তানুস্কা বলল, “তুমি আমাকে খুশি করার জন্যে এই কথা বলছ। এটি মোটেও ভালো কফি নয়।”
“আমার জন্যে যথেষ্ট ভালো কফি। আমি যেখান থেকে এসেছি। সেখানে এরকম কফি পাওয়া যায় না।”
তানুস্কা জিজ্ঞেস করল, “সেখানে কী রকম কফি পাওয়া যায়?”
রিটিন বলতে পারল না মানুষ বহুঁকাল আগে জৈবিক কফি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, সব খাবারই এখন সিনথেটিক। সব খাবার কিংবা পানীয় এখন অজৈবিক। রিটিন তানুস্কার দিকে তাকিয়ে বলল, “সেখানকার কফি মুখে দিলে থু থু করে ফেলে দেবে।”
বাইরে তখন হঠাৎ করে কোনো এক ধরনের বুনো পশুর ডাক শোনা গেল। একটা রাতজাগা পাখি বাসার উপর দিয়ে শব্দ করতে করতে উড়ে গেল। রিটিন একধরনের বিস্ময় নিয়ে তানুস্কার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “ওটা কিসের ডাক?”
তানুস্কা খিল খিল করে হেসে উঠে বলল, “ওটা শেয়ালের ডাক। তুমি কখনো শেয়ালের ডাক শুনেননি?”
রিটিন বলল, “না। আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে শেয়াল নেই। শেয়ালের ডাক নেই।”
“আর কী কী নেই?”
“আরো অনেক কিছু নেই। বনজঙ্গল নেই! সব ধরনের মানুষ নেই। বনমোরগ নেই। যবের রুটি নেই।”
তানুস্কা হাসল, বলল, “তোমার এলাকাটা একবার গিয়ে দেখে আসতে হবে।”
রিটিন কোনো কথা বলল না, তার এলাকাটা তানুস্কা কখনো গিয়ে দেখে আসতে পারবে না।
তানুস্কা প্রায় অনুচ্চ স্বরে বলল, “আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ভাবতাম বড় হলে আমি পৃথিবীর সব দেশ ঘুরে বেড়াব। এখন বড় হয়েছি এখন এই বাসা আর বাসার বাইরে যবের ক্ষেত ছাড়া আর কোথাও যেতে পারি না!”
রিটিন কী বলবে বুঝতে না পেরে একটু ইতস্তত করে বলল, “তোমার তো সময় শেষ হয়ে যায়নি। তুমি তো এখনো পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে পারবে।”
তানুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, “সব দোষ জিহানের।”
“জিহান?”
“হ্যাঁ। নীলের বাবা জিহান। সে কেন হঠাৎ করে মারা গেল? কেন হঠাৎ করে সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে দিয়ে তাকে মরে যেতে হলো?”
রিটিন কী বলবে বুঝতে পারল না। তানুস্কার স্বামী জিহান কীভাবে মারা গিয়েছে, সেটাও সে জানে না। জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি না সেটাও সে বুঝতে পারছিল না। অবশ্য জিজ্ঞেস করতে হলো না, তানুস্কা নিজেই বলল, “গ্রীষ্মকালে সে দক্ষিণের বনাঞ্চলে গেল একটা কাজে। সেখান থেকে ফিরে এসে বলল শরীরটা ভালো লাগছে না। দেখতে দেখতে আকাশ-পাতাল জ্বর। হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, পরীক্ষা করে কিছু খুঁজে পেল না। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ভোরবেলা জ্ঞান হয়েছে, আমাকে ডাকল, কাছে গেলাম। হাত ধরে বলল, তানুস্কা তুমি নীলকে দেখে রেখো। আমি গেলাম। তারপর সে চোখ বন্ধ করে চলে গেল। ঠিক এইভাবে।”
রিটিন ভাবল তানুস্কা এখন আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে কিন্তু সে কাঁদল না। মুখটা শক্ত করে বসে রইল, তারপর বলল, “আমি খুব দুঃখিত রিটিন। আমার একেবারেই ব্যক্তিগত কথাগুলো কেন আমি তোমাকে বলেছি আমি জানি না। তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর এখনো চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়নি। আমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
রিটিন বলল, “না তানুস্কা, তোমার মাথা খারাপ হয়নি। মানুষ যখন কষ্টে থাকে তখন সেটা অন্য কাউকে বললে তার কষ্টটা একটু কমে। অনেক সময় পরিচিত কাউকে বলার ইচ্ছে করে না, অপরিচিত কাউকে বলা সহজ।”
তানুস্কা বলল, “আমি জানি না কী কারণ। তুমি বিচিত্র একটা উচ্চারণে কথা বলো, তোমাকে দেখতেও ঠিক আমাদের মানুষ বলে মনে হয় না, তোমার আচার-আচরণও কেমন জানি অন্যরকম, কিন্তু তারপরও কেন জানি মনে হয় তোমাকে আমি বহুদিন থেকে চিনি।”
রিটিন বলল, “শুনে আমি খুশি হলাম যে তুমি আমাকে চেনা মানুষ হিসেবে ভাবছ।”
তানুস্কা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “চেনা মানুষ হিসেবে ভাবলেও মনে হয় একটু যন্ত্রণা দিয়ে ফেলেছি। কাঁদুনি হিসেবে যা যা বলেছি সব ভুলে যাও। মনে করো কিছু বলিনি।”
রিটিন বলল, “তার প্রয়োজন নেই তানুস্কা। সবারই কথা বলার একজন থাকতে হয়, তুমি না হয় আমাকেই বললে, তা ছাড়া–” রিটিন থেমে গেল।
তানুস্কা জিজ্ঞেস করল, “তা ছাড়া কী?”
“তা ছাড়া তুমি এখনই হতাশ হয়ে যাচ্ছ কেন? তুমি নীলকে বড় করার জন্যে কোনো একজনকে তো পেয়েও যেতে পার। হৃদয়বান সুদর্শন একজন মানুষ। যে তোমাকে ভালোবাসবে, মাথায় তুলে রাখবে। নীলও একজন বাবা পাবে।”
তানুস্কা শব্দ করে হাসল, হাসতে হাসতে বলল, “বোঝাই যাচ্ছে তুমি অন্য জগতের মানুষ। যে মেয়ের চার বছরের ছটফটে একটা ছেলে আছে তার ধারে কাছে কোনো মানুষ আসে না! কয়দিন আগে একজন আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিল।
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। প্রস্তাবটি কী ছিল জানো?”
“কী?”
“প্রস্তাবটি ছিল এরকম, আমি যদি নীলকে একটা অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিই তাহলে সে আমাকে বিয়ে করবে।”
“তুমি কী বললে?”
তানুস্কা হিহি করে হেসে বলল, “সেটা আমি তোমাকে বলতে পারব না। আমি তার শরীরের বিশেষ একটা অংশ সার্জারি করে বিশেষ অন্য একটা অংশে সেটাকে ঢুকিয়ে রাখার কথা বলেছিলাম।”
তানুস্কার কথা বলার ভঙ্গি দেখে রিটিনও হাসতে শুরু করল।
গভীর রাতে রিটিন যখন দেখল তানুস্কার ঘরের বাতি নিভে গেছে তখন সে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে সাবধানে ঘর থেকে বের হয়ে এল। বাসার সামনে খোলা জায়গাটাতে বসে সে আকাশের নক্ষত্রের অবস্থানগুলো মাপতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই সে পৃথিবীর ঠিক কোন জায়গাটিতে আছে বের করে ফেলল। তাকে নিরাপত্তা ভবনের যে জায়গাটিতে যেতে হবে সেটি ঘটনাক্রমে খুব বেশি দূরে নয়, মাত্র বারো’শ পঞ্চাশ কিলোমিটার। জায়গাটি এখন একটি নির্জন বনভূমি। তাকে সেই বনভূমিতে গিয়ে মাটির নিচে একটা শীতল ঘরে পাঁচশ বছরের জন্যে ঘুমিয়ে যেতে হবে।