হাঁটতে হাঁটতে রিটিনের মনে হলো সে একটা জলধারার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। রিটিন কোনো দিন একটা প্রাকৃতিক পরিবেশে কোনো জলধারা বয়ে যেতে দেখেনি। এই পৃথিবীতে হয়তো সে প্রথমবার সেটি দেখতে পাবে। রিটিন জলধারার সেই ক্ষীণ শব্দ অনুসরণ করে হাঁটতে থাকে।
ধীরে ধীরে শব্দটি আরো স্পষ্ট হলো এবং রিটিন আবিষ্কার করল সামনে হঠাৎ করে মাটি নিচে নেমে গিয়েছে। নিচে পাথর এবং সেই পাথরের উপর দিয়ে একটা জলধারা অনেকটা নিজের মনে বয়ে যাচ্ছে। পানির স্রোত বেশ প্রবল এবং পাথরে ধাক্কা খেয়ে পানির একটি বিচিত্র শব্দ এলাকাটিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
পুরো এলাকাটি আশ্চর্য রকম নির্জন, পানির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। রিটিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। পাথরে ভর করে নিচে নেমে পানিটাকে তার হাত দিয়ে স্পর্শ করার প্রবল ইচ্ছা হলো! ঠিক কোন দিক দিয়ে নামা সবচেয়ে সহজ হবে বোঝার জন্যে সে ডানে বামে তাকাল এবং হঠাৎ করে সে চমকে উঠল। নিচে একটা বড় পাথরের পাশে একটি শিশু পড়ে আছে। শিশুটি নড়ছে না, বেঁচে আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
রিটিন তার ব্যাগ থেকে স্পেস ভিউয়ার বের করে চোখে লাগিয়ে শিশুটিকে দেখার চেষ্টা করল। শিশুটি বেঁচে আছে, তবে জ্ঞান নেই। হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক, পাঁজর এবং পায়ের হাড় ভেঙে গেছে, সাথে সাথে মাথায়ও আঘাত পেয়েছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এই মুহূর্তে উদ্ধার করে চিকিৎসা করা দরকার। রিটিনের পৃথিবীতে এই শিশুটিকে বাঁচানো সম্ভব, এই পাঁচশ বছর আগের এই পৃথিবীতে সম্ভব কি না রিটিন সেটি জানে না।
রিটিন সময় নষ্ট না করে পাথরের উপর পা দিয়ে দ্রুত নিচে নামতে থাকে। নিচে নেমে সে ছোট নদীটির পাশে ছোট-বড় পাথরে পা দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে শিশুটির কাছে পৌঁছাল। রিটিন তার জীবনে গুরুতর আহত কোনো মানুষকে কখনো দেখেনি, তাদেরকে কীভাবে দেখতে হয় সে জানে না। শিশুটি উপর থেকে গড়িয়ে নিচে এসে পড়েছে, শরীর ক্ষত-বিক্ষত। শরীরের হাড় ভেঙেছে কিন্তু সবচেয়ে গুরুতর হচ্ছে মাথার আঘাত। করোটির হাড় ভেঙে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রিটিন আবার তার স্পেস ভিউয়ার বের করে সেটার ভেতর দিয়ে শিশুটিকে দেখল, স্পেস ভিউয়ারে সে লালরঙের একটি অ্যালার্ম দেখতে পায়। শিশুটিকে দ্রুত চিকিৎসা দিতে হবে, তা না হলে তাকে বাঁচানো যাবে না। কীভাবে চিকিৎসা করতে হবে, সেটাও রিটিন স্পেস ভিউয়ারে দেখতে পেল। দুই সিসি ট্র্যাকিনল তার শরীরের রক্তে মিশিয়ে দিতে হবে। তার কাছে কিছু ট্র্যাকিনলের এম্পুল আছে, সেগুলো দেয়ার সময় তাকে অনেকবার সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এগুলো কোনোভাবেই অর্ধসহস্র বছর আগের কোনো মানুষকে চিকিৎসা করার জন্যে ব্যবহার করা যাবে না। এগুলো একান্তভাবেই রিটিনের নিজের জন্যে, যদি সে কখনো গুরুতর আহত হয় তখন যেন সে নিজের জন্যে ব্যবহার করে–অন্য কারো জন্যে নয়।
রিটিন আপাতত নিয়ম-কানুনের মাঝে গেল না। ব্যাগ থেকে ট্র্যাকিনলের একটা এম্পুল নিয়ে সেখান থেকে দুই সিসি স্বচ্ছ তরল সিরিঞ্জ দিয়ে বের করে শিশুটির গলার কাছে একটা আর্টারিতে ঢুকিয়ে দিল। তারপর সাবধানে শিশুটিকে পাঁজকোলা করে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। দুই পা অগ্রসর হতেই সে দেখল একটা খেলনা ডাইনোসর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। নিশ্চয়ই এই শিশুটির ডাইনোসর, সম্ভবত উপর থেকে সেটি নিচে পড়ে গেছে। শিশুটি তার প্রিয় খেলনাটিকে উদ্ধার করার জন্যে পাথর বেয়ে নামতে চেষ্টা করেছে–মাঝখানে পা পিছলে নিচে এসে পড়ছে।
রিটিন নিচু হয়ে এক হাতে খেলনাটি তুলে নিল। যে খেলনার জন্যে এত বড় বিপর্যয়, সেটি এভাবে এখানে ফেলে রেখে যাওয়া যাবে না।
শিশুটিকে পাঁজকোলা করে রিটিন সাবধানে উপরে উঠে এল, এখন তার বাবা-মাকে খুঁজে বের করতে হবে। এত ছোট শিশু নিশ্চয়ই একা একা এই নির্জন এলাকায় চলে আসেনি। তার বাবা-মা নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও আছে। স্পেস ভিউয়ারের সেটিং পাল্টে সে ইচ্ছে করলে আশপাশে জনবসতি খুঁজে বের করতে পারে, কিন্তু তাহলে শিশুটিকে প্রথমে নিচে নামিয়ে রাখতে হবে। রিটিন তাকে এখন মাটিতে শোয়াতে চাইল না, শিশুটিকে পাঁজকোলা করে ধরে সামনে এগোতে লাগল।
এমন সময় সে দূর থেকে একটা নারীকণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেল, কণ্ঠস্বরে একধরনের আতঙ্ক, প্রাণপণ চিৎকার করে সে কাউকে ডাকছে। রিটিন বুঝতে পারল নিশ্চয়ই এই শিশুটির মা, তার সন্তানকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
রিটিন গলার স্বর লক্ষ করে ছুটে যেতে থাকে এবং কয়েক মিনিটের মাঝেই সে মেয়েটির দেখা পেল। নীল জিনসের একটা ট্রাউজার আর হাতকাটা গোলাপি একটা গেঞ্জি পরে আছে। মাথায় একটা লালরঙের রুমাল বেঁধে রেখেছে। রিটিনকে পাজকোলা করে শিশুটিকে নিয়ে আসতে দেখে মেয়েটি একটা আর্তচিৎকার করে ছুটে এল। শিশুটিকে খপ করে ধরে চিৎকার করে ডাকল, “নীল! নীল–বাবা আমার।”
রিটিন মেয়েটির কথা বুঝতে পারছে, রওনা দেবার আগে তাকে এই প্রাচীন ভাষাটি শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। রিটিন সাবধানে যতটুকু সম্ভব সঠিক উচ্চারণ করে বলল, “একে হাসপাতালে নিতে হবে। এক্ষুনি।”
“হাসপাতাল?” মেয়েটা একধরনের অসহায় ব্যাকুল দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকাল, মনে হলো সে রিটিনের কথা বুঝতে পারছে না।