.
ভোরবেলা রিটিনের ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হলো। ঘুম ভাঙার পর সে দেখল তার বিছানার কাছে একটা চেয়ারে নীল গম্ভীর হয়ে বসে আছে। নীলের হাতে গতকাল উদ্ধার করে নিয়ে আসা সেই খেলনা ডাইনোসরটি।
রিটিন শুয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার নীল? তুমি এত সকালে এখানে কী মনে করে?”
নীল বলল, “মা বলেছে তোমাকে ধন্যবাদ দিতে।”
“ধন্যবাদ দিতে? আমাকে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ সে জন্যে।”
“আমি তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছি? কীভাবে?”
“আমি জানি না।”
রিটিন হাসল, বলল, “আমিও জানি না।”
চার বছরের শিশুটিকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, “তাহলে কী আমার প্রাণ বাঁচানো হয়নি? আমার কি প্রাণ নেই?”
রিটিন এবারে বিছানায় উঠে বসে বলল, “আছে আছে। নিশ্চয়ই আছে। তোমার প্রাণটা এতই শক্ত যে সেটা কাউকে বাঁচাতে হয় না। নিজে নিজে বেঁচে থাকে।”
নীল কিছুক্ষণ কথাটা নিয়ে চিন্তা করল, তারপর বলল, “তোমাকে ধন্যবাদ।”
“কেন আমাকে ধন্যবাদ।”
“আমি জানি না। মা বলেছে সবসময় সবাইকে ধন্যবাদ দিতে হয়।”
রিটিন বলল, “তোমার মা ঠিকই বলেছে। সবসময় সবাইকে ধন্যবাদ দেয়াটা খুবই ভালো একটা কাজ।”
নীল কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল। রিটিন বলল, “আমি তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছি কিনা সেটা জানি না। কিন্তু আমি তোমার ডাইনোসরটাকে বাঁচিয়েছি।”
নীল তার খেলনা ডাইনোসরটিকে বুকে চেপে ধরে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার টিটিন রেক্সকে বাঁচানোর জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।”
“এটার নাম টিটিন রেক্স?”
“হ্যাঁ।”
“আমার নাম রিটিন, তোমার ডাইনোসরের নাম টিটিন। আমাদের দুজনের নামের মাঝে মিল আছে।”
নীল ফিক করে হেসে ফেলল।
রিটিন বিছানা থেকে নেমে বলল, “তোমার মা কী করছে?”
“মাঠে ট্রাক্টর চালাচ্ছে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
রিটিন জানালায় দাঁড়িয়ে দেখল দূরে একটা মাঠে তানুস্কা একটা ট্রাক্টরে বসে মাটি চাষ করছে। পেছনে ধুলা উড়ছে। আকাশে সূর্যটা এর মাঝে উত্তপ্ত হয়ে উঠে তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। রিটিন জানালা থেকে চোখ সরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, পৃথিবীর মানুষ এখনো জানে না পাঁচশ বছর পর পৃথিবী থেকে চাষাবাদ উঠে যাবে। যখন যে খাবার দরকার সিনথেটিক উপায়ে সেটা তৈরি করে নেয়া হবে! মানুষকে আর এত কষ্ট করে মাটি চাষ করে ফসল লাগাতে হবে না।
“তুমি কি নাশতা করেছ, নীল?”
“না, আমি নাশতা করিনি। আমার সকালে নাশতা করতে ভালো লাগে না।”
“নাশতা করতে ভালো না লাগলেও এটা করতে হয়। তোমার মা কি নাশতা করে কাজে বের হয়েছে?”
“না। আমার মা বলেছে ট্রাক্টর দিয়ে পুরো মাঠ চষে তারপর বাসায় এসে নাশতা তৈরি করবে।”
“চলো, আমরা তোমার মায়ের জন্যে নাশতা তৈরি করে ফেলি।”
“তুমি নাশতা তৈরি করতে পারো?”
“একশবার। আমি খুব ভালো ডিম পোচ করতে পারি।”
নীল এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিটিনের দিকে তাকাল।
রিটিন রুটি টোস্ট করল। ঝুড়ি থেকে কমলা নিয়ে তার রস বের করল। ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে ডিম পোচ করল। পনির বের করে সেটাকে চিকন করে কাটল। দুধ বের করে গ্লাসে ঢেলে নিল। কফি মেকারে কফি দিয়ে সেটার সুইচ অন করে দিল, কিছুক্ষণেই পুরো রান্নাঘরটা কফির গন্ধে ভরে যায়।
তানুস্কা যখন ধূলি ধূসরিত হয়ে ঘরে ঢুকল, নীল চিৎকার করে বলল, “মা, আমি আর রিটিন মিলে তোমার জন্যে নাশতা তৈরি করেছি।”
তানুস্কা অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ মা।”
তানুস্কা বলল, “কী আশ্চর্য রিটিন! তুমি জানো নীলের বাবা জিশান আমার জন্যে ঠিক এই কাজটা করত?”
নীল বলল, “মা তাহলে রিটিন কি আমার বাবা হতে পারে না?”
তানুস্কার গাল লাল হয়ে উঠল, লজ্জা পেয়ে বলল, “বোকা ছেলে! শুধু নাশতা তৈরি করলেই বাবা হওয়া যায় না।”
রিটিন হঠাৎ করে বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। তার মনে হতে থাকে নিয়ন্ত্রণ ভবন ধ্বংস করার জন্যে ভবিষ্যতে ফিরে না গিয়ে সত্যি সত্যি সে এখানে নীলের বাবা হয়ে থেকে যায় না কেন?
নাশতা করে তানুস্কা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি মাঠে যাই। আকাশ দেখে মনে হচ্ছে আর কয়েকদিনের মাঝে বৃষ্টি নামবে। যদি এর মাঝে জমিটা প্রস্তুত না করি বীজ লাগাতে পারব না।”
রিটিন বলল, “আমি কি তোমার সাথে আসতে পারি?”
নীল বলল, “আমিও কি আসতে পারি?”
তানুস্কা জানতে চাইল, “কেন? এই বাসার দুজন পুরুষ মানুষ মাঠে যেতে চাইছে কেন?”
রিটিন বলল, “তোমাকে একটু সাহায্য করি।”
নীল বলল, “হ্যাঁ, একটু সাহায্য করি।”
রিটিন বলল, “তা ছাড়া আমি আগে কখনো মাঠে কাজ করিনি। তোমার কাছ থেকে একটু শিখে নিই!”
তানুস্কা বলল, “আমি প্রার্থনা করি যেন কোনো দিন তোমার মাঠে কাজ করার জ্ঞানটুকুর প্রয়োজন না হয়।”
রিটিন বলল, “একজন মানুষের জীবনে কখন কোন জ্ঞানের হঠাৎ করে প্রয়োজন হয়ে যাবে কেউ বলতে পারবে না! আমিই কি কখনো জানতাম যে আমার ডিম পোচ করার জ্ঞানটুকু আজকে এভাবে কাজে লেগে যাবে?”
তানুস্কা বলল, “ঠিক আছে তাহলে চলো। ডিম পোচ করার মতো আরেকটা প্রয়োজনীয় জ্ঞান তোমাকে শিখিয়ে দিই।”
নীল বলল, “আমাকেও শেখাবে মা?”
তানুস্কা বলল, “হ্যাঁ তোমাকেও শেখাব। কাজের সময় কীভাবে কাউকে বিরক্ত না করে চুপচাপ বসে থাকতে হয় আজকে আমি তোমাকে সেটা শেখাব।”
.
রিটিন সারাদিন তানুস্কাকে সাহায্য করল, ট্রাক্টর চালিয়ে মাঠ চাষ, সেখান থেকে আগাছা সরিয়ে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সার দিয়ে প্রস্তুত করল। মাঠটিতে মাটি সারি সারি করে বীজ লাগানোর জন্যে প্রস্তুত করল। পানি আনার জন্যে খালটুকু কেটে পরিষ্কার করল। পাহাড়ের উপর আটকে রাখা পানিটুকুর এক পাশের বাঁধ কেটে সেখান থেকে পানিকে মাঠের মাঝে প্রবাহিত হতে দিল। যখন গড়িয়ে গড়িয়ে পানি পুরো মাঠটিকে ভিজিয়ে দিতে শুরু করেছে তখন মাটির ভেতর থেকে এক ধরনের আদিম ঘ্রাণ বের হতে শুরু করে। রিটিন অনেকটা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “কী আশ্চর্য।”