কাঁপতে থাকা মানুষটা বের হওয়ার সাথে সাথে খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা বলল, “খুবই অপমানজনক ব্যাপার।”
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “কোনটা অপমানজনক?”
“এই যে একটা রোবট ট্র্যাকার দিয়ে ট্র্যাকিওশান অনুরণিত করে একজন একজন করে ধরে নিয়ে যায়। আমরা তো আর রোবট না, হাজার হলেও আমরা মানুষ, আমাদের নাম ধরে ডাকতে পারে। আমাদের সবার একটা করে নাম আছে।”
রিটিন খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, “রোবটটা ঐ মানুষটাকে ধরে নিয়ে গেল কেন?”
“চেক আপ করে দেখবে অপরাধী কি না।”
“কীভাবে দেখবে।”
“তাদের উপায় আছে। নিখুঁত উপায়।”
“যদি অপরাধী হয় তাহলে কী করবে?”
খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা বলল, “আগে হলে মেরে টেরে ফেলত। এখন মনে হয় স্মৃতি ধ্বংস করে নতুন স্মৃতি ঢুকিয়ে দেয়।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন বলল, “স্মৃতি ধ্বংস করার থেকে মেরে ফেলাই ভালো ছিল।”
ধবধবে ফর্সা মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, “স্মৃতি ধ্বংস করা আর মেরে ফেলার মাঝে কোনো পার্থক্য নাই।”
“আছে।” অন্যজন কঠোর গলায় বলল, “মেরে ফেললে শেষ। কিন্তু স্মৃতি ধ্বংস করলে আমার শরীরটা থেকে যায়, সেখানে অন্য একজন মানুষ বেঁচে থাকে। অন্য একজন মানুষ কেন আমার শরীরে বেঁচে থাকবে? আমার শরীরে আমি যদি বেঁচে থাকতে না পারি তাহলে আর কেউ বেঁচে থাকতে পারবে না।”
“কেন বেঁচে থাকতে পারবে না? এটা কোন ধরনের কথা?”
রিটিন দেখল মানুষগুলোর গলায় স্বর উঁচু হতে থাকে। তারা 1ৎকার করতে থাকে, হই হল্লা করতে থাকে। রিটিন তখন একটু সরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করল।
রিটিন অপেক্ষা করতে করতে লক্ষ করে নির্দিষ্ট সময় পরপর ধূসর পোশাক পরা একটি রোবট এসে ট্র্যাকিওশান ট্র্যাকার দিয়ে লক করে একজন একজন করে মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যাকে ধরে নিতে যাচ্ছে তার ট্র্যাকিওশানে সিগন্যাল পাঠিয়ে মানুষটির স্নায়ুতে এক ধরনের কম্পন তৈরি করে। সেই কম্পনে একেকজনের প্রতিক্রিয়া হয় একেকরকম। কেউ কাঁপতে থাকে, কেউ ছটফট করতে থাকে, কেউ যন্ত্রণার কাতর শব্দ করতে থাকে। খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটি ঠিকই বলেছিল, এখানে মানুষগুলোকে ঠিক মানুষের সম্মান দেয়া হয় না।
বসে থাকতে থাকতে রিটিনের মনে হয় একটু ঝিমুনির মতো এসেছিল, হঠাৎ সে শরীরের ভেতর ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো ঝাঁকুনি অনুভব করল। সাথে সাথে সে বুঝে গেল ধূসর রোবটটা তাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে। রিটিন চোখ খুলে তাকিয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তখন সে আবার নিজের ভেতর একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে, এবারে সেটি আগের থেকে তীব্র এবং যন্ত্রণাময়। রিটিন হাত তুলে বলল, “আসছি। আমি আসছি।”
রোবটটি তারপরও ট্র্যাকারটা তার দিকে ধরে রাখল এবং রিটিন নিজের শরীরের ভেতর তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করতে থাকল। রিটিন কোনোভাবে পা ফেলে দরজার দিকে ছুটে যেতে থাকে। ছুটে যেতে যেতে শুনতে পেল খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা উচ্চ স্বরে তাকে লক্ষ করে বলছে “ভয় পাবার কিছু নাই ছেলে, দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকো।”
কোথায় দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকতে হবে সে বুঝতে পারল, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা বোঝারও চেষ্টা করল না। দ্রুত রোবটের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। শরীরের ভেতর ঝাঁকুনিটা তখন একটু কমে গেল কিন্তু পুরোপুরি চলে গেল না।
রোবটটার পাশে পাশে হেঁটে সে ছোট খুপরির মতো একটা ঘরের সামনে এসে থেমে গেল, কেউ বলে দেয়নি কিন্তু সে বুঝতে পারল এই ঘরটিতেই তার স্ক্যানিং হবে।
খুপরির মতো ঘরের ভেতর থেকে কোনো একজন বলল, “চলে এসো।”
রিটিন ঘরের ভেতর ঢুকল। ঘরের মাঝামাঝি একটা চেয়ার, চেয়ারের চারপাশে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। কাছেই একটা ডেস্কের পেছনে একজন মাঝবয়সী মানুষ নিরাসক্ত দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকাল।
রিটিন বলল, “নিশ্চয়ই কিছু ভুল হয়েছে। আমি আসলে কিছু করিনি, একটা রোবটকে মেটাকোড দিয়ে অচল করে দিয়েছিলাম, খুবই নির্বুদ্ধিতা হয়েছিল কাজটি, কিন্তু সেটা তো বড় অপরাধ নয়। নির্বুদ্ধিতা তো অপরাধ হতে পারে না”
মানুষটি কোনো কথা না বলে যেভাবে তার দিকে তাকিয়েছিল সেভাবেই তাকিয়ে রইল। তার কোনো কথা শুনেছে কি না বোঝা গেল না। রিটিন আবার শুরু করল, “আমাকে মনে হয় তোমরা চলে যেতে দিতে পার–”
“বসো।” মানুষটি চেয়ারটা দেখিয়ে তাকে বসতে বলল।
রিটিন বলল, “তোমার সময় নষ্ট করতে চাই না আমি-”
মানুষটা আবার বলল, “বসো।”
রিটিন বলল, “বসার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আমি তোমাকে বলছি আমি কোনো অপরাধ করিনি, বিশ্বাস করো। আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি–”
মানুষটি একই ভঙ্গিতে নিরাসক্তভাবে বলল, “চেয়ারটাতে বসো।”
রিটিন তখন একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারটাতে বসল। বসে বলল, “ঠিক আছে বসছি। কিন্তু তোমাকে আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে।”
“মাথাটা হেলান দাও।”
রির্টিন মাথাটা হেলান দিল এবং তখন হঠাৎ দুই পাশ থেকে দুটো সিলিন্ডারের মতো কিছু এসে তার মাথাটাকে আটকে ফেলল। রিটিন ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী করছ? কী করছ তুমি?”
মানুষটা কোনো উত্তর দিল না, সামনে রাখা একটা প্যানেলে যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করতে লাগল। রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি রোবট?”
মানুষটা এবারেও তার কথার উত্তর দিল না। রিটিন বলল, “রোবট হলে তোমাকে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু মানুষ হলে আমি জানতে চাই তুমি ঠিক কী করতে যাচ্ছ?”