“তার আগে আমাকে একটু সময় দাও, আমি দেখে আসি নীল কী করছে! এখানে এত খুনোখুনি হয়ে গেল সে কি কিছু টের পায়নি।”
রিটিন বলল, “মনে হয় পায়নি। জেগে উঠলে এতক্ষণে বাইরে চলে আসত।”
তানুস্কা বাসার দিকে ছুটে যেতে লাগল।
১৫-১৬. নির্জন রাস্তা দিয়ে তানুস্কা
১৫.
নির্জন রাস্তা দিয়ে তানুস্কা তার ভ্যানটি চালিয়ে নিচ্ছে। তানুস্কার পাশে রিটিন নিঃশব্দে বসে আছে। পেছনের সিটে নীল ঘুমিয়ে আছে। তাদেরকে প্রায় বারোশত কিলোমিটার যেতে হবে, একটানা গাড়ি চালিয়ে গেলেও চব্বিশ ঘণ্টা থেকে বেশি লেগে যাবে। একটানা গাড়ি চালানো সম্ভব নয়, রিটিন গাড়ি চালাতে পারে না। সে যে পৃথিবী থেকে এসেছে সেখানে কোনো মানুষ গাড়ি চালায় না। একজন মানুষ যে গাড়ি নামের এই বিপজ্জনক যন্ত্রটাকে সরু একটা রাস্তার উপর দিয়ে ঠিকভাবে চালিয়ে নিতে পারে সেটি নিজের চোখে দেখেও রিটিনের এখনো বিশ্বাস হয় না।
ভ্যানের পেছনে রিটিনের যন্ত্রপাতি। একটি ধাতব টিউব, এর ভেতরে সে পাঁচশত বছরের জন্যে ঘুমিয়ে যাবে। এই টিউবটিকে শীতল রাখার জন্যে ছোট একটি ফিউসান ইঞ্জিন, সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যন্ত্রপাতি। মাটি খুঁড়ে নিচে নামার জন্যে কিছু ভারী যন্ত্রপাতি। পাঁচশ বছর পর আবার এই যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করে সে উপরে উঠে নিয়ন্ত্রণ ভবনে ঢুকে যাবে। নিয়ন্ত্রণ ভবন ধ্বংস করার জন্যে তার কাছে প্রচুর বিস্ফোরক, যে বিস্ফোরক দিয়ে সম্ভবত পৃথিবীর একটা বড় শহর ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব। এছাড়া আছে কিছু ভয়ংকর দর্শন অস্ত্র। বারোশত কিলোমিটার যাবার সময় পথে যদি কোনো কারণে পুলিশ তাদের থামিয়ে পেছনে কী আছে সেটা পরীক্ষা করতে চায় তাহলে খুব বড় বিপদে পড়ে যেতে পারে! তবে পাঁচশ বছর পরের প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি এই মুহূর্তে কেউ যেন চিনতে না পারে সে জন্যে যথেষ্ট যত্ন করে নকল খোলস দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে এগুলোকে পানির পাম্প, সার ছিটানোর স্প্রে, ট্রাক্টরের ইঞ্জিন এরকম মনে হবে।
রিটিন তানুস্কাকে সবকিছু খুলে বলেছে। তানুস্কা সবকিছু খুঁটিনাটি বুঝেছে তা নয় কিন্তু অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছে তার সাথে হঠাৎ করে ক্ষণিকের পরিচয়ের এই মানুষটির উপর ভবিষ্যতের পৃথিবীর বিশাল একটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই মানুষটিকে ধরে রাখা যায় না। ভবিষ্যৎ থেকে একজন মানুষ তার কাছে চলে এসেছে এই বিষয়টিই সে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না।
নির্জন পথে গাড়ি চালাতে চালাতে দুজনে কথা বলছে। প্রথম প্রথম তাদের কথা হয়েছে নিজেদের জগৎ নিয়ে, একসময় সেই কথার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তখন কথা শুরু হয়েছে নিজেদের নিয়ে। নিজেদের কথা শেষ হওয়ার পর কথা হয়েছে একজন অপরজনকে নিয়ে।
গাড়ি চালাতে চালাতে একসময় তানুস্কা গাড়ি থামিয়েছে। কোনো একটা পার্কে কিংবা বনভূমিতে গাড়ি থামিয়ে বিশ্রাম নিয়েছে। তানুস্কা গাড়ির সিট লম্বা করে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে গেছে, রিটিন নীলকে কোলে নিয়ে তার সাথে গল্প করছে।
যখন তাদের ক্ষুধা পেয়েছে তখন তারা পথের ধারে কোনো একটা ছোট ক্যাফেতে গাড়ি থামিয়ে কিছু একটা খেয়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ যদি নদীতীরে কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে অপূর্ব একটি দৃশ্য ফুটে ওঠে তখন তারা সেখানে তাদের গাড়ি থামিয়ে পথের ধারে পা ছড়িয়ে বসে থেকেছে। কখনো দুজনে নিচু গলায় কথা বলে, কখনো চুপচাপ বসে থাকে। কখনো তানুস্কা করুণ সুরে একটি গান গায়। তানুস্কার মিষ্টি গলার স্বর শুনে রিটিন আনমনা হয়ে যায়। বুকের ভেতর থেকে হাহাকারের মতো একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে।
তৃতীয় দিন সকাল বেলা তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছাল। রাস্তা থেকে নেমে তাদের আরো ভেতরে যেতে হবে, পুরো এলাকাটি একটি বনভূমি। এখানে কেমন করে এত যন্ত্রপাতি নিয়ে যাবে তানুস্কা ঠিক অনুমান করতে পারছিল না, কিন্তু সে দেখল কাজটি বেশ সহজ। রিটিন যেসব যন্ত্রপাতি এনেছে তার মাঝে একটি হচ্ছে মিনি বাইভার্বাল। তার উপর সবকিছু চাপিয়ে রিটিন কিছুক্ষণের মাঝেই সবাইকে নিয়ে বনভূমির গভীরে ঢুকে গেল।
ঠিক কোথায় হিমঘরটি বসাবে সেটি রিটিন খুব নিখুঁতভাবে বের করল। জায়গাটি নিশ্চিত করার পর রিটিন যন্ত্র দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করল। প্রায় পাঁচশ মিটার গভীরে পাথরের নানা স্তর ভেদ করে সে একটা ছোট ঘর তৈরি করে নেয়, তারপর সেখানে যন্ত্রপাতি নামাতে থাকে।
সন্ধেবেলার আগেই তার কাজ শেষ হয়ে যায়। এখন শুধু ভেতরে গিয়ে টিউবের ভেতরে আশ্রয় নেয়া। পুরো সময়টুকু তানুস্কা একটা গাছের গুঁড়িতে চুপচাপ বসে ছিল। নির্জন বনভূমিতে পাখির ডাক, গাছের পাতার শব্দ কিংবা বুনো পশুর পদচারণা কিছুই সে শুনছিল না। যখন রিটিন তার কাছে বিদায় নিতে এল তখন তানুস্কা প্রথমবার ভেঙে পড়ল। রিটিনকে গভীর আলিঙ্গনে কিছুক্ষণ ধরে রেখে ছেড়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে ছেড়ে দিতে মন চাইছে না রিটিন। মনে হচ্ছে তোমাকে বুকে চেপে ধরে রাখি।”
রিটিন নিচু গলায় বলল, “যে কষ্ট মানুষ সইতে পারে না, মানুষকে সেই কষ্ট কেন পেতে হয় আমি জানি না।” তারপর মুখে জোর করে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, “অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে তানুস্কা। তুমি এখন যাও, তোমাকে অনেকটা পথ যেতে হবে।”