রিটিন শক্ত করে অস্ত্রটা ধরে রাখল, যদি মানুষগুলো বিন্দুমাত্র বিপদের আভাস দেয় এক পশলা গুলি দিয়ে সবাইকে শেষ করে দেবে। কিন্তু মানুষগুলো একটু নড়ল না, কোনো রকম বিপজ্জনক কিছু করল না, শুধুমাত্র স্থির দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল।
রিটিন মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে আনার চেষ্টা করে বলল, “শুভ সকাল।”
মানুষগুলো কোনো উত্তর না দিয়ে তার দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। রিটিন বলল, “আমি বলেছি শুভ সকাল।”
এবারে মানুষগুলো একজন কিংবা বেশ কয়েকজন মিলে বলল, “আসলে সময়টা সকাল না। সন্ধে হয়ে গেছে।”
গলার স্বর যান্ত্রিক। রিটিন অস্ত্রটা তাক করে রেখে বলল, “তোমরা কী রোবট?”
মানুষগুলো পুতুলের মতো একসাথে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, “না, আমরা রোবট না। আমরা মানুষ।”
রিটিন অবাক হয়ে লক্ষ করল সবগুলো মানুষ মিলে কথা বলছে কিন্তু তারা এক সাথে কথা বলছে না, একেকজন একেকটা শব্দ উচ্চারণ করছে, কিন্তু এত বিস্ময়করভাবে একজনের পর আরেকজন কথা বলে যাচ্ছে যে শুনে মনে হচ্ছে বুঝি একজন কথা বলছে।
রিটিন অস্ত্রটা তাক করে ধরে রেখে বলল, “তোমরা ক্লোন।”
“হ্যাঁ, আমরা একে অপরের ক্লোন।”
রিটিন কী বলবে বুঝতে পারল না। একটু ইতস্তত করে বলল, “তোমাদের সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।”
মানুষগুলো উত্তর দিল না, তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। রিটিন বলল, “আমি একটা বিশেষ কাজ করতে এসেছি। আশা করি তোমরা আমাকে কাজটা করতে দেবে। আমার কাজে বাধা দেবে না।”
“কী কাজ?”
“আমি এই যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে এসেছি। যদি আমার কাজে বাধা দাও আমায় তোমাদেরকে মেরে ফেলতে হবে।”
মানুষগুলো নিচু গলায় কিছু একটা বলল, রিটিন ঠিক বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, “কী, বললে তোমরা?”
“বলেছি যন্ত্রগুলো ধ্বংস করলে আমরা এমনিতেই মরে যাব।”
“এমনিতেই মরে যাবে? কেন?”
“আমরা হচ্ছি যন্ত্রগুলোর আত্মা। যন্ত্রগুলো আমাদের শরীর। শরীর ধ্বংস হলে আত্মা বেঁচে থাকে না।”
রিটিন শব্দ করে হাসল। বলল, “যন্ত্র হচ্ছে যন্ত্র। যন্ত্রের আত্মা থাকে না। তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো তোমরা মারা যাবে না। কিন্তু আমার কাজে বাধা দিলে তোমাদের অবশ্যই মেরে ফেলতে হবে।”
মানুষগুলো কোনো কথা না বলে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল। রিটিন বলল, “তোমরা পেছন দিকে সরে যাও আমি এখন যন্ত্রগুলোতে বিস্ফোরক লাগাব।”
মানুষগুলো জিজ্ঞেস করল, “কেন তুমি যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে চাও?”
“এই যন্ত্রগুলো দিয়ে পৃথিবীর মানুষের বিভাজন করা হয়। আমরা বিভাজন দূর করে দিতে চাই।”
“পৃথিবীতে কি অনেক মানুষ?”
রিটিন একটু অবাক হয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “তোমরা পৃথিবীর কিছু জানো না?”
মানুষগুলো বলল, “এটা আমাদের পৃথিবী। এই যন্ত্রগুলো আমাদের শরীর, আমরা যন্ত্রগুলোর আত্মা। বাইরের পৃথিবীতে কী আছে আমরা জানি না। জানতেও চাই না।”
এই নিয়ে দ্বিতীয়বার মানুষগুলো যন্ত্রের আত্মা কথাটি বলেছে। কেন বলেছে কে জানে। রিটিন তার কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাকটা খুলে ভেতর থেকে বিস্ফোরকগুলো বের করতে থাকে। ছোট ছোট চতুষ্কোণ ব্লক। উপরে একটি ডায়াল, ডায়ালটিতে সময় নির্ধারণ করে দিতে হয়। নির্ধারিত সময়ে বিস্ফোরকগুলো বিস্ফোরিত হয়।
রিটিন একটা বিস্ফোরক হাতে নিয়ে মানুষগুলোকে লক্ষ করে বলল, “তোমরা পেছনে সরে যাও, এই বিস্ফোরকগুলো প্রচণ্ড শক্তিশালী। যখন যন্ত্রগুলো ধ্বংস হবে তখন দূরে থাকতে হবে।”
মানুষগুলো বলল, “আমরা কি যন্ত্রগুলোর কাছে থাকতে পারি?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “না। পারো না।”
“জন্ম থেকে আমরা এই যন্ত্রগুলোকে লালন করেছি। মৃত্যুর সময় আমরা তার পাশে থাকতে চাই।”
রিটিন কঠিন মুখ করে বলল, “না, আমি যখন যন্ত্রগুলো ধ্বংস করব তখন তোমরা তার কাছে থাকতে পারবে না। আমি যন্ত্র ধ্বংস করতে এসেছি, মানুষ ধ্বংস করতে আসিনি। যাও, পিছিয়ে যাও।”
মানুষগুলো পিছিয়ে গেল না। বলল, “তুমি কেন যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে চাও? যন্ত্রগুলো ধ্বংস করলে আমরাও ধ্বংস হয়ে যাব।”
“না, তোমরা ধ্বংস হবে না।”
“এই যন্ত্র ছাড়া আমাদের জীবনে আর কিছু নেই।”
“এখন থাকবে। এখান থেকে বের হওয়ার পর তোমাদের নতুন একটা জীবন হবে।”
“কিন্তু কেন যন্ত্রগুলো ধ্বংস করতে চাও?”
রিটিন মাথা ঘুরিয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা কি জানো এই যন্ত্রগুলো কী করে?”
“না। জানি না।”
“তাহলে জেনে রাখো। এই যন্ত্রগুলো পৃথিবীর সব মানুষের সব তথ্য সংরক্ষণ করে। সেই তথ্য দিয়ে মানুষের সাথে মানুষের বিভাজন করা হয়। যদি এই যন্ত্রগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয় তাহলে মানুষে মানুষে আর বিভাজন থাকবে না।”
মানুষগুলো এক সাথে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “যন্ত্র দিয়ে কী হয় আমরা জানতে চাই না, আমরা শুধু যন্ত্রটা চাই।”
রিটিন মানুষগুলোর দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল এই মানুষগুলো কিছুতেই তাকে যন্ত্রগুলোর মাঝে বিস্ফোরক লাগাতে দেবে না। শুধু তাই নয়, এই মানুষগুলো একে অপরের ক্লোন, তারা এক সাথে একভাবে চিন্তা করে, তাই হঠাৎ করে সবাই যদি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে তাদের থামাতে পারবে না। মানুষগুলোর মাথায় কী আছে সে জানে না। তারা কী ভাবছে সেটাও সে জানে না।