রিটিন আধশোয়া হয়ে চারদিকে তাকাল। ক্লোনগুলো তার দিকে তাকাচ্ছে না, তারপরও সে কোনো ঝুঁকি নিল না। নিশ্চল হয়ে শুয়ে থেকে সাবধানে চারদিকে তাকায়, হিমশীতল তরল বয়ে নিয়ে যাওয়া পাইপগুলো বাইরে থেকে এসেছে। ডান দিকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে ছোট একটা ঘর, এই ঘরের ভেতর থেকে হিমশীতল তরলগুলোকে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। যন্ত্রগুলোর ভেতর থেকে তাপ নিয়ে যাওয়া উষ্ণ তরলের পাইপগুলোও রিটিন খুঁজে বের করল। হাত দিয়ে স্পর্শ করে নিশ্চিত হতে পারলে ভালো হতো কিন্তু ক্লোনগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে সেটি করা সম্ভব নয় বলে রিটিন তার চেষ্টা করল না।
পঞ্চাশ মিটার দূরে ছোট ঘরটাতে ঢুকতে পারলে সে সম্ভবত হিমশীতল তরলের প্রবাহটি বন্ধ করতে পারবে। ঢোকার জন্যে কোনো একটা দরজা ভাঙতে হবে–সেটিও খুব সোজা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু রিটিন সেটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করল না। তার দুই হাতের দুটি আঙুলে চার মাত্রার দুটি বিস্ফোরক আছে। এগুলো দিয়ে সে বড় ধরনের কিছু ধ্বংস করতে পারবে না কিন্তু ডিস্ট্রিবিউশান ঘরটির দরজা নিশ্চয়ই ভাঙতে পারবে।
রিটিনকে এখন শুধু ডিস্ট্রিবিউশান ঘরটিতে পৌঁছাতে হবে। ক্লোনদের দৃষ্টি এড়িয়ে সেটি করা সম্ভব হবে না, কিন্তু যতটুকু সম্ভব সে চেষ্টা করবে।
রিটিন দুই হাতে ভর দিয়ে খুব সাবধানে ঘরটির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ক্লোনগুলো তাকে লক্ষ করছে না, যখন সে ঘরটির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তখন হঠাৎ একটি ক্লোন তাকে প্রথমবার লক্ষ করল, ক্লোনটি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল এবং সাথে সাথে সবাই একসাথে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। ক্লোনগুলোর আলাদা অস্তিত্ব নেই, সবাই একসাথে একভাবে সবকিছু অনুভব করে।
ক্লোনগুলো যে যেখানে ছিল সেখানে থেমে গেল। তারপর এক সারিতে দ্রুত পদক্ষেপে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। তাদের মাঝে কোনো ব্যস্ততা নেই, শুধু একটুখানি বিস্ময় আছে।
রিটিনকে এখন আর গোপনে গুঁড়ি মেরে যেতে হবে না, তাই সে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াল। সে দৌড়ে ঘরটার কাছে ছুটে যায়। দরজার হ্যাঁন্ডেল ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে খোলার চেষ্টা করল, দরজাটি খুলল না, খুলবে সেটি সে আশাও করেনি।
এবার ডান হাতের তর্জনীটি দরজার হাতলের দিকে লক্ষ করে বুড়ো আঙুলের গোড়ায় চাপ দিল, সাথে সাথে আঙুলের চামড়া ভেদ করে একটি ছোট বিস্ফোরক ছুটে গেল, বিস্ফোরণের শব্দের সাথে সাথে দরজার হ্যাঁন্ডলটি খুলে আসে। রিটিন লাথি দিতেই এবারে দরজাটা খুলে গেল। রিটিন তখন ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তার ভাগ্য ভালো দরজাটা বন্ধ রাখার জন্যে ভেতরে আরো একটা লক আছে, দ্রুত সে লকটা লাগিয়ে দেয়। ক্লোনগুলো সহজে এখন ভেতরে ঢুকতে পারবে না।
রিটিন ঘরের ভেতরে তাকাল। চারদিক থেকে বড় বড় পাইপ এসে জড়ো হয়েছে। একদিক থেকে হিমশীতল পাইপগুলো বের হয়েছে, অন্যদিক দিয়ে উষ্ণ পাইপগুলো ফিরে এসেছে। দেয়ালে একটা বড় কন্ট্রোল প্যানেল, সেটি দেখার আর সময় নেই। রিটিন পাইপের ভাল্বগুলোর দিকে তাকাল, সেগুলো বন্ধ করে দিতে পারলেই হিমশীতল তরলের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সে কি খালি হাতে এত বড় বড় ভাল্ব বন্ধ করতে পারবে?
এখন চিন্তা করার সময় নেই, রিটিন তাই তার চেষ্টাও করল না। সে বড় একটা ভাল্ব ধরে সেটাকে টেনে বন্ধ করার চেষ্টা করল, কোনো লাভ হলো না। গোড়ায় একটা ছোট কন্ট্রোল বক্স রয়েছে, সেটা অকেজো না করা পর্যন্ত ভাটা বন্ধ করা যাবে না। রিটিনের অন্য হাতের আঙুলে এখনো আরেকটি বিস্ফোরক লুকানো আছে, সেটি এখন ব্যবহার করতে পারে।
বাম হাতের তর্জনীটি কন্ট্রোল বক্সের দিকে তাক করে সে তার বুড়ো আঙুলটি টেনে ধরে, সাথে সাথে আগুলের চামড়া ভেদ করে ক্ষুদ্র বিস্ফোরকটি ছুটে বের হয়ে কন্ট্রোল বক্সটাকে আঘাত করল। বিস্ফোরণের ঝলকানির সাথে সাথে কন্ট্রোল বক্সটা হাট হয়ে খুলে যায়। ভেতরে কিছু সার্কিট, রিটিন লাথি দিয়ে সার্কিটগুলো গুঁড়ো করে দিয়ে আবার বড় ভাল্বটাকে ধরে টান দিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করল। প্রথমে সেটি নড়তে চাইল না কিন্তু একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই ঘড় ঘড় শব্দ করে ভাটা বন্ধ হয়ে গেল।
শীতল প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতেই ভবনের মাঝে থরে থরে সাজানো যন্ত্রগুলো মুহূর্তের মাঝে গনগনে লাল হয়ে ওঠে, তারপর প্রচণ্ড বিস্ফোরণ করে একটি পর একটি বাষ্পীভূত হয়ে যেতে থাকে। লকলকে আগুনের শিখা আর কুচকুচে কালো ধোঁয়ায় ভবনটি অন্ধকার হয়ে যায়।
সারি বেঁধে ছুটে আসা ক্লোনগুলো থমকে দাঁড়িয়ে গেল, তারপর কাতর আর্তনাদ করে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে। এই যন্ত্রগুলো তাদের অস্তিত্ব, যদি এগুলো ধ্বংস হয়ে যায় তাদের বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই।
রিটিন হতবাক হয়ে দেখতে পেলো ভবনটির যন্ত্রগুলোর একটার পর একটাকে আগুনে গ্রাস করে ফেলছে–সেই গনগনে লাল আগুনে একটির পর একটি ক্লোন ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কী ভয়ংকর দৃশ্য, রিটিন আর দেখতে পারছিল না, সে দুই হাতে মুখ ঢেকে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
.
১৮.
বড় টেবিলটার এক পাশে বসে স্যুপের বাটি থেকে এক চামচ স্যুপ মুখে দিয়ে ক্লিওন বলল, “তোমাকে ধন্যবাদ রিটিন।”