“হ্যাঁ। হাসপাতাল। উপর থেকে নিচে পড়ে গিয়ে অনেক ব্যথা পেয়েছে।”
মেয়েটা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল, শিশুটিকে জাপটে ধরে বলতে লাগল, “নীল! আমার নীল। বাবা আমার
রিটিন সাবধানে শিশুটিকে ধরে রেখে শান্ত গলায় বলল, “তুমি এখন একটু শান্ত হও। কীভাবে একে হাসপাতালে নেয়া যায় সেটি বলো। প্লিজ। সময় নেই আমাদের হাতে।”
“মেয়েটি চোখ মুছে ভাঙা গলায় বলল, আমার বাসার সামনে গাড়ি আছে।”
“চলো তাহলে। কোনদিকে যাব?”
মেয়েটা তখন কাঁদতে কাঁদতে ছুটতে থাকে। রিটিন তার পিছু পিছু শিশুটিকে নিয়ে যেতে থাকে। একটু সামনেই হঠাৎ করে একটা কাঠের বাসা দেখা গেল, তার সামনে একটা সাদা রঙের ভ্যান।
মেয়েটা ছুটে গিয়ে ভ্যানের দরজা খুলে রিটিনের দিকে তাকাল। রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি গাড়ি চালাতে পারবে?”
“পারব।”
“চমৎকার। তুমি গাড়ি চালাও। আমি পেছনে তোমার ছেলেকে কোলে নিয়ে বসছি।”
রিটিন শিশুটিকে কোলে নিয়ে গাড়ির পেছনে বসল। শিশুটির মাথা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে রিটিনের ট্রাউজার ভিজে যেতে থাকে।
মেয়েটি গাড়ি স্টার্ট করে প্রায় গুলির মতো সেটাকে ছুটিয়ে নিতে থাকে। স্টিয়ারিং হুইল শক্ত হাতে ধরে ভাঙা গলায় বলতে থাকে, “ছেলেটা এত দুষ্টু, ঘরে থাকতে চায় না, কখন যে বের হয়েছে জানি
–তুমি না থাকলে খুঁজে পেতে কতক্ষণ লাগত কে জানে! তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব–”
রিটিন বলল, “আমাকে তোমার ধন্যবাদ দিতে হবে না।”
মেয়েটি বলল, “কী মনে হয় তোমার? নীল কি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছে? ভালো হয়ে যাবে না? সুস্থ হয়ে যাবে না?”
রিটিন নরম গলায় বলল, “নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে যাবে।”
“হায় ঈশ্বর! বাপ-মরা ছেলেটার কপালে তুমি আর কত কষ্ট দেবে?”
মেয়েটি অনেকটা নিজের সাথে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাতে থাকে। সরু একটা রাস্তা, আঁকাবাঁকা পথ, মাঝেমধ্যে অন্যদিক থেকে কোনো একটা গাড়ি আসছে। একসময় একটা শহরতলির মাঝে গাড়ি ঢুকল। কিছু মানুষজন দেখা গেল। দোকানপাট রেস্টুরেন্ট নাইট ক্লাব পার হয়ে গাড়িটি হাসপাতালের সামনে দাঁড়াল। মেয়েটা গাড়ি থামিয়ে ছুটে এসে রিটিনের জন্যে দরজা খুলে দেয়। রিটিন শিশুটিকে পাঁজাকোলা করে গাড়ি থেকে নামল। হাসপাতালের ভেতর থেকে একজন একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসে, রিটিন সাবধানে শিশুটিকে সেখানে শুইয়ে দিতেই স্ট্রেচার ঠেলে তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। মেয়েটি স্ট্রেচারের সাথে সাথে ভেতরে ঢুকে গেল।
রিটিন এখন কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না। এখানে কোথায় অপেক্ষা করতে হয় সে ঠিক ভালো করে জানে না। পাঁচশ বছর আগের পৃথিবীটা তার পরিচিত পৃথিবী থেকে এত ভিন্ন যে রিটিন কেমন জানি অসহায় অনুভব করে। চারপাশে অনেক মানুষ, রিটিন একধরনের বিস্ময় নিয়ে এই মানুষগুলোকে দেখে। এদের মাঝে সব ধরনের মানুষ আছে। রিটিন অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার পৃথিবী থেকে এই পৃথিবীর মানুষের বৈচিত্র্য অনেক বেশি।
রিটিন ঠিক কী করবে বুঝতে পারছিল না। শিশুটির এমনিতে বেঁচে যাবার কোনো উপায় ছিল না। দুই সিসি ট্র্যাকিনল শিশুটির শরীরে দিয়ে দেয়ার কারণে সম্ভবত বেঁচে যাবে। ট্র্যাকিনল তার শরীরের ক্ষতস্থানগুলোতে নতুন কোষ তৈরি করা শুরু করবে। এই সময়ের ডাক্তাররা যদি ভালো করে পরীক্ষা করে তাহলে কী ঘটছে সেটা দেখে হতবাক হয়ে যাবে। কিন্তু ডাক্তারেরা নিশ্চয়ই পরীক্ষা করবে না, ধরে নেবে আঘাতটা নিশ্চয়ই গুরুতর ছিল না, মনে হয়েছিল গুরুতর।
রিটিন অপেক্ষা করার জায়গাটিতে পায়চারি করতে থাকে। চারপাশের পরিবেশটুকু তার কাছে প্রায় সুররিয়াল মনে হয়। মানুষগুলো বিচিত্র, কথা বলার ভঙ্গি বিস্ময়কর-পাঁচশ বছরে মানুষের কি অবিশ্বাস্য পরিবর্তন হয়েছে। যারা চারপাশে আছে তারা যদি কোনোভাবে বুঝতে পারে সে সুদূর ভবিষ্যৎ থেকে এসেছে তাহলে তাদের ভেতর কী রকম একটা প্রতিক্রিয়া হবে সে কল্পনাও করতে পারে না।
রিটিন কতক্ষণ পায়চারি করেছিল নিজেও বলতে পারবে না, হঠাৎ করে দেখতে পেল একটা দরজা খুলে মেয়েটি বের হয়ে আসছে। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই রিটিন বুঝতে পারল শিশুটির শরীরে ট্র্যাকিনল কাজ করেছে। মেয়েটির মুখে হাসি, পুরো চেহারাটি আনন্দে ঝলমল করছে। প্রায় ছুটে রিটিনের কাছে এসে বলল, “নীল ভালো আছে।”
রিটিন বলল, “বাহ! কী চমৎকার।”
মেয়েটি বলল, “একটু বেশিই ভালো আছে।”
রিটিন বলল, “বেশি ভালো?”
“হ্যাঁ। তুমি যখন তাকে কোলে করে আনছিলে আমার মনে হচ্ছিল মাথায় অনেক ব্যথা হয়েছে, মনে হচ্ছিল করোটি ভেঙে গেছে, আসলে কিছু হয় নি। শুধু চামড়া একটু কেটে গেছে।”
“সত্যি?”
মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। হাত-পা কেটে গিয়েছিল মনে আছে?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ মনে আছে।”
“এখন কোনো কাটা নেই। আশ্চর্য না?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “আশ্চর্য।”
“ডাক্তারেরা দৌড়াদৌড়ি করে অস্ত্রোপচার করার জন্যে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে গেছে, একটু পরে দেখে নীল অপারেশন থিয়েটারে পা তুলে বসে আছে!”
“সত্যি?”
“সত্যি। চারপাশে ডাক্তার নার্স দেখে ভয় পেয়ে কাঁদছিল, তখন আমাকে ডেকে নিয়ে গেছে।”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তারপর?”
“আমাকে দেখে তার ভয় কেটে গেল, তখন ডাক্তার নার্সের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে!”