তানুস্কা জানতে চাইল, “কোনটুকু আশ্চর্য?”
রিটিন বলল, “সবকিছু! মাটি থেকে এই যে ঘ্রাণ বের হচ্ছে এটা সবচেয়ে আশ্চর্য!” তারপর তানুস্কার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে এই চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা দেয়ার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, তানুস্কা!”
তানুস্কা খিল খিল করে হেসে বলল, “তুমি যদি এরকম চমৎকার অভিজ্ঞতা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাও তাহলে তোমাকে আমি আরো অনেক অভিজ্ঞতা দিতে পারব।”
।তারপর রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকেও ধন্যবাদ রিটিন, আমার যে কাজ করতে টানা তিনদিন লাগত তোমার জন্যে সেটা একদিনেই শেষ করে ফেলেছি!”
নীল বলল, “শুধু রিটিন নয় মা, আমিও তোমাকে সাহায্য করেছি। আমাকেও ধন্যবাদ দাও।”
তানুস্কা নিচু হয়ে নীলের গালে চুমু খেয়ে বলল, “হ্যাঁ বাবা তুমিও অনেক সাহায্য করেছ। তোমাকেও ধন্যবাদ। এখন চলো বাসায় গিয়ে কনকনে ঠান্ডা পানিতে গোসল করি। তারপর আজ রাতে আমরা একটা হাঁসের রোস্ট খাব। সাথে স্ট্রবেরি কেক।”
ঠিক কী কারণ জানা নেই, রিটিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
.
১৪.
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। এই এক সপ্তাহে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। একদিন তানুস্কা রিটিন আর নীলকে নিয়ে শহরে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গেল। খাওয়ার পর তারা যখন শহরের রাস্তা ধরে ইতস্তত হাঁটছে তখন হঠাৎ তারা একটা ফটো স্টুডিওর সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। তানুস্কা হাসি হাসি মুখে বলল, “চলো আজকের দিনটির স্মৃতি ধরে রাখার জন্যে আমরা একটা ছবি তুলি।”
রিটিন ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল, কারণ এটিই নিশ্চয়ই সেই ছবিটি যেটি দেখে ক্যাটাগরি সি মানুষেরা জানতে পারবে সময় পরিভ্রমণ সম্ভব। বাইরে শান্তভাব ধরে রেখে সে বলল, “চলো। ছবি তুলি।”
স্টুডিওর ভেতরে রিটিন নীলকে কোলে তুলে নেয়, তার পাশে তানুস্কা হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্ল্যাশের সাথে সাথে রিটিন নিজের ভেতরে বিস্ময়কর একধরনের চাপ অনুভব করে। এই ছবিটি তোলা হবে এটুকু পর্যন্ত সে নিশ্চিত ছিল, এরপর কী হবে কেউ জানে না! এই ছবিটি তুলে সে তার পুরো জীবনটি অনিশ্চিত করে তুলেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে শীতল ঘরে ঘুমিয়ে যেতে হবে। সেই ঘুম থেকে তাকে জেগে উঠতে হবে পাঁচশ বছর পর।
স্টুডিও থেকে বের হয়ে তারা একটা আইসক্রিম পার্লারে গিয়ে আইসক্রিম খেলো এবং যখন নীল ক্লান্ত হয়ে বলল তার ঘুম পাচ্ছে। তখন তারা আবার তাদের বাসায় রওনা দিল।
অন্ধকার নির্জন পথে গাড়ি চালিয়ে নিতে নিতে তানুস্কা বলল, “রিটিন, তুমি হঠাৎ করে একটু চুপচাপ হয়ে গেলে।”
রিটিন বলল, “হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ। আমি নিজেকে নিজে ভুলিয়ে রাখছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারছি আর ভুলিয়ে রাখা যাবে না। আমাকে–”
তানুস্কা একধরনের ভয় পাওয়া গলায় বলল, “তোমাকে?”
“আমাকে চলে যেতে হবে তানুস্কা।”
তানুস্কা গাড়ি চালাতে চালাতে একবার মাথা ঘুরিয়ে রিটিনের দিকে তাকাল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে হাসার চেষ্টা করে বলল, “হ্যাঁ রিটিন। আমি অনুমান করছিলাম তুমি নিশ্চয়ই একদিন চলে যাবে। তুমি তো আর একটা শিশুর সাথে খেলার জন্যে কিংবা একটা নিঃসঙ্গ মেয়ের ক্ষেত চষে দেবার জন্যে আসোনি! তোমার নিশ্চয়ই আরো বড় কিছু করার আছে!”
রিটিন একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমার জীবনটা যদি আমি নিজে ডিজাইন করতে পারতাম তাহলে আমি সত্যি সত্যি বাকি জীবনটা তোমার খেত চষে কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু তানুস্কা, তুমি বিশ্বাস করো আমার জীবনটা আমার হাতে নেই! আমাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেটি কী, তুমি আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না।”
তানুস্কা বলল, “জিজ্ঞেস করব না।”
রিটিন বলল, “আমাকে চলে যেতে হবে তানুস্কা।”
তানুস্কা বলল, “আমি বুঝতে পারছি রিটিন।”
রিটিন বলল, “আমার মনে হচ্ছে আমার যদি চলে যেতে না হতো, আমি যদি তোমার সাথে থাকতে পারতাম-”
তানুস্কা বলল, “আমরা এটা নিয়ে কথা না বলি রিটিন। সত্যিটাকে মেনে নিই। তুমি অল্প কয়েকদিনের জন্যে এসেছ। আমরা এই অল্প কয়টা দিন হাসিখুশিতে কাটিয়েছি। এখন তোমার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে, আমি আর নীল তোমাকে হাসি মুখ করে বিদায় দেব রিটিন। তুমি কোথায় যাবে কী করবে আমি জানি না। কিন্তু যেখানেই যাও তুমি যেন ভালো থাকো। আনন্দে থাকো”
কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে তানুস্কার গলা ধরে এল। তানুস্কা তখন চুপ করে যায়, নির্জন পথ ধরে নিঃশব্দে গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকে।
বাসায় পৌঁছানোর পর রিটিন ঘুমন্ত নীলকে কোলে নিয়ে তানুস্কার ঘরে শুইয়ে দিল।
সেদিন সে অনেক রাত পর্যন্ত বাসার বাইরে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল, সপ্তর্ষি মণ্ডলকে ধ্রুবতারাকে ঘিরে একটু একটু করে ঘুরে যেতে দেখল। বাতাসের শব্দ শুনল, গাছের পাতার শিরশির শব্দ শুনল, মাথার উপর দিয়ে একটা রাতজাগা পাখিকে করুণ সুরে ডাকতে ডাকতে উড়ে যেতে শুনল।
.
পরের কয়েকদিন রিটিন আর তানুস্কা দুজনেই ভান করতে লাগল যেন সবকিছুই স্বাভাবিক আছে, সবকিছুই আগের মতো আছে, যদিও দুজনেই জানে যে তাদের দুজনের সুন্দর সময়টা হঠাৎ করে শেষ হয়ে যেতে যাচ্ছে। তানুস্কা তার ট্রাক্টরে করে জমি চাষ করে যেতে লাগল, রিটিন ট্রাক্টরের পেছনে সার তুলে দিতে লাগল, পানির প্রবাহ শুরু করার জন্যে পাহাড়ের উপর আটকে থাকা পানির বাঁধে খাল কেটে দিতে লাগল।