.
১২.
রিটিন চোখ খুলে তাকাল। তীব্র আলোতে তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সে আবার তার চোখ বন্ধ করে ফেলে মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। সে কোথায়। খুব ধীরে ধীরে তার মনে পড়তে থাকে সে সময় পরিভ্রমণের জন্যে একটা টাইম ক্যাপসুলে করে রওনা দিয়েছিল। সে কি তাহলে তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে?
রিটিন আবার চোখ খুলে তাকাল, তীব্র আলোতে চোখ অভ্যন্ত হয়ে যাবার পর সে টাইম ক্যাপসুলটি চিনতে পারে। সিলিন্ডারের মতো একটা খুপরির মাঝে সে শুয়ে আছে। শরীরের অনেকগুলো জায়গা স্ট্যাপ দিয়ে বাঁধা। রিটিন তার মাথাটা একটু নাড়ল, মাথার ভেতরে কোথায় জানি দপ দপ করে ওঠে। সে নিজের শরীরটা নাড়ানোর চেষ্টা করে, সাথে সাথে কোথায় জানি তীক্ষ্ণ ব্যথার একটি স্পন্দন অনুভব করে। রিটিন দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথার অনুভূতিটি কমে যাবার জন্যে অপেক্ষা করে তারপর আবার চারদিকে তাকাল।
রিটিন বুঝতে পারল তার টাইম ক্যাপসুলটি কোথাও আঘাত করেছে, সেই আঘাতের কারণে তার নিজের শরীরে এই যন্ত্রণার অনুভূতি। কিন্তু যন্ত্রণার অনুভূতি থাকবে না। তার ডান হাতের চামড়ার নিচে যে ছোট ডিস্কটি রয়েছে সেটি তার শরীরের সকল যন্ত্রণা কিংবা রোগশোকের চিকিৎসা করবে, তাকে সেটা নিয়ে দুর্ভাবনা করতে হবে না।
রিটিন কিছুক্ষণ নিঃশব্দে শুয়ে রইল। সত্যি সত্যি তার শরীরের ব্যথার অনুভূতি কমতে কমতে একসময় সারা শরীরে আরামের এক ধরনের কোমল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রিটিন তখন তার কুঠুরির ভেতর উঠে বসে হাত-পা এবং শরীরের স্ট্যাপগুলো খুলে নেয়। তারপর সে তার নির্ধারিত কাজগুলো করতে শুরু করে। টাইম ক্যাপসুলের ভেতর থেকে একটি অণু বা পরমাণুও বের হতে পারবে না, ভেতর থেকে বাইরে কিছু দেখারও কোনো উপায় নেই। এখন সে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে, এখন বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। টাইম ক্যাপসুলের দেয়ালে ভেতর থেকে কাঁপন সৃষ্টি করে সেই কম্পনের প্রতিধ্বনি শুনে বাইরে কী আছে সেটা অনুমান করার একটা ছোট যন্ত্র দেয়া হয়েছে, রিটিন এখন সেটা ব্যবহার করতে শুরু করল।
সে দেখতে পেল তার ডানে, বামে, সামনে, পেছনে এবং নিচে বহুদূর পর্যন্ত কোনো এক ধরনের কঠিন পদার্থ, ঘনত্ব দেখে মনে হয় মাটি। উপরেও সেই একই পদার্থ তবে কয়েক মিটারের বেশি নয়। অর্থাৎ সে সম্ভবত, কোনো একটি জায়গায় মাটির নিচে এসে উপস্থিত হয়েছে। এটা নিয়ে অনুমান করার চেষ্টা না করে তার এর ভেতর থেকে বের হওয়া উচিত। সে সাবধানে টাইম ক্যাপসুলের ঢাকনাটি খুলতে শুরু করল।
উপরে অনেকখানি মাটি, টাইম ক্যাপসুলের হাইড্রোলিক সিস্টেম ঠেলে ঢাকনাটা খুলতে থাকে। বাইরে কী আছে সে জানে না, প্রথমেই তার বের হওয়া ঠিক হবে না। রিটিন মাটি ফুটো করে উপরে একটি প্রোব পাঠাল এবং সেটার ভেতর দিয়ে প্রথমবার চারপাশের পৃথিবীটা দেখতে পেল। জায়গাটি নির্জন, আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। ঝোঁপঝাড় আছে এবং কয়েকটা বড় বড় গাছ আছে। রিটিন একটা প্রজাপতিকে উড়ে যেতে দেখলো। বাতাসে গাছের পাতা নড়তে দেখল এবং তার একটি শিরশির শব্দ শুনতে পেল।
জায়গাটি নিরাপদ, রিটিন ইচ্ছে করলে বের হতে পারে। তাকে পাঁচশ বছর আগের মানুষের পোশাক দেয়া হয়েছে, এই সময়ের টাকার নোট, কিছু ছোট খাটো যন্ত্রপাতিও আছে। রিটিন পোশাক পাল্টে একটা ছোট ব্যাগে কিছু দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে, ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বাইরে বের হওয়ার কাজ শুরু করে দিল।
খানিকটা মাটি সরিয়ে একটা গর্তের মতো করা হয়েছে, রিটিন সেই গর্ত দিয়ে বের হয়ে আসে। শরীরে মাটি লেগে গিয়েছিল। সে হাত দিয়ে পরিষ্কার করে গর্তের মাঝে পা ঝুলিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল। একবার সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল, বাতাসে বিচিত্র এক ধরনের সজীবতা, সাথে একধরনের বুনো ফুলের গন্ধ। রিটিন আকাশের দিকে তাকাল, নীল আকাশে সাদা মেঘ, সময়টা মনে হয় শরৎকাল। সূর্য ঢলে পড়েছে মনে হয়, একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসবে।
রিটিন উঠে দাঁড়াল, সে কোথায় আছে জানতে হবে। মানুষের জনবসতি খুঁজে বের করতে হবে। পৃথিবীতে এখন কত সাল সেটি জানতে হবে সবার আগে। তার কাছে এগুলো বের করার যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলোকে এই সময়ের উপযোগী যন্ত্রপাতির মতো একটা রূপও দেয়া হয়েছে, হঠাৎ করে কেউ দেখলে সন্দেহ করবে না। কিন্তু রিটিন এখনই সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হতে চাইছে না–তার কোনো তাড়াহুড়ো নেই, বলা যেতে পারে, তার হাতে অফুরন্ত সময়।
এখানে তার কালো চুলের হাসিখুশি একটা মেয়ের সাথে দেখা হওয়ার কথা। মেয়েটাকে সে কেমন করে খুঁজে বের করবে জানে না। সেটি নিয়ে রিটিন অবশ্যি চিন্তিত নয়, প্রকৃতি নিশ্চয়ই তাদের দুজনের দেখা করিয়ে দেবে।
রিটিন তার ছোট ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকে। জায়গাটা সুন্দর, সবুজ বড় বড় ঘাস, ঝোঁপঝাড় এবং মাঝে মাঝে বড় গাছ। এগুলো কী গাছ কে জানে, তার নিজের পৃথিবীতে যতদিন তার ট্র্যাকিওশান ছিল সেটা ব্যবহার করে মুহূর্তের মাঝে সব তথ্য বের ১০৪
করে ফেলতে পারত। ট্র্যাকিওশান ফেলে দেয়ার পর সে আর কোনো তথ্য যখন খুশি জানতে পারত না। পাঁচশ বছর আগের পৃথিবীটা তার কাছে এখন ট্র্যাকিওশানহীন পৃথিবীর মতো। একটা গাছ দেখলেও সেটি কী গাছ সে নিজে নিজে কখনো জানতে পারবে না।