রোবটটা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি এই কথাটা আমাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে বলেছ। কথাটি তুমি বিশ্বাস করো না। কেন তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলছ?”
রিটিন উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না, একটু চিন্তা করে বলল, “এই মুহূর্তে হয়তো কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করি না কিন্তু যেহেতু কথাটার মাঝে যুক্তি আছে আমাকে আগে হোক পরে হোক মেনে নিতে হবে।”
“তুমি গবেষণা করার কথা বলেছ। তুমি কী নিয়ে গবেষণা করতে চাও?”
রিটিন বলল, “আমি এখনো বিশেষ কিছু জানি না। তাই কী নিয়ে গবেষণা করতে চাই সেটা পরিষ্কারভাবে বলা সম্ভব নয়।”
পুলিশটি বলল, “কিছু একটার কথা বলো। তুমি সবসময়ই নতুন তথ্য সংগ্রহ করছ।”
কী বললে রোবটটা কী বুঝবে সেটা নিয়ে রিটিন একটু দুর্ভাবনার মাঝে ছিল, তারপরও সে অনিশ্চিতের মতো বলল, “সময় পরিভ্রমণের বিষয়টা আমাকে খুবই কৌতূহলী করে–”
কথাটা শেষ করার আগেই এবারে পুলিশগুলো চিৎকার করে রিটিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিছু বোঝার আগেই রিটিন আবিষ্কার করল সে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পুলিশগুলো তার হাত দুটো পেছনে নিয়ে সেখানে হ্যাঁন্ডকাফ লাগাচ্ছে। রিটিন বলার চেষ্টা করল, “কী হয়েছে?”
তার আগেই সে ঘাড়ের কাছে একটা খোঁচা অনুভব করল, সাথে সাথে পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যায়।
.
০২.
অনেক মানুষের কথা শুনতে শুনতে রিটিনের জ্ঞান ফিরে এল। মনে হচ্ছিল অনেক দূর থেকে বুঝি কথাগুলো ভেসে আসছে, ঢেউয়ের মতো কখনো কথাগুলো কাছে আসে আবার দূরে চলে যায়। রিটিন একসময় চোখ খুলে তাকাল, সে নোংরা একটা শক্ত মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। রিটিন সাবধানে মাথা তুলে তাকাল, সাথে সাথে মনে হলো মাথার ভেতর কিছু একটা যেন ছিঁড়ে গেল, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আবার মেঝেতে মাথা রেখে রিটিন কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। শুয়ে থেকেই রিটিন চোখ খুলে পিট পিট করে দেখার চেষ্টা করল। ঘরটাতে সে একা নয়, অনেক মানুষ। কেউ কেউ তার মতো নোংরা মেঝেতে অচেতন হয়ে শুয়ে আছে। কেউ কেউ মাথা নিচু করে বসে আছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষগুলো নিজেদের মাঝে নিচু স্বরে কথা বলছে। রিটিন ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করল, তখন শুনতে পেল কেউ একজন বলল, “এই যে আরেকজনের জ্ঞান ফিরেছে।”
কথাটা রিটিনকেই বলেছে কি না বোঝা গেল না, রিটিন তার মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই মাথার ভেতরে কোথায় জানি চিন চিন করে ব্যথা করে উঠল। রিটিন তাই আর চেষ্টা করল না, হাঁটুতে মাথা রেখে প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। আগের মানুষটা আবার বলল, “বসে থাকলে হবে না, উঠে দাঁড়াও। হাঁটো।”
রিটিন কোনোমতে মাথা ঘুরিয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে বলছ?”
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, লাল চোখ, এলোমেলো চুলের একজন মানুষ একটা বেঞ্চে পিঠ সোজা করে বসে আছে, সে মাথা নেড়ে বলল, “আর কাকে বলব? তোমাকেই বলছি।”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়?”
রিটিনের কথা শুনে মানুষটা হাহা করে হেসে উঠল, আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে বলল, “জিজ্ঞেস করছে সে কোথায়? এখনো জানে না সে কোথায়।”
মোটামুটি একই চেহারার কিন্তু গায়ের রং মৃত মানুষের মতো ধবধবে সাদা একজন বলল, “তুমি কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে। কেউ যখন কোনো অপরাধ করে তখন তাকে এখানে আনে।”
রিটিন বলল, “আমি কোনো অপরাধ করিনি।”
তার কথাটা শুনে এবারে মনে হলো আরো অনেকে খুব মজা পেল। তারা আনন্দে হাহা করে হাসতে থাকে। একজন হাসি থামিয়ে বলল, “যখন কেউ এখানে আসে তখন সে সবসময় বলে সে কোনো অপরাধ করেনি।”
রিটিন বলল, “আমি শুধু মেটাকোড বলে একটা রোবটকে অচল করেছিলাম।”
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি মানুষটা বলল, “আর কিছু করনি? একটা দুইটা মার্ডার?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না। মার্ডার করিনি।”
“ড্রাগস? সাইড বিজনেস? ব্ল্যাক মার্কেট খুব ভালো ভিচুরিয়াস এসেছে।”
রিটিন বলল, “না আমি ড্রাগস বিজনেস করিনি।”
“করেছ। নিশ্চয়ই করেছ। তা না হলে তোমাকে এখানে আনবে কেন? তোমার নিশ্চয়ই এখন মনে নেই।”
রিটিন আর তর্ক করল না। ধবধবে সাদা মানুষটা বলল, “চেক আপের সময় সব বের হয়ে আসবে।”
“চেক আপ? কিসের চেক আপ?”
“এখনো জান না চেক আপ কী?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না, জানি না।”
একজন বলল, “প্রথমবার এসেছে তো তাই কিছু জানে না।”
আরেকজন বলল, “আস্তে আস্তে জেনে যাবে। প্রথমবার একটু ঝামেলা হয়, তারপর অভ্যাস হয়ে যায়।”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তোমরা আগে এখানে এসেছ?”
“অনেকবার।”
“কী করে এখানে?”
“ধোলাই। ধোলাই করে তোমাকে সিধে করে দেবে।”
খোঁচা খোঁচা দাড়ির মানুষটা বলল, “কেন শুধু শুধু ছেলেটাকে ভয় দেখাচ্ছ?”
“কে বলেছে ভয় দেখাচ্ছি, মোটেও ভয় দেখাচ্ছি না। সত্যি কথা বলে প্রস্তুত থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”
ঠিক তখন একটা দরজা খুলে গেল এবং ধূসর পোশাক পরা একটা রোবট ঢুকে হাতের ট্র্যাকারটা উঁচু করে মানুষগুলোর দিকে তাক করে সুইচ টিপে দিল। সাথে সাথে একজন লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়, সবাই দেখল তার পুরো শরীরটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে শুরু করেছে। মানুষটা কোনোভাবে নিজের কাঁপুনিটা থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, “আসছি! আসছি!”
মানুষটা দরজার দিকে প্রায় ছুটে গেল। রোবটটা তার ট্র্যাকারটা নামিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে হাঁটতে থাকল, মানুষটাও তার পাশে পাশে কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে যেতে থাকে।