রিটিন হাসল, বলল, “কী চমৎকার।”
মেয়েটা বলল, “আমি কি ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল নীল বুঝি মরেই যাবে।”
রিটিন কিছু বলল না। মেয়েটির মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়, সে নিচু গলায় বলল, “তুমি একটি জিনিস জানো?”
“কী জিনিস?”
“নীল কিন্তু আসলেই খুব গুরুতর আঘাত পেয়েছিল। আমি জানি। মায়ের মন কখনো মিথ্যা বলে না।”
রিটিন বলল, “কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ–”
“আমি যেটা দেখছি সেটা একটা স্বপ্নের মতো। সেটা হওয়া সম্ভব ছিল না–”
“কিন্তু হয়েছে।”
“হ্যাঁ হয়েছে। সে জন্যে আমি এটাকে প্রশ্ন করব না—কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
মেয়েটা হঠাৎ কথা না বলে রিটিনের মুখের দিকে তাকাল, তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
রিটিন হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমার নাম রিটিন। রিটি রিটিন। তোমার ছেলে নিয়ে আমরা এত ব্যস্ত ছিলাম যে পরিচয় করার কথা মনে পড়েনি।”
মেয়েটি তার হাতটা সামনে বাড়িয়ে বলল, “আমার নাম তানুস্কা।”
রিটিন বলল “তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম তানুস্কা।”
তানুস্কা নামের মেয়েটা বলল, “সত্যি করে বলো দেখি তুমি কে?”
“বলেছি।” রিটিন একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “আমি রিটিন।”
তানুস্কা হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়, তারপর মাথা ঘুরিয়ে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে তুমি বিচিত্র একটা উচ্চারণে কথা বলছ, আমার কেন জানি মনে হয়, এটা আমার খুব পরিচিত। এই যে তুমি বলছ তোমার নাম রিটিন, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই নামটাও আমি জানি। আর–”
“আর কী?”
“কেন জানি মনে হচ্ছে তোমাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার আগে দেখা হয়েছে!”
রিটিনের মনে হলো সে বলে যে, হ্যাঁ, আমার সাথে তোমার দেখা হয়েছে। তোমার সাথে আর নীলের সাথে আমার একটা ছবি আছে। সেই ছবিটাকে সত্যি করার জন্যে আমি পাঁচশ বছর ভবিষ্যৎ থেকে এসেছি। আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে। আমি সে জন্যে এই পৃথিবীতে এসেছি।
রিটিন অবশ্য তার কিছুই বলল না, সে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “মানুষের মস্তিষ্ক খুবই বিচিত্র! এটা কখন কীভাবে কাজ করবে কেউ বলতে পারে না।”
তানুস্কা কোনো কথা না বলে এক দৃষ্টে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল।
১৩-১৪. নীলকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে
১৩.
নীলকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তানুস্কা রান্নাঘরে ফিরে এল। রান্নাঘরের ছোট টেবিলটাতে বসে রিটিন তানুস্কা আর নীলের সাথে রাতের খাবার এইমাত্র শেষ করেছে। খাবার শেষ হবার আগেই নীলের চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের কাজকর্ম শেষ করে ফিরে আসতে আসতে বেশ রাত হয়েছে, নীলকে জাগিয়ে রাখাটাই মোটামুটিভাবে একটা কঠিন ব্যাপার ছিল। সবাই মিলে একসাথে টেবিলে বসে রাতের খাবার খাবে, সেটি আজকে বিকেলেও তানুস্কা কল্পনাও করেনি।
রান্নাঘরে ঢুকে তানুস্কা হাসিমুখে বলল, “আমি তো তোমাকে জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি কিন্তু এরকম দায়সারা খাবার খেতে হবে তুমি নিশ্চয়ই কল্পনাও করোনি।”
রিটিনের শরীরে যে ডিস্কটি লাগিয়ে রেখেছে সেটি তার শরীরে পুষ্টির জোগান দিতে পারে, মাঝেমধ্যে এক-দুই গ্লাস পানি খেয়ে সে দুই-এক মাস কাটিয়ে দিতে পারবে, সত্যি কথা বলতে কী, তার কোনো কিছু খাওয়ারও প্রয়োজন নেই। কিন্তু রিটিন সেটা তানুস্কাকে জানাল না। বলল, “আমাকে রাত কাটানোর জন্যে একটা আশ্রয়, খাওয়ার জন্যে একটা রেস্টুরেন্ট খুঁজে নিতে হতো। তুমি আমাকে দুটোই দিয়েছ, কাজেই আমার অভিযোগ করার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া আমার জন্যে এটা মোটেও দায়সারা খাবার ছিল না। আমি বহুঁকাল সত্যিকারের বনমোরগের গোশত খাইনি।”
তানুস্কা বলল, “কাল রাতে আমি তোমাকে ভালো করে খাওয়াব। কথা দিচ্ছি।”
“কথা দিতে হবে না। আমার জন্যে আলাদা করে কোনো খাবারের আয়োজন করতে হবে না! আমি সবকিছু খেতে পারি।”
তানুস্কা বলল, “আমি তোমাকে কী ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না। তুমি না থাকলে কী যে হতো–”
রিটিন বলল, “কী আবার হতো। তুমি নীলকে খুঁজে পেতে, হাসপাতালে নিয়ে যেতে! তুমি তো দেখেছ তার আঘাত মোটেও গুরুতর ছিল না।”
তানুস্কা বলল, “ডাক্তাররা যাই বলুক আমি জানি ভয়ংকর গুরুতর ছিল। কোনো একটা ম্যাজিক হয়েছে। তুমি স্বীকার করছ না কিন্তু আমি জানি তোমার কারণে সেই ম্যাজিকটা হয়েছে।”
রিটিন হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, “ঠিক আছে তুমি যদি এটা ভেবেই শান্তি পেতে চাও আমি বাধা দেব না।”
তানুস্কা টেবিল থেকে খাবার প্লেট চামচ গ্লাস ন্যাপকিন তুলে নিতে নিতে বলল, “একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না।”
“কী জিনিস?”
“তুমি যথেষ্ট সুন্দর ভাষায় কথা বলো কিন্তু তোমার উচ্চারণটা একটু অন্যরকম।”
“কী রকম?”
“মনে হয় তুমি এই ভাষাটা জানো না। এই ভাষাটা শিখছ। মনে মনে অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ করে বলছ!”
রিটিন হাসল, বলল, “তুমি ঠিকই অনুমান করছ। আমি ভাষাটা জানি না, শিখছি। আমি এই এলাকার মানুষ নই, একটা কাজে এই এলাকায় এসেছি।”
তানুস্কা রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল, সে আশা করছিল রিটিন আরো কিছু বলবে। রিটিন অবশ্য আর কিছু বলল না।
তানুস্কা দুই মগ কফি তৈরি করে টেবিলে নিয়ে এসে রাখল। রিটিন কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, “বাহ! কী চমৎকার কফি।”