মানুষটা বলল, “আমি তোমার মস্তিষ্কের ভেতর দেখতে চাই।”
“মস্তিষ্কের ভেতরে?”
“হ্যাঁ। তুমি কী কর, কী চিন্তা কর, কী করেছ, কী করতে চাও। সবকিছু আমি দেখতে পাব। কাজেই চুপচাপ বসে থাকো।”
“কীভাবে দেখবে? মাথার ভেতরে ফুটো করে কিছু ঢোকাবে না তো?”
“না।”
“তাহলে?”
“কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকো। নিজেই দেখবে।”
হঠাৎ করে রিটিনের চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়, সে চোখ খুলে তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছু দেখছে না। ভয়ে আতঙ্কে সে চিৎকার করে উঠতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই সে বিচিত্র কিছু রং দেখতে পায়, রংগুলো স্থির নয়, কুণ্ডলী পাকিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধীরে ধীরে নড়ছে। রিটিন অবাক হয়ে বুঝতে পারল, সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে কিন্তু সে চোখ দিয়ে দেখছে না। দেখার অনুভূতিটি আসছে অন্য কোনোভাবে। মাথার কাছে যন্ত্রপাতির একটা ভোঁতা শব্দ হচ্ছিল, হঠাৎ করে সেই শব্দ ছাপিয়ে সে অন্য এক ধরনের শব্দ শুনতে পায়। এত বিচিত্র শব্দ সে তার জীবনে আগে কখনো শোনেনি, শব্দগুলো ঢেউয়ের মতো আসছে এবং যাচ্ছে।
চারপাশে কী হচ্ছিল প্রথম প্রথম রিটিন সেটা অনুভব করতে পারছিল কিন্তু ধীরে ধীরে সেই অনুভূতি চলে যেতে থাকে। রিটিন বুঝতে পারে তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে। সে তার আঙুলটাও আর নাড়াতে পারছে না। তার ভেতরে একটা আতঙ্ক হওয়ায় কথা ছিল কিন্তু কোনো একটা কারণে এই মুহূর্তে ভয়ভীতি আতঙ্ক বা অন্য কোনো অনুভূতিই তার মাঝে নেই। তার মনে হতে থাকে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।
রিটিন হঠাৎ শীত শীত অনুভব করতে থাকে, মুখের ভেতর তীব্র একটা লোনা ভাব, সাথে সাথে বিচিত্র একটা গন্ধ। সেই অস্বাভাবিক গন্ধে তার সারা শরীর কুঞ্চিত হয়ে যায়। শীত শীত ভাবটা সরে গিয়ে হঠাৎ করে সে উষ্ণতা অনুভব করতে থাকে, হঠাৎ করে মনে হয় শরীরের চামড়া খুলে যেতে শুরু করেছে, কিছুক্ষণের জন্য তীব্র যন্ত্রণা, হঠাৎ করে সেই যন্ত্রণা সরে গিয়ে সমস্ত শরীর অনুভূতিহীন হয়ে যায়, মুখের ভেতর বিস্বাদ এক ধরনের মিষ্টি অনুভূতি, নাকে কটু গন্ধ। রিটিনের মনে হতে থাকে অনেক দূর থেকে একটা শিশু তাকে ডাকছে–সেই ডাকটি শুনে নিজের ভেতরে সীমাহীন এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকে। রিটিনের মনে হয় সে বেঁচে নেই, মনে হয় বেঁচে থাকা কিংবা না থাকার কোনো অর্থ নেই, কোনো গুরুত্ব নেই।
রিটিন কতক্ষণ এভাবে ছিল সে জানে না, হঠাৎ করে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সে পুরোপুরি জেগে উঠল। সামনে একটা ডেস্ক সেখানে মানুষটি যন্ত্রপাতির প্যানেলটির দিকে তাকিয়ে আছে। যন্ত্রপাতির ভোঁতা শব্দটি সে আবার শুনতে পেল, দেখল তার সারা শরীর কুলকুল করে ঘামছে।
মাথাকে শক্ত করে আটকে রাখা সিলিন্ডার দুটো আস্তে আস্তে সরে গেল, রিটিন মাথাটা মুক্ত করে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগল।
যন্ত্রপাতির প্যানেলের সামনে বসে থাকা মানুষটা রিটিনের দিকে তাকিয়েই বলল, “রিটিন, তুমি চেয়ার থেকে নেমে আসতে পার।”
রিটিন চেয়ার থেকে নামল। মানুষটি বলল, “তুমি চলে যেতে পার। বাইরে পি-টু তোমাকে বের হওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেবে।”
রিটিন ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু–”
মানুষটি নিরাসক্ত দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকাল। রিটিন বলল, “স্ক্যানিং করে তুমি কী দেখলে?”
“দেখলাম ক্যাটাগরি সি এর মানুষ হিসেবে তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটু বেশি। তুমি তোমার জন্যে ঠিক করে রাখা প্রোগ্রামের বাইরে লেখাপড়া করতে চাও।”
“সেটা কি অপরাধ?”
“না, সেটা অপরাধ না, সেটা ঝুঁকিপূর্ণ। এই রকম মানুষেরা বিপজ্জনক হতে পারে।”
“আমি কি বিপজ্জনক?”
“এখনো হওনি। তোমার পক্ষে একটা ভালো যুক্তি আছে। শহরকেন্দ্রে একটা মেয়ে তোমাকে ক্রিমিজিমের নাম বলেছে, তারপরও তুমি সেখানে যাওনি। তোমার ভেতরে অপরাধপ্রবণতা নেই।”
“আর কিছু?”
“সময় পরিভ্রমণ নিয়ে লেখাপড়া করার চিন্তা মাথা থেকে দূর করো। এ সম্পর্কে তোমার চিন্তাভাবনা হাস্যকর। তুমি কখনো সেই সুযোগ পাবে না।”
“আর কিছু?”
“হিমবাহ প্রবাহে তোমার বাবা-মা আর তুমি ভেসে গিয়েছিলে, তোমার মা তোমাকে বাঁচানোর জন্যে মারা গিয়েছে, তোমার বাবা তোমার মাকে বাঁচানোর জন্যে মারা গিয়েছে, তোমার সেরকম একটা স্মৃতি আছে।”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আছে।” শৈশবের সেই স্মৃতি রিটিনের পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়, মায়ের সেই শেষ দৃষ্টিটি এখনো তাকে অস্থির করে তুলল। ২৮
মানুষটি বলল, “সেই স্মৃতিটি সত্যি নয়। তোমার মস্তিষ্ক সেই স্মৃতিটি তৈরি করেছে। সেরকম কিছু ঘটেনি।”
রিটিন বলল, “কী বলছ তুমি, আমার স্পষ্ট মনে আছে”
“আমি জানি, তোমার স্পষ্ট মনে আছে। মস্তিষ্ক এরকম স্পষ্ট মনে থাকা স্মৃতি তৈরি করে।”
“কিন্তু–”
“আর কিন্তু নয়। তুমি এখন যাও।”
রিটিন তবু ইতস্তত করতে থাকে, “আমার কি কিছু করতে হবে?”
“না। তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি যদি তোমার বাড়াবাড়ি এবং অযৌক্তিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা দূর করে তোমার জন্য নির্ধারিত স্বাভাবিক একটা জীবনে ফিরে যাও তোমার কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।”
“আমার ট্র্যাকিওশানে একটা অ্যালার্ট সিগন্যাল ছিল।”
“আমি সেটা বন্ধ করে দিয়েছি। তুমি এখন স্বাভাবিক একজন মানুষ। তোমাকে কোনো রোবট জ্বালাতন করবে না।”