তানুস্কা চোখের পানি লুকিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। কয়েক পা গিয়ে হঠাৎ করে সে আবার ছুটে ফিরে আসে। রিটিনকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি পারব না রিটিন। আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারব না, আমাকে তুমি তোমার সাথে নিয়ে যাও।”
নীল অনুচ্চ স্বরে বলল, “মা। রিটিন তোমাকে নিয়ে গেলে আমি কার সাথে থাকব?”
রিটিন নিঃশব্দে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
দুই ঘণ্টা পর তানুস্কা তার ভ্যানটি চালিয়ে উত্তরে যেতে থাকে। সে তার মস্তিষ্কটিকে পুরোপুরি শূন্য করে রাখার চেষ্টা করছে।
ঠিক তখন রিটিন মাটির পাঁচশ মিটার নিচে একটা টিউবের ভেতর শুয়ে তার মাথার কাছে একটা যন্ত্রপাতির প্যানেলের সুইচ টিপে দেয়। খুব অস্পষ্ট একটা চাপা গুঞ্জন শুনতে পেল। টিউবের ভেতর একধরনের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রিটিনের চোখে ঘুম নেমে আসতে থাকে।
সুদীর্ঘ একটি ঘুম। টানা পাঁচশ বছরের ঘুম।
.
১৬.
খুব ধীরে ধীরে রিটিনের ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে কিছুক্ষণ রিটিন বুঝতে পারে না সে কোথায় আছে, কেন আছে। ধীরে ধীরে তার চেতনা ফিরে আসতে থাকে এবং হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ে যায়। তানুস্কা তাকে গভীর আলিঙ্গনে ধরে রেখে আকুল হয়ে কাঁদছে, দৃশ্যটার কথা সে ভুলতে পারছে না, কিন্তু সেই ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে। পাঁচশ বছর দীর্ঘ সময়, এই সময়ে পুরো পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেছে। পৃথিবীর এই সময়ে তানুস্কা নেই–রিটিন সেটি মেনে নিতে পারছিল না। তার মনে হতে থাকে ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এলেই দেখবে ঘন অরণ্য। সামনে ছুটে গেলেই দেখবে তানুস্কা তার ভ্যানটিতে হেলান দিয়ে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে দাঁড়িয়ে আছে নীল, তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে।
রিটিন জানে আসলে গত পাঁচশ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সে মাটির গহ্বরে যে কক্ষটিতে শুয়ে আছে তার উপরে সেই অভিশপ্ত নিয়ন্ত্রণকক্ষ। তাকে সেখানে যেতে হবে, কক্ষটিকে ধ্বংস করতে হবে। তানুস্কা নেই। নীল নেই, কয়েকদিনের সেই দিনগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। সেটি শুধুমাত্র স্মৃতি। তার মস্তিষ্কের কিছু কিছু নিউরনে জমা করে রাখা একটি পরাবাস্তব স্মৃতি।
রিটিন তার মাথা থেকে সব চিন্তা জোর করে সরিয়ে দিল। তাকে যে কাজ করার জন্যে পাঠানো হয়েছে তাকে সেই কাজটি শেষ করতে হবে। পৃথিবীতে মানুষের বিভাজনটি শেষ হবে কি হবে সেটা নির্ভর করছে সামনের কয়েকটি ঘণ্টায় সে ঠিক করে তার দায়িত্বটি শেষ করতে পারবে কি না তার উপর।
রিটিন সরু ক্যাপসুলটিতে উঠে বসে। মাথার কাছে রাখা মনিটরটির দিকে তাকায়, ছোট প্যানেলটির কয়েকটি জায়গা স্পর্শ করতেই তার শরীরে কিছু উত্তেজক তরল প্রবাহিত হতে শুরু করে এবং প্রায় সাথে সাথেই রিটিন সতেজ অনুভব করতে থাকে।
রিটিন ছোট ক্যাপসুলটির ভেতর বসে তার ব্যাক প্যাকটি পরীক্ষা করল। এর ভেতর যে পরিমাণ বিস্ফোরক আছে সেটি দিয়ে পুরো একটি শহরকে মুহূর্তে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। রিটিন তার পোশাক পাল্টে নেয়, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে তারপর উপরের মাটি ভেদ করে বের হয়ে আসার কাজে লেগে যায়।
রিটিন পুরো সিস্টেমটি পরীক্ষা করল, সবকিছু ঠিকভাবে কাজ করছে। এখন কয়েকটি বোতাম টিপে তাকে অপেক্ষা করতে হবে। নিও মিসাইল উপরের মাটি পাথর কংক্রিট ধাতব শিলা সবকিছু কেটে একটা গোল গর্ত তৈরি করে দেবে। রিটিনকে সেই গর্ত দিয়ে নিয়ন্ত্রণকক্ষের ভেতর ঢুকে যেতে হবে। সেখানে কী দেখবে সে জানে না।
রিটিন কন্ট্রোল প্যানেলের বোতামগুলো স্পর্শ করল। সাথে সাথে সে একটি ঝাঁকুনি অনুভব করল এবং ভোতা একটি যান্ত্রিক শব্দ শোনা যেতে থাকে। রিটিন মনিটরের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।
রিটিন ভেবেছিল গর্তটি করতে বুঝি অনেক সময় নেবে। কিন্তু বেশি সময় নিল না, হঠাৎ করে যান্ত্রিক শব্দটি থেমে যায় এবং মনিটরে একটা লাল বাতি জ্বলতে থাকে। রিটিনের বের হবার সময় হয়েছে।
রিটিন তখন ক্যাপসুল খুলে বের হয়ে আসে। ঠিক তার মাথার উপর গোল একটি গর্ত। মাটি পাথর ধাতব দেয়াল আর কংক্রিট কেটে গর্ত করা হলে নিচে যে পরিমাণ জঞ্জাল আর ধুলো বালি থাকার কথা সেরকম নেই। গর্ত করায় যে নিও মিসাইলটি ব্যবহার হয়েছে সেটি নিশ্চয়ই প্রথম শ্রেণির যন্ত্র।
রিটিন তার শরীরে জেট প্যাক লাগিয়ে নিল, তারপর ব্যাক প্যাকের বিস্ফোরকের সুইচটা টিপে সেটাকে ট্রিগার করে নিল। তারপর গর্তের নিচে দাঁড়িয়ে জেট প্যাকটির কন্ট্রোল রডটি ধরে চাপ দিতেই সে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করে। উপরে কী আছে সে জানে না। বের হওয়ামাত্রই গুলি করে তাকে ছিন্নভিন্ন। করে দেবে কি না সেটাও সে জানে না। দিলেও ক্ষতি নেই, সে যতক্ষণ বেঁচে থাকবে বিস্ফোরকটি নিজে নিজে বিস্ফোরিত হবে না, তার নিজের হাতে সেটিকে বিস্ফোরিত করতে হবে। কিন্তু কোনো কারণে সে মারা গেলে বিস্ফোরকটি নিজে নিজে বিস্ফোরিত হবে।
গর্তটির মুখের কাছে এসে সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে, তারপর একটা ঝটকা দিয়ে উপরে উঠে আসে। একটা আলোকোজ্জ্বল হলঘর, চারপাশে থরে থরে যন্ত্রপাতি সাজানো। যন্ত্রপাতিগুলো আশ্চর্য রকম নীরব, এতগুলো যন্ত্র থেকে বিন্দুমাত্র শব্দ বের হচ্ছে না। রিটিন অস্ত্রটি হাতে নিয়ে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়। অনেকগুলো মানুষ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে তার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মানুষগুলো সবাই একই রকম। সাদা ওভার অল পরে আছে। আর সবচেয়ে যেটি আশ্চর্য সেটি হচ্ছে সবগুলো মানুষ শুধু যে দেখতে একরকম তা নয় মানুষগুলোর মুখের অভিব্যক্তি এক রকম। তারা সবাই একসাথে মুখটা উপরে তুলে রিটিনের দিকে তাকাল, তারপর এক সাথে সবাই চোখের দৃষ্টি নামিয়ে আনে।