রিটিন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “কেন?”
“তোমার কারণে পৃথিবীতে মানুষের সাথে মানুষের বিভাজন দূর করার প্রক্রিয়াটি আমরা শুরু করতে পেরেছি।”
রিটিন স্যুপের চামচে চুমুক দিয়ে বলল, “শুরু করা সহজ, কিন্তু শেষ কি করা যাবে? মানুষে মানুষে বিভাজন কি দূর হবে?”
“নিশ্চয়ই হবে। সত্যি কথা বলতে কী কাজ শুরু হয়ে গেছে। ভিডি টিউবে দেখনি সব বাচ্চা মিলে দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে?”
“হ্যাঁ, দেখেছি।”
“এর থেকে সুন্দর দৃশ্য কি পৃথিবীতে আছে?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না, নেই।”
দুজন আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে স্যুপের বাটি থেকে স্যুপ খেতে থাকে। রিটিন জিজ্ঞেস করল, “প্রফেসর রাইখ কেমন আছে?”
“এখন অনেকটুকু ভালো। টাইম ক্যাপসুল তৈরি করার জন্যে তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। মস্তিষ্ক স্ক্যান করার সময় তার মস্তিষ্কের কিছু ক্ষতি করেছে।”
“সুস্থ হবে তো?”
“হ্যাঁ, হবে। তুমি যদি নিয়ন্ত্রণ ভবন উড়িয়ে না দিতে তাহলে কী হতো আমরা জানি না।”
ক্লিওন রিটিনের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ রিটিন।”
রিটিন শব্দ করে হাসল, বলল, “তুমি কেন আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছ। আমি নিজে কিছু করিনি-প্রকৃতি যেটা করতে চেয়েছে সেটা হয়েছে। আমি শুধু সেটাকে সাহায্য করেছি।”
“আমি সে জন্যেই তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি রিটিন। প্রকৃতি কী চায় সেটা কতজন জানে?”
স্যুপের বাটিটা সামনে ঠেলে ক্লিওন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি চাও বলো রিটিন। পৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে আমরা তোমাকে কিছু একটা দিতে চাই।”
“আমি কিছু চাই না।”
“কেন কিছু চাইবে না! কিছু একটা চাও, তোমাকে দেব আমরা।”
“গ্লানা নামের একটা মেয়ের ভালোবাসার মানুষটির নাম ছিল মিশি। তার মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন করে দিয়েছিল–তাকে আবার মিশি করে দাও।”
ক্লিওন হাসল, বলল, “এগুলো তো আমরাই করে দিচ্ছি। সব মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপন ঠিক করে দিয়েছি। তুমি নিজের জন্যে কিছু চাও।”
“একজন মানুষ যা কিছু চাইতে পারে তার সবকিছু আমি পেয়েছি। আমি আর কী চাইব। আমি কিছু চাই না।”
“ঠিক আছে, তুমি সময় নাও। তারপর কিছু একটা চাও। তুমি যা চাইবে আমরা তোমাকে সেটাই দেব।”
রিটিন ক্লিওনের দিকে বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “সত্যি?”
“সত্যি।”
.
শেষ কথা
প্রায় বারোশত কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে তানুস্কা নীলকে নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছে। বাসার সামনে ভ্যানটি থামিয়ে পাশে বসে থাকা নীলের দিকে তাকিয়ে তানুস্কা বলল, “ আমার বাসার ভেতরে ঢুকতে মন চাইছে না।”
নীল তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন, তোমার ঢুকতে মন চাইছে না মা?”
“শুধু রিটিনের কথা মনে হচ্ছে! তাকে কোথায় এক জঙ্গলের ভেতর মাটির নিচে রেখে এসেছি। পাঁচশ বছর সেখানে ঘুমিয়ে থাকবে।”
নীল কোনো কথা না বলে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কেন পাঁচশ বছর ঘুমিয়ে থাকতে হবে? কেন আমাদের সাথে থাকল না?”
তানুস্কা বলল, “তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে নীল। কোনো কোনো মানুষকে পৃথিবীর অনেক বড় বড় দায়িত্ব নিতে হয়। এই বড় বড় দায়িত্ব নেয়ার জন্যে আমাদের মতো মানুষকে ছেড়ে চলে যেতে হয়। রিটিনকে তাই আমাদের ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।”
কথা বলতে বলতে তানুস্কা ছেলের হাত ধরে সিঁড়িতে দাঁড়াল। দরজা খোলার জন্যে চাবি বের করতে গিয়ে দেখল দরজাটা খোলা।
সে অবাক হয়ে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কফির গন্ধ পেল। সে আরেকটু এগিয়ে খাবার ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখল খাবার টেবিলে প্লেটের মাঝে রুটি টোস্ট। ছোট গ্লাসে ফলের রস। হাফ প্লেটে ডিম পোচ। ছোট একটা বাটিতে টুকরো করে কাটা পনির। কেউ একজন টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছে।
ঠিক তখন রান্নাঘর থেকে দরজা খুলে রিটিন বের হয়ে আসে। যেন কিছুই হয়নি, সেরকম ভান করে বলল, “ভালো আছ তানুস্কা?”
“তুমি?”
“হ্যাঁ। আমি।”
“তুমি? তুমি?”
“হ্যাঁ। আমি তানুস্কা। আমি পাঁচশ বছর কাটিয়ে পৃথিবীতে গিয়েছি। তারপর পুরো পৃথিবীকে ওলটপালট করে ফেলেছি।”
রিটিন একটু এগিয়ে যায়। দুই হাত বাড়িয়ে তানুস্কাকে আলিঙ্গন করে বলল, “তারপর আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি তানুস্কা। পৃথিবীর মানুষ আমাকে কিছু একটা উপহার দিতে চেয়েছিল। আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি। তোমাকে আর নীলকে।”
তানুস্কা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না রিটিন।”
“তোমার কিছু বুঝতে হবে না তানুস্কা। শুধু বলো–”
“কী বলব?”
“প্রতিদিন ভোরে তুমি আমাকে তোমার জন্যে ডিম পোচ করতে দেবে”
তানুস্কা কথা না বলে রিটিনকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
নীল মায়ের কাপড় ধরে টেনে বলল, “মা, তুমি বলো তুমি রাজি আছো। বলো। তাড়াতাড়ি বলো।”