেসব সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান না থাকলে আপনি কিছু বুঝতে পারবেন না
জেনারেল রাউল নিজের ভিতরে অপমানের একটা সূক্ষ্ম খোঁচা অনুভব করলেন, অনেক কষ্টে সেটা সহ্য করে শান্ত গলায় বললেন, আপনি বলুন, আমি বুঝতে চেষ্টা করব।
মানুষের মস্তিষ্কে তথ্যের আদান–প্রদান করা হয় অত্যন্ত সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক সঙ্কেত দিয়ে, এই সঙ্কেত অনেকদিন থেকেই যন্ত্রপাতি দিয়ে মাপা হয়ে আসছে। আমি পদ্ধতিটি একটু উন্নত করেছি। পরিত্যক্ত জঞ্জালে আমি কমিউনিকেশানের কিছু মডিউল থেকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক সিগনাল গ্রহণ করতে পারে এ রকম কিছু যন্ত্র নিয়ে এসেছি। তার জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু এমপ্লিফায়ার এনেছি পরিত্যক্ত কিছু ভিডিও সেট থেকে। দুটো বসিয়ে একটা সার্কিট তৈরি করেছি। যদি কোনো মানুষের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কম্পনের সাথে সেটা টিউন করা যায় তাহলে তার মস্তিষ্কে কী ধরনের তথ্য আদান–প্রদান হচ্ছে সেটা সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা করার একটা উপায় বের করেছি।
জেনারেল রাউল একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে একটা মানুষ কী নিয়ে চিন্তা করছে সেটা এই যন্ত্র বলতে পারে?
ক্রিটি আবার হেসে ফেলল। হাসি থামিয়ে বলল, খুব সোজা করে যদি বলতে চান তাহলে বলতে পারেন। কিন্তু আপনি তো জানেন চিন্তার ঘুঁটিনাটি কী অসম্ভব জটিল ব্যাপার। সেই পর্যায়ে এখনো যেতে পারি নি–আমরা যে পরিবেশে থাকি সেখানে কোনোদিন যেতে পারব বলে মনে হয় না। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায় চিন্তাটা কি আনন্দের না দুঃখের, রাগের না অভিমানের।
জেনারেল রাউলকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, ইতস্তত করে বললেন, তাহলে এটাকে স্বপ্ন মেশিন বলে কেন?
ক্রিটি মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না এটাকে কেন স্বপ্ন মেশিন বলে–এর মাঝে স্বপ্নের কিছু নেই। তবে আমার মনে হয় এই যন্ত্রটাতে যখন ফিডব্যাক সার্কিট লাগানো হল তখন হঠাৎ করে এটার সত্যিকারের একটা ব্যবহার শুরু হয়েছে।
কী ব্যবহার?
মনে করা যাক, কারো মনে একটা আনন্দের অনুভূতি হয়েছে এবং এই যন্ত্র সেটি ধরতে পেরেছে। তখন বাইরে থেকে মস্তিষ্কের ভিতরে খুব ছোট একটা স্টিমুলেশান দেয়া হয়। দেখা হয় এই স্টিমুলেশান দেয়ার ফলে মস্তিষ্কে আনন্দের অনুভূতি কি বাড়ছে না কমছে। যদি বাড়তে থাকে তাহলে সেটা আরো বেশি করে দেয়া হয়, তখন আনন্দের অনুভূতিটা আরো বেড়ে যায়, তখন আরো বেশি স্টিমুলেশান দেয়া হয়। কাজেই মনের ভিতরের ছোট একটা আনন্দের অনুভূতি থেকে শুরু করে তীব্র একটা আনন্দ সৃষ্টি করা যায়। ভয়ঙ্কর তীব্র একটা আনন্দ যারা সেটা অনুভব করেছে শুধু তারাই জানে কী অসাধারণ সেই অনুভূতি!
জেনারেল রাউল তীক্ষ্ণ চোখে ক্রিটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ড্রাগসের মতো?
ক্রিটি থতমত খেয়ে বলল, কিসের মতো?
ড্রাগস। মাদকদ্রব্য। মানুষ যখন তার শিরার মাঝে সিরিঞ্জ দিয়ে ভিচুবিয়াস ঢুকিয়ে দেয় তখন তাদের যেরকম তীব্র আনন্দ হয় সেরকম?
ক্রিটি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, অনেকটা সেরকম। তবে মাদকদ্রব্যের সাথে এর একটা খুব বড় পার্থক্য রয়েছে, এতে কোনো নেশা হয় না। একবার স্বপ্ন মেশিন ব্যবহার করলে বার বার সেটা ব্যবহার করার জন্যে কেউ খেপে ওঠে না।
কেন?
কারণ এই তীব্র অনুভূতি সাময়িক নয়। এই অনুভূতি মস্তিষ্কে আনন্দের একটা পাকাঁপাকি ছাপ রেখে যায়। তাছাড়া মাদকদ্রব্যের মতো এই অনুভূতি শুধু এক ধরনের নয়। এই যন্ত্র দিয়ে আপনি যেকোনো ধরনের অনুভূতি পেতে পারেন। যদি মনের ভিতরে অল্প একটু পবিত্র ভাব জন্ম নেয় সেটা থেকে তীব্র গভীর একটা পবিত্র ভাব আসে। যদি এক ধরনের সুখের অনুভূতি হয় সেটা থেকে তীব্র একটা সুখের অনুভূতির জন্ম হয়। যদি কোনোভাবে মনের মাঝে অল্প একটু প্রশান্তির জন্ম হয় সেখান থেকে গভীর প্রশান্তির জন্ম দেয়া যায়। মনের ভিতরে যদি অল্প একটু আত্মবিশ্বাস তৈরি করে দেয়া যায় সেটা থেকে তৈরি হয় গভীর প্রচণ্ড একটা আত্মবিশ্বাস। অল্প একটু আশা থেকে বুকের ভিতরে নূতন। আশার বান ডেকে যায়। সেইসব অনুভূতি এত তীব্র যে তাকে বলা যায় সম্পূর্ণ নূতন এক ধরনের অনুভূতি। পৃথিবীর মানুষের সেই অনুভূতির সাথে পরিচয় নেই।
জেনারেল রাউল মাথা নেড়ে বললেন, বুঝেছি। এটা একটা অনুভূতি তীব্র করার যন্ত্র। কিন্তু এখনো বুঝতে পারলাম না কেন এর নাম স্বপ্ন মেশিন?
ক্রিটি একটু হেসে বলল, যখন মানুষেরা নানা দুঃখ কষ্ট হতাশায় ডুবে যায় তখন তারা এ রকম একটা যন্ত্রের কাছে আসে। এটা মাথায় লাগিয়ে বসে। তার ভিতরে তখন কোনোভাবে একটা ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করা হয়। ছোট একটা আশার বাণী বলা হয়। সেটা থেকে তার ভিতরে জন্ম নেয় বিশাল এক উৎসাহ। সত্যিকারের একটা স্বপ্ন জেগে ওঠে তার বুকে। মনে হয় সে জন্যেই এর নাম দিয়েছে স্বপ্ন মেশিন।
জেনারেল রাউল থমথমে মুখে খানিকক্ষণ বসে রইলেন তারপর জিজ্ঞেস করলে আপনাদের এলাকায় এ রকম যন্ত্র কয়টা রয়েছে?
আমি ঠিক জানি না। কীভাবে তৈরি করা যায় সেটা গোপন কিছু নয়, আমি সবাইকেই বলে দিই। ছোটখাটো জঞ্জাল থেকে তৈরি হয় বলে অসংখ্য যন্ত্র রয়েছে। তার মাঝে কিছু কিছু কাজ করে, কিছু করে না। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস দিয়ে সেটা পুষিয়ে নেয়।
জেনারেল রাউল হাত দিয়ে টেবিলের উপরে রাখা বিচিত্র যন্ত্রটাকে দেখিয়ে বললেন, এটা কি সত্যিকারভাবে কাজ করে?
করে।
আমাকে দেখাতে পারবেন?
ক্রিটি একটু অবাক হয়ে জেনারেল রাউলের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, আপনি সত্যি দেখতে চান?
হ্যাঁ, চাই।
ক্রিটি টেবিলের উপর থেকে হেলমেটের মতো একটা জিনিস তুলে জেনারেল রাউলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, প্রথমে এটা আপনার মাথায় পরতে হবে।
জেনারেল রাউল একটু ইতস্তত করে বললেন, না, প্রথমে আমি নিজে এটা পরতে চাই না। প্রথমে অন্য কাউকে দিয়ে পরীক্ষা করানো যাক।
রাউল ঘুরে নুবার দিকে তাকিয়ে বলল, কী বল নুবা?
নুবা মাথা নাড়ল, বলল, নিরাপত্তার দিক থেকে চিন্তা করে সেটা মনে হয় ঠিকই বলেছেন।
কাকে দিয়ে পরীক্ষা করানো যায়? 69
নুবা বলল, আপনার আপত্তি না থাকলে আমি এটা পরতে পারি। এটা সম্পর্কে এত চমৎকার সব রিপোর্ট এসেছে যে আমার এমনিতেই খুব কৌতূহল হচ্ছে।
জেনারেল রাউল নুবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি পরতে চাও?
জি জেনারেল। আপনি যদি আপত্তি না করেন।
জেনারেল রাউল মাথা নাড়লেন, বললেন, না, কোনো আপত্তি নেই।
নুবা ক্রিটির কাছাকাছি একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। ক্রিটি তার মাথায় হেলমেটটি পরিয়ে দেয়। সেটা ঠিকভাবে লাগানো হয়েছে কি না পরীক্ষা করে যন্ত্রটার একটা সুইচ অন করে দেয়। সাথে সাথে যন্ত্রের ভিতর থেকে একটা মৃদু গুঞ্জনের মতো শব্দ শোনা যেতে থাকে। ক্রিটি যন্ত্রের প্যানেলে কিছু একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করে নুবার দিকে তাকিয়ে সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, এখন তোমাকে মিষ্টি একটা ভাবনা ভাবতে হবে। সুখের বা আনন্দের কোনো স্মৃতি–
নুবা মাথা নাড়ল, ঠিক আছে।
বল, তোমার প্রিয় মানুষ কে?
আমার ছেলে। দু বছরের ছেলে।
কী করে তোমার ছেলে?
ছেলের কথা মনে করে নুবার মুখ হঠাৎ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে মৃদু হেসে কোমল গলায় বলল, এত দুষ্ট তুমি চিন্তা করতে পারবে না।
কী করে সে?
আমি যখন বাসায় যাই সাথে সাথে দরজার আড়ালে লুকিয়ে যায়। তখন আমাকে ভান করতে হয় তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমি তাকে ডাকাডাকি করি তখন হঠাৎ ছুটে বের হয়ে এসে পিছন থেকে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে–
তুমি কী কর?
আমি তাকে বলি ছাড় ছাড়, সে কিছুতেই ছাড়ে না, আমাকে ধরে ঝুলে থাকে–
ক্রিটি তার যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলল, ফিডব্যাক শুরু হয়ে গেছে। তোমার বাচ্চার কথা মনে করে তোমার ভিতরে আনন্দের যে অনুভূতি জন্ম হয়েছিল এখন সেটা বাড়তে থাকবে।
নুবার সারা মুখ হঠাৎ এক ধরনের বিস্ময়কর আনন্দের আভায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে সোজা হয়ে বসে এবং তার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করতে থাকে। সে ফিসফিস করে বলে, কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!
ক্রিটি আবার মৃদু গলায় বলল, ফিডব্যাকটা খুব চমৎকারভাবে শুরু হয়েছে। আমি বলতে পারি এটা একেবারে অনায়াসে দশ ডিবি চলে যাবে।
নুবার মুখে আনন্দ এবং ভালবাসার এমন একটি মধুর ছাপ পড়ল যে জেনারেল রাউল সেখান থেকে চোখ ফেরাতে পারলেন না। তিনি এক ধরনের ঈর্ষার দৃষ্টিতে নুবার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
নুবাকে প্রায় পনের মিনিট স্বপ্ন মেশিনে স্টিমুলেশান দেয়া হল। নব ঘুরিয়ে যখন ফিডব্যাক কমিয়ে নিয়ে এসে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হল তখনো তার মুখে বিস্ময়ের ছাপ লেগে রয়েছে।
জেনারেল রাউল নুবার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কেমন লাগছিল নুবা?
নুবা বুকের ভিতর থেকে একটা বড় নিশ্বাস বের করে বলল, আমি–আমি–আমি সেটা বোঝাতে পারব না। ভালবাসা আনন্দ আর সুখের এত তীব্র একটা অনুভূতি যে সেটা আমি কোনোদিন অনুভব করি নি। সাধারণ সুখ, আনন্দ ভালবাসা থেকে সেটা হাজার গুণ, লক্ষ গুণ বেশি। তীব্র। এত মধুর সেই অনুভূতি যে আমার মনে হচ্ছে আমি সারা জীবনের জন্যে পাল্টে গেছি।
মধুর অনুভূতি?
জি। আপনি যতক্ষণ নিজে এটা অনুভব না করছেন ততক্ষণ সেটা আপনাকে বোঝানো সম্ভব নয়। এই অনুভূতি এত তীব্র যে এটাকে বলা যায় সম্পূর্ণ নূতন একটা অনুভূতি। সেই অনুভূতি মানুষ এর আগে কোনোদিন অনুভব করে নি। যখন সেটা এসে ভর করে তখন মনে হবে আপনি বুঝি মানুষ নন, মানুষ থেকে উন্নত কোনো মহাজাগতিক প্রাণী, কিংবা স্বর্গের দূত বা সেরকম একটা কিছু। তাদের অনুভূতিও অন্য রকম–
জেনারেল রাউল হঠাৎ ঘুরে ক্রিটির দিকে তাকালেন, তারপর শক্ত গলায় বললেন, আমি নিজে এখন এটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
আপনি দেখবেন? ক্রিটি মৃদু হেসে বলল, এটা মাথায় পরবেন?
হ্যাঁ, পরব। জেনারেল রাউল তার চেয়ার ছেড়ে উঠে স্বপ্ন মেশিনের কাছাকাছি একটা চেয়ারে এসে বসলেন।
হেলমেটটি মাথায় পরে নেবার পর ক্রিটি ভালো করে সেটা একবার পরীক্ষা করে নিল। যন্ত্রটার উপর ঝুঁকে পড়ে সুইচটা অন করে দেবার সাথে সাথে আবার যন্ত্রের ভিতর থেকে একটা মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। ক্রিটি জেনারেল রাউলের দিকে তাকিয়ে কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, যদি ভালো একটা পাওয়ার সাপ্লাই পেতাম তাহলে যন্ত্রটাকে একেবারে শব্দহীন করে দেয়া যেত।
রাউল কোনো কথা বললেন না, মুখ শক্ত করে বসে রইলেন। ক্রিটি বলল, যন্ত্রটি কাজ করতে শুরু করেছে, এখন আপনাকে মধুর একটা জিনিস ভাবতে হবে। মধুর এবং আনন্দের এবং সুখের
হ্যাঁ, চেষ্টা করছি। রাউল তার চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বললেন, আমার বয়সে পৌঁছে গেলে স্মৃতি দুর্বল হয়ে যায়। সহজে কিছু মনে হতে চায় না।
ক্রিটি যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সেটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনার প্রিয়জনের কথা ভাবুন। আপনার সন্তান–আপনার স্ত্রী
স্ত্রী! জেনারেল রাউল চমকে উঠলেন–হঠাৎ করে তার স্ত্রীর কথা মনে পড়ে গেল। তার ভয়ঙ্কর স্ত্রী যে তার বিবাহিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কলুষিত করে রেখেছিল। ভয়ঙ্কর নিরানন্দ যন্ত্রণায় বিষাক্ত করে রেখেছিল। যে তাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত আর যাকে তিনি সমস্ত চেতনা দিয়ে ঘৃণা করতেন। জেনারেল রাউল অনেকদিন পর হঠাৎ করে তার ভিতরে আবার সেই সুপ্ত ঘৃণা, ক্রোধ এবং বিতৃষ্ণা অনুভব করলেন।
চমৎকারভাবে শুরু করেছেন। ক্রিটি উত্তেজিত গলায় বলল, দেখা যাচ্ছে আপনার ভিতরে খুব সতেজ একটা অনুভূতির জন্ম হয়েছে। এক্ষুনি ফিডব্যাক শুরু হবে। আপনি অনুভূতিটা ধরে রাখুন।
জেনারেল রাউল তার ভিতরে রাগ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, বিদ্বেষ এবং তার সাথে সাথে এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক অনুভব করতে থাকেন। বুঝতে পারেন আস্তে আস্তে রাগ ঘৃণা আর আতঙ্ক বাড়তে শুরু করেছে, তার চেতনাকে ঐচ্ছিন্ন করতে শুরু করেছে। বিচিত্র এই ভয়ঙ্কর অনুভূতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে কুৎসিত কালো ঘৃণায় তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠতে থাকে, প্রচণ্ড ক্রোধে তার শরীরে রক্ত ফুটতে থাকে। মানুষের প্রতি, জগৎ সংসারের প্রতি ভয়ঙ্কর বিদ্বেষ জীবন্ত কোনো প্রাণীর মতো তার চামড়ার নিচে কিলবিল করতে থাকে। সাথে সাথে বিজাতীয় এক আতঙ্ক তাকে গ্রাস করতে থাকে, যে আতঙ্কের ভয়াবহতার কোনো তুলনা নেই। মহাসমুদ্রের প্লাবনের মতো তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে শুরু করে–
জেনারেল রাউল ভয়ঙ্কর চোখে ক্রিটির দিকে তাকালেন–ক্রিটি মাথা নিচু করে তার যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই সাবধানে নবটি স্পর্শ করে বলল, দেখতে পাচ্ছি আপনার ফিডব্যাক শুরু হয়ে গেছে। বাড়িয়ে দিচ্ছি আমি, আপনার অনুভূতির তীব্রতা এখন বেড়ে যাবে বহুগুণ। হাজার লক্ষ বা আরো বেশি
ক্রিটি যন্ত্রের নবটাকে ঘুরিয়ে দিতেই জেনারেল রাউল এক ভয়ঙ্কর রক্ত–শীতল–করা আর্তনাদ করে জান্তব ক্ষিপ্রতায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। পশুর মতো চিৎকার করতে করতে মাথা কুটতে কুটতে তিনি দুই হাতে নিজের মুখের চামড়া খামচে ধরে নিজেকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলেন। জান্তব স্বরে গোঙাতে লাগলেন, বীভৎস ভঙ্গিতে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেন…
***
কয়েকদিন পর জেনারেল রাউলকে তার প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর দেয়ার খবরটি সংবাদপত্রে ছোট করে ছাপা হল।
কেন তাকে অবসর দেয়া হল সেটি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কোথাও ছাপা হল না।
নিউরন ম্যাপিং
লিলি, আমি জানি তুমি বিশ্বাস করবে না প্রফেসর খোরাসানী তার মাথার সাদা চুলকে হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে দিয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, কিন্তু আমার নিউরন ম্যাপিং যন্ত্র শেষ হয়েছে।
হৃতযৌবনা লিলি ক্লান্ত চোখে তার খ্যাপাটে এবং প্রায় বাতিকগ্রস্ত স্বামীর দিকে তাকালেন, তিনি আগেও অনেকবার তার মুখে এই কথা শুনেছেন, কাজেই কথাটি বিশ্বাস করবেন কি না বুঝতে পারলেন না। প্রফেসর খোরাসানী দুই পা এগিয়ে এসে তার স্ত্রীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় বললেন, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?
না। লিলি নিচু গলায় বললেন, আমি একবার তোমার কথা বিশ্বাস করে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম, আজ দেখ আমার কী অবস্থা!
তোমার এই অবস্থা দূর হয়ে যাবে লিলি।
আমি বিশ্বাস করি না–লিলি গলায় বিষ ঢেলে বললেন, তোমার কোনো কথা আমি বিশ্বাস করি না।
প্রফেসর খোরাসানী কাতর গলায় বললেন, বিশ্বাস কর লিলি, সত্যি আমার কাজ শেষ হয়েছে। যার জন্যে আমি আমার সারা জীবন নষ্ট করেছি, অপেক্ষা করে করে তুমি তোমার সারা জীবন শেষ করে এনেছ, সেই কাজ শেষ হয়েছে।
লিলি স্থির চোখে তার বৃদ্ধ স্বামীর দিকে তাকালেন, মুখের কুঞ্চিত চামড়া, নিষ্প্রভ চোখ, সাদা শণের মতো চুল– এই কি তার যৌবনের স্বপ্নরাজ্যের সেই রাজপুত্র? তার এখন আর বিশ্বাস হয় না। কিন্তু সত্যিই যদি এই অথর্ব বৃদ্ধ তার কাজ শেষ করে থাকে তাহলে কি তার সেই যৌবনের রাজপুত্র আবার তার কাছে ফিরে আসবে না? তিনি নিজেও ফিরে পাবেন তার হৃত যৌবন? লিলি বয়সের ভারে ন্যুব্জ দেহে হঠাৎ করে অনভ্যস্ত এক ধরনের উত্তেজনার শিহরন অনুভব করলেন।
খোরাসানী নিচু হয়ে তার স্ত্রীর শীর্ণ হাত ধরে বললেন, তুমি আমার জন্যে তোমার সারা জীবন নষ্ট করেছ লিলি। আমি তোমাকে সব ফিরিয়ে দেব। তোমার জীবন যৌবন সবকিছু।
লিলি জ্বলজ্বলে চোখে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, সত্যি?
সত্যি লিলি। এস আমার সাথে, আমি তোমাকে দেখাই।
প্রফেসর খোরাসানী স্ত্রীর হাত ধরে তাকে নিউরন ম্যাপিং মডিউলের সামনে নিয়ে গেলেন। কোথায় মাথাটি স্ক্যানারের নিচে রাখতে হয়, স্ক্যানার কীভাবে মস্তিষ্কের নিউরন স্ক্যান করে, কীভাবে তার ভিতরের সুষম সামঞ্জস্য খুঁজে বিশাল সম্ভাব্য সূত্রকে কমিয়ে আনে, কীভাবে সেটা কম্পিউটারের মেমোরিতে সাজিয়ে রাখা হয় এবং কীভাবে একজন মানুষের পুরো স্মৃতি, তার চিন্তাভাবনা, কল্পনা, স্বপ্ন–সাধ সবকিছু সরিয়ে যন্ত্রের মাঝে এনে বন্দি করে। রাখা যায় বুঝিয়ে দিলেন। মানুষের সেই স্মৃতি, সেই স্বপ্ন–সাধ, কল্পনা, ভালবাসা সবকিছু তখন বিপরীত একটা প্রক্রিয়ায় নূতন একজন মানুষের মস্তিষ্কে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়া যায়। লিলি বিজ্ঞানী নন, খোরাসানীর সব কথা তিনি বুঝতে পারলেন না, কিন্তু তবু ভাসা ভাসা ভাবে কীভাবে একজন মানুষের শরীরে অন্য একজন মানুষকে প্রবেশ করিয়ে দেয়া যায় তার মূল ভাবটা ধরে ফেললেন। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, তুমি সুন্দরী একজন যুবতী মেয়েকে এনে তার শরীরে আমাকে ঢুকিয়ে দেবে?
হ্যাঁ। খোরাসানী মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, তোমার মস্তিষ্কের নিউরন কীভাবে সাজানো আছে সেটা রেকর্ড করা থাকবে এই মেগা কম্পিউটারের বিশাল মেমোরিতে। সেই সাজানো নিউরনের সমস্ত তথ্য একটু একটু করে পৌঁছে দেয়া হবে সুন্দরী কমবয়সী একটা মেয়ের মাথায়। সেই মেয়েটা তখন একটু একটু করে হয়ে যাবে তুমি।
আর সেই মেয়েটা?
প্রফেসর খোরাসানী দুর্বল গলায় বললেন, মেয়েটা পাবে তোমার শরীর।
আমার শরীর? এই শরীর!
হ্যাঁ–তবে বেশিক্ষণের জন্যে নয়।
লিলি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বেশিক্ষণের জন্যে নয় কেন?
প্রফেসর খোরাসানী কঠোর মুখ করে বললেন, কেন এসব নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছ লিলি? মহৎ কিছুর জন্যে সব সময় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আমার আর তোমার জীবনের জন্যে সাধারণ দুজন মানুষ ত্যাগ স্বীকার করবে। আমি আর তুমি একজন সুদর্শন মানুষ আর একজন সুন্দরী মেয়ের শরীর নিয়ে নেব। যন্ত্রটা যেভাবে কাজ করে তার ফল হিসেবে সেই মানুষ আর মেয়েটি পাবে আমাদের শরীর। তারা চাইলেও পাবে, না চাইলেও পাবে! কিন্তু সেই শরীরে তাদের আটকে রেখে কী লাভ? সেটা হবে তাদের জন্যে একটা যন্ত্রণা
লিলির চোখ হঠাৎ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতে থাকে, তার মানে তাদেরকে তুমি মেরে ফেলবে?
প্রফেসর খোরাসানী বিরক্ত হয়ে বললেন, আহ লিলি, তুমি ঘুঁটিনাটি জিনিস নিয়ে বড় বেশি মাথা ঘামাও। সেই মানুষ দুটিকে নিয়ে কী করা হবে সেটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। যদি তুমি নূতন দেহ নিয়ে নূতন জীবন শুরু করতে চাও তাহলে আমার আর তোমার এই জীর্ণ দেহ নিয়ে অন্য কোনো মানুষকে ঘোরাঘুরি করতে দেয়া যাবে না লিলি। তাছাড়া
তাছাড়া কী?
তাছাড়া আমরা যদি কোনো দেহকে হত্যা করি সেটা হবে আমাদের নিজেদের দেহ। আত্মহত্যা করতে পারলে সেটা অপরাধ নয় লিলি। প্রচলিত আইনে এটা খুন নয়, এটা আত্মহত্যা!
লিলির চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতে থাকে। তিনি তার বুকের ভিতরে এক ধরনের শিহরন অনুভব করেন। একই সাথে আনন্দ এবং ভয়ের শিহরন!
.
প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি তাদের জন্যে যে দুজন মানুষকে বেছে নিলেন তাদের নাম যথাক্রমে জসিম এবং সুলতানা। জসিম চাকরিচ্যুত একজন যুবক, যে ওষুধের ফ্যাক্টরিতে কাজ করত, কয়দিন আগে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। সুলতানা মফস্বলের মেয়ে, চাকরির সন্ধানে শহরে এসেছে। খবরের কাগজে খোরাসানী এবং লিলি যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন সেটা পড়ে সে দেখা করতে এসেছিল। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল :
শহরের উপকণ্ঠে বৃদ্ধ দম্পতির দেখাশোনা করার জন্যে ২০–২৫ বছরের পুরুষ সাহায্যকারী এবং মহিলা পরিচারিকা প্রয়োজন। থাকা, খাওয়া, সাপ্তাহিক ছুটি এবং আকর্ষণীয় মাসিক ভাতা দেয়া হবে। পড়াশোনা অথবা অন্য কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলে ক্ষতি নেই তবে শারীরিক সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং পারিবারিক তথ্যসহ যোগাযোগ করুন।
বিজ্ঞাপন দেখে জসিম এবং সুলতানার মতো আরো অনেকেই যোগাযোগ করেছিল। খোরাসানী আর লিলি সেখান থেকে বেছে সুদর্শন এবং সুন্দরীদের আলাদা করে ডেকে পাঠালেন। যদিও তাদের সাথে গৃহ পরিচর্যা, রান্না–বান্না, স্বাস্থ্যবিধি এই ধরনের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হল কিন্তু তাদের প্রকৃত নজর ছিল এই যুবক এবং যুবতীদের শরীরের দিকে। অন্য সময় হলে কমবয়সী এই যুবক–যুবতীর সুন্দর সুঠাম দেহ দেখে তারা এক ধরনের ঈর্ষা অনুভব করতেন, কিন্তু এখন ঈর্ষার বদলে তাদের ভিতরে সূক্ষ্ম আত্মপ্রসাদের বোধ জেগে উঠছিল। আর কয়দিনের মাঝেই এই দেহগুলোর কোনো–কোনোটি হবে তাদের। ব্যাপারটা এখনো তারা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি অন্য অনেকের মাঝে থেকে জসিম এবং সুলতানাকে বেছে নিলেন তাদের পারিবারিক অবস্থার জন্যে। তারা দুজনেই আত্মীয়–পরিজনহীন, দুজনেই নিঃসঙ্গ এবং পরিচিত জগৎ থেকে এই দুজন হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেলে খুব বেশি মানুষ তাদের জন্যে বিচলিত হবে না। জসিম এবং সুলতানাকে ডাক্তার দিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করিয়ে খোরাসানী এবং লিলি তাদের নিজেদের বাসায় উঠে আসতে বললেন।
নিউরন ম্যাপিং শুরু করার জন্যে প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি আরো মাসখানেক সময় নিলেন। জসিম এবং সুলতানার দৈনন্দিন কাজকর্ম তারা ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন, নূতন পরিবেশে দুজনেই চমৎকারভাবে মানিয়ে নিয়েছে। খোরাসানী এবং লিলি একা একা জীবন কাটিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন, কাজেই জসিম এবং সুলতানার কাছে তাদের দাবি ছিল খুব কম।
নিউরন ম্যাপিঙের জন্যে শেষ পর্যন্ত যে দিনটি বেছে নেয়া হল সেটি ছিল একটি বর্ষণমুখর রাত, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে, বিজলি চমকে চমকে উঠছে, বাতাসের ঝাঁপটায় জানালা কেঁপে কেঁপে উঠছে। জসিম আর সুলতানার রাতের খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা ঘুমে অচেতন হয়ে থাকলে দীর্ঘ সময়।
খোরাসানী আর লিলি নিউরন ম্যাপিং যন্ত্রটি চালু করে জসিম এবং সুলতানাকে আনতে গেলেন। জসিমের ঘরে উঁকি দিয়ে তারা আবিষ্কার করলেন ঘরটি শূন্য। ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়া শুরু হবার আগেই নিশ্চয়ই কোথাও গিয়েছে। দুজনে সুলতানার ঘরে এসে আবিষ্কার করলেন সেখানে জসিম এবং সুলতানা আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ঘুমোচ্ছে। নিসঃঙ্গ দুজন তরুণ–তরুণীর মাঝে যে এক ধরনের ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টি হয়েছে তারা সেটি আঁচ করতে পেরেছিলেন কিন্তু সেই ঘনিষ্ঠতা কোন পর্যায়ে গিয়েছে তারা বুঝতে পারেন নি। খোরাসানী এবং লিলি দুজনে মিলে সুলতানাকে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে ধরাধরি করে উপরে নিয়ে এলেন। নিউরন ম্যাপিং যন্ত্রের নিচে রাখা বড় ট্রলিতে শুইয়ে রেখে তাকে স্ট্র্যাপ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিলেন। পাশাপাশি অন্য একটি ট্রলিতে লিলি শুয়ে পড়লেন। খোরাসানী তাকেও স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধতে গেলেন, লিলি আপত্তি করে বললেন, আমাকে বাধছ কেন?
খোরাসানী মৃদু হেসে বললেন, তুমি যদি সবসময় তুমিই থাকতে আমার বাঁধার দরকার ছিল না। কিন্তু খানিকক্ষণ পর তোমার শরীরে ওই মেয়েটি এসে হাজির হবে–তখন সে এটা মেনে নেবে না, ছটফট করবে, চিৎকার করে বাধা দেবে
লিলি মাথা নাড়লেন, বললেন, তা ঠিক। বাধ, আমাকেই তাহলে শক্ত করে বাঁধ!
খোরাসানী শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে বললেন, তোমাকে আমি অনেকবার দেখিয়েছি কী করতে হবে, আমার নিজের বেলায় পুরো ব্যাপারটা করতে হবে তোমার। মনে আছে তো?
মনে আছে।
তখন তোমার অবশ্যি থাকবে নূতন শরীর!
তা ঠিক–লিলি লোভাতুর দৃষ্টিতে ট্রলিতে শুইয়ে রাখা সুলতানার শরীরের দিকে তাকালেন, একটু পরেই সেটা তিনি পেয়ে যাবেন সেটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
খোরাসানী তার যন্ত্রপাতির প্যানেলে ঝুঁকে পড়লেন, মনিটরের দিকে তাকিয়ে সুইচ স্পর্শ করতেই নিউরন ম্যাপিঙের যন্ত্রটা একটা ভোতা শব্দ করে কাজ করতে লাগল। তিনি তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, চোখ বন্ধ করে নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে, সেখানে নিশ্চয়ই এখন সুলতানা এসে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। মেয়েটি যখন সেটা বুঝতে পারবে কী করবে কে জানে? খোরাসানী জোর করে চিন্তাটা তার মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে সুলতানার দেহের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আর কিছুক্ষণেই এই শরীরটি হবে তার স্ত্রীর। খোরাসানী জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকেন, অনভ্যস্ত উত্তেজনায় তার শরীরে শিহরন বয়ে যেতে থাকে।
পুরো ব্যাপারটি শেষ হতে হতে প্রায় ভোররাত হয়ে গেল। খোরাসানী এবং লিলি কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই জসিম আর সুলতানার শরীরে স্থানান্তরিত হয়েছেন, ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত হওয়া দূরে থাকুক তারা এখনো সেটা বিশ্বাসই করতে পারছেন না। তারা অবাক বিস্ময়ে নিজেদের দেখছেন, কিছুক্ষণ আগেও যখন দু পা যেতেই তারা হাঁপিয়ে উঠতেন এখন হঠাৎ করে সমস্ত শরীরে এসে ভর করেছে এক বিস্ময়কর সজীবতা, অচিন্তনীয় শক্তি। নির্জীব দেহের বদলে প্রাণশক্তিতে ভরপুর তাজা তরুণ দেহ, তার মাঝে হঠাৎ করে আবিষ্কার করছেন এক ধরনের শারীরিক কামনা। তারা একজন আরেকজনকে দেখে একটু পরে পরে চমকে উঠছেন, তারপর ভুল বুঝতে পেরে নিজেরাই খিলখিল করে হেসে উঠছেন।
জ্ঞান ফিরে পাবার পর খোরাসানী এবং লিলির দেহে জসিম আর সুলতানা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সুলতানার দেহে লিলিকে দেখে জসিম খোরাসানীর শরীরের ভিতর থেকে কাতর গলায় ডেকে বলল, সুলতানা, আমার কী হয়েছে? আমাকে বেঁধে রেখেছে কেন?
লিলি সুলতানার দেহ নিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, আমি তোমার সুলতানা নই!
তাহলে সুলতানা কই?
লিলি তার এককালীন শীর্ণ দেহটি দেখিয়ে বললেন, ওই যে তোমার সুলতানা! তোমার ভালবাসার মেয়ে।
খোরাসানীর দেহটি লিলির শীর্ণ দেহটি দেখে চমকে উঠে মাথা নেড়ে বলল, কী বলছ তুমি?
ঠিক এ রকম সময় খোরাসানী একটা সিরিঞ্জে করে খানিকটা বিষ নিয়ে এলেন। তীব্র বিষ, রক্তের সাথে মিশে গেলে কিছুক্ষণের মাঝেই শরীরের স্নায়ু বিকল হয়ে দেহ অসাড় হয়ে যাবে, হৃৎপিণ্ড থেমে যাবে। খোরাসানীকে দেখে জসিম ভয়ানক চমকে উঠল, আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, কারণ সেটি তার নিজের শরীর। সে হতচকিত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দুর্বল গলায় বলল, তুমি কে?
খোরাসানী মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, আমি হচ্ছি তুমি। কিংবা যদি ইচ্ছে কর তাহলে বলতে পার তুমি হচ্ছ আমি।
জসিম খোরাসানীর দেহ থেকে বিভ্রান্ত শূন্য দৃষ্টিতে নিজের দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। খোরাসানী বললেন, পুরো ব্যাপারটা তোমার পক্ষে বোঝা কঠিন। কাজেই ধরে নাও এটা হচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। আমি তোমাকে একটা ইনজেকশান দিচ্ছি, তুমি তাহলে দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে।
খোরাসানী সিরিঞ্জ নিয়ে এগিয়ে এলেন, জসিম তার রুগণ দুর্বল দেহে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু লাভ হল না, তার শিরার মাঝে ভয়ঙ্কর একটি বিষ প্রবেশ করিয়ে দেয়া হল।
সিরিঞ্জে বিষ ভরে খোরাসানী যখন লিলির শীর্ণ দেহে আটকে থাকা সুলতানার দিকে এগিয়ে গেলেন সে কাতর গলায় বলল, এটা কি সত্যি? নাকি মিথ্যা?
লিলি বললেন, তোমার কী মনে হয়?
মিথ্যা! নিশ্চয়ই মিথ্যা!
লিলি খিলখিল করে হেসে উঠলেন, বললেন, নাগো ঘাগী বুড়ি,! এটা মিথ্যা না! এটা সত্যি
খোরাসানী যখন লিলির শীর্ণ হাতের একটি শিরায় বিষ প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছিলেন সেই দেহে আটকে থাকা সুলতানা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে ছিল আতঙ্ক, অবিশ্বাস এবং গম্ভীর হতাশা।
.
খোরাসানী এবং লিলির দেহ–যে দেহ দুটিতে জসিম এবং সুলতানার মৃত্যু ঘটেছে, খোরাসানী এবং লিলি তাদের নিজেদের বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলেন। পুরো ব্যাপারটিকে জোড়া আত্মহত্যা হিসেবে দেখাতে হবে, আগে থেকে তার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। আত্মহত্যার আগে লিখে যাওয়া চিঠিটা অনেক আগেই লিখে রাখা হয়েছে, গুছিয়ে লেখা চিঠি, মৃত্যুর পরে সেটা প্রকাশ করার কথা। সুদীর্ঘ চিঠি, সেটা শুরু হয়েছে এভাবে : “আমি এবং আমার স্ত্রী জীবনের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের শরীর দুর্বল, জীবনীশক্তি তার শেষ বিন্দুতে এসে পৌঁছেছে। দৈনন্দিন কাজও আমরা আর নিজেরা করতে পারি না, এক একটি দিন এখন আমাদের জন্যে এক একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমাদের জীবনকে এভাবে টেনে নিতে নিতে আমরা আজ সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তাই অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করেছি পৃথিবী থেকে আমরা বিদায় নেব সম্মানের সাথে। আমরা দুজন একজন আরেকজনের জীবনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গিনী হিসেবে কাটিয়ে এসেছি, পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার সময়েও আমরা একজন আরেকজনের হাত ধরে বিদায় নেব।….”
চিঠির পরের অংশে কীভাবে আত্মহত্যা করবে তার বর্ণনা দেয়া আছে। মৃত্যু নিয়ে দার্শনিক কথাবার্তা আছে, ব্যাপারটিকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করা আছে। সুন্দর করে লেখা হয়েছে, পড়তে গিয়ে চোখের কোনায় পানি এসে যেতে পারে। চিঠির শেষ অংশে জসিম আর সুলতানার কথা লেখা এভাবে :
“মৃত্যুর আগে আগে আমরা জসিম আর সুলতানাকে এনেছিলাম আমাদের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার জন্যে। তারা দুজন আমাদের দুই অথর্ব বৃদ্ধ–বৃদ্ধার দিকে ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। বেশিদিন আমরা তাদের ভালবাসার স্পর্শ নিতে পারি নি কিন্তু যেটুকু নিয়েছি তাতে মুগ্ধ হয়েছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তাদের জীবন সুন্দর হোক। আমাদের যৎকিঞ্চিত সম্পত্তি, বাড়িঘর তাদের দান করে গেলাম– দুজনে এটি দিয়ে যেন তাদের জীবন শুরু করতে পারে। পৃথিবী থেকে বিদায়। সবার জন্যে রইল প্রাণভরা ভালবাসা।….”
চিঠির নিচে প্রফেসর খোরাসানী এবং লিলি পরিষ্কার করে স্বাক্ষর দিয়েছেন, আজকের তারিখ লিখে দিয়েছেন।
চিঠিটা ভাঁজ করে টেবিলের পাশে রাখা হল, তার কাছে রাখা হল, বিষ–মাখানো ইনজেকশানের সিরিঞ্জ। খোরাসানী এবং লিলির দেহ শুইয়ে রেখে চাদর দিয়ে বুক পর্যন্ত ঢেকে দেয়া হল, হাতগুলো বুকের উপর ভাজ করে রাখা, চোখ দুটি বন্ধ।
সবকিছু শেষ করে জসিম এবং সুলতানার দেহে খোরাসানী এবং লিলি মাত্র অভ্যস্ত হতে শুরু করেছেন ঠিক সেই মুহূর্তে নিচে দরজায় শব্দ হল, সাথে সাথে দুজনেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে, এই সময়ে কে আসতে পারে?
খোরাসানী এবং লিলি একজন আরেকজনের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকালেন এবং ঠিক তখন দরজায় আবার শব্দ হল, এবারে আগের থেকেও জোরে। খোরাসানী পা টিপে টিপে নিচে এসে উঁকি দিলেন, বাইরে বেশ কয়জন পুলিশ শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। খোরাসানী আবার চমকে উঠলেন, এত রাতে পুলিশ কেন এসেছে? দরজায় আবার শব্দ হল, খোরাসানী নিজেকে সামলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
দরজা খোলার আগে খোরাসানী একবার লিলির দিকে তাকালেন, লিলি দরজা ধরে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দুর্বলভাবে হেসে খোরাসানীকে একটু সাহস দেবার চেষ্টা করলেন।
দরজা খোলার সাথে সাথে প্রায় হুড়মুড় করে ভিতরে পুলিশগুলো ঢুকে পড়ল, অফিসার ধরনের একজন খোরাসানীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি জসিম?
খোরাসানীর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল অপমান এবং ক্রোধ, তিনি একজন সম্মানী, বিজ্ঞানী, এর আগে কেউ তাকে এভাবে হেয় করে সম্বোধন করে নি। কিন্তু তিনি দ্রুত তার অপমান এবং ক্রোধকে নিবৃত্ত করে নিলেন কারণ তিনি আর প্রফেসর খোরাসানী নন, সত্যিই তিনি জসিম, একজন পরিচারক। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ আমি জসিম।
সাথে সাথে একজন কনস্টেবল তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল, তিনি আর্তনাদ করে বললেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে?
কী হয়েছে জান না? পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বললেন, ফাজলামোর আর জায়গা পাও না?
আরেকজন কনস্টেবল বলল, স্যার মেয়েছেলেটাকেও বাঁধব?
হ্যাঁ, হ্যাঁ বেঁধে ফেল, ছেড়ে দিও না যেন।
কিছু বোঝার আগেই লিলিকে, যে সুলতানার দেহে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, হাতকড়া দিয়ে বেঁধে ফেলা হল। লিলি ভয়ার্ত গলায় বললেন, কী হয়েছে? কী করেছি আমরা?
পুলিশ অফিসারটি মুখ ভ্যাংচে বললেন, ন্যাকামো দেখে মরে যাই! কিছু যেন জানে না। এক সপ্তাহ থেকে তোমাদের ওয়াচ করা হচ্ছে।
আমাদের? খোরাসানী কাঁপা গলায় বললেন, ওয়াচ করা হচ্ছে?
হ্যাঁ। যখন দেখেছি প্রফেসর সাহেবের বাড়ির জিনিসপত্র চুরি করে বিক্রি করা শুরু করেছ সাথে সাথে তোমাদের পিছু লোক লাগানো হয়েছে! আজ যখন বিষ কিনলে
বিষ? আ–আ–আমি বিষ কিনেছি?
পুলিশ অফিসার প্রফেসর খোরাসানীর সাথে কথা বলার কোনো উৎসাহ দেখালেন না, একজনকে বললেন, যাও দেখি, প্রফেসর সাহেবকে ডেকে আন, তার জিনিসপত্র চিনে নিন।
কনস্টেবলটি ভিতরে চলে গেল, পুলিশ অফিসার তার হাতের ব্যাগ থেকে কিছু জিনিসপত্র বের করে টেবিলে রাখতে লাগলেন, ঘড়ি আংটি ছোটখাটো সোনার গয়না। প্রফেসর খোরাসানী চিনতে পারলেন এগুলো তার এবং লিলির। জসিম এবং সুলতানা গোপনে বিক্রি করেছে?
ঘরের ভিতর থেকে হঠাৎ ভয়ার্ত গলার স্বর শোনা গেল, কনস্টেবলটি ছুটতে ছুটতে এসে বলল, স্যার! সর্বনাশ হয়ে গেছে!
পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে?
মেরে ফেলেছে।
মেরে ফেলেছে?
জি স্যার, দুজনকেই। প্রফেসর খোরাসানী আর তার স্ত্রী। দুজনেই ডেড।
পুলিশ অফিসার রক্তচোখে খোরাসানীর দিকে তাকালেন, তারপর হিসহিস করে বললেন, স্কাউনড্রেল! মার্ডারার!
খোরাসানী শুষ্ক গলায় বললেন, এটা আত্মহত্যা। এটা মার্ডার না। আপনি দেখেন খোঁজ নিয়ে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি– আমি জানি। দেখেন চিঠি লেখা আছে—
পুলিশ অফিসার চোখ ঘোট ঘোট করে বললেন, আর চিঠিতে কী লেখা আছে বলব?
কী?
লেখা আছে সমস্ত সম্পত্তি তোমাদের দিয়ে গেছেন, তাই না?
খোরাসানী হঠাৎ তার সজীব দেহ নিয়েও দুর্বল অনুভব করতে থাকেন। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন, কি–কি–কিন্তু
তোমাদের মতো কেস আমরা অনেক দেখেছি। বুড়ো স্বামী–স্ত্রীকে মেরে বলবে আত্মহত্যা, দেখা যাবে চিঠিতে লিখা সমস্ত বাড়িঘর লিখে দিয়ে গেছে। আমরা কি কচি খোকা, নাকি আমাদের নাক টিপলে দুধ বের হয়?
খোরাসানী কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন। পুলিশ অফিসার ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে বললেন, শুধু যে সম্পত্তি দিয়ে চিঠি লিখে গেছে তাই না, হাতের লেখাটাও তোমার! তাই না?
প্রফেসর খোরাসানী মাথা নাড়লেন, না!
দেখি একটা কাগজ দাও দেখি, পুলিশ অফিসার একজন কনস্টেবলকে ডেকে বললেন, এই ব্যাটা ধড়িবাজের হাতের লেখার একটা নমুনা নিয়ে নিই!
প্রফেসর খোরাসানীর হাতকড়া খোলা হল, তাকে একটা কাগজ আর কলম দেয়া হল, পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বললেন, লেখ।
কী লিখব?
তোমার নাম লেখ।
প্রফেসর খোরাসানী অন্যমনস্কভাবে নিজের নাম স্বাক্ষর করলেন এবং হঠাৎ করে তার মনে পড়ল আত্মহত্যার চিঠিতে এই নাম হুবহু এভাবে স্বাক্ষর করা আছে। নিজের অজান্তে তিনি মৃত্যু পরোয়ানাতে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন!
ঘণ্টাখানেক পর দেখা গেল পুলিশের গাড়িতে করে জসিম এবং সুলতানা নামের দুজন কমবয়সী তরুণ–তরুণীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কেউ জানতে পারল না প্রফেসর খোরাসানী এবং তার স্ত্রী লিলিকে হত্যা করার জন্যে প্রফেসর খোরাসানী এবং তার স্ত্রীকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
ব্যাংক ডাকাত
দেয়াল টপকে সাবধানে ভিতরে নামল কাসেম, চোখে ইনফ্রারেড চশমা লাগানো, অন্ধকারেও সে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। যে রবোটটা পাহারায় আছে তার হাতে নাকি কয়েক ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থাকে। হঠাৎ করে তার হাতে ধরা পড়তে চায় না। কয়েক মুহূর্ত সে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কোথাও কোনো শব্দ নেই, মনে হয় কেউ তাকে লক্ষ করে নি। কাসেম সাবধানে তার ছোট রেডিওটা বের করে, প্রথমে পুরো ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জটা পরীক্ষা করে নেয়, চল্লিশ মেগাহার্টজের কাছে একটা ভোতা শব্দ শুনতে পেল– সম্ভবত পাহারাদার রবোটটা এই ফ্রিকোয়েন্সিটাই ব্যবহার করছে, কাসেম নব ঘুরিয়ে একটা নিরাপদ ফ্রিকোয়েন্সি বের করে ফিসফিস করে ডাকল, বদি–
দেয়ালের অন্য পাশে বেশ কিছু দূরে একটা গাছের আড়ালে বদি দাঁড়িয়ে ছিল, সে ফিসফিস করে বলল, কী খবর ওস্তাদ? সব ঠিকঠাক?
হ্যাঁ। আগে যন্ত্রপাতি পাঠা—
পাঠাচ্ছি।
কাসেমের কোমরে একটা শক্তিশালী অটোমেটিক রিভলবার ঝুলছে, টেফলন কোটেড বুলেট, এক গুলিতেই বড় জখম করে দিতে পারে। তবু ভারি অস্ত্র হাতে না আসা পর্যন্ত সে স্বস্তি পাচ্ছে না। এই ব্যাংকটার পাহারায় যে রবোটটা রয়েছে সেটি নাকি বিশেষ উন্নত শ্রেণীর, লেজার লক না করে তাকে কাবু করা শক্ত।
বদি বাইরে থেকে নাইলনের কর্ডে করে ভারি অস্ত্রগুলো বেঁধে দিল, কাসেম ভিতরে দাঁড়িয়ে সাবধানে সেগুলো ভিতরে টেনে আনতে থাকে। অস্ত্রের পর প্রাষ্টিক এক্সপ্লোসিভ এবং যন্ত্রপাতির বাক্স। কাসেম দক্ষ হাতে অস্ত্রগুলো বের করে সাজিয়ে নেয়, এখন মোটামুটি সবকিছু হাতের কাছে আছে, হঠাৎ করে ধরা পড়ার ভয় নেই। কাসেম তার ইনফ্রারেড চশমায় চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে তার রেডিওতে মুখ লাগিয়ে নিচু গলায় বলল, বদি
কী হল?
ভিতরে চলে আয় এখন। সব ক্লিয়ার।
ঠিক আছে।
দুই মিনিট পরে বদিও ঝুপ করে কাসেমের পাশে এসে নেমে পড়ল। তার সারা শরীরে কালো পোশাক, ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে হঠাৎ করে দেখা যায় না। হাঁটুতে বেঁধে রাখা রিভলবারটা খুলে হাতে নিতে নিতে বলল, শালার রবোটটাকে নিয়ে ভয়।
কাসেম নিচু গলায় বলল, কোনো ভয় নাই। প্রথম ধাক্কায় যদি ধরা না পড়িস তাহলে কোনো ভয় নাই। মোশান ডিটেক্টরগুলো ছড়িয়ে দিতে থাক, আমি আছি।
বদি ঘাড়ে–ঝোলানো প্যাকেট থেকে ছোট ছোট মোশান ডিটেক্টরগুলো বের করে চারপাশে ছড়িয়ে দিতে থাকে। দশ মিটার রেঞ্জের মোশান ডিটেক্টর, আশপাশে কোনোকিছু নড়লেই তাদের সতর্ক করে দেবে।
কাসেম কানে হেডফোন লাগিয়ে মোশান ডিটেক্টরগুলোর সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করে নেয়, অযথা প্রতিটি ঘাসফড়িংকে খুঁজে বের করে সময় নষ্ট করার কোনো অর্থ হয় না। পাহারাদার রবোটটা হঠাৎ করে হাজির না হলেই হল।
বদি বাক্স খুলে যন্ত্রপাতি বের করতে করতে বলল, এইসব যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের আগে মানুষ ব্যাংক ডাকাতি করত কীভাবে?
কাসেম অন্ধকারে দাঁত বের করে হেসে বলল, আগের যুগের মানুষের বুকের পাটা ছিল। বন্দুক নিয়ে ব্যাংকে ঢুকে যেত, বলত টাকা দাও নইলে গুলি!
সর্বনাশ! ধরা পড়লে?
ধরা পড়লেও গুলি। যদি গুলি না খেয়ে ধরা পড়ে তাহলে চোখ বন্ধ করে আট বছর।
কী সর্বনাশ!
তবে অনেক ওস্তাদ লোক ছিল। কায়দা করে গয়নার দোকান সাফ করে দিত, ব্যাংক লোপাট করে দিত। সেই যুগের মানুষের মাথায় মালপানি ছিল।
বদি প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ বের করতে করতে বলল, আমরাই খারাপ কী? মাসে একটা করে দাও মারছি!
কাসেম তার ইনফ্রারেড চশমা দিয়ে দরজাটা পরীক্ষা করতে করতে বলল, কিসের সাথে কিসের তুলনা। আমি যার কাছে কাজ শিখেছি তার নাম লোকমান ওস্তাদ। তার তুলনায় তুই হচ্ছিস গাধা।
কাসেমের কথায় বদি একটু অসন্তুষ্ট হলেও সে কিছু বলল না। সে এখন কাসেমের কাছে কাজকর্ম শিখছে, যন্ত্রপাতি ব্যবহার শিখে গেলে নিজের দল খুলবে, যতদিন সেটা না হচ্ছে কাসেমের হেনস্থা একটু সহ্য করতেই হবে। বড় একটা দাও মারতে পারলে যন্ত্রপাতির খরচটা উঠে আসবে, সে আশায় কাসেমের সাথে সাথে আজকের অপারেশনটাতে এসেছে।
কাসেম ম্যাগনেটিক ফ্লিপার দিয়ে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে গিয়ে দরজার কজা খুঁজে বের করতে থাকে, সেখানে পরিমাণ মতো প্রাষ্টিক এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল, বদি
কী হল ওস্তাদ?
ডাক্ট টেপ দে দেখি।
কেন?
এক্সপ্লোসিভটা ঢেকে দিই। ভাইব্রেশানে পড়ে না যায়।
অন্ধকারে বদি কাসেমের হাতে একটা রোল ধরিয়ে দিতেই কাসেম ধমক দিয়ে বলল, এটা কী দিচ্ছিস?
ডাক্ট টেপ।
এটা কি ডাক্ট টেপ হল নাকি গাধা? এটা হচ্ছে ডাবল স্টিকি। তোর মাথায় কি ঘিলু নেই? নাকি যা আছে তা হাঁটুতে?
বদি গালি খেয়ে একটু সঙ্কুচিত হয়ে গেল, ভাগ্যিস আশপাশে কেউ নেই। কাসেমের কথা বলার ধরন খুব খারাপ, নেহাত কাজকর্ম জানে বলে গালমন্দ খেয়েও কোনোভাবে টিকে আছে। একজন মানুষকে বলা তার মস্তিষ্ক হচ্ছে হাঁটুতে– কী পরিমাণ অপমানজনক কথা সেটা কখনো ভেবে দেখেছে?
কাসেম উপর থেকে বলল, ড্রিলটা দে দেখি।
বদি ড্রিলটা এগিয়ে দেয়।
কোন বিট লাগিয়েছিস? ছয় নম্বরতা?
জি। ছয় নম্বর।
ড্রিলটা চালু করেই কাসেম খেঁকিয়ে উঠল, গাধার বাচ্চা গাধা, এটা ছয় নম্বর বিট হল? তোর ঘিলু আসলেই হাঁটুতে–
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ড্রিলের বিট পাল্টাতে পাল্টাতে হঠাৎ বদি শঙ্কিত গলায় বলল, ওস্তাদ!
কী হল?
বদি ফিসফিস করে বলল, মোশান ডিটেক্টরে মোশান ধরা পড়েছে। কেউ একজন আসছে–
কাসেম তার গলা থেকে ঝোলানো মাইক্রোওয়েভ জেমিং ডিভাইসটা টেনে নেয়। চুরি ডাকাতির জন্যে এই জিনিসটির কোনো তুলনা হয় না। ছোট একটা এলাকায় মাইক্রোওয়েভ দিয়ে ভাসিয়ে দেয়া হয়। সেখানকার রবোট, কম্পিউটার কমিউনিকেশান মডিউল সবকিছু পুরোপুরি অচল হয়ে যায়। কাসেম ইনফ্রারেড চশমায় চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে মাইক্রোওয়েভ জেমিং ডিভাইসটি হাতে নিয়ে প্রস্তুত থাকে।
তারা যে ব্যাংকের দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছে তার পিছন দিক দিয়ে রবোটটিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। হাতে একটা অটোমেটিক রাইফেল, সেটাকে লাঠির মতো ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে আনছে। রবোটটির ভঙ্গিতে সতর্কতার এতটুকু চিহ্ন নেই। কাসেম রবোটটার দিকে তাকিয়ে থেকে জেমিং ডিভাইসটির বোম চেপে ধরে এবং সাথে সাথে রবোটটি পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে যায়। শুধু একটা হাত অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে থাকে।
বদি হাতে কিল দিয়ে বলল, ধরেছ সোনার চাঁদকে।
কাসেম দাঁত বের করে হেসে মাইক্রোওয়েভ জেমিং ডিভাইসটাকে সশব্দে চুমু খেয়ে বলল, এই জিনিস না থাকলে আমাদের বিজনেস লাটে উঠত। যা বদি, দাঁড়িয়ে থাকিস না, রবোটের বাচ্চাকে ডিজআর্ম কর আগে।
বদি সাবধানে এগিয়ে গিয়ে রবোটটার হাত থেকে রাইফেলটা কেড়ে নিল। এতক্ষণে রবোটের হাতের কম্পন খানিকটা কমেছে কিন্তু এখনো সমস্ত শরীর থেকে থেকে কেঁপে উঠছে এবং গলা দিয়ে মাঝে মাঝেই একটা বিচিত্র শব্দ বের হচ্ছে।
কাসেম দরজার উপর থেকে নেমে আসে, কাছাকাছি এসে পিঠে ঝোলানো শক্তিশালী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা রবোটের দিকে তাক করে জেমিং ডিভাইসের সুইচ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। সাথে সাথে রবোটটা নিজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল, সে ঘাড় ঘুরিয়ে দুজনকে দেখল এবং কণ্ঠস্বরে এক ধরনের উৎফুল্ল ভাব ফুটিয়ে নিয়ে বলল, শুভ সন্ধ্যায় আপনারা নিশ্চয়ই ব্যাংক ডাকাত।
কাসেম অস্ত্রটা সোজাসুজি তাক করে রেখে বলল, তুমি নিশ্চয়ই কোনো খবর পাঠানোর চেষ্টা করছ না? পুরো কমিউনিকেশান্স চ্যানেল জ্যাম করে রেখেছি।
রবোটটা খুশি খুশি গলায় বলল, সেটা আমিও লক্ষ করেছি।
তোমাকে এখন আমরা কাবাব বানিয়ে ছেড়ে দেব।
রবোটটি দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো এক ধরনের শব্দ করে বলল, তার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনারা ইতিমধ্যে আমার অস্ত্রটা নিয়ে নিয়েছেন, জ্যামিং ডিভাইস দিয়ে সবকিছু জ্যাম করে রেখেছেন এখন আমার মাঝে আর একটা কলাগাছের মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই।
না থাকুক–কাসেম এক হাতে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে খুব কায়দা করে ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, ডাকাতি লাইনের প্রথম কথাই হচ্ছে সাবধানের মার নেই। তোমাকে এক্ষুনি কাবাব বানিয়ে ছেড়ে দেব।
রবোটটি করুণ গলায় বলল, ছেড়ে দেন স্যার। অনেকদিনের রবোট, অনেক স্মৃতি জমা আছে সব শেষ হয়ে যাবে।
বদি নিচু গলায় বলল, ছেড়ে দেন ওস্তাদ! এত করে বলছে–
চুপ ব্যাটা গর্দভ–কাসেম রেগে গিয়ে বলল, তোর মাথার ঘিলু আসলেই হাঁটুতে। এই রকম একটা রবোটের মাঝে কী পরিমাণ কমিউনিকেশানের ব্যবস্থা আছে জানিস? ইচ্ছা করলে সারা দুনিয়াতে খবর পাঠিয়ে দিতে পারে।
রবোটটা বলল, সত্যি কথা স্যার। কিন্তু আপনারা তো সেটা করতে দিচ্ছেন না। আপনারা তো আমার সবকিছু জ্যাম করেই রেখেছেন–
ঘ্যান ঘ্যান কোরো না, চুপ কর। কাসেম সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, তোমার সময় শেষ। যদি চাও তো খোদাকে ডাকতে পার।
রবোটটা অবশ্যি খোদাকে ডাকার কোনো চেষ্টা করল না, বেঢপ একটা ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে রইল
কাসেমের প্রথম গুলিতে রবোটের মাথাটা চূর্ণ হয়ে উড়ে গেল। সেটা কয়েকবার দুলে পড়তে পড়তে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুণ্ডহীন একটা রবোটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা খুব বিচিত্র–বদির খুব অস্বস্তি হতে থাকে। সে গলা নামিয়ে বলল, এই শালা কি এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে?
মনে হয়।
একেবারে শেষ কর দিলে হয় না?
শেষ তো হয়েই গেছে। ইচ্ছে হলে দে আরো বারটা বাজিয়ে।
বদি তার হাতের অস্ত্র নিয়ে আবার গুলি করল, রবোটের বুকের কাছাকাছি একটা অংশ প্রায় উড়ে বের হয়ে গেল। গুলির প্রচণ্ড আঘাতে রবোটটি তাল হারিয়ে নিচে পড়ে যেতে থাকে। বদি তার মাঝে আবার গুলি করল এবং এবারে শরীরের অংশগুলো প্রায় আলাদা আলাদা হয়ে ছিটকে পড়ল। রবোটটি কীভাবে তৈরি হয়েছে কে জানে। তার শরীরের নানা অংশ নিচে পড়েও থরথর করে কাঁপতে থাকে। শুধু তাই নয়, একটা পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক জায়গায় লাফাতে থাকে।
বদি দৃশ্যটি দেখে হাসি থামাতে পারে না, কাসেমকে ডেকে বলল, ওস্তাদ! দেখেন, পায়ের কারবারটা দেখেন!
কাসেম সিগারেটটা নিচে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে বলল, টিকটিকির লেজের মতো! কাটার পরেও তড়পাতে থাকে।
বদি একটু এগিয়ে গিয়ে বিচ্ছিন্ন পা–টাকে কষে একটা লাথি দিল, পা–টা ছিটকে পড়ল দূরে এবং সেখানেও সেটা নড়তে লাগল। বদি সেদিকে তাকিয়ে আবার হাসতে শুরু করে। শুধু একটা পা হেঁটে বেড়াচ্ছে–দৃশ্যটি যে এত হাস্যকর সেটি নিজের চোখে দেখার আগে সে বুঝতে পারে নি।
ব্যাংকের শক্ত দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে তাদের এক ঘণ্টার মতো সময় লাগল। ভিতরে ভল্ট ভাঙতে আরো এক ঘণ্টা। টাকাগুলো বের করে যখন তারা তাদের ব্যাগে গুছিয়ে রাখছে তখন হঠাৎ করে টের পেল সমস্ত ব্যাংকটি পুলিশে ঘিরে ফেলেছে। উপরে। হেলিকপ্টার এবং দূরে সেনাবাহিনী তাদের দিকে মেশিনগান তাক করে রেখেছে। বদি ভাঙা গলায় বলল, কী হল ওস্তাদ?
কাসেম পিচিক করে থুতু ফেলে চাপা স্বরে একটা গালি দিয়ে বলল, খেল খতম।
.
কাসেম আর বদিকে যখন হাতকড়া পরানো হচ্ছে তখন হঠাৎ করে তারা রবোটের সেই ভাঙা পা–টিকে আবার দেখতে পেল। সেটা লাফিয়ে লাফিয়ে পুলিশ অফিসারের কাছে এসে বলল, এই যে মোটা মতন মানুষটাকে দেখছেন এটা হচ্ছে পালের গোদা। আর ওই যে শুটকো মতন মানুষটা তার নাম বদি, সে হচ্ছে চামচা
বদি হতচকিত হয়ে বিচ্ছিন্ন পা–টির দিকে তাকিয়ে রইল, তোতলাতে তোতলাতে বলল, আরে! আরে! তাজ্জবের ব্যাপার–পা দেখি কথা বলে।
পা–টা আবার লাফিয়ে লাফিয়ে পুলিশ অফিসারকে বলল, মোটা মানুষটাকে যে দেখছেন তার মুখ খুব খারাপ। সারাক্ষণ এই চামচাকে গালিগালাজ করে–
বদি নিজেকে সামলাতে পারল না, প্রায় চিৎকার করে বলল, এই এই তুমি কথা বলছ কেমন করে?
পা–টা এবারে লাফিয়ে লাফিয়ে বদির কাছে এসে বলল, কেন সমস্যা কোথায়?
তু–তু–তুমি তো শুধু পা।
তাতে কী হয়েছে? আমি তো আর মানুষ না যে আমার মস্তিষ্ক থাকবে মাথায়। আমি হচ্ছি রবোট। আমার মস্তিষ্ক যেখানে জায়গা হয় সেখানেই রাখা যায়। আমার বেলায় রেখেছে পায়ে।
পায়ে?
শুদ্ধ করে বলতে পার হাঁটুতে। চোখও আছে আমার হাঁটুতে। শোনার জন্যে আছে মাইক্রোফোন আর কথা বলার জন্যে ছোট পিজিও স্পিকার। এই দেখ–
এই বলে পা–টি বদির সামনে ছোট ছোট লাফ দেয়া শুরু করে।
বদি চমকৃত হয়ে বলল, ওস্তাদ! দেখেছেন কী তাজ্জবের ব্যাপার? দেখেছেন। কারবারটা? দেখেছেন?
চুপ কর–কাসেম গর্জে উঠে বলল, চুপ কর গাধার বাচ্চা গাধা। মাথায় কি ঘিলু আছে? নাকি ঘিলুটা রয়েছে–
কাসেম কথাটা শেষ না করে হঠাৎ থেমে গেল। ফোঁস করে বড় একটা নিশ্বাস ফেলল সে।
রবোনগরী
রবোনগরীতে একদিন একটা কালো ক্যাপসুল এসে হাজির হল। প্রথমে সেটি চোখে পড়েছিল যোগাযোগ কেন্দ্রের একজন শৌখিন জ্যোতির্বিদের। অবসর সময়ে সে টেলিস্কোপ চোখে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, এভাবে তাকিয়ে থাকার সময় সে প্রথম একটি মহাকাশযানকে দেখতে পায়। মহাকাশযানটি ছিল একটি বিধ্বস্ত মহাকাশযান এবং শৌখিন জ্যোতির্বিদ সেটিকে প্রথমে শক্র মহাকাশযান হিসেবে ভুল করেছিল। তারা মহাজাগতিক ইতিহাসের একটি ক্রান্তিলগ্নে বাস করছে, গ্রহে গ্রহে হানাহানি, ধ্বংসযজ্ঞ, শক্তি প্রয়োগ হচ্ছে–সবাইকেই তাই সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। রবোনগরীর সবাই তাই তাদের অস্ত্র উদ্যত করে সতর্ক হয়ে থাকল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা দেখতে পেল মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত এবং তার মাঝে কারগো বলতে একটি কালো ক্যাপসুল। ক্যাপসুলটি খুলে দেখা গেল তার মাঝে জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়া ব্যবহার করে কোনোভাবে একজন মানুষের জীবনকে বাচিয়ে রাখা হয়েছে।
রবোনগরীর জন্যে সেটি ছিল একটি খুব বড় ঘটনা, তার কারণ রবোনগরী হচ্ছে রবোটদের নগর, এখানে সবাই রবোট। তাদের অনেকে শুধু মানুষের নাম শুনেছে, কখনো নিজের চোখে কোনো মানুষ দেখে নি। ক্যাপসুলের মানুষটিকে তারা খুব অবাক হয়ে দেখল। তারা জানত মানুষ অত্যন্ত কোমল প্রাণী, তাপ চাপ বা শক্তির অত্যন্ত ক্ষুদ্র তারতম্যেই তাদের শরীর বিধ্বস্ত হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ যে প্রকৃত অর্থে কী পরিমাণ অসহায় সেটা তারা আবিষ্কার করল জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়ায় বেঁচে থাকা এই অসহায় মানুষটিকে দেখে।
মানুষটির কী হয়েছে তারা জানত না এবং তাকে নিয়ে কী করবে সেটাও তারা বুঝতে পারল না। নিজেদের কপোট্রন, রবোনগরীর মূল তথ্যকেন্দ্র হাতড়ে নানারকম তথ্য জড়ো করে তারা মানুষটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করল, কিন্তু দেখা গেল সেটি সম্ভব নয় :
রবোনগরীর সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় দলপতি কুরোশিয়া। কুরোশিয়ার মূল কপোট্রন যদিও প্রাচীন পি–৪৬ ধরনের কিন্তু নূতন প্রজন্মের মডিউলগুলো তার কপোট্রনে জুড়ে দেয়া আছে। তার কার্যকর স্মৃতির পরিমাণ বিশাল এবং মূল তথ্যকেন্দ্রে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকায় রোশিয়া অন্য যে–কোনো রবোট থেকে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে তার বিশাল যান্ত্রিক মাথা নেড়ে সবুজ ফটোসেলের চোখ পিটপিট করে কয়েকবার বন্ধ করে এবং খুলে বলল, আমার মনে হয় মানুষটিকে আর কষ্ট দেয়া ঠিক নয়।
প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা একজন রবোট জিজ্ঞেস করল, কষ্ট মানে কী?
কুরোশিয়া বলল, কষ্ট এক ধরনের মানবিক প্রক্রিয়া। মানুষের মূল মানবিক প্রক্রিয়া দুই ধরনের। একটির নাম কষ্ট অন্যটির নাম আনন্দ। আনন্দ নামের প্রক্রিয়াটি তারা পেতে চায়, কষ্টটি পেতে চায় না।
তার কারণ কী?
কুরোশিয়া মূল তথ্যকেন্দ্রের সাথে খানিকক্ষণ তথ্য বিনিময় করে বলল, কারণটি সম্ভবত তাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কম্পনের সাথে জড়িত। কষ্ট প্রক্রিয়াটি তাদের স্বাভাবিক কম্পনকে ব্যাহত করে।
নগরীর উন্নয়নের দায়িত্বে থাকা অন্য একটি রবোট বলল, মানুষটি কি এখন কষ্ট পাচ্ছে?
কুরোশিয়া তার মাথা নেড়ে বলল, আমি নিশ্চিত। কষ্ট পাওয়া মানুষের মুখভঙ্গির সাথে আমি পরিচিত। তখন তাদের ভুরু কুঞ্চিত থাকে, মুখমণ্ডল অল্প খোলা রাখে এবং তুলনামূলকভাবে দ্রুত নিশ্বাস নেয়। এই মানুষটি তাই করছে। আমি নিশ্চিত সে কষ্ট পাচ্ছে।
আমরা কীভাবে তাকে কষ্ট থেকে মুক্তি দেব?
তার মৃত্যুর ব্যবস্থা করতে হবে।
মৃত্যু? তুলনামূলকভাবে নূতন প্রজাতির একটি রবোট বলল, সেটি কী?
কুরোশিয়া উত্তর দেয়ার আগেই আরেকটি প্রাচীন রবোট বলল, মৃত্যু হচ্ছে চূড়ান্ত ধ্বংস প্রক্রিয়া। একজন মানুষের মৃত্যু হলে সে আর জীবনে ফিরে আসতে পারে না।
নূতন প্রজন্মের আরেকটি রবোট বলল, কী আশ্চর্য!
কুরেশিয়া মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, এটি খুব আশ্চর্য। মানুষ মাত্রই আশ্চর্য। মৃত্যু থেকে ফিরে আসা যায় না বলে মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে খুব সাবধানে, শুধু যখন তাদের অন্য কোনো উপায় থাকে না তখন।
রবোটগুলো কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে স্থির হয়ে বসে রইল। যান্ত্রিক অনুভূতিতে বিষণ্ণতা একটি দুঃসাধ্য প্রক্রিয়া, সে কারণে তারা সত্যিকার অর্থে বিষণ্ণ হতে পারল না।
পরদিন মানুষটির জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রটি ব্যবহার করে মানুষটির জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হল। মানুষটি তার খোলা চোখ মেলে বলল, আমি কোথায়?
কুরোশিয়া বলল, তুমি রবোনগরীতে
রবোনগরী? এখানে মানুষ নেইঃ
না, আমরা সবাই রবোট। কিন্ধু আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই।
মানুষটি যন্ত্রণাকাতর মুখে খানিকক্ষণ কুরোশিয়ার ধাতব মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর দুর্বল গলায় বলল, তুমি সত্যিই আমাকে সাহায্য করতে চাও?
হ্যাঁ।
তাহলে মৃত্যুর আগে একবার আমাকে সত্যিকার একজন মানুষের সাথে কথা বলতে দাও।
কুরোশিয়া দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, আমরা যেখানে থাকি–গ্যালাক্সির এই কোনায় কোনো মানুষ নেই।
মানুষটি কোনো কথা না বলে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কুরোশিয়ার মাঝে সত্যিকার মানবিক আবেগ নেই কিন্তু তবু সে মানুষের দুঃখটুকু অনুভব করতে পারল।
ধীরে ধীরে মানুষটির শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। তার গায়ের বর্ণ বিবর্ণ হয়ে আসে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে, হৃৎস্পন্দন কমে আসে, শরীরের তাপমাত্রা নিচে নেমে যায়। কুরোশিয়া মাথা নেড়ে অন্য রবোটদের বলল, আর কিছুদিনের মাঝেই মানুষটির মৃত্যু হবে।
নতুন প্রজন্মের একটি রবোট বলল, আমরা কি তার মৃত্যু ত্বরান্বিত করতে পারি না? জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়াটিতে কি হাত দেয়া যায় না?
কুরোশিয়া মাথা নেড়ে বলল, মানুষের মৃত্যু একটি চূড়ান্ত প্রক্রিয়া, এর থেকে ফিরে আসার কোনো উপায় নেই। আমি সেখানে হাত দেয়া পছন্দ করি না
কাজেই রুগণ মানুষটি কালো ক্যাপসুলে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে থাকে। কুরোশিয়া আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করে বলল, মানুষের জীবনীশক্তি অপরিসীম। এই মানুষটি মৃত্যুকে গ্রহণ করে নি বলে তার মৃত্যু হচ্ছে না।
নিরাপত্তা কেন্দ্রের চতুর্থ মাত্রার একটি রবোট বলল, কেন সে মৃত্যুকে গ্রহণ করে নি?
কারণ সে মৃত্যুর আগে একজন মানুষের সাথে কথা বলতে চেয়েছে। যতক্ষণ সে একজন মানুষের সাথে কথা বলবে না ততক্ষণ সে নিজে থেকে মৃত্যুকে গ্রহণ করবে না। মৃত্যুকে জোর করে তার ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। যতক্ষণ সেটি না ঘটবে ততক্ষণ মানুষটি তার কালো ক্যাপসুলে শুয়ে কষ্ট ভোগ করবে।
চতুর্থ মাত্রার রবোটটি জিজ্ঞেস করল, মানুষটি কী নিয়ে কথা বলবে বলে তোমার মনে হয়?
কুরেশিয়া আবার মূল তথ্যকেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করে নানারকম তথ্য পর্যালোচনা করে বলল, আমি ঠিক জানি না। কিন্তু কথাটি হবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানব সভ্যতার গূঢ় তথ্যটি তার মাঝে লুকিয়ে থাকবে।
নূতন প্রজন্মের একটি রবোট তার কপোট্রনে উত্তেজনার টার্বো চ্যানেল চালু করে বলল, আমরা কি একজন মানুষকে খুঁজে আনতে পারি না? তাহলে অসুস্থ মানুষটির শেষ কথাটি শুনতে পেতাম। মানুষের সভ্যতার প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেতাম।
উৎসাহী আরেকটি রবোট বলল, আমরাও তাহলে আমাদের সভ্যতা মানুষের সভ্যতার অনুকরণে তৈরি করতে পারতাম।
কুরোশিয়া খানিকক্ষণ নূতন প্রজন্মের এই উৎসাহী রবোটটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমারও খুব জানার কৌতূহল হচ্ছে এই মানুষটি কী কথা বলবে।
আমরা কি আন্তঃগ্যালাক্টিক বুলেটিন বোর্ডে ছোট একটি বিজ্ঞাপন বা খবর পাঠাতে পারি না?
ব্যাপারটি কষ্টসাধ্য, কিন্তু আমি চেষ্টা করব।
কয়েকদিন পর কুরোশিয়া এবং রবোনগরীর অন্য প্রবীণ রবোটেরা আন্তঃগ্যালাক্টিক বুলেটিন বোর্ডে এ রকম একটি খবর প্রচারের ব্যবস্থা করল :
রবোনগরীতে একজন মানুষ মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি অন্য একজন মানুষের সাথে কথা বলতে চান। কোনো দয়ার্দ্র মানুষ কি এই উদ্দেশ্যে অল্প সময়ের জন্যে রবোনগরীতে পদার্পণ করবেন?
বুলেটিন বোর্ডে খবর প্রচারিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন কেটে গেল, কিন্তু কোনো মানুষ রবোনগরীতে দেখা করতে এল না। রুগ্ণ মানুষটির অবস্থা ধীরে ধীরে আরো খারাপ হয়ে গেল, তার নিশ্বাস প্রায় শোনা যায় না, হৃৎস্পন্দন কমে প্রায় অর্ধেক হয়ে এসেছে। কুরোশিয়া মাথা নেড়ে তার সবুজ ফটোসেলের চোখ পিটপিট করে বলল, আমার মনে হচ্ছে এই মানুষটি সত্যিকার অর্থে দুর্ভাগা। সম্ভবত তাকে তার শেষ ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই মৃত্যুবরণ করতে হবে।
অন্য রবোটরাও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, কেউ কোনো কথা বলল না।
যখন রবোনগরীর সবাই আন্তঃগ্যালাক্টিক গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে কোনো মানুষের এখানে। পদার্পণ করার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল ঠিক তখন তারা মহাকাশে একটি মহাকাশযান আবিষ্কার করল। হাইপার ডাইভ দিয়ে কাছাকাছি চলে আসার পর রবোনগরীর রবোটেরা মহাকাশযানের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারল সত্যি সত্যি বুলেটিন বোর্ডের তথ্য পড়ে একজন পরিব্রাজক মানুষ রুগ্ণ মানুষটির সাথে দেখা করতে আসছে।
পরদিন অপরাহ্নে মহাকাশযানটি রবোনগরীতে পৌঁছল এবং সেখান থেকে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ নেমে এল। তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ কিন্তু চোখ দুটি আশ্চর্য রকম সজীব। কুরেশিয়া মানুষটিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, আমাদের আহ্বানে সাড়া দেয়ার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। মধ্যবয়স্ক পরিব্রাজক মানুষটি বলল, একজন মানুষের অন্য মানুষের প্রতি একটি দায়িত্ব থাকে। আমি সেই দায়িত্ববোধ থেকে এসেছি। কোথায় আছে সেই রুগ্ণ মানুষটি?
চল আমার সাথে, আমি তোমাকে নিয়ে যাই। কুরোশিয়া মানুষটির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, তুমি যখন এই রুগ্ণ মানুষটির সাথে কথা বলবে তখন আমি কি তোমার পাশে থাকতে পারি?
মধ্যবয়স্ক পরিব্রাজক মানুষটি একটু অবাক হয়ে কুরোশিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি যদি চাও অবশ্যি থাকতে পার।
রুগণ মানুষটির জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়া চালু করে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হল। মানুষটি চোখ খুলে কুরোশিয়ার পাশে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মানুষটিকে দেখতে পায় এবং তার নিষ্প্রভ চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে। সে তার দুর্বল ডান হাতটি উঁচু করে বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল। মধ্যবয়স্ক মানুষটি রুগণ মানুষটির দুর্বল হাতটি দুই হাতের মাঝে নিয়ে নরম গলায় বলল, আমি সুদূর গ্যালাক্টিক গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।
রুগ্ণ মানুষটি তার চোখের পাতা ফেলে শোনা–যায়–না এ রকম গলায় বলল, তোমাকে ধন্যবাদ।
তুমি আমাকে কিছু বলবে?
রুগ্ণ মানুষটি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বলব।
কী বলবে?
আমি–আমি তোমাদের ভালবাসি।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি ঝুঁকে পড়ে নরম গলায় বলল, আমি জানি। একজন মানুষ সবসময় অন্য একজন মানুষকে ভালবাসে।
রুণ মানুষটি তার চোখ বন্ধ করল এবং তার চোখের কোনা দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। মানুষটি তার দুর্বল হাত দিয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটির হাত ধরে রাখে, তার মুখে এক ধরনের প্রশান্তির ছাপ ফুটে ওঠে। কিছুক্ষণের মাঝেই তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে হৃৎস্পন্দন থেমে যায়।
কুরোশিয়া রুগণ মানুষটির দিকে ঝুঁকে পড়ে তাকে একবার স্পর্শ করে বলল, মানুষটি কি মৃত্যুবরণ করেছে?
হ্যাঁ কুরোশিয়া।
এই একটি কথা বলার জন্যে সে এতদিন অপেক্ষা করেছিল?
হ্যাঁ।
তুমি কি জানতে সে এই কথা বলবে?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, জানতাম।
কুরোশিয়া কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল কী আশ্চর্য!
মানুষটি একটু অবাক হয়ে রবোট দলপতি কুরোশিয়ার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।
.
দুই সহস্র বছরে রবোনগরীর যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেটি পরবর্তী কয়েক বছরে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল। আন্তঃগ্যালাক্টিক ইতিহাস জার্নালে তার কারণ হিসেবে রবোটের গভীর হীনমন্যতার কথা উল্লেখ করা হয়।
সন্তান
কিয়া তৃতীয়বারের মতো খাবার টেবিলটি পরিষ্কার করে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ক্রল রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কিয়া, তুমি আর কত রান্না করবে? বাকিটুকু ট্রনের হাতে ছেড়ে দাও।
ট্রন সংসারের সাহায্যকারী রবোট, কাজকর্মে কিয়া বা ক্রল দুজনের থেকেই অনেক বেশি পারদর্শী। কিয়া ক্ৰলের কথায় কান না দিয়ে বলল, কী বলছ তুমি? এতদিন পরে আমার ছেলে আসছে আর আমি নিজের হাতে কিছু রান্না করব না?
তোমার ছেলের বয়স আট, তার জন্যে তুমি আর কত রান্না করবে?
কিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আমার ছেলে–আমি তাকে পেটে ধরেছি, তাকে আমি দেখি বছরে মাত্র একবার, তাও কয়েক ঘণ্টার জন্য! আমি জানি সে কিছু খাবে না, কিন্তু তবু তার জন্যে রান্না করতে আমার ভালো লাগে।
ক্রল হার মেনে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তাই যদি তোমার ভালো লাগে তাহলে সেটাই কর।
কিয়া কপালের উপর ঘামে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে বলল, তুমি দেখ তার ঘরে যে নূতন খেলনাগুলো কিনেছি, সবগুলো ঠিক করে রাখা আছে কি না।
দেখছি।
ক্রল একটা নিশ্বাস ফেলে তাদের সন্তানের জন্যে আলাদা করে রাখা ঘরটিতে হাজির হল। কখনো সে এখানে রাতে ঘুমায় নি, কখনো ঘুমাবে না, কিন্তু তবু এখানে তার জন্যে একটা বিছানা আলাদা করে রাখা আছে, পাশে ছোট টেবিল, টেবিলের পাশে ছোট চেয়ার। দেয়ালে রঙিন ছবি, উপর থেকে ঝুলছে নানা ধরনের মোবাইল, ঘরের একপাশে খেলনার বাক্স, নানারকম খেলনায় উপচে পড়ছে। মেঝেতে নরম কার্পেট, জানালায় রঙিন পরদা। দেয়ালে ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক ছবি, ক্ষণে ক্ষণে সেইসব ছবি পাল্টে যাচ্ছে। ঘরের দেয়ালে লুকানো স্পিকার থেকে শোনা–যায়–না এ রকম নরম সুরে কোমল সঙ্গীতের সুর ভেসে আসছে। ঘরের ভিতরে একটি শিশুর আনন্দের জন্যে সবকিছু রয়েছে, যেটা নেই সেটা হচ্ছে শিশুটি।
ক্রল উবু হয়ে বসে নতুন খেলনার বাক্সগুলো খুলে ভিতর থেকে খেলনাগুলো বের করতে থাকল। তাদের ছেলে আসবে সকাল দশটায়, চলে যাবে তিন ঘণ্টা পর, তার মাঝে সে কি এই খেলনাগুলো স্পর্শ করার সময় পাবে? ক্রল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কী প্রয়োজন ছিল এই সভ্যতার যেখানে একটি শিশুকে কার্যক্ষম মানুষ হিসেবে বড় করবার দায়িত্বটুকু নিতে হয় রাষ্ট্রযন্ত্রকে? কেন তাকে সরিয়ে নিতে হয় মা–বাবার কাছে থেকে? কেন সে প্রাচীনকালের মানুষের মতো মা–বাবার স্নেহে, আদরে, আবদারে, শাসনে, ভালবাসায় বড় হতে পারে না? সত্যিই কি প্রাচীনকালের পদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ? কী প্রমাণ আছে পৃথিবীর মানুষের কাছে?
.
ঠিক দশটার সময় ক্রল এবং কিয়ার বাসার সামনে একটা ভাসমান গাড়ি এসে থামল। নিঃশব্দে গাড়ির পিছনে একটা দরজা খুলে গেল এবং ভিতর থেকে বের হয়ে এল কোমল চেহারার একটি শিশু। সাত–আট বছরের শিশুটি একবার চারদিকে তাকিয়ে বাসার দরজার দিকে হেঁটে আসতে থাকে। সাথে সাথে দরজা খুলে কিয়া প্রায় ছুটে বের হয়ে এসে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। শিশুটি তার মায়ের বুকে মুখ গুঁজে বলল, মা তুমি ভালো আছ?
কিয়া শিশুটিকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে রেখে বলল, হ্যাঁ বাবা। তুই ভালো আছিস?
আছি মা। বাবা কোথায়?
ওই যে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্রল তখন সামনে এগিয়ে এল। শিশুটি তার মাকে ছেড়ে বাবার দিকে এগিয়ে যায়, কাছে গেলে বাবা গভীর ভালবাসায় তার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।
শিশুটিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে এল বাবা-মা। তাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল দুজন। মুগ্ধ বিস্ময়ে তারা তাদের সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে, গভীর ভালবাসায় স্পর্শ করে, চুলে হাত বুলায়। শিশুটি মুখে একটু লাজুক হাসি নিয়ে বসে থাকে, এতদিন পরে বাবা–মাকে দেখে যেন ঠিক বুঝতে পারে না কী করবে।
কিয়া হঠাৎ আরো একবার গভীর ভালবাসায় শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাদের কথা তোর মনে আছে বাবা?
আছে মা
কেমন করে মনে আছে? এক বছর পর পর তুই মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্যে আমাদের কাছে আসিস
কিন্তু মা, আমাদের মস্তিষ্কে তোমাদের নিয়ে স্টিমুলেশান দেয়া হয়। আমরা রাতে যখন ঘুমাতে যাই তোমাদের দেখি, তোমাদের কথা শুনি–
কিন্তু সেটা কি সত্যি দেখা হল?
হ্যাঁ মা, সেটা সত্যির মতো।
তুই যখন আমাকে দেখিস তোর ভালো লাগে?
হ্যাঁ মা, ভালো লাগে। আমার যখন মন খারাপ হয় তখন আমি তোমার কথা ভাবি।
কিয়ার চোখে হঠাৎ এক ধরনের আশঙ্কার ছাপ পড়ে, তোর মন খারাপ হয় বাবা?
শিশুটি একটু হেসে বলল, কেন হবে না মা? সবার মন খারাপ হয়। এমনিতেই মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়, তাছাড়া আমাদের মাঝে মাঝে মন খারাপ করিয়ে দেয়া হয়।
ক্ৰল উদ্বিগ্ন মুখে বলল, কেন বাবা? কেন তোদের মন খারাপ করিয়ে দেয়া হয়?
শিশুটি হেসে বলল, বাবা, আমাদের শুধু মন খারাপ নয়; আমাদের রাগ, দুঃখ, আনন্দ, হিংসা–সবকিছু শেখানো হয়। যখন তোমাদের খুব মন খারাপ থাকে তোমরা কোনো কাজ করতে পার?
না বাবা, পারি না
আমরা পারি। শিশুটি উজ্জ্বল চোখে বলল, আমাদের যখন মন খারাপ হয় আমরা তখনো কাজ করতে পারি। আমাদের যখন অনেক আনন্দ হয় কিংবা রাগ হয় তখনো আমরা কাজ করতে পারি।
কেমন করে করিস, বাবা?
আমাদের মস্তিষ্কে স্টিমুলেশান দেয়া হয়। স্টিমুলেশান দিয়ে আমাদের মন খারাপ করানো হয়, যখন খুব মন খারাপ হয় তখন আমাদের কাজ করতে দেয়া হয়। সেটা আরেক রকম স্টিমুলেশান।
কী কাজ করিস তোরা?
নানারকম কাজ। আমাদের কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি পড়তে হয়, সুপার কন্ডাক্টিভিটি শিখতে হয়। নানা রকম মডেল থাকে, টেকনিক্যাল প্রজেক্ট করতে হয়–
তোরা সব করতে পারিস?
শিশুটি লাজুক হাসি হেসে বলল, পারি মা। আমি গত পরীক্ষায় সবগুলো বিষয়ে বেশি নম্বর পেয়েছি। ব্ল্যাকহোল কেমন করে এসেছে তার ওপর আমার একটা পেপার জার্নালে ছাপা হয়েছে।
পুত্রগর্বে গর্বিত মা তার আদরের শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
শিশুটি তার ঘরে ঘুরে বেড়াল, তার জন্যে আলাদা করে রাখা ঘরটিতে তার খেলনাগুলো নেড়েচেড়ে দেখল। তার বিছানায় পা দুলিয়ে বসে হলোগ্রাফিক ছবি দেখল। মায়ের পিছু পিছু হেঁটে হেঁটে টেবিলে খাবার এনে দিল। গৃহস্থালি রবোট ট্রনের সাথে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তর্ক–বিতর্ক করল, বাবার ঘাড়ে উঠে ঘরময় ছুটে বেড়াল।
দুপুরে কিয়া, ক্রল এবং শিশুটি একসাথে বসে খেল। শিশুটি খাওয়ার ব্যাপারে একটু খুঁতখুঁতে–অনেক রকম খাবার রান্না হয়েছে তবু কোনোটাই তৃপ্তি করে খেল না। সবগুলো থেকে একটু একটু করে খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে উঠে পড়ল।
কিয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল, যে কয়েক ঘন্টা সময়ের জন্যে সে এক বছর থেকে অপেক্ষা করছে সেই সময়টা শেষ হয়ে আসছে। আবার এক বছর পর তার সন্তানটি কয়েক ঘণ্টার জন্যে আসবে। গভীর বেদনায় তার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যেতে চায়।
শিশুটি কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসে তার জুতোগুলো পরে নেয়। হাতের ছোট ব্যাগটি তুলে নিয়ে মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আসি মা?
মা চোখের অশ্রু ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে শেষবার আলিঙ্গন করে বলল, আয় বাবা।
শিশুটি ক্রলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, আসি বাবা।
ক্রল শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আয় বাবা। ভালো হয়ে থাকিস।
শিশুটি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সাবধানে চোখের পানি হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে নেয়। ভাসমান গাড়িটার কাছাকাছি যেতেই নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল। শিশুটি মুখ ঘুরিয়ে একবার পিছনে তাকিয়ে গাড়ির ভিতরে ঢুকে যেতেই নিঃশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় সাথে সাথেই ভাসমান গাড়িটা ছোট একটা গর্জন করে উপরে উঠে যায়।
***
শিশুটি ম্লান মুখে একটা ছোট চেয়ারে বসে আছে। পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক একজন লোক নরম গলায় বলল, মন খারাপ লাগছে?
শিশুটি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল।
এক্ষুনি তোমাকে আনন্দের স্টিমুলেশান দেয়া হবে তখন তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। যাবে না?
শিশুটি আবার মাথা নাড়ল।
তার আগে তোমাকে ডাউনলোড করতে হবে, মনে আছে?
শিশুটি একটা নিশ্বাস ফেলে শোনা–যায়–না এ রকম গলায় বলল, মনে আছে।
তাহলে দেরি করে কাজ নেই। এস, শুয়ে পড়।
শিশুটি বাধ্য ছেলের মতো এসে পাশে রাখা বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। মৃদু গুঞ্জন করে। মাথার উপরে একটা চতুষ্কোণ যন্ত্র নেমে আসতে থাকে, লাল একটা বাতি জ্বলে ওঠে এবং উচ্চ কম্পনের একটা তীক্ষ্ণ শব্দের গুঞ্জন শোনা যেতে থাকে। শিশুটি ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
ভাসমান গাড়ির সামনে থেকে সোনালি চুলের একজন কমবয়সী মেয়ে এগিয়ে এসে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ডাউনলোড শুরু হয়েছে?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, হ্যাঁ।
এখন কাকে ডাউনলোড করছ?
পরের জনকে। শহরতলিতে থাকে বাবা-মা, এক শ এগার তলা এপার্টমেন্ট বিল্ডিঙের ছিয়ানব্বই তলায়।
কতক্ষণের জন্যে পাবে বাচ্চাটাকে?
মধ্যবয়স্ক মানুষটি মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলল, এই বাবা–মা পাবে দু ঘণ্টার জন্যে।
বাচ্চার চেহারার পরিবর্তন করতে হবে?
হ্যাঁ। চোখগুলো এখন হবে নীল, চুলটা হবে লালচে।
কাজ শুরু করে দেব?
হা দাও। বাবা–মা এক বছর থেকে অপেক্ষা করছে, তাদের আরো অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না।
সোনালি রঙের চুলের মেয়েটি বলল, ঠিকই বলেছ।