রাতে তারা ডাইনিং টেবিলে বসে হইচই করে খেতে লাগল, খেতে খেতে হাসাহাসি করতে লাগল। রিটিন তানুস্কার দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভেতর একধরনের তীক্ষ্ণ বেদনা অনুভব করে। তার মনে হতে থাকে, কী হতো যদি সে ক্যাটাগরি সি মানুষকে বাঁচানোর জন্যে নিয়ন্ত্রণ ভবনের জন্যে নির্দিষ্ট করা জায়গাটিতে পাঁচশত বছরের জন্যে শীতল ঘরে আশ্রয় না নেয়? সে যদি পাঁচশ বছর ভবিষ্যতের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে না নিয়ে এই সাদামাটা প্রাচীন পৃথিবীতে তানুস্কা আর নীলকে নিয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেয় তাহলে কী এমন ক্ষতি হবে? কেন তাকেই এত বড় দায়িত্ব নিতে হবে?
রিটিন যখন এরকম এলোমেলো চিন্তা করছিল ঠিক তখন একদিন গভীর রাতে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটল।
.
নীল ঘুমিয়ে গেছে। তানুস্কা আর রিটিন বাসার সামনে ডেক চেয়ারে আধশোয়া হয়ে গল্প করছে। রিটিন মাত্র আবিষ্কার করেছে তানুস্কার গলাটি খুব মিষ্টি, ইচ্ছে করলেই সে খুব সুন্দর গাইতে পারে। রিটিনের অনুরোধ রক্ষা করে সে প্রথম গানটি শেষ করে মাত্র দ্বিতীয় গানটি শুরু করেছে তখন হঠাৎ করে মাটি কেঁপে উঠল, জানালার কাঁচে ঝনঝন করে শব্দ করে উঠল। তানুস্কা গান থামিয়ে বলল, “ভূমিকম্প!”
।রিটিন ডেক চেয়ারে সোজা হয়ে বসল, সত্যিকারের ভূমিকম্প হয়ে থাকলে পায়ের নিচের মাটি শুধু একবার ঝটকা মেরে কেঁপে উঠবে না, এটি থরথর করে কাঁপতে থাকবে। কিন্তু মাটি আর কাঁপল না, পুরো পৃথিবী স্থির হয়ে রইল।
তানুস্কা বলল, “কী আশ্চর্য!”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “কোনটা আশ্চর্য।”
“এই যে একটা ঝটকা দিয়ে একবার কেঁপে ওঠা। তুমি যেদিন এসেছিলে সেদিনও ঠিক এভাবে মাটি এভাবে ঝটকা মেরে কেঁপে উঠেছিল।”
রিটিন চমকে উঠে তানুস্কার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “সত্যি।”
“হ্যাঁ।” তানুস্কা অবাক হয়ে বলল, “তুমি এত অবাক হলে কেন?”
রিটিন উত্তর দিতে পারল না, তানুস্কাকে বলতে পারল না তার টাইম ক্যাপসুল মাটির গহ্বরে আঘাত করায় আশপাশের মাটি কেঁপে উঠেছিল। এখন কি আবার আরেকটি টাইম ক্যাপসুল এসেছে? কেন এসেছে?
রিটিন উঠে দাঁড়াল। তানুস্কা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাও?”
“আসছি, আমি এক্ষুনি আসছি।”
রিটিনের গলার স্বরে কিছু একটা ছিল যেটি শুনে তানুস্কা হঠাৎ ভয় পেয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলল, “কী হয়েছে রিটিন? তুমি কোথা থেকে আসছ?”
রিটিন বলল, “কিছু হয়নি তানুস্কা। আসলে হয়তো কিছুই হয়নি। কিন্তু আমি একটু সাবধান থাকতে চাই। আমি আমার ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে আসি। আমার ব্যাগে নিরাপত্তার কিছু যন্ত্রপাতি আছে।”
রিটিন তার ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে এসে সেখান থেকে তার স্পেস ভিউয়ার বের করে এনে তার ভেতরে তাকাল। তানুস্কা অবাক হয়ে দেখল ভিউয়ারের স্ক্রিনে চারিদিক একেবারে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেখানে বহুদূরে চারজন মানুষকে হেঁটে আসতে দেখা গেল।
তানুস্কা অবাক হয়ে বলল, “এটা কী যন্ত্র? সবকিছু এত স্পষ্ট দেখা যায়! এত রাতে এখানে মানুষ কোথা থেকে আসছে?”
রিটিন তার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা ভয়ংকর দর্শন অস্ত্র বের করে আনে। অস্ত্রটিতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সচল করে চাপা গলায় বলল, “তানুস্কা, তুমি ভেতরে যাও।”
“কেন?”
“এখন আমার কাছে এটা জানতে চেয়ো না তানুস্কা। তুমি ভেতরে যাও, নীলকে বিছানা থেকে নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে রেখো। তুমিও তার পাশে শুয়ে থেকো।”
“তুমি কী বলছ রিটিন?” তানুস্কা ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হচ্ছে এখানে?”
“আমি তোমাকে এখন সবকিছু বুঝিয়ে বলতে পারব না। শুধু এটুকু বলতে পারি ঐ চারজন মানুষ সম্ভবত আমাকে মেরে ফেলতে আসছে।”
“কেন? তোমাকে মারবে কেন? তুমি কী করেছ?”
রিটিন চাপা গলায় বলল, “সেটা এখন বলতে পারব না, এখনই তুমি ভেতরে যাও। এদের কাছে ভয়ংকর অস্ত্র আছে, একবার লক করে ফেলতে পারলে কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। এখনো অনেক দূরে, লক করতে পারবে না।”
তানুস্কা কাঁপা গলায় বলল, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না–”
“তুমি বুঝতে পারবে না। শুধু জেনে রাখো ওরা যদি আমাকে মেরে ফেলতে পারে তুমি মন খারাপ করবে না। আমি শুধু একটা কথা বলে রাখি–আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি, জ্ঞান হওয়ার পর আমি কারো কাছে ভালোবাসা পাইনি। তুমি প্রথম আমাকে ভালোবাসা দিয়েছ। তোমার জন্যে আমার জীবনটা পরিপূর্ণ হয়েছে–”
তানুস্কা বলল, “না, তুমি এরকম করে কথা বোলো না”
“ঠিক আছে বলব না।”
“ভেতরে যাও তানুস্কা–”
“না। আমি ভেতরে যাব না। আমি তোমার সাথে থাকব।”
“অবুঝ হয়ো না তানুস্কা–”
“আমি অবুঝ হচ্ছি না। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।”
“ওরা শুধু আমার জন্যে আসছে। তুমি যদি আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করো তাহলে ওরা তোমাকেও ছাড়বে না।”
“না ছাড়ুক।”
রিটিন আবছা অন্ধকারে তানুস্কার দিকে তাকাল, সে হঠাৎ করে বুঝতে পারল এই মেয়েটি তাকে একা ফেলে রেখে ভেতরে যাবে না। কাজটি অর্থহীন এবং বিপজ্জনক। কিন্তু মেয়েটি এই পুরোপুরি অর্থহীন এবং বিপজ্জনক কাজটাই করবে।
রিটিন বলল, “তুমি যদি ভেতরে না যাবে তাহলে এসো আমরা দুজন এখন ট্রাক্টরটার পেছনে চলে যাই।”
দুইজন গুঁড়ি মেরে ট্রাক্টরের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে যায়। রিটিন স্পেস ভিউয়ারটিতে দূরের মানুষগুলোকে আরো একবার দেখে সেটা বন্ধ করে দিল, এটা চালু থাকলে দূর থেকে এটার সিগন্যাল পাওয়া সম্ভব হতে পারে।