“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”
মানুষটি প্রথম তার দিকে তাকাল, নরম গলায় বলল, “যাও। বাড়ি যাও। ঠান্ডা পানিতে গোসল করে একটা ঘুম দাও। আর শোনো”
রিটিন দাঁড়াল। মানুষটি এই প্রথম হাসি হাসি মুখে বলল, “এভোকাডো ফলটা খারাপ না। খেয়ে দেখো, ভালো লাগবে।”
রিটিন অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকাল। সে দুই চোখে এভোকাডো নামক ফলটি দেখতে পারে না, মানুষটি সেটাও জানে! এই মানুষটির কাছে তার জীবনের গোপন কিছু নেই।
ঘরের বাইরে পি-টু রোবটটি অপেক্ষা করছিল, লম্বা পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসে।
রিটিন বলল, “খবরদার, বেশি কাছে আসবে না। দূরে দূরে থাকো। রোবট নিয়ে আমার অ্যালার্জি আছে।”
পি-টু বলল, “পি-টু রোবটটি পুরোপুরি জৈব নিষ্ক্রিয় পদার্থ দিয়ে তৈরি। অ্যালার্জি হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। মানবশরীরের অ্যালার্জিবিষয়ক প্রতিক্রিয়াটি গত শতকে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, এখন এটি একটা একাডেমিক বিষয় ছাড়া কিছু নয়। সাম্প্রতিক একটি বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে-”
রিটিন ধমক দিয়ে বলল, “চুপ করবে তুমি।”
পি-টু চুপ করে গেল।
০৩-০৪. ক্যাম্পের বাইরে সরু একটা রাস্তা
০৩.
ক্যাম্পের বাইরে সরু একটা রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ। গাছের ছায়ায় শুকনো পাতা মাড়িয়ে রিটিন অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকে। রাস্তাটা ঘুরে যেতেই রিটিন ছোট একটা পানীয়ের ঘর দেখতে পেল। ঘরটা চোখে পড়তেই সে বুঝতে পারল তার আসলে খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।
ঘরের সামনে দাঁড়াতেই দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। ঘরের এক কোনায় সোনালি চুলের একটা কম বয়সী মেয়ে বসে আছে। মেয়েটি প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজের ভেতরকার উদ্বেগটুকু লুকিয়ে রাখতে কিন্তু রিটিন বুঝতে পারল মেয়েটার ভেতরে চাপা উত্তেজনা।
রিটিন ছোট একটা গ্লাসে এক গ্লাস উত্তেজক পানীয় ঢেলে নেয়, তারপর গ্লাসটি নিয়ে মেয়েটির কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসে। মেয়েটির সাথে চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি নার্ভাস ভাবে একটু হাসল। বলল, “ক্যাম্প থেকে এসেছ?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“মিশিকেও গত রাতে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে। এতক্ষণে মনে হয় ছেড়ে দেয়ার সময় হয়েছে।”
রিটিন ভাবল জিজ্ঞেস করে মিশি কে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। মেয়েটা নিজে থেকেই বলল, “মিশি আমার অনেক দিনের বন্ধু। এই শীতে আমরা বিয়ে করব।”
রিটিন চলল, “ও আচ্ছা। চমৎকার।”
“হ্যাঁ। অনেক কষ্ট করে, অনুমতি পেয়েছি। ক্যাটাগরি সি মানুষদের বিয়ের অনুমতি দিতে চায় না।”
রিটিন তার গ্লাসের পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, “মিশিকে ক্যাম্পে নিয়ে গেছে কেন?”
মেয়েটা নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করল, বলল, “শুধু শুধু। একেবারেই শুধু শুধু। কোনো কারণ নেই। ব্রেন স্ক্যানিং করে যখন দেখবে শুধু শুধু ধরে নিয়েছে তখন ছেড়ে দেবে, তাই না?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। স্ক্যান করে কিছু পায়নি।”
মেয়েটা ছটফটে চোখে রিটিনের চোখের দিকে তাকাল, বলল, “কিছু পায়নি?”
“না। কিন্তু ব্রেনের ভেতরে কী আছে সব জেনে গেছে।”
মেয়েটার চোখে এবারে উদ্বেগের একটা চিহ্ন ফুটে উঠল। শুকনো ঠোঁটগুলো জিব দিয়ে ভেজানোর চেষ্টা করে বলল, “সব জেনে যায়?”
“হ্যাঁ।” রিটিন মাথা নাড়ল, “পুরো মাথাটার ভেতরে ঢুকে যায়। একটা একটা করে স্মৃতি খুলে খুলে দেখে–”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। আমি যে এভোকাডো খেতে পছন্দ করি না সেটা পর্যন্ত জানে।”
মেয়েটা তার হাতের পানীয়ের গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিয়ে বলল, “মিশির ব্রেনে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু পাবে না।”
রিটিন বলল, “না, নিশ্চয়ই পাবে না।”
মেয়েটা অস্বস্তিতে ছটফট করতে থাকে। একটু পর গলা পরিষ্কার করে বলল, “কিন্তু যদি ভুলে কিছু একটা পেয়ে যায় তাহলে কী হবে?”
রিটিন বলল, “ভুল করে কিছু পাবার কথা না।”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “তা ঠিক।”
রিটিন তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে চোখের কোনা দিয়ে মেয়েটাকে লক্ষ করে। মেয়েটা বাইরে যতই শান্ত ভাব দেখাক ভেতরে ভেতরে সে অস্থির হয়ে আছে।
ঠিক এরকম সময় দরজাটা খুলে গেল এবং রিটিনের বয়সী একজন মানুষ ঘরের ভেতর এসে ঢুকল। মেয়েটি সাথে সাথে লাফ দিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “মিশি।”
মিশি মেয়েটার কথা শুনল বলে মনে হয় না। সে পানীয় ডিসপেন্সরের কাছে গিয়ে নিজের জন্যে একটা পানীয় বেছে নেয়। মেয়েটা দুই হাত উপরে তুলে মিশির দিকে ছুটে যেতে থাকে, চিৎকার করে বলতে থাকে, “আমি তোমার জন্যে সেই সকাল থেকে বসে আছি, মিশি–”
রিটিন দেখল মিশি একটু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল, বলল, “তুমি আমাকে বলছ?”
“তোমাকে না বললে আমি কাকে বলব? মিশি–মিশি–”
রিটিন দেখল মেয়েটি মিশিকে জাপটে ধরল আর সাথে সাথে মিশি একটা ঝটকা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। মেয়েটা প্রস্তুত ছিল না, পড়ে যেতে যেতে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে অবাক হয়ে কাতর গলায় বলল, “মিশি–”
মিশি বলল, “আমি মিশি না।”
মেয়েটা প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “কী বলছ তুমি?”
“আমি ঠিকই বলছি। আমার নাম ক্লড।”
“মিশি! তুমি কী বলছ এসব? তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি গ্লানা।”
মানুষটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “আমি তোমাকে চিনি না। কখনো দেখিনি।”