রিটিন অস্ত্রটা হাতে ধরে চিৎকার করে বলল, “তোমরা সবাই পিছিয়ে যাও। নইলে আমি গুলি করব। পিছিয়ে যাও।”
মানুষগুলো যন্ত্রের মতো এক পা পিছিয়ে গেল। শুধু পিছিয়ে গেল না, একজন থেকে আরেকজন সরে গেল। এরা নিজেদের ভেতর একটা দূরত্ব তৈরি করছে।
রিটিন আবার চিৎকার করল, “পিছিয়ে যাও।”
মানুষগুলো আবার এক পা পিছিয়ে গেল, রিটিন লক্ষ করল কেউ একটু বেশি পিছিয়েছে, কেউ কম। মানুষগুলো আসলে বৃত্তাকারে তাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। রিটিন প্রথমবার এক ধরনের বিপদ আঁচ করতে পারে, কিছু একটা ঘটছে যেটা সে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে তার কী মনে হলো কে জানে, সে মাথা ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাল, দেখল পেছন থেকে নিঃশব্দে অনেকগুলো ক্লোন তার দিকে এগিয়ে আসছে।
কিছু বোঝার আগেই সবগুলো ক্লোন এক সাথে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রিটিন হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা দিয়ে গুলি করার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, কেউ একজন পেছন থেকে তার মাথায় আঘাত করেছে। কী হচ্ছে বোঝার আগেই চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। রিটিন শক্ত গ্রানাইটের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগে আবছা আবছা দেখতে পেল অসংখ্য ক্লোন হিংস্র মুখে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, মনে হচ্ছে তার সমস্ত শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
জ্ঞান হারানোর আগে রিটিন হঠাৎ করে নিজের ভেতর এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে। ক্লোনগুলো তাকে এখানে মেরে ফেলবে। তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না। বিস্ফোরকগুলো তার শরীরের সাথে ট্রিগার করে রাখা আছে। তার হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়া মাত্রই বিস্ফোরকগুলো বিস্ফোরিত হয়ে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলবে।
সে বেঁচে থাকবে না কিন্তু মৃত্যুর ভেতর দিয়ে তার দায়িত্ব সে পালন করে যাবে। ক্লোনগুলোর হিংস্র আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হতে হতে রিটিন তার চোখ বন্ধ করল। ধীরে ধীরে সে অচেতন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, জীবনের শেষ মুহূর্তটি সে সুন্দর কিছু ভাবতে চায়।
রিটিনের চোখের সামনে তানুস্কার চেহারাটি ভেসে ওঠে। রিটিন দেখল তানুস্কা গভীর মমতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
রিটিন তখন জ্ঞান হারাল।
১৭-১৮. রিটিনের জ্ঞান ফিরে আসে
১৭.
খুব ধীরে ধীরে রিটিনের জ্ঞান ফিরে আসে। রিটিনের প্রথম অনুভূতিটি হয় তীব্র ঠান্ডার, তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। রিটিন চোখ খুলে তাকাল, হঠাৎ করে তার মনে হয় সে বুঝি একটি পরাবাস্তব দৃশ্য দেখছে। থরে থরে যন্ত্র সাজানো এবং সেই যন্ত্রগুলোকে পরম মমতা এবং ভালোবাসায় ক্লোনগুলো আদর করছে। মানুষ যেমন করে তার ভালোবাসার মানুষটিকে আদর করে, ক্লোনগুলোর যন্ত্রগুলোকে আদর করার ভঙ্গি তার থেকেও বেশি বাস্তব। তার থেকেও বেশি তীব্র।
রিটিন চোখ বন্ধ করে। এই যন্ত্রগুলোকে দেখেশুনে রাখার জন্যে মানুষ কী বিচিত্র একটা পদ্ধতি বের করেছে।
রিটিন একটা নিঃশ্বাস ফেলল, সে এখনো বেঁচে আছে। সে বেঁচে আছে বলে বিস্ফোরকগুলো এখনো বিস্ফোরিত হয়নি। তার দাঁতের ভেতর ছোট একটা ক্যাপসুলে একটা সায়ানাইডের এম্পুল আছে। একটা বিশেষ নিয়মে কামড় দিলে এম্পুলটি ভেঙে যাবে, সাথে সাথে মৃত্যু হবে তার। ক্লোনগুলো কিছু বোঝার আগেই পুরো ভবনটি ধ্বংস হয়ে যাবে। রিটিন কি এখন তার দাঁতের কামড় দেবে? ভেঙে ফেলবে সায়ানাইডের এম্পুলটিকে?
আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক। মৃত্যু যখন নিশ্চিত তখন সেটি কয়েক মুহূর্ত পরে এলেও ক্ষতি নেই। রিটিন আবার চোখ খুলে তাকাল। যন্ত্রকে আদর করার পরাবাস্তব দৃশ্যটি আবার ফিরে এল তার চোখের সামনে। রিটিন দৃশ্যটি দেখতে দেখতে হঠাৎ আবার শীতে থরথর করে কেঁপে ওঠে। এত ঠান্ডা লাগছে কেন?
রিটিন ভালো করে তাকাল। জ্ঞান হারানোর পর তাকে টেনে ঘরের এক কোনায় এনে ফেলে রেখেছে। ঘরের এই কোনা দিয়ে মোটা মোটা কিছু পাইপ গিয়েছে, পাইপগুলো হিমশীতল। এই হিম শীতল পাইপগুলোর উপর পড়ে থাকার কারণে সে শীতে থরথর করে কাঁপছে। পাইপগুলোর উপর থেকে সরে যাবার একটু চেষ্টা করতেই তার সারা শরীর যন্ত্রণায় শিউরে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে সে যন্ত্রণার ঢেউটি নিজের শরীরের ভেতর দিয়ে বয়ে যেতে দিল এই হিমশীতল পাইপগুলো এখানে কী করছে? পাইপগুলো এত হিমশীতল কেন?
হঠাৎ করে রিটিন চমকে উঠল। নিয়ন্ত্রণ ভবনের ভেতর থরে থরে সাজানো যন্ত্রগুলোকে শীতল রাখার জন্যে এই পাইপগুলোর ভেতর দিয়ে কোনো এক ধরনের তরল পাঠানো হচ্ছে। অনেক পুরানো কিন্তু কার্যকর পদ্ধতি। যন্ত্রগুলোর ভেতর যে পরিমাণ তাপ তৈরি হচ্ছে সেটাকে শীতল করতে বিশাল পরিমাণ হিমশীতল তরল পাঠাতে হয়। এই হিমশীতল প্রবাহ কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে মুহূর্তে সবগুলো যন্ত্র প্রচণ্ড তাপে বাষ্পীভূত হয়ে যাবে! তাকে কোনো বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে না, এই হিমশীতল তরলের প্রবাহটি শুধু এক মুহূর্তের জন্যে থামতে হবে।
সায়ানাইডের এম্পুলে কামড় না দিয়ে সে কি কোনোভাবে এই হিমশীতল তরল প্রবাহ কয়েক মুহূর্তের জন্যে বন্ধ করতে পারে না? রিটিন হঠাৎ করে নিজের ভেতর একধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। তার এখন শরীরে কয়েক সিসি ট্র্যাকিনল দরকার। তার শরীরের ভেতরেই একটা এম্পুল রয়েছে, সেটাকে ভেঙে দিয়ে রক্তের প্রবাহের সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। রিটিন সাবধানে কনুইয়ের একটু উপরে হাত দিয়ে চামড়ার নিচে ট্রাকিনলের এম্পুলটি খুঁজে বের করে দুই পাশ থেকে চাপ দিল। কয়েকবার চেষ্টা করতেই এম্পুলটা ভেঙে তার রক্তের মাঝে ট্র্যাকিনলও মিশে যেতে থাকে। কয়েক সেকেন্ডের ভেতর রিটিন সতেজ অনুভব করতে থাকে।